প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব-৬+৭

0
398

#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ৬ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
আয়মান শান্তসুরে বলল,আমি যদি
তোমার থাকার ব্যবস্থা করি থাকবে?
কোথায় স্যার?

আমাদের বাসায়। জানি কি ভাবছ তুমি এখন?

বাজ পড়া পাখির মতো পিয়াসা স্থির হয়ে গেল। আয়মানের বলা বাক্যদ্বয়ের প্রতিটি শব্দ পিয়াসার কর্ণকুহুরে প্রবেশ করেছে অগ্নিকনা হয়ে। যা তার হৃদয়ে বহ্নিশিখার মত দাউদাউ করে জ্বলছে। পুড়ে ছাইঁ হচ্ছে তার অন্তরখানি।

মনে মনে বলল, আপনি ঠিকই ধরতে পেরেছেন স্যার। আপনার বলা কথাগুলো আমার কাছে ভীষণ তেতো লাগছে। ভারী অসহ্য ঠেকছে। বিষের পেয়ালায় মধু ঢাললে সে মধু পান করাও বিপজ্জনক। কি হচ্ছে আমার সাথে এসব। কেন যে বাবার সাথে মরে গেলাম না। কেন সবাই ভালোবাসার নামে করুণার পসরা সাজিয়ে বসেছে আমার জন্য। কেন শকুনের মতো আমাকে নিয়ে টানা হিঁচড়া চলছে। পিয়াসার আঁখিকোণ ছলছল করে উঠলো।

আয়মান ফের পিয়াসা বলে ডাক দিলো। পিয়াসা সম্বিৎ ফিরে পেল। আরক্ত দুটি চোখে একবার তাকালো আয়মানের দিকে।

আপত্তি আমাদের বাসায় থাকতে?

আপত্তি হওয়াটাই কি স্বাভাবিক নয় স্যার?

আয়মান আর বিশেষ ঘাটালোনা পিয়াসাকে। বেহায়াপানা তার অপছন্দ। ওকে। তুমি তোমার মত করে থাকো। ভুল বুঝলে বা উল্টো বুঝলে কিইবা করার আছে আমার। আয়মান জেনেবুঝেই রায়হানের প্রসঙ্গ তুললনা। চলে যাও পিয়াসা।

পিয়াসা পা ঘুরিয়ে বের হয়ে গেল অফিস থেকে। আয়মান পিয়াসার পিছনপানে নিষ্পলক চোখে চেয়ে রইলো।

তার মাস খানেক পরে একবিকেলে আয়মান কলেজের পাশের মার্কেটে একটি গহনার দোকানে গেল। উদ্দেশ্য সপ্তাহ আগে বানাতে দেওয়া ছোটবোনের কানের দুল জোড়া নিতে হবে। দোকানের কাছাকাছি হতেই দেখতে পেল সে দোকান বেরিয়ে যাচ্ছে পিয়াসা। সে আয়মানকে দেখেনি। আয়মান ও তাকে ডাকেনি।

কৌতুহলবশত আয়মান দোকানের ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করলো,
যে মেয়েটি এখন বেরিয়ে গেল সে কেন এলো?

এক জোড়া কানের দুল বিক্রি করলো। কেন ভাই আপনি চিনেন নাকি তাকে?

দোকানদারকে বিশ্বাসযোগ্য কিছু বলতে হবে, নয়তো কি না কি ভেবে বসে থাকে। হুম মেয়েটি আমার ঘনিষ্ঠজন। দুল জোড়া দেখানতো দেখি।

সে পুরোনো একটি বক্স থেকে বের করে দিলো পিয়াসার থেকে কেনা কানের দুল জোড়া। বলল, বুঝলাম না ভাই। বলছেন ঘনিষ্ঠজন। অথচ তার দুঃসময়ে পাশে নেই? আমরা যেন তাকে না ঠকাই। এটার জন্য কত অনুনয় করে কান্নারত কণ্ঠে বলল,এই দুল তার মৃত বাবার দেওয়া।

আয়মান দুল জোড়া দেখে চিনলো। পিয়াসার কানে এতদিন এই দুল জোড়া ছিল। বেশ মানাতো তাকে এই দুল জোড়াতে। আচ্ছা আপনারা কত টাকা দিয়েছেন তাকে?

তারা সোনা কতটুকু ছিল এবং কত মূল্য দিলো জানালো আয়মানকে।

আয়মান মানিব্যাগ থেকে দশ হাজার টাকার ম্যানেজারের হাতে দিয়ে বলল,বাকিটা কাল দিয়ে দিব। সমস্যা আছে? আর এটাকে ওয়াশ করে নতুন একটি সুন্দর বক্সে দেন।

আরেহ কিসের সমস্যা ভাই। আপনি আমাদের চেনা কাস্টমার। একটু পাঁচ মিনিট বসেন।

আয়মান ভাবে গরীব আর মধ্যবিত্তের সম্বল ওই আত্মসম্মানটুকই। তাই এই সম্মানকে বিকিয়ে দিয়ে তারা চলতে পারেনা। বাঁচতে পারেনা। নয়তো সেদিন আমাদের বাসায় থাকার কথা বলতেই বিনাদ্বিধায় রাজী হয়ে যেত পিয়াসা।

ভাইজান নেন। দুই জোড়াই রেডি।
আয়মান বাসায় গিয়ে আলিশার হাতে তার দুল দিয়ে দেয়। পিয়াসার দুল জোড়া নিজের রুমের আলমারির ড্রয়ারে অতি সাবধানে রেখে দেয়। চাবি দিয়ে বন্ধ করে ফেলে। এই ড্রয়ারে তার ব্যক্তিগত সবকিছু থাকে।

সেই রাতেই রায়হান আয়মানকে ফোন দিয়ে পিয়াসার কথা জানায়। জানতে চায়, কি বলিস দোস্ত ঠকব নাকি পিয়াসাকে বিয়ে করলে?

আয়মান গ্লাস থেকে পানি খেল। তার মাঝে কোন ভাবান্তর হলনা। যে কোন পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার অসীম ক্ষমতা তার। অন্যদিকে খুব চাপা স্বাভাবের ও ব্যক্তিত্ববান পুরুষ আয়মান। চট করে না বলা কথাগুলো ও বলতে পারেনা । না পারে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে ।

ছোটবেলায় যখন বাবাকে হারিয়েছে । দেখেছে এই দোতলা বাড়িটার ভাড়া দিয়ে মা কোনমতে হিসেব করে করে দুই ভাইবোনকে বড় করেছে। পড়াশুনা করিয়েছে। অতিরিক্ত চাওয়া পাওয়াকে জলাঞ্জলী দিয়ে দেওয়ার অভ্যেসটা বেশ রপ্ত হয়ে গিয়েছে তার। এখন আস্তে আস্তে তাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এসেছে। মা বোনকে নিয়ে সে ভালই আছে। জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতে প্রেম ভালোবাসা অধরাই থেকে গেল তার জীবনে। সবার জন্য সব কিছু নয়। এই নীতিতে আয়মান বিশ্বাসী।

ফোনের ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এল রায়হানের কানে। শুনতে পেল আয়মান বলছে, একদম ঠকবিনা। ভালো থাকবি তুই। কিন্তু তোর পরিবার কি মেনে নিবে? আংকেল, আন্টি, তোর বড় ভাই,বাকি সবাই? অপরদিকে পিয়াসাও তো রাজী নয় বললি। তাহলে?

রায়হান একটু চুপ থেকে, পিয়াসা দু চারমাস গেলে রাজী হয়ে যাবে। দরকার হলে ওর বন্ধুদের দিয়ে ওকে ম্যানেজ করাব। তোকে দিয়েও অনুরোধ করাব। তুই নিজে প্রেম প্রণয় থেকে বিচ্ছিন্ন।
তাই বলে কি বন্ধুর জন্য এটুকু করতে পারবিনা আয়মান?

ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হয়ে কিভাবে পারিস প্রেম না করে থাকতে? নিরস গবেট কোথাকার।

আয়মান মুহুর্তেই বলল,হাজারবার পারব রায়হান। আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে তাকে পজেটিভ করার চেষ্টা করব।

এই না হলো আমার প্রাণের বন্ধু। কিন্তু আমার বাসায় রাজী করানোটাই তো হিমালয় জয়ের মতো কঠিন। এটাইতো এখন বড় চিন্তার বিষয়। আচ্ছা রাখিরে। গুড নাইট।

গুড নাইট রায়হান। আগাম অভিনন্দন তোকে। মৃদু হেসে মোবাইল রেখে দিল।

গভীর রাত। ঘুম আসছেনা। সবকিছু কেমন যেন ধোঁয়াশা লাগছে। এলোমেলো লাগছে। আয়মান তার ডায়েরিটা ও ভিতরে থাকা নীল কালির কলমটা হাতে নিল। যেহেতু তার একাডেমিক বিষয় ছিল ইংরেজি সাহিত্য। তাই কবিতা, গান লিখার প্রতিও ঝোঁক রয়েছে কিছুটা ।
আর ইংরেজি কবিতাগুলো বাংলায় অনুবাদ করতে বেশ পছন্দ করে আয়মান ।

‘ কেমনে তোমায় আমি ভালবাসি ‘

” কতভাবে আমি তোমায় ভালবাসি? আমায় গণনা করতে দাও।
আমি তোমাকে ভালবাসি গভীরতায়, প্রশস্ততায় এবং উচ্চতায়।
আমার হৃদয় পোঁছাতে পারে, মোহ যখন তিরোহিত।
আমি তোমায় ভালবাসি প্রতিদিনের
অতি গোপন প্রয়োজনে, রাতে এবং দিনে।
আমি তোমায় মুক্তভাবে ভালবাসি,
আমি শুধুমাত্র তোমায় ভালবাসি।
আমি তোমায় ভালবাসি প্রতিটি নিঃশ্বাসে
হাসিতে, কান্নায়, জীবনের সব কিছু দিয়ে; এবং, ঈশ্বর যদি চায়,
মৃত্যুর পরেও আমি তোমায় আরো ভালবাসব। ”

এভাবে ইংরেজ কবি এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং এর কবিতা
‘ হাউ ডু আই লাভ দি ‘ র কিছু কিছু চরণ অনুবাদ করে লিখল।

বার কয়েক পড়ল। আপন মনে নিজের উপর ক্রুর হাসি হাসলো। কল্পনা করলো এক ঝলক। জীবন কি কেবলি নীল বিষাদের? নাকি রাশি রাশি শূন্যতা আর হাহাকারের ঝাঁপি বয়ে বেড়ানো? কি অদ্ভুত খারাপ লাগছে আমার।
রাতটাকে এত নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে কেন।

এই ভিতরে আয়মান নিজ থেকে অতিরিক্ত একটি বাক্যলাপ ও করেনি পিয়াসার সাথে । রায়হানের বিষয় নিয়েও তার কোন মাথাব্যথা নেই। সবাই সবার মত চলুক। আনন্দে থাকুক।

রায়হান পিয়াসাকে রোজ ফোন দেয়। নানান গল্পগুজব করতে চায়। পিয়াসা দু চার বাক্য বলেই অনেক ছুতোয় ফোন কেটে দেয়। সম্ভবপর অনুযায়ী দূরত্ব বজায় রেখে চলে। রায়হান এসব গায়ে মাখেনা।

একদিন ক্লাসে কথাপ্রসঙ্গে পিয়াসা তাদের ‘ সুপার গ্লু বাহিনী ‘ র সাথে রায়হানের বিষয় শেয়ার করল। তারা পুলকিত হলো। তাকে মোটিভেটেড করতে লাগলো রাজী হওয়ার জন্য। নাহিদ বলল দেখ পিয়ু পাখি মেয়ে যেহেতু হয়েছিস। বিয়েতো কাউকে না কাউকে করতেই হবে। রায়হান স্যার টুকটাক হলেও তোর পাশে থেকেছে তোর ভাষ্যমতে। উদারতার হাত প্রসারিত করেছে।
সুতরাং মালা তার গলায় দেওয়া উচিত। কি বল গাইস?

হ হ ঠিক ঠিক বলে সবগুলো টেবিল চাপড়াতে লাগল। পিয়াসা মুখকে ধূসর বর্ণ করে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করল,
মনে না টানলে মালা দেয়া যায় বা দেয়া উচিত? তোরাই বল?

আজব চিজ তুই পিয়াসা। তাহলে মন কারে চায় তোর?

কাউকেই না আপাতত। গেলাম বাই। টাটা। বলে পিয়াসা উঠে চলে গেল।

পিছন দিয়ে তারা নানা দুষ্টমিতে মেতে উঠল। তুলি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে আমারে ক্যান কোন স্যার পছন্দ করেনা। স্যার আর ছাত্রীর প্রণয়ের প্রতি আমার দূর্বলতা সেই প্রাগৈতিহাসিককাল হতেই। ছাত্রী লাজুক লাজুক বদনে পড়া নোট করবে। স্যার রোমাঞ্চিত দৃষ্টিতে ছাত্রীকে দেখবে। আবার চোখাচোখি হবে। একটু আঙ্গুলে আঙ্গুলে মৃদু ঘর্ষণ হবে। সেখান থেকে বিদুৎ উৎপন্ন হবে। সেই তাপ পরিবাহী হয়ে সমান্তরালভাবে দুটো হৃদয়ে ঢলে ঢলে পড়বে। আর তখনি ‘ চাহা হে তুজকো চাহুঙা হারদম। ‘ মান ছবির এ গান গাইতে গাইতে খুন হবে হবে দুজন।

বাকিরা ভ্রুকুটি নজরে হা হয়ে চেয়ে রইলো তুলির দিকে।

তুলি আরো বলতে লাগল,
আয়মান স্যারকে ভালোলাগে। কিন্তু স্যার যেন একটা মেশিন । রসকষহীন মানব। কি যে অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ লাগে আয়মান স্যারকে। উফফস! গাল ভরা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। উড়ুউড়ু ঘন কেশ। হাঁটা কি সুন্দর। জাস্ট ওহ!

জেবা বলল রায়হান স্যার ও কি কম নাকি।

দেখতে দেখতে সময় গড়ালো। পিয়াসার ইন্টার পরিক্ষা শেষ হয়ে গেল। রায়হান ও আয়মান দুজন দুজনের মতো করে পিয়াসার পরিক্ষার বিশেষ খোঁজ খবর রাখল। রায়হান অনেকভাবেই পিয়াসাকে হেল্প করতে চাইল। কিন্তু পিয়াসা কোন হেল্পই আর নিলনা তার থেকে।

যাকে ভালোবাসতে এ হৃদয় সায় দেয়না। শুধু শুধু তার দান নিয়ে নিজেকে ঋনী করে রাখা একদম অনুচিত। এতে দাতার প্রত্যাশার পাল্লা ক্রমশ মজবুত হতে থাকবে।

রায়হান আয়মানকে বলল পিয়াসাকে ফোন দিয়ে যেন বোঝায় একটু জোর চেষ্টা দিয়েই। আয়মান পিয়াসাকে ফোন দিল। কিন্তু সুইচড অফ। পরেরদিন ও ফোন বন্ধ পেল। একটু চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বিকেলেই পিয়াসার বাসায় গেল।

খোঁজ নিয়ে মিনা আন্টির বাসায় ঢুকল পিয়াসার কলেজের শিক্ষক পরিচয় দিয়ে। তিনি হতাশ নয়নে ব্যথিত হয়ে জানালেন,
স্যার আমি যে কি বিপদে আছি এই মেয়েটারে নিয়ে। পরশু আত্মহত্যা করতে গেছিলো। অল্পর জন্য বেঁচে যায়। কখন কি করে বসে ঠিক নাই। অনেক অসুখ এখন। পিছনের রুমে মাটিতে মরার মতো পড়ে আছে।

আয়মান চমকে গেল শুনে। তার মাকে ফোন দিয়ে সব জানালো। তার মা বলল তুই এক্ষুনি মেয়েটাকে নিয়ে আয় বাবা। পরে দেখছি বাকিটা।

আয়মান মিনা আণ্টির অনুমতিক্রমে বাইরে গিয়ে একটা সিএনজি ঠিক করে এনে গেটে দাঁড় করালো।

মিনা আন্টি পিয়াসার সব কাপড়চোপড় গুছিয়ে একটি ব্যাগে ভরে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। আয়মান পাঁজাকোলা করে পিয়াসাকে নিয়ে সিএনজিতে উঠে বসল। তার বুকের বাঁ পাশে পিয়াসাকে মিশিয়ে রেখেছে। নয়তো হাত সরিয়ে নিলেই পিয়াসা হেলে পড়ে যাবে ।

এদিকে রায়হান সুখ সুখ মনে শেষ বিকেলের দিকে আয়মানদের বাসার উদ্দেশ্যে পথ ধরলো। উদ্দেশ্য পিয়াসার বিষয়ে সরাসরি যুক্তি পরামর্শ করতে হবে আয়মানের সাথে।

বাসার গেটে পৌঁছাতেই সে নির্বাক হয়ে গেল। দেখলো আয়মান কোলে করে পিয়াসাকে নিয়ে তাদের বাসায় ঢুকছে।

চলবেঃ ৬

#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ৭ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
এদিকে রায়হান সুখ সুখ মনে শেষ বিকেলের দিকে আয়মানদের বাসার দিকে পথ ধরলো। উদ্দেশ্য পিয়াসার বিষয়ে সরাসরি যুক্তি পরামর্শ করতে হবে আয়মানের সাথে।

বাসার গেটে পৌঁছাতেই সে নির্বাক হয়ে গেল। দেখল আয়মান কোলে করে পিয়াসাকে নিয়ে তাদের বাসায় ঢুকছে।
সে প্রায় দৌড়েই পাশের একটি চোখের ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলো। সিরিয়াস মুডে ব্যস্ততার ভঙ্গিতে,

স্লামালেকুম, আমার চোখটা একটু দেখে দিন প্লিজ। আর চশমার পাওয়ারটাও ঠিক আছে কিনা দেখুন।

ডাক্তার চোখ দেখল। পাওয়ার দেখল। জানালো পাওয়ার ঠিক আছে। ডাক্তারের ভিজিট দিয়ে সে বের হয়ে গেল।

একটি নিরব গলিতে ঢুকে সিগারেটের পর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল। চোখ দুটো রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। যেন রক্ত চোষা পিশাচ । ভাবনার তলানীতে গিয়েও কোন সমীকরণ মেলাতে পারছেনা। আয়মানের চরিত্রের সাথে তার দৃষ্টিগোচর হওয়া বিষয়টা কিছুতেই যায়না। নিরেট ভদ্র আর বেরসিক একটা ছেলে আয়মান। বিপরীত লিঙের প্রতি তার বিন্দুমাত্র কিউরিওসিটি নেই। সেখানে অনুরাগ জন্মানোর প্রশ্নই উঠেনা।

ভার্সিটিতে আয়মানের প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছে কত মেয়ে। আয়মান পাত্তাই দেয়নি। তাদের আবেগকে বাষ্পের মতো উড়িয়ে দিয়েছে । সেই আয়মান পিয়াসাকে ভালোবাসে। ভাবাই যায়না। সে নিজেই দেখেছে এই পিয়াসাকে আয়মান কি কঠিনভাবে বেত্রাঘাত করেছে।

দু’ চারটা মানুষের রক্ত ঝরাতে পারলে রায়হান নিজেকে দমাতে পারতো এখন। আয়মানের উপর ভিতরে ভিতরে ফুঁসে উঠছে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো। এভাবে বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেল।

________
আয়মান পিয়াসাকে নিয়ে ঢুকলো আলিশার রুমে। কোল থেকে খাটে বিছানার উপর শোয়ালো। তার মা ছুটে এলো। সে দ্রুত পায়ে নিজের রুমে চলে গেল। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। ধপাস করে বিছানার মাঝ বরাবর পড়ল। উপুড় হয়ে আছে।
বিরতিহীনভাবে স্বাস উঠানামা করছে। এক অজানা অচেনা পুলক জাগানিয়া রোমাঞ্চকর অনুভূতি তাকে গ্রাস করে ফেলছে।

জীবনে এর আগে কখনোই তার হৃদয়ে কাউকে নিয়ে এমন অনুভব অনুভূতির উদয় হয়নি। না হওয়ারই কথা। এর আগে বাইরের কোন মেয়েকেই সে ভুলক্রমেও স্পর্শ করেনি। অথচ আজ একটি যুবতী মেয়েকে তার কোলে তুলে নিতে হলো। পড়ে যাবে করে কাঁধ ও বুকের সাথে মিশিয়ে নিতে হলো। পিঠের উপরে হাত দিয়ে রাখতে হল। ঘোরে চলে যাচ্ছে আয়মান। কেমন বোহেমিয়ান মনে হচ্ছে নিজেকে তার কাছে। আবার খানিক সংকোচ ও লাগছে। না তাকে এত বিবশ হলে চলবেনা। কারণ পিয়াসা তার বন্ধুর প্রেম। হবু লাইফপাটনার।

তার রুমের দরজায় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। অসহনীয় বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দরজা খুলতেই দেখে রায়হান। অবাক হলনা। কারণ রায়হান প্রায় তাদের বাসায় আসে বহু আগে থেকেই।

কিরে দরজা বন্ধ কেন তোর? সতেজ,প্রাণময় চাহনিতে জিজ্ঞেস করলো রায়হান।

আয়মান নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল আগেই। বলল, না শরীর ছেড়ে দিয়েছে তাই একটু রেস্ট নিচ্ছি। তোর প্রেম আলিশার রুমে। দেখেছিস?

না এখনো যাইনি। যাব। আলিশার কাছে ডিটেইলস শুনেছি।

হুম। তারাতো আর জানেনা তোর জন্যই গিয়েছি আর আনতে হলো। তুই বললি ফোন দিতে। বারবার দিয়েও পাইনি। পরে তোর কথা ভেবেই খোঁজ নিতে গেলাম। গিয়ে দেখি অনেক অসুস্থ। মাকে জানালাম। সবশুনে মা বলল বাসায় নিয়ে আসতে। সুইসাইডের কথাটা আয়মান লুকালো রায়হানের কাছে।

রায়হানের কোন অভিযোগ নেই আয়মানের উপর। ভুল বোঝার ঘেরাটোপ থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিল। হাসিমুখে বলল, খুব উপকার করেছিস দোস্ত। তোদের বাসায় যখন তখন আসতে পারব পিয়াসার কাছে। কিন্ত সে যেখানে থাকতো,সেখানে বারবার গেলে সবাই মাইন্ড করতো।

স্ট্রেঞ্জ! তাতে কি। তুইতো ওকেই বিয়েই করতে যাচ্ছিস।

তা ঠিক। তবুও। বাসার সাইড তো এখনো পজেটিভ করতে পারিনি। এর আগে পিয়াসার দিকটা শতভাগ নিশ্চিত হই। পরে বাসার দিকটা দেখছি।

ওকে। যেভাবে সুবিধা মনে করিস। তাই কর। এখন এলি কেন সেটা বল?

ওই পিয়াসার বিষয়েই আলাপ করতে। তবে এখন যেহেতু তোদের বাসায় আছে সমস্যা নেই। আমি তার সাথে আরেক দফা বৈঠকে বসব। বলে রায়হান হেসে ফেলল।

এখন পিয়াসার কাছে যা তুই। বলল আয়মান। রায়হান উঠে গেল পিয়াসার কাছে। পাশে আয়মানের মা ও আলিশাও ছিল বসা।

পিয়াসা এখন একটু আরাম বোধ করছ?

পিয়াসা শ্রদ্ধাবনত চোখে রায়হানকে দেখল। মিনমিনিয়ে বলল একটু স্যার।

আয়মানের মা রায়হানের দিকে চেয়ে , ভালোই হলো। পিয়াসা তোমাদের দুই বন্ধুরই ছাত্রী। তাই তুমিও এসে এসে ওকে দেখে যেও।

রায়হান মনে মনে আন্দোলিত হয়ে উঠলো। অবশ্যই খালাম্মা। পিয়াসার দুঃসময়ে আয়মান আমি দুজনই পাশে রবো। তো খালাম্মা আমি এখন আসি। কাল আবার আসব। পিয়াসার মাথায় হাত রেখে কোমলকন্ঠে বিদায় নিল রায়হান।

পিয়াসা রাতে আলিশাকে জিজ্ঞেস করলো, আমি কিভাবে এসেছি তোমাদের বাসায়?

তোমার স্যারের কাঁধে চড়ে। এই বলে হিঃহিঃহিঃ করে কিটকিটিয়ে হেসে ফেলল আলিশা। তোমার কোন হুশ ছিলনা তখন পিয়াপু। ভাইয়া কোলে করে এনেছে। শুনে পিয়াসা মুখ ঢেকে ফেলল লজ্জায়। খুব অস্বস্তি হচ্ছে তার এখন।
কি করবে বল। ভাইয়া বেচারা যে নিরুপায় হয়ে গেল। কারণ আম্মাজানের হুকুম বলে কথা। অমান্য করার সাধ্যি কার আছে।

তিন চারদিনের মধ্যেই পিয়াসা সদ্য মাথা তুলে বেড়ে উঠা কচি গাছের চারার মতন ঝরঝরে হয়ে গেলো। আলিশার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তার মায়ের সাথেও সখ্যতা হয়ে গেল।

এই ভিতরে আয়মান পিয়াসার সাথে দেখাও করেনি। কথাও বলেনি। এতে পিয়াসার বেশ দুঃখবোধ হলো। ধরে নিল,আয়মান স্যার আসলেই আমাকে পছন্দ করেনা। মানবিকতার জায়গা থেকেই বাসায় এনেছে সুস্থ করার জন্য। কিন্তু আর একটিবার ও সামনে এলনা। অথচ রায়হান স্যার রোজ ফোনে খবর নিত। বাসায় এসে দেখে যেত। মিছে মিছে অন্যের দয়ায় এ বাসায় থাকার মানেই হয়না।

এক দুপুরে ভাত খেয়ে উঠার পর পিয়াসা তার ব্যাগ হাতে নিয়ে এসে বলল,
আন্টি আমি চলে যাচ্ছি। দোয়া করবেন। শুনে তিনি ও আলিশা চমকে গেল। তারা প্রবলভাবে বাধা দিল। সব বুঝিয়ে বলল যে তোমার কোথাও যাওয়া লাগবেনা। আমার যদি আরেকটা মেয়ে থাকতো। ফেলে দিতাম? বল? তাই বলছি পাগলামি করোনা মা। এখানেই থাকবে সবসময় আমাদের সাথে।

না আন্টি এভাবে আপনাদের বাসায় থাকব, খাবো । এটা আমার জন্য ভারী হীনমন্যতার ও নিচুতার। আমি এটা পারবনা প্লিজ।

আচ্ছা অন্তত আজ রাতটুকু থাক। আয়মান আসুক বাসায়। সে বরং কাল তোমাকে বাসে তুলে দিবে।

এই কথার উপরে পিয়াসা ব্যাগ নিয়ে আলিশার রুমে চলে গেল । আয়মান এলে বিষয়টা জানাল তাকে তার মা ও বোন। আয়মান তাদেরকে রায়হানের বিষয়টা জানাল। শুনে তার মা বলল,ওহ তাহলেতো ওর আমাদের বাসায় থাকতেই হচ্ছে বিয়ে হওয়া পর্যন্ত।

হুম তাই মা। আমি পিয়াসার সাথে রাতে কথা বলব। আশাকরি ফেলে দিবেনা।

শুনে আলিশা ভিমরি খেল যেন। তার চক্ষু চড়কগাছ। খেলখেলিয়ে উঠে আয়মানকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমিতো ভাবছি পিয়াসাকে আমার ভাবি বানাব। তুমি সারাজীবন বলদই রয়েই যাবা। এত নাইস এত কিউট একটা মেয়েকে হাত করতে পারলেনা।

দেখলে মা কি অসভ্য একটা। প্রেম না করতে পারলে নাকি বলদ?

ঠিকই তো বলছি। প্রেম না করে কয়টা ছেলে থাকে এখন? যারা প্রেম করেনা। রোমান্স করেনা। আমি তাদের বলদ মনে করি।

এই তুই এত নিলজ্জ্ব কবে থেকে হলি? কেমন করে হলি? কলেজে পা না রাখতেই এই হাল তোর। আর…
এই থামবি দুই ভাইবোন। মায়ের ধমকে থেমে যায় আয়মান ও আলিশা।

_______
রাতে আলিশাকে দিয়ে আয়মান পিয়াসাকে ডেকে নিল। পিয়াসা গেল আয়মানের রুমে। দরজা খোলা। পর্দা ফাঁক করা। দরজা বরাবর দুরুদুরু বক্ষে দাঁড়িয়ে আছে পিয়াসা।

বসো পিয়াসা। তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে। পিয়াসা নরম হয়ে বসলো চেয়ার টেনে। আয়মান এগিয়ে গিয়ে আরেকটি চেয়ার নিয়ে পিয়াসার মুখোমুখি বসলো। পিয়াসা চেয়ার টেনে পিছনে নিতে চেষ্টা করতেই আয়মান চেয়ারের হাতল ধরে ফেলল। পিয়াসা হেরে গেল আয়মানের বাহুশক্তির কাছে। চেয়ার এক ইঞ্চি ও পিছনে নিতে পারলনা। সন্দেহতীত নজরে আয়মানের দিকে চাইলো।

এভাবে দেখছ কি? অন্যের হবু স্ত্রীকে একা পেয়ে আমি জডিয়ে ধরে বসব? আস্তে করে ভরাট গলায় বলল আয়মান।

শুনে পিয়াসা হতভম্ব হয়ে গেল। মনে মনে, নিজেই বলল কাউকে না জানাতে। এখন নিজেই দেখি বন্ধুকে জানিয়ে বসে আছে। থরথর করে কাঁপছে পিয়াসা। কিছুই বলতে পারছেনা। চুপটি হয়ে বসে আছে।

মা বলল তুমি নাকি গ্রামে চলে যেতে চেয়েছ? তাহলে রায়হানের কি হবে? তার সাথে প্রেম করেছ অথচ বিয়ে করবেনা। প্রতারণা হয়ে গেলনা পিয়াসা? তুমি কি তাহলে ছলনাময়ী নারী?

রাগে,ক্ষোভে পিয়াসা বেলুনের মত ফুলে যাচ্ছে। তার অভিমান আবেগ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ল। কম্পিত অধরে আয়মানের দিকে তাকিয়ে, তারমানে উনি বলছে আমি প্রেম করি উনার সাথে? ছিঃ! একজন শিক্ষক এতটা মিথ্যুক, ধাপ্পাবাজির হতে পারে জানা ছিলনা। আমার ব্যাগে কিন্তু আরো দশটা ঘুমের ট্যাবলেট ‘ ইপনিল ‘ আছে। আজ রাতেই খেয়ে মরে যাব। তবুও না এই শহরে থাকব। না কাউকে বিয়ে করব।

আয়মান বুঝতে পারল পরিস্থিতি বেগতিক। কন্ঠকে খাদে নামিয়ে আস্তে করে বলল,খুব স্যরি পিয়াসা। এ কথাগুলো আমিই বলেছি। রায়হান একবার ও বলেনি তুমি তাকে লাভ কর। সে তোমার সাথে যতটুকু যা, ঠিক তাই বলেছে আমার কাছে। ওকে ভুল বুঝনা প্লিজ।

পিয়াসার রাগ কিছুটা স্তিমিত হলো রায়হানের উপর । এবার রাগ জাগ্রত হলো আয়মানের উপর। মনে মনে গজগজ করতে করতে বলল,তাহলে আমাকে আপনি মিথ্যে বললেন কেন? আপনি তো এমন মজা করার মানুষ নয় স্যার।

এক মিনিট আসছি বলে আয়মান উঠে গেল। খানিকবাদেই ফিরে এলো। হাতে পিয়াসার ব্যাগ। ব্যাগের ভিতরের সাইড পকেট থেকে ট্যাবলেটের পাতাটি হাতে নিল। একটা একটা করে সব ট্যাবলেটগুলো হাতে নিল। গ্লাসভর্তি পানিতে টুপটুপ করে ফেলে দিল। কিছুসময় পর গলে গেলে বেসিনের কল ছেড়ে গ্লাসের সব পানি ঢেলে ফেলল।

পিয়াসা নিরব থেকে অপলক নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখলোই শুধু। তার বুকের ভিতর উথাল-পাতাল ঝড় শুরু হলো আয়মানের এই পজেসিভ আচরণে।

আয়মান ফের পিয়াসার মুখোমুখি হয়ে বসল চেয়ারে এসে। আচ্ছা যেজন্য ডেকেছি। আসল কথাটা বলি মন দিয়ে শোন, পিয়াসা নির্লিপ্ত চোখ দুটির পাতা তুলে চাইলো আয়মানের দিকে।

রায়হান তোমাকে ভালোবাসে। বিয়ে করে সুখী করতে চায়। সে আমার বন্ধু। আমি তাকে তোমার চেয়ে বেশি জানি। সুতরাং আমাদের বাসায় থাক তুমি । ও তার ফ্যামেলিকে রাজি করিয়ে আমাদের বাসা থেকে বউ বানিয়ে নিবে তোমাকে।

পিয়াসা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বলল, আমি আপনাদের বাসায় থাকব। পড়াশুনা চালিয়ে যাব। তবে রায়হান স্যারকে বিয়ে করতে পারবোনা। কারণ আমি ভুল করেও উনাকে শিক্ষক ছাড়া আর কিছুই ভাবিনা।

রায়হান এত কিছু করার পরেও তাকে বিয়ে আপত্তির কারণটা কি একটু বলবে? তুমি কি অন্য কোন ছেলেকে পছন্দ করো?

নাহ স্যার। এসব আমার জন্য বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

নিজের অজান্তেই আয়মানের হৃদয়াকাশে একদল সুখ পাখি চঞ্চল কলরবে মেতে উঠলো।

চলবেঃ ৭