প্রণয়ডোর পর্ব-০৩

0
1497

#প্রণয়ডোর
#লেখিকা_রামিশা_তাসলিম
#পর্ব- তিন

— কারা আপনারা ? ”

বেডে শুয়ে থাকা শুভ্রার কন্ঠ ছিলো ভয় মিশ্রিত। আর এই ভয় মিশ্রিত কন্ঠ নিয়েই বৃদ্ধা মহিলা কে জিজ্ঞাসা করে। বৃদ্ধা মহিলা শুভ্রার জড়তা বুঝতে পারলো। মুচকি হেসে শুভ্রাকে উত্তর দেন,

— উত্তেজিত হইয়ো না মা। আমি তোমার মায়ের মতোই। ”

এই বলেই বৃদ্ধা মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে বেড সাইডের লাইট অন করে দেয়। নিমিষেই আলোকিত হয় পুরো রুম। পর্দা টেনে দেয় তাসবি। উদ্দেশ্য খাওয়া শেষ করা। উঠে বসার চেষ্টা চালায় শুভ্রা। তা দেখে বৃদ্ধা। মহিলা বলেন,

— আরে রিলাক্স। দাড়াও আমি তোমায় সাহায্য করছি। ”

ভদ্র মহিলার চাল-চলন আর পোশাক-আশাক বেশ ভালোই ঠেকলো শুভ্রার কাছে। সে এবার ভদ্র মহিলার সাহায্যে আধ শোয়া হয়ে বসে। শুভ্রার কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ভদ্র মহিলা শুভ্রা কে মিষ্টি হাঁসি উপহার দিয়ে বলতে লাগলেন,

— চিন্তা করো না মা। আমার ছেলে এখানকার ডাক্তার। ডাক্তার ইয়ানাত তাসবি। ওই তোমার ট্রিটমেন্ট করছে। আজকে তো ফ্রাইডে মানে হসপিটাল এ অফ ডে। কোন ডাক্তার এইতো ছিল না আজ সারাদিন। আমার ছেলে আবার অফ ডে তো কাজ ছাড়ে না। তো সেই সুবাদে ও হসপিটালে এসে তোমাকে পেয়ে যায়। তোমার অবস্থা নাকি খুব ক্রিটিকাল ছিল। পরে আমি বলি যে, এজে ডক্টর মেয়েটার ফুল ট্রিটমেন্ট দূর করা উচিত। যেহেতু ও ট্রিটমেন্টটা তোর থেকে শুরু হয়েছে। পরে আর কি আমার ছেলেটাও থেকে গেল। বাসায় আমি আর আমার দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকি। মেয়েটাকে বাসায় রেখে এই যে এখন আমার বুড়ো ছেলেটার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। ছেলেটা আমার বড্ড আদরের। কখনো আমাকে ছেড়ে খায়নি। বলতে পারো এটাই তার প্রফেশনাল লাইফে হসপিটালে প্রথম থাকা। ”

বৃদ্ধা মহিলার কথা শুনে শুভ্রা মুচকি হাসে। আর বলে,

— আরে আন্টি আপনি এখন রিলাক্স করেন। আমার জন্য এত উত্তেজিত হতে হবে না। আসলে আমি তো আপনাদেরকে প্রথম দেখছি আগে থেকে তো চিনি না, তো সে কারণে আমি কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম। ”

শুভ্রার কথা শুনে ভদ্রমহিলা খানিকটা অবাক হলেন। তিনি তার জীবনে এরকম মেয়ে খুব কমই দেখেছেন। তার অসুস্থ শরীর নিয়ে সে যতটা স্বাভাবিক থাকা যায় ঠিক ততোটাই থাকার চেষ্টা করছে। যেন সে তাদেরকে চেনে। তবে ভদ্রমহিলা তো এরকম ধাঁচের ই ছিলেন। তাই শুভ্রার এই চমৎকার একটা গুণ ভদ্র মহিলার চোখ এড়াতে পারল না। আবারো মুচকি হাসেন ভদ্র মহিলাটি আর শুভ্রা কে বলে,

— বুঝতে পেরেছি। ”

ভদ্রমহিলা আর শুভ্রার কথার মাঝখানে গলা খ্যাঁকারি দেয় তাসবি। সুউচ্চ আওয়াজে বলে,

— আম্মু ! আমি আসছি । তুমি এখানেই থেকো। আর কোন কিছু দরকার পড়লে আমার কেবিনে এসো। বাইরে আমার একটা ফ্রেন্ড ওয়েট করছে আমার সাথে দেখা করার জন্য, তাই দেখা করে আসছি। ”

ভদ্র মহিলা ছেলের কথায় মাথা নাড়িয়ে সায় জানায় । মায়ের সম্মতি পেয়ে তাসবি নিজের প্রস্থান ঘটায়। আবারো শুরু হয় ভদ্রমহিলা আর শুভ্রার মধ্যে কথোপকথন ,

— আচ্ছা আন্টি আপনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারবেন ? ”

শুভ্রার কথা শুনে ভদ্রমহিলা শুভ্রা কে বলে,

— হ্যাঁ মা, বলই না। বলব না কেন ! ”

— আসলে আন্টি আমি জানতে চাইছিলাম যে আমি এখানে কি করে এলাম। মানে আমার তো একটা,,,। ”

শুভ্রা এইটুকু বলেই থেমে যায়। শুভরাত থেমে যাওয়া কথাটা ভদ্র মহিলা যেন শুনতে চাইলেন। তাই তিনি শুভ্রা কে জিজ্ঞাসু হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ,

— কি মা? বল ? ”

ভদ্র মহিলার কথা শুনে শুভ্রা আমতা আমতা করতে লাগলো। শুভ্রার আমতা আমতা করা দেখে ভদ্র মহিলা চুপ করে গেলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন,

— আমি যতদূর জানতে পেরেছি। একজন ভদ্রলোকের গাড়ির সামনে তুমি পড়ে গিয়েছিলে। পরে উনি তোমাকে এই হসপিটালে এনেছে। তোমার মাথা দিয়ে প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছিল। সে কারণে তিনি এখানকার কাছাকাছি এই হাসপাতালে’ই ভর্তি করেছেন। ”

— ওহ ! ”

এরপর খানিক সেকেন্ড নিরবতা শুভ্রার মাঝে। তাকে এখন দেখে মনে হবে না যে সে তখন কি পাগলামো টাই না করেছিলো। একদম শীতল হাওয়ার মতো শুভ্রার শীতল চাহনী। ভাবুক মন ফলে মুখে খানিকটা ভাঁজ সৃষ্টি হয়েছে। এবার ভদ্র মহিলা আবারো বলতে লাগলেন,

— মা ? ”

— জি ? ”

— আমাকে কি তুমি কিছু বলবে ? আমি মনে করি, যদি তুমি তোমার কষ্টটা বা ভেতরের অনুভব টা আমাকে একটু বলো হয়তো বা তুমি একটু বেটার ফিল করবে। কেননা ,,,। ”

ভদ্র মহিলা এর পর থেকেই তার ছেলের অবদানের কথা তুলে ধরলেন। এক পর্যায়ে আইডি কার্ড খুঁজে পাওয়ার কথা বললে জামা খামঁচে ধরে শুভ্রা। ভদ্রমহিলা তার বিচক্ষণ চোখ দিয়ে তা পরখ করেন। আর তখনই শুভ্রা ভদ্র মহিলাকে জিজ্ঞাসা করেন,

— আন্টি আমার আইডি কার্ড টা কোথায় ? ”

ভদ্রমহিলা শুভ্রার আইডি কার্ড টা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,

— নাও। ”

ভদ্র মহিলার নাও বলার সাথে সাথে শুভ্রা আইডি কার্ড টা নিয়ে নেয়। সতর্ক মিশ্রিত কন্ঠে বলে,

— আন্টি আমার এই আইডি কার্ডের ব্যাপারে কারা জানে? আই মিন এই আইডি কার্ড টা কজন দেখেছে ? ”

শুভ্রার কথা শুনে ভদ্রমহিলা কপাল খানিক কুঁচকে আবার মুচকি হেসে বলেন ,

— আসলে মা এটা কিছুক্ষণ আগেই তোমার নার্স খুঁজে পেয়েছে। আর এই আইডি কার্ড সম্পর্কে জানি বলতে জাস্ট দেখেছি। আমি, আমার ছেলে আর ওই নার্স টাই দেখেছি । বাইরের কেউ দেখেনি। ”

— আন্টি আপনি কি শিউর ? ”

— হ্যাঁ মা আমি শিওর। কারণ আমার ছেলে আমাকে সবটাই বলেছে। আর আমার ছেলের প্রতি এতোটুকু বিশ্বাস আছে যে, সে আমাকে কোন কিছুই এড়িয়ে গিয়ে বলবে না। ”

ভদ্রমহিলার বলা কথায় শুভ্রা বোধ হয় একটু স্বস্তি বোধ করে। এবার নিজে থেকেই শুভ্রা ভদ্র মহিলাকে বলে,

— আন্টি আমি এতিম। আমার মা-বাবা কেউ নেই। ছোটবেলা থেকেই আমি অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি। তারপর যখন আমার বয়স ১৩ বছর, তখন অনাথ আশ্রম থেকে কেউ আমাকে দত্তক নেয়। দত্তক নেয় বলে ভুল হবে, কেননা বরঞ্চ তারা আমাকে কাজে মেয়ে হিসেবে নেয় তাদের বাড়িতে। দত্তক নেওয়ার তিন বছরের প্রতিটা দিনের পর দিন তারা আমাকে দিয়ে কাজ করিয়েছে । পড়াশোনা অবশ্য ঠিকই করিয়েছে ওই দত্তক নেওয়ার প্রথম তিন বছর। তখন আমি এসএসসি দিয়েছি। বেশ ভালই ফলাফল অর্জন করেছিলাম। একেবারে জিপিএ গোল্ডেন । তখনই তাদের কল আলো করে আসে রাফসান। বলা যায় তাদের বিয়ের ২০ বছর পর রাফসান জন্ম নিয়েছে। আস্তে আস্তে আমার প্রতি তাদের মায়া মহব্বত সবই কমতে লাগলো। যার দরুন আমি তবে থেকে কাজের মেয়ে হয়ে গেছি। তবে একটা জিনিস খটকার ব্যাপার, যে মানুষগুলো আমাকে এত ভালবাসতো একটা সময়, তারা কিভাবে পারলো আমার সাথে এরকম জঘন্যতম আচরণ করতে। যেটা রহস্য আজ’ও অজানা। আমি বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলে প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছি। তোর মেডিকেলে ভর্তি হয়েছি অনেক জোর জুলুম করে। আমি আবার টিউশনও চালাই। ওই টিউশন থেকে যতটুকু টাকা আয় হয় তা দিয়ে আমি মেডিকেলের খরচ চালায়। আমার টিউশনে টাকায় যদিও হয় না তারপরও কলেজের ফান্ড থেকে আমাকে কিছু টাকা দেয়। তারপর একদিন টিউশন শেষ করে বাড়িতে যাই। তখন বাড়ি থেকে আমাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। আমি তাদেরকে আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার কারণটাও পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করতে পারিনি। তখন আমি আমার এক ক্লোজ ফ্রেন্ডের বাসায় উঠি। আমার সাধারণত অত ফ্রেন্ড ছিল না। ছিল হাতেগোনা দুই একজন। তার মধ্যে ফারিয়া একজন। আমার নামে নামে তার নামটা হওয়ায় তার সাথে ফ্রেন্ডশিপ হয়েছিলো আমার। তারপর তো একসাথেই মেডিকেলে চান্স পেলাম। আমাদের ঘনিষ্ঠ তো ততটা বাড়লো। আমার ফ্রেন্ডের বাবা আবার অনেক ভালো মনের মানুষ। তিনি আমার কথা জানার পরে আমার বান্ধবীর সাথে আমার থাকার জন্য রিকোয়েস্ট করেন। বাবা বয়সী লোকের রিকুয়েস্ট আমি ফেলতে পারিনি। তাই থেকে যাই ফ্রেন্ডের কাছে। চার মাস হলো আমি আমার ফ্রেন্ডের সাথে আছি। ”

এটুকু বলেই শুভ্রা থেমে যায়। দীর্ঘশ্বাস পেলে আবার বলতে শুরু করে ,

— গত সাত দিন আগে কেউ আমাকে কিডন্যাপ করে। পুরুষ মানুষকে তো দেখিনি। শুরু থেকে সব মহিলা মানুষকে দেখেছি। তারা আমাকে প্রতিদিন বেধরম পেটাতো। আর বলতো , কেনো আমি মিস্টার আমজেদের মেয়ে। তাদের কথা মতে আমি নাকি মহি উদ্দীনের মেয়ে। আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে আমার কি জন্ম নেওয়াটাই দোষ হয়েছে নাকি,,, ! যাই হোক পরে আমি অনেক কষ্টে কৌশলে বেরিয়েছি। তাদের আস্তানা থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই তারা আমাকে কিভাবে যেন আমায় ধাঁয়া করে। পরিত্যক্ত বিল্ডিং ছেড়ে যখন আমি লোকালয়ে আসলাম। তখন আর তাদেরকে চোখে পড়েনি। কিন্তু , মনের মধ্যে একটা ভয় থেকেই গিয়েছিল। তাই চারিপাশ না দেখেই প্রাণপণে দৌড়াচ্ছিলাম। তারপর হঠাৎ আমি রাস্তায় পড়ে থাকা একটা ইটের উপর যেন তেন পা ফেলতেই সামনে এগিয়ে যাই আর আমার চোখের সামনে একটা কার দেখি। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই। ”

শুভ্রার কথা শুনে ভদ্রমহিলা বললেন,

— হুম ! সবই বুঝতে পেরেছি । ”

ভদ্রমহিলা মুখে এই কথাটা বললেও তার মনের সন্দেহ দূর হলো না। কিছু কিছু সমীকরণ যেন তিনি বুঝলেন না। মনে হলো শুভ্রা যেন তার অতীত থেকে কিছু এড়িয়ে গিয়েছে। না হলে ঘুমের ঘুরে ওই কথাটা কেনোই বা বলবে যে, “ আজও মারার চেষ্টা করেছিল আর এখনোও ! ”। মনে মনে তিনি আওড়ালেন , ‘মেয়েটার মধ্যে নিশ্চিত ঘাপলা আছে। তবে যতটুকু মেয়েটা বলেছে ততটুকু মিথ্যে বলে মনে হচ্ছে না। ’

তখনই কেবিনের দরজা খোলার আওয়াজ হলো।

— চলবে ?