পূর্ণতা নাকি শূন্যতা পর্ব-১৪

0
290

#পূর্ণতা_নাকি_শূন্যতা
#রেজওয়ানা_রমা
#পর্ব_১৪ ( হলুদ সন্ধা)

আজ গায়ে হলুদ। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন এতো বেশি যে জায়গা দেওয়া কষ্টকর। নিচের ঘর গুলো তে সব মেহমানে ভরা। নোভা, ইতি, লামু, মিতু এরা চার জনকেই এখন আমার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। সারাক্ষণ হইচই, গান, বাজনা, চলছেই। দিনে ফুলের বাগান মনে হয় বাড়ি টা আর রাতে আলোয় ঝলমল করে। সিদ্ধাত ভাইয়ার বাড়ি থেকে গায়ে হলুদের তত্ত্ব পাঠিয়েছে। আর এবাড়ি থেকেই পাঠানো হয়েছে। হলুদ সন্ধ্যায় কিভাবে সাজবো কি করবো এসব ভাবছি। ধুরু হুদাই ভাবি। এসব ভাবার জন্য তো লোক আছেই। এখন নোভারা আমার সাথে থাকায় আমার বেশ আনন্দ হচ্ছে। গল্প করার মানুষ তো পেলাম। এতো আনন্দ, এতো উচ্ছাস সব কিছু ঠিক থাকবে তো? মনের ভিতর থেকে ভয় কাটছে না কিছুইতেই। ভেবে নিয়েছি আজ থেকে আর সিদ্ধাত ভাইয়ার সাথে কথা বলবো না যতক্ষণ না বিয়ে হয়। এক বারেই বাসর ঘরে আমাদের কথা হবে। আর মাত্র একটা দিন। তারপর নতুন জীবন। সব যেন ভালোই ভালোই হয়।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে এলাম। এরই মধ্যে হঠাৎ কোথা থেকে এসে লামু জড়িয়ে ধরে বলে,

লামু: ঈশা আপি
আমি: হুম বলো লামু সোনা
লামু: কাল তোমার বিয়ে। আমার কাছে এখনো স্বপ্নের মত লাগছে।
আমি: তাই
লামু: সত্যি তোমার বিয়ে। আজকে গায়ে হলুদ
আমি: সময় কত দ্রুত যায় লামু। দেখ না দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ও চলে এলো
লামু: হ্যাঁ আর দেখতে দেখতে আমি খালামনি ও হয়ে যাবো হিহিহি
আমি: ওরে এতো সখ

এর মধ্যে মিতু ও চলে আসে

মিতু: লামু তুই একা একা আদর খাচ্ছিস?
আমি : মিতু আয়।

মিতুও এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। বোনের ভালোবাসা সত্যি অন্য রকম। আজকে একটু খারাপ লাগছে এদের সবাই কে ছেড়ে থাকতে হবে। একটা খারাপ লাগা কাজ করছে নিজের ভিতর। আবার অন্য দিকে ভালো লাগছে সিদ্ধাত ভাইয়া না না আর ভাইয়া নয় সিদ্ধাত, সিদ্ধাতকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু হবে। ভালো খারাপ দুটো অনুভূতি এক সাথে বিরাজ করছে। গায়ে হলুদের সকল আয়োজন শেষ।

সন্ধ্যায় আমি গায়ে হলুদের জন্য রেডি হচ্ছি। কাল থেকে পার্লের লোক আমাদের বাড়িতেই আছে। তাদের সাথে কথাও বলে নিয়েছে এক বারে রিসিপশনের পর তারা চলে যাবে। সুতরাং আমাকে গায়ে হলুদের জন্য সাজাচ্ছে। সিদ্ধাতদের বাড়িতে কি এতক্ষণে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে। নাকি সিদ্ধাত ও রেডি হচ্ছে কি জানি। আমাকে হলুদের সেই শাড়ি পড়ানো হয়েছে যেটা সিদ্ধাত চুজ করেছিলো। বাঙালি স্টাইলে শাড়ি পড়িয়েছে, চুল বাধা, খোপা জুড়ে ফুল দেওয়া, আজকের সব জুয়েলারি ফুলের। গলার মালা, হাতের চুড়ি, মাথার টিকলি, কানের দুল সব কিছু ফুলের। নিজেকে পুষ্পকন্যা মনে হচ্ছে। মুখে হালকা মেকআপ। মাথায় শাড়ির আচল দিয়ে ঘোমটা টেনে দেওয়া। কেমন জানি বউ বউ ফিল আসছে। দু পায়ে গাঢ় আলতা দেওয়া। হাতে মেহেদী দেওয়ার কারনে হাতে আর আলতা দেয় নি। আমাকে রুম থেকে নিচে নিয়ে যাচ্ছে নোভা ইতি সহ আমার অনেক ফ্রেন্ডরাও আছে। আরও আছে আমার কাজিনরা, রিলেটিভরা অনেকেই। আজ সব কিছুর মাঝে আমি স্পেশাল। আমার জন্য এতো আয়োজন। খুব অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। নিচে নামতেই আম্মু বলে,

আম্মু: আমার ঈশা কে তো খুব সুন্দর লাগছে
আমি: এই ভিলেন আম্মু অবশেষে তোমার চোখ আমার দিকে পড়লো?
ফুপি: পড়বে না মানে, যেন আসমান থেকে পরী নেমে এসেছে। নজর পড়বে না আবার
নোভা: আমাদের হলুদ পরী।
ইতি: একদম ই তাই। আজকে সিদ্ধাত ভাইয়া থাকলে নিশ্চিত হার্ট অ‍্যাটাক করতো
আমি: ধ্যাত।
আম্মু: এই চুপ করো সবাই আমার মেয়ে টা লজ্জা পাচ্ছে।

আমি বসে আছি আর সবাই আমাকে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে। আর দোয়া করে যাচ্ছে। যেন আমারা সুখে সংসার করতে পারি। আব্বুর চোখে পানি ছলছল করছে। আব্বু সেই চোখের পানি লুকিয়ে রেখেছে সবার চোখের আড়ালে। তবে আমার চোখের আড়াল হয় নি। আব্বুর কাছে গিয়ে বললাম,

আমি: আব্বু আমি চলে যাচ্ছি তাই তোমার মন খারাপ?
আব্বু: মা রে তোকে ছাড়া যে আমাদের বাড়ি টা অচল হয়ে পড়বে। কি করে তোকে ছেড়ে থাকবো
আমি: আব্বু

আব্বু কে জড়িয়ে ধরে কেদে দিলাম। আব্বুও আর চোখের পানি আটকাতে পারলো না। আমাদের কান্না দেখে আম্মুও আচলে চোখ মুছে নিলো। সবার মন খারাপ হয়ে গেছে মূহুর্তেই। তখনি ইতি এসে বলে,

ইতি: আজকে এতো খুশির মাঝে কান্না কাটি কেন হচ্ছে? ঈশা কান্না বন্ধ কর।

ইতির কথায় চোখ মুছে নিলাম। ইতি হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো ছবি তোলার জন্য। নোভা ইতি দুই জনকেই আজকে ভীষন সুন্দর লাগছে। এই বিয়ে বাড়ি তে যদি ওদের কাউ কে মনে ধরে তাহলে ভালোই হবে। আমার একটা থুক্কু দুটো দুলাভাই হবে হিহি।

ইতি: কিরে কি ভাবছিস?
আমি: ভাবছি আমার তো বিয়ে হয়েই যাচ্ছে বাট তোদের কি হবে
নোভা: আমাদের রাজকুমার এখনো আসে নাই গো। পঙক্ষিরাজ ঘোড়া পাচ্ছে না তো তাই আসতে পারছে না

নোভার কথায় ইতি আর আমি ফিক করে হেসে দিলাম। আর ওমনেই ফটোগ্রাফার মূহুর্ত টা ক্যামেরা বন্দি করে নিলো অনেক ছবি তুলেছে। সবাই সাথে গায়ে হলুদের ছবি আছে। হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত সাড়ে ১১ টা বাজে। সবাই খুব ক্লান্ত আর চিন্তিত ও। আমারা গল্প করতে করতে রুমে যাচ্ছি। রুমের দরজায় এসে দেখি রাক্ষস টা আমার ঘরে খাটের ওপর পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে বসে ফোন টিপছ।

নোভা: একি সিদ্ধাত ভাইয়া এখানে?
মিতু: কালই তো বিয়ে তর সয়ছে না?
লামু: আজকে না দেখে থাকতে পারছেন না?
ইতি: গত কালই তো দেখলেন। আজকে না দেখলে হতো না?

সবাই একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। রাক্ষিস টা নোভার কথায় মাথা তুলে তাকায়। আর সেই থেকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বাকিরা যে কে কি বলছে তা শুনেছে বলে মনে হয় না।

ইতি: হুদাই চিল্লাইতেছি উনি তো উনার বউ কে দেখতে ব্যস্ত
লামু: আজকে কেউ নেই বলে এভাবে কেউ আমাদেরকে দেখে না
মিতু: একদমই তাই
আমি: চুপ করবি তোরা?

এক পা এগিয়ে রুমের ভিতরে প্রবেশ করে কোমরে হাত দিয়ে বললাম,

আমি: এই রাক্ষসের বাচ্চা তুমি এখানে এতো রাতে কি করো?

আমার কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে,

সিদ্ধাত: তার আগে বলে ওরা এখানে কি করে? ( নোভাদের দেখিয়ে)
নোভা: আমরা এখানে কি করি মানে? আপনি এখানে কেন ভাইয়া?
সিদ্ধাত: আমি তো আমার বউ কে দেখতে এসেছি তোমার কেন এসেছো?
ইতি: আপনার বউ কে পাহারা দিতে
সিদ্ধাত : গুড। ভেরী গুড। এখন যাও তোমরা আমার ওর সাথে কথা আছে
মিতু: আমরা কোথায় যাবো? সবাই ঘুমিয়ে পড়ছে এতোক্ষনে।
সিদ্ধাত: ওকে তাহলে আপাতত বেলকানি তে যাও

নোভারা আর কেউ কোনো কথা না বলে বেলকানি তে চলে যায়। আর সাথে সাথে সিদ্ধাত ভাইয়া বেলকানির দরজা লাগিয়ে দেয়। অতঃপর আমার দিকে এগোতে থাকে। আমিও তাল মিলিয়ে পিছিয়ে যাচ্ছি।

এক পর্যায়ে দেয়ালে পিঠ লাগায় থেমে যাই। সিদ্ধাত ভাইয়া আমার খুব কাছে চলে আসে। চোখে অন্য রকম নেশা, তাকিয়ে আছে আমার দিকে সেই নেশাক্ত চোখে। আবেগ জড়িত কন্ঠে বলে,

সিদ্ধাত: আমার পাখি টা কে এতো সুন্দর লাগছে। আমি তো আবারও প্রেমে পড়ে গেলাম।
আমি: ( মাথা নিচে করে আছি)
সিদ্ধাত: তোমার এই সৌন্দর্য দেখার অধিকার শুধু আমার। তোমার পেট দেখে যাচ্ছে কেন? এভাবেই নিচে ঘুরেছো সবার সামনে? ( গম্ভীর স্বরে)
আমি: না মানে.. ( তারাতারি শাড়ি ঠিক করে নিলাম।)
সিদ্ধাত: না মানে কি? সবাই কে পেট দেখিয়ে এখন আমার সামনে ঢাকছো?
আমি: এখন ত শাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে তাই।
সিদ্ধাত: তাহলে আবার নষ্ট করো আমি দেখি
আমি: খুব সয়তান হয়েছো তুমি সিদ্ধাত ভা….
সিদ্ধাত: ভাইয়া নই আমি। আমি শুধুমাত্র সিদ্ধাত
আমি: হুম
সিদ্ধাত: বলো সিদ্ধাত
আমি: সিদ্ধাত ( মাথা নিচু করে)

এবার সিদ্ধাত ভাইয়া আমাকে তার বুকে জড়িয়ে নিলো। আমিও নিজেকে স্বপে দিলাম সিদ্ধাত ভাইয়ার মাঝে।

কিছুক্ষন পর সিদ্ধাত ভাইয়া চলে যায়। এরপর আমরা ফ্রেস হয়ে নেই। সারা রাত কেউ ঘুমাই নি। আমারা আড্ডা দিয়েছি সারা রাত। এই সুযোগ আর আসবে না। হয়ত আর কখনও এভাবে এক সাথে হতেও পারবো না। এটাই শেষ তাই মিস করলাম না।

☆☆ ঈশার সাথে দেখা করে মন টা ভালো লাগছে। খুব মিষ্টি লাগছিল আজকে আমার পরী টা কে। যেন সকল সৌন্দর্য ওর মাঝেই বিরাজ করছে। রাত পেরোলেই ঈশা আমার।এখন রাত দুটো বাজে। কাল দুপুর ১ টার পরেই বিয়ের কাজ সম্পন্ন হবে। আর মাত্র ১১ ঘন্টা। আর ১১ ঘন্টা পর আমার ১১ বছরের ভালোবাসা স্বার্থকতা পাবে।

সকালে বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। সকালের নাস্তা করেই সবাই গোসল করে নেই। তার পর সবাই রেডি হতে থাকে। আজকে ভালোবাসা পূর্ণতা পাওয়া দিন। আমার ১১ বছরের ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে চলেছে। সকাল ৯ টা বাজে শেরওয়ানি পরে বসে আছি একটু পরেই বের হবো আমার প্রিয়তমা কে নিয়ে আসতে। আর মাত্র তিন চার ঘন্টা পর ঈশা আমার। ও নিজেও জানে না আমি ওকে কতটা ভালোবাসি। হঠাৎই রুমে আগমন হয় ভূমির। ভূমি কে দেখে আমার ভুত দেখার মত অবস্থা হয়। ভূমি এখানে কি করছে?

– ভূমি তুমি এখানে?
– ইনভাইড ছাড়াই চলে এলাম রাগ করেছো?
– আরে না। কিন্তু তুমি এখানে? কিছু না জানিয়ে
– তোমাকে বরের সাজে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে সিদ্ধাত। টোপর টা পরো না একটু দেখি
– একটু পরেই দেখতে পাবা । কিন্তু তুমি হঠাৎ এখানে এলে কেন?

ভূমি কিছু বলার আগেই সিফাত আমাকে ডাকতে ডাকয়ে রুমে প্রবেশ করে,

সিফাত: কি রে হলো তোর? বউ আনতে যা….( ভূমি কে দেখে থমকে যায়)
ভূমি: আরে সিফাত কেমন আছো?
সিফাত : ভালো আছি। কিন্তু তুমি এখানে?
ভূমি: প্রিয়জন কে তার প্রিয়জনের হাতে তুলে দিতে এসেছি
সিফাত : কিন্তু তোমাকে কে বলল আজকে ওর বিয়ে
ভূমি : ভালোবাসার মানুষের খোঁজ না রাখলে কিসের ভালোবাসা
সিদ্ধাত: এই ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই আমার কাছে
ভূমি : আমি কি মূল্য চেয়েছি?
সিফাত : সিদ্ধাত দেরি হয়ে যাচ্ছে। চল
ভূমি : আমাকে কি রেখে যাবে?
সিফাত : তুমিও তো আমাদের ফ্রেন্ড অবশ্যই যাবে আমাদের সাথে। এসো

একরাশ বিরক্তি নিয়ে ভূমি কে নিয়ে যাচ্ছি। আমার গাড়িতে আমার পাশেই বসেছে ভূমি। আমার হাত ধরে আছে। কিছু বলতেও পারছি না। আজকের দিন টা নষ্ট করতে পারবো না ওর জন্য। আমার মন ছুটে চলেছে ঈশা কে দেখার আশায়। কখন পৌঁছাবো কখন দেখবো আমার প্রিয়তমা কে? কেমন লাগছে ঈশা কে দেখতে? নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর। ১১ বছরের ভালোবাসা পূর্ণতা পেতে আর কয়েক মূহুর্ত বাকি। সর্বোচ্চ আর দুই থেকে তিন ঘন্টা। তার পর ঈশা আমার। শুধু আমার। চিরদিনের জন্য আমার। এখন আমার অপেক্ষার শেষ প্রহর চলছে ।
.
.
.
.
.
.
#চলবে_কি?