প্রণয়ী পর্ব-২২+২৩

0
152

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|২২.| (১৮+ এ্যালার্ট)
(লেখা কপি করা নিষেধ)
………

সকালবেলা প্রিয়তা ছাদে এসে বসে আছে। ফুল গাছ গুলো এই ক’দিনে বেশ ভালোই ডালপালা ছড়িয়েছে। বড়রা না করলেও বাচ্চারা সুযোগ পেলে ফুল ছিঁড়ে। জ্বি নের ভয়ে সকলে গাছগুলোকে খাতির যত্ন করে অথচ জানতেও পারলো না এ গাছগুলো এক প্রেমিক এনেছে তার পছন্দের মানুষের মন পেতে। প্রিয়তা শুধু দূর হতে গাছগুলো দেখে। মাঝে মাঝে গাছের ফুল পাতা ছুঁইয়ে দেয়। তার কাছে এখন ছাদের পরিবেশ আগের চেয়ে ভালো লাগে। সমস্যা হলো মানুষের আনাগোনা দিনে বেড়ে গেছে। কেউ না কেউ এসে গাছ গুলো দেখে যায়। উৎসুক জনতা এসে লাইভ করে দেশবাসীকে গাছগুলো দেখায়। তাদের লাইভের চমকপ্রদ হেডিং থাকে। ‘দেখুন কীভাবে জ্বি ন রা এক রাতে বাসার ছাদে রেখে গেলো নিরানব্বইটা ফুল গাছ।’ সেই সাথে থাকে তাদের বানানো আজগুবি কাহিনী।
এসবে প্রিয়তা বিরক্ত হয়৷ বাড়িওয়ালা তাই বাহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। এখন শুধু বিল্ডিং এর লোকজন এসে দেখে যায় আর গাছে পানি সার দেয়।

‘আপু একা একা কি করছো?’
রুমার গলা পেলে চোখ তুলে তাকায় প্রিয়তা। অতিরিক্ত পাকনা কথা বলার কারণে তাকে অপছন্দ করে প্রিয়তা। যথা সম্ভব রুমাকে এড়িয়ে চলে সে।

‘বসে আছি।’

‘ভাইয়ার খবর শুনেছো?’

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,’কোন ভাইয়া?’

‘আরে জাইন ভাইয়া। শুনলাম গত রাতে নাকি অনেক ঝামেলা হয়েছে। ভাইয়া কাদের মে রে নাকি মাথা ফা টি য়ে ছে। সে ও নাকি আহত হয়েছে। রফিকেরও লেগেছে।’
কথাগুলো রুমা মন খারাপ করে বলে।

‘কীসের ঝামেলা?’

‘ঐইটা তো আমাকে বলেনি। শুধু বলছে শাকিল ভাইকে মা র ছে তাই জাইন ভাইয়া ওদের মা র তে গেছে। কারা মা র ছে কেনো মা র ছে সেটা জানি না। আমার সাথে রাতেই একটু কথা হইছে এরপর ওর ফোন বন্ধ।’

প্রিয়তা রুমার কথায় তেমন আগ্রহ দেখায় না। তবে জাইনের বিষয়টা মিথ্যে হবে না কারণ জাইন যে ঝামেলা করে রোজ এটা মহল্লায় বের হলেই শোনা যায়৷ সে বের হলেও শুনতে পেতো কিন্তু পরীক্ষা একদিন পর তাই এসব খবর তার কানে আসেনি।

রুমা প্রিয়তার বাহু ধরে বলে,’জানো জাইন ভাইয়ার নাকি অনেক লেগেছে। রক্ত গিয়েছে অনেক। ভাইয়া হাসপাতালে যেতে চায়নি জোর করে নিয়ে গেছে। ঐ সময় রফিকের সাথে আমার কথা হইছে। জাইন ভাইয়ার অবস্থা দেখে ও নিজের ব্যথা ভুলে গেছে।’

প্রিয়তা রুদ্ধ গলায় বলে,’ঝামেলা করলে এমনই হবে।’

‘ভাইয়া শুধু শুধু কাউকে মা রে না। ওদের কি দরকার ছিলো শাকিল ভাইকে মা রা র? তুমি একটু ভাইয়াকে বলো সাবধানে থাকতে।’

‘আমি কেনো বলবো?’

‘তুমি বলবা না তো কে বলবে? তোমাদের মধ্যে কি ঝগড়া হইছে নাকি? আরে আপু জাইন ভাইয়ার মতো মানুষের সাথে ঝগড়া করো এটা তো ঠিক না। মিটমাট করে নাও সব।’

প্রিয়তা বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রুমা এবার বেশি বেশি বলতে শুরু করেছে।
‘কই যাও আপু?’

‘ঐ যে বললা খোঁজ নিতে তাই যাচ্ছি কল দিয়ে খোঁজ নিতে।’

‘আচ্ছা যাও। শুনো ভাইয়াকে বলবা রফিক যেনো আমাকে কল দেয়। ওর জন্য আমার চিন্তা হচ্ছে।’

প্রিয়তা কথাটা এমনি বলেছে রুমাকে থামাতে কিন্তু সে সত্যি ভেবেছে।
বাসায় এসে প্রিয়তা রান্নাঘরে যায় মাকে সাহায্য করতে। মিসেস মাসুমা প্রিয়তার সাথে তেমন কথা বলছে না তাই প্রিয়তা আগ বাড়িয়ে কাজ সব করে দিচ্ছে। সারাদিন কাজ,পড়াশোনা এসব করেই কেটেছে প্রিয়তার।

রাতে খাবারের টেবিলে সকলে খেতে বসেছে। মিসেস মাসুমা একবার ছেলের দিকে তাকায়। তুহিন ইশারা করলে সে বলতে শুরু করে,’ প্রিয়তার আব্বু প্রিয়তার নাকি এই বছরই পড়াশোনা শেষ হয়ে যাবে?’

বেল্লাল হোসেন জবাব দেয়,’হতেই পারে। কেনো?’

‘একটা ভালো ঘর থেকে সমন্ধ আসছে। বিয়ে দেওয়ার বিষয় পরে কিন্তু দেখে রাখো। এতো ভালো সমন্ধ তো বারবার আসে না।’

‘আচ্ছা পরে আলোচনা করবো এ বিষয়ে।’

‘ছেলের বাবার বড় ব্যবসা আছে বুঝছো। যিনি এসেছিলো ওনার কথাবার্তায় বুঝাই যায় না এতো বড়লোকের বউ। কত সুন্দর তার ব্যবহার কথাবার্তা। আমাকে তো আপা আপা ডেকে পুরা মাথায় তুলছে।’

‘দেখো প্রিয়তার মা মানুষ কেমন সেটা এমনে বিচার না করাই ভালো। আজকাল পশুকে বিশ্বাস করা যায় মানুষকে না।’

‘আচ্ছা আমি তো এখন বিয়ের কথা বকি নাই। দেখো রাখো পরে না হয় চিন্তা করবা।’

‘আচ্ছা।’

প্রিয়তা এ বিষয়ে মাথা ঘামায় না। সে জানে তার বাবা এখন এসব নিয়ে ভাববে না। সে নিশ্চিন্ত রইলো বাবার কথায়।

রাতের বেলায় টেবিলে পড়ছিলো প্রিয়তা এমন সময় বিদ্যুৎ চলে যায়। শ্বাস ফেলে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয় সে। বাহিরে চোখ গেলে সেখানে কাউকে দেখতে পায়না৷ অবচেতন মনে সে কাউকে খুঁজে। চট করে ভেতরটা কেমন জানি করে ওঠে তার। টেবিলের উপরই ফোনটা ছিলো। ফোনটা তুলে দেখে রাত দেড়টা বাজে। এরপর কল লিস্ট চেক করে। গত দু’দিনে জাইন তাকে কোনো কল মেসেজ দেয়নি। এতে প্রিয়তার খুশি হওয়ার কথা কিন্তু সে কেনো জানি খুশি হতে পারছে না। উল্টো বিরক্ত হচ্ছে।

এর মধ্যে রুমার বলা কথাগুলো মাথায় ঘুরছে। কোনো কিছু না ভেবে জাইনের নাম্বার ডায়াল করে প্রিয়তা। রিং বেজে কলটা কেটে যায় অপরপাশ থেকে রিসিভ করে না। আরেকটা যে কল দিবে সে সাহস হয়না প্রিয়তার। ফোন পাশে রেখে পা তুলে চেয়ারে বসে থাকে। এলোমেলো চিন্তা ভাবনা মস্তিষ্কে বিচরণ করতে শুরু করে।

ফোনের আলো বেজে উঠলে সেদিকে দৃষ্টি যায়। রাতের বেলা ফোন সাইলেন্ট করে রাখে সে। সে জানে কে কল করেছে তবুও গলা উঁচিয়ে দেখে এরপর হাত বাড়িয়ে ফোন নেয়। ততক্ষণে কলটা কেটে যায়। প্রিয়তা অপেক্ষা করতে থাকে আবারো কল আসার। মিনিট খানেক পেরিয়ে গেলেও কল আসে না। ফোনটা রাখতে নিলে আবারো কল আসে। এবার দেরি না করে কল রিসিভ করে ফোন কানে দেয় সে। প্রিয়তা নিশ্চুপ রইলো। অপরপাশের ব্যক্তিও নিশ্চুপ রইলো। দু’জনেই চাইছে অপর মানুষটা কথা শুরু করুক। প্রিয়তা বুঝতে পারছে না কোথা থেকে কি বলে শুরু করবে। এখন মনে হচ্ছে কল না দিলেই ভালো হতো।
অবশেষে জাইন মোনতা ভাঙলো।
‘ঘুমাওনি?’

‘উহু।’

‘কালকে পরীক্ষা আছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমি ভেবেছি ঘুমাচ্ছো তাই কল দেইনি।’

প্রিয়তা চুপ রইলো।

‘রাতে খেয়েছো?’

জাইনের স্বাভাবিক গলা যা প্রিয়তাকে উতলা করে দিচ্ছে। না পেরে সে শেষে জিজ্ঞেস করে বসে।

‘আপনি কোথায়? আপনি নাকি আবারো ঝামেলা করে আহত হয়েছেন?’

প্রিয়তার প্রশ্নে জাইন নিশ্চুপ হয়ে নিজের ডান হাতের দিকে তাকায়। পুরো হাত ব্যান্ডেজ করা তার। বাম হাতে দিয়ে ফোন কানে ধরে আছে সে।

‘কে বললো এই সংবাদ? এমন কিছু তো হয়নি।’

‘আপনি ঝামেলা করেননি?’

‘ঐইগুলো তো টুকিটাকি হয়েই থাকে। সিরিয়াস কিছু না।’

‘তার মানে আপনি সুস্থ?’

‘একদম সুস্থ। অসুস্থ হলে কথা বলতে পারতাম?’

প্রিয়তা তবুও আশ্বস্ত হয় না। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়।

‘কোথায় আছেন এখন?’

‘এই তো একটু দূরে কেনো? আসবো? দেখা করবা?’

‘আপনি বাসায় যান না?’

‘কম যাই।’

‘বাসার লোক কিছু বলে না?’

‘মা একটু চিন্তা করে।’

‘কে কে আছে আপনার ঘরে?’

‘বাবা-মা,ভাই-বোন সব আছে শুধু..’

‘শুধু কী?’

‘তুমি নাই।’

এই কথার প্রেক্ষিতে প্রিয়তা কিছু খুঁজে পায় না জবাব দেওয়ার।

‘কি হলো চুপ হয়ে গেলা যে?’

‘কিছু না ঘুমাবো। আপনি সত্যিই ঠিক আছেন?’

‘হ্যাঁ চিন্তা কোরো না একদম ফিট আছি।’

‘ঠিক আছে রাখছি। নিজের খেয়াল রাখবেন।’

‘তুমিও।’

‘আমিও কী?’

‘নিজের খেয়াল রেখো যতদিন না দেখা হচ্ছে।’

‘দেখা কেনো হবে না?’

‘তুমি দেখা করতে চাইছো? তুমি চাইলে শীঘ্রই দেখা হবে আর না চাইলে হবে না।’

‘না চাইছি না।’

‘আচ্ছা ঘুমাও তাহলে।’

প্রিয়তা চুপ রইলো। জাইন তাকে জোরও করলো না কিংবা এ বিষয়ে আর বললোও না।

জাইন আবারো বলে,’রেখে দিবো?’

প্রিয়তা আনমনে বলে,’না।’

‘তোমায় দেখতে ইচ্ছে করছে প্রিয়। খুউব দেখতে ইচ্ছে করছে।’

জাইনের মাতাল কন্ঠ শুনে প্রিয়তা নেত্রযুগল বন্ধ করে ফেলে।

ফিসফিস করে জাইন বলে,’আই মিস ইউ প্রিয়। ডু ইউ মিস মি?’

‘নো।’

জাইন নিঃশব্দে হাসে প্রিয়তার উত্তরে।
‘তোমাকে এখন বুকে নিয়ে উষ্ণ স্পর্শ দিতে মন চাচ্ছে।’
লজ্জায় প্রিয়তার কান গরম হয়ে যায়।
‘ছিঃ অসভ্য!’

জাইন হেসে বলে,’ধরলাম না ছুঁইলাম না আমি অসভ্য! আমি তো সাহিত্যের ভাষায় বললাম যদি আঞ্চলিক ভাষায় বলতাম তোমায় আদর করতে চাই তাহলে তো মনে হয় আমায় মে রেই ফেলতে তুমি।’

প্রিয়তা মেকি রাগ দেখিয়ে বলে,’রাখছি অসভ্য কথা বাড়ানোর কোনো ইচ্ছে নেই আমার।’

‘আচ্ছা তবে দেখা হলে তুমি আমায় একটু অসভ্য স্পর্শ দিও।’

‘আমি কেনো আপনাকে স্পর্শ করবো?’

‘আমি বললাম তাই। এই ধরো হুট করে আমার বাহু জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখলে কিংবা আমার বুকে মাথা রেখে নাক ঘষলে ব্যাপারটা মন্দ হয় না।’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তার মাথা ঘুরে যায়।
‘আপনি মজা করছেন?’

‘উহু আমি সিরিয়াস। তোমাকে বুকে টেনে নেওয়ার বড্ড লোভ আমার। তোমার এলোমেলো কেশগুলো কানে গুঁজে দিয়ে গলায় আদর দিবো।’

‘উফ রাখছি।’
প্রিয়তা সাথে সাথে কল কেটে দেয়। জাইন হেসে দেয় প্রিয়তার কান্ডে। সে তো শুধু প্রিয়তাকে ক্ষ্যাপাচ্ছিলো।
কল কেটে বোতল হতে ঢকঢক করে পানি পান করে প্রিয়তা। ইশ! কী সব বলে লোকটা তাকে লজ্জায় ফেলে দিলো। ফোনের বাতি জ্বলে উঠলে দেখে মেসেজ এসেছে। ফোন হাতে দিয়ে মেসেজে ঢুকে।

‘আজ তো অসম্পূর্ণ রইলো বাকিটা অন্য দিন বলবো। এখন ঘুমাও। আর শুনো তোমার শুষ্ক ঠোঁটে আমার দুষ্ট চুমু পাঠিয়ে দিলাম,নিয়ে নিও।’
মেসেজটা পড়ে প্রিয়তা হেসে দেয়।
বিরবির করে বলে,’অসভ্য গু ন্ডা।’

_________

পরীক্ষা শেষ করে লাইব্রেরীতে বসে আছে তিনজনই। হৈমন্তী প্রিয়তার খাতা থেকে কিছু নোটস তুলছে। মাঝে জ্বর থাকায় যেই কোর্সের ক্লাসটা সে মিস করেছে পরের পরীক্ষা সেই কোর্সের। সব একদিকে হৈমন্তীর পড়াশোনা একদিকে।

‘দোস্ত পরীক্ষা শেষে চল একটা টুর দেই।’
রিমির কথায় হৈমন্তী কান দেয় না। প্রতিবার ও একই কথা বলে এরপর নিজেই পিছিয়ে যায়।

প্রিয়তা বলে,’তোর বাসায় গিয়ে একদিন আড্ডা দিবো সেটাই পারি না আর টুর তো বিলাসিতা।’

‘দোস্ত ভয় পাস কেন? সংগ্রামী হ বুঝছিস?’

হৈমন্তী বলে,’তুই প্রিয়ুকে ঘর ছাড়ানোর ব্যবস্থা করছিস।’

‘সমস্যা কি আমার বাসায় উঠবে।’

প্রিয়তা আফসোসের স্বরে বলে,’ঘর থেকে তো বের করবে না বিয়ে দিয়ে দিবে।’

রিমি ভেংচি দিয়ে বলে,’নিশ্চয়ই ঐ টাকলু আঙ্কেলের সাথে? বেটা বুড়া বলে তারে ভাইয়া ডাকতাম আঙ্কেল না এ্যা শখ কত।’

রিমির কথা শুনে প্রিয়তা আর হৈমন্তী হেসে দেয়।

প্রিয়তা রিমির দিকে তাকিয়ে ওর বকবক শুনতে থাকে। এদিকে তার ফোনে মেসেজ আসার শব্দ হয় ফোন তুলে হাতে নেয় সে।

‘কোথায় আছো তুমি?’

‘ভার্সিটির লাইব্রেরীতে।’

মেসেজের উত্তর দিয়ে ফোনটা আবারো টেবিলে রেখে দেয়। এরপর আর মেসেজ আসে না। কয়েকবার চেক করার পর প্রিয়তা। মেসেজ না আসায় ফোন রেখে দেয়।

‘দোস্ত আমার কথা শুনছিস তুই?’
রিমি প্রিয়তাকে ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে।

প্রিয়তা মাথা নাড়িয়ে বলে,’হ্যাঁ শুনছি।’

রিমি বলে,’আমার বাসা থেকে বলে দিছে এখন বিয়ের নাম যেনো না নেই। গ্রাজুয়েশন শেষ করে চাকরি করবো তারপর বিয়েশাদি। এটা মানা যায়?’

‘একদমই মানা যায় না।’

হৈমন্তী বলে,’তুই না ইংরেজি কবিতার বই নিতে চেয়েছিলি? শুনলাম এসেছে। গিয়ে দেখ যেটা খুঁজছিস পাস কিনা।’

‘ঐ বই কী আমাদের লাইব্রেরীতে আনবে?’

‘খুঁজেই দেখ না।’

হৈমন্তীর কথা মতো প্রিয়তা উঠে শেলফের দিকে যায়। কবিতার বই খুবই কম আনে। হাতে গোনা। সকলের কাছেই একাডেমিকের বাহিরে উপন্যাসের চাহিদা বেশি। প্রিয়তার কাছে কবিতা ভালো লাগে। তাই ভেতরের দিকের শেলফে কিছু কবিতার বই রাখা হয়। প্রিয়তা সেখানে এসেই খুঁজতে থাকে। এগুলো সব বাংলা কবিতার বই যা প্রিয়তার পড়া শেষ। দুটো ইংরেজি কবিতার বই আছে সেগুলো পড়তে নিয়েছিলো কিন্তু রসকষহীন লেগেছে তার কাছে।
না যেই বই খুঁজছে তা নেই। অন্য একটা বই হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। এরপর চিন্তা করে যেই বই খুঁজছে সেটা কিনে নিবে। পিছনে ঘুরতে নিলেই একদফা চমকায়। চক্ষুদ্বয় বড় বড় করে তাকায়।

‘কি দেখছো এভাবে?’

‘আপ..আপনি এখানে? কীভাবে এলেন?’

‘হেঁটে এসেছি।’

‘মানে কেউ দেখেনি?’

‘পিছনের ইমারজেন্সী এক্সিট দিয়ে এসেছি।’

প্রিয়তা জাইনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে। পরনে পাঞ্জাবী আর জিন্স রয়েছে তবে মুখে মাস্ক আর চোখে সানগ্লাস পরা সে। জাইন সানগ্লাস আর মাস্ক খুলে সেলফের উপর রাখে। প্রিয়তার নজর যায় জাইনের হাতের দিকে।

‘কীভাবে লাগলো হাতে? আপনি না বলেছিলেন আপনি ঠিক আছেন?’

‘যতক্ষণ না হাড্ডি ভাঙে ততক্ষণ তো সুস্থই আছি। এইগুলো সামান্য কাটাছেঁড়া।’

‘এটা সামান্য? সামান্য হলে এতো বড় ব্যান্ডেজ করে দিতো?’

‘সামান্যই তো।’

প্রিয়তা এগিয়ে এসে জাইনের হাতের ব্যান্ডেজ দেখতে শুরু করে। এরপর নাকে হাত দিয়ে দূরে সরে।

‘আপনি সিগারেট খেয়ে এসেছেন?’

‘কই না তো।’

‘আমি মাত্র গন্ধ পেলাম।’

প্রিয়তার কথা মতো জাইন নিজের পাঞ্জাবীতে নাক ছোঁয়ায়।

‘আমি খাইনি। ওরা খেয়েছিলো তারই গন্ধ রয়ে গেছে।’

‘মিথ্যে কথা খেয়েছেন।’

জাইন এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলে,’দুষ্ট ঠোঁটে একটু শুষ্ক ঠোঁট ছুঁইয়ে দেখো সিগারেট খেয়েছি কিনা।’

‘অসভ্য লোক। আপনাকে ভদ্র ভেবেছিলাম। এখন দেখছি আপনার কথাবার্তা লাগামছাড়া।’

‘তোমার জন্য অসভ্য হতে আমার আপত্তি নেই। দুষ্ট ঠোঁটে একটু আদর দিবা? একটু খানি প্লিজ।’

প্রিয়তা দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরে। জাইন হেসে দেয় প্রিয়তার অবস্থা দেখে।

‘আপনার সাথে আমি আর কথা বলবো না। এমন অসভ্য লোক আমার চাই না।’

‘তার মানে সভ্য হলে চাইবে? সভ্য হবো?’

প্রিয়তা থতমত খায় জাইনের কথা শুনে। বিদ্যুতের গতিতে মাথা নাড়িয়ে বলে,’আপনাকেই চাই না।’

‘আচ্ছা দেখা যাবে। কে কাকে চায় কিংবা চায় না।’

‘সরুন আমি বের হবো।’

‘যাও সমস্যা নেই শুধু যাওয়ার আগে বুকটাকে শান্ত করে যাও নইলে আবারো বিরক্ত করবো।’

‘পারবো না।’

‘অনেকদিন তোমায় দেখতে পারবো না তাই জেদ কোরো না প্লিজ।’

প্রিয়তা চমকে প্রশ্ন করে,’কই যাবেন?’

‘খুলনা যাবো ভাইয়া ডেকেছে।’

‘ঠিক আছে যান।’

‘দিবা না?’

‘কী?’

‘দুষ্ট ঠোঁটে শুষ্ক ঠোঁটের চুমু।’

প্রিয়তা চোখ রাঙায়।
‘এভাবে তাকিও না রমনী,ইচ্ছে করে বুকে টেনে মিশিয়ে ফেলি।’

প্রিয়তা জাইনকে ধাক্কা দিয়ে হাঁটা দেয়। জাইন প্রিয়তার যাওয়ার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়তা তাকায় কয়েকবার। বাম হাত পকেটে ঢুকিয়ে জাইন সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রয়।

……….
(চলবে..)

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|২৩.|
(লেখা কপি করা নিষেধ)
…………

প্রিয়তাদের বাসা থেকে বাজার খানিকটা দূরে। আগে মোটামুটি নিয়মিত বেল্লাল হোসেনের দোকানে সে যেতো কিন্তু পরীক্ষা থাকায় বিগত এক মাসে আসা হয়নি। দু’দিন হলো প্রিয়তার সেমিস্টার ফাইনাল শেষ। এখন তাদের সেমিস্টার ব্রেক চলছে। এরপর শুরু হবে শেষ সেমিস্টারের ক্লাস।
বেল্লাল হোসেনের জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছে প্রিয়তা। দূর হতে জাইনের জিপটা দেখে থমকে দাঁড়ালো। জাইন ফিরেছে? কই তাকে তো জানালো না! সকলেও তো মেসেজ দিলো তখন বললো আরো দু’দিন পর সে ফিরবে। কাজে আঁটকে গেছে সে। প্রিয়তা ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে যায়। জিপ থেকে মারুফ,শাকিব আর রফিক নামে। চোখ তুলে আরেকবার প্রিয়তা তাকায়। না জাইন নেই কোত্থাও! প্রিয়তা নিজের ভাবনায় অবাক হয়। হঠাৎ এতো কেনো সে ভাবছে একটা মানুষকে নিয়ে? না সে ভাববে না আর। তার ভাবনায় লাগাম টানবে।

প্রিয়তার দৃষ্টি মারুফকে এড়ায় না। প্রিয়তা চোখ নামিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে মারুফ ডাকে। তাকাতেই দেখে মারুফ আর শাকিল একত্রে দাঁড়িয়ে আছে। শাকিলের মাথায় এখনো ব্যন্ডেজ করা। প্রিয়তা বুঝে নেয় মস্ত বড় ঝামেলা হয়েছিলো। মারুফকে দেখে মনে হয় না সে আঘাত পেয়েছে।

মারুফ প্রশ্ন করে,’কেমন আছো প্রিয়তা?’

‘জ্বী ভাইয়া ভালো।’

‘কাউকে খুঁজছো?’
প্রশ্নটা করে মিটমিট করে হাসে মরুফ।

‘জ্বী না ভাইয়া।’

‘ও ফেরেনি। ফিরলে আমাদের আগে দেখবা তোমাকে জানাবে।’

প্রিয়তা বিব্রত হয় মারুফের কথায়। শাকিল বিষয়টা বুঝতে পারে।

‘কোথাও যাচ্ছো?’

‘বাবার দোকানে।’

‘আচ্ছা যাও আর কিছু প্রয়োজন হলে জানিও।’

প্রিয়তা হ্যাঁ অথবা না কিছুই বলে না সোজা হাঁটা দেয়। এখানে দাঁড়ালেই বিব্রত হবে সে। যত সম্ভব এদেরকে এড়িয়ে চলতে হবে।
প্রিয়তা যেতেই মারুফকে ধমকায় শাকিল।

‘তোর কি হুঁশ জ্ঞান হবে না? রাস্তার মধ্যে এসব বলে মেয়েটাকে বিব্রত করলি কেনো?’

‘আমি শুধু তোর চোখ দেখে যেটা আন্দাজ করছি বলছি। তোর ওরে দেখে মনে হয় নায় ও জাইনকে খুঁজছে?’

‘তা তো মনে হইছেই কিন্তু তবুও এমনে জিজ্ঞেস করলে মেয়েটা পল্টি খেতে পারে। পরে জাইন শুনলে রাম ধো লাই দিবে। তাই মুখ বন্ধ রাখ নিজের।’

শাকিলের কথায় মারুফ কান না দিয়ে সিগারেট ধরায়।
সিগারেটে সুখ টান দিয়ে বলে,’জাইনের তো ব্যবস্থা হয়ে গেলো আমাদের কি হবেরে মামা?’

‘ক্যান তুই না এক মেয়েকে দেখলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকিস ওটাকে পটিয়ে নে।’

মারুফ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,’কোন মেয়ে?’

‘প্রিয়তার বান্ধবী।’

‘ঐ ঝগড়ুটে মহিলার কথা বলছিস? ওটা মেয়ে না ধানি লঙ্ক! কথায় কথায় ঝগড়া করে।’

‘তুই ঐ মেয়েকে ঠিক বশ করতে পারবি।’

‘দরকার নাই আমি সিঙ্গেলই ঠিক আছি।’

পিছন থেকে রফিক বলে,’হ ভাই সিঙ্গেল লাইফ বেস্ট।’

রফিকের কথা শুনে মারুফ আর শাকিল পিছনে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায়।
মারুফ বলে,’কিরে তোর গফের সাথে আবার ঝগড়া করছিস?’

‘আর বইলেন না ভাই খালি কথায় কথায় রাগ করে। দিনের মধ্যে চৌদ্দ বার ওর রাগ ভাঙাই।’

রফিকের কথা শুনে মারুফ বলে,’থাক আমরা সিঙ্গেলই ভালো আছি।’
শাকিল আর মারুফ একে অপরের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানে।

প্রিয়তা ফার্মেসীতে এসে দেখে দু’জন লোক বসে তার বাবার সাথে গল্প করছে। প্রিয়তাকে দেখে তারা গল্প থামায়।

‘তা বেল্লাল মেয়ে তো দেখি অনেক বড় হয়ে গেছে। বিয়েশাদি দিবা না? আমার কাছে ভালো একটা পাত্র আছে।’

বেল্লাল হোসেন জবাব দেন,’না ভাই আপাততঃ এসব নিয়ে ভাবছি না।’

‘শুনো ভালো পাত্র বারবার আসে না বুঝছো। চাহিদা থাকতেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দাও।’

লোকটার কথা শুনে প্রিয়তা চমকে তাকায়।
রাগ সংযত করে বলে,’আঙ্কেল একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না।’

‘জ্বী বলো।’

‘মেয়েরা কী পণ্য?’

‘পণ্য কেনো হবে?’

‘তাহলে আপনি যে মাত্র বললেন চাহিদা থাকতেই বিয়ে দিতে। পণ্য না হলে চাহিদার কথা আসলো কেনো?’

‘আঠারোর পর মেয়ে মানুষ ঘরে রাখা ঠিক না। যত জলদি বিয়ে দিয়ে দিবে তত জলদি জেনা থেকে বাবা-মা রক্ষা পাবে।’

‘আপনার ছেলে মেয়ে ক’জন?’

‘তিন মেয়ে আমার। বড় দুই জনের বিয়ে হয়ে গেছে আর ছোটটা অস্ট্রেলিয়াতে পড়াশোনা করে।’

প্রিয়তা খেয়াল করলো লোকটা বুক ফুলিয়ে কথাগুলো বললো।

‘আপনার ছোট মেয়ে নিশ্চয়ই আমার বয়সী বা আমার থেকে সিনিয়র? তার বিয়ের কথা বলেননি তার মানে সে আনম্যারিড। আপনার লজিক অনুযায়ী তো তার চাহিদা শেষ। তার মানে আপনি নিজের ঘরের মেয়েকে বিয়ে দিতে ব্যর্থ অথচ আরেকজনের মেয়ের বিয়ে নিয়ে আপনার কত চিন্তা।’

প্রিয়তার কথা শুনে লোকটা রক্তিম চোখে তাকায়। ধমকে উঠে দাঁড়ায়।

‘বেল্লাল তোমার মেয়ে দেখি আস্ত বেয়াদব। এই জন্যই বিয়ে হয় না।’

বেল্লাল হোসেন বলে,’প্রিয়তা ভুল কিছু কিন্তু বলেনি। শুরুটা আপনিই করেছেন।’

‘তোমাকে ভালো মনে করেছিলাম। আর কখনোই তোমার দোকানে আসবো না। বেয়াদব বাপের বেয়াদব মেয়ে।’

কথাগুলো বলে লোকটা হনহনিয়ে চলে যান। লোকটা যেতেই প্রিয়তা তার বাবার দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়।

বেল্লাল হোসেন বলে,’এরা নিজের ঘর থেকে অন্যের ঘর নিয়ে মাথা ঘামেতে বেশি পছন্দ করে।’

‘থাক বাবা বেশি কিছু বোলো না পরে এলাকায় ছড়াবে বেয়াদব বাবার বেয়াদব মেয়ের বিয়ে হয় না।’

প্রিয়তার কথা শুনে বেল্লাল হোসেন ও হেসে দেয়।
ফার্মেসীর ভেতরে ঢুকে বেল্লাল হোসেনকে খেতে দেয় প্রিয়তা। পিছনের দিকে ঘুরে সে খেতে বসে। এমন সময় এক মেয়ে আসে প্রেসক্রিপশন নিয়ে। প্রিয়তা যেহেতু এর আগেও দোকানে এসেছে তাই বেল্লাল হোসেনের অনুপস্থিতিতে অনেক ঔষধ বিক্রি করেছে। তাই তার মোটামুটি ধারণা আছে কোনটা কোথায়। প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে চোখ বুলালে তার দৃষ্টি আটকায় রোগীর নামে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা জাইন। বয়সের জায়গাটা ফাঁকা। প্রিয়তা চোখ তুলে মেয়েটার দিকে তাকায়।

প্রিয়তা অস্বস্তি নিয়ে প্রশ্ন করে,’কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করি?’

‘বলেন।’

‘রোগী আপনার কী হয়?’

মেয়েটা প্রিয়তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়।

‘না মানে বয়স দেওয়া নেই তো। ঔষধ গুলোর নাম দেখে জিজ্ঞেস করলাম।’

‘আমার ছেলে হয়। ওর বয়স আট।’

উত্তর পেয়ে প্রিয়তা ঠান্ডা হয়। খুঁজে ঔষধ বের করে দেয়। বেল্লাল হোসেনের খাওয়া হতেই সব গুছিয়ে নেয়। এরপর কিছুক্ষণ বাবার সাথে গল্প করে বাসার দিকে রওনা দেয়।

কলেজের সামনে দিয়ে আসার সময় দূর হতে দেখে কয়েকটা বাইক একত্রে রাখা। তার উপর পাঞ্জাবী পরিহিত কেউ বসা। একই পাঞ্জাবী সে জাইনকে পরতে দেখেছে। তবে কি এটা জাইন? না না সে হতেই পারে না। জাইন হলে তারই বা কী আসে যায়? ছেলেটার মাথায় টুপি থাকায় ঠিক বুঝতে পারছে না। পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় আঁড়চোখে তাকায়। ছেলেটাও হুট করে তাকায়। প্রিয়তা সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেলে। তার সাথে হচ্ছেটা কি বুঝতে পারছে না সে। ওড়নার শেষাংশ দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নেয় সে। যত দ্রুত সম্ভব বাসায় ফিরতে চায়।

বাসায় ফিরেই ব্যাগ টেবিলে রেখে নিজ কক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। ধপ করে বিছানায় বসে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে।

বিরবির করে বলে,’কি সব আলতু ফালতু চিন্তা করছি আমি! আমার চিন্তায় লাগাম টানতে হবে আর বাসা থেকে একদমই বের হওয়া যাবে না। ঐ লোক হতে দূরে থাকবো। বাস্তবে তো বিরক্ত করেই এখন জল্পনা-কল্পনাতে এসে বিরক্ত করছে। এইরকম চলতে থাকলে সামনে আমার ঘোর বিপদ। কিছুতেই এসব পাত্তা দেওয়া যাবে না। আই ডোন্ট লাইক ইউ জাইন রহমান। আপনি আমাকে পা গ ল করতে আমার চিন্তা চেতনা বশ করতে চাইছেন কিন্তু এসব আমি হতে দিবো না।’

হুট করে বাইকের শব্দ পেয়ে প্রিয়তা আনমনে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। দেখতে পায় রফিক বাইকে বসে তাদের পাশের বারান্দায় তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারে রুমাকে দেখতে এসেছে সে। প্রিয়তা সাথে সাথে সরে যায়। লজ্জা পায় নিজ কর্মকান্ডে। বালিশে মুখ লুকিয়ে শুয়ে থাকে। প্রতিজ্ঞা করে ঘর থেকেই বের হবে না।

………

বিকাল বেলা ছাদে বসে রিমি আর হৈমন্তীর সাথে গ্রুপ কলে কথা বলছিলো প্রিয়তা। তাদের কথার মূল বিষয় বস্তু ঘুরতে যাওয়া। রিমি নানান জায়গা সম্পর্কে বলছে আর চেষ্টা করছে বান্ধবীদের রাজি করাতে।

রিমি বলে,’দেখ এরপর তো আর সেমিস্টার ব্রেক পাবো না। এবার চল না কোথাও যাই।’

প্রিয়তা বলে,’যেখানেই যাবি আমি যেতে রাজি শুধু সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে হবে।’

হৈমন্তী হাই তুলে বলে,’আমি ব্যস্ত।’

রিমি জিজ্ঞেস করে,’ব্যস্ত মানে? কীসের ব্যস্ততা তোর?’

‘পড়া নিয়ে ব্যস্ত আমি।’

‘মাত্র না সেমিস্টার গেলো এখন আবার কীসের পড়া?’

‘পরের সেমিস্টারের পড়া পড়ছি।’

‘ওরে আমার বিদ্যাসাগর এবার মস্তিষ্কটারে একটা রেহাই দে। ওটার উপর আর কত অত্যাচার করবি?’

‘তোর মতো কী মস্তিষ্করে গোয়াল ঘর বানিয়ে রাখবো না? এটা দেওয়া হয়েছে ব্যবহারের জন্য আর আমি তা ই করছি।’

রিমি আর হৈমন্তীর মধ্যে ছোটখাটো ঝগড়া বেঁধে যায়। প্রিয়তা চুপচাপ ঝগড়া শুনতে থাকে। এমন সময় সে দেখে কেউ এই ছাদে ইটের টুকরো ছুড়ছে। পাশের ছাদে তাকাতেই দেখে রফিক। প্রিয়তা সাথে সাথে ডানে তাকায় দেখে রুমা উল্টো দিকে ঘুরে পড়ছে। রফিক প্রিয়তাকে ইশারায় বলে রুমাকে ডেকে দিতে। রফিকের আকুতি দেখে প্রিয়তা উঠে যায়। রুমের কাঁধে হাত রাখতেই সে চোখ তুলে তাকায়। ইশারায় পিছনে দেখাতেই রুমা তাকায় কিন্তু রফিককে দেখে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। প্রিয়তা বুঝতে পারে রুমা রাগ করেছে তাই রফিক রাগ ভাঙাতে এসেছে। রফিক আশেপাশে তাকায়। ছাদ টপকে যাবে কিন্তু কেউ দেখে নিলে রুমার সমস্যা হবে তাই সে নিরুপায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কোমড়ের পিছনে গুঁজে রাখা কয়েকটা গোলাপের কলি বের করে। রুমার গোলাপের কলি পছন্দ। এক পাশে দাঁড়িয়ে কানে ফোন রেখে রফিকের কান্ড দেখতে থাকে প্রিয়তা। এদিকে কলে রিমি আর হৈমন্তীর বাকবিতন্ড চলছে।
সেদিকে প্রিয়তার ধ্যান নেই। রফিক একটা করে কলি রুমাকে লক্ষ্য করে ছুড়ছে। রুমা একটি বারও ফিরে চাইলো না। সবগুলো কলি ছোঁড়া শেষে মুখ কালো করে রফিক চলে যায়। বেচারা হয়তো হার মেনেছে। অনেকক্ষণ কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে রুমা ফিরে তাকায়। রফিককে দেখতে না পেয়ে উঠে গিয়ে গোলাপের কলিগুলো কুড়িয়ে নেয়। প্রিয়তা শুধু মেয়েটার কান্ড দেখছে। কলিগুলো নিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রুমা নিচে চলে গেলো। রুমাকে দেখে বুঝার উপায় নেই সে রেগে ছিলো। মেয়েটা নিজের বইখাতা ফেলেই ঘরে গেলো কি আশ্চর্য! প্রেমে পড়লে বুঝি মানুষ সব ভুলে যায়? প্রশ্নের কোনো উত্তর পেলো না প্রিয়তা। কথাবার্তা ছাড়া কান থেকে ফোন নামিয়ে কল কেটে দিলো।
ফোনের অপরপাশে থাকা রিমি আর হৈমন্তী আহাম্মক বনে যায় প্রিয়তার কাজে।

………

রাতের বেলা প্রিয়তা হাত পা মেলে বিছানায় শোয়। তার কাছে সব কিছু অদ্ভুত লাগছে। জাইনের কথাবার্তায় আজকাল সে বিরক্ত হয় না। চাইলেও রাগ করতে পারে না। তবুও শক্ত খোসল সে ধরে রাখে। বালিশ টেনে সেটা জড়িয়ে শোয় সে। দিনের বেলা মেসেজ দিয়ে খোঁজ খবর নেয় জাইন। এর বাহিরে তেমন কল দেয়নি। এ ক’দিনে একবার কল দিয়েছিলো শুধু। ফোন বেজে উঠলে হাতে নিয়ে দেখে জাইনের কল। কপাল কুঁচকে ফেলে সে। এই সময় কল দিলো কেনো তা বুঝার চেষ্টা করে। কল রিসিভ করে ফোন কান দিতেই অপরপাশ থেকে জাইনের আদুরে গলা ভেসে আসে।

‘কি করছো?’

‘মশা মারি।’

‘আমাকে মিস করছো না?’

‘আপনাকে কেনো মিস করবো?’

‘তা করবা কেনো! সেদিন আমায় লাইব্রেরীতে ওভাবে রেখে চলে গেলে, তুমি বড় নিষ্ঠুর প্রিয়।’

‘আপনি একটু আপনার কথাবার্তা ঠিক করুন নইলে আমি আপনাকে আবারো ব্লক দিতে বাধ্য হবো।’

‘ফোন থেকে না হয় ব্লক দিবা কিন্তু মন থেকে কীভাবে ব্লক দিবা?’

জাইনের কথায় প্রিয়তা চমকায়।

‘কী সব যা তা বলছেন! আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছুই না।’

‘আজকাল তোমার চোখমুখের উতলা বলে দিচ্ছে তুমি কী চাইছো।’

‘কি চাইছি?’

‘আমাকে।’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা উঠে বসে।
‘মোটেও না।’

‘কিন্তু তোমার চোখমুখ তো অন্য কথা বলে।’

‘কী বলে?’

‘তুমি আমায় চাইছো তাও গভীর ভাবে।’

‘কী সব আবোলতাবোল বলছেন। আমি মোটেও এমন কিছু ভাবিনি।’

‘ঠিক আছে তোমার স্বীকারোক্তি লাগবে না আমি সবটা বুঝে নিলাম।’

‘কী বুঝে নিয়েছেন?’

‘অনেক কিছু।’

‘যেমন?’

‘এখন বললে তো বলবা অসভ্য।’

‘অসভ্য কথাবার্তা বললে তা ই বলবো। কী বুঝেছেন সেটা জানতে চাই।’

‘এই যে তুমি আমায় জড়িয়ে আমার অধরে স্পর্শ দিতে চাও।’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা কেশে ওঠে। শোয়া থেকে দ্রুত উঠে বসে।

‘এগুলো সব আপনার বানানো কথা। আমি আপনাকে নিয়ে কিছুই ভাবিনি।’

‘মিথ্যে কেনো বলছো? সত্যিটা বলো।’

‘কল রাখলাম।’

‘ভয় পাচ্ছো যদি ভালোবেসে ফেলো?’

‘আপনাকে ভালোবাসতে যাবো কোন দুক্ষে? ইউ নো আই হেট ইউ।’

‘বাট জাইন লাভ’স ইউ। লাভ’স ইউ এ লট। জাইনের শরীর মন জুড়ে তোমার বসবাস।’

‘ছিঃ! আপনি বড় বেহায়া।’

‘ভালোবাসলে বেহায়া হতে হয়। তুমিও একদিন বেহায়া হবা।’

‘আমি কেনো বেহায়া হতে যাবো?’

‘হবা হবা তাও আমার জন্য।’

‘অসম্ভব।’

‘এ পৃথিবীতে সবই সম্ভব বুঝলেন ম্যাডাম?’

‘এটা বানোয়াট কথা।’

‘বিশ্বাস না হলে পরীক্ষা করে দেখো।’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা একটু ভাবে। এরপর বলে,’আপনি কোথায় এখন?’

‘যেখানে ছিলাম সেখানে। কেনো মিস করছো? দেখতে ইচ্ছে করছে?’

প্রিয়তা ভেঙ্গিয়ে বলে,’হ্যাঁ খুব ইচ্ছে করছে আসুন।’

‘এভাবে বোলো না চলে আসবো কিন্তু পরে সামলাতে পারবা না।’

‘আসেন আমার কোনো সমস্যা নেই।’

‘আসলে কী দিবা?’

‘যা চাইবেন তা তবে এক্ষুণি আসতে হবে। দশ মিনিটের মধ্যে।’

প্রিয়তার কথা শুনে জাইন চুপ হয়ে যায়। এরপর গলার স্বর নামিয়ে বলে,’যা চাইবো তা?’

প্রিয়তা রাগান্বিত গলায় বলে,’হ্যাঁ।’

‘ভেবে বলছো তো?’

‘ভেবেই বলছি। এখন কল রাখলাম ঘড়ি ধরবো।’

জাইন আর কিছু বলে না। প্রিয়তা কল কেটে দেয়। সে জানে খুলনা থেকে এখন আসা অসম্ভব। জাইনকে শিক্ষা দিতে এসব বলেছে যাতে পরেরবার জাইন তাকে আজেবাজে কথা বলে না ক্ষেপাতে পারে। মিনিট পাঁচেক পর মেসেজ আসে।

‘ছাদে আসো আমি অপেক্ষা করছি। আর শুনো শাড়ি পরে আসবা। আজকে আমার আবদার মিটাবা সব।’

মেসেজটা পড়ে প্রিয়তার চক্ষু ছানাবড়া। সে তো রাগের মাথায় কথাটা বলেছে। ভেবেছে জাইন এখনো ফেরেনি। জাইন তাকে একবারো জানায়নি সে ফিরেছে। লোকটা তার সাথে চালাকি করলো? এখন সে কী করবে?
মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ে প্রিয়তা। হাত পা ছড়িয়ে তার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। নিজের কথার জালে নিজেই ফেঁসে গেলো সে।

…………
(চলবে..)