#প্রণয়ের_বাঁধন
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
|১|
-“ছিঃ ছিঃ ছিঃ সারারাত একঘরে প্রাপ্ত বয়স্ক অবিবাহিত ছেলে-মেয়ে রাত কাটায় কীভাবে? হায় হায়! হায় খোদা জাত মান সব গেল দেখছি! অ্যাই মেয়ে? অ্যাই মেয়ে অ্যাই লাজ লজ্জা কিছুই নেই নাকী, হ্যা? দেখে তো ভদ্রই মনে হয় তবে এমন একটা কান্ড করতে বিবেকে বাঁধল না! একটি বারো শরম করলো না,হ্যা?”
সত্তরোর্ধ্ব নুরজাহান বেগম পরনে শুভ্ররঙা আটপৌরে শাড়ি। নাক সিঁটকিয়ে চেঁচিয়ে বিলাপ করতে থাকে। শেষে ধ’ম’কের সুরে বলে তীক্ষ্ণ চোখে তনুজার দিকে চাইলেন। তনুজা যেন পাথর হয়ে জমে ছিল। কী থেকে কী হয়ে গেল এখনো বুঝে আসছে না তনুজার! নুরজাহানের ধ’ম’কে তনুজার পেলব শরীর মৃদু কেঁপে উঠল। নুরজাহানের দিকে ভ’য়ে ভ’য়ে পলক তুলে চায় তনুজা। দিঘির জলের মতো শান্ত আঁখিজোড়া নোনা জলে টইটম্বুর হয়ে আছে। সারা শরীর কেমন যেন অসাড় হয়ে আসছে। তনুজার চোখের ঘনপল্লব থেকে থেকেই কাঁপছে। তনুজা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে আওড়ায়,
-“বিশ্বাস করুন দিদুন। কীভাবে এরকমটা হয়েছে আমি সত্যিই কিছু জানি না। আমি মনে করতে পারছি না।”
-“থামবে অ’স’ভ্য মেয়ে মানুষ কোথাকার। তুমি দুধের বাচ্চা? আর নাকী পাঁচ বছরের খুকি? এত বড় এক কান্ড ঘটিয়ে এখন বলছে সে কিছুই জানে না। আমাকে তোমার ব/লদ মনে হয়,হ্যা? পা/গলেও তোমার কথা বিশ্বাস করবে না। বাজে মেয়ে মানুষ কোথাকার। বাপের চরিত্র যেমন মেয়ের চরিত্রও তো তেমনই হবে। মা/তালের মেয়ে আবার কত ভালো হবে। যার বাপ বউ থুয়ে অন্য বেডির লগে প’র’কি’য়া করে বেড়াইত, **পল্লিতে রাত কাটায় তার মেয়ের স্বভাব চরিত্র কত ভালো হবে এ সবাই জানে বোঝে,হুহ। আমারই ভুল হয়েছে এরকম একটা মেয়েকে আমার বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছিলাম। ইশশ্! কী ভুলটাই না করে ফেললাম। হায় হায় হায়!”
কপাল চা’প’ড়া’তে থাকে নুরজাহান। মানুষ সব সময় মানুষের ঠিক দূর্বল পয়েন্টে আ’ঘা’ত করে। এই একটি যায়গায়ই তনুজা বড্ড দূর্বল। তবে এতে তার কী দোষ! বাবার উপর তনুজার পাহাড়সম অভিমান। বাবার মুখ দর্শন করতেও তনুজার কখনো ইচ্ছেও হয় না। একটা দুশচরিত্র,মা/তা/ল এর মেয়ে পরিচয়ে সমাজে বেঁচে থাকা কতটা কষ্টের তা কেবল নিরীহ নিষ্পাপ মেয়েটিই বোঝে আর জানে। মা তো সেই ছোট্টটি থাকতে ছেড়ে গিয়েছে। পারি দিয়েছে না ফেরার দেশে। তনুজার খুব ক্ষোভ হয় মায়ের উপর। মা কেন তাকে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একলা ছেড়ে গেল! কেন তাকে সঙ্গী করে সাথে নিলো না! তাহলে তো অন্তত এরকম অসুস্থ পরিবেশে তাকে থাকতে হতো না। তনুজা নাক টেনে হাতের উল্টো পাশ দিয়ে গাল গড়িয়ে পরা পানিটুকু মুছে নেয়। উপস্থিত কয়েকজোড়া চোখ তনুজার দিকে কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সবার চোখে তনুজার জন্য ঘৃণা ঝরছে। নুরজাহানের পাশে তার ছোট মেয়ে বয়স চল্লিশোর্ধ্ব তামান্না বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। নুরজাহান তো চোখ দিয়েই যেন গিলে খাচ্ছে। বুয়া মাজেদা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে তামাশা দেখছে আর মনেমনে আড়ালে হাসছে। তনুজা ঘাড় ঘুরিয়ে এ বাড়ির ছোট বউ শিরিন সুলতানার দিকে চাইল। শিরিনের মুখে রা নেই। মূর্তির মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে তিনি। তনুজা দু’কদম শিরিনের দিকে এগোয়। শিরিনের হাত দু’টো ধরে ঝাঁকায়। অসহায়ত্ব ঝরল তনুজার কন্ঠে, সে বলল,
-“আন্টি আপনি কিছু বলুন। এভাবে চুপ থাকবেন না প্লিজ। প্লিজ আন্টি এভাবে চুপ থেকে ওনাদের সাথে নীরব সম্মতি জানাবেন না। দয়া করে আমাকে বোঝার চেষ্টা করুন। আমি সত্যিই বলছি আমি জানি না।আমি জানি না, আমি কীকরে ইভান ভাইয়ের রুমে ছিলাম। ট্রাস্ট মি।”
শিরিন তনুজাকে আগলে নেয়। তনুজার মাথাটা পরম মমতায় বুকে রাখে। শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে ভরাট গলায় বলল,
-“মা আমার মনেহয় যা হওয়ার হয়েছে। আমাদের এখানেই থেমে যাওয়া উচিত। কথাটা পাঁচকান হওয়ার আগেই চুপ করে যাওয়াই বেটার।”
নুরজাহানের মুখে অন্ধকার নামল। ফর্সা মুখ কালো করে খেকিয়ে উঠলেন,
-“যা সব ঘটেছে সব তোমার জন্য। তোমার জন্যই এমন একটা কেলেঙ্কারি হয়ে গেল। যদি না তুমি এই মেয়েটাকে এই বাড়িতে আশ্রয় দিতে , আর না তো এরকম বি/শ্রী ঘটনা ঘটতো।বাড়িতে দুই দুইটা জোয়ান ছেলে আছে, সেখানে তুমি কী করলে বান্ধবীর অসহায় মেয়েকে আশ্রয় দিয়ে ভালো মানুষি দেখালে। আমি পইপই করে বলেছিলাম এরকম যুবতী মেয়েরে বাড়িতে রাইখো না। সাহায্য করার হলে করো ,ঠিক আছে। তবে হেতিরে মেস ঠিক করে দাও। মেসে থাকগা। শুনলা না তো আমার কথা। হলো এবার মান সম্মান সব গেলো তো। আমি সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। আমার শ্বশুর ঘরও সম্ভ্রান্ত। সেখানে এরকম একটা ঘটনাকে ধামাচাপা দেই কীকরে! এরকম একটা মা/রা/ত্মক বিষয় তুমি ধামাচাপা দেয়ার কথা কীকরে ভাবো বউমা? তোমার কী জ্ঞান-বুদ্ধি,বিবেক সব জলাঞ্জলি দিয়ে দিয়েছো? আমার বাড়ির বউ হয়ে তোমার মুখ থেকে নির্বোধের মতো কথা আমি মোটেই আশা করিনি। ডাকো এই মেয়ের দাদীকে। আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে। এমন ন’ষ্ট চরিত্রের নাতনিকে আমাদের ঘাড়ে চেপে তিনি তো আরামসে আছেন।”
দাদীকে ডাকার কথা শুনতেই তনুজার পিলে চমকে উঠল। আঁতকে উঠে তনুজা। তনুজা একপাশে দাঁড়ানো সুঠাম দেহের অধিকারী ইফতিয়ার ইভানের দিকে চাইল। লোকটার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। কপাল ছাড়িয়ে ভ্রু পর্যন্ত নেমেছে এলোমেলো চুল। তনুজা কিছুপল ঐ মানবের দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল। তনুজা বুঝতে পারছে না এই লোকটা এত চুপচাপ কেন? এ কিছুই বলছে না কেন? তনুজা একবুক আশা নিয়ে ইভানের সামনে দাঁড়ায়। ইভানের দিকে মুখটা তুলে তাকিয়ে ভেজা গলায় বলল,
-“আপনি এভাবে চুপ করে আছেন কেন? সবাইকে ক্লিয়ার করুন। আপনার আর আমার মধ্যে এমন কিছুই হয়নি, যা সবাই ভাবছে। আর আপনার আর আমার অমন কোন সম্পর্কও নেই, আর নাতো কোনদিন ছিলো। প্লিজ সবাইকে খুলে বলুন।”
ইভান দুইহাত টাউজারের পকেটে গুঁজে দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ করে রেখেছিল। পরপর মাথা তুলে শান্ত নজরে তনুজার অসহায় মুখশ্রী দেখল। নির্লিপ্ত জবাব এলো,
-“আমি রাতে ড্রাঙ্ক করে বাসায় ফিরেছিলাম। ইউ নো ড্রাঙ্ক অবস্থায় থাকলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। আর পরবর্তীতে সবকিছু তার মেমরিতেও থাকে না। সো আমি মনে করতে পারছি না, একচুয়েলি রাতে আমার সাথে কী ঘটেছিল। আর সকালে ঘুম ভাঙ্গার পরের টা তো তুমি নিজেই জানো। ”
তনুজার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো যেন। এরুপ উত্তর ইভানের থেকে আসবে,তা সে কস্মিনকালেও ভাবেনি। তনুজার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। চারিদিকটা কেমন ঘুরতে থাকে তনুজার কাছে। নুরজাহান আবার বিলাপ করতে থাকেন,
-“ছিঃ ছিঃ এর পরেও ছোট বউমা তুমি আমাকে ঘটনাটা চাপা দিতে বলবে? আর দাদুভাইয়ের কথা শুনে তো মনে হচ্ছে সব দোষ এই মেয়ের। এই মেয়েই খা/রাপ।”
তনুজার চারিপাশটা ঘুরতে থাকে। চোখের সামনের সবকিছু ঝাঁপসা হয়ে আসে। তনুজা দুইহাতে কপাল চেপে ধরে। সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসতেই মেছেতে লুটিয়ে পরে ।
_______________
মির্জা বাড়িতে আসা তনুজার একমাসও হয়নি। মা/তা/ল বাবা এক বিপত্নীক চল্লিশোর্ধ্ব দুই বাচ্চার বাপের সাথে বিয়ে ঠিক করেছিল তনুজার। বিয়ের আগের দিন তনুজার দাদি সুফিয়া তনুজার মায়ের বান্ধবী শিরিনের কাছে সাহায্য চান। আপাতত কটা দিন যেন তনুজাকে থাকার ব্যবস্থা করে। এরমধ্যে সুফিয়া তার একমাত্র মেয়ের কাছে তনুজাকে পাঠিয়ে দিবেন। তনুজার ফুপু-ফুপা চিকিৎসা নিতে ইন্ডিয়া গিয়েছে। তিনমাসের ভিসায় তারা ইন্ডিয়া চিকিৎসা নিতে গিয়েছে। ওনারা ফিরলেই তনুজাকে তাদের কাছে একেবারে পাঠিয়ে দিবেন সুফিয়া। মা/তা/ল বিকৃত মস্তিষ্কের বাবা নামক কলঙ্কিত নোং*রা মানুষের ছায়াও পড়তে দেবে না তনুজার উপর।
আজ সকালে মির্জা বাড়ির কাজের বুয়া মাজেদা ইভানের রুম ঝাড়ু দিতে গিয়ে এক বেডে ইভান আর তনুজাকে দেখতে পায়। মাজেদা ছিহ ছিহ করে চিৎকার করে বাড়ির সবাইকে জড়ো করে। মাজেদার হাঁক ছেড়ে ডাক, তারপর সবার হৈচৈ এ তনুজার ঘুম হালকা হয়। শোয়া থেকে ধপ করে উঠে বসে সে। তার মাথাটা কেমন যেন ঝিম ধরে ছিল। ঘুম ভেঙ্গে ইভানের রুমে নিজেকে দেখে বিস্মিত হয় তনুজা। সে কখন এখানে এলো, সেসব কিছুই মনে করতে পারে না। তারপর নুরজাহানসহ বাড়ির প্রতিটি সদস্য তনুজাকে দোষারোপ করতে থাকে।
এইতো কিছুক্ষণ আগে সুফিয়া আসছে। নাতির ঘরে একটা মেয়ে ছিল। সেখানে সব দোষ যেন মেয়েটারই। নাতির এতে কোন দোষ নেই। মেয়েটার চরিত্রে সমস্যা আছে। নাতি ধোঁয়া তুলসি পাতা। মেয়ে যদি এতো ভালোই হবে ছেলেটার ঘরে কী করতে গিয়েছিল! ছেলেটা জোর করলে চিৎকার করতে পারত,বাড়ি ভরতি লোকজন ছিল। তারমানে এখানে সব দোষ কেবল তনুজার। ইভান পুরুষ মানুষ আর পুরুষ মানুষের ভার্জিনিটি হারায় না, তারা ন’ষ্টা হয় না, তাদের কোনো দোষও থাকে না। নুরজাহান ঠিক এমন করেই বলছিলো সুফিয়াকে। বসার ঘরে সোফায় মাথা নিচু করে বৃদ্ধা সুফিয়া বসে আছে। নুরজাহান রাজকীয় সিঙ্গেল সোফায় বসেছে। যেন রাজ দরবারের বিচার সভায় সে প্রধান বিচারক। শিরিন আর তামান্না একপাশে দাঁড়িয়ে। নুরজাহান গম্ভীর মুখে বলল,
-“সব তো শুনলেন। কাজের বুয়াদের তো জানেনই কেমন স্বভাব। এই ঘটনার চাক্ষুস সাক্ষী হলো মাজেদা। সে আমাদের এখানে ছাড়াও এই তল্লাটে আরো কয়েক বাসায় কাজ করে। মূহুর্তে খবরটা ছড়িয়ে দিবে সে। ছোট বেলায় এক গল্প শুনেছিলাম। কোন এক রাজার বউয়ের কালো বাচ্চা হয়েছিল। এক দাসি বলল, রানি মা’র কালো দেখতে ছেলে হয়েছে, এই খবর অন্যজন বলে, রানি মায়ের কাকের মতো কালো দেখতে ছেলে হয়েছে। এরকম করতে করতে রাজ্যে গুজব রুটে যায়,রানি মায়ের কাক হয়েছে। তো বুঝছেনই তো আমাদের সম্ভ্রান্ত মির্জা বাড়ি। মানুষ গুজব রুটে মান সম্মান শেষ করে দিবে। এমনিতেই শত্রুর অভাব নেই। তিলকে তাল করতে উস্তাদ সবাই। একবার ঘটনাটা জানাজানি হলে সমাজে মাথা নিচু হয়ে যাবে। আমার কাছে সব থেকে আগে আমার মির্জা বাড়ির সম্মান। যা আমি বেঁচে থাকতে ধূলিসাৎ হতে দিবো না। তাই কথাটা পাঁচকান হওয়ার আগেই, জল গড়িয়ে পরার আগেই একটা সিদ্ধান্তে যেতে চাই। আপনার নাতনি যদিও আমার নাতির,এই মির্জা বাড়ির যোগ্য নয়। না আছে রুপ আর না আছে গুণ আপনার নাতনির। কোনোদিক থেকেই আমার বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্যতা নেই ঐ মেয়ের। তারপরেও আমি এই মির্জা বাড়ির সম্মান রক্ষার্থে ওদের দুজনের বিয়ে দিতে চাচ্ছি। এতে আপনি কী বলেন?”
___________
পিটপিট করে চোখ মেলে তাকানোর চেষ্টা করে তনুজা। শা শা শব্দে ঘোরা ফ্যানের দিকে কিছুপল থ মে/রে তাকিয়ে থাকে তনুজা। পরপর মস্তিষ্ক সজাগ হতেই আশেপাশে তাকায়। পায়ের কাছে বিছানায় বসে আছে ফুল। তনুজার প্রতিবেশি বোন। তনুজার সাথে ভারী মিষ্টি সম্পর্ক ফুলের। দাদির সাথেও ফুলের বেশ সখ্যতা, পান পিষে দেয়, আবার দাদির পান নিয়ে খায় ফুল। কোথাও গেলে ফুল দাদির পিছ ধরে। এখানে ফুলকে দেখতে পেয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে বসে তনুজা। পিঠজুড়ে অবিন্যস্ত খোলা কেশ। শ্যামবর্ণের মুখটা চিন্তায় ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে তনুজার। মুখের উপর ছোটছোট এলোমেলো চুল উড়ছে বাতাসে । সব সময় নিজেকে গুছিয়ে রাখা তনুজা কয়েক ঘন্টার ব্যবধানেই কেমন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। তনুজা ব্যস্ত স্বরে পর পর এক নাগাড়ে জিজ্ঞাসা করল,
-“ফুল তুই? দাদি আসছে? ওরা দাদি রে কী বলছে? দাদি নিশ্চয় ওদের কথা বিশ্বাস করেনি। আমি দাদির সাথে কথা বলব,ফুল দাদি কই? দাদি কই?”
ফুলের মুখটা ভার। বিরস স্বরে বলে,
-“দাদি ওনাগো লগে কতা কইতাছে। তোমার আইজ বিয়া তনু আপা। আমি শুনলাম ইভান নাকী নাম ঐ ব্যাডার লগে আইজ সন্ধ্যায় তোমার বিয়া। দাদি আমারে কইলো বিয়া পড়াইয়া থুইয়া তারপর বাড়ি যাইব।”
বিনা মেঘে যেন বজ্রপাত হলো। তনুজার বুকের ভেতর অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। সাথে মাথা হ্যাং হয়ে আসছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না? তনুজা তার মুঠোফোনটা খুঁজতে থাকে আর বিড়বিড় করে আওড়ায়,
-”দিব্য…দিব্য একমাত্র দিব্যই পারবে আমাকে এই বিপদ থেকে বাঁচাতে। সবাই ভুল বুঝলেও দিব্য ঠিক আমাকে বুঝবে। আমাকে এক্ষুনি দিব্যর সাথে কথা বলতে হবে।আজকেই তো দিব্যর ফেরার কথা। প্লিজ দিব্য ফাস্ট আসো তুমি। আমাকে তোমার খুব প্রয়োজন। ”
সারা ঘরময় তন্ন তন্ন করে খুঁজেও ফোন পাচ্ছে না তনুজা। তনুজার নিজেকে পা/গ/ল পা/গ/ল ঠেকছে। তনুজা ড্রয়ারে ফোন খুঁজতে থাকে। এরমধ্যে শিরিন আসে খাবার নিয়ে। খাবারটা টেবিলে নামায়। তনুজা শিরিনকে দেখে উদ্ভ্রান্তের মতোন ছুটে সামনে দাঁড়ায়,
-“আন্টি? আন্টি যা হচ্ছে,হতে যাচ্ছে তা মোটেই ঠিক হচ্ছে না। একদম ঠিক হচ্ছে না। আন্টি আর কেউ জানুক আর না জানুক আপনি তো জানেন আমার আর দি__”
কথা সম্পূর্ণ করতে দেয় না শিরিন সুলতানা।তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
-“ভুলে যাও সবটা। যা হচ্ছে মেনে নাও।”
তনুজা আহত হলো। বুকের ভেতরটা তার ক্ষত বিক্ষত হয়। অসহনীয় যন্ত্রণায় বক্ষ পিঞ্জর ছটফট করছে। তনুজা অশান্ত গলায় বলে,
-“দয়া করুন আন্টি। আপনি সবটা সামলে নিন। আমায় একটু সময় দিন। আমি প্রুভ করে দিব। আমি খারাপ নই। আর নাতো আমার ওরকম বাজে ইন্টেনশন ছিল।”
-” ভেবে নাও যা হচ্ছে হয়তো ভালোর জন্যই । তোমার দাদি মতামত জানানোর পরেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। খাবারটা খেয়ে নিও। ওদিকে আমাকে ডাকছে। ”
শিরিন আর কোনো কথা না বলেই প্রস্থান করে। তনুজা শিরিনের যাওয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে ঠাঁয় তাকিয়ে রয়। সুফিয়া নাতনির কাছে আসতেই তনুজা তার দাদিকে বোঝানোর চেষ্টা করে এই বিয়ে করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। সুফিয়া অটল থাকে তার সিদ্ধান্তে। বোঝায় তনুজাকে,
-“হয়তো এটাই তারজন্য মঙ্গলকর। সৃষ্টি কর্তা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। সবটা মেনে নিতে বলেন।”
___________
পড়ন্ত বিকেল। শিরিনের রুমে দাড়িয়ে মা-ছেলে। দিব্যর ফর্সা মুখটা কালো হয়ে আছে। চোখ দু’টো থেকে আ/গু/ন বেরুচ্ছে যেন।রাগে ক্রোধে ফুঁসে উঠে দিব্য কাঁচের ফুলদানিটা এক হাত দিয়ে ফেলে দেয় ফ্লোরে । মূহুর্তেই কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ রুমজুড়ে ধ্বনিত হতে থাকে। শিরিন শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দিব্য দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
-“মাম্মা তুমি সব জেনেও চুপ করে মেনে নিচ্ছো কেন? আর এত কিছু ঘটেছে তুমি আমাকে ফোন দিয়ে জানাওনি কেন? এই বিয়ে এক্ষুনি বন্ধ করো। ”
শিরিন শান্ত গলায় বলে,
-“দিব্য তুমি মাত্র আসলে। শাওয়ার নাও, ফ্রেশ হও আর মাথা ঠান্ডা করো। তোমার দিদুন সবটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমার করার কিছুই ছিলো না। আর তুমি তো জানো আমি কেন উনার উপর দিয়ে তোমার পাপাও কিছু বলতে পারেন না। যাইহোক যা হচ্ছে হতে দাও। আশাকরি এই বিয়েতে তুমি কোন বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।”
-“বিয়ে মাই ফুট।”
দিব্য ফ্লোরে থাকা কাঁচের টুকরোয় লাথি দেয়। পায়ে কেডস থাকায় আঘাত থেকে বেঁচে যায়। শিরিন দপ করে চোখ বন্ধ করে নেয়। আসন্ন ঝ’ড়ে’র ভয়াবহতা ঢের অনুমান করতে পারছে শিরিন। দিব্য বড় বড় শ্বাস ফেলে রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করে। দাঁতে দাঁত চেপে বলতে থাকে,
-“মাম্মা আমি দিদুনের সাথে কথা বলব। আর তনুজার মতো একটা ভালো মেয়ে কখনোই একজন মেন্টালি সিক,ড্রাঙ্কার, সাইকোকে ডিজার্ভ করে না। মাম্মা তনুজা কখনোই ঐ ড্রাঙ্কারকে ডিজার্ভ করে না। করে না তনুজা ডিজার্ভ।”
চিল্লিয়ে বলতে থাকে দিব্য। শিরিন স্পষ্ট রাগি দৃষ্টিতে তাকাল ছেলের দিকে।
-“দিব্য ইভান তোমার বড়। সে তোমার ভাই হয়। তাকে সম্মান দিয়ে কথা বলো। আমার সামনে ইভানকে নিয়ে কখনোই এরকম কথা পুনরায় বলবে না। আমি তোমাকে সাবধান করে দিলাম।”
-“ভাই মাই ফুট। আমার বিশ্বাস সবটা যেনে বুঝেই এরকম নোংরা ছক কষেছে সে। আমি ওকে সফল হতে দেব না মাম্মা। কখনোই না।”
ঠাস করে শব্দ হয়। বদ্ধ ঘরে শব্দটা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পরল। দিব্য একহাত গালে ধরে মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চাইল। মা তাকে চ/ড় মে/রে/ছে এটা অবিশ্বাস্য দিব্যর কাছে। দিব্য অস্ফুটে আওড়ায়,
-“মাম্মা তুমি আমাকে মা/র/লে। অন্যর ছেলের জন্য নিজের ছেলের গায়ে হাত তুললে। ”
শিরিন বড় বড় শ্বাস ফেলতে থাকে। বড় হওয়ার , বুদ্ধি হওয়ার পর এই প্রথম ছেলের গায়ে হাত তোলে শিরিন। একমাত্র ছেলে হওয়ায় খুব আদরে বড় করেছে। শিরিনের চোখের মণি তার ছেলে সাফওয়ান দিব্য মির্জা। শিরিন প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলল,
-“হ্যা হ্যা অন্যর ছেলের জন্য নিজের ছেলেকে মে/রেছি আমি। তুমি ভুলে যেতে পারো,আমি ভুলতে পারি না। আজ তুমি যাকে ড্রাঙ্কার, মেন্টালি সিক বলছো সে আজ আমাদের জন্যই এরকম হয়েছে। আমরা তার কষ্ট বুঝিনি। তাকে ঠিকভাবে আগলে রাখতে পারিনি। ছেলেটা মায়ের আদর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়েছে শুধু কিন্তু তোমার জন্য দিব্য। তোমাকে বাঁচাতে গিয়েই সেই অন্যর মাম্মাই প্রাণ হারায়। তারপর…তারপর আমরা কী দিলাম,কী দিয়েছি ছেলেটাকে। কিচ্ছু দিতে পারিনি। তুমি নিজেও ছেলেটার সাথে চিট করেছিলে। ছোটবেলায় ইভান মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরে। মা’কে হারানোর শোক তার মনে, মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। একটা হাসি খুশি ছেলে কেমন বদলে যেতে থাকে। পরবর্তীতে যখন সে দ্বিতীয় আ/ঘা/ত পায়। সে নিজেকে তিলে তিলে শেষ করে দিতে চায়। ইভান মানসিক ডিজঅর্ডারের মধ্যে আছে। নিঃসঙ্গতা একাকিত্ব তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। আমরা নিজেদেরকে নিয়ে এত ব্যস্ত যে ছেলেটার দিকে তাকানোর ফুরসত মেলেনি। ছেলেটা দিন দিন নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে সেদিকে আমাদের নজর অবেলায় এসে পরল। সাইকোলজিস্ট, সাইকিয়াট্রিস্ট ডেকেও এখন লাভ হচ্ছে না।”
শিরিনের দু’চোখের কোল গড়িয়ে পানি পরতে থাকে। শিরিন দিব্যর দুই ডানা ধরে বলল,
-“দিব্য মনে আছে তোমার? সাইকোলজিস্ট কী বলেছিলেন ইভানকে আগের মতো হাসিখুশি, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আনার জন্য একজন সঙ্গী প্রয়োজন। আমি তো আশার আলো দেখছি। ইভান বিয়েতে রাজি হয়েছে। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না! ইভান আবার কখনো বিয়েতে মত দিবে, সংসার করতে চাইবে এটা আমার কাছে কল্পনাতীত ছিল। আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।”
দিব্যর কাছে অসয্য লাগছে। দিব্যর দু’চোখে তনুজার মুখটা ভাসছে। আর ভাসছে কিছু কিছু সুন্দর মূহূর্ত। মনের ক্যানভাসে বারংবার উঁকি দিচ্ছে রঙিন স্বপ্নের কল্পনারা। মস্তিষ্কে স্মৃতিরা হানা দিতেই দিব্যর নিজেকে এলোমেলো লাগছে। রাগে দিব্যর ফর্সা মুখে লাল আভা ছড়িয়ে পড়েছে। সাথে কপালের নীল রগগুলো দৃশ্যমান । দুই হাত দিয়ে মায়ের হাত দু’টো ঝাঁকি দিয়ে সরায় দিব্য। মায়ের দিকে পিঠ করে পিছন ঘুরে দাঁড়ায়। একহাতে কপাল স্লাইড করে রুঢ় কণ্ঠে বলল,
-“মাম্মা তুমি বুঝতে পারছ না। ও প্রতিশোধ নিচ্ছে। আমার থেকে প্রতিশোধ নিচ্ছে ও। আই রিপিট ও সাফওয়ান দিব্যর থেকে রিভেঞ্জ নিচ্ছে। তৃষাকে আমি হেল্প করেছিলাম, সেই রাগ ক্ষোভ থেকেই ও আমার থেকে তনুকে কেড়ে নিচ্ছে। মাম্মা আমি সবটা বুঝার পরেও চুপ থাকি কী করে?”
#চলবে