প্রণয়ডোর পর্ব-০১

0
2025

#প্রণয়ডোর
#লেখিকা_রামিশা_তাসলিম
#পর্ব-এক

— মেয়েটার শরীরে এতো মারের দাগ আসলো কোত্থেকে ? আপনারা কি মেয়েটার উপর নিয়মিত অত্যাচার চালান নাকি ? ”

মহিলা ডাক্তারের কথা শুনে চল্লিশোর্ধ্ব বয়স্ক ভদ্র লোকটি বললেন,

— ছি ছি ! ডাক্তার। কি বলছেন আপনি এইসব। আমি কেনো আমার মেয়ের বয়সী মেয়েকে মারতে যাবো । আর আমি মেয়েটাকে চিনি না। এলিফ্যান্ট রোডের দিকে আসছিলাম আমার কার করে। তো দেখলাম মেয়েটা দৌড়ে আসছে কোথা থেকে। দেখে মনে হচ্ছিলো বেশ আতঙ্কে ছিলো মেয়েটা। গাড়ি থামাতে থামাতেই গাড়ির উপর পড়ে গিয়েছিলো। ”

লোকটির কথা ডাক্তার মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর বললেন,

— বুঝেছি। মেয়েটা আউট অফ ডেঞ্জার। জ্ঞান এখনোও ফেরে নি। কিন্তু কোথাও যেনো মনে হচ্ছে আমাদের কোনো খামতি রয়েছে। আমার সিনিয়র ডাক্তার আজকেই আসবেন। তাই চাচ্ছি ওনি রোগী কে পর্যবেক্ষণ করে যাক। ”

মহিলা ডাক্তারের কথা শুনে ভদ্র লোকটি বললেন,

— আপনারা যা ভালো মনে করেন। আমি অপেক্ষা করছি । ”

— জি। ”

এই বলেই চলে গেলো মহিলা ডাক্তার। ভদ্র লোকটি বাহিরে রাখা টুলে বসে পড়লেন। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা যাচ্ছে। তিনি ভাবছেন মেয়েটিকে নিয়ে। মেয়েটার পরিবার সম্পর্কে তিনি কিচ্ছু জানেন না। কি করবেন তিনি ? অচেনা অজানা একটা মেয়ে। বাড়িতে তিনি আর তার ভদ্র মহিলা বসবাস করেন। মেয়ে থেকেও নেই। মেয়েকে হারিয়েছে গত ১২ বছর আগেই। এমনিতেও তার আর ভদ্র মহিলার সন্তান হওয়ার আশংকা খুব কম ছিলো। তারপর অনেক মানত টানত করে পেয়েছিলো মেয়ে শুভ্রা কে। মেয়ের যখন ৯ বছর তখন সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে ঘুরতে গিয়েছিলো স্ব-পরিবারে। একটি আদর্শ একপত্নী ( যে পরিবারে একজন স্বামী, একজন স্ত্রী ও তাদের সন্তানাদি থাকে, তাকে একপত্নী পরিবার বলে। এই পরিবারকে সমাজে আদর্শ পরিবার বলে আখ্যা দেওয়া হয়।) পরিবার ছিলো তাদের। তারপর কক্সবাজার থেকে ফেরার সময় তাদের মেয়েটা খেলতে খেলতে পাহাড় থেকে পড়ে যায়। পাহাড় অতো উঁচু ছিলো না, তবুও পাওয়া যায় নি মেয়েকে। আজ মেয়ে হারানোর বারো তম দিবস । মেয়ে হারানোর শোকে ভদ্র মহিলা বাক শক্তি হারিয়েছেন। হারিয়েছেন বললে ভুল হবে, কথা বলার ইচ্ছা তিনি হারিয়েছেন। ওই ভদ্র লোক ভদ্র মহিলার সময়ের জিনিস সময়ে করে দেয়।

ভদ্র লোকটি একটু অন্যায় আবদার আনলো নিজের কাছে। ভাবলোে, মেয়েটার যেহেতু পরিবার সম্পর্কে তিনি জানেন না, তাহলে যদি মেয়েটাকে নিজের করে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারেন তিনি । মেয়েটাকে দেখে নিজের মেয়ের কথা মনে হয়েছে ভদ্র লোকের। ইশ! যদি তার মেয়েটা তার কাছে থাকতো তবে নিশ্চয়ই এই মেয়েটার মতোই বড় হতো ! আর যদি সত্যিই ভদ্রলোক চোট পাওয়া মেয়েটিকে নিজের মেয়ে শুভ্রা করে বাড়িতে নিয়ে যায় তবে তার ভদ্র মহিলা যদি একটু সুস্থ হয়। পরক্ষণে -ই আবার নিজের মনকে শাসালো আর বলল,

— এখন কি সব শুরু করে দিয়েছিস মহি! আগে মেয়েটাকে সুস্থ হতে দে তারপর দেখা যাবে। ”

~~

সময় রাত নয়টা বেজে একুশ। হসপিটালের রোগীদের দেখার একটা ফিক্সড টাইম এইটা। ভদ্রলোকটি সেই দুপুর থেকেই বসে আছেন। বাসায় ফোন দিয়ে কাজের মহিলা লতু কে জানিয়ে দিয়েছেন পুরোটা। এবার লতু সবটা বলবে ভদ্রমহিলা কে। তিনি কথাবার্তা ছাড়া বাকি সবকিছু করতে পারেন, সব বুঝতে পারেন এবং শুনতেও পারেন। গত ১২ বছর ধরেই তিনি একঘরে কাটিয়েছেন। আর এই বারোটি বছর রান্না করে খাইয়েছে লতু। লতু একজন কাজের মেয়েই নয় বরং সে বাড়ির এই একজন। দারিদ্রতার চাপে মা ছোটবেলা থেকেই এই বাড়িতে কাজ করতে দিয়েছিল লতুকে। লতু ছিলো গ্রামের মেয়ে। তাই রান্নাবান্না তো বেশ পটু ছিল। যা এখনোও আছে। শুভ্রার হারিয়ে যাওয়ার তিন বছর পরেই লতু সে বাড়িতে আসে। এর আগে অন্য এক মহিলা কাজ করতেন। ছেলের চাকরি হওয়াতে তিনি চলে গিয়েছিলেন। এরপর লতু আসার পর আর বাড়ির চৌখাট পেরিয়ে অন্য কোন বাড়িতে যায়নি। থেকে গিয়েছে দুই বুড়ো-বুড়ির সাথে। নতুন মেয়েটার ব্যাপারে জানার পর বলল,

— খালু ! আপনে আপা মনিরে নিয়ে আসেন। দেখবেন খালাম্মা সুস্থ হইয়া যাইবো। ”

ভদ্রলোক লতুর কথায় চিন্তা না করে উত্তর দেয়,

— চেষ্টা করবো লতু। ”

— আইচ্ছা তাইলে ফোনটা রাহি। আল্লাহ হাফেজ। ”

ভদ্রলোকটি দীর্ঘশ্বাস পেলেন। খুব খিদে পেয়েছে তার। মনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি তার পা চালালেন খুদা মিটাবার জন্য।

~~

— কোন জানোয়ারের কাজ এইটা ? এভাবে কেউ কাউকে মারে ? মেয়েটার রিপোর্ট যা বলছে , আই থিঙ্ক মেয়েটার বোধহয় শরীরের কোষ গুলো প্রাণ হারাতে বসেছে। আর মেয়েটার শরীরের অবস্থা দেখেছেন আপনি ? এরকম রোগা চেহারাও হয় ? ওনার ফ্যামিলি মেম্বার কোথায় ? ডাকুন ওনাকে। আমি ওনাদের সাথে কথা বলতে চাই। ”

এপ্রোনের বুক পকেটের প্লেটে লেখা ‘ইয়ানাত তাসবি’। হ্যাঁ , নার্স এই ইয়ানাত তাসবির কথা শুনেই বাহিরে বের হয় মেয়েটার পরিবারের লোককে ডাকতে। আর এদিকে ডাক্তার ‘ইয়ানাত তাসবি’ অপলক তাকিয়ে আছে নেয়েটির দিকে। তার জানতে বেশ ইচ্ছে হলো মেয়েটার হয়েছে কি ? পরক্ষনেই নিজের মনকে শাসালো। আর বললো,

“কুল ইয়াং ম্যান ! সামান্য একটা পেশেন্টের জন্য তুমি কেনই বা চিন্তা করছো। এইসব তোমাকে দিয়ে মানায় না। সো প্লিজ স্টপ। থেমে যাও। ”

এদিকে নার্স এসেছিলেন ১১৩ নাম্বার কেবিনের পরিবারের লোককে খুঁজতে। কিন্তু তিনি বাইরে তেমন ডাকাডাকি করেও কাউকে পেলেন না। তাই ফিরে যেতে নিলেই এক মধ্যবয়স্ক লোকের কণ্ঠস্বর শোনা যায় ,

— নার্স ! একটু এদিকে আসবেন ? ”

আপনার স্পেশাল ফিরে তাকায়। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থাকা লোকটিকে তিনি দেখতে পেয়েছেন। আজকে তার এই রুমটাতেই ডিউটি। তাই বারকয়েক এদিক-ওদিক যাওয়াতে বেশ ভালোভাবে লক্ষ্য করেছিল এই সামান্যবয়স্ককে। তিনি এগিয়ে গেলেন। বললেন,

— জি বলুন! আমি আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি ? ”

— আসলে ১১৩ নাম্বার কেবিন আমার পেশেন্ট রয়েছে। তার কি কোন আপডেট আপনি বলতে পারবেন ? ”

লোকটির কথাবার্তা, বাচন ভঙ্গি এবং পোশাক-আশাক দেখে মনে করছে লোকটি ভদ্রলোক। । তাই বাবার বয়সী লোকটিকে নিজের গলার কাঠ কাঠ কণ্ঠ না শুনিয়ে , স্বাভাবিকভাবে নিয়ে সুন্দর কন্ঠে বলে ,

— জ্বী আঙ্কেল আমি তো আপনাকে খুঁজতে এসেছিলাম । যদি একটু আপনি আমার সাথে যেতেন। সিনিয়র ডাক্তার আপনাকে ডাকছে। ”

নার্সের কথা শুনে ভদ্রলোকটি তড়িঘড়ি করে বলেন,

— চলেন চলেন । ”

বার্সেলোটির কথা শুনে মিষ্টি হেসে চলল। উদ্দেশ্য কেবিন নাম্বার ১১৩।

~~

— তারমানে আপনি মেয়েটার পরিবার সম্পর্কে জানেন না ? ”

ভদ্রলোক এসেছেন ১০ মিনিট হল। এর মাঝেই কিভাবে কি হয়েছে সবটা খুলে বলেন ভদ্রলোকটি। সবটা শুনে ডাক্তার সাহেব উত্তরে বলেন উপরোক্ত এই কথাটি। ডাক্তারের কথায় ভদ্রলোকটি বললেন,

— দেখুন ডাক্তার সাহেব ! আমি তো আপনাকে বললাম সবটাই। জানলে আমি অবশ্যই বলতাম। ”

— তাহলে মেয়েটার টেক কেয়ার কে করবে ? আই থিঙ্ক মেয়েটার শরীরের সেলগুলো প্রায় অর্ধমৃত। মাথায় আঘাতে রিপোর্টগুলো তো নরমাল এসেছে। তবে শরীরের ক্ষতগুলো বেশ গভীর। তাই বলছি। ”

এবার ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বললেন ,

— আসলে আমি চাইছি ওকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব। এখন বাকিটা ওর জ্ঞান ফেরার পর জানা যাবে। যদি এমনটা হয় যে মেয়েটা আমার বাড়িতে যেতে রাজি হয় তাহলে ওর সব দায়িত্ব আমি নেব। ”

— ইটস ইউর ম্যাটার । স্যালাইন দিয়ে দিয়েছি। আমার আর কোনো কাজ নেই। বাকীটা নার্স কে বুঝিয়ে দিয়েছি, ওনি সেটা করভেন। নাও , আই হোপ আই ক্যান গো। বাই। ”

বলেই চলে গেলেন অন্য কেবিনে। ভদ্রলোক ডাক্তারের কথায় মাথা নাড়ালেন। মন থেকে আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন যেন মেয়েটার জ্ঞান ফিরে আসে। এভাবে একের পর এক কেবিনের রোগী দেখছেন তিনি। এবার কেবিনের সিরিয়াল নাম্বার ২১৩। তখনই কোথা থেকে সেই নার্স টা হন্তদন্ত করে দৌঁড়িয়ে আসে। সোজা ডাক্তার ইয়ানাত তাসবীর সামিনে দাঁড়ায়। হাঁপাতে হাঁপাতেই বলে,

— স্যার ১১৩ নাম্বার কেবিনের পেশেন্ট টা কেমন জানি করছে । আর আজকে অফ ডে। অন্যান্য ডাক্তার তো নেই। প্লিজ স্যার আপনি তাড়াতাড়ি চলুন। ”

নার্সের কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা কত সিরিয়াস । তাই সেখানেই পেসেন্ট দেখা রেখে ছুটে চলে ১১৩ নাম্বার কেবিনের দিকে। কেবিনে প্রবেশ করল তারা কয়েক মিনিটের মধ্যে। এসেই দেখে সেই রোগা পেশেন্ট টি চিল্লাচ্ছে আর সব জিনিস ভাংছে। হাতে ক্যানোলা লাগানো ছিলো মেয়েটার । সেটা ছিড়ে গিয়ে ক্রমশ রক্ত বেরোচ্ছে। এগিয়ে যায় ডাক্তার “ইয়ানাত তাসবি”। ততক্ষণে মেয়েটির জিনিস ছুড়াছুড়ি বেরিয়ে চলেছে। পেছন থেকে ডাক্তার ইয়ানাত তাসবি পেছন থেকে মেয়েটা ধরতে গেলে মেয়েটা জড়িয়ে ধরে তাকে। আতঙ্কিত কন্ঠে বলে,

— বাঁচাও আমায় ! ওরা ওরা আসছে ! প্লিজ কেউ বাচাঁও। ও মেরে ফেলবে। বাবা ! ”

ক্রমশ চিল্লিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। তার চিৎকারে পুরো রুমের রোগীরা সজাগ হলো। ইয়ানাত তাসবি নার্স কে ইশারা দেয় ইনজেকশন পুশ করার জন্য। তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ইয়ানাত তাসবির বুকে ঢলে পড়ে মেয়েটি । ইয়ানাত তাসবি পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ধরে ফেললেন তাকে ।

চলবে ?