প্রতাপ গড়ের অভিশাপ পর্ব-১০

0
1

#প্রতাপ_গড়ের_অভিশাপ
#লেখায়_জান্নাতুন_নাঈম
#পর্ব_১০

রাত ক্রমেই ভয়ংকর হয়ে উঠছিল। বাইরে নর্তকীর উপস্থিতি পুরো পরিবেশকে অশুভ করে তুলেছিল। তাঁবুর ভেতরে সবাই নিস্তব্ধ হয়ে বসে ছিল।
রুদ্র বলল, “তাহলে এখানে থাকা আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। সকালের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই।”

হৈমু উদ্বিগ্নভাবে বলল, “এটা মনে হয় ভুতুড়ে দ্বীপ।আমরা এখান থেকে বেরোতে পারব তো?”

আরাফ শান্ত গলায় বলল, “হতেও পারে আবার নাও হতে পারে।আমরা তো এখন ও জানি না এই দ্বীপে আসলেই কোন মানুষ থাকে কিনা। মেয়েটি জ্বীন ও হতে পারে। সবকিছু কাল সকালে দেখব। এখন চুপচাপ ঘুমাও। বাইরে চাকর পাহাড়ায় আছে”

রুদ্র বলল, “মেয়েটা ডাইনী কিংবা পিশাচ”

আরাফ বলল, “আমি বাইরে পাহারা দিচ্ছি, বাকিরা কিছুক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করো।”

বীর প্রতাপ বলল, “তুমি অসুস্থ।এই সবের দরকার নাই। তোমার এইসবের অভ্যাস নেই। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো। দুইজন চাকর পাহাড়ায় আছে”

আরাফ বলল, “আমি পারবো আপনি চিন্তা করবেন না”

বীর প্রতাপ আরাফের কথা মেনে নিল।বাইরে শেয়ালের ডাক থেমে গেলেও, বাতাসের সাথে মাঝে মাঝে সেই ভয়ংকর নুপুরের শব্দ ভেসে আসছিল।রাত গভীর হতে থাকল।

হৈমু বলল, “আমার মনে হয় না এই নর্তকী কোন ক্ষতি করবে।সে নিজের ইচ্ছামতো নৃত্য করছে।আমরা আমাদের মতো ঘুমালেই হয়।”

আরাফ বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত নিল।সে তাঁবুর বাইরে গিয়ে দাড়াল। বাইরে চাকর দুইজন ঘুমিয়ে আছে। আরাফ সতর্ক চোখে চারপাশে নজর রাখছিল। কিছুক্ষণ পর, বাইরে অন্ধকারের মাঝে অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেল। “এটা কি?” সে চিন্তিত হয়ে বলল।

আরাফ আশেপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখলো একটা জংলি ছাগল ঘাস খাচ্ছে।আরাফ হাফ ছেড়ে বাঁচলো।

পরদিন সকালে।সবাই ঘুম থেকে উঠে দেখে আরাফ তাঁবুর বাইরে ঘুমোচ্ছে।বীর প্রতাপ আরাফ কে ডাক দিল।আরাফ ঘুম থেকে উঠে বসে পড়লো।হৈমু আরাফ কে উদ্দেশ্য করে বলল, “কি ছিল?”

আরাফ বলল, “আমি কিছুই দেখিনি।বোকাটা কি দেখে ভয় পেয়েছে কে জানে?”

রুদ্র বলল, “আমি নিজের চোখে দেখেছি”

বীর প্রতাপ বলল, “হয়তো তোমার মনের ভুল।আমরা একটু পড়ে পাহাড়ের উপর যাব ।এত সুন্দর একটা দ্বীপে আসছি।একটু ঘুরে দেখা দরকার।কাল সকালে আমরা আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা দেব”

সবাই তাঁবুর থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের উদ্দেশ্য রওনা দিল।চাকররা তাবু পাহাড়ায় রয়ে গেল।

হৈমু হাটতে হাঁটতে বলল, “আমাদের পানি লাগবে। পাহাড়ের উপর কি পানি পাওয়া যাবে?”

আরাফ বলল, “মনে হয় না।পানি নিচু জায়গায় পাওয়া যায়।’

সবাই সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াল।পাহাড়ের পাশেই পাকা সিড়ি রয়েছে। অনেক দিন ব্যবহার না হওয়ায় ভাঙা ও স্যতসেতে হয়ে আছে।সিড়ির মুখে একটা কাক মরে পড়ে আছে। তার থেকে গন্ধ ছড়াচ্ছে।

সবাই নাকে মুখে কাপড় দিয়ে কোন রকম সিড়ি বেয়ে পাহাড়ের উপর উঠে। পাহাড়ের উপর পুরনো প্রাসাদ।প্রাসাদের সদর দরজা ভেঙে পড়ে আছে। প্রাসাদের সদর দরজায় বড় বড় করে লেখা লস্ট টেম্পল। প্রাসাদের দেয়াল ভেঙে একটা বিশাল সাইজের বটগাছ আকাশের দিকে তাকিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।তার মধ্যে আবার নাম না জানা হরেক রকম পাখির বাসা।পাখি গুলো তাদের দেখে কেমন যেন চারদিকে উড়াউড়ি শুরু করে দেয়।

বীর প্রতাপ বলল, “এখানে কি লেখা আছে?”

হৈমু বলল, “আপনি ইংরেজি পারেন না?”

বীর প্রতাপ আমতা আমতা করে বলল, “আমি বেশিদূর পড়িনি। ইংরেজি জানা নেই আমার”

হৈমু বলল, “এখানে লেখা আছে লস্ট টেম্পল”

বীর প্রতাপ মনে মনে বীর বীর করে বলল, “লস্ট টেম্পল মানে কি?”

হৈমু বলল, “লস্ট মানে হারানো আর টেম্পল মানে মন্দির।আমার ধারণা অনুযায়ী লস্ট টেম্পল বলতে এমন একটি মন্দির বোঝানো হয়েছে যার অস্তিত্ব কোন এক সময় ছিল কিন্তু বর্তমানে সেটা হারিয়ে গেছে কিংবা বিলুপ্ত হয়েছে।এটা হয়তো অনেক পুরনো একটা মন্দির এবং বর্তমানে এর অবস্থান বা অস্তিত্ব সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা নেই। এইরকম লস্ট টেম্পল বেশিরভাগ পুরান বইয়ে উল্লেখ থাকে। লস্ট টেম্পল হলো এমন একটি স্থাপত্য যা সময়ের সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

আরাফ বলল, “সবই বুঝলাম কিন্তু মানুষ কি করে জানতো এটা একদিন মানুষের আড়ালে চলে আসবে। মানুষ এর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানবে না”

হৈমু বলল, “এতশত আমি জানি না। আমি যা জানি তাই বলেছি”

বীর প্রতাপ বলল, “এটা কি কোন মন্দির”

হৈমু বলল, “হতে পারে কোন মন্দির কিংবা কোন রাজার প্রাসাদ।সময়ের সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে গেছে। এখানে হয়তো কোন এক সময়ে মানুষ বসবাস করতো।তখন এই প্রাসাদটি নির্মাণ করা হয়েছে।”

আরাফ বলল, “গেটের সামনে কিছু লেখা আছে।ওই লেখা গুলো পড়ে বলো ওখানে কি লেখা আছে”

হৈমু বলল, “কোন জায়গায়?”

আরাফ তাকে ইশারা দেখাল।হৈমু দেয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।লেখা গুলো অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে।হৈমু অনেক কষ্টে পড়ার চেষ্টা করলো।হৈমু বলল, “এটা একটা জেলখানা”

আরাফ বলল, “এখানে কে জেলখানা তৈরি করবে?”

হৈমু বলল, “এটা একটা নির্জন দ্বীপ। এখানে কোন মানুষ থাকে না।কোন এক সময়ে হেরে যাওয়া রাজাদের এখানে নির্বাসনে পাঠানো হতো।এই টেম্পল অনেক বড়।একটা নির্জন দ্বীপে একা একটা মানুষ বেশিদিন বাঁচতে পারে না।কেউ চাইলেও এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারে না।এই জেল বানায় আলফ্রেড মার্শাল। এখানে প্রথম আসামি হিসেবে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছিল রিচার্ড ব্লাক নামের এক রাজাকে।তার জন্যই এক টেম্পল তৈরি করা হয়। এখানে এরপর অনেকেই এসেছিল।”

রুদ্র বলল, “ভাবলাম কি আর হলো কি?”

হৈমু বলল, “এইজন্যই হয়তো এটা লোকচক্ষুর আড়ালে।একটা নির্জন দ্বীপে একটা জেলখানা। মানুষ এর সম্পর্কে জানে না”

বীর প্রতাপ বলল, “প্রতাপগড়ে গেলে তোমাকে লেখাপড়া করাব। তুমি খুব বুদ্ধিমতি।চলো ভেতরে যাই”

সবাই টেম্পলের ভেতরে প্রবেশ করলো। টেম্পলের প্রবেশের সিঁড়ি মাটির নিচের দিকে চলে গেছে। দীর্ঘ তিন ঘণ্টা যাবত সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এখন আবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হবে।

সিঁড়ি গুলো বেশ মজবুত। এতগুলো বছর এখানে পড়ে থাকার পড়েও নষ্ট হয়নি।সিঁড়ি শেষ হলো একটা বিশাল হলঘরে। হলঘরের ডান দিকে একটা বিশাল বাগান দেখা যায়।বেশ‌ অগোছালো আর নির্জীব।কেমন যেন অবহেলায় আগাছা জন্মে আছে। গাছগুলো নির্জীব হয়ে আছে। বাগানের মাঝখানে একটা মেয়ের ভাস্কর্য।একটা হাত ভেঙে পড়েছে।তাতে নাম না জানা এক লতা বেড়ে উঠেছে।পুরো লতা জুড়ে সুন্দর বেগুনী রঙের এক ধরনের ফুল ফুটে আছে।

বীর প্রতাপ অবাক হয়ে বলল, “এটা আমার প্রাসাদের থেকে ও অনেক বেশি সুন্দর।আমরা আজ রাতে এখানে ঘুমাব।”

রুদ্র বলল, “চলো পুরো প্রাসাদ টা ঘুরে দেখি”

সবাই প্রাসাদের ভেতর ঘুরে দেখতে লাগলো। অন্যদিকে হৈমু বাগানে একটা দোলনায় বসে দোল খেতে লাগল। হঠাৎ তার নজরে গেল দুরেই একটা ফল গাছের দিকে।গাছের অনেক সুন্দর ফল ধরে আছে।হৈমু কিছু না ভেবেই কতগুলো ফল পেড়ে খেতে শুরু করলো।ফল গুলো হৈমুর বেশ পছন্দ হয়।
প্রাসাদ টা খুব বেশি বড় ছিল না। ঘন্টা খানেক ঘুরতেই পুরো প্রাসাদটাই ঘুরে দেখা হয়ে গেল।বীর প্রতাপ, রুদ্র ও আরাফ ফিরে এসে দেখলো হৈমু ফল খাচ্ছে আর দোলনায় দুলছে।

বীর প্রতাপ বলল, “এখানে জিনিস পত্র গুলো খুব সুন্দর।ভেতরে দামী বিছানা আছে।রাতে সুন্দর সময় কাটবে এই নির্জন দ্বীপের রাজপ্রাসাদে।”

হৈমু বলল, “আমার কাছে এর থেকে ভালো খবর আছে”

আরাফ বলল, “কি?”

হৈমু বলল, “বলুন তো এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি কোন জিনিস দরকার?”

বীর প্রতাপ বলল, “খাবার?”

হৈমু বলল, “আমাকেই বলতেই হচ্ছে আপনার বুদ্ধি হাঁটুর নিচে”

বীর প্রতাপ বলল, “তাহলে তুমিই বলো এই মুহূর্তে আমাদের কি দরকার?”

হৈমু বলল, “জাহাজ”

আরাফ বলল, “আর আমরা সেটা কোথায় পাবো?”

হৈমু বলল, “এটাই তো সুখবর। বাগানের ওপাশে লেকের ওইদিকে একটা ছোট জাহাজ আছে। আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবো।”

বীর প্রতাপ বলল, “বাহ। তাহলে আমরা সরাসরি ক্লিফটন দ্বীপে চলে যাব। আমাদের নিজেদের জাহাজ আছে।অন্য জায়গায় যেতে হবে না”

হৈমু বলল, “এটা অনেক পুরনো।এটা না ও চলতে পারে”

বীর প্রতাপ বলল, “তাহলে সেটা হবে আমাদের জন্য খুবই খারাপ।”

হৈমু বলল, “এবার ফল খাও। অনেক মজা”

আরাফ বলল, “তুমি হুট করে একটা ফল দেখলে আর খেয়ে ফেললে?যদি বিষাক্ত হতো”

হৈমু বলল, “আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম তাই খেয়ে নিয়েছি। বিষাক্ত হলে কিইবা হতো । আমি মরে যেতাম। এছাড়া আর কিছুই হবে না”

বীর প্রতাপ বলল, “হয়েছে। সামনে থেকে এইরকম আর করবে না।হতে পারে তোমার মধ্যে কেউ আছে।তার কথাও তোমাকে ভাবতে হবে”

সন্ধ্যা হতেই অন্ধকার নেমে এলো।সবাই একটা রুমে থাকার সিদ্ধান্ত নিল। একটা রুমে দুইটা বিছানা আনা হলো। একটায় রুদ্র আর আরাফ অন্য বিছানায় হৈমু আর বীর প্রতাপ।সবাই ফল আর পানি খেয়ে শুয়ে পড়লো।রুমের চারপাশে মশাল জ্বালিয়ে দেয়া হলো। ফায়ার প্লেসের মধ্যে আগুন জ্বলছে।
লস্ট টেম্পলে রাতটা সুন্দর ভাবেই কাটলো।
পরদিন সকালে রুদ্র আর আরাফ গিয়ে চাকরদের লস্ট টেম্পলে নিয়ে আসা হলো। এরপর সবাই জাহাজের দিকে রওনা দিলো। জাহাজ পুরনো হলেও একদম ভালো ছিল।হৈমু লেক থেকে কিছু মিঠা পানি সংগ্রহ করে নিল। দ্বীপ থেকে বিভিন্ন ফল আর ডাব সংগ্রহ করে জাহাজ সমুদ্রের উদ্দেশ্য রওনা দিল। দুইদিন বিশ্রাম নেয়ায় সবার মধ্যেই একটু ভালা লাগা কাজ করছে। শরীর টা সুস্থ অনুভব হচ্ছে।সকল অলসতা দূর হয়ে গেছে।হৈমু লস্ট টেম্পল থেকে আসার সময় শাড়ির আঁচলে করে অনেক গুলো স্বর্ণ আর হিরা খুঁজে পায়। সেইগুলো নিয়ে আসে”

বীর প্রতাপ বলল, “তুমি চুরি করেছ?”

হৈমু বলল, “চুরি বলছেন কেন? এইগুলো গুপ্তধন। গুপ্তধন যে খুঁজে পায় তার হয়। আমাদের বাড়ি ফিরতে গেলে অনেক টাকা লাগবে। এইগুলো বিক্রি করে টাকা পাব”

বীর প্রতাপ বলল, “তুমি যা ভালো মনে করো”

আরাফ বলল, “আমি কিন্তু কিছু জিনিস আসার সময় এনেছি”

বীর প্রতাপ বলল, “আমার সাথেই দেখা বলল সব চোরের”

হৈমু বলল, “চোপ।বেশি কথা বললে কিন্তু খবর আছে”

বীর প্রতাপ আর কথা বাড়াল না।

সাত দিন চলে গেল। সাতদিন পর ক্লিফটন দ্বীপের দেখা মিলল।দুর থেকে দ্বীপের মধ্যে অদ্ভুত সব গাছপালা দেখা গেল।বীর প্রতাপ বলল, “অবশেষে আমরা আমাদের গন্তব্যের কাছে চলে এসেছি। এবার আমরা সফল হবোই”

(চলবে)