প্রণয়ের মহাকাব্য পর্ব-১৯+২০+২১

0
21

#প্রণয়ের_মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(১৯)

শিকদার নিবাস নিস্তব্ধ। রাত গভীর। ছাদে আনন্দ আর কোলাহলের ঝলক পেরিয়ে ঘরে ফিরেছে সবাই। হিয়া অনেক কষ্টে সোহান আর সোহানাকে বুঝিয়ে, সবার অলক্ষ্যে সামির বন্ধ ঘরে এসে ঢুকেছে। ঘরটায় এখনো হালকা হালকা সামীর গায়ের থেকে আসা পারফিউমের মিষ্টি পুরুষালিগ্রান, হিয়া লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিলো ,অন্ধকারের মধ্যে হেঁটে গিয়ে জানালার কপাট খুলে দিলো, সাথে সাথে হিম শীতল ঠাণ্ডা বাতাস ছুঁয়ে দিলো হিয়ার মুখমন্ডল,জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলো বিছানার এক প্রান্তে গিয়ে পড়ে।

হিয়া আস্তে করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। তারপর নিঃশব্দে সামির ঘরের বিছানায় উঠে বসে। এখানে এলে তার ভেতরটা কেমন করে উঠে… যেন সামিকে অনুভব করতে পারে নিঃশ্বাসে, বাতাসে, বালিশের গন্ধে। চোখ বন্ধ করলেই মনে পড়ে যায় সামির মুখ, সেই গম্ভীর অথচ যত্নভরা চাহনি, অস্পষ্ট আদরে মোড়ানো শব্দগুলো।

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে হিয়া কম্বলের নিচে ঢুকে পড়ে। তার হৃদপিণ্ড বোধহয় স্বাভাবিক ছন্দে নেই, অস্থির, গতি হারিয়ে বিভ্রান্ত। একটু পরে ক্লান্তিতে চোখটা বুজে আসে। একটু একটু করে তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে।
————–
নিউ ইয়ার এর রাত,আকাশে কুয়াশার চাদরে ঘেরা রাত গভীর হলেও এখনো প্রায় অনেক বাড়ির ছাদের উপর থেকে পার্টি সং এর উচ্চ আওয়াজ ভেসে আসছে, আশেপাশের দোকান পাট ও খোলা,, চারপাশে উৎসবের আমেজ। ঠিক এই সময়, একটি কালো রঙের BMW X5 মডেলের গাড়ি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার পথে শা শা করে ছুটে চলেছে। গাড়ির ভেতরে সামী, তার চোখে ক্লান্তি, কিন্তু হৃদয়ে উত্তেজনা।
হিয়াকে না দেখে, তার কণ্ঠ না শুনে, এই কয়েকটা দিন যেনো তার জন্য এক যুগের সমান।
এর মধ্যে সামীর পার্টনার আগের এখন মোটামুটি সুস্থ,
তাই হাতের কাজ প্রায় সব গুছিয়ে সন্ধ্যা নাগাত সামী চট্টগ্রাম থেকে হঠাৎ ফিরে আসে।বাড়ির সবার অজান্তে, নিঃশব্দে।
প্রিয় নারির মুখ দেখে না কণ্ঠ শুনে না মাত্র সপ্তাহ খানেক তাও যেনো সামীর কাছে তা বর্ষ সমান। সামীর মনটা উত্তেজনা আর আশায় ভরে উঠেছে—এক সপ্তাহেরও কম সময় দূরে থেকেও, হিয়ার মুখটা তার হৃদয়ে বারবার ফিরে এসেছে।প্রিয় নারীর মুখ দর্শনের জন্য মুখিয়ে আছে ছেলেটি তাছাড়াও এবারের নতুন বছরটা সে তার জীবন সঙ্গিনী তাঁর প্রণয়িনীর সাথে পরিবারের সাথে শুরু করতে চায়। সামী হিয়ার কথা ভাবতে ভাবতে মুচকি হেসে আওড়ায়,,
‘ I am coming My little Bard ‘

যখন শিকদার নিবাসের সামনে গাড়ি থামে , রাত তখন প্রায় সারে তিনটা, রাত গভীর হওয়ায়, আর সামীর কাছে ডুপ্লিকেট চাবি থাকায়, সে আর কাওকে ডাকে না।নিঃশব্দে দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে চোখ ভর্তি ঘুম,ক্লান্ত শরীর, আর হাতে ট্রলি ব্যাগ নিয়ে । সবাই তখন ঘুমিয়ে, এক টানা এতো ক্ষণ গাড়ী চালিয়ে ঘাড় যেনো ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে সামী এক হাতে ট্রলি ব্যাগ ধরে অন্য হাতে ঘাড় মালিশ করতে করতে দোতলার সিঁড়ি পেরিয়ে এগিয়ে যায় নিজের ঘরের দিকে, আর যা দেখে সে থমকে যায়…

তার বিছানায় কেউ ঘুমিয়ে।

কিছুক্ষণের জন্য নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে সামি। এরপর ধীরে ধীরে কাছে আসে। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট হয় মেয়েটির মুখ—হিয়া!“তুই?” – শব্দটা ফিসফিস করে বেরিয়ে আসে সামির ঠোঁট থেকে।
-হিয়া এখানে ?তাঁর ঘরে? তাঁর বিছানায় ঘুমিয়ে কীভাবে সম্ভব?
সামী বিশ্বাস হয় না, সে ভাবে এতোক্ষন হিয়ার কথা ভবায় সে হিয়া কে হেলোসিউনেশন করছে । ভ্রম ভেবে হিয়ার মুখের উপর ঝুঁকে গালে হাত রাখতেই
হিয়ার ঘুম ভেঙে যায় , মুখের সামনে কারো ছায়া ঝুঁকে আছে দেখে ভয়ে চিৎকার করতে যাবে ওমনি সামী হিয়ার মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরে, হিয়া কে অভয় দিতে ফিসফিয়ে বলে,,
– It’s me your Men !
পরিচিত কন্ঠ শুনে হিয়া অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় অন্ধকার সয়ে এলে দৃশ্যপটে সামীর মুখটা ভেসে ওঠে। সামী ফিসফিসিয়ে বলে,,
– don’t shout , ছেড়ে দিলে চিৎকার করবি না।
হিয়া সম্মতি জনক মাথা নাড়ালে সামী তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে দাড়ায়। হিয়া ও উঠে বসে, চোখ কচলে সামির দিকে তাকায়। অপ্রস্তুত মুখে বলে, – আপনি ? আপনি কখন এলেন?
– মাত্রই, তবে তুই এখানে?
হিয়া চুপ করে থাকে কিছু বলে না, কোন মুখে সে শিকদার সাহেব কে বলবে যে এই রূমে সে তার অস্তিত্ব অনুভব করতে এসেছে! একথা কি মুখে আনা যায়?
সামির চোখে এখনো বিস্ময়, প্রশ্রয়, আর চাপা উষ্ণতা। সে হিয়ার কাছে এসে বসে ক্লান্ত শরীর টা হিয়ার পাশে ছেড়ে দিয়ে মাথা টা রাখে হিয়ার কাঁধে। হিয়া শিউরে উঠে, নড়েচড়ে বসে, সামী মাথা তুলে হিয়ার দিকে তাকায়,এক মুহূর্তে সব নীরবতা ভেঙে যায় যেন।
সামি ধীরে হিয়ার কপালে হাত রাখে বলে
– তুই আমার ঘরে… আমি কি স্বপ্ন দেখছি?

হিয়া মৃদু হাসে, “না, স্বপ্ন না… সত্যি।”

সামির ক্লান্ত চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। সে হিয়ার হাত ধরে বসে পড়ে পাশে। “তুই জানিস না, আমি কতটা চাইতাম এই দৃশ্য। আমার ঘরে, আমার বিছানায়, আমার পাশে তুই থাকবি।”
সামীর কথায় হিয়া লজ্জা পায় , লাজুক রমণীকে দেখে
সামির ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে হালকা হাসি। ধীরে ধীরে হিয়ার কাছকাছি গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,,
– আমি ভিষন ক্লান্ত , আজকে ডিস্টার্ব করবি তো খবর আছে,
হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকায় কিছু বলার আগেই ঠোঁট ছুঁয়ে যায় ঠোঁটকে। চোখ বুজে যায় দুজনের। গভীর, নিঃশব্দ এক মুহূর্ত—যেখানে শুধু ভালোবাসার ভাষা বলে।

সামী ছেড়ে দিতেই হিয়া হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,,
– আমি এখনই সোহার রূমে চলে যাবো, যদি জানতাম আপনি আসবেন তাহলে জীবনেও এই রূমে আসতাম না।
সামী হিয়ার কাঁধে মাথা রাখে, কপালে আলতো চুমু দিয়ে বলে,
– কোথাও যাবি না তুই,তোকে ছাড়া আমার রাতটা অন্ধকার মনে হয়। আজ যেহেতু পাশে আছিস তোকে আর ছাড়বো না,
সামীর কথা শুনে হিয়ার চোখে-মুখে লজ্জা আর দ্বিধা ফুটে ওঠে,কিন্তু চোখের ভাষায় সে থেমে যায়। মনের গভীরে যে অপেক্ষা, যে অভিমান, সবকিছুকে হার মানায় এই মুহূর্ত। ঘরের বাতিটা বন্ধ, জানালা দিয়ে কুয়াশা ভেজা রাতের আলো আসছে। বাইরে যেনো শহরও আজ থেমে আছে শুধু ওদের জন্য।

সামীর হাত ধীরে ধীরে হিয়ার আঙুলে জড়িয়ে যায়, কণ্ঠে ভেসে আসে চাপা আকুলতা—
– “তুই জানিস না, তোকে ছাড়া এই ক’টা দিন কীভাবে ছিলাম। তোর গন্ধ, তোর ছোঁয়া—সব মিস করেছি। শুধু তোকে ছুঁয়ে থাকতেই এই ফেরাটা।”

হিয়া চুপচাপ চোখ বুজে থাকে, যেনো এ ছোঁয়া ছাড়া আর কিছু চায় না।
তারপর ধীরে ধীরে ওদের ঠোঁট আবার মিলিত হয়—এবারে গভীর, দীর্ঘ, নিরবধি।

হিয়া বলে,
– “আমি তো ভাবিনি সত্যি সত্যি আজ আপনি ফিরবেন … যদি জানতাম…”

সামী থামিয়ে দেয় ওর কথা, ওর গাল ছুঁয়ে বলে,
– “ভবিষ্যতে ভাবার কিছু নেই। আমি তোর কাছে ফিরে এসেছি, আর আসবো এটাই ধ্রুব সত্য। আমি তো প্রতিদিন তোর জন্যই বাঁচি…”
হিয়ার বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে।রাত গভীর হয়। কুয়াশার চাদর ঢেকে ফেলে শহরকে। কিন্তু একমাত্র শিকদার নিবাসের এক কোণে, ভালোবাসা আজ নিঃশব্দে জেগে থাকে। সামীর বুকের মধ্যে হিয়া মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে, আর সামী ওর কপালে চুমু খেয়ে চোখ বুজে বলে,
– “Happy New year, my little Bard ,আমার জীবন… তোকে ছাড়া কোনো বছর শুরু হবে না আর…”
————–
নতুন বছরের প্রথম সকাল। শিকদার নিবাসে সূর্যের কোমল আলো ছড়িয়ে পড়েছে। রাতের কুয়াশা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে, আর পাখিরা তাদের মিষ্টি সুরে নতুন দিনের আগমন জানাচ্ছে।

সোহান এবং সোহানা ছাদে বসে চা খাচ্ছে। সোহান হেসে বলে,

– কিরে হিয়া কই? সেই যে রাতে ভাইয়ার রুমে গিয়ে ঘুমালো তার পর তো গায়েব, যা গিয়ে উঠা কেও দেখার আগে।
সোহানা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বলল,,
– আম্মু একটু আগে চা নিতে যাওয়ার সময় ওর কথা জানতে চাইলো, আমি তো কোনো রকম বলেছি এখনো ঘুম ,,
এমন সময় তাদের কথার মাঝে ছাদে প্রবেশ করে সামী। দুই বদর কে কথা বলতে দেখে বলে উঠে,,
– সকাল সকাল কি খিচুড়ি পাকাচ্ছিস?
সামীর কণ্ঠ ভেসে আসে,সোহান এবং সোহানা অবাক হয়ে সামীর দিকে তাকায়। দেখে, সামী সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে,
সোহান ,সোহানা দুজনেই চমকে বলে উঠে,
– ভাইয়া!
#চলবে,,,,

#প্রণয়ের_মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(২০)
ফেব্রুয়ারি মাস মানেই প্রেমিক যুগলদের জন্য একের পর এক বিশেষ দিন সব ছাপিয়ে আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসাদিবস তথা পহেলা ফাল্গুন চারদিকে যত আবেগী আয়োজন। কলেজ ক্যাম্পাসে চলছে পহেলা ফাল্গুন উৎসবের আয়োজন। দলে দলে ছেলে মেয়েরা সব শাড়ি , পাঞ্জাবি পরে ফুল হাতে কলেজ ক্যাম্পাসের গেট অতিক্রম করছে। কেউ কেউ বা যুগল বেঁধে আবার কেউ কেউ আসছে বন্ধু মহল নিয়ে দল বেঁধে, সেই দল বলের মধ্যে আছে হিয়াদের অপরিপূর্ণ বন্ধু মহল ও, সবাই বসে আছে পুকুর পাড়ে অন্যান্য মেয়েদের মত ইরা প্রীতি ও শাড়ি পড়েছে খোপায় তাদের সোভা পাচ্ছে গাঁদা ফুলের মালা,নীরবের পরনে পাঞ্জাবি ঐ দিকে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে আর তারা পুকুর পাড়ে বসে গল্প করছে, গল্প করছে বললে ভূল হবে মুলুত তাঁরা এখানে বসে সোহান সোহানা আর হিয়ার জন্য অপেক্ষা করছে, তাদের কথার মাঝেই ক্যাম্পাস গেট অতিক্রম করে সোহানের Honda CB150x পেছনে তার বসে শাড়ী পরিহিতা এক রমণী মাথায় তার হেলমেট পরা,হেলমেটের গ্লাস নামানো হওয়ায় ইরা প্রীতি ওরা চিনলো না পেছনে বসা মেয়েটিকে। সোহান সোজা এসে বাইক থামালো প্রীতি দের সামনে , ওড়া কিছু বলার আগেই প্রীতি ভ্রূ কুঁচকায় সন্ধিহান গলায় বলে,,,
– এইটা কে? সোহা কই? এইটা কারে নিয়ে ঘুরছিস তুই?
প্রীতির কথায় সোহান ভ্রু কুঁচকে মাথার হেলমেট খুলে, পর মুহুর্তে মাথায় খেলে যায় দুষ্টুমির হাসি পেছনে বসে থাকা সোহানাকে হাত ধরে ইশারা করে চুপ থাকতে সোহানা চুপ করে বসে থাকে, সোহান হেলমেটটা রেখে চুলে হাত বুলিয়ে ভাব নিয়ে বলে,,
– কে আবার তোগো ভাবী,, আমার
বলার আগেই সোহানা ওর পিঠে থাপ্পড় মারে,, সোহান ব্যথায় মৃদু চিৎকার করে পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,,
– আরে বা*ল বেটি আগে পুরাটা শেষ তো করতে দিবি, তামিম ভাই তো আমদের জাতির ভাই সে হিসেবে তো তুই ওদের ভাবীই লাগিস আমি বলতে চাইছিলাম যে তোগো ভাবী আমার বোন দি গ্রেট সোহানা শিকদার!
সোহানের কথা শুনে সবাই অবাক চোখে তাকালো এর বিশেষ কারণ হলো এর আগে সোহানা কে কেউ শাড়ি পরতে দেখেনি। তাদের অবাক হতে দেখে সোহানা মিষ্টি হেসে হেলমেট খুলে,, প্রীতি উচ্ছসিত হয়ে সোহানাকে হাত ধরে বাইক থেকে নামিয়ে আগা গড়া দেখে বলে,,
– ওয়াও বেবি,, তোমাকে তো মারাত্মক লাগছে,, প্রথম শাড়ি পড়লি বুঝি?
বিনিময়ে সোহানা মুচকি হাসে , ইরা ফোড়ন কেটে বলে,,
– উহুম উহুম,, বুঝলি তো প্রীতি নতুন নতুন প্রেমে পড়লে এমনই হয়, তা তোমার হিরো আসবে তো? তুমার এই নয়া রূপ দেখতে?
– যে দেখার সে তোদের আগেই দেখে ফেলেছে, এই রূপ দেখেই না তামিম ভাই পাগল হলো!
বলেই সোহান হাসলো সোহানা খানিকটা লজ্জা পেল, তাকে দেখে ইরা আগ্রহ নিয়ে বলে,,
– আসার আগে বুঝি তামিম ভাইয়ের সাথে দেখা করে এসেছে?
– আরে না,
– তাহলে?
সোহান সোহানার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,,
– কি বলে দিবো সিস্টার?
সোহানা চোখ রাঙায় তবে সোহান থোরা না পাত্তা দিলো, বরং আগ্রহ নিয়ে সবাইকে ঐ দিনের হলুদ সন্ধ্যার সব ঘটনা বলল,, সবাই তামিম আর সোহানার ঘটনার চেয়ে সামী আর হিয়ার কান্ডো শুনে হাসতে হাসতে শেষ, ইরা পেট চেপে হাসতে হাসতে বলে,,
– ভাই দুলাভাইয়ের এই ডায়লগ টা কিন্তু সেই,,এই শালা ছাড় তুই আমাকে আমি ওর নাচ করা দেখাইতাছি,,
প্রীতি বলল,,
– আমার তার থেকেও জোস লাগলো তামিম ভাইয়ের কথা শুনে,,আমি তোর সমন্ধি হই শালা না,,
তাঁরা আবারও গল্পে মজল কিন্তু এতো কিছুর ভিড়েও যে নীরব সম্পূর্ণ নীরব থাকলো কেউ তা খেয়ালই করলো না!
পহেলা ফাল্গুনের রঙিন সকালে কলেজ ক্যাম্পাস এক নতুন প্রাণ পেয়েছে। আকাশে হালকা রোদ, গাছের পাতায় পাতায় ফুলের মৃদু নাচন, আর পুকুরপাড়ে বসে আছে ইরা, প্রীতি, নীরব ,সোহানা ও সোহান। তাদের আলাপচারিতা যেন এই ঋতুর সুরে মিশে এক অবিনশ্বর আবহ তৈরি করছে।

তখনই ক্যাম্পাস গেটের সামনে এসে থামে এক গাড়ি, রঙ তার Galaxy Blue গভীর নীলাভ ধূসর, যা সূর্যের আলোয় কখনো নীল, কখনো ধূসর রূপে ধরা দেয়।
ধীরে ধীরে গাড়ির দরজা খুলে নামে তামীম। তার পরনে ধূসর-নীল রঙের স্লিম ফিটেড স্যুট, হাতে ঘড়ি, চোখে ব্ল্যাক রোদচশমা। সোহানার চোখ আটকায় কিছু ক্ষন চেয়েই থাকে, তখনই তামিম ও তাকায় তার দিকে চোখাচোখি হয়,ইরার ধাক্কায় তার ধ্যান ভাঙ্গে,সোহানা লজ্জায় এলো মেলো দৃষ্টি ফেলে।
তামিম মুচকি হেসে এগিয়ে আসে,আর তার পাশেই, নরম পায়ে মাটিতে নামে হিয়া। পড়নে তার তায়্যেবার বিয়েতে পড়বে বলে কেনা সেই বাসন্তি শাড়িটা, তখন না পড়লেও বসন্ত তে আয়োজনকরে পড়েছে সে,, বাসন্তী রঙে মেশানো কোমলতা ও দীপ্তি, তাকে যেন বসন্তের রাণীতে পরিণত করেছে। তার খোলা চুলে হালকা বাতাসের ছোঁয়া, কপালে ছোট টিপ, আর চোখে একধরনের দুর্বোধ্য আলো,যা তাকে করেছে অনন্য। হিয়া গুটি গুটি পায়ে শাড়ীর কুচি ধরে এগিয়ে আসে, বন্ধুদের কাছে,হা করে তাকিয়ে আছে বন্ধু মহলের সব
সোহান মুখ ফসকে বলে ফেলে,,
– ভাইয়া তুই কই?
সোহানা ওর পিঠে হালকা থাপ্পড় মারে ইরা বলে,,
– ওড়ে মারোস কে? ঠিকই তো বলেছে ভাইয়া যেই পোসেসিব ওর জন্য,, আর হিয়া ( হিয়ার দিকে চেয়ে) আজ তোরা দুই ননদ ভাবী শুরু কি করলি তোদের দেখে তো আমি মেয়ে হয়েই ক্রাশ খাচ্ছি,ছেলেদের আর কি দোষ?
এতো ক্ষণে মুখ খুলল হিয়া, বিরক্ত হয়ে বলল,,
– দূর হ যত সব নষ্ট গুলা এমনি জনমের গরম তার উপর শাড়ি পড়ে সামলাতে পারছি না, এই ভাইয়া তুই এখনো এখানে দাড়িয়ে আছিস কেন, যা তো যা তোর নাকি জরুরি মিটিং আছে তো এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আর তোরা (বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে) এখনো এখানে কেন? ঐ দিকে তো প্রোগ্রাম শেষ হয়ে যাচ্ছে, তোরা আসলে আয় না আসলে নাই আমি গেলাম,
বলেই এক হাতে শাড়ির আচল, আরেক হাতে শাড়ীর কুচি সামলে ধরে স্টেজের দিকে হাটা দিলো, হুট করে হিয়ার এরূপ আচরণে সবাই যেনো বোকা বনে গেলো, সোহানা তামিমকে জিজ্ঞেস করে,,
– ওর হটাৎ কি হলো? এমন রেগে আছে কেনো আমরা তো এতো ক্ষন ওর জন্যই দাঁড়িয়ে ছিলাম!
– আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেনো তোর ভাই কে জিজ্ঞা ,যাহ,
বলেই তামিম হনহনিয়ে চলে গেলো সবাই যেনো তাজ্যব বনে গেলো,,সোহানার অভিমান হলো অবশ্য সে কি করলো? তাকে কেনো এই লোক? এই দুই ভাই বোনের হলো তো হলো কি?
———–
স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে হিয়া রাগে সে ফোসফোস করছে, তখনই পুড়ো বন্ধু মহল এসে দাড়ালো তার পেছনে সোহানা তার গাঁ ঘেঁষে দাড়ালো হাত ধরে টেনে ফাঁকা ক্লাস রুম গুলোর দিকে নিয়ে এসে হাত ছাড়লো হিয়ার চোখে জল টলোমলো করছে, বেশি রেগে গেলে হিয়ার চোখে পানি চলে আসে সোহানা জানে এখন হিয়া নিজেই সব বলবে আর ভ্যা ব্যা করে কাদবে বা চিৎকার করবে।তাঁরা হিয়া কে একটু সময় দিলো,হিয়া কিছুক্ষন চুপ থেকে সোহানার হাত ধরে বলল,,
– আমাকে কি খুব খারাপ লাগছে দেখতে?
সোহানা সহ সবাই মাথা নাড়িয়ে না বলল,,সোহানা হিয়ার মুখ ধরে বলল,,
– কে বলেছে তোকে খারাপ দেখতে লাগছে,?
– তোর ভাই, তোর ভাই বলেছে আমাকে নাকি পেত্নীর মতো লাগছে, আমি নাকি এই রূপে বাহিরে বের হলে আমার ভয়ে বাচ্চারা বেহুস হবে, আর আর আর কি যেনো একটা বলেছিল মনে নাই, ফোন বাড়ীতে ফেলে এসেছি না হলে দেখাতাম তোর ভাই আমাকে কি কি বলেছে, আমি এতো কষ্ট করে শাড়ি পড়ে সেজে গুজে পিক পাঠালাম আর ওনি? কি বলল?এতোই যখন ভয়ংকর দেখতে তাহলে তোর ভাই আমাকে আমার বাড়ি থেকে কিডনাপ করে তুলে নিয়ে গিয়ে মাঝ রাস্তায় বিয়ে করলো কেন? বল বল জলদি বল! তোরাই তো গিয়ে তুলে এনেছিস?
হিয়ার কথায় সোহানা সহ সবাই হাসলো তাদের হাসি দেখে হিয়ার রাগের পাহাড় আরো বেড়ে গেলো, সে চলে যেতে নিবে তখন নীরব তার পথ আটকায় মৃদু হেসে বলে,,
– রেগে যাচ্ছিস কেনো পাগলি? তুই বুঝি জানিস না সামীহ ভাইয়া তোর প্রতি কতটা পোসেসিভ? সে তোকে এইসব বলেছে জানো তুই রেগে এইসব সাজ পোশাক ছেরে সবসময়ের মতো কলেজে আসিস সত্যিকার অর্থে আজকে তোকে সত্যিই খুব সুন্দর লাগছে সামীহ ভাইয়া হয়তো চান না তার রাণীকে কেও এমন অপ্সরী রূপে দেখে ফেলুক, এখানে আর কেও না জানলেও আমি জানি ভাইয়া তোকে কতোটা ভালবাসে, তাই শুধু শুধুই রেগে থাকিস না, চল ঐ দিকে প্রোগ্রাম অর্ধেক শেষ আর আমরা এখনো এখানেই পড়ে আছি।
নীরবের সাথে সাথে বাকি সবাই ও হিয়া কে বুঝিয়ে শুনিয়ে সবাই প্রোগ্রামে জয়েন হয়,
———
নিজের দু হাতের দিকে তাকিয়ে সামীর রূমে বেডের উপর বসে আছে হিয়া, আজ হাতে তার হাতে সোভা পাচ্ছে মোটা দুটো সোনার বালা, এগুলো জাহানারা বেগমের দাদাজান নাকি দিয়েছিলেন তাকে এই দুটো, হিয়ার হাতের মাপ অনুযায়ী একটু বড় তাও হিয়ার মনে ধরেছে চুড়ি দুটো, প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার আগেই হিয়া কে নিয়ে সোহান সোহানা শিকদার নিবাসে চলে আসে, শাড়ী পরিহিতা হিয়া কে দেখে জাহানারা বেগমের কতো রসিকতা, বৃদ্ধ শরীর নিয়ে হিয়াকে টেনে নিয়ে গিয়ে বালা দুটো পরিয়ে দেয়, পান খাওয়া দাঁত গুলো বের করে হেঁসে বলে,,
– এইবার না মনে হইতাছে শিকদার বাড়ির এই জামানার বড় বউ,
শাহানা শিকদার বলেন, একদম তবে একটু খালি খালি লাগছে কেনো বলুনতো মা!
জাহানারা বেগম আবারও হেসে বলে,, এই ঝুড়ির নাকের ডগায় ছোট্ট একটা ফুল হলে একদম খাপে খাপ মিললা জাইতো ,
তখন কার কথা মনে হতেই হিয়া মুচকি হাসলো, রুমের দেওয়ালে টাঙ্গানো সামীর ছবির দিকে তাঁকিয়ে অভিমানী গলাতে বলে,,
– আজকে সবাই আমার প্রশংসা করলো শুধু আপনি ছাড়া! অথচ আমি আপনার প্রশংসাই সবার আগে আশা করেছিমাল।
– অথছ আপনি জানলেনই না মিসেস শিকদার অপনার এই রূপ দেখে বোর্ড মিটিংয়ে বসে আমি কতবার অন্যমনস্ক হয়ে ভুলভাল বলে ফেলেছি, শেষে মনের অবস্থা বেগতিক দেখে মিটিং ক্যানসাল করে দিয়েদশটার মিটিং বেলা দুটোয় শেষ করে আপনার বাড়ী আসার খবর পেয়ে একপ্রকার উড়ে এসেছি
সামীর গলা শুনে হিয়া পেছন ফিরে তাকায় দেখে ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমের দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে সামী, পড়নে তার ফর্মাল ড্রেস আপ গায়ের কোর্ট টা খুলে বা হাতে ঝুলানো, হিয়া অভিমানী হয়ে মুখ ঘুড়িয়ে নেয় , হিয়ার অভিমান দেখে সামী হাসে, ধীরে ধীরে হিয়ার পাশে এসে বসে। তার চোখে মৃদু ক্লান্তি, কিন্তু তবুও ভরা মমতা। এক হাত দিয়ে হিয়ার কাঁধে আলতো করে ছোঁয়া দিয়ে বলে,
– তুই জানিস, আজকে তোকে দেখে আমার চোখই কেমন যেন পাগল হয়ে গিয়েছিল। মিটিংয়ে যখন তোর ছবিটা মনে পড়ছিল, তখন কথা বলার জায়গায় শুধু তোকে দেখছিলাম! শেষে তো সবাই বললো, ‘স্যার ঠিক আছেন তো?ভাব কি বিচ্ছিরি এক অবস্থা হয়েছে আমার!
হিয়া মুখ ঘুরিয়ে বসেই থাকে, নরম অভিমানে ঠোঁটটা একটু ফুলিয়ে।সামী এবার একটু ঝুঁকে আসে, হিয়ার চিবুকে আঙুল দিয়ে মুখটা নিজের দিকে ফিরিয়ে বলে,
– এই ফুলে থাকা মুখটা না দেখলে আমার দিনের কাজই পূর্ণ হয় না। আর আজ? আজ তো তুই ছিলি আগুনের মতো সুন্দর। মনে হচ্ছিল আমার পুরো পৃথিবীতে একটাই রঙ, আর সেটা তোর শাড়ির বাসন্তী রঙ।
হিয়ার ঠোঁটের কোণে একটু হাসি খেলে যায়, কিন্তু সে আবার মুখ শক্ত করে বলে,
– আজকে সবাই বলেছে আমাকে সুন্দর লাগছে, শুধু আপনি ছাড়া।
সামী আবারও মৃদু হাসে, হিয়ার কপালে একটি চুমু দিয়ে ধীরে বলে,
– তোর রূপের প্রশংসা করবো কোন ভাষায় বলতো? আমার তো ভাষাই হারিয়ে যায় তোকে দেখলে। তোকে দেখলে তো আমার শুধু প্রেম প্রেম পায় বউ কিছু বলার সময় কই?
সামী কে আর কিছু বলতে না দিয়ে হিয়া বলে,,
– চুপ করুন অসভ্য লোক ,, দিন দিন খুব অসভ্য হয়ে যাচ্ছেন ,,
সামী তার কোমর একহাত জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে ফিসফিসিয়ে বলে,,
– তা একটু হচ্ছি ,তবে শুধু আর শুধু তোর জন্য!
#চলবে,,,,

#প্রণয়ের_মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(২১)
-তোর সমস্যাটা কি তামিম কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে? এমনি তোর বাপ আমাকে দেখতে পারে না তার মধ্যে কাজ ফেলে তোর সাথে অকাজ করতে যাচ্ছি শুনলে ঠিক দুটো কথা শুনিয়ে দিবে।
বিরক্ত হয়ে বলল সামী, তামিম কোনো প্রকার উওর না দিয়ে সামনের দিকে তাঁকিয়ে ড্রাইভ করছে, এবার সামী বেশ চোটে গেলো, রেগে গিয়ে বলল,,
– এই শালা কথা বলছিস না কেন?
– তোকে কতবার বলেছি আমি তোর সমন্ধি হই শালা না,,
তামিমের কথায় সামী কিছু বলতে যাবে তার আগেই তামিম গাড়ি ব্রেক করে,সামী নিজের রাগ কন্ট্রোল করে বাহিরে তাঁকিয়ে দেখে তামিম তাকে নিয়ে বসুন্ধরায় এসেছে, সামী ভ্রু কুঁচকায় তামিমের দিকে চেয়ে গম্ভীর হয়ে বলে,,
– এই সময় হঠাৎ শপিং মলে?
– আরে ভাই কাজ আছে, আয় বলছি ,,
তামিম নেমে যায় গাড়ি থেকে সামী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে গাড়ী থেকে নামতেই তামিম তাকে টেনে নিয়ে মলের ভিতর যায় কিন্তু বিপত্তি বাদে তখন যখন তামিম সামী কে সরাসরি ছেলেদের সেকশন পেরিয়ে মেয়েদের ফ্লোরে টেনে নিয়ে যায়। সামী আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে থাকে, ভ্রু কুঁচকে বলে,
– তুই ঠিক আছিস? আমরা ভুল জায়গায় এসেছি ছেলেদের সেকশন টা ঐ দিকে,
তামিম রহস্যময় হেসে বলে,
– আসলে আজকে আমি মেয়েদের আই মিন একটা মেয়ের জন্য একটা সারপ্রাইজ গিফট কিনতে এসেছি, ভাই। আমি তো কোনো দিন মেয়েদের জন্য কিছু কিনিনি তাই তোকে নিয়ে এলাম।বেশি প্রশ্ন করিস না, শুধু একটু হেল্প কর।
সামীর মুখটা প্রথমে থমথমে হয়,, তারপর ধীরে ধীরে একটা কৌতূহলী হাসিতে ভরে ওঠে। চোখ দুটো কুঁচকে তামিমের দিকে তাকিয়ে বলল,
– ওরে বাবা! তুই… তুই এসেছিস গিফট কিনতে? মেয়েদের জন্য? তোর বাপ জানে? তুই কি প্রেমে পড়েছিস?
তামিম কাঁধ উঁচিয়ে লাজুকভাবে হাসে, বলে,,
– হয়তো!
সামীর মুখে যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। যে তামিম একসময় তাকে প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে ঠাট্টা করত, আজ সে-ই কিনা দাঁড়িয়ে আছে শাড়ির দোকানে, প্রেমিকার জন্য গিফট কিনবে বলে?
সামী একটা নিঃশ্বাস ফেলল, মাথা নাড়ল কৌতুকভরা অভিব্যক্তিতে।
– হায় রে প্রেম! তোকে পর্যন্ত ধরে ফেলেছে! তবে এই ব্যাপারে আমি তোকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? আমি কি কোনোদিন এইসব কিনেছি নাকি?
তামিম কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
– সে কী! তোর তো বউ আছে!
সামী গম্ভীর মুখে তাকিয়ে বলল,
– তো?
তামিম ভুরু কুঁচকে জবাব দিল,
– তো মানে? আমি তো শুনেছি, যাদের বউ থাকে তারা না-কি মেয়েদের জিনিসপত্র বেছে নিতে ওস্তাদ হয়!
এইবার হঠাৎ তামিম ঠোঁট বাঁকিয়ে চোখে খলখলে দৃষ্টি নিয়ে বলে,
– ওহ হো, আমি তো ভুলেই গেছি,তুই এখনো পর্যন্ত আমার বোনকে কিছুই দিসনি! আমার বোন বলে অন্য মেয়ে হলে এতো দিনে কপালে ডিভোর্স ঠুকে চলে যেতো !
সামী কিছুক্ষণ চুপ থেকে চোখে একরাশ রহস্যময়তা নিয়ে হেসে ফেলল। ঠোঁটে খেলা করা সেই মৃদু হাসি, রেগে যাওয়ার বদলে সামী কে হাসতে দেখে তামিমও কৌতূহলী হয়ে সামীর চোখের দিকে তাকায়। সামী ধীরে ধীরে বলল,
– কত দূরই বা যাবে? যেখানে যাবে ওখান থেকেই ধরে আনবো…
বলেই চোখ মারে, সামীর রহস্য বুঝে তামিম হাসে হাসে সামী ও তারপর চোখে একরাশ কৌতূহল নিয়ে বলে ,
– কে সে মেয়ে? নামটা তো বল!
তামিম তখন হালকা হাসে মনে মনে বলে,,
– তোর বাপের একমাত্র মেয়ে , আর তোর একমাত্র বোন।
তবে মুখে বলল,
– এখনও সবকিছু বলার সময় হয়নি ভাই। শুধু এটুকু বুঝ, মেয়েটা আমার পুরো জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে।
সামী কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে থাকল বন্ধুর মুখের দিকে। তারপর হালকা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
– ঠিক আছে। চল তাহলে,, তবে আমি এসব ব্যাপারে অভিজ্ঞ নই তাই আমি কোনো প্রকার সাহায্য করতে পারব না সরি,,
– ঠিক আছে করা লাগবে না তোর সাহায্য, শুধু সাথে থাকবি চল,
বলেই তামিম সামীকে বগলদাবা করে এগোলো ,তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক ঝলমলে ফ্যাশন আউটলেট, কাঁচের ওপার থেকে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন রঙের একাধিক শাড়ি ঝুলছে আলোর ঝলকে। সামী আর তামিম ভিতরে ঢুকে, সামী এক কোনে বসে ফোন নিয়ে, তামিম আর চোখে একবার তাকিয়ে সেলসম্যানকে ডাকে বেস্ত হয় প্রেয়সীর জন্য একখানা শাড়ি কেনার যুদ্ধে!
শপিংমলের ঝলমলে আলোয় ঝলক দিচ্ছে কাঁচঘেরা একটি অভিজাত ফ্যাশন আউটলেট। রঙিন আলোয় ভেসে আছে শাড়ির নানান রঙ আর নকশার নানান শাড়ী, সামী এক কোণে বসে আছে ফোনের দিকে চেয়ে, অন্য দিকে তামিম পড়েছে মহা ঝামেলায় কোনটা রেখে কোনটা নিবে ভেবে পাচ্ছে না , সেলসম্যান তাকে একে একে তুলে ধরে হাফ সিল্ক, পিওর কটন, জামদানি দেখাচ্ছে। শাড়ির এতো নাম আর ভেরাইটি দেখে সামীর দিকে তামিম চোখ বড় বড় করে তাঁকিয়ে বলে উঠল,
– ভাইরে শাড়ির আবার এতো জাত! এতো রকম নাম শুনে তো আমি নিজেই কনফিউজড হয়ে গেলাম!
সেলসম্যান হেসে বললো,
– স্যার, এই তো শুরু! এখনো তো কাতান, মুগা সিল্ক, মনিপুরি, হাতের কাজের বুটিক বাকি!
তামিম মাথা চুলকে বললো,
– আরে ভাই আমি তো ভাবছিলাম শাড়ি মানেই একটা বড় কাপড়, আর এখানে তো পুরা গবেষণা করতে হইতাছে!
সেলসম্যান হাসতে হাসতে আরেকটা হালকা বেইজ জামদানি তুলে ধরল,
– এটা দেখেন স্যার, আপনার যাকে দেবেন উনি পড়লে একেবারে রাণীর মতো লাগবে,
তামিম শাড়ির দিকে তাকিয়ে একটু বিভ্রান্ত গলায় বললো,
– ভাই, আমার তো এখন মনে হইতাছে ওরে ফুল সেটে জামা কিনে দিতাম ভালো হইত!
এই শুনে সামী পাশ থেকে হেসে ফেলে আর তামিম শাড়ির দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
– এখন তো প্রেম করাই ভুল হইসে মনে হইতাছে!
এই দৃশ্যে সেলসম্যান, সামী, আর আশেপাশের দুইজন ক্রেতাও হেসে উঠে, হাসতে হাসতে হুট করেই সামীর চোখ আটকে যায় দোকানের ডিসপ্লে তে থাকা একটা নীল রঙের শাড়িতে, যার পাড়ে সূক্ষ্ম সোনালী কারুকাজ। সামী মূহুর্তেই কল্পনা করে বসলো এই শাড়ি তে তার হিয়া রাণী কে কেমন লাগবে! তখনই তামিম শাড়িগুলো থেকে একটা মেরুন রঙের শাড়ি বাছাই করে সামীর দিকে তাকিয়ে বলে, ভাই, এইটা কেমন?
সামী তখনও চোখ সরায়নি ডিসপ্লের কোণে রাখা সেই নীল শাড়ি থেকে। এক ঝলক তাকিয়ে হাত তুলে থামস আপ দেখায়। তামিম হেসে সেলসম্যানকে বলে,
– এইটাই প্যাক করে দিন ।
সেলসম্যান প্যাক করতে যাবে, ঠিক তখনই সামী গম্ভীর গলায় বলে,
–ঐ কোণের নীলটা… ওটাও প্যাক করে দেন।
তামিম হঠাৎ একটু থমকে যায়। চোখ কুঁচকে একটু অবাক হয়ে সামীর দিকে তাকিয়ে বলে,
–নীলটা? ওটা আবার কেনো?
সামী নিরুত্তর,ভাবলেশহীন । তামিম একটু ভাবে পরমুহুর্তেই মুচকি হেসে ঠেস দিয়ে বলল,,
– কেউ এতোক্ষন শাড়ী টারি কেনার ব্যাপারে অভিজ্ঞ না হোলে ও হুট করেই হয়ে গেল, বাহ্ ভালোই ভালোই!
সেলসম্যান তখন একহাতে মেরুন আর অন্য হাতে নীল শাড়ি দুটো যত্ন করে প্যাক করছেন, আর সামীর চোখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি, যেন মনে মনে হিয়াকে ঠিক ঐ শাড়িতে কল্পনা করে ফেলেছে ।
————–
এইচএসসি পরীক্ষার আর মাত্র কয়েক দিন টেস্টে কোনরকম সবকয়টা পাশ করলে ও সামী আচ্ছা মত ধুয়েছে তিনটাকে, সবচেয়ে বেশি বকেছে সোহানা কে কারণ প্রত্যাশার চেয়ে খারাপ রেজাল্ট হয়েছে সোহানার । হিয়ার রুমের বেডের উপর মন খারাপ করে বসে আছে সোহানা হাতে তার বায়োলজির বই আর সোহান বসে ফোনে গেমস খেলছে, তখনই ট্রে হাতে রূমে ঢুকলো হিয়া,সোহানা একবার চোখ তুলে তাঁকিয়ে আবারও মন দেয় বইয়ের পাতায়, হিয়া এগিয়ে এসে বেডের উপর ট্রে টা রাখতেই সোহান ফোন থেকে হিয়ার দিকে নজর দিতেই দেখে হিয়া ট্রেতে করে বিভিন্ন রকম স্নেক্স আইটেম , চিপস্, চকলেট, সফট ড্রিংকস এগুলো নিয়ে এসেছে, সোহান এক লাফে উঠে বসে, এক হাতে ফোন টা বন্ধ করে পকেটে রাখতে রাখতে অন্য হাতে হাতিয়ে নেয় চিপসের একখ্যান প্যাকেট, সোহানা তখনও বইয়ের দিকে তাকিয়ে, সোহান চিপসের প্যাকেট খুলে এক সঙ্গে কয়েকটা চিপস্ তুলে মুখে পুরে খেতে খেতে সোহানাকে বলে,,
– আরে বেডি এইবার অন্তত মুখটা বই থেকে তুল, চেয়ে দেখ খাবার গুলো যেনো তোর দীকেই চেয়ে আছে,
সোহানা মুখ তুলে তাকায় , চোখে তার জল চিকচিক করছে,শক্ত গলায় বলে,,
– এই তোদের জন্য , তোদের জন্যই ভাইয়া আমাকে এতো বকেছে, আমার রেজাল্ট এতো খারাপ হয়েছে, নিজেরা তো ফাকিবাজি করেছিসই সাথে আমাকেও ফাকিবাজ বানিয়েছিস, আমি এখানে গ্রুপ স্টাডি করতে এসেছি খেতে না, তোর মন চায় তুই খা, মন প্রাণ ভরে খা তাও আমাকে জালাস না।
বলেই সোহানা মুখ ঘুড়িয়ে বসে পড়ে, ওড়নার কোনা দিয়ে চোখের কোনের পানি টুকু মুছে নিলো, হিয়া এখনো ভ্রূ কুচকে চেয়ে সোহান যেনো বোকা বনে গেলো সোহানার ব্যবহারে শোকে দুঃখে আরও চার পাঁচ টা চিপস্ মুখে পুরে চিবাতে চিবাতে বলে,,
– তোর ভাইয়ের বউ ভাবির হলো হলো কি হিয়া ? এই ,,
সোহান শেষ করার আগেই সোহানা হুংকার ছাড়লো,,
– খবরদার আজেবাজে কথা বলবি তো, না আমি কারো ভাইয়ের বউ আর না আমি কারো ভাবী!
এইবার যেনো হিয়ার সন্ধেহ জোরালো হলো, সোহান কে ইশারায় ঊঠতে বলে বারান্দায় আসলো, সোহান আসতেই ওর হাতে থাকা চিপসের প্যাকেট থাবা দিয়ে নিয়ে ঝটপট কয়েকটা মুখে পুরে নিল,, চিবাতে চিবাতে বলল,,
– ঐ ভাইয়ের সাথে সোহার কি কোনো ঝগড়া হয়েছে?
সোহান একটু ভাবলো পরপরই নাক মুখ কুঁচকে বলে,,
– ঝগড়া হয়েছে কি না জানি না তবে, ভাইয়া ঐ দিন সোহাকে সবার সামনে ধমকেছিল,
– কোন দিন?
– আরে ঐ দিন, ১৪ই ফেব্রুয়ারি… তুই যখন রেগে গিয়ে চলে আসলি, সোহা তখন তামিম ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করেছিল তুই ক্যানো রাগ করলি। ভাই তখন ভীষণ রেগে গিয়ে, সবার সামনে সোহাকে ধমকে চুপচাপ চলে যায়।
এই কথা শুনে হিয়ার চোখ মুহূর্তেই বড় হয়ে ওঠে। ঠোঁট কামড়ে ধরে, মুখে অভিমান আর অনুশোচনার ছাপ স্পষ্ট।
– মানে? আমি ভাইয়ের উপর রেগে ছিলাম, আর ভাই সেই রাগ গিয়ে ঝাড়লো সোহার উপর!
একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে গলা শক্ত করে বলে,
– দারা… ভাইয়ের হিসাব পরে হবে। আগে চল, আমার ভাইয়ের বউ এর মুড ঠিক করে আসি,চল!

চোখে তার অনুতাপ, প্রাণ প্রিয় সখীর মান তাকে ভাঙ্গতেই হবে, হিয়া মনে মনে বলে উঠে,,,
– মেঘ জমা ভুলগুলো ভালোবাসার বৃষ্টিতে ধুয়ে দিতে হবে…

#চলবে,,,,,