প্রণয়ডোর পর্ব-০২

0
1700

#প্রণয়ডোর
#লেখিকা_রামিশা_তাসলিম
#পর্ব–দুই

কপালে হাত দিয়ে বসে আছে ডাক্তার ইয়ানাত তাসবি। সে ভাবছে মেয়েটার কথা। তখন অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় পালস রেট চেক করে স্যালাইন লাগিয়ে দেয় নার্স। ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। মেয়েটা অজ্ঞান অবস্থায় থাকার পরেও ইঞ্জেকশন দেওয়ার সময় ‘আহ’ সূচক শব্দ করে। ভদ্র লোক বিচলিত ছিলেন। ডাক্তার তাসবি ও ভদ্র লোকের অবস্থা খানিক বুঝতে পেরেছিলেন। মানবতার খাতিরে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রাতের খাবার খেতে। ভদ্রলোক বাড়িতে গিয়ে দেখে তার স্ত্রী অসুস্থ। তাই আর আসতে পারেন নি। জানিয়েছেন সকালে অবশ্যই আসবে। এটাই ভদ্রলোক হসপিটালের রিসেপশনে কল করে বলে আর ডাক্তার ইয়ানাত তাসবি’কে জানিয়ে দিতে বলে। আজ অফ ডে। ফ্রাইডে । এক্সট্রা কোনো ডাক্তার আর নার্স ও নেই। একেক ওয়ার্ডে একেক নার্স। মেয়েটার সিচুয়েশন সম্পর্কে কিছুই বলা যাচ্ছে না। এই ভালো তো এই খারাপ। এজ এ ডক্টর , তাসবি রেখে চলে যেতে পারেনি। বাড়িতে মা কে ফোনকল করে সবটুকু বলে দিয়েছে। মা-ও ছেলের কথায় সায় জানিয়ে দেয়। তাসবির রাতের খাবার মা নিজের হাতে রেঁধে হাসপাতালে নিয়ে আসবেন বলেছেন। তাসবি আর আপত্তি করেনি। সারাদিনে ক্লান্ত সে। মা’কে তার এখন খুব দরকার। হয়তো বা এসে পড়বে তাসবির মা। এবার তাসবি এও ভাবছে যে, এই প্রথম সে কোনো পেশেন্টের জন্য হসপিটালে রাত অব্ধি থেকে গিয়েছে। এখন গভীর রাত। ঘড়িতে ২ টা ছুঁই ছুঁই। মেয়েটি ঘুমিয়েছে ঘন্টা তিনেক আগে। মেয়েটার মুখখানা শুকিয়ে গিয়েছে। চেহারায় ক্লান্তির একটা ছাঁপ স্পষ্ট দেখতে পারছে তাসবি। তাসবি ভেবে পায় না, এটুকু একটা মেয়ে এমন বয়সে এই অবস্থা কেনো। তাসবি হাত পা পর্যবেক্ষণ করে বুঝলো যে, মেয়েটা হয়তো কারোর বাসায় কাজ করে। কাজে ফাঁকি দেওয়ায় হয়তো বা মেয়েটাকে মারধর করতো। এতটুকু ঠিক ছিলো কিন্তু সেই ভদ্র লোকের কথা মতো ধাওয়া কেনোই বা করলো ?

তাসবির হাজারো উত্তর না পাওয়া প্রশ্নের মাঝেই নার্স কেবিনে প্রবেশ করে। নার্স এসে মেয়েটির কিছুটা দূরে জানালার পাশে চেয়ার পেতে বসে থাকতে দেখে তাসবি কে। নার্স তাসবি কে বলে,

— স্যার, রিসেপশন থেকে আপনাকে কল করছে। যদি একটু দেখতেন। ”

নার্সের কথা শুনে নড়েচড়ে বসে তাসবি। ‘দেখছি’ বলে তাসবি নিজের ফোনটা পকেট থেকে বের করে দেখে সত্যিই রিসেপশন থেকে কল এসেছে। ফোন সাইলেন্ট থাকায় টের পায়নি সে। এবার নিজের ফোন থেকেই ডায়াল করে কল দেয় রিসেপশনে। এদিকে নার্স এসে মেয়েটির সব চেক করছে। মুহূর্তেই মেয়েটির জামার ইনার পকেট দেখা যায়। যেটি নার্স কিছুটা ফুলে থাকতে দেখে । নার্স কিছুটা ভেবে কৌতূহলী হয়ে আস্তে করে পকেটে হাত ঢোকায়। সে ভাবছে কি হতে পারে। ভর্তি করার সময় তো সব চেক করে তারপর বেডে শিফট করে , তাহলে তো এর পকেটে কিছু থাকার কথা না। তারপরই মনে পড়ে, মেয়েটার মাথা ফেটে এতো ব্লিডদিং হচ্ছিলো যে তেমন একটা চেক করে দেওয়া হয়নি। যেন তেনো করে শিফট করা হয়েছে বেডে। আরোও আজ ছিলো ফ্রাইডে। মহিলা চেকার ও ছিলো না। তাই হয়তো। ব্যাপার টা স্বাভাবিক ভাবে নেয় নার্স টি।

এদিকে ডাক্তার ইয়ানাত তাসবি কানে ফোন ধরে কথা বলছে রিসেপশনিস্ট-এর সাথে।

— হ্যালো। ডাক্তার ইয়ানাত তাসবি বলছি। কল করছেন দেখলাম। এনিথিং ইজ রঙ ? ”

— নো স্যার। তেমন কিছুই না। তবে একটা বিষয় স্যার। আপনি তো জানেন ই আমাদের হসপিটালের হার্ড সিকিউরিটির ব্যাপারে। তো, একচুয়ালি একজন ভদ্র মহিলা এসেছেন রিসেপশনে। বলছেন ওনি আপনার মা। এতো রাত, তার মধ্যে মধ্যবয়স্কা মহিলা, কিছুটা সন্দেহ হলো। ওনাকে কার্ড দেখাতে বললাম তো বলছেন ওনি কার্ড বাসায় রেখে চলে এসেছেন। এখন আপনি যদি ,,,। ”

রিসেপশনিস্টের কথা শেষ না করতে দিয়ে তাসবি তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

— আচ্ছা বুঝেছি। ওনাকে জিজ্ঞাসা করুন যে ওনার নাম কি। ”

রিসেপশনিস্ট কিছু সেকেন্ড পর উত্তর দিলো,

— স্যার ওনি বলছেন ওনার নাম সাইয়্যারা আহমেদ। ”

— জি আপনি পাঠিয়ে দিন। ওনি আমার মা হল। ”

তাসবি’র তড়িঘড়ি করা কন্ঠ শুনে রিসেপশনিস্ট বললেন,

— স্যার আপনি কোথায় আছেন যদি বলতেন। ”

— ইমারজেন্সির দ্বিতীয় তলায়। ওয়ার্ড নাম্বার ৭ কেবিন নাম্বার ১১৩। ”

— ঠিক আছে স্যার। আমি ম্যাম কে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ”

কল কেটে দেয় তাসবি। ওঠে দাঁড়ায় ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য। ফ্রেশ হতে হবে। এই হসপিটালের বিশেষত্ব হচ্ছে হাসপাতাল টা অন্যান্য হসপিটাল অপেক্ষা পরিষ্কার। প্রত্যেক কেবিন আলাদা এবং এটাচড বাথরুম। তবে সেই অনুযায়ী এখানকার খরচ তেমন বেশি না। উন্নত যেমন পরিবেশ ঠিক তেমন উন্নত চিকিৎসা সেবা। তাই অধিকাংশ লোকেরা এখানেই রোগীদের আনে। হাসপাতাল হাসপাতাল গন্ধ টা যেনো থাকে না এখানে। এদিকে তাসবি’র উঠে দাঁড়ানো দেখে নার্সটি তাকে ডাকে। আর বলে,

— স্যার একটা জিনিস পেয়েছি মেয়েটার থেকে। ”

নার্সের কথা শুনে ভ্রু কুচঁকে তাকায় তাসবি। সাথে সাথে উত্তর দেয়,

— কি ? ”

— স্যার মেয়েটার ইনার পকেট থেকে একটা ছোট্ট পার্স পেয়েছি। সেখানে আইডি কার্ড টা শুধু আছে। ”

— কি বলছেন, ইনার পকেটে আইডি কার্ড ? আইডি কার্ড কি ওনি লুকিয়ে রাখতে চেয়েছেন নাকি? ”

তাসবি’র কথা শুনে নার্সটি বলে,

— হবে হয়তো। নিন স্যার দেখুন। ”

এই বলে নার্স এগিয়ে দিলো আইডি কার্ড টা। তাসবি সেখানকার গোটা গোটা অক্ষরে লেখা নামটা উচ্চারন করলো। “ ফারিহাতুল শুভ্রা ”। পাশেই চুল খোলে রাখা হাস্বোজ্জ্বল মুখ খানা স্পষ্ট হলো। কে যেনো বলেছিলো, মেয়েরা আসলে দেখতে কেমন তা দেখা আর বোঝার জন্য মেয়েদের আইডি কার্ডের ছবি টাই যথেষ্ট। তবে এখানে মেয়েটার চেহারায় তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এবার তাসবি বলে,

— আই সি ! মেয়েটার নান “ফারিহাতুল শুভ্রা” বাবা হাতিম আমজেদ আর মা শিলু আমজেদ । ”

— স্যার ওই যে ভদ্রলোক ওনার মেয়ের নাম ও তো শুভ্রা। সকালে নাদিরা ম্যাম ( সকালের ডাক্তার) বলেছিলেন আমাকে। ”

— কিন্তু ওনি তো বলেছেন মেয়েটা কে ওনি চেনেন না। তার গাড়িতেই এক্সিডেন্ট করেছে নাকি। ”

— জি স্যার। আমিও সেটা শুনেছি। ”

— যাই হোক! এইসব দেখার বিষয় আমাদের না। আকরা বোধহয় বেশিই ভেবে ফেলছি এই মেয়েটার জন্য। হতে পারে এই শুভ্রা আর ওনার মেয়ে শুভ্রা আলাদা। নামের কুয়েন্সিডেন্স তো হতেই পারে। ”

এই বলেই তাসবি ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। নার্স ও চলে যেতে নেয়। তখনি এক বৃদ্ধ মহিলার আগমন ঘটে। তিনি নার্সকে জিজ্ঞাসা করলেন,

— মা ! এখানে আমার তাসবি কে দেখছি না। এটাই তো ১১৩ নাম্বার কেবিন। বলছি ও কি এখানে নেই ? ”

— না ম্যাম। তিনি এইখানেই আছেন। স্যার জাস্ট একটু আগেই ওয়াশরুমে গেলেন। ”

— ঠিক আছে। ”

এই বলে মহিলাটি কেবিনে প্রবেশ করে খাবারের বক্সখানা সেখানকার টেবিলে রাখলেন। আরাম করে মোড়ায় বসে রইলেন। তাকে দেখে নার্সটি জিজ্ঞাসা করল,

— ম্যাম আপনার কি কোন সাহায্য লাগবে ? ”

নার্সের কথা শুনে বৃদ্ধ মহিলাটি নার্সের দিকে তাকায়। উত্তরে বলে,

— আপাতত কিছু দেখতে পারছি না। তবে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও। এই মেয়েটাই কি সে মেয়েটা, যার কারণে আমার ছেলে হাসপাতালে থেকে গেলো ? ”

— জি ম্যাম। এই মেয়েটাই। ”

— ওর সম্পর্কে কিছু জানো ? ”

— বৃদ্ধ মহিলার কথা শুনে নার্সে একে একে সব খুলে বলে। ”

— তাহলে তো ভালই। ওর আইডি কার্ডের বাবা মা কে খুঁজলেই পাওয়া যাবে ওর পরিবারের সন্ধান। আচ্ছা তাহলে তুমি এখন যেতে পারো। ”

— জি ম্যাম। ”

এই বলে প্রস্থান ঘটায় নার্সটি। বৃদ্ধ মহিলাটি চেয়ারটা এগিয়ে নিয়ে বসে শুভ্রার হাত ধরে খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে রয়। তিনি ভাবেন এরকম মায়ামুখখানা বোধহয় কখনো দেখেননি। তবে মেয়েটাকে ভাল করে পরখ করতে আঁতকে ওঠেন বৃদ্ধ মহিলাটি। শরীরের জায়গায় জায়গায় ক্ষত। বিশেষ করে হাতের। হাতের তালুর চামড়াটা বেশ শক্ত। বৃদ্ধ মহিলাটি বেশ ভালো করে বুঝছেন যে , এই কম বয়সি মেয়েটা তার বয়সের তুলনায় অতিরিক্ত কাজ করে। তাইতো তার হাতের তালু শক্ত। এবার যেন বৃদ্ধ মহিলাটিও চিন্তায় পড়ে গেলেন। তখনই ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ হয়। বৃদ্ধ মহিলাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। নিজের ছেলের অস্তিত্ব বুঝতে পেরে তিনি মুচকি হাঁসেন। মুখে মিষ্টি একখানা হাসির রেখা টেনে সন্তানের উদ্দেশ্যে বলেন,

— বোস বাবা। ”

মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতেই তাসবি পুলকিত হয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করে।

— কখন এলে মা? ”

— এইতো এসেছি খানিকক্ষণ। গাড়িত্ব করে এসেছি। ড্রাইভার গাড়িতেই আছে। আর এসেই মেয়েটাকে বসে দেখছিলাম। মনে হয় মেয়েটাকে অনেক মারধর করে কেউ। আচ্ছা মেয়েটা কি বিবাহিত ? এ ব্যাপারে কিছু কি জানিস ? ”

— আরে না মা তেমন কিছুই জানিনা। তবে এটুকু জানি মেয়েটার নাম ফারিয়াতুল শুভ্রা। ”

— ও আচ্ছা তাই বল। আয় এদিকে, আয়! খাবার এনেছি খাবি। ”

মায়ের কথা শুনে তাজবি একবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়। সময় ২ টা বেজে ৪৫। বৃদ্ধা মহিলা একে একে সব খাবার বের করে তারই আনা প্লেটে খাবার মাখিয়ে ছেলেকেও খাওয়াচ্ছেন আর নিজেও খাচ্ছেন। তাসবি আর তানহা বৃদ্ধার সম্বল। বিয়ের ৩ বছরে বৃদ্ধা মহিলা তানহা কে পায়। তারপর স্বামী মৃত্যুর ৪ মাস পরেই তাসবি আসে। স্বামীর মৃত্যু টা ছিলো অকাল মৃত্যু। যদিও অকাল মৃত্যু বলে কিছু হয়না। তকদিরে যখন যার মৃত্যু লেখা থাকে, তখনই হয়। তবে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মৃত্যু হওয়াটাকে অকাল মৃত্যু’ই বলে।

খাবার প্রায় শেষ পথে। তখনই বেডে শুয়ে থাকা শুভ্রা আওয়াজ করে বলে,

— আম্মু ! ”

সাথে সাথে চমকে ওঠে তাসবি আর তার মা। তাসবি ভাত গলায় রেখেই মনে মনে আওরায়,

— মেয়েটা কী সাংঘাতিক রে বাবা। ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়েও একে ঘুম পাড়ানো যায়না। সেই ঠিক জেগে মাতলামো করবে। ”

অসুস্থ একটা মেয়েকে নিয়ে এসব আজেবাজে কথা ভাবতেই লজ্জায় জর্জরিত হয় তাসবি। বেমালম ভুলেই বসে ছিল যে মেয়েটা অসুস্থ। ততক্ষণ এগিয়ে গেলেন বৃদ্ধা। মেয়েটার হাত ধরে জিজ্ঞাসা করলেন,

— হ্যাঁ , মা ! বলো ? কিছু বলবে ? ”

— ওরা আমাকে মেরেই ফেললো ! তখনো মারতে চেয়েছিলো আর এখনও । ”

মেয়েটার কন্ঠে বলা কথাটুকু জড়ানো ছিলো। তবে বৃদ্ধা অতি কাছে থাকায় বেশ ভালো ভাবেই কথাটুকু শুনেছে।

– চলবে ?

( রেস্পন্স অতীব জরুরি । )