#প্রণয়ের_মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(২৫)
নানাভায়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর, তাকে বিশ্রাম করার জন্য রেখে সবাই গিয়ে বসে সৈয়দ বাড়ির হল রূমে,, সামীর মামীরা বাড়ির দুই বউ বেস্ত পায়ে চলে যায় রান্না ঘরের দিকে,, হিয়া মাথনিচু করে সোহানার পাশে বসে আর চোখে দেখছে পুরো লিভিং রুমটা, হিয়ার কাছে বাড়িটা তামিল মুভির গ্রামের অভিজাত বাড়ির গুলো যেমন তেমনই লাগলো বাড়ির বাইরে যেমন উঠোন আছে তেমনই বাড়ির ভেতরে ও বাড়ির ঠিক মাঝে একটা বেশ বড় উঠোনের মতো, যার সোজা গেলে একপাশে সদর দরজা আরেক পাশে দোতলার সিঁড়ি,, সেই উঠোনটুকুর এক পাশে বসার ব্যবস্থা করা যেখানে তারা বর্তমানে বসে আছে তার আরেকটু সামনে রান্না ঘর আর বিশাল খাবারের টেবিল,, আরেক পাশে বাড়ির নিচ তলার রুম গুলো,, পুড়ো বাড়ীতে আর চোখে এক পলক তাঁকিয়ে শান্ত হয়ে বসলো, তাদের সামনেই সামীর দুই মামা আর সামীর মা বসে তাদের বাবার শারীরিক অবস্থার সম্পর্কে আলোচনা করছে,, বাকি সবাই ও নিজেদের জায়গা দখল করে বসলো,, তখনই সামীর মামিরা আর সেই মেয়ে গুলো হাতে হালকা নাশতা সহ শরবত নিয়ে এলো,, সবাই আসতেই সামী ফোন থেকে মুখ তুলে একটা গ্লাস তুলে শরবত টুকু শেষ করে মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,
– আম্মু আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি,, ওকে তুমিই সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিও,,
বলেই সামী উঠে চলে গেলো,, হিয়া এবার ও আর চোখে তাকালো সামীর দিকে,, মনে মনে মুখভেঙ্গলো,, শাহানা শিকদার ছেলের কথা মত পর পর বাড়ীর সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন,, হিয়ার ধারণা মিলে গেলো শাহানা শিকদাররা দুই ভাই এক বোন, বড় মামা সৈয়দ আশরাফ, আর ছোটো মামা সৈয়দ আরিফ আসার পর উঠোনে আশা মধ্যবয়স্ক মহিলা দুজনের এক জন বড় মামী সালমা বেগম আরেক জন ছোটো মামি রহিমা বেগম। সবার পরিচয় দিতে হিয়া নম্র কন্ঠে সালাম দিলো,, সবাই সালাম সুন্দর করে ফিরিয়ে দিলেও ছোটো মামী সালাম ফিরিয়ে নাক মুখ কুঁচকে বলে,,
– ওয়ালাইকুম আসসালাম,, তা আপা (শাহানাকে উদ্দেশ্য করে)বউ আনেছেন ভালো, কিন্তু বউয়ের তো কোনো বিবাহিত মেয়েদের মতো লাগেই না হাত কান গলা সবই তো খালি,, বাড়ির বউ কই শাড়ী চুড়ি পরব তা না ফরাগ ( গোল জামা) পড়ে নানা শশুর বাড়িতে আইসা পড়লো? লোক দেখলে কইবো কি?
মহিলার কথায় হিয়া মুখ তুলে চাইলো তাতে যেনো মহিলার মাথায় বাঝ পড়লো এমন করে বলল,,
– হ্যায় হায় মাইয়ার কান্ড কারখানা দেখিসনি? নাকের ডগায় ফুলটা পর্যন্ত পড়ে নাই? এতে আমাগো সামীর ক্ষতি হইবো না?আপনি কিছু কন না?
রহিমার কথা শুনে শাহানা শিকদার হেঁসে বলল,,
– কি বলতো রহিমা ছেলের বউ আমার নিতান্তই বাচ্চা আমার সোহানার মত ,, আমার সোহানা যেমন আমার হিয়া ও আমার কাছে তেমন,, তাই ওকে কিছু বলতে পারি না আর বিয়ে টাও অমন ভাবে হলো যে এইসব করার সময় পেলাম না,
রহিমা বেগম আবার কিছু বলবেন তার আগেই সেখানে বসে থাকা সামীর বড় মামা সৈয়দ আশরাফ খানিকটা গম্ভীর কণ্ঠে বলে,,
– আহ ছোটো বউ, চুপ থাকো আর এইসব গহনা কখনো একজনকে রক্ষা করতে পারে না, এইসব অন্ধবিশ্বাস যাও তোমরা রাতের খবরের আয়োজন করো,, বলেই তিনি চলে গেলেন, তিনি উঠে যেতেই তাঁর পেছন পেছন সৈয়দ আরিফ সাহেব ও উঠে চলে গেলেন,, যাওয়ার আগে অবশ্য চোখ দিয়ে স্ত্রী কে শাসিয়ে গেলেন,, ওনারা যেতেই সালমা বেগম রহিমা বেগম কে নিয়ে রান্না ঘরে চলে গেলেন যাওয়ার আগে হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,,
– কিছু মনে করোনা মা আমরা গ্রামের মেয়ে বউ তো ছোটো থেকে এইগুলোই শুনে বড় হয়েছি তাই ও ওমন ভাবে বলে ফেলেছে,,
বিনিময়ে হিয়া মুচকি হেসে মাথা নাড়ায়,, ওনারা যেতেই শাহানা শিকদার ও ওঠে দাঁড়ায় সেখানে তখন শুধু মেয়েগুলো আর হিয়া সোহানা বসে,, সোহান সেই কখনইগেছে ফ্রেশ হতে এখনো আসেনি, শাহানা শিকদার উঠে হিয়ার কাছে আসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,,
– আয়েশা এমন চুপ করে থাকতে বলেছে তাই না?
শাহানার কথায় হিয়া চঞ্চল দৃষ্টিতে তাকায়,, বলে
– কেমনে বুঝলা?
উনি হেসে বলে,,
– আমার হিয়া তো এতো শান্ত না, তারপর কোমল কন্ঠে বলে,,
– একটু মানিয়ে নে গ্রামের মানুষ তো, আমার কাছ থেকে শাড়ী নিয়ে যাস ফ্রেশ হয়ে শাড়ী পড়ে নিস,,
– আম্মু শাড়ী সাথে দিয়ে দিয়েছে মামুনি ,, কিন্তু আমি তো শাড়ী পড়তে পারি না,
হিয়ার কথায় শাহানার মুখের হাসি চওড়া হয়,,
– আয়েশা তো দেখছি মেয়েকে একদম তৈরী করে পাঠিয়েছে,, তারপর নিজের ভায়ের মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন,, এইগুলো হচ্ছে আমার দুই ভাইয়ের মেয়েরাতুই সোহার সাথে বসে ওদের সাথে কথা বলে সোজা আমার রুমে চলে আসিস সোহান কে বলে আমি তোর ব্যাগ আনিয়ে রাখবো পড়ে আমার ঘর থেকেফ্রেশ হয়ে শাড়ী পড়ে রাতের খাবার খেয়ে একেবারে সামীর রুমে যাস,
শাহানার কথায় হিয়া সামান্য লজ্জা পেল, মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল, শাহানা চলে যেতেই সাথে সাথে মেয়ে গুলো এক প্রকার হামলে পড়লো হিয়ার উপর তিন জনই নিজেদের পরিচয় দিলো একে একে যে একজন তাদের সমান বয়সী মনে হয়েছিলো সে হলো নাবা সামীর বড় মামার মেয়ে, জানা গেলো নাবারা দুই বোন নাবা আর নীলা আর এক ভাই নিলয় ,ভাই সবার বড় সে এখন দেশের বাহিরে আছে পড়াশোনার জন্য, আর ছোটো মামার দুই মেয়ে রাইশা আর রিয়া রাইশা বড় আর রিয়া ছোটো, নাবা এইবার হিয়াদের সাথে পরীক্ষার্থী রাইশা তাদের এক বছরের বড় সে ন্যাশনালে অনার্স করছে,, আর নীলা আর রিয়া ক্লাস নাইনে পড়ে।
সবার পরিচয় দিয়ে তাঁরা হিয়া কে ঝেঁকে ধরলো কীভাবে তাদের পরিচয় হলো, কীভাবে সে তাদের অমন বদ রাগী ভাই কে তার প্রেমে ফেলল যে সোজা তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে, কীভাবে তাদের বিয়ে হলো আরও এতো এত প্রশ্ন, হিয়া প্রথমে একটু অবাক হলো প্রথম থেকে দেখে আসছে মেয়ে গুলো বেশ শান্ত তবে বড়রা যেতেই যেনো একেক জন নিজেদের আসল রূপে ফিরিছে মেয়েগুলো বেশ চঞ্চল, হিয়া ও ওদের দেখে নিজের বাচাল রূপে ফিরে আসে সোফার উপর পা তুলে চানাচুরের বাটি হাতে নিয়ে খেতে খেতে আড্ডা জমিয়ে দেয়,, যেনো তারা কত দিনের পরিচিত সবকটা হিয়াকে ভাবী ডেকে ডেকে পাগল করে ফেলছে প্রত্যেকটা কথায় ভাবী এইটা ভাবী ঐটা ,,সোহানা হাসতে হাসতে বলে,,
– কি শুরু করেছিস তোরা? ভাবী ডেকে ডেকে তো আমার বেবি কে পাগল করে দিবি।
হিয়া বরাবরই লজ্জা কম সে ভাব নিয়ে বলল,,
– তোদের মুখে ভাবী ডাক শুনবো বলেই তো তোর ভাইকে বিয়ে করেছি না হলে তোর ভাই ওমন ও কিছু না, তোরা তো আর ভাবী ডাকিস না ওরাই ডেকে আমার ভাবী হওয়ার সখ পূরণ করুক।
সোহানা মুখ বাকিয়ে বলে,,
– ঐ জন্যই তো আমার ভাই অন্য মেয়েকে ভালবাসে জেনে কেঁদে কেটে জ্বর বাঁধিয়ে ঢাকা ছেড়ে নাটোর গিয়ে সোক পালন করেছিস!
সোহানা আর কিছু বলার আগে হিয়া সোহানার মুখ চেপে ধরে হেসে বলে,,দেখেছ আড্ডায় পড়ে ভুলেই গিয়েছিলাম মামুনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে তাছাড়া এখন ফ্রেশ না হলে আমি অসস্তি তে মরেই যাব এই সোহা চল,,
হিয়ার কাণ্ডে সবাই হাসে,সোহানা নাবা কে বলে,,
– তোরা ওকে নিয়ে মায়ের ঘরে যা আমি একটু আসছি, বলেই একটু আড়ালে চলে গেলো, তামিম সেই কখন থেকে কল করে যাচ্ছে এইবার একটু কথা না বললেই নয়।
————
চুন-সুরকির দেয়াল, ভেতরে কাঠের খোদাই করা জানালা, আর উঁচু উঁচু সিলিং সৈয়দ বাড়ী সব মিলিয়ে বাড়িটা যেন গল্পের মতো এক জায়গা। জানালা দিয়ে তাকালে আধারে দেখা যায় এক অনন্য দৃশ্য, চাঁদের আলোয় আধারের চা বাগানের দৃশ্য আর মনমাতানো দক্ষিণা বাতাস সব মিলিয়ে মুগ্ধকর। রাতে হালকা খাবার খেয়ে সবাই ঘুমাতে চলে যায়,, ওরা সবাই এতো জার্নি করে বেশ কালন্ত থাকায় সবাই নিজ নিজ ঘরে চলে যায় ঘুমাতে ,, সামীর নানাবাড়িতে লোকের তুলনায় ঘর বেশি হওয়ায় নানার বাড়িতে ও সামীর নিজের ঘর আছে সেখানেই সামীর সাথে থাকতে দেওয়া হয় হিয়া কে,, তবে এত সুন্দর পরিবেশে ও হিয়া অস্থির হয়ে পায়চারি করছে সারা ঘর জুড়ে । সামীর সঙ্গে এর আগে একঘরে একবার থেকেছে ঠিকই, কিন্তু সেটা ছিল হঠাৎ পরিস্থিতি, অল্প কিছু সময়ের জন্য। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন তাই হিয়ার কেমন অসস্তি লাগছে। বৈধ স্ত্রী হিসেবে, পুরো একটা রাত একসঙ্গে থাকতে হবে,এই ভাবনাতেই হিয়ার বুক ধকধক করতে থাকে।তার উপর গত চার দিন ধরে সে সামীর সঙ্গে কথা বলে না। সামীর উপর রেগে এতদিন কল ধরেনি এইবার নিশ্চয়ই সামী তাকে বাগে পেয়ে কাঁচা গিলে খাবে অস্থির হয়ে হিয়া রুম জুড়ে পায়চারি করছে নানান চিন্তার মধ্যেই খট করে দরজার খোলার শব্দ। হিয়া চেয়ে দেখে সামী তাকেই কেমন করে দেখছে,, সামীর সেই চোখ জোড়া দেখেই হিয়া শুকনো ঢোক গিলে আবারও রেগে যাওয়ার ভান ধরে সামীর হাত থেকে বাঁচতে দ্রুত খাটের এক পাশে গিয়ে এই গরমেই কাথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়ে ,, দরজা বন্ধ করার শব্দ হয় ,,তারপর সব নিশ্চুপ কোনো সারা না পেয়ে হিয়া চোখের উপর থেকে কাথা সরিয়ে উকি মারে মূহুর্তেই চোখের সামনে সব অন্ধকার দেখে ,, ভাগ্যিস দক্ষিণের জানলা দিয়ে এক ফালি চাঁদের আলো এসে ঘরটাতে অল্প স্বল্প আলো দিচ্ছিল,, না হোলে তো হিয়া ভয়েই মরে যেত,, হিয়া সামনের দিকে তাকিয়ে সামী কে খোঁজে, না সামী নেই হিয়া একটু ভয় পায় এমন সময় হিয়া টের পায় ধীরে ধীরে কাথার নিচে একজোর ঠান্ডা হাত স্পর্শ করে তার পেট ,, ভয়ে হিয়া আম্মুউউ বলে চেঁচিয়ে উঠে,, সামী সাথে সাথে তাঁর মুখ চেপে ধরে ধীর গলায় বলে,,
– হুস ফুল ইটস মি ইউর মেন,,
সামীর সেই শীতল কন্ঠ আর স্পর্শে হিয়া যেনো জমে যায় বুকের ভেতর থাকা হৃদযন্ত্র যেনো ম্যারাথনে নেমেছে ,,, সামী টের পায় তা ,হিয়াকে ওভাবেই ধরে থেকে ধীর গলায় বলে,,
– আচ্ছা ফুল তোর কাছে আমাদের সম্পর্কটা ঠিক কেমন বলতো? মানে হুট করে একদিন দেখলাম ভালো লাগলো,, ভালো লাগা না ভালোবাসা পরীক্ষা করলাম না, কোনো ধৈর্য না কোনো অপেক্ষা না, না কোনো ভালবাসা পাবার জন্য তড়পানো,শুধু ভাললাগে মানে সে আমার সেই কথা প্রকাশ হওয়ার সাথে সাথেই তাকে পেয়ে গেলাম কি তাই তো?
হিয়া এখনো ওমন ভাবেই সুয়ে তার পিঠ ঠেকেছে সামীর বুকে, হিয়ার সারা না পেয়ে সামী দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও বলতে লাগলো,,
– কিন্তু আমার কাছে আমদের সম্পর্কটা আমার আট বছরের প্রতীক্ষার ফল,, আমার একবার দুবার না বারবার হাজারবার পরীক্ষা নেওয়া ভালোবাসার ফল,, তোকে পাওয়ার জন্য আমি আট আটটি বছর অপেক্ষা করছি,, তোর ভাইয়ের কাছে তোর বাপের কাছে আমার পরিবারের কাছে এমনকি আমার নিজের কাছেও আমাকে বারবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে প্রমাণ করতে যে আমি ঠিক তোকে কতটা ভালবাসি , দূর থেকে তোর জন্য তরপিয়েছি, হাজারো মেয়ের ভিড়ে তোর জন্য অপেক্ষা করেছি, নিজেকে তোর জন্য সুরক্ষিত রেখেছি, নিয়ন্ত্রণ করেছি, তোকে পাবার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছি, আমার এত সাধনার ফল তুই, আর তুই কি না বললি আমি তোকে কখনও ভালোই বাসি নি ? শুধু মুখে বললেই কি ভালো বাসা যায় হিয়া?
হিয়া কিছুক্ষণ নিঃশব্দ থাকে। যেন শব্দগুলো তার বুকের ভেতর গিয়ে বিধছে। সামীর কণ্ঠটা এতটা শান্ত, গভীর আর আবেশে ভরা যে ওর ঠোঁট কাঁপে।
সামীর হাত তখনো হিয়ার কোমর জড়িয়ে ধরে আছে, তার শরীরের উষ্ণতা হিয়ার প্রতিটি শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রবাহিত হচ্ছে সামীর কথাগুলো প্রতিটা বাক্যে যেন হিয়ার অভিমান গলে যাচ্ছে।
একটু থেমে সামী আবার বলল,
– তুই জানিস না, তোকে ভালোবাসার আগেই আমি তোকে সম্মান করতে শিখেছি। তোকে পাবার জন্য আগে তোকে পাওয়ার জন্য যতটুকু যোগ্য হতে হবে আমি সেটা হয়েছি, শুধু তোর জন্য।
আমি তোর প্রেমিক না, আমি তোর স্বামী। আমার ভালোবাসা ফুচকা খাওয়ানোর মধ্যে না, সেটা তোকে নিয়ে জীবন গড়ার মধ্যে। জানি ছোটো ছোটো এইসব মুহূর্ত গুলো জীবনে প্রয়োজন তবে আমি সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম তোর কাছে গেলে কাছকাছি থাকলে আমি ঠিক থাকি না ফুল, নিয়ন্ত্রণ হারাই, সামনে তোর পরীক্ষা তাই তোকে এখনই এসবে জড়াতে চাইনি,, তাই এই দুরত্ব হিয়া, তুই যদি মনে করিস, তোর সাথে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে গল্প না করে, তোকে রোজ ডেট-এ না নিয়ে গিয়ে, আমি ভালোবাসি না তাহলে তুই আমার ভালোবাসা বুঝিস না হিয়া একটু ও না।
হিয়া আস্তে আস্তে চোখ ঘোরায়। সামীর চোখে চোখ পড়তেই চোখে জল এসে যায় ওর। কণ্ঠ শুকনো, ধীরে বলে,
– তাহলে এতদিন এসব বললেন না কেন? অপনার থেকে অবহেলা পেলে আমার বুঝি খারাপ লাগে না,
সামী হিয়ার কাঁধে মুখ গুঁজে ফেলে ফিসফিস করে বলে ,
– আমি রোজ তোকে ভালোবাসি হিয়া। প্রতিটা নিঃশ্বাসে তোর জন্য বাচি শুধু বলি না, কারণ তুই আমার,, তোকে আমার বলে বোঝাতে হবে কেন এইটুকু যদি না বুঝিস তাহলে তুই আমার কেমন বউ?
হিয়া এবার পুরো ঘুরে সামীর বুকে মুখ গুঁজে ফেলে। সামী হিয়ার কানের পিঠে চুমু খেয়ে বলে,,
– রাগ কমেছে? অভিমান কমেছে?
হিয়া সামীর বুকে মুখ গুঁজে রেখেই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়,আর কিছু বলে না।
সামী ওর কপালে চুমু খায়, হাত বুলিয়ে দেয় পিঠে। ধীর কণ্ঠে বলে,,
– ফুললল,, আজ তোকে দিবি? আমার হবি? তোর আজকের এই বউ বউ রুপে আমি শেষ হয়ে যাচ্ছি আই ক্যান্ট কন্ট্রোল মাইসেলফ এনিমোর,মেবি আই ডোন্ট ইভেন ওয়ান্ট টু। আই ডোন্ট ওয়ান্ট এনি মোর ডিস্ট্যান্স বিটুইন আস , হিয়া চাই না আর দুরত্ব।
হিয়ার শরীর কাঁপছিল একটু একটু করে, লজ্জায়, আবেগে, আর কিছুটা সংকোচে। সামীর এই সরল অথচ গভীর ভালোবাসার কাছে হার মেনে হিয়া যেন ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছিলো।
সামী হিয়ার মুখটা তার দুই হাতের মাঝে নিয়ে চোখে চোখ রেখে আবার বলল,
– কি হলো ? কিছু তো বল!
হিয়া লাজুক গলায় বলল,
– আমি তো আগে থেকেই আপনার , আপনার আর কি হবো?
সামী হেসে বলে,
– বুঝিসনি ? নাকি বুঝতে চাচ্ছিস না?
হিয়া লজ্জায় আবারও মুখ লুকালো সামীর বুকে আলতো হাতে কিল মেরে বলল,,
– জানি না, অসভ্য পুরুষ!
এই কথাটুকু যেন আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করল। সামী এক মুহূর্তও আর দেরি করল না। ও হিয়াকে বুকে টেনে নিয়ে আদরে, ভালোবাসায় ভরিয়ে দিলো। কপাল থেকে শুরু করে চোখ, গাল, ঠোঁট ধীরে ধীরে নিজের স্পর্শে অনুভব করাতে থাকলো ভালোবাসার নিঃশর্ততা।
হিয়াও আর বাধা দিলো না, ওর অভিমান, লজ্জা, কষ্ট সব যেন আজকের ভালোবাসায় ধুয়ে গেলো। সেই রাতে হিয়ার শিকদার সাহেব আর তাঁর মিসেস শিকদার ভালোবাসার পূর্ণতা খুঁজে পেলো এক নিঃশব্দ কিন্তু গভীর আবেগের আলিঙ্গনে।
চাঁদের আলোয় চা বাগান আর সৈয়দ বাড়ির আকাশ ছুঁই ছুঁই ছাদ যেন সাক্ষী হয়ে রইলো তাদের ভালোবাসার নিঃশব্দ ঘোষণা।
#চলবে,,,
#প্রণয়ের_মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(২৬)
কেটে গেছে অনেকগুলো দিন, সিলেট সফরের পর। সিলেটে সামীর নানাবাড়ীতে হীয়ারা দশ দিন ছিলো, নানাভাই কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরপরই তারা ঢাকায় ফিরে,সৈয়দ বাড়ির সেই আবেগময় দিন গুলোর পর হিয়া আর সামীর জীবনে যেন এক নতুন সকাল এসেছে। সে দিন গুলো যেনো হিয়ার স্বপ্নের মতো কেটেছে, সামীর সাথে হাত ধরে ঘুড়েছে সিলেটের চা বাগানের আনাচে কানাচে, রাত গুলো ছিলো আরো বেশি সুন্দর,সম্পর্কের টানাপোড়েন, অভিমান আর দূরত্বের জায়গা এখন ভরে আছে বোঝাপড়া, আদর আর একরাশ নির্ভরতায়।
হিয়া আর সামীর মধ্যকার খুনসুটি এখন যেন আরও মধুর। সকাল-বিকেল সামীর হাজার ব্যস্ততার মাঝেও হিয়ার সাথে কথা বলা, মাঝে মাঝেই কলেজ থেকে ফেরার পথে সামীর সাথে লং ড্রাইভে যাওয়া,, মাঝে মাঝে তো এমন ও হয়েছে সামী হিয়াকে নিয়ে আর তামিম সোহানাকে নিয়ে বেড়িয়ে গেছে আর সোহান বেচারা ইরা ,প্রীতি, নীরব ওদের সাথে বসে শুধু গালি দিয়েছে,, আর হায় হুতাশ করেছে ওর কেউ নেই বলে, হিয়া কে অনেক বলার পর ও এখনো তাকে তানিয়ার সাথে যোগাযোগ করায়নি বলে ও দু চারটে বেশি গালি দিয়েছে।
আগামীকাল থেকে হিয়াদের এইচ এস সি পরীক্ষা শুরু
শুধু মাত্র সোহানা আর নীরব বাদে তাদের বন্ধুমহলের সবকটাই ভন্ড পড়াশোনায় ফাকিবাজ তবে এক্সাম এলে তারা খুব সিরিয়াস হয়ে যায় রাত দিন এক করে পড়ে তাঁরা, এই যেমন এখন বাজে রাত দেরটা এখনো হিয়া ও তাঁর বন্ধুমহলের সবকটা বাংলা প্রথমপত্র বই নিয়ে পড়ে আছে যার যার পড়ার টেবিলে, তাঁরা সংযুক্ত ভিডিও কলে ,, শুধুমাত্র পড়ায় কোনো সমস্যা হলেই তারা কথা বলছে,হিয়া তখন লালসালু উপন্যাস টা পড়ছে, এতো প্যাচ মারা এক উপন্যাস তার উপর উপন্যাসে গালিগুলো নাউজুবিল্লাহ মুখ বিকৃতি করে হিয়া বলল,,
– ছিঃ এগুলো কোনো উপন্যাস হলো? মানে কি যে বলবো,
– ঠিক বলেছিস ভাবী, বাল পড়মু না বাংলা প্রথম পত্র দ্বিতীয় পত্র থেকে কঠিন, কিসব বাল ছালের গল্প উপন্যাস, বিলাসী,মাসি পিসি, ভয়ানক একগালি মাসি পড়লে পিসিরে ভুইল্লা যায় পিসিরে পড়লে মাসিরে আবার বিলাসীর রং অনুপমের ডং শালার মামা হইলো আরেক ভিলেন এতো এতো ক্যারেক্টার মনে রাখা যায় নাকি?
সোহনের আজাইরা কথায় সোহনা বিরক্ত হয়ে বলে,,
– তোর পড়া লাগবে না ,মুখ বন্ধ রাখ আর আমাদের পড়তে দে !
তখনই রূমে প্রবেশ করলো সামী গম্ভীর কণ্ঠে বলে,,
– এখন আর কারোই পড়ার দরকার নেই, রাত অনেক হয়েছে সারা বছরে যা পারোনি এক রাতেতা পারবে না তাই এতো স্ট্রেস নিয়ে রাত জেগে অসুস্থ হওয়ার কোনো মানেই হয় না, আর তোমারও ( ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে) সবাই এখনই বইপত্র বন্ধ করে ঘুমাতে যাবে, বাকিটা সকালে শেষ করবে, সমীর এক কথায় সবকটা বই বন্ধ করে উঠে দাড়ালো শুধু হিয়া বাদে সামী কে গুড নাইট বলে কল কেটে দিয়েছি, হিয়া তখনো লাইনে, সামী আবারো গম্ভীর কণ্ঠে বলে,,
– কি হলো? সবাই তো ঘুমাতে চলে গেলো, তুই এখনো কি করছিস? যা ঘুমাতে যা,
– আপনার কথায় নাকি?
বলেই হিয়া মুখ ভেঙ্গিয়ে খট করে কলটা কেটে দিলো,
সামী দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মৃদু স্বরে বলল,,
– জ্বালিয়ে মারলো, পকেট থেকে ফোন বের করে কল লাগালোওপাশ থেকে রিসিভ হতেই বলল,,
– বিরক্ত করলাম? ঘুমিয়ে গিয়েছিলে মামুনি?
– না তো আমি তো হিয়ার জন্য কফি করছি, এখনো জেগে আছে,দেখ না বাবা সেই কখন থেকে বলছি এইবার অন্তত ঘুমা শুনছেই না আমার কথা ,
আয়েশার কথায় হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করে সামী আবারও বলল,,
– ঐ জন্যই কল দিয়েছি একটু বুঝাও আমাকেও ঝাড়ি দিয়ে কল কেটে দিয়েছে, রাত জাগলে এক্সাম হলে ঘুমাবে গর্ধব টা,
– ঠিক আছে বলে দেখছি তাহলে,, তখনই হিয়া আয়েশা কে ডেকে উঠল
– মাআআআ ,,
– ডাকছে, দেখি বুঝিয়ে রাখছি তাহলে,,
ফোন রেখে আয়েশা মীর চলে গেলো হিয়ার রূমে হিয়া টেবিলে মাথা গুঁজে পড়ে আছে,, হিয়া কে ওভাবে দেখে আয়েশা মীর দ্রুত হিয়ার কাছে গেলেন হিয়ার কাঁধে হাত দিয়ে ডেকে বললেন,,
– এখানে অভাবে শুয়ে আছিস কেন? যা বিছানায় গিয়ে ঘুমা, আবার সকালে উঠে নাহয় পরিস কিরে উঠ,,
হিয়া ধীরেধীরে মাথা তুলে,, হিয়ার মুখ চোঁখের অবস্থা ভালো না, মেয়ের এই অবস্থা দেখে আয়েশা মীর বিচলিত হয় বলে,,
– সে কি মুখের অবস্থা এমন কেন? খারাপ লাগছে তোর বাবা কে ডাকবো? দেখে যাক একটু
আয়েশা মীর ছুট লাগায় নিজের ঘরের দিকে হিয়া খপ করে মায়ের হাত ধরে থামায় বলে,,
– কোনো দরকার নেই,, এতো রাতে আব্বুকে ডাকার প্রয়োজন নেই, কিছুই হয়নি আমার, মাথা টা ঘুরে গিয়েছিল একটু হয়তো এক্সামের টেনশন তার উপর রাত জাগছি তাই,, এখন একটু রেস্ট নিলেই ঠিক হয়ে যাবো,, তুমি নিশ্চিন্তে যাও আমি শুয়ে পড়ছি,,
হিয়ার কথায় যেনো একটু স্বস্তি পেলেন আয়েশা মেয়েকে ধরে বিছানায় শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,,
– নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়,, মাথা ঠাণ্ডা রাখ যা হওয়ার তাই হবে
বলেই তিনি হিয়ার মাথায় চুমু দিয়ে লাইট অফ করে চলে যান,, উনি যেতেই হিয়া চোখ বুঝে তখনই হিয়ার ফোনে নোটিফিকেশন এর শব্দ হয় মেসেজ এসেছে, সামীর, হিয়া মুচকি হেসে মেসেজটা ওপেন করে,,
– ঘুমিয়ে পড়, একটু বেশিই ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। চোখের নিচে কালি পড়লে খবর আছে, তোকে বুঝি ঠিকমতো সময় দিতে পারছি না? তাই রেগে আছিস আবারো?কিন্তু বিশ্বাস কর হিয়া, তুই আমার দুনিয়ার সবচেয়ে দামী মানুষ। কাজের চাপে একটু হয়তো কম সময় দেই তবে তোকে ছাড়া আমি টোটালি নিঃস্ব ।তোর হাসি, তোর চুলের ঘ্রাণ, তোর রাগ, তোর অভিমান সব, সব আমার ভালোলাগার কারণ, তাই আর রাগ করিস না না হলে কিন্তু আগের বারের মতো রাগ ভাঙ্গাবো!
এই পর্যায়ে হিয়া লাজুক হাসে সৈয়দ বাড়ির সেই রাত গুলোর কথা মনে হলেই হিয়ার লজ্জা পায় খুব করে লজ্জা পায়, লাজুক হেঁসে বলল,, অসভ্য, হিয়া আবারো চোখ দিল স্ক্রিনে বাকি টুকু পড়ে শেষ করলো,
– ঘুমো ভালো করে। কাল তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে, যার জন্য আমার এতো ব্যস্ততা , তুই নিশ্চিন্তে ঘুমা এক্সাম যা হবার হবে আমি তো আছিই ,,তোকে আগলে রাখতে, ভালোবাসতে, শুধু তোর হয়ে থাকতে।
ঘোলা ঘোলা চোখে পুড়োটা কোনো মতে পড়ে শেষ করলো হিয়া, মাথাটা আবারও ঘুরছে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছে, কিছুতেই আর চোখ দুটো খুলে রাখা যাচ্ছে না, রিপলেও করতে পারল না হিয়া লিখতে পারলো না তার মনের কৌতূহল, কি সরপাইজ রেখেছে তাঁর জন্য তাঁর শিকদার সাহেব, তার আগেই চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল, হিয়া তলিয়ে গেলো ঘুমে।
———
বই নিয়ে বিছানায় পড়ে আছে হিয়া, এখন সকাল বাজে এগারোটা, এতো ক্ষণে সোহানদের এক্সাম প্রায় এক ঘন্টা শেষ, যখন হিয়া এডমিট কার্ডে দেখেছিল বোর্ড এক্সাম ও ওদের বিকেলে সময় ফেলেছে হিয়ার মেজাজ খুব খারাপ হয়েছিল এবার ও তাকে একা এক্সাম হলে যেতে হবে বলে তবে এখন হিয়ার মনে হচ্ছে ভালোই হয়েছে দুপুরে এক্সাম হওয়ায়, না হলে সে কি করতো? সে তো মাথায় তুলতে পারছে না, সকাল থেকেই হিয়া একটু অন্যরকম অনুভবকরছে। ক্লান্ত লাগছে মাথাটা ভার হয়ে আসছে। সকালে হসপিটাল যাওয়ার আগে মীর সাহেব এসে ছিলেন মেয়েকে দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝিয়ে গেছেন, সাথে মাথা ঠান্ডা রাখতে ঔষুধ দিয়ে গেছেন,এই একটা সমস্যা হিয়ার এক্সাম এলেই হিয়া অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাছাড়া রাত জাগা পড়ার চাপ আর এক্সামের টেনশন সব মিলিয়ে হিয়ার অবস্থা করুণ, মেয়ের এমন অবস্থা দেখে আয়েশা মীর যেনো বিপাকে পড়লেন, মেয়েটা তার এমনি পরীক্ষা এলেই হিয়ার যত অসুখ হয়, তবে এইবার একটু বেশীই, তাই ওনার চিন্তার শেষ নেই নিজে সকাল সকাল হিয়াকে ডেকে তুলে নাস্তা খাইয়েছেন, মেয়ের পাশে বসে আছেন কখন কি লাগবে না লাগবে, আরেকটু পরেই বের হতে হবে তবুও হিয়া যেন কেমন আনমনা। তখনই দুধের গ্লাস হাতে রূমে প্রবেশ করলেন আয়েশা, মাকে দেখে হিয়া উঠে বসে, আয়েশা পাশে বসে আদুরে স্পর্শ মাথায় দিতেই হিয়া জিজ্ঞেস করল,,
– কয়টা বাজে আম্মু? সময় আর বেশি নেই না? রেডি হোতে হবে তো,
– সারে এগারোটা বেজে গেছে এবার তৈরি হ,, আর চিন্তা করিস না ভয় পাস না যা হবার হবে, চিন্তা করে করে শরীরের কি অবস্থা করেছিস দেখেছিস? আল্লাহ না করুক পরীক্ষার হলে যদি মাথা ঘুরে যায় তখন কি করবো? তাই আর পড়া ও লাগবে না আর চিন্তাও করা লাগবে না, উঠ এবার হাতের গ্লাস টা এগিয়ে বলেন গরম গরম শেষ করে তৈরি হ কেন্দ্র যথেষ্ট দূরে যেতে সময় লাগবে, দুইটা থেকে এক্সাম শুরু না?
হিয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়, তখনই কলিং বেল বেজে উঠে,, আয়েশা মীর হিয়ার হাতে দুধের গ্লাস টা হিয়ার হাতে গুজে চলে যান দরজা খুলতে,, আয়েশা যেতেই হিয়া গ্লাস টা মুখের সামনে তুলতেই ওয়াক করে উঠে,, হিয়ার মনে হলো এই গন্ধে তার নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসছে, হিয়া দৌড়ে গিয়ে ওয়াশরুমের দরজায় বসে গরগর করে বমি করে দিল,, হিয়ার চিৎকার শুনে আয়েশা মীর দৌড়ে রূমে প্রবেশ করলো সাথে দৌড়ে আসলো সামী, গিয়েই আয়েশার সামনেই ঝাপটে ধরলো, আয়েশা মেয়ের চোখে মুখে পানি দিলো, পানি ঢেলে সব পরিষ্কার করলো সামী হিয়াকে ধরে বলল,,
– মামুনি ভিজে যেহেতু গিয়েছে ওকে আমি ধরি তুমি গিয়ে ওর জামাকাপড় নিয়ে এসো, একদম গসল করে বের হোক, আয়েশা দ্রুত গেলেন, উনি আসতেই সামী হিয়াকে গোসল করতে বলল, হিয়া উঠে ধীরে ধীরে গোসলে গেলো সামী আয়েশা কে বলল,,
– বাড়ীতে বমির ঔষুধ আছে?
– হ্যাঁ
– তাহলে নিয়ে আসো আমি আছি ওর কাছে সমস্যা নেই ,
আয়েশা মীর যেতেই হিয়া বেরোলো গোসল বলতে দুই মগ পানি ঢেলে কোনরকম চেঞ্জ করে বের হয়েছে, সামী তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বসায়, চুলের পানি মুছে দেয়, আয়েশা মীর ঔষুধ নিয়ে এলে ঔষুধ খাওয়ায়, এতো ক্ষণে হিয়া একটু স্বস্তি পায়, হিয়া একটু সুস্থ বোধ করতেই সামী হিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে , কেন্দ্র টা বেশ দূরেই পড়েছে,সোহানা সোহন কে নিয়ে গিয়েছিল যখন তখনই দেখেছে,কলেজে পৌঁছে সামী গেট পর্যন্ত হিয়াকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
– শান্তভাবে পরীক্ষা দিস, ঠিক আছে? খালি খালি টেনশন নিস না। কোনো ভয় নেই আমি বাইরেই থাকবো, ঠিক মতো লিখবি, আর এত চাপ নেওয়ার কিছুই নেই, সাবধানে যা,,
হিয়া হেসে মাথা নাড়ে। কিন্তু সেই হাসিটা একটু ফ্যাকাসে ছিল। হিয়া কেন্দ্রে প্রবেশ করে,পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টাখানেক ভালোই ছিলো, কিন্তু দ্বিতীয় ঘণ্টার পরেই হঠাৎ করেই হিয়ার মাথা ঘুরে ওঠে। প্রথমে সে চোখে অন্ধকার দেখে, এরপরই ধপ করে নিচে পড়ে যায়। সাথে সাথে হৈচৈ শুরু হয়ে যায় হল রুমে। কলেজের শিক্ষকরা দৌড়ে আসে। কেন্দ্রে থাকা ডাক্তার রূমে ধরা ধরি করে হিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয়, বোর্ড পরিক্ষা এমন এক জিনিস যেখানে, কেও মরে গেলেও পরীক্ষার্থী উঠে যেতে পারে না, হিয়ার এমন পরিস্থিতি তে এগিয়ে যেতে না পারায় অনেকে আফসোস ও করলো, সবার মুখে একটাই কথা গুঞ্জন হয়ে উঠলো,,
– পরীক্ষা নিয়ে চাপ নিয়েছে বেশি, তাই হয়তো অজ্ঞান হয়ে গেছে।
#চলবে,,
#প্রণয়ের_মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(২৭)
মূহুর্তেই হওয়ার বেগে পুড় কেন্দ্র ছড়িয়ে পড়ে হিয়ার জ্ঞান হারানোর খবর,খবরটি এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো যে কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সামীর কানে সেটি পৌছাতে বেশি সময় লাগলো না।সামী তখন হিয়ার জন্য বাহিরে অপেক্ষারত, একটা মেয়ে জ্ঞান হারিয়েছে শুনে সামী অস্থির হয়ে উঠলো, কোনো ভাবে সেই মেয়েটা হিয়া নয় তো? কেও মেয়েটির নাম বলতে পারলো না তবে মেয়েটি যে হীয়াদের কলেজের তা নিশ্চিত এইটা শুনে সামীর অস্থিরতা আরও বেড়ে গেলো , তার মনে শুধু একটা কথা ,হিয়া যেন ঠিক থাকে। হিয়ার চিন্তায় অস্থিরতায় সামীর পুড়ো শরীর ঘেমে উঠলো, বুকের ভেতর যেন আগুন লেগে গেছে। সামী জ্ঞান হারিয়ে ফেলা মেয়েটার নাম জানার খুব চেষ্টা করলো তবে সঠিকভাবে কেউ বলতে পারলো না। সামী বার বার ঘড়িতে সময় দেখে পরিক্ষা শেষ হওয়ার আর মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট তবুও সামীর মনে হয় এই সময়টুকু যেনো তার কাছে এক যুগের সমান!
———
অন্যদিকে কেন্দ্রের স্টাফরুমে ডাক্তার এসে পৌঁছেছেন। হিয়াকে এক কোণে শুইয়ে পরীক্ষা করছেন। প্রেসার নিচে, ঠোঁট ফ্যাকাশে। চোখ খুলছে না ঠিকমতো। পাশে দুজন ম্যাডাম চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে।
ডাক্তার হিয়াকে চেক করে নিচু গলায় বলেন,,
– স্ট্রেস, রাত জাগা,এসব তো আছেই। কিন্তু কিছু উপসর্গ দেখছি, যেটা এক্সেসিভ স্ট্রেস নয়, বরং হরমোনাল ইমব্যালেন্স বা প্রেগনেন্সির ইফেক্টও হতে পারে। আমি নিশ্চিত না, তবে strong suspicion আছে।”
– মানে? ও প্রেগনেন্ট হতে পারে?
আশ্চর্য চোখে বলে ওঠেন একজন ম্যাডাম।
– না আমি সন্ধেহ করছি,,ব্লাড প্রেশার বেশ নিচে নেমে গেছে। পরীক্ষা আর মানসিক চাপ হয়তো কারণ হতে পারে। কিন্তু কিছু শারীরিক লক্ষণ দেখছি, মনে হচ্ছে পসিবলি ইট’স আ আর্লি স্টেজ অফ প্রেগনেন্সি।
ডাক্তার ধীরে বলেন।
পাশে থাকা একজন ম্যাডাম অবাক হয়ে চোখ বড় করে তাকান,
– প্রেগনেন্সি?আপনি কি নিশ্চিত? আমার জানামতে ও তো আনমেরিড।
ডাক্তার মাথা নাড়েন,
– টোটালি না, কিন্তু সম্ভাবনা আছে। ওর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার। দ্রুত ওকে হাসপাতালে নিতে হবে কিছু টেস্ট করার জন্য। তবে তার আগে মেয়েটার জ্ঞান ফেরানো জরুরি।হিয়ার নিস্তেজ মুখটা যেন গুমোট এক ভাব ছড়িয়ে রেখেছে পুরো রুমে। সবার চোখে উৎকণ্ঠা। মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত তাঁর শিক্ষক গণ, একটা বছর নষ্ট হলেও হতে পারে, একজন ম্যাম তাঁর নাম রোমানা তিনি ঘড়িতে সময় দেখেন আর ও বেশ কিছুটা সময় আছে পরিক্ষা শেষ হওয়ার, তিনি ডাক্তারকে তারা লাগান, যদি কিছুটা লিখতে পারে মেয়েটা ডাক্তার দ্রুত কাজ শুরু করেন। প্রথমেই তিনি হিয়ার পালস চেক করে নিশ্চিত হন, শ্বাস চলছে কিন্তু দুর্বল। নার্সকে ইশারা করেন, ঠান্ডা পানিতে তুলা ভিজিয়ে আনতে।
হিয়ার কপালে ঠান্ডা পানির ছোঁয়া রাখতেই ডাক্তার মৃদু কণ্ঠে ডাকেন,
– আমায়রা,,আমায়রা ( হিয়ার এডমিট থেকে ডাক্তার হিয়ার এই নাম জানেন) চোখ খুলো মা, দেখো, সবাই তোমার পাশে আছে, কিচ্ছু হয়নি তোমার,,
তুলার ঠান্ডা স্পর্শ, ডাক্তারদের নিরবধি কণ্ঠ আর স্নেহমাখা ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে কাঁপে হিয়ার চোখের পাতা। এরপর হঠাৎই যেন হালকা শ্বাস ফেলে চোখ খুলে ফেলে। ভয়ার্ত চোখে চারপাশে তাকায় হিয়া।
– আলহামদুলিল্লাহ, জ্ঞান ফিরেছে, বলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন ডাক্তার।
একজন ম্যাডাম হিয়ার মাথার পাশে বসে ওর হাতটা ধরে বলেন,
– তুমি ভালো আছো মা, ভয় পেও না,, তুমি এখন ঠিক আছো?
হিয়া কাঁপা কণ্ঠে শুধু এইটুকুই শব্দ উচ্চারণ করে,
– আমি এখানে? আমার এক্সাম?
হিয়ার চোখের কোণে জল জমে উঠলেও ও এখন কিছুটা স্থির। নিজের হাতের পেছনে স্যালাইনের সুই দেখে একটু চমকে ওঠে, পাশে বসে থাকা ডাক্তার আনজুমান হাত টা ধরে বলেন,,
– শান্ত হও তোমার শরীর ভালো না, আচ্ছা ডোন্ট মাইন্ড তুমি কি বিবাহিত?
হিয়া এই মুহুর্তে এসব কেনো জিজ্ঞেস করলেন বুঝে ঊঠতে পারল না, শিক্ষক দের সামনে এমন প্রশ্নে সে একটু প্রস্তুত হলেও ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বলে,,
– হুম ,,
হিয়ার কথায় ডাক্তার আনজুমান মুচকি হাসে তার ডাক্তারি জীবনে এমন পরিস্থিতি সে প্রথম দেখলো কেও এক্সাম হলে এসে জানতে পারবে সে মা হতে চলেছে ,, ওনার ধারনা তবে উনি এই মুহুর্তে তিনি হিয়া কে কিছুই বললেন না, তিনি উল্টো বললেন,
– তুমি শক্ত মেয়ে, আমায়রা। আর একটু সাহস করো। তোমার কিছুই হয়নি জাস্ট টেনশনে একটু মাথা ঘুড়িয়ে গিয়েছিল,
উনার কথায় দাঁড়িয়ে থাকা ম্যাম কিছু বলতে নিলে উনি চোখের ইশারায় চুপ থাকতে বলেন , হিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,,
– সময় এখনও আছে। তুমি চাইলে লিখতে পারো। নয়তো তোমার একটা বছর নষ্ট হতে পারে,,
হিয়া চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস নেয়। মাথায় এখনও হালকা ঝিম ধরে আছে, হাত কাঁপছে, কিন্তু সে উঠে বসে। রোমানা ম্যাম তাকে এক গ্লাস খেতে দেন, মাথার পেছনে বালিশ তুলে দেন। হিয়া বলে,,
– আমি লিখবো ম্যাম ,আমার এক বছর নষ্ট হোক, আমি চাই না,
হিয়ার কথা শুনে রোমানা ম্যাডাম সঙ্গে সঙ্গে ফোন করলেন যেন কোথাও কোথাও পরপরই অনুমতি দেন হিয়াকে যে টুকু সময় আছে সে যেন পরীক্ষায় অংশ নেয়।
তাকে দ্রুত পরীক্ষার হলে আনা হয়, তাকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য আবারও পরীক্ষার্থীরা থমকায়,, হিয়াকে দ্রুত লিখার জন্য ব্যবস্থা করে দেওয়া হলো । শুরুর দিকে হাত কাঁপছিল, অক্ষরগুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু ধীরে ধীরে মনসংযোগ ফিরতে থাকে। শরীর দুর্বল, মাথা ভার,তবুও হৃদয়ে ছিল দৃঢ় একটা প্রত্যয়। সে দুর্বল হাতে বাকিটা সময় লিখে,
কোনোভাবে জোগাড় করা সাহসে হিয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর লিখে যেতে থাকে। পাশ থেকে একজন নার্স নিরব দাঁড়িয়ে থাকে যেন যেকোনো সময় তাকে সাপোর্ট দেওয়া যায়। ডাক্তার আনজুমানের অনুরোধ ও হলে থাকা শিক্ষকদের পরামর্শে হিয়ার জন্য আরও কিছুটা সময় বরাদ্দ করা হয়, তাঁর খাতাটা নেওয়া হয়
তাঁর হলে থাকা আরেকটা শারিরীক প্রতিবন্ধী মেয়ের সাথে, প্রশ্ন শেষ করে যখন খাতা জমা দেয় হিয়া, তখন ওর ঠোঁটে ক্লান্ত এক হাসি, পুরোটা শেষ করতে পারেনি তবুও মোটামুটি পাশ করার মতো খাতা অন্তত হয়েছে, হিয়া ,পরীক্ষার খাতা জমা দিয়ে হিয়া একদম নিঃশ্বাস ফেলে। ঠোঁটে এক ক্লান্ত অথচ তৃপ্তির হাসি। শরীর তখনও কাঁপছে, কিন্তু মন শান্ত।
হিয়ার পাশের নার্স আস্তে করে তার কাঁধে হাত রাখেন,
– এখন ঠিক আছো তুমি?
হিয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়, হিয়াকে নিয়ে গিয়ে বসানো হয়ে ডাক্তার আনজুমানের কাছে, তখনই রোমানা ম্যাম এলেন,কাছে এসে মাথায় হাত রেখে বলেন,
– তুমিআজ যা করেছ, অসাধারণ। অন্য মেয়ে হলে হয়তো এক্সাম টা শেষ করতো না,,
হিয়া কৃতজ্ঞতা পূর্ণ চোখে তাকায় সবার দিকে। কাঁপা কণ্ঠে বলে,
– ম্যাম, আপনাদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আপনারা না থাকলে আজ আমি লিখতেই পারতাম না , আমার বছরটা নষ্ট হয়ে যেতো,,অনেক ধন্যবাদ ম্যাম,,
রোমানা ম্যাম হেসে বলেন,
– কৃতজ্ঞতার প্রয়োজন নেই, এটা আমাদের দায়িত্ব। আঞ্জুমান ও বলেন,
– একদম এটা আমাদের দায়িত্ব তবে,,
হিয়ার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন,
– এখন তোমার পরিবারকে জানানো দরকার। তুমি অনেকটা দুর্বল, তোমাকে একা ছাড়তে পারছি না আর কিছু শারীরিক বিষয়েও চিকিৎসা দরকার। কারো সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে?
হিয়া একটু থেমে মাথা নিচু করে। তারপর আস্তে করে মাথা নাড়ে। দুর্বল কন্ঠে বলে,
– হ্যাঁ,, আমার স্বামী উনি বাহিরেই আছেন, এখনো বের হচ্ছি না বলে হয়তো চিন্তাও করছেন , আপনি প্লিজ ওনাকে কল করুন,,
হিয়া সামীর নম্বর দেওয়ার সাথে সাথেই শিক্ষকরা যোগাযোগের চেষ্টা করেন। দুবার রিং হতেই কল রিসিভ হয়, রোমানা ম্যাম সবটা বলতেই, ওপাশ থেকে যেনো বহু কষ্টে শুধু উত্তর এলো,,
– আমি আসছি,,
রোমানা ম্যাম কল কেটে হিয়ার দিকে ফিরে তাকান। মুখে একধরনের আশ্বাস ছড়িয়ে, বলেন,
– সে আসছে, চিন্তা করো না ,
হিয়া চোখ বন্ধ করে এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে।
মুহূর্ত পেরোতেই বাইরের করিডোরে হালকা হৈচৈ হয়।ঠিক তখনই দরজায় ঠাস করে শব্দ হয়। দরজা খুলতেই যেন ঝড়ের বেগে ছুটে আসে সামী। চোখে অস্থিরতা, মুখে আতঙ্ক, গলা শুকিয়ে এসেছে, শরীর ঘেমে নেয়ে একাকার, সে দমবন্ধ মুখে কেবল প্রশ্ন করে,,
– হিয়া! হিয়া কোথায়? আমি ওর হাজব্যান্ড। প্লিজ, আমাকে যেতে দিন।
রোমানা ম্যাম হাত দেখিয়ে হিয়ার দিকে ইশারা করেন। ওনি দেখিয়ে দিতেই সামী ঝড়ের গতিতে এগিয়ে সামী ওর কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে, হিয়ার কাঁপা হাতে নিজের হাত জড়িয়ে ধরে।
– হিয়া,,তুই ঠিক আছিস তো?
হিয়া মাথা নাড়ে। ঠোঁট কাঁপে, কিছু বলতে গিয়ে গলার শব্দ আটকে যায়।
ডাক্তার আনজুমান সামনে এসে বলেন,
– ও এখন কিছুটা স্থিতিশীল। তবে দুর্বল। আমরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছি, কিন্তু হাসপাতালেই কিছু জরুরি টেস্ট করাতে হবে। সম্ভব হলে আপনি এখনই ওকে নিয়ে যান।
সামী আর এক মুহুর্ত ও দেরী করে না স্যার মেম সকলের সামনেই ঝট করে হিয়া কে কোলে তুলে নেয়, হিয়া লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে সামীর কোল থেকে নামার জন্য নড়াচড়া করছে। হিয়ার নড়াচড়া দেখে রেগে গেল সামী তার সেই চিরপরিচিত গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,,
– আর জ্বালাস না আমায় ফুল, পরপরই নরম হলো কন্ঠ,তোর চিন্তায় চিন্তায় শেষ হয়ে গেছি , এই বুকে একটু কান পেতে দেখ তাহলে বুঝবি ঠিক কতটা জ্বালিয়েছিস আমায়,
সামীর কথায় হিয়া আর নড়াচড়া করার সাহস পায় না
চারপাশের ভিড়, দৃষ্টি, ফিসফাস কথা সব যেন হঠাৎই হারিয়ে যায় । সামীর শক্ত বাহুতে জড়িয়ে থাকা হিয়া অনুভব করে ওর বুকের ভেতর অস্থির সেই ধকধকে স্পন্দন, যেটা ঠিক আগের কথাগুলোর মতোই কাঁপিয়ে দেয় হৃদয়।হিয়া চুপচাপ সামীর বুকেই ঘাপটি মেরে বসে থাকে।
রোমানা ম্যাম মৃদু হেসে বলেন,
– ওকে নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে যাও। আমরা ওর ফাইলপত্র পাঠিয়ে দিচ্ছি। কোনো সমস্যা হবে না।
সামী মাথা নাড়ে, কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকায়। সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাঁটতে শুরু করে,বুকে হিয়াকে নিয়ে, মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত শঙ্কা আর আশার দোলাচলে দুলতে দুলতে সামী হিয়াকে আগলে ধরে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে ক্যাম্পাসের গেটের দিকে। একটা ছেলে এসে হিয়ার ফাইলটা দিতেই সামী দ্রুত গাড়ি ছাড়ে, ড্রাইভ করা অবস্থায় সামী বারবার হিয়ার দিকে তাকায়, কপালের ঘাম মুছে দেয়। হিয়া তখন চোখ আধা বন্ধ করে পাশের সিটে বসা কিন্তু অনুভব করতে পারে সামীর ব্যাকুলতা।
হসপিটালে গাড়ি পৌঁছানোর সাথে সাথে সামী হিয়াকে কোলে নিয়ে হাঁটা ধরল। হসপিটালের ওয়ার্ডবয় থেকে শুরু করে ডাক্তার যেই সামী কে কোলে করে এক কলেজ ড্রেস পরিহিত মেয়েকে নিয়ে হসপিটালে ঢুকতে দেখলো সবাই বেশ অবাকই হলো, এতো মানুষের সামনে সামীর কোলে চড়তে হিয়ার ভিষণ লজ্জা লাগছে। তারউপর আসে পাশের সবাই তাদের দিকে যেভাবে চেয়ে আছে। সকলের চাহনি দেখে হিয়া আরো বেশি লজ্জা পেয়ে গেল। করুন মূখে বলল,
– সবাই দেখছে প্লিজ নামিয়ে দিন,আমি হেটে যেতে পারবো।
সামী হিয়াকে কোলে নিয়েই এক রাম ধমকে দিল,
– আর একটা কথা বললে বিশ্বাস কর আমি যে কি করবো নিজেও যানি না, মানুষ মনে হয় না আমায় না?
আর কতো টেনশনে রাখবি আমায়?
সামী হিয়াকে নিয়ে সোজা ইমারজেন্সি তে নিয়ে আঞ্জুমানের দেওয়া টেস্ট গুলো জরুরি ভিত্তিতে করায়, ততক্ষণে সারা হসপিটালে গুঞ্জন ছড়িয়ে যায় মালিক পক্ষ হসপিটালের ম্যানেজমেন্ট,পরিচালনার প্রধান স্বয়ং সামীহ শিকদার এক মেয়েকে কোলে করে নিয়ে এসেছে তাও এক কলেজ পড়ুয়া মেয়ে যথারীতি এসব গুঞ্জন এক সময় জসীম আর মীর সাহেবের কানেও পৌঁছায় ওনারা হাসপাতালেই ছিলেন , কলেজ পড়ুয়া মেয়ের কথা শুনে মীর সাহেব দ্রুত এসে হাজীর হন সামীর কেবিনে সাথে তার জসীম শিকদার ও। সামী তখন সবে মাত্র হিয়াকে নিয়ে কেবিনে এনে বসিয়েছে, হিয়ার চোখ আধা বন্ধ, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। সামী ওকে গ্লাসে পানি খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, মেয়ে কেএমন অবস্থায় দেখে মীর সাহেব দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে হিয়াকে ধরে ওনি অস্থির হয়ে পড়লেন কি হয়েছে জানার জন্য, সামী সবটা খুলে বলল , তখনই এক ওয়ার্ডবয় এসে টেস্টের রিপোর্ট গুলো দিয়ে যায় । মীর সাহেব উঠে এসে মনোযোগ দিয়ে সেই রিপোর্ট গুলো দেখে যাচ্ছে। কিছু সময় পড়ে তাঁর মুখটা আশ্চর্যভাবে বদলে যায় চিন্তিত মুখ একবার শিথিল হয়, আবার কপালে গভীর ভাঁজ পড়ে। গম্ভীর মুখে একবার সামীর দিকে তো একবার হিয়ার দিকে তাকায় যে এখন সামীর চেয়ারে মাথা ফেলে চোখ বন্ধ করে বসে, মীর সাহেবের গম্ভীর মুখ দেখে জসীম শিকদার একটু টেনসড হয়েই জিজ্ঞেস করলো,,
– কি হয়েছে তাসাউফ ? সিরিয়াস কিছু? তোর মুখ চোখ অমন দেখাচ্ছে কেনো? হিয়া ঠিক আছে তো?
– ঠিক কি তোর ছেলে থাকতে দিয়েছে নাকি?
– মানে কি?
– মানে কি তাই না এই দেখ,,
বলেই তাসাউফ মীর জসীম শিকদারের হাতে রিপোর্ট টা তুলে দিলেন। যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে হিয়ার প্রেগনেসি রেজাল্ট পজিটিভ এসেছে,জসীম শিকদার স্তব্ধ। এক ঝটকায় যেন চোখ বড় হয়ে যায় তাঁর। তাদের এমন মুখ দেখে সামী এইবার ভীষন ভয় পেয়ে যায়,এসি রুমেও সামীর কপাল বেয়ে কয়েক ফোটা ঘাম গড়িয়ে পড়ে। শুষ্ক হয়ে ওঠা ঠোঁট দুটো জিভে ভিজায় সে। বুক অনবরত কাঁপছে।সামী কাপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে আব্বু? তোমরা কিছু বলছো না কেন? এনিথিং সিরিয়াস?
– সিরিয়াস তো অবশ্যই বাবা, খুব বিরাট বড় একটা সমস্যা হয়ে গেছে!
সামী এবার রেগে গেল। হনহনিয়ে বাবার সামনে গিয়ে রিপোর্টটা তাঁর হাত থেকে এক টানে ছিনিয়ে নিয়ে গর্জে উঠল,
– বলতে হবে না তোমাদের আমি অন্য কোনো ডাক্তার দেখিয়ে নেবো,
ছেলের রেগে যাওয়া দেখে হেসে জসীম শিকদার ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলে,,
– বাপ হতে যাচ্ছিস, এবার অন্তত রাগ ধাগ কমা,
সামী এক মুহুর্ত থমকে যায়, বিশ্বাস হয় যেন বলে,,
– কি বললে? এবার বলো!
শিকদার সাহেব হেসে সামীর পিঠ চাপড়ে বললেন,,
– তুই বাপ আর আমি দাদা হতে চলেছি,,
মুহূর্তেই সামীর শরীরে শীতল স্রোত বয়ে যায়,শান্তির নিশ্বাস নেয় । বুকটা কেঁপে ওঠে, অজানা এক সুখে চোখের কোণ ভিজে আসে তাঁর ,চারপাশের সবকিছু থেমে গেছে যেন। তার ঠোঁটে ফুটে ওঠে এক অবিশ্বাস্য বিস্ময়ের হাসি। ধীরে ধীরে সে ঘুরে হিয়ার দিকে তাকায়, যিনি তখনো চোখ বন্ধ করে চুপচাপ বসে আছে।
#চলবে,,,