#প্রণয়ডোর
#পর্ব-চব্বিশ
#লেখিকা_রামিশা_আঞ্জুম_বুশরা
‘নীল নীলাঞ্জনা’ বাড়ির বিয়ের বাজার করতে মলে এসেছে বেশ খানিকক্ষণ হলো। এবার খানিকটা ব্রেক নিয়ে হালকা কিছু খাবার খাওয়ার উদ্দেশ্যে গ্রাউন্ড ফ্লোরে আসলো। এলিজা সহ তার মা-বাবা এসেছেন। ছেলে পক্ষ কেনে দেবে মেয়ে পক্ষের জিনিস আর মেয়ে পক্ষ কেনে দেবে ছেলে পক্ষের জিনিস। শুভ্রা বাদে বাকীরা গিয়েছে টুকটাক খাবার খেতে। শত হোক সৎ ভাইয়ের বিয়ে তো। তার উপর এতো বড় ধামাকা দেবে সেই দিনে। অন্তত তার হাসিখুশি থাকা চাই। তাই এগিয়ে গেলো বোরকার দোকানে। অনুষ্ঠানে অন্যান্য দের মতো শাড়ি বা লেহেঙ্গা পড়ার মেয়ে সে নয়। বাড়ি বা বাহিরে অপরিচিত লোকদের সামনে সে বরাবরই নিজেকে আবৃত করে রাখে। একের পর এক বোরকা দেখে গেলো তবুও তার পছন্দ হলো না। যেটাই দেখছে না কেনো সেটাতেই কিছু না কিছু খামতি থাকছেই। শুভ্রা নিজের ড্রেসের প্রতি ভীষণ সেন্সেটিভ। পছন্দ হলো আর নিয়ে নেবে এমন মেয়ে সে নয়। ওর ড্রেস সেন্স খুব ভালো। হঠাৎ মনে পড়ে গেলো কিছুদিন আগেই সে একটা বোরকা দেখেছিলো, ঠিক এই মলের ই কোনো একটা তে। যেটা তার খুব মনে ধরেছিলো। কিন্তু সময় স্বল্পতার কারনে সেদিন নিতে পারেনি। তবে আজ নেবে। বিয়ের দিন তো তাসবি ও থাকবে। সুতারাং তার জন্যেও কিছু কেনাকাটা দরকার। আর ভাইয়ের বিয়েতে অবশ্যই ভাইকে কিছু না কিছু উপহার দেবে। সেজন্য আড়ালে গিয়ে যা কেনার তা কিনে নেবে সে। তবে বলে যেতে হবে মিসেস মির্জা কে। নয়তো আবার তিনি চিন্তা করবেন। তাই এগিয়ে গেলো তাদের কাছে।
~~
শুভ্রা কে দেখে মিসেস মির্জা মুচকি হেঁসে কাছে ডাকলেন। এগিয়ে যায় শুভ্রা।
– “কোথায় ছিলে মা ? ”
– “এইতো এখানেই। উম,,আন্টি! ”
– “হ্যাঁ মা ! ”
– “বলছিলাম যে আমার একটা বোরকা পছন্দ হয়েছিল অনেক দিন আগে। এই মলের ই কোনো একটা দোকানের। ঠিক স্মরণে নেই দোকান টা , আর আমি ডিসাইড করে ফেলেছি যে বিয়ের দিন আমি ওই বোরকা টাই পড়বো। তাই আমাকে খুঁজে হলেও ওই বোরকা টা কিনতে হবে। তাই বলছিলাম যে…।”
আরাফ শুভ্রার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে ফেলে,
– “হ্যাঁ ! তাই বলছিলে যে , তোমাকে যেন কোনো ক্রেডিড কার্ড বা ক্যাশ টাকা দেয় । সেটাই তো ? ”
বলেই হেঁসে উঠলো সে। সকলেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শুভ্রার দিকে। তা দেখে আরাফ ফের বলে ,
– “আরে বাবা , একে একটা ক্রেডিড কার্ড দিয়ে দাও তো। গরিব তো ! ”
পুনরায় হেঁসে উঠলো নিজের মতো। শুভ্রার ঘৃণায় শরীর রি রি করে উঠলো। সেদিনের করা কাজ টা রিপিট করতে ইচ্ছে হলো তার। কিন্তু ভাইয়ের শশুড় শাশুড়ির নিকট ছোট করতে সে চায়না। তাই দমে গেলো। এদিকে ছেলেকে বকতে থাকলেন মিসেস মির্জা। আর মিস্টার মির্জা ছেলের কথা শুনে তাচ্ছিল্যের হাঁসি মুখে ফুটিয়ে এনে ওয়ালেট থেকে কার্ড বের করে শুভ্রার সামনে ধরে। শুভ্রা এক পলক কার্ডের দিকে তাকিয়ে আরেক পলক বাবার দিকে তাকালেন। বাবার হাঁসি নাকি মেয়ের সকল অশান্তি দূরীকরণের মেডিসিন। কিন্তু সেটা শুভ্রার কাছে এক প্রকার গাঢ় এসিড। যখনই বাবার হাঁসির দেখা পায় তখনই তার মন জ্বলে ছাড়খার হয়ে যায় । এবারও তাই হলো।
– “আসলে আন্টি ! আমি আপনার সাথে কথা বলছিলাম। তবে কারোর যে ছিচকে ইঁদুরের স্বভাব রয়েছে তা আমি জানতাম ই না। আর আমার কি করার এবিলিটি আছে আর কি করার এবিলিটি নেই তা সম্পর্কে কেউ ই অবগত নন। আপনারা ততটুকুই দেখেন যতটুকু আমি দেখাই। সুতারাং আমার ব্যাপারে ভাবার আগে কয়েক কদম নিজে ভেবে তারপর ভাববেন। তো যেই কথা বলছিলাম , আন্টি সেজন্য আমার খানিকটা লেইট হলে হতে পারে। আপনি টেনশন করবেন তাই জানিয়ে দিলাম। আর ব্যাক করার আগে আমায় একটা কল করবেন আশা করি। ”
এটুকু বলে সামনে কয়েক কদম এগিয়ে থেমে যায় , যেখানটায় আরাফ দাঁড়িয়ে। সে নিজের অবস্থানে থেকেই আরাফের চোখে চোখ রেখে বলে ,
– “কাঁটার সাথে করলাম সন্ধি , পায়ে পিষে ভুল ! ”
চমকে উঠে আরাফ। এই লাইন ও জানলো কীভাবে ? কে ও ?
#চলবে
#প্রণয়ডোর
#পর্ব-পঁচিশ
#লেখিকা_রামিশা_আঞ্জুম_বুশরা
-“অনেক পরিবর্তন হয়েছি আমি। অনেক মানে অনেক ! বাস্তবতা মেনে নিতে শিখেছি। যা আমার না তা উপলব্ধি করতে পারলেই এমনভাবে শক্ত হয়ে যাই যে, বুকের অসহ্যকর যন্ত্রনা টাকেও সহ্য করি। যেখানে আগে একটু আঘাত পেলেই কেঁদে কেটে পুরো বাড়ি মাথায় তুলতাম , সেখানে আজ চোখের জল টাও চোখে আটকে রাখি । মস্তিষ্ক জানান দেয় , কষ্ট টা পুষে রাখো বের হতে দিও না। বারংবার তুমিই আঘাত পাবে খুব বাজেভাবে।
ব্যস্ত রাখছি নিত্যনতুন কাজে। কখনো রান্না করছি তো কখনো পড়াশোনা , মোবাইল আবার কখনো নিজের প্রপফেশনে মনযোগ দিচ্ছি। অতীত মনে হয়না হয়না , কিন্তু হঠাৎ ই যখন মনে হয় তখন নিজেকে স্বান্তনা দেবার মতো কিছুই খুঁজে পাইনা। কেনো এমন করলো ও ? বলবি বনু ?”
শুভ্রা চুপ রয়। এই মুহূর্তে এহেন কথার প্রেক্ষিতে বলার মতো কিছুই খুঁজে পায় না। সামনের ব্যক্তিটির দিকে মাথা তুলে তাকায়। এক জোড়া অশ্রুসিক্ত চোখ তার ভেতর নাড়িয়ে দিলো। ব্যক্তিটির চোখ জোড়া বলে দিচ্ছে তার অসহ্যকর যন্ত্রনা। ভালোবেসে ও ঠকে যাওয়ার এক অসহ্যকর অনুভূতি।
হাউমাউ করে কাঁদছে ব্যক্তি টি। আর আশেপাশের মানুষগুলো আড় চোখে পরখ করে তাদের কাজে যাচ্ছে। তবে আশেপাশের পরিবেশ নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা নেই ব্যক্তিটির। সমানতালেই কেঁদে যাচ্ছে।
বোধহয় তার দামী কিছু সে হারিয়ে ফেলতে চলেছে। তার চোখ জোড়া যেনো শুভ্রার নিকট আবেদন করছে , “বনু , ওকে আমার কাছে এনে দে ! তুই তো সবার কষ্ট দূর করে দিস আমার টাও দূর করে দে না ! সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো তোর কাছে।”
এবার শুভ্রা সহ্য করতে না পেরে কয়েক কদম এগিয়ে ব্যক্তিটিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। এতে যেনো ব্যক্তিটি কান্না করার আরেকটু আশকারা পেলো। শুভ্রা ক্রমাগত হাত বুলিয়ে চললো পিঠে। বিচলিত কন্ঠে বললো,
-“বনু! শান্ত হো। এইভাবে বাচ্চাদের মতো কাঁদলে চলে ? যে আসবার নয় কিংবা যে থাকার নয় তাকে জোড় করাটা বোকামি ।
আর যাই হোক ভালোবাসা জোড় করে হয়না। এতোদিন তো দিব্যি শক্ত ছিলি আজ তাহলে কী এমন হলো তোর ? আর দেখ এটা পাব্লিক প্লেস। কেউ আমাদের এভাবে দেখে ফেললে সমস্যা হয়ে যাবে। তোর আমার কনভারসেশনের সম্বোধন টা …”
শুভ্রার কথা শুনে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর কাধে মুখ গুজলো। নাক টেনে বলতে লাগলো,
-“আমাদের জীবনে কেন এতো জটিলতা বলতে পারবি ? আজ বাদে কাল তার বিয়ে। তুই বুঝতে পারছিস ? ও একবার অন্য কারোর নামে কবুল বলে ফেললেই আমি ওকে হারিয়েছি ইহকাল পরকাল দুটোতেই ! আমি ওকে হারাতে চাইনা।
শত খারাপ হোক, আমি ওকে ভালোবাসি। আর আমার ভালোবাসা মৃত্যুর মতোই সত্য ! ওর থেকে ভালোবাসা পেলাম না কিন্তু ওকে আমি নিজের করে পেতে চাই। শত অপমান ও আমায় করুক আমি মেনে নেবো তবুও মানুষটা আমি ছাড়া অন্য কারো নামে কবুল না পড়ুক। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। বড় বোন হয়ে আজ হন্নে হয়ে তোর কাছে এসছি। ”
ব্যক্তির কন্ঠ এবার খানিকটা মিইয়ে যাওয়া কন্ঠের ন্যায় অনুভব হলো। হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে সাইডের একটা টুলে তাকেও বসতে দিলো। ব্যক্তির দৃষ্টি ফ্লোরে। হাটু গেঁড়ে বসে পড়ে তার সামনে। হাত দুটো নিজের মুঠোয় নিয়ে ব্যক্তি টি কে শুধালো,
-“আপু ! শান্ত হও। তুমি তো জানো লোকটা কতটা বাজে। ও তোমাকে পাওয়ার যোগ্যতাই রাখে না। কতটা বাজেভাবে ও তোমায় ঠকিয়েছে সেটা ভুলে যাচ্ছো কেনো ? তোমার আগেও কত মেয়ের সাথে সম্পর্কে গিয়েছে। হোক সেটা সোশ্যাল। এসব করে গিয়ে তোমায় মিথ্যে বলেছে। নিজের একটা মিথ্যে পার্সোনালিটি বানিয়ে তোমায় সেটার উপর মায়া তৈরি করে দিয়েছে। তোমাকে যেটা দেখিয়েছে আদতেও সে সেটা নয়। তোমার সাথে সম্পর্কে থাকা অবস্থাতেই তো অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্কে ছিলো। তোমার বারবার জিজ্ঞাসা করার পরেও কত সূক্ষ্ম ভাবেই না মিথ্যা বলে গেলো অবলীলায়। ওর মধ্যে কোনো ভয় নেই। আমি যদি সব মনে রাখতে পারি তবে তুমি কেন পারবি না বলো ? তুমি তো সে মেয়েটা যে আমাকে প্রতিনিয়ত শক্ত হতে সাহায্য করেছো। শুরু থেকে এ অব্দি ।”
শুভ্রার কথাগুলো গাঁয়ে মাখলো না ব্যক্তি টি। চুপচাপ হয়ে থাকলো কিছু সময়। শুভ্রাও অপেক্ষা করলো ব্যক্তির উত্তরের। অতঃপর হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে নিলো ব্যক্তি টি। অন্যদিক তাকিয়ে বললো,
-“সব মনে আছে আমার। ভুলিনি কিছুই। কিন্তু তাকে নিয়ে আমার দেখা ছোট ছোট স্বপ্ন গুলো যে পূর্ণতা পাবে না ? ”
কন্ঠ খানিক শান্ত শুনালো। মুচকি হেঁসে ফেলে শুভ্রা। এবার হয়তো মানুষ টা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যাবে।
-“কেনো ? তোমার কি এবিলিটি নেই ? নিজের স্বপ্ন নিজে পূরণ করবে। পরপুরুষ কে কেনো টানবে ? তুমি না হেদায়েত হয়ে গিয়েছো ? এই তার নমূনা ? আল্লাহ বুঝি খুশি হলো আজকের এই ঘটনা তে ? তুমি আল্লাহ কে রেখে তার সৃষ্টির জন্য চোখের জল ফেলছো !
বোরকা , হিজাব, নিকাব , গ্লাভস আর মোজা পড়ে নিজেকে বাহিরের থেকে আলাদা রাখতে শিখেছো।মান রাখবে না তুমি এর ? আল্লাহ কিন্তু উত্তম পরিকল্পনাকারী। তিনি সব বুঝে শুনেই করেন। ভরসা রাখো তার উপর। যা হবে ভালো হবে। তোমার ভাগ্যে যদি আরাফ থাকে তবে দুনিয়ার কোনো মানুষের ক্ষমতা নেই তাকে তোমার ভাগ্য থেকে মুছে আনার যদি আল্লাহ না চায়।”
এবারের কথাগুলো ব্যক্তি খুব মনযোগ সহকারে শুনলো।
-“আল্লাহুম্মাগফিরলি ! আমি তওবা করে নেবো। ওর বিয়ের কথা শুনে আমি বেমালুম ভুলে বসেছিলাম। আল্লাহ আমায় মাফ করে দিক।
আমি আর এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাবো না। ইন-শা-আল্লাহ। ”
-“এইতো বুঝেছো ! তো এবার চোখের জল মুছে চলো।
তোমায় আজ আমি বোরকা উপহার দেবো।আরাফের বিয়ের দিন সেটা পড়বে। ওকে দেখতে নয় , পাপের শেষ দেখতে। ”
-“হুম চলো !”
~~
আজ তাসবির সব বেন্ডেজ খুলে দেওয়া হবে। একটু আগেই ডক্টর এসেছেন। পর্যবেক্ষণ করে সব পজিটিভ বলেছেন। এবার নার্স বেন্ডেজ গুলো খুলে দেবে। তাসবির পুরো রুম জুড়ে আছে সার্ভেন্ট আর নার্স। একজন ভিডিও করছেন , শুভ্রা কে পাঠাবে বলে। তা দেখেই মলিন হাঁসির রেখা টানলো মুখে। আজকের এই দিনে অন্তত ওকে পাশে চেয়েছিলো। কিন্তু মানুষ টা এতোটাই ব্যস্ত, যে দুদিন ধরে তার সাথে কোনো কথাই বলেনি। মাঝেমধ্যে তার মনে হয় আদৌও শুভ্রা ওকে ভালোবাসে ? নাকি মিছেমিছি !
#চলবে
#প্রণয়ডোর
l২৬l
-রামিশা আঞ্জুম বুশরা
শপিং করতে করতেই সময় এগিয়ে এসেছে ৫ ঘন্টা। রাত বাজে ১১:২০ । এখনো মিসেস মির্জার নিকট থেকে কোনো ফোনকল আসেনি। তার শপিং প্রায় শেষ। নিজের জন্য মেরুন কালারের লং গাউন তার সাথে ম্যাচিং হিজাব। ফারিয়া আপুকে কিনে দিয়েছে সেইম ডিজাইনের লং গাউন। কালার টা শুধু ভিন্ন। আর তাসবির জন্য নিয়েছে অফ হোয়াইট শার্ট এন্ড ডার্ক মেরুন ব্লেজার , সাথে প্যান্ট। তখন ওভাবে আকুতি করা ব্যক্তিটি ফারিয়া’ই ছিলো। ফারিয়া আর আরাফের সম্পর্ক ছিল তিন বছরের। প্রথম প্রথম সব স্বাভাবিক থাকলেও সম্পর্কের আড়াই বছর থেকেই ওর পরিবর্তন শুরু হয়। আরাফের এমন ধীরে ধীরে পরিবর্তন হওয়া টা ফারিয়া কে খুব যন্ত্রনা দিতো। তবুও ভালোবাসে বিধায় সবটা চুপচাপ মেনে নিতো। মেডিকেল স্টুডেন্ট ফারিয়া। সারাদিন পড়লেও বই তাকে ছাড়তেই চাইতো না। এতো এতো পড়া ছিলো তার সেমিস্টার গুলোতে ! তবুও সময় বের করে কথা বলে যেতো।
তখনই তার ভাই তাসবি শুভ্রার গুরুদায়িত্ব দেয়। তাসবি শুভ্রার আলাদা আইডেন্টিটি’র জন্য উপরমহলে যোগাযোগ করে ওনাদের কে কিছুটা জানিয়ে শুভ্রা কে ফারিয়ার ব্যাচে এডমিট করে দেয়। কাজটা ওতো সহজ না হলেও যখন জানতে পারলো শুভ্রা স্পেশাল ব্রাঞ্চের স্পেশাল গোয়েন্দা তখন আর না করতে পারেনি। যেখানে কিনা দেশের দাগী ক্রিমিনাল কে ধরার মিশন ছিলো শুভ্রার। আর এইজন্যই ফারিয়া কে কখনো আপু , বান্ধবী নজরে ব্যবহার করতে হয় । মেডিকেলে ওদের সম্পর্ক ছিলো বেস্ট ফ্রেন্ড আর বাড়িতে আপু। বলা যায় ক্ষেত্র বিশেষ এ এর পরিবর্তন ঘটে। এছাড়াও হুট করে বিয়ের সম্পর্কে জড়িয়ে যায় শুভ্রা । এই সম্পর্কের খাতিরেও ফারিহা তার আপু।
অনেক সম্পর্কের বেড়াজালেই ঘনিষ্ঠ হয় ফারিয়া আর শুভ্রা। তারপর আস্তে ধীরে শুভ্রা ফারিয়ার সবচেয়ে বিশ্বাসের জায়গা হয়ে যায়। আর ফারিয়ার ও ঠিক তেমন। বয়সের বেশ পার্থক্য থাকলেও সম্পর্কে তেমন পার্থক্য নেই বললেই চলে। একে অপরের সব কথাই কমবেশি উভয়েই জানতো। আস্তে আস্তে সব খোলাশা হলো শুভ্রার কাছে। আরাফের অস্বাভাবিক পরিবর্তনে ফারিয়া ডিপ্রেশনে চলে যায়। তাসবির সাথে তেমন একটা ভালো বন্ডিং না থাকায় ওকেও বলতে পারেনি। তাই নিজেই নিজের সোর্সের দ্বারা আরাফের খোঁজ নেওয়া শুরু করে দেয়। এরপরেই একপ্রকার সহজ হয়ে যায় শুভ্রার কাজ। আরাফ ই যে তার সৎ ভাই সেটার যথেষ্ট প্রমাণ তখনই সংগ্রহ করে ফেলে সে। তারপর আরাফের ব্যাপারে ভয়ানক কিছু কথা জানতে পারে সে।
তখন থেকেই আরাফ একের পর এক মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে তাদের কে পাচার করে নেওয়াজ মির্জার কাছে দিতো আর ওনি ওদের মেরে তাদের অর্গান নিয়ে নিতো। তারপর চড়া দামে কালোবাজারে বিক্রি করতো। যা এখনোও করছে। আন্ডারওয়ার্ল্ডে সে ‘এমএম’ নামে পরিচিত। এছাড়াও এনার কুখ্যাত সব কাজের কুখ্যাত নামের উপাধি ও রয়েছে। যা ফাঁস করবে তার ছেলে আরাফের বিয়েতে। মূলত আরাফ তার বাবার সত্যিটা কোনোভাবে জেনে গিয়েছিলো। তারপর তার বাবা তার মা কে মেরে ফেলার থ্রেড দিয়ে ওকে-ও এসবের সাথে যুক্ত করে নেয়। পদে পদে পাপ আরাফের বেড়াজালে আছড়ে পড়ে। বেরিয়ে আসতে পারেনি সে। একটা সময় বাবা তাকে হুমকি দেয় যে , ফারিয়ার সাথে সত্যিকারের কোনো ভালোবাসা , অনুভূতি থেকে থাকলে তাকেও নেওয়াজ তুলে এনে বাকী মেয়েদের মতোই একই ব্যবস্থা করবেন। আরাফ ফারিয়া কে অসম্ভব ভালোবাসে।
আর নিজের জন্য তার ভালোবাসার মানুষের ক্ষতি হোক সেটা সে চায়না। সে পাপ কাজে জড়িয়ে থাকলেও সে কাজ গুলোতে অভ্যস্ত নয় বরং বাধ্য। নয়তো চলে যাবে দুটো প্রাণ। তার দুটো ভালোবাসা। মিসেস মির্জা আর ফারিয়া। এলিজা নামের যে মেয়েটাকে বাছাই করা হয়েছে আরাফের জন্য সে মেয়ের বাবা আন্ডারওয়ার্ল্ডের দ্বিতীয় মাফিয়া। আরাফ এলিজার বিয়ে হলে নেওয়াজ মির্জার ই সবচেয়ে বেশি লাভ। তার অবৈধ কাজগুলো খুব সহজেই তিনি করতে পারবেন। তাই সকলের কাছে এটাই শো করেছে এলিজা আরাফের বিয়েটা হচ্ছে আরাফের মতেই। কেননা, আরাফ এলিজা কে পছন্দ করে। আরাফ ও দেখতে শুনতে কম নয়। তাই এলিজার ও না করার কোনো যুক্তি থাকে না। বিদেশি কালচারে বড় হলেও মা-বাবার বাধ্যগত মেয়ে সে। তাই বিনাবাক্য ব্যয়ে বিয়েতে রাজি হয়েছে সে।
আর এতো সবকিছুর একটাও জানানো হয়নি ফারিয়া কে। জানালে মেয়েটা আবেগের বশে না জানি কি পাগলামো করে বসে , আর এতে ওর প্রাণ সংকট ও থাকে। তাই তো শুভ্রা বেশ বুদ্ধি খাটিয়ে দূর থেকে প্রোটেক্ট করছে ফারিয়া কে। তবে আরাফ কে তার অজান্তেই দূর থেকে সরাসরি সাহায্য করছে বলেই বলা যায়। তখনকার বলা লাইনটা ছিলো আরাফের জন্য একটা ইঙ্গিত।
ফারিয়া প্রায়সময়ই রাগ করতো আরাফের সাথে। তখন অনেক করেও রাগ ছাড়াতে পারতো না আরাফ। শেষমেষ নিজেই রাগ করে ‘কাটার সাথে করলাম , সন্ধি পায়ে পিষে ভুল’ লাইনটা বলে চলে আসতো। তারপর কীভাবে কীভাবে যেনো দুজনের ই রাগ অভিমান কমে আসতো। কাকতালীয় ভাবে এই ঘটনা ই রিপিট হতো বারংবার।
তারপর থেকেই ‘কাটার সাথে করলাম সন্ধি , পায়ে পিষে ভুল’ লাইনটা তাদের ভালো কিছুর সাইন হয়ে দাঁড়ায়। তাদের সম্পর্কে কাঁটা ছিলো রাগ, অভিমান।
আর যেই এই লাইনটা বলতো তার মানে হচ্ছে সে অপর পাশের মানুষটার রাগ, অভিমান তৈরি করে বড্ড বেশি অপরাধ করে ফেলেছে !
তারপর ই তো তাদের সব রাগ, অভিমান মুছে যেতো। আর সেখানে আজ ? পরিস্থিতি আরাফ কে কোথায় নিয়ে গিয়েছে। তবে এ পরিস্থিতি থেকে ওদের বের করে এনে পূর্ণতা পাইয়ে দেওয়ার জন্য নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করবে শুভ্রা। বাকীটা আল্লাহ পাকের উপর।
এইসব ভাবতে ভাবতেই ইতোমধ্যে তাদের সব কাজ শেষ। এবার শুভ্রা আর ফারিয়া ফোর্থ ফ্লোরে যেতে থাকলো। যাওয়ার সময় বলে ফেললো বাসায় গিয়ে কোন গুরু দায়িত্ব টা ওকে পালন করতে হবে। যেন কোনোমতেই কোনো ভুল না হয়। ব্যক্তি টি কে অবশ্যই ধরতে হবে।
অতঃপর ফোর্থ ফ্লোরে গিয়ে বেলকনির একটা সাইডে এসে দাঁড়িয়ে গেলো। আশপাশ ভালো করে দেখে নিলো। সেখানটায় লোক সমাগম খুব কম। জায়গা টা খানিকটা নিরাপদ বলে মনে করলো সে। তাই ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কল করলো তাসবির ফোনে। রিং হচ্ছে , কিন্তু কেউ কল তুলছে না।
আর ফারিয়াও ভীষণ খুশি এক সপ্তাহ পর ভাইকে দেখবে ফারিয়া। ভাইয়ের এক্সিডেন্টে সেও কম শোকে থাকেনি। তবে শুভ্রার এহেন নরমাল বিহেভিয়ার ফারিয়া খানিকটা আন্দাজ করে চুপ থেকে গিয়েছে। আজ ফাইনাললি সে তার ভাইকে দেখবে। তবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে একবার ভেবে নিলো নিজের ভাঙা চোরা হৃদয় নিয়েই হয়তো বাকিটা জীবন তার কাটাতে হবে। তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে এলো। সব বিরক্ত লাগলো তার কাছে।
তখনই কলটা রিসিভ হলো। সার্ভেন্টের গোঙানোর আওয়াজ শোনা গেলো। তাসবির আধো আধো বলা কথাটাও শুভ্রার কানে এলো। ‘এদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছো ! আর আমায় এভাবে মেরে কেনো ইঞ্জেকশন পুশ করছো ??’
#চলবে