প্রণয়ের বাঁধন পর্ব-৩৫

0
907

#প্রণয়ের_বাঁধন |৩৫|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

জাঁকজমকপূর্ণ জমকালো অনুষ্ঠান চলছে। ঝলমলে আলোকসজ্জা, মিষ্টি সুর বাজছে নরমভাবে। অতিথিরা সবাই ব্যস্ত। কেউ কেউ খোশ মেজাজে গল্পের আসর পেতে বসেছে, কেউ কোমল পানীয় পান করছে, কেউ চোখেমুখে উৎসুকতা নিয়ে মির্জা বাড়ির বড় বউকে দেখছে, সাথে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। তন্মধ্যে নৃত্য আলতো পায়ে হেঁটে স্টেজের দিকে যাচ্ছিল। ঝলমলে সোনালী কাপড় দিয়ে আবৃত করা কিছু একটা মেয়েটার হাতে। হঠাৎ নৃত্যর দৃষ্টি আটকায় খানিকটা দূরত্বে অবস্থিত সুদর্শন এক যুবকের দিকে। ডার্ক ব্লু স্যুট পরনে, সুঠাম শরীর, হাতে সফট ড্রিংকসের গ্লাস নিয়ে দাঁড়িয়ে। যুবকটির চোখে এক সম্মোহনী আকর্ষণ। আচানক নৃত্যর পা দুটো থেমে যায়। নৃত্যের কাছে আশেপাশের সব শব্দ মিলিয়ে যায়, শুধু ছেলেটির দিকে তাকিয়ে থাকার অদ্ভুত আকর্ষণ কাজ করছে। নৃত্য এক্সাইটেড হয়ে বিড়বিড় করে বলে,

-” উফ্! এনাকে এত হ্যান্ডসাম লাগে কেনো? সবার চোখেই লাগে! নাকি শুধু আমার চোখেই একে একটু বেশিই ড্যাশিং লাগে। আয় হায়!”

ভাবনার মাঝেই কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে নৃত্য পিলে চমকে উঠার মতো আঁতকে ওঠে। ঘাড় ঘুরিয়ে নিতিকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অস্ফুটে বলে,

-” উফ্! তুমি! ভ’য় পাইয়ে দিয়েছিলে।”

নিতির চোখমুখে প্রশ্ন খেলে যায়। কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে উঠল,

-” অ্যাই? ওদিকে অমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে কী দেখছিলি শুনি?”

-“ক-কই? কিছু না তো।”

নৃত্য জড় গলায় জবাব দেয়। নিতি ফের জেরার সুরে বলল,

-” একদম মিথ্যে বলবি না। কিছুই লুকাবি না। আমার কাছে তো কখনোই নয়। বল এবার সত্যি করে, কি ভাবছিলি যে হঠাৎ আমার স্পর্শে চমকে উঠলি?”

নৃত্য বি’র’ক্তিকর কণ্ঠে বলল,

-” ওহ্ আপু, তুমিও না শুধু জেরা করো। দিনদিন তোমার স্বভাব কিন্তু গোয়েন্দার মতো হয়ে যাচ্ছে।”

নিতি একগাল হেসে বলল,

-” সত্যি বলছিস তুই? তবে আমি বলব, এই স্বভাবটা তোর থেকে পেয়েছি। তুইই তো চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে আমার ক্রাশ কে জেনেছিলি।”

থেমে তাড়াহুড়ো করে প্রশ্ন করল,

-” আচ্ছা যাজ্ঞগে সেসব। এবার আসল কাহিনী কী বল?”

চোখেমুখে সলজ্জ ভাবটা কিঞ্চিৎ ফুটে ওঠে নৃত্যর। ইশারায় দেখিয়ে নিম্নস্বরে বলে,

-” ঐযে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। চিনোই তো নানুআপুর দূর সম্পর্কের বোনের মেয়ের ছেলে। ওকে আমার ভালো লাগে।”

নিতির চোখদুটো বিস্ময়ে থমথমে হয়ে যায়। শাসানোর সুরে বলল,

-” এখনো যার মাধ্যমিক পার হয়নি। নাক টিপলে দুধ বেরুবে। আর উনি কী না ক্রাশ খেয়ে বসে আছে। দু’দিন পর যার বোর্ড এক্সাম। সেকিনা একে-ওকে দেখে ব্লাশ করছে। পড়াশোনা তুঙ্গে উঠবে।”

-” আরেহ আপু, তুমি আমাকে বলছো। তোমার নিজের কথা মনে নেই! নিজের ক্রাশ খাওয়ার কথা তো নিজেই বলেছিলে। আবার বিয়ে করার জন্য রীতিমত ফোর্স অবধি করেছিলে। এখন আমাকে বলছো।”

বড় বোন সুলভ আচরণ করতে গিয়ে ছোট বোনের এহেন কথায় নিতির মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে যায়। এইজন্য বলে, আর যাইহোক ছোট বোনের কাছে এসব প্রেম কাহিনীর কথা বলতে হয় না। বড় হয়ে শাসন করে দু’টো ভালো-মন্দ বলতে গেলে উল্টো শুনতে হবে, ‘তুমি নিজে কী?’ নিতির দুনিয়ার সব বড় বোনদের এলার্ট করে বলতে ইচ্ছে করছে, আর যাইহোক। প্রেম কাহিনীর ব্যাপারে টু শব্দটি ছোট বোনের কাছে করো না। দরকার পড়লে, ইট-পাথর জড় বস্তুর কাছে শেয়ার করা ভালো। তবুও ছোট বোনের কাছে নয়। একদম নয়।

নিতি নিজেকে ধাতস্থ করে। পরপর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

-” নৃত্য তুই ছোট। এসব আবেগ টাবেগকে এখনই প্রশ্রয় না দেওয়াই বেটার। আর মাম্মা একবার শুনলে শূ/লে চড়াবে।”

-” আচ্ছা আমি বুঝিনা মাম্মা কেনো এসব ব্যাপারে এত কড়া শাসন করে। যেখানে নানির মেয়ে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছে, সেখানে আমাদের বেলায় কেনো অবিচার। সেদিন কোচিং থেকে ফেরার পথে আমার এক ছেলে ফ্রেন্ডের সাথে আইসক্রিম খেতে খেতে আসছিলাম। মাম্মা শপিংয়ে যেতে নিয়ে দেখে। বাসায় ফিরেই সেকি জেরা, আর শাসানো।”

বাবা-মা সন্তানদের ভালো চায়। তাদের নিয়ে সর্বক্ষণ চিন্তায় থাকে। তাই হয়তো ছোটখাটো বিষয় নিয়েও কড়া শাসনে রাখেন। নিতি আলতো হেসে বলল,

-” নৃত্য আমরা ছোট। বাবা-মা কখনো সন্তানের খারাপ চায় না। আর এইজ অনুযায়ী একটা আবেগ কাজ করে। সেই আবেগে গা ভাসিয়ে অনেক সময় বিপথে পরিচালিত হয় অনেকে। তাই বাবা-মা সবসময় সচেতন করতে একটু-আকটু কড়া শাসনে রাখে।”

ছোট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিতি। কিছু ভেবে স্মিত হেসে বলল,

-” আচ্ছা এসব থাক। তোকে একটা কথা বলি। আশাকরি কথাটা মনে রাখবি।”

নৃত্যর ভ্রুজোড়া কুঁচকে যায়। ভ্রুকুটি করে শুধাল,

-” কী কথা?”

শুণ্য দৃষ্টিতে তাকায় নিতি। ভেতরটা নীল বেদনায় ছেয়ে যায়। মুখে টেনে আনে এক টুকরো হাসি। হাসির পিছনে লুকায় কিছু কষ্ট আর হতাশা। ধীরে ধীরে ঠোঁট দুটো নেড়ে বলল,

-” কখনো আগ বাড়িয়ে নিজের ভালোবাসার কথা বারবার বলবি না। কারো কাছে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে নেই। তাহলে সস্তা হতে হয়।”

এদিক দিয়ে যাচ্ছিল দিব্য। নিতির কথাগুলো স্পষ্ট শুনতে পায়। নিচের ওষ্ঠে দাঁত বসিয়ে চোখের পলক তুলে নিতির দিকে তাকায় দিব্য। নিতির কথার মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করে সে। নিজেকে ভাবাতে থাকে। তার কঠোর মনের এককোণে গিয়ে কথাটা ফলার মতো বিঁধে। পরপর দৃষ্টি সরিয়ে পা চালায়। নৃত্য কাধ নাড়িয়ে বলল,

-” নিজ থেকে কারো প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করলেই সে সস্তা হয়ে যায় না। আর শুনেছি ভালোবাসার ক্ষেত্রে ইগো রাখতে নেই। পাপা বলে, জীবনে চলতে গেলে রাগ-ক্ষোভ, ইগো বড় করে দেখতে নেই। একটু কম্প্রোমাইজ করে চললে, জীবনের আঁকাবাঁকা পথ চলাটা কিছুটা হলেও সহজ হয়।”

নিতি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তড়াক করে বলে উঠল,

-” কচু পাতার মতো মন যাদের তাদের সাথে কখনো কম্প্রোমাইজ করেও চলা যায় না।”

নিতির কথাশুনে নৃত্যর প্রচন্ড হাসি পায়। নিঃশব্দে ঠোঁট টিপে হাসে নৃত্য। হাসতে হাসতে বলল,

-” ফুলের মতো কোমল স্নিগ্ধ পবিত্র মনের কথা শুনেছি। পাথরের মতো শক্ত জড় প্রাণহীন মনের কথাও শুনেছি। বাট কচু পাতার মতো মন এটা ফার্স্ট শুনলাম। এটার ব্যাখা কী?”

-” এটার ব্যাখা স্বয়ং ছোট মির্জা।”

নৃত্য চোখদুটো কপালে তুলে বলল,

-” মানে?”

-” মানে অতি সহজ। এইযে একদম প্রমাণ সহ উপস্থাপন করছি।”

থেমে জিভ দিয়ে নিম্নাষ্ঠ ভিজিয়ে নিয়ে নিতি বলল,

-” কচু পাতায় যেমন পানি রাখলে ধরে না। গড়িয়ে পরে যায়। অমনি আমার ভালোবাসা রাগি মির্জার কাঠখোট্টা কঠোর মনে ধরছে না। ইহকালে ধরবে কী না আল্লাহ মালুম!”
.
.
সুসজ্জিত স্টেজ। চারিপাশে লাল ও সাদা ফুলের বাহার। ইভান -তনুজা, দিব্য-নিতি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। আশেপাশে পরিবার আর ক্লোজ আত্বীয় স্বজন সবাই উচ্ছ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে। গোল্ডেন কালারের শাড়ি আর সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত দুইজোড়া কাপলকেই দৃষ্টিনন্দন দেখাচ্ছে। নৃত্য এসে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল,

-” গুড এভেনিং লেডিস এন্ড জেন্টালম্যান। আজকের এই শুভ সন্ধ্যায় উপস্থিত থাকার জন্য আপনাদের সবাইকে জানাই স্বাগত। এই আনন্দঘন পরিবেশকে উৎসব মুখর করতে এখন কেক কাটা হবে। অবশ্যই আজকের দিনের স্পেশাল দুই কাপল একসাথে কেক কাটবে। এন্ড আরো একটা মজার বিষয় না বললেই নয়, দুই ভাইয়াই ভাবীদের হাতে রিং পড়িয়ে দিবে।”

নৃত্যর হাতের উপর ঢেকে রাখা সোনালী কাপড়টা সরাতেই ফুলে সজ্জিত ডালার উপর দু’টো লাল বক্স চকচক করে ওঠে। প্রথমে নৃত্য ইভানের সামনে দাঁড়ায়। ইভান স্মিত হেসে একটা বক্স নেয়। অতঃপর দিব্য একটা বক্স হাতে নেয়। ধীরে ধীরে বক্স খুলে সুন্দর হীরের পাথর বসানো আংটি বের করে তনুজার দিকে বাড়িয়ে দেয় ইভান। তনুজার চোখেমুখে লাজুক হাসি। সবার সামনে বেচারির লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। লজ্জায় আড়ষ্ট তনুজা হাতটা বাড়িয়ে দেয় ইভানের দিকে; ইভান হাসিমুখে তনুজার হাতটা আলতো করে ধরে ধীরেধীরে রিং পড়িয়ে দেয়। ওদিকে দিব্য ত্রস্ত হাতে রিং বের করে নিতির দিকে তাকায়। নিতি ভেংচি কে’টে হাত বাড়ায়। দিব্য দায়সারা ভাবে পড়িয়ে দেয়। নিতি বিড়বিড় করে বলে,

-” ফর্মালিটিজ না করলেই পারতে।”

দিব্য উত্তর দেয় না। এই সুন্দর মূহুর্তটা ক্যামেরায় ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ তুলে বন্দি করা হয়। তারপর ইভান-তনুজা একসাথে নাইফ ধরে, দিব্য-নিতি একসাথে দু’টো কেক কা’টা হয়। ফ্যামেলির লোকজন তারপর কাপলদের অনেক ফটো তোলা হয়। ক্যামেরা ম্যান নিতি দিব্যর ছবি তোলার সময় বলল,

-” স্যার একটু ক্লোজ হোন।”

দিব্য এতক্ষণ অনেক ধৈর্য্য নিয়ে সবটা মানিয়ে নিচ্ছিল। ক্যামেরা ম্যানের কথায় ওর ধৈর্য্যর বাঁধভাঙে। রাগি দৃষ্টিতে তাকিয়ে চ্যাচানো সুরে বলল,

-” আরে তুলুন তো।”

নিতি মৃদুস্বরে বলল,

-” আরে ভাই কাকে কী বলছেন? এ হলো তৃণভোজী। আমিষে এর এলার্জি।”

ক্যামেরাম্যান নির্বোধের মতোন চাইল। নিতির কথা সে ভেবেও ঠাহর করতে পারে না। দিব্যর রাগ হলো, তড়াক করে এক অদ্ভুত কান্ড করে বসলো। দাঁত কিড়মিড় করে নিতির দিকে চেপে দাঁড়িয়ে একহাতে নিতির কোমড় জড়িয়ে ধরল। ক্যামেরা ম্যানের দিকে তাকিয়ে আদেশ বাণী ছুঁ’ড়’ল,

-” এবার তুলুন।”

নিতি প্রথমে চমকায়। পরপর অস্বস্তিতে অপ্রস্তুত হয়। আশেপাশে অল্প স্বল্প লোকজন আছে। ঐতো ওখানে ভাইয়া আছে। লোকজনের মাঝে লজ্জায় এবার নিতি মূর্ছা যাচ্ছে। মহারাজ তো রেগে হিতাহিত জ্ঞান শুণ্য হয়েছে।

সুন্দর নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে অনুষ্ঠানটা সম্পন্ন হয়। ডিনার করে লোকজন বিদায় নেয়।

____________

বসন্ত শেষ হয়ে গ্রীষ্মের দাবদাহ পেরিয়ে ঋতুতে বর্ষাকাল চলছে। চোখের পলকে পেরিয়েছে কয়েকটি মাস। রাতের শহর শান্ত, নিভৃত। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের সোনালী আলো বৃষ্টির পানিতে ভিজে ঝরে পড়ছে পিচের রাস্তায়। গাড়ির উইন্ডোশিল্ডে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, আর ওয়াইপার ধীরে ধীরে পানি সরিয়ে দিচ্ছে। গাড়ির ভেতরে হালকা উষ্ণতা , বাইরে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। ইভান স্টিয়ারিং ধরে মনোযোগ দিয়ে ড্রাইভ করছে। চোখে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও মুখে লেগে আছে একরকম প্রশান্তি। পাশে বসা তনুজা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। জানালা দিয়ে দমকা শীতল হাওয়া আসতে থাকে। শীতল হাওয়া গাড়ির ভেতরের উষ্ণতাকে শুষে নেয়। গাড়ির ভেতরকার উষ্ণতাকে ধীরে ধীরে আর্দ্রতার চাদরে মুড়িয়ে দেয়। ইভান তনুজার দিকে তাকিয়ে বলল,

-” ঠান্ডা বাতাস আসছে তো। উইন্ডো লাগিয়ে দেই।”

ডক্টরের থেকে চেকাপ করিয়ে বাসায় ফিরছে ওরা। বিকেল থেকেই আকাশে মেঘের আনাগোনা ছিলো। ফিরতে পথেই হঠাৎ শুরু হয় আষাঢ়িয়া বর্ষণ। ইভানের কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে চায়। পরপর সোজা হয়ে বসে একহাতের উপর আরেকটা হাত রেখে হাত দু’টো কোলের উপর রাখে। মেয়েটার চোখেমুখে ক্লান্তি আর অবসাদের ছাপ স্পষ্ট। চোখদুটো ডেবে গর্তের মধ্যে ঢুকেছে। আগের চেয়ে অনেকটাই শুকিয়ে গিয়েছে। এমনি কোনো জটিলতা নেই। তবে খাবার খেতে না পারা আর ভমিটিং এর দরুণ চোখমুখের এই হাল হয়েছে। ক্লান্ত ভঙিতে উত্তর দেয় তনুজা,

-” থাক না। উইন্ডো বন্ধ করলে কেমন জানি মাথা ধরে আসে। বমি পায়। হালকা বাতাসে তাও একটু স্বস্তি পাচ্ছি। প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারছি।”

ইভান আলতো হাসল। উইন্ডো ওপেনই রাখল। একহাতে স্লো গতিতে ড্রাইভ করতে করতে নিজের ব্লেজারটা খুলে তনুজার কোলের উপর দেয়। আদেশের সুরে বলে,

-” ভালোই ঠান্ডা বাতাস আসছে। ঠান্ডা লেগে যাবে। এইসময় শরীরে ঠান্ডা বসে গেলে প্রবলেম হবে। সো এটা জড়িয়ে নাও।”

তনুজা দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলাচলে থাকে। অস্ফুটে বলে,

-” আমি ঠিক আছি লাগবে না। আপনার এটা প্রয়োজন।”

ইভান গম্ভীর মুখে ত্যাড়া সু্রে বলল,

-” তনুজা এটা আমার থেকেও তোমার জন্য বেশি জরুরী। তুমি সুস্থ থাকলে, আমাদের বেবি সুস্থ থাকবে। আমি আমার বেবির কথা ভেবে বলছি। তোমার জন্য না হলেও আমার বেবীর জন্য ইমার্জেন্সি। ক্লিয়ার?”

তনুজা দ্বিরুক্তি শব্দ উচ্চারণ না করে গায়ে জড়িয়ে নেয়। পরিচিত ম্যান পারফিউমের গন্ধটা নাকে বারি খায়। গন্ধটা তনুজার কাছে অন্যরকম ভালো লাগে। তনুজা কপট অভিমানের ছাপ চোখেমুখে নিয়ে অভিযোগের সুরে বলল,

-” আপনি সবকিছুতেই বেবির কথা বলে আমাকে জোর করেন। এটা কিন্তু মোটেই ঠিক নয়। খাবার সময় জোর করেন বেবির কথা বলে। শুধু তুমি একা নও…এটা বলে বলে দিনদিন আপনি কিন্তু স্বৈরাচারীতা করছেন, হুঁ।”

তনুজার অভিযোগে ইভান আলতো হাসল। প্রশ্ন করল,

-” তুমি আর বেবি মিলে আমার রাজ্য। আর বেবি হলো আমাদের ভালোবাসার অংশ। আমার রাজ্যে আমার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করা খুব কী অন্যায় হচ্ছে, তনুজা?”

-” শুধু অন্যায় বললে ভুল হবে। ঘোরতর অন্যায় হচ্ছে।”

কথাটা বলতে বলতে তনুজা একহাতে ইভানের বাহু জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে। ইভান একহাতে ড্রাইভ করে অন্যহাতে আগলে নেয় তনুজাকে। একঝলক ভালোবাসার দৃষ্টিতে তনুজার দিকে তাকিয়ে পরপর দৃষ্টি ফেরাল রাস্তায়। ইভান হঠাৎ আদুরে গলায় ডাকল,

-” তনুজা?”

ইভানের কাঁধে মাথা রেখে চোখদুটো বুঁজে ছিলো তনুজা। আলতো স্বরে সাড়া দেয়,

-” হুঁ।”

ইভান আবেগময় স্বরে বলে উঠল,

-” জানো আমার না এখনো মাঝে মাঝে বিশ্বাস হয় না আমি বাবা হচ্ছি। মনেহয় কোনো স্বপ্ন নয়তো? ঘুম ভাঙলেই কে’টে যাবে।”

তনুজা মৃদু হেসে বলল,

-” আমারও মাঝে মাঝে অবিশ্বাস্য ঠেকে। মনে হয় আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি। এতটা সুখ আমার ভাগ্যে লিখা ছিলো। অপ্রত্যাশিত ভালোবাসায়, সুখে আমি সিক্ত। সৃষ্টিকর্তার কাছে অসংখ্য কৃতজ্ঞ।”

ইভানের হাতটা আলগোছে শাড়ির আঁচল গলিয়ে তনুজার পেট ছোঁয়। ইভান আলতো করে হাতটা রেখে চোখেমুখে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,

-” জানো এই ছোট্ট প্রাণটা আমাদের দু’জনের ভালোবাসার সবচেয়ে বড় এন্ড সুন্দর উপহার। ওকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখি আমি।”

তনুজা কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,

-” কী স্বপ্ন? বলুন তো শুনি?”

-” ওকে প্রথমে আমি কোলে নিবো। কোলে নিয়ে আমার ছোট্ট রাজকুমার বা রাজকুমারীকে ওয়েলকাম জানাবো। বলব, সোনা তুমি আমার স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর! তারপর ওর ছোট্ট ছোট্ট আঙুল ধরব, সারা মুখে, মাথায় চুমুয় ভরিয়ে দেব। আহা! কী যে দারুণ হবে সেই মূহুর্ত!”

বলতে বলতে ইভানের চোখ ছলছল করে ওঠে। তনুজার দুচোখেও অশ্রু টলমল করে। মন্ত্র মুগ্ধের ন্যায় ইভানের কথা শ্রবণ করতে থাকে। ইভান উচ্ছ্বাস নিয়ে ফের বলল,

-” দেখবে ওর নাকটা পেয়েছে আমার মতো। আর চোখদুটো হবে তোমার মতো মায়াবী।”

-” বাহবা আপনি তো দেখছি এখনই হিসেব কষে নিলেন।”

-” হুম।”

ছোট করে জবাব দিয়ে ছোট দম ফেলে ইভান। কিছুপল পর আবেগঘন কণ্ঠে বলল,

-” আর জানো ও যখন হাঁটতে শিখবে , আমি হাত ধরে ওকে হাঁটতে শেখাবো। আর প্রথম ডাকটা যেন পাপা ডাকে।”

তনুজা মুগ্ধ হয়ে বলল,

-” ইভান জানেন, আমি চাই ও যেনো আপনার মতো ভালো মনের মানুষ হয়। মায়া-মমতায় ভরা আপনার মতো যত্নশীল।”

তনুজার চোখের দিকে তাকিয়ে ইভান বলল,

-” আর আমি চাই ও যেন তোমার মতো সুন্দর হৃদয়ের হয়।”

দু’জনে ভবিষ্যতের সুখ স্বপ্নে বিভোর হয়। গাড়ি ধীর লয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। বৃষ্টির ফোঁটা হিমেল হাওয়া রাতটাকে আরো সুন্দর করে তোলে।

__________

রৌদ্রজ্জ্বল সকালের শান্ত পরিবেশটা অশান্ত করতে নিতির মাথায় এক দুষ্টু বুদ্ধি চাপে। সকালের সোনালী রোদ্দুর জানালার সফেদ পর্দার ফাঁক গলে ঘরে ঢুকেছে, কফির মগ হাতে বিছানার পাশে দাড়িয়ে নিতি। হাতের কফির মগ থেকে ধীরে ধীরে ধোঁয়া উঠছে। গরম কফির সুবাস ঘরময় ছড়িয়ে পরেছে। একবার কফির দিকে তাকিয়ে আবার বেডে ঘুমন্ত দিব‌্যর দিকে তাকায় নিতি। ঘুমন্ত দিব্যকে দেখে বিরক্তির ছাঁট পরে নিতির কপালে। মনেমনে ভাবে,

-” এখনো জাগেনি। কফি রেখে দিলে ঠান্ডা শরবত হয়ে যাবে। সেটা তো আবার মহারাজের গলা দিয়ে নামবে না। আবার অর্ডার করে বসবে, নতুন করে কফি বানিয়ে আনতে।”

এসব মনে মনে ভেবে মাথা ঝাড়া দেয় নিতি। শুকনো ঢোঁক গিলে আস্তে আস্তে বারকয়েক দিব্যকে ডাকল। কয়েকবার ডাকবার পরেও সাড়া শব্দ না পেয়ে নিতির মেজাজ খা’রা’প হলো। দুষ্টু বুদ্ধি করে বেডের দিকে ঝুঁকে দিব‌্যর একটা হাতের তর্জনী আঙুল ধরল; অতঃপর আঙুলটা আলগোছে কফির মগের ভেতর ছোঁয়ায়।

#চলবে