পূর্ণিমা সন্ধ্যা পর্ব-০১

0
69

#পূর্ণিমা_সন্ধ্যা
লেখক: নবনীতা শেখ
[১]

“নিজের মেয়ের বয়সী একজনকে বিয়ে করে আনল আমার স্বামী। আজ আমার তেইশ বছরের সাজানো সংসারে সতিনের প্রবেশ ঘটল। আমি অবাক হতেও ভুলে গেলাম। একবার তাকালাম আমজাদের দিকে। সে পাশে একজন সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চিন্তমনে। বড়ো প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছিল তাকে—এই তেইশ বছর পর আমার মধ্যে কী এমন কমতি দেখলে যে, অন্যনারীতে মন গেল? আমি প্রশ্ন করতে পারলাম না।

আজ চারপাশ কেমন মলিন লাগছে। বাড়ির কেউ তাকে কিচ্ছু বলেনি। উলটো নতুন বউ বরণে ব্যস্ত তারা। আমাকে সব মেনে নিতে বলছে। পুরুষমানুষ চারটা বিয়ে করতে পারে। আমাকে তো থাকতে দিচ্ছে। আমাকে তো তালাক দিচ্ছে না।

আমি মানতে পারছি না এসব। তালাকের প্রসঙ্গ ওদিক থেকে উঠবেই বা কেন? আমি তো নিজের সবটা দিয়েছিলাম, নিজের দিক থেকে সঠিক ছিলাম। দোষ সে করেছে, আমি কেন ভোগ করব এই দশা?

আমার চোখের জল শুকিয়ে গেছে। পাগলামো করতে আর ইচ্ছে জাগছে না। কার জন্য পাগলামো করব? সেই পুরুষের জন্য যে এখন অন্য কারো?
ছি! এই পুরুষের সাথে আমি তেইশ বছর সংসার করেছি? একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে আছে আমাদের। এটুকুও মাথায় রাখেনি আমজাদ?”

এতসব ভাবনা-চিন্তা করতে করতে আয়শা নতমুখী হয়ে বসে থাকল। মেয়েটা ভার্সিটিতে গেছে। বাড়ি এলে কী বলবে তাকে, মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বার বার। সকাল গড়িয়ে গেছে। গতরাতে বিয়ে করেছিল, আজ সকালে বউ এনেছে।

এভাবেই ঠাঁই বসে রইল আয়শা। চিন্তা-শক্তি লোপ পাচ্ছে যে। বাবা-মা ছোটবেলায় মারা গেছে, বড়ো হয়েছে মামার বাড়ি। সংসার জীবনের এই তেইশ বছর পর চাইলেই আর সেই মামাবাড়িতে যাওয়ার উপায় নেই আয়শার। গিয়ে কী বলবে? আশ্রয় চাইবে? সম্ভব না তো। অস্থিরতা অনুভব করছে আয়শা। ফোন উঠিয়ে কল লাগাল তার একমাত্র সহায়কে।

_____
ক্যাম্পাসের মাঠে বসে গল্প করছে অরণী ও তাবাসসুম। তাবাসসুমের সাথে অরণীর পরিচয় বছর চারেক হয়েছে। একই ডিপার্টমেন্টের তারা। ভার্সিটি লাইফ কিছু বন্ধু ছাড়া ঠিক তেমন, যেমনটা দুধ ছাড়া দুধচা। অরণী একজন ভীষণ ভালো শ্রোতা। কাজেই যেখানেই যায়, কিছু পার্মানেন্ট বন্ধু জুটে যায় তার। ক্যাম্পাসেও কিছু আছে। তবে সবচেয়ে ভালো সখী যে জন, সে হচ্ছে তাবাসসুম।

আজ তাবাসসুম তাকে বলছে,
-“দোস্ত, মাস্টার্সের একটা ভাই আছে বুঝছোস? এত জোস! দেখতে পুরাই সালমান শাহ! চুলগুলো এত সুন্দর করে সেট করা থাকে সবসময়। আমি তো পুরাই টাশকি খেয়ে যাই। যতবার সে তাকায়, ততবার চোখ দুটো হাতে নিয়ে তার দিকে তাকায় থাকতে মন চায় রে দোস্তোও।”

অরণী হেসে ফেলে বলল,
-“আচ্ছা? আর কী করতে মন চায়?”

তাবাসসুম বলল,
-“আর চুমু খেতে মন চায়। ঠোঁট দুটো চৌকা করে উম্মম্মায়ায়ায়ায়াহ!”

অরণী মুখে হাত রেখে হেসে যাচ্ছে। তাবাসসুম ফের বলল,
-“বন্ধু, সিরিয়াসলি। সবাই তাকে এ.জে. বলে ডাকে। আমার তাকে এইযে বলে ডাকতে ইচ্ছে করে। দাঁড়া, প্রোফাইলটা ঘুরে দেখি।”

তাবাসসুম কথাটা বলে পড়ল বিপাকে। এখন কোত্থেকে আবার আইডি পাবে? নামটা তো জানে না। প্রায় কুড়ি মিনিট ধরে এর-ওর কাছে চেয়ে চেয়ে অবশেষে আইডির লিংক পেল। উৎফুল্ল মনে সে অরণীকে বলল,
-“আসো, তোমাকে আমার ক্রাশ দেখাই। এই যে!”

অরণী মুচকি হেসে এদিকে তাকাল। তাবাসসুম লিংকে ঢুকতেই বলল,
-“এই দ্যাখ দ্যাখ!”

অরণীর সর্বপ্রথম নজর গেল আইডির মালিকের নামটাতে। সে ঠোঁট চেপে ফেলল, তার আগে তাবাসসুমকে বলল,
-“নাম দেখ, তাবু।”

তাবাসসুম নাম দেখল। সুন্দর করে লেখা, “অনন্ত জলীলুদ্দিন।” এটা কি না দেখলেই হতো না? তাবাসসুম দুঃখিত মনে বলল,
-“আমি কিছু দেখতে পাইনি। আচ্ছা হ্যাঁয় ম্যায় আন্ধা হুঁ।”

অরণী হেসে ঢলে পড়ল তাবাসসুমের গায়ে। মেয়েটা এত মিষ্টি! এর সাথে থাকলে অরণীর কোনো দুঃখ লাগে না। অরণী হয়ে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে হাসিখুশি মেয়ে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ফোনে কল এলো। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে নামটা, “মামনি”। অরণী জলদি রিসিভ করে মিষ্টি করে বলল,
-“হ্যাঁ, মামনি। বলো।”

ওপাশ থেকে আয়শার থমকানো আওয়াজ এলো,
-“কই তুই?”

নিষ্প্রাণ আওয়াজটা কাঁপছে। শুনতেই ভড়কে উঠল অরণী। চিন্তিত হয়ে বলল,
-“ক্যাম্পাসে। মামণি, তুমি ঠিক আছো?”

আয়শা এত কথা বলার পরিস্থিতিতে নেই এখন। দেহের বল ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে সে। যে-কোনো সময় জ্ঞান হারাতে পারে। কথা বলাটা এখন তার কাছে সবচেয়ে কঠিন কাজ। মুখে প্রচণ্ড রকম জড়তা কাজ করছে। বেশ কষ্টেই সে বলতে পারল,
-“মা, বাড়ি আসতে পারবি?”

অরণী সময় নিল না, তৎক্ষনাৎ প্রত্যুত্তর করল,
-“আসছি।”

কল কেটে তাবাসসুমকে বলল,
-“বাড়ি যেতে হবে। থাক।”
-“কী হয়েছে?”
-“জানি না। গেলেই বুঝতে পারব।”

অরণীর বাড়ি ফিরতে সময় লাগল আধ ঘন্টা। বাড়ির প্রবেশমুখেই কাকিদের কাছে জানতে পারল, বাবা বিয়ে করেছে আজ। হতবিহ্বল হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। পরমুহূর্তে দৌড়ে প্রবেশ করল ভেতরে। সোজা আমজাদের কাছে গেল সে। মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল আধ ঘন্টা আগে ফোনকলে মায়ের অমন নির্জীবতা।

এরপর অরণী যখন নিজের বাবার পাশে থাকা অল্পবয়সী মেয়েটাকে নিজের মায়ের জায়গায় দেখল, পায়ের নিচ থেকে যেন তার মাটিই সরে গেল। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। সম্ভব কী করে? তার বাবা একটু রাগী, একটু কম কথা বলে, মিশুক না, চুপচাপ ও গম্ভীর স্বভাবের! সব ঠিক আছে। কিন্তু লুকিয়ে-চুরিয়ে আরেকটা বিয়ে করার মতো নিকৃষ্ট লোক হিসেবে নিজের বাবাকে মানতে অরণীর কষ্ট হচ্ছে।

আজ সকালে তার বাবা যেই মেয়েটিকে বিয়ে করে এনেছে, তার নাম রোকসানা। রোকসানার বয়স বাইশ। তার সমবয়সী। অরণী অবাক চোখে মেয়েটিকে দেখল। আরেকটা বিয়ে করল? কচি মেয়ে বিয়ে করল? তার বাবা এমন ঘৃণ্য কাজ কী করে করতে পারল?

বসার ঘর থেকে তার বেডরুম দেখা যাচ্ছে। দরজা খোলা। আয়শা ওখানে বসে আছে নিষ্প্রাণ অবস্থায়। অরণী বড়ো শক্ত হৃদয়ের মেয়ে। সে মায়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে সোজা বাবার চোখে চোখ রাখল। গম্ভীরমুখে প্রশ্ন করল,
-“কারণ?”

আমজাদ কিছু বলতে পারল না। কোন মুখে কী বলবে, সেটাও বুঝল না। পুরো দুনিয়ার সামনে শক্তসমর্থ লোকটা মেয়ের কাছে খানিকটা দূর্বলই বটে। কিন্তু একটা ছেলের অভাব যে এই বয়সে এসেও খুব টের পাচ্ছে, সে কথা তো এভাবে বলা যায় না। অনেক চিন্তা করেই গ্রামে বেড়ে ওঠা রোকসানাকে বিয়ে করেছে সে।

আমজাদকে চুপ থাকতে দেখে অরণী রাগে দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়ল। উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করল,
-“অনুমতি নিয়েছিলে নিজের প্রথম স্ত্রীর? নিয়েছিলে?”

অনুমতি নেওয়া তো দূর, জানায়নি অবধি আমজাদ। পাশ থেকে দাদি ধমকে উঠল অরণীকে,
-“বাপের সাথে এমনে বেয়াদবের মতো কথা কইতে শিখছিস কার থেকে, অসভ্য? চুপ কইরা থাক।”

অরণী আরও চেতে গেল, রক্তলাল চোখে দাদিকে বলল,
-“বেয়াদব-অসভ্য তো তুমি আর তোমার ছেলে। ছেলেকে শিক্ষা দাওনি ঠিকঠাক? আমার মায়ের সাথে অন্যায় করেছে সে। আর আমাকে চুপ থাকতে বলছ?”

দাদি ভড়কে গেল অরণীর কথা বলার ধরন শুনে। এভাবে মেয়েটা কোনোদিন কারো সাথে কথা বলেনি তো। কাকিরাও কিছুটা ভয় পাচ্ছে এবার। অরণী সকলকে দেখে নিয়ে আমজাদকে ফের বলল,
-“কতখানি ঘৃণিত কাজ করেছ তুমি জানো? তুমি পাপ করেছ, সেটা জানো? পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্যতম কাজ করেছ তুমি। তুমি তোমার স্ত্রীকে সর্বোচ্চ কষ্ট দিয়েছ। তুমি ক্ষমার অযোগ্য। তুমি নিকৃষ্ট।”

অরণী কথাগুলো বলে বড়ো বড়ো পায়ে রুমে প্রবেশ করল। খাটে পা গুটিয়ে বসে আছে আয়শা। পরনে তার কালো পাড়ের নীল শাড়ি। এলোমেলো হয়ে আছে। অরণী সামনে দাঁড়িয়ে আয়শাকে জড়িয়ে ধরল। মায়ের মাথাটা নিজের বুকে আগলে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়াল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-“মামনি, আমি আছি। আর কাউকে লাগবে না আমাদের। লাগবে কি? বলো।”

আয়শা কিছু বলতে পারল না। তার কান্না পেয়ে যাচ্ছে। অরণী আবারও বলল,
-“তোমার দিক থেকে তুমি ঠিক ছিলে। অন্যায় সে করেছে। তুমি কেন কষ্ট পাবে? মামনি?”

মেয়ের কাছে এমন আহ্লাদ পেয়ে আয়শা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। অরণী আরও শক্ত করে আয়শাকে জড়িয়ে ধরল। আয়শা এতক্ষণে একটু শান্তি পেল। মরুভূমির মতো উত্তপ্ত হৃদয়ে তার একপশলা বৃষ্টি নামল। এই তো! এই তো আশ্রয় তার! এইটুকু দিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে ফেলবে সে নিশ্চিত।

অনেকটা সময় অরণী মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গেল। আয়শার কান্না থেমে গেছে। ফোঁপাচ্ছে একটু পর পর। অরণী ডাকল তাকে,
-“মামনি?”
-“হুঁ?”
-“কিছু প্রশ্ন করতে চাই। উত্তর দেওয়ার পরিস্থিতিতে আছো কি?”
-“আছি।”

অরণী আয়শাকে ছেড়ে দাঁড়াল। এরপর হাঁটুমুড়ে ফ্লোরে বসল। আয়শার দুইহাত নিজের দুইহাতে ধরে জিজ্ঞেস করল,
-“মামনি, তুমি কি এখনও তার সংসার করতে চাও?”

থমকাল আয়শা। জল ছলছল চোখে তাকাল মেয়ের দিকে। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বিরবির করল,
-“চাই না।”
-“তুমি কি তাকে কোনো শাস্তি দিতে চাও? তুমি চাইলে আইনি সহায়তা নিতে পারি আমরা।”
-“চাই না।”
-“মাফ করে দিতে চাও?”
-“না।”
-“কী চাও?”
-“এসব থেকে মুক্তি চাই। যতদিন বেঁচে আছি, এই লোকের মুখ দেখতে চাই না।”
-“তুমি নিশ্চিত?”
-“হ্যাঁ।”

অরণী আয়শায় দুইহাত নিজের গালে ঠেকিয়ে বলল,
-“তাই হবে। তুমি আস্থা রাখো আমার ওপর।”

আয়শা মাথা নাড়ল। অরণী উঠে লাগেজ বের করে আয়শাকে বলল,
-“মামনি, প্রয়োজনীয় সব গুছিয়ে নাও। আর হ্যাঁ, শুধু আমি তোমাকে যা কিনে দিয়েছি এবং বাপের বাড়ি থেকে যা নিয়ে এসেছিলে, তাই গোছাও। এই লোকের একটা সুতাও নেবে না।”

আয়শা পুনরায় মাথা নেড়ে লাগেজ গোছাতে লাগল। অরণীও নিজের সবটা গুছিয়ে নিল। সব শেষে কুড়ি মিনিটের মধ্যে তারা রুম থেকে বেরোল। অরণী একহাতে নিজের মায়ের হাত ধরে রেখেছে।

মাকে নিয়ে বাবার মুখোমুখি দাঁড়াল সে। শক্ত গলায় বলল,
-“খুব শীঘ্রই তালাকের ব্যবস্থা করা হবে। আপনার ও আপনার সকল সম্পত্তির ওপর থেকে আমি ও আমার মা সব ধরনের দাবি তুলে নিলাম। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে হয় না। আপনার বিয়েও বৈধ হয়নি। তালাকের পর পুনরায় বিয়ে করে নেবেন। শুভ কামনা। আল্লাহ হাফেজ।”

সম্পূর্ণ অনিশ্চিত জীবনব্যবস্থা নিয়ে মায়ের সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো অরণী। এখন কোথায় যাবে, কী করবে, কীভাবে থাকবে…

চলবে…