প্রণয়ী পর্ব-১১+১২

0
143

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|১১.|
(লেখা কপি করা নিষেধ)

………..

মিটিং বসেছে যেখানে এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত রয়েছে। এটাকে মিটিং বললে ভুল,বিচার বললে ঠিক হবে। আর সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু জাইন। এক পাশে কমিশনার,কাউন্সিলর সহ দলের আরো নেতারা রয়েছে। অপরপাশে এমপি খালেকুজ্জামান সহ অন্য আরো নেতারা রয়েছে। এরা সকলেই বাঙলা দলের লোকজন। জাইন এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার পিছনেই মারুফ,শাকিল,রফিক রয়েছে।

কমিশনার প্রথমে মুখ খুলে,’দেখেন আপনাকে আমি বড় ভাই মানি তাই এখনো চুপ আছি না হলে সাথে সাথে আমি ব্যবস্থা নিতাম। ওর সাহস কত আমার ছেলের গায়ে হাত দেয়।’

কাউন্সিলর সায় দিয়ে বলে,’এসব পোলাপানকে বেশি আশকারা দিলে বিপদ। আপনাদেরকে তো আগেই বলছি এটারে দল থেকে বের করেন। দুইদিন পরপর ঝামেলা করে।’

মারুফ বলে,’জাইনের কি দোষ ও তো যা করছে ঠিকই করছে। খালি খালি তো আর মারে নায়।’

শাকিল মারুফের হাত চেপে তাকে চুপ থাকতে বলে।

কমিশনার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলে,’কি বেয়াদব দেখেন। এইসব ছেলেপেলে দিয়ে দল আরো ডুববে। আপনি এদের একটা ব্যবস্থা করেন।’

খালেকুজ্জামান চুপ করে ট। শুনে জাইনের দিকে তাকায়।
‘তুমি কি কিছু বলতে চাও?’

খালেকুজ্জামানের প্রশ্ন শুনে জাইন মাথা তুুলে তাকায়।
‘আমার তেমন কিছু বলার নেই। যদি মনে হয় ভুল করেছি তাহলে শাস্তি দিবেন।’

‘তুমি ছেলেটাকে মেরেছো কেনো?’

‘এক মেয়েকে নোংরা প্রস্তাব দিয়েছিলো সে রাজি হয়নি তাই তার ওড়না টেনে নিয়ে গিয়েছিলো। মেয়েটার জায়গায় আমার বোনের সাথে কেউ এমন করলে আমি ভাই হিসেবে যেই কাজটা করতাম সেটাই করেছি।’

জাইনের কথা শেষ হলেই খালেকুজ্জামান কমিশনারের দিকে তাকায়।

খালেকুজ্জামান বলে,’শুনলেন তো সব।’

কমিশনার সাথে সাথে বলে,’এগুলা মিথ্যা কথা। আমার ছেলে এইসব কাজ করতেই পারে না।’

মারুফ ফোন থেকে একটা ভিডিও বের করে সকলের সামনে প্লে করে।
‘এই ভিডিও আপনার ছেলে করে আর সেটা সে টিকটকে আপলোড করেছে।’

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে কমিশনারের ছেলে বাইকে বসে মেয়েটার ওড়না টানছে আর আজেবাজে কথা বলছে। ভিডিওটা দেখে কমিশনার মাথা নিচু করে ফেলে। সে হয়তো ভিডিও এর কথা জানতেন না। জানলে আজকে এখানে উপস্থিত হতেন না।

খালেকুজ্জামান বলে,’ব্যস সবটা তো তাহলে পানির মতো পরিষ্কার। আর কারো কিছু বলার আছে? যেহেতু ওর এখানে কোনো অপরাধ নেই সেহেতু বিচার হচ্ছে না কোনো।’

কমিশনার মুখ কালো করে বসে রইলো। বুঝা গেলো বিচারে সে খুশি না।

খালেকুজ্জামান জাইনের দিকে তাকিয়ে বলে,’তো জাইন রহমান আপনার নামে অনেক বিচার এসেছে। আপনি নাকি জনতা দলের ছেলেদেরও মেরেছেন। কেউ উনিশ বিশ করলেই মারেন। আমি জানি আপনি বিনা দোষে কাউকে মারেননি তবুও বলবো মেজাজটা একটু কন্ট্রোল করার চেষ্টা করবেন। সবাইকে মারলে তো হয় না।’

জাইন জবাব দেয়,’চেষ্টা করবো কন্ট্রোল করার।’

অতপরঃ জাইনের টপিক শেষে অন্য বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। দলের আলোচনা চলে অনেকক্ষণ।

…..

রাতের বেলায় খাবারের টেবিলে মাসুদা ভাত নাড়ছে আর আঁড়চোখে বাকিদের দেখছে। অন্য সময় খাবারের টেবিলে বেল্লাল হোসেন তুহিন টুকটাক বিষয় আলোচনা করে কিন্তু মাসুদা আসলে তারা নিরব থাকে। উনি একটা কথার সূত্র পেলে সেটা টেনে গ্রাম পর্যন্ত নিয়ে যায়। তাকে সবাই হাড়ে হাড়ে চিনে। তাই তো চুপচাপ রয়েছে। তুহিন অন্য সময় বাসায় ছোটখাটো বিষয় নিয়ে চেঁচামেচি করলেও মাসুদা আসলে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে।

‘দুলাভাই আপনার দোকান কেমন চলে?’

‘আলহামদুলিল্লাহ চলছে ভালো। তা তোমার ছেলেমেয়েদের কি অবস্থা?’

‘এতক্ষণে জিগাইলেন। আমি তো ভাবছি আপনারা বোবা হইয়া গেছেন অথবা আমার লগে কথা কইতে ভাল্লাগে না।’

বেল্লাল হোসেন জোর পূর্বক হেসে বলে,’আরে মাসুদা কি যে বলো। তুমি প্রিয়তার মায়ের বড় হলেও এখনো ছোটই রয়ে গেছো।’

বেল্লাল হোসেন মাসুদার এক বছরের বড়।

মাসুদা বলে,’দুলাভাই আমার কাছে একটা ভালো পাত্র আছে। পোলাডা বিদেশ থাকে। মাসে লাখ টাকা ইনকাম করে। প্রিয়তারে ঐ বাড়ি বিয়ে দিলে পায়ের উপর পা তুইল্লা খাইবো। আপনাগো ও কষ্ট কিছুডা কমবো। বিয়ে পর পোলার থেকে সাহায্য নিতে পারবেন।’

তুহিন বিরক্তি নিয়ে বলে,’খালা খাওয়ার সময় বেশি কথা বলা ভালো না।’

মাসুদা ভেংচি দিয়ে বলে,’তোর থেইকা আমার শেখা লাগবো কোনডা ভালো আর কোনডা মন্দ?’

মিসেস মাসুমা বলেন,’আপা বাদ দেন পোলাপানের কথা ধইরেন না।’

বেল্লাল হোসেন বলেন,’আপাততঃ আমরা প্রিয়তাকে বিয়ে দিবো না।’

তুহিন বলে,’হ্যা ওরে শোকেসে সাজাইয়া রাখবো। বয়স বাড়লেও এ বাড়িতেই ও থাকবে।’

তুহিনের কথায় বেল্লাল হোসেন কিছুটা আহত হন। ছেলেটা বরাবরই মেয়েটাকে দেখতে পারে না। প্রিয়তার জন্ম থেকেই অজানা কারণে তুহিনের তার প্রতি একরাশ রাগ। তার ধারণা প্রিয়তাকে বিয়ে দিলে তবেই তুহিনের এ রূপ আচরণ বন্ধ হবে।

এত কিছুর মধ্যে প্রিয়তা চুপচাপ খাচ্ছে। তার এখন অসহ্য লাগে এসব। যেই বিষয়েই কথা শুরু হোক শেষ হয় তাকে নিয়ে।

মিসেস মাসুমা বলেন,’আপা আমরা পরে এই বিষয়ে কথা বলবনি এখন থাক।’

মাসুদা বলে,’তুহিন কিন্তু খারাপ কিছু কয় নায়। মাইয়া মানুষ ঘরের বোঝা।’

প্রিয়তা হুট করে বলে,’যেদিন মনে হবে এ বাড়িতে আমি বোঝা সেদিন আমি নিজেই নিজের ব্যবস্থা করবো।’

প্রিয়তার এমন কথায় সকলে হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকায়। এমনিতে প্রিয়তা কথা কম বলে। তাকে অপমান করলেও জবাব দেয় না কিন্তু আজ সে জবাব দিলো তাও এমন যা আশ্চর্য হওয়ার মতো।
সকলের প্রথমে খাওয়া শেষ করে প্রিয়তা উঠে রান্নাঘরে চলে যায়। এরপর হাত ধুয়ে সোজা নিজের কক্ষে। বসে যায় টেবিলে। কক্ষের বাতি বন্ধ করে টেবিলের ল্যাম্প জ্বালিয়ে বই খুলে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সে ব্যর্থ হয়। বারবার খাবার টেবিলের কথাগুলো মাথায় ঘুরছে তার। জানালার পর্দা একটু সরিয়ে গগণের পানে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। একটু নিরিবিলি বসতে পারলে তার ভালো লাগতো। আজকে সন্ধ্যায় ছাদে যেতে পারেনি মাসুদার কারণে। সে মিসেস মাসুমাকে পাশের ফ্ল্যাটে যেতে দেয়নি ঘরে বসে গল্প করেছে ফলে প্রিয়তা ছাদে যেতে পারেনি। ছাদে একা বসে থাকতে তার ভালোই লাগে।
হঠাৎ প্রিয়তার নজর যায় রাস্তায় থাকা বাইকের দিকে। সেখানে কেউ বসে সিগারেট টানছে। ভ্রু কুঁচকে ভালো করে অবয়ব খেয়াল করতেই বুঝে এটা কে।
সিগারেটে টান দিয়ে উপরে তাকাতেই জাইন দেখে প্রিয়তার কক্ষের বাতি জ্বলছে। সিগারেটটা ফেলে সে বাইক থেকে নেমে সোজা হয়ে আলোতে এসে দাঁড়ায়। প্রিয়তা ইতিমধ্যে জানালার পর্দা টেনে দিয়েছে।
জাইন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে প্রিয়তার দেখা পাওয়ার জন্য। কিন্তু জানালার ধারে প্রিয়তার ছায়ার অবধি দেখা পায় না সে। দুঃখ ভার কান্ত হৃদয়ে বাইকে উঠে বসে সে। সন্ধ্যায় একবার এসেছিলো ছাদে। প্রিয়তাকে না পেয়ে মিটিং শেষে রফিককে নিয়ে এসেছিলো সে। এরপর তাকে চলে যেতে বলে সে এতোক্ষণ অপেক্ষা করছিলো প্রিয়তাকে একবার দেখার জন্য। দেখা না পেয়ে মন মেজাজ আরো খারাপ হয়। হাতের ক্ষত নিয়েই বাইক স্টার্ট দেয়। বাইক টান দিয়ে বাসার দিকে রওনা দেয়। বাইকের শব্দ পেয়ে প্রিয়তা বুঝে জাইন চলে গেছে। একটুপর পর্দা সরিয়ে নিশ্চিত হয়।

জাইনকে তার অদ্ভুত লাগে। ছেলেটা না তাকে বিরক্ত করে না তাকে কিছু বলে। অথচ ছেলেটাকে দেখলে মনে হয় কত কিছু বলতে চায় শুধু তাকে দেখলে সে কিছু বলতে পারে না। প্রিয়তার মনে হয় তার কঠোর দিকটা হয়তো জাইন ভয় পায়। এলাকার গুন্ডা তাকে ভয় পায় ব্যাপারটা দারুন না? ছেলেটাকে প্রিয়তার খারাপও লাগে না আবার ভালোও লাগে না। শুধু অদ্ভুত লাগে। আর যখন জাইন তাকে কিছু বলতে গিয়ে চুপ হয়ে যায় তখন তার ঐ অসহায় মুখটা দেখে প্রিয়তার হাসি পায়। তার জায়গায় রিমি হলে নিশ্চয়ই খিলখিল করে হাসতো? প্রিয়তা তা পারে না। সে কাউকে আশকারা দিতে চায় না। এমনিতেই তার পায়ে পায়ে দোষ।
প্রিয়তার ভাবনার মাঝে মাসুদা তার কক্ষে আসে। সে প্রিয়তার সাথে ঘুমাবে। অবশ্য যতক্ষণ সে না ঘুমাবে ততক্ষণ প্রিয়তা বিছানায় যাবে না। একা একা বিরবির করতে করতে এক সময় মাসুদা ঘুমাবে।

___________

আজকে ভার্সিটির অডিটোরিয়ামে কয়েক ডিপার্টমেন্ট মিলে মেলার আয়োজন করেছে। যেখানে ভার্সিটির স্টুডেন্টরা নিজেদের পন্য বিক্রি করবে। বলা যায় উদ্দোক্তা মেলা। প্রিয়তাদের ডিপার্টমেন্টের নাম সেখানে নেই। উল্টো তাদের ডাবল ক্লাস রাখা হয়েছে আজকে। লাইব্রেরীতে বসে আজকের ক্লাসের টপিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে প্রিয়তা। হৈমন্তীর জ্বর থাকায় আজকে সে আসেনি।
দু কাপ কফি এনে রিমি প্রিয়তার পাশে বসে।
ফিসফিস করে বলে,’শুনলাম মেলা উপলক্ষে জান ভাইকে ইনভাইটেশন দিয়ে আনা হয়েছে। মেয়েরা সেখানে ভীড় জমিয়েছে।’

রিমির কথা না শোনার ভান করে রইলো প্রিয়তা। শুনলেই বিপদ! রিমি একবার শুরু করলে আর থামবে না।
রিমি প্রিয়তাকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বললো,’ঐ শুনছিস কি বলছি?’

প্রিয়তা অগ্নি দৃষ্টিতে রিমির দিকে তাকায়। বিপদ সংকেত বুঝে রিমি দাঁত বের করে হাসি দিয়ে কফি খাওয়াতে মনোযোগ দেয়। প্রিয়তা কফিতে এক চুমুক দিয়ে আবারো পড়ায় মনোযোগ দেয়।

‘এই তোমরা সব এখানে কি করো মেলায় যাচ্ছো না কেনো?’
এক সিনিয়র এসে সকলের উদ্দেশ্যে বলে।

অনেকে অনেক রকম উত্তর দেয়। প্রিয়তা কোনো উত্তর দেয় না। ক্লাস শেষ করে মেলায় যেতো। অবশ্য না গিয়ে উপায় নেই রিমি তাকে ঠিকই টেনে নিয়ে যেতো। তবে এখন যাবে না কারণ না অবশ্যই জাইন।

একটু পর কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ কানে আসে প্রিয়তার তবুও সে চোখ তুলে তাকায় না। রিমি চোখ বড় বড় করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।

‘ঐ জান ভাই এখানে আসছে।’
রিমির কথা শুনেও প্রিয়তা চুপচাপ থাকে। মাথার ওড়না ভালো করে টেনে দেয় যাতে তাকে দেখা না যায়।

জাইন স্টুডেন্টদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করছিলো আর লাইব্রেরীর চারিদিকে চোখ বুলিয়ে একজনকে খুঁজছে। আজকে তার দেখা না পেলে কি করবে নিজেও জানে না।
প্রিয়তা রিমির পাশ থেকে উঠে লাইব্রেরীর ভেতরে হাঁটা দেয় বুক শেলফের দিকে। রিমি ভাবে সে কোনো বই আনতে যাচ্ছে। জাইন ঘুরতেই আকাশী রঙের কামিজ দেখে প্রিয়তাকে চিনে ফেলে। মারুফকে ইশারা দিয়ে সে সেদিকে হাঁটা দেয়। মারুফ বুঝে নেয় এবার পরিস্থিতি সামলাতে হবে। শাকিলকে কনুই দিয়ে খোঁচা দিয়ে ইশারা করে। দু’জনে মিলে জাইনের সাথে একটু আগায়। এমন ভান করে যেনো কেউ বুঝতে না পারে।

রিমি উঠে যেতে নিলে মারুফ এসে দাঁড়ায়।
‘আপনাকে চেনাচেনা লাগছে। কোথায় যেনো দেখেছি মনে হচ্ছে।’

রিমি মুখ ঘুরিয়ে বলে,’আমি আপনাকে চিনি না। সরুন আমার বান্ধবীর কাছে যাবো।’

‘মনে হচ্ছে মনে পড়েছে। আপনি সে না যে চোখ হাতে নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটেন আর ধাক্কা খান?’

মারুফের কথা শুনে রিমি কটমট চোখে তাকায়।
‘আপনি আমাকে কানা বললেন?’

‘দেখো মেয়ের কান্ড আমি কখন আপনাকে কানা বললাম? এখন তো চোখের সাথে মনে হচ্ছে কান দুটো চিলে নিয়ে গেছে তাই উল্টোপাল্টা শুনছেন। সাবধান ক’দিন পর আবার আপনাকে না কেউ তুলে নিয়ে যায়।’

‘আপনার মতো ছেলের সাথে তর্ক করার কোনো ইচ্ছে নেই। রাস্তা ছাড়ুন আমি আমার কাজে যাবো।’

‘আপনার বয়ফ্রেন্ড আছে?’

‘কেনো?’

‘বলুন না।’

রিমি ভাব নিয়ে বলে,’হ্যা আছে তো?’

‘জানতাম আছে। নাম নিশ্চয়ই জায়েদ খান।’

কথাটা বলেই মারুফ একদফা হাসে। মারুফের সাথে শাকিল আর রফিকও যোগ দেয়।

হাসি থামিয়ে মারুফ বলে,’আপনি কি জায়েদ খানের মতো ডিগবাজি দিতে পারেন? একটা ডিগবাজি দিবেন প্লিজ?’

এবার রিমি প্রচন্ড ক্ষেপে যায়। ইতিমধ্যে অনেকে মুখ চেপে হাসতে শুরু করেছে। যা রিতীমতো অপমান।

‘অসহ্য’ বলেই ব্যাগ তুলে রিমি হাঁটা দেয়।

পিছন থেকে মারুফ ডাক দেয়,’এই যে মিস নাম কি আপনার? মিস মেন্টাল কেস শুনুন রাগ করবেন না।’

ততক্ষণে রিমি লাইব্রেরীর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
হাসি থামিয়ে মারুফ,শাকিল,রফিক নিজেদের কাজ শুরু করে।

প্রিয়তা শেষের সারির দুটো শেলফের মাঝে দাঁড়িয়ে শিটে চোখ বুলাচ্ছে। লাইব্রেরীটা বেশ বড়। এক পাশে স্টুডেন্টের বসার ব্যবস্থা করা অপরপাশে বুক শেলফ দিয়ে সাজানো। এতো পিছনে তাকে কেউ খুঁজতে আসবে না। কিন্তু তার ধারণা মিথ্যে হয়।

‘অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না।
এবার হৃদয় মাঝে লুকিয়ে বোসো
কেউ জানবে না,কেউ বলবে না।’

হঠাৎ পুরুষালী কন্ঠ পেয়ে ডান পাশে চোখ তুলে তাকায় প্রিয়তা। জাইনে হাসি মুখে তার থেকে দুই হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়তা বামে হাঁটা দিতেই তার হুঁশ হয় এ পাশে শুধু দেয়াল বের হওয়ার পথ নেই। বের হওয়ার পথে দাঁড়িয়ে আছে জাইন।

জাইন বুক শেলফে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। প্রিয়তা মাথা উচিয়ে সিসিক্যামেরাটা দেখে নেয়।

‘ওটা নষ্ট। আমি আসার সময় দেখে এসেছি।’

‘সরুন আমি বের হবো।’

‘যাও আমি তো তোমায় ধরে রাখিনি।’

‘আপনি না সরলে আমি কিন্তু চেঁচাবো।’

জাইন বিনা শব্দে হাসে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই মারুফ আর শাকিল মিলে সকলকে বের করে দিয়েছে। সে ইশারায় তাই বলে এসেছে।
প্রিয়তা বুঝতে উঠতে পারে না জাইনের উদ্দেশ্য। ছেলেটাকে গুন্ডা মনে হয় কিন্তু কখনো মনে হয়নি চারিত্রিক সমস্যা আছে। কিন্তু আজকে মনে হচ্ছে তার ধারণা ভুল। অবশ্য সে ঠিক করে রেখেছে কাছে আসতে নিলেই কয়েকটা চড় বসিয়ে দিবে।

‘আপনি কি সরবেন নাকি আমি চেঁচাবো?’

বাম হাত দিয়ে চুল গুলো পিছনে ঠেলে জাইন বলে,’লাইব্রেরীতে এখন কেউ নেই শুধু তুমি আর আমি ছাড়া।’

প্রিয়তা চমকে প্রশ্ন করে,’মানে?’

‘মানে লাইব্রেরী সম্পূর্ণ খালি শুধু দুজন আছে।’

এবার প্রিয়তা জাইনের কথার মানে বুঝে। সে খানিকটা ঘাবড়ে যায় তবে বুঝতে দিতে চায় না।

‘ভয় পেয়ো না জাইন সাথে থাকলে তুমি নিরাপদ।’

‘আমি আপনাকে মোটেও বিশ্বাস করি না।’

প্রিয়তার কথা শুনে এবারো জাইন হাসে। প্রিয়তা যা ই বলে তা ই জাইনের কাছে ভালো লাগে। বলা যায় প্রিয়তার সব কিছুই তার ভালো লাগে।

‘আপনি কি তামাশা করতে এখানে এসেছেন?’

‘উহু অন্য কারণে। কিন্তু সেটা তোমায় বলবো না।’

জাইনের ইচ্ছে করে বলতে ‘আমি তো সব কাজ ফেলে এসেছি শুধু তোমায় দেখতে প্রিয় তা কি তুমি বুঝো না?’
ভেতরের কথা ভেতরেই থেকে গেলো বাহিরে প্রকাশ করলো না সে।

‘দেখুন।’

‘দেখছি তো।’

‘তামাশা বন্ধ করুন আর আমাকে যেতে দিন।’

‘আচ্ছা যাও।’

জাইন সরে দাঁড়ায়। প্রিয়তা অবাক হয় জাইন এতো সহজে তাকে যেতে দিচ্ছে দেখে। সময় নষ্ট না করে প্রিয়তা বের হয় শেলফ থেকে। বেরিয়ে দেখে সত্যি সত্যি কোনো স্টুডেন্ট সেখানে নেই। এমনকি লাইব্রেরীর দরজাও লাগানো।
জাইন হেলেদুলে তার পিছন পিছন আসে।

প্রিয়তা ক্ষিপ্ত গলায় বলে,’সমস্যা কি আপনার? লাইব্রেরীর দরজা বন্ধ করেছেন কেনো?’

‘আমি কই বন্ধ করলাম? আমি তো তোমার সাথে এলাম। হয়তো কেউ ভুলে বন্ধ করেছে।’

‘এখন বের হবো কীভাবে?’

‘দাঁড়াও আমি কল দিচ্ছি।’

ফোন বের করে জাইন বলে,’শিট!ফোনের ব্যাটারি ডেড। তোমার ফোনটা দাও কল দিয়ে ওদের খুলে দিতে বলি।’

প্রিয়তা দোটানায় পড়ে যায় ফোন দিবে কিনা।

‘আরে দাও দ্রুত। কেউ দেখার আগে বের হতে হবে।’

প্রিয়তা ব্যাগ থেকে ফোন বের করে জাইনের হাতে দেয়। জাইন কাউকে কল দেয়।

‘দরজা খোল।’
অপর পাশ থেকে কি বললো শুনতে পায়নি প্রিয়তা। কল কাটার পূর্বেই দরজা খুলে গেলো। জাইনের হাত থেকে ফোন কেঁড়ে নিয়ে হাঁটা দেয় প্রিয়তা। পিছনে তাকিয়ে দেখার প্রয়োজনবোধ করলো না।

রিমিকে খুঁজতে খুঁজতে ক্লাসে চলে যায়। সেখানেই রিমিকে দেখতে পায়। হঠাৎ ফোনে মেসেজ আসার শব্দ হয়। ফোন বের করে মেসেজটা দেখে।

‘এতো রাগ করলে বুদ্ধি তো কমে যাবে। এই দেখো রাগের মাথায় তোমার নাম্বারটা আমাকে দিয়ে গেলা। ঠান্ডা মাথায় থাকলে এই ভুল হতো না। আমার নাম্বারটা সেভ করে রাখো আর শুনো ভুলেও আমাকে ব্লক দেওয়ার চিন্তা কোরো না। ব্লক দিলে সোজা বাসায় গিয়ে ব্লক খুলাবো।’

মেসেজটা পড়ে প্রিয়তার ইচ্ছে করে ফোন দিয়ে নিজের মাথায় একটা বাড়ি মেরে অজ্ঞান হয়ে যেতে। রাগে তার তারা শরীর কাঁপছে। শেষে কিনা এমন একটা মস্ত বড় ভুল করলো সে!

…….
(চলবে..)

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|১২.|

(লেখা কপি করা নিষেধ)
……….

‘ছাদে আসো প্লিজ।’

মেসেজের টুংটাং শব্দে ফোনটা হাতে নিয়েছিলো প্রিয়তা। মেসেজ ওপেন করতেই উপরোক্ত মেসেজটা দেখতে পায়। ফোন টেবিলে রাখতেই আবারো মেসেজ আসার শব্দ হয়।

‘আমি অপেক্ষা করছি। একটু সময়ে জন্য আসো প্লিজ।’

প্রিয়তা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো তার বের হওয়ার সময় হয়েছে। আজকে সন্ধ্যার সময় পড়াতে এসেছিলো। তার ছাত্রী বিকালে ঘুরতে গিয়েছিলো তাই তো এই সময় এসেছে সে। দশ মিনিট পর সে বের হবে এখান থেকে। এখন এই মেসেজ আসাতে কেমন উশখুশ লাগছে তার। বাসায় যেতে দেরি হলে তার মা নানান প্রশ্ন করবে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। সে দিন ভার্সিটিতে জাইনের সাথে দেখা হওয়ার পর দু দিন আর তার দেখা পায়নি। এমন কি সে আর মেসেজও দেয়নি। যতটা খারাপ জাইনকে ভেবেছিলো ততটা খারাপ সে নয় সেটা পরে মনে হয়েছে। আজকেই আবার মেসেজ এলো। প্রিয়তা কি করবে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

এরিমধ্যে প্রিয়তার ছাত্রী লক্ষ করে সে অন্যমনস্ক হয়ে আছে। সে তো রিতীমত প্রশ্ন করে বসে প্রিয়তার মন খারাপ কিনা। প্রিয়তা তাকে পড়ায় মন দিতে বলে।

পড়ানো শেষ করে গুটি গুটি পায়ে বাসার বিল্ডিং এর দিকে এগুতে থাকে প্রিয়তা। তৃতীয় তলায় উঠার পর ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে আবারো চিন্তা করে কি করবে।
শেষে ছাদের দিকে রওনা দেয় সে। ছাদের দরজায় এসে আবারো চিন্তা করে ভেতরে যাবে কিনা। জাইনকে তার পছন্দ না তবুও কেনো জানি মনে হচ্ছে একটু দেখা দরকার সে কি বলবে। পরক্ষণেই ছাদে প্রবেশ করে। বেঞ্চে জাইন একাই বসা ছিলো। প্রিয়তা বেঞ্চের অপর প্রান্তে এসে দাঁড়ায়। কি বলে ডাক দিবে খুঁজে পায় না।

‘ভেবেছিলাম আসবা না।’

‘আমি আপনার জন্য আসিনি।’
চট করে কথাটা বলে প্রিয়তা।

‘আমি আমার জন্য ডাকিনি। ডেকেছি অন্য প্রয়োজনে।’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকায়। জাইন বসা থেকে উঠে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়ায়।

‘এদিকে আয়।’
জাইনের ডাকে ছাদের পিছনের দিক থেকে তিনজন বেরিয়ে আসে। এদের মধ্যে মারুফ,শাকিলও রয়েছে। আর সাথে একজন ছেলে আর মেয়ে। যাদেরকে প্রিয়তা চিনে না।

‘ওর নাম মকবুল আর সাথে ওর গার্লফ্রেন্ড অনু। ওরা পালিয়ে এসেছে।’

‘তোহ?’

‘ওদের বিয়ে দিবো তাই তোমার সাহায্য লাগবে।’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা তার দিকে তাকায়।

সোজাসাপটা বলে দেয়,’আমি কোনো সাহায্য করতে পারবো না।’

প্রিয়তার কথা শুনে অনু এসে তার হাত চেপে ধরে বলে,’প্লিজ আপু। ভাইয়া একবার আমাকে খুঁজে পেলে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিবে। আপনি আমাদেরকে সাহায্য করুন।’

অনুর কথা শুনে প্রিয়তা কিছু বলতে নিলে জাইন বলে,’কেউ সাহায্য চাইলে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত না।’

অনু এখনো প্রিয়তার হাত ধরে অনুরোধ করেই যাচ্ছে।
প্রিয়তা জিজ্ঞেস করে,’কি সাহায্য লাগবে?’

প্রিয়তার কথা শুনে জাইনের ওষ্ঠে হাসি ফুটে উঠে।
জাইন বলে,’অনু পোশাক বদলে শাড়ি পরবে। তুমি ওকে তোমার রুমে নিয়ে গেলেই হবে।’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা চিন্তায় পড়ে যায়। বাসায় তার মা এবং খালা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অনুকে কিভাবে নিজের কক্ষে নিয়ে যাবে।

জাইন আবারো বলে,’কি হলো পারবে না?’

প্রিয়তা উত্তর দেয়,’চেষ্টা করবো তবে এটাই শেষবার এরপর আর কোনো সাহায্য আপনাকে আমি করবো না।’

কথাটা বলে প্রিয়তা হাঁটা দেয়। অনুও তার পিছন পিছন যায়।
জাইন নিঃশব্দে হেসে বিরবির করে বলে,’এটা সবে শুরু,প্রণয়ের আদি।’

ফ্ল্যাটের কলিংবেল দিতেই মিসেস মাসুমা দরজা খুলে দেয়।

মিসেস মাসুমা দরজা খুলেই প্রশ্ন করে,’এতো দেরি হলো কেন?’

প্রিয়তা উত্তর দেয়,’আরে আজকে পড়া দেখাতে সময় লাগলো।’
প্রিয়তার পিছনে বোরকা পরা এক মেয়েকে দেখে প্রশ্ন করে,’এটা কে?’

‘ও আমার বান্ধবী হৈমন্তী। একটা নোটস নিতে এসেছে।’

অনু মিসেস মাসুমাকে সালাম দিয়ে চুপ করে থাকে। বেশি কথা বললেই বিপদ।

মিসেস মাসুমা দরজা থেকে সরে দাঁড়ালে প্রিয়তা অনুর হাত টেনে নিজের কক্ষের দিকে টেনে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। দরজা বন্ধ করতেই অনু মুখোসটা খুলে। তার হাতে একটা কাপড়ের ব্যাগ যাতে শাড়ি রয়েছে। প্রিয়তা অনুকে বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে আসতে বলে।
অনু বাথরুমে গেলে প্রিয়তা দরজা খুলে রান্নাঘরে যায়। মিসেস মাসুমা পিছন পিছন দেখতে আসে প্রিয়তা কি করছে।

‘তোর এই মাসের বেতনটা কবে দিবে? আপাকে কিছু কিনে দিতাম।’

‘ওর বাবা এখনো বেতন পায়নি। বলেছে পেলেই দিবে।’

‘আচ্ছা শোন তোর বাবা এই মাসের হাত খরচের টাকাটা দিয়েছে না? ঐইটা আমাকে দে পরে বেতন পেলে সেখান থেকে রেখে দিস।’

মিসেস মাসুমার এহেন কথায় প্রিয়তা আহত হয়। সে যদি টাকাটা দিয়ে দেয় তাহলে তার হাত একদম খালি হয়ে যাবে। প্রিয়তা কিছু না বলে খাবারের থালা নিয়ে চলে যায়।
দরজা বন্ধ করতেই অনু বাথরুম থেকে বের হয়। খাবারের থালা অনুর সামনে রাখতেই সে চমকায়। সকাল থেকে না খেয়ে আছে সে। এতো টেনশনে গলা দিয়ে ভাত নামছিলো না তার। অবশ্য এখন খিদে পেয়েছে প্রচন্ড কিন্তু লজ্জায় খেতে পারবে না সে।

প্রিয়তা বোধহয় আন্দাজ করতে পারে অনুর অবস্থা।

‘আমাকে নিজের মনে করে খাবারটা খাও। এখন যদি না খেয়ে কাজী অফিসে যাও হুট করে মাথা ঘুরে পড়ে যেতে পারো এতে তোমার বিয়ের সুন্দর মূহুর্তটা নষ্ট হবে।’

অনু ছলছল নয়নে প্রিয়তার দিকে তাকায়। তার বড় বোন থাকলে বোধহয় এভাবেই আদর করতো। প্রিয়তা খাবারের থালা অনুর সামনে দিয়ে ইশারা করে খেতে। অনু গপাগপ খেতে শুরু করে। এক নলা পেটে যাওয়ার পর খিদেটা দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

খাওয়া শেষ হতেই অনুকে শাড়ি পরতে সাহায্য করে প্রিয়তা। অনুর সাথে শুধু শাড়িই ছিলো কোনো রকম গহনা ছিলো না। ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে সেখান থেকে এক মুঠ লাল রঙের কাঁচের চুড়ি বের করে অনুকে পরিয়ে দেয় সে। অনু বেশ অবাক হয়। সেখা সাথে কপালে ছোট্ট একটা লাল টিপ আর চোখে কাজল দিয়ে দেয়। অনুকে দেখে পুরোদমে বউ বউ লাগছে না,প্রিয়তার মনে হয় কিছু একটা মিসিং। আবারো ড্রয়ার হাতরে একটা ছোট্ট বক্স বের করে যেটা খুলতেই একটা নাকফুল বেরিয়ে আসে। নাকফুলটা অনুকে পরাতে নিলে সে বাঁধা দেয়।

‘আপু এটা আমি নিতে পারবো না।’

‘বড় বোন হিসেবে তোমাকে বিয়ের উপহার দিলাম নাও। আমি তোমার বোন হলে নিতে না?’

প্রিয়তার কথা শুনে অনু তাকে জড়িয়ে ধরে। দু’জনে কিছুটা সময়ের জন্য আবেগী হয়ে যায়।

জাইন ফোন বের করে বারবার সময় দেখে নিচ্ছে। সেই যে প্রিয়তা অনুকে নিয়ে গেলো আর খবর নেই। বেশি দেরি করলে সমস্যা। কাজী অফিসে রফিক সব ব্যবস্থা করে রেখেছে যাতে যত দেরিই হোক বিয়েটা আজকে যাতে হয়। সমস্যা অন্য জায়গায়। অনুর ভাই রাজনীতি করে তাও জনতা দলের সভাপতি। সে সকাল থেকে লোক লাগিয়ে হন্য হয়ে অনুকে খুঁজছে। বিয়েটা হওয়ার আগে অনু আর মকবুলকে খুঁজে পেলে বিরাট ঝামেলা বাঁধবে। বিয়েটা একবার হলে কারো আর কিছু করার থাকবে না।

‘তোর লাইলী কি অনুকে সাজিয়ে আনবে নাকি আবার ধরিয়ে দিবে?’
মারুফের প্রশ্ন শুনে জাইনের ভাবান্তর হয় না। শাকিল এসে মারুফের পাশে দাঁড়ায়।

‘এখন আমারো চিন্তা হচ্ছে। তুই ওরে একটা কল দিয়ে দেখ।’

জাইন বলে,’মেয়ে মানুষ রেডি হচ্ছে তাই হয়তো একটু দেরি। চিন্তা করিস না চলে আসবে।’

শাকিল প্রশ্ন ছুঁড়ে,’আর না আসলে?’

‘প্রিয়র উপর আমার সম্পূর্ণ ভরসা আছে।’

জাইনের কথা শেষ হতেই পায়ের শব্দ শোনা যায়। প্রিয়তা আর অনু ছাদে এসে উপস্থিত হয়েছে। অনু বোরকা পরে আছে শাড়ির উপরে। দু’জনে আসতেই শাকিল তাড়া দেয় যাওয়ার জন্য। যাওয়ার পূর্বে প্রিয়তা আর অনু একে অপরকে আলিঙ্গন করে বিদায় জানায়। অতঃপর অনুকে ধরে পাশের ছাদে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই বাসার সিঁড়ি বেয়ে তারা যাবে।

মারুফ জাইনকে ইশারা করেতেই সে তাদেরকে যেতে বলে। কথা মতো সকলে চলে যায়। এখন শুধু ছাদে জাইন আর প্রিয়তা রয়েছে। জাইন এগিয়ে এসে পকেটে দু হাত গুঁজে দাঁড়ায়। কি বলবে খুঁজে পায় না সে।
শেষে বলে,’ধন্যবাদ সাহায্যের জন্য।’

‘সাহায্য আপনাকে করিনি অনুকে করেছি।’

‘তাহলে আমাকে একটা সাহায্য করো।’

প্রিয়তা কোনো উত্তর না দিয়ে ছাদের রেলিং এর কাছে এসে দাঁড়ায়। নিচে গাড়িতে অনু সহ বাকিদের উঠতে দেখা যাচ্ছে। জাইনের ফোন বেজে ওঠে। প্রিয়তা আন্দাজ করে জাইন দেরি করছে তাই হয়তো তার বন্ধু কল দিয়েছে নিচে যাওয়ার জন্য। তার অনুমান সঠিক হয় একদম। জাইন কল রিসিভ না করে কেটে দেয়।

প্রিয়তা বলে,’আপনার এখন যাওয়া উচিত। আমিও এখন নিচে যাবো।’

জাইন ব্যস্ত গলায় বলে,’যাচ্ছি তবে আজও চাওয়া অপূর্ণ রইলো।’

প্রিয়তা কিছু না বলে জাইনের কথা শুধু শুনলো। ছাদ টপকে জাইন চলে গেলে সে আবারো রেলিং ধরে ছাদের কিনারায় দাঁড়ায়। কিছু সময় পর জাইনকে নিচে দেখা যায়। বাইকে শাকিলের পিছনে উঠে ছাদের দিকে এক পলক তাকায় সে। প্রিয়তাকে স্পষ্ট দেখা যায় না তবে তার অবয়বের দিকে সে তাকিয়ে রয়। প্রিয়তাও কেনো জানি জাইনের দিকে তাকিয়ে থাকে। শাকিল বাইক টান দিতেই জাইন চোখ সরায়। সে জানেই না প্রিয়তা তার দিকে তাকিয়ে ছিলো।

________________

আজকে ভার্সিটিতে একটা ক্লাস আছে শুধু তবুও প্রিয়তা এসেছে। গত রাতে তার জ্বর এসেছে তাই মিসেস মাসুমা তাকে বারণ করেছিলো আজকে বের হতে কিন্তু সে তবুও এসেছে। গতরাতে এরপর কি ঘটেছে সেটা নিয়ে তার চিন্তা হচ্ছে। জাইনকে মেসেজ দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো সে শুধু রিপ্লাই দিয়েছে ‘ব্যস্ত আছি পরে জানাচ্ছি’
মেসেজ দেখে প্রিয়তার আরে বেশি চিন্তা হয়। আজকে আসার সময় পুরোটা পথে জাইনকে খুঁজেছে কিন্তু পায়নি। প্রিয়তার বারবার একই প্রশ্ন জায়গে ঠিকঠাক ভাবে অনু আর মকবুলের বিয়েটা হয়েছে কিনা।

‘তুই এভাবে আছিস কেনো? কিরে তোর গা গরম!জ্বর এসেছে?’
রিমি প্রিয়তার কপালের হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘না তেমন কিছু না।’

‘তুই কোন আক্কেলে জ্বর নিয়ে বের হলি? চল তোকে বাসায় দিয়ে আসি।’

রিমি প্রিয়তার সাথে জোরাজোরি করে। সেই সময় হৈমন্তী আসে।

হৈমন্তী জিজ্ঞেস করে,’কিরে কি হয়েছে।’

‘প্রিয়ু জ্বর নিয়ে এসেছে। আজকে একটা ক্লাস না আসলেও হতো। বললাম চল বাসায় দিয়ে আসি সে যাবে না।’

রিমির কথা শুনে হৈমন্তী প্রিয়তার কপালে হাত দিয়ে দেখে।

‘সত্যিই তো তোর জ্বর এসেছে। চল বাসায়।’

প্রিয়তা বলে,’তোরা শুধু শুধু চিন্তা করছিস।’

রিমি আর হৈমন্তী জোর করতে শুরু করে। এমন সময় প্রিয়তার ফোনে মেসেজ আসার শব্দ হয়।

‘আচ্ছা রিকশা নিয়ে আয় আমি যাবো।’
প্রিয়তার কথা শুনে হৈমন্তী আর রিমি একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। বেশি ভাবার সময় পায় না। রিমি চলে যায় রিকশা আনতে আর হৈমন্তী প্রিয়তার ব্যাগ নিয়ে দাঁড়ায়। এই ফাঁকে প্রিয়তা মেসেজটা পড়ে নেয়।

প্রিয়তা রিকশায় চড়তেই রিমি উঠতে নেয় সাথে সাথে প্রিয়তা তাকে বাঁধা দেয়।

‘আমি যেতে পারবো তোরা ক্লাসটা কর।’

রিমি বলে,’আরে রাখ তোর ক্লাস। তুই আগে তারপর ক্লাস।’

‘আমি বাসায় পৌঁছে কল দিবো যা এখন ক্লাসে।’

প্রিয়তার কথা শুনে হৈমন্তী রিমিকে বোঝায়। অতঃপর বিদায় জানাতেই রিকশা চলতে শুরু করে। কিছু দূর যাওয়ার পর প্রিয়তা রিকশাওয়ালাকে বলে রিকশার দিক পরিবর্তন করতে। প্রিয়তার কথা মতো রিকশাওয়ালা তা-ই করে। কুড়ি মিনিট পর একটা শপিং মলের সামনে এসে নামে সে। ভাড়া মিটিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। ওড়না টেনে একাংশ দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে যাতে কেউ না চিনতে পারে।

‘কাউকে খুঁজছো?’

পরিচিত গলা পেয়ে পিছনে তাকায়। দেখতে পায় জাইন দাঁড়িয়ে আছে। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে জাইন তার পাশে এসে দাঁড়ায়।

‘ওরা কোথায়?’

‘ওরা বাসায়।’

‘বাসায়?কার বাসায়?’

‘তুমি ওদের সাথে দেখা করতে চাও?’

‘বিয়েটা ঠিকঠাক হয়েছে?’

‘তুমি দেখা করতে চাও কিনা বলো।’

কিছু না ভেবে প্রিয়তা মাথা নাড়ায়। জাইন সাথে সাথে একটা রিকশা ডাক দিয়ে তাতে চড়ে বসে। প্রিয়তা বেকুবের মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘কি হলো যাবা না?আসো।’

প্রিয়তা মুখ ঘুরিয়ে বলে,’আমি অন্য রিকশায় যাবো।’

জাইন আহত হয় প্রিয়তার কথায়। ভেবেছিলো এই সুযোগে প্রিয়তার সাথে রিকশায় ঘোরা হবে। বিনা বাক্যে সে রিকশা থেকে নেমে প্রিয়তাকে আহ্বান করে রিকশা উঠার জন্য। রিকশাওয়ালাকে বলে দেয় কোথায় যেতে হবে। প্রিয়তা চড়ে বসতেই রিকশা চলতে শুরু করে। পিছনে ঘুরে জাইনকে আর দেখা যায় না। একটু পর বাইকের শব্দ পেয়ে পাশে তাকাতেই দেখে জাইন বাইক চালাচ্ছে। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। জাইন এক পলক তার দিকে তাকিয়ে হাসে। বাইক সে এনেছে ঠিকই কিন্তু তবুও রিকশায় চড়েছিলো।

একটা পুরনো তিনতলা বাড়ির সামনে এসে রিকশা থামে। অনেকটা দূর আর গ্রাম সাইডের এলাকায় এসেছে তারা। রিকশা থেকে নামতেই জাইন বাইক এক পাশে পার্ক করে ভাড়া মেটায়। প্রিয়তার যতক্ষণে খেয়াল হয় ভাড়া দেওয়ার কথা ততক্ষণে জাইন দিয়ে দিয়েছে। কিছু না বলে জাইনের পিছন পিছন সে চলতে শুরু করে। তিন তলার চিলে কোঠায় আসতেই জাইন এগিয়ে গিয়ে দরজায় নক করে। কয়েকবার নক করার পর ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করে ‘কে?’

জাইন জবাব দেয়,’আমি খোল।’

সাথে সাথে দরজা খুলে দেয় মকবুল। জাইনকে দেখে হাসিমুখে সরে দাঁড়ায়। জাইন প্রিয়তাকে ইশারা করে ভেতরে যেতে। তখন ভেতর থেকে অনু আসে। প্রিয়তাকে দেখেই অনু ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। দু’জনকে দেখে বুঝার উপায় নেই গত রাতেই মাত্র তাদের দেখা হয়েছে সেভাবে আলাপ হয়নি।
অনুকে হাসিখুশি দেখে প্রিয়তা বুঝে নেয় বিয়েটা ভালো ভাবেই সম্পূর্ণ হয়েছে। অনু তাকে টেনে ভেতরে নিয়ে যায়। চিলেকোঠার এক কক্ষ বিশিষ্ট এ বাসায় তারা উঠেছে। মকবুলের যতদিন না ভালো চাকরি হচ্ছে তারা এখানেই থাকবে। জাইন মকবুলের কাঁধে হাত দিয়ে তার খবর জিজ্ঞেস করে।
মেঝেতে বিছানা পাতা হয়েছে সেখানেই প্রিয়তাকে বসতে দেয় অনু। সারা ঘরে বিছানা আর একটা ছোট্ট রেক ছাড়া আর কিছু নেই।

প্রিয়তার হাত ধরে অনু চমকে বলে,’আপু তোমার তো শরীর গরম। দেখি তো। আরে জ্বর এসেছে মনে হচ্ছে।’

‘না তেমন কিছু না।’

‘কিছু না মানে? তোমার গায়ে জ্বর।’

প্রিয়তা কিছু বলবে এর পূর্বেই জাইন কক্ষে প্রবেশ করে অনুর পিছনে দাঁড়ায়। প্রিয়তা চোখ তুলে জাইনের দিকে তাকায়। এতক্ষণ জাইনকে প্রাণবন্ত লাগলেও এখন তার চেহারা কেমন ফ্যাকাসে লাগছে।

জাইন গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে,’কি হয়েছে?’

অনু জবাব দেয়,’আপুর জ্বর এসেছে।’

‘জ্বরটা নিশ্চয়ই এখন উদয় হয়নি আগে থেকেই ছিলো?’

জাইনের প্রশ্ন শুনে প্রিয়তা চুপ করে রয়। নিঃশব্দে জাইন কক্ষ হতে বেরিয়ে যায়। ধীরে ধীরে প্রিয়তা অনুভব করে জ্বরটা বাড়ছে। সেই সাথে চোখও জ্বলতে শুরু করে।

……..
(চলবে..)