প্রতাপ গড়ের অভিশাপ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব

0
5

#প্রতাপ_গড়ের_অভিশাপ
#লেখায়_জান্নাতুন_নাঈম
#পর্ব_১১(শেষ পর্ব)

সবাই দ্বীপের মাটিতে পা রাখল। হৈমু আশেপাশের গাছপালা দেখে অবাক না হয়ে পারল না। সবগুলো গাছ খুব ছোট। দ্বীপের সব গাছ তিন-চার ফুটের মধ্যে। হৈমু হঠাৎ খেয়াল করল, দূরেই একটা গাছে কতগুলো ফুল দেখা যাচ্ছে। ফুলগুলো দেখে মনে হচ্ছে বাদুড় লটকে আছে।

আরাফ বলল, “আমরা তো দ্বীপে পৌঁছে গেলাম। তাহলে সেই দ্বীপ কোথায়?”

বীর প্রতাপ বলল, “মানচিত্র অনুযায়ী গেলে এখান থেকে তিন মাইল দূরে।”

রুদ্র বলল, “তিন মাইল হাঁটতে হবে?”

বীর প্রতাপ বলল, “না, তোমাকে কোলে করে নিয়ে যাব।”

আরাফ বলল, “চলো রওনা দিই। রাত হতে বেশি দেরি নেই।”

হৈমু বলল, “এখানে মনে হয় না কোনো জীবজন্তুর বসবাস আছে।”

আরাফ বলল, “সব আছে, তোমার নজরে আসছে না।”

হৈমু বলল, “মানে?”

আরাফ বলল, “ওই যে দূরে বাদুড়ের মতো ফুল দেখেছ?”

হৈমু বলল, “দেখেছি।”

আরাফ বলল, “ওগুলো ফুল না, ওগুলো পাখি।”

কথাটা বলেই আরাফ একটা পাথরের টুকরো ছুড়ে মারল গাছের দিকে। সাথে সাথে পাখিগুলো উড়ে গেল।
হৈমু বলল, “এত ছোট পাখি?”

বীর প্রতাপ বলল, “শুনেছি এখানে সবকিছুই খুব ছোট ছোট। বাঘ, সিংহ, ভাল্লুক—সবই বিড়ালের মতো ছোট। এখানে খাবারের খুব অভাব। তাই হয়তো সময়ের সাথে সাথে কম খেয়ে এদের এইরকম অবস্থা হয়েছে। এখানে অনেক অদ্ভুত গাছপালা, পাখি আর পশু দেখবে, যা আগে কখনো দেখোনি। তবে হৈমু, হুট করে কিছু খেয়ে ফেলো না।”

হৈমু বলল, “দেখা যাক, ক্ষুধা না লাগলে কিছুই খাব না।”

সবাই দ্বীপের পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে শুরু করল। রাস্তা খুব খারাপ। মানুষের চলাফেরা করার উপযুক্ত না। চারদিকে ছোটোখাটো ঝোপঝাড়ের কারণে হাঁটা মুশকিল হচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা গুহার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গুহার ভেতরে ছিল একটা বই। আরাফ আর রুদ্র কিছু মশাল বানিয়ে নিল। হাঁটতে হাঁটতে গুহার শেষ মাথায় একটা দরজা দেখা গেল। দরজায় অদ্ভুত ভাষায় বিভিন্ন লেখা ছিল। বীর প্রতাপ তার কাছ থেকে একটা অদ্ভুত জিনিস দেয়ালের বিশেষ জায়গায় বসাতেই দরজা খুলে গেল। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই তারা একটা বড় হলঘর দেখতে পেল। হলঘরের ঠিক মাঝখানে একটা বিশাল কাঠের সিন্দুক রাখা ছিল।

বীর প্রতাপ বলল, “এখানে অনেক ধনসম্পদ থাকবে। কেউ কোনো কিছুতে হাত দেবে না। এই ধরনের সম্পদের কারণে আমাদের পরিবার অভিশপ্ত হয়েছে। যারা নিয়েছে, তারাও অভিশপ্ত হয়েছে। এখানে কেউ লোভ করবে না। আমরা শুধু বইটাই নিয়ে যাব।”

আরাফ বলল, “তুমি বই নিয়ে আসো, আমরা এখানেই থাকি।”

বীর প্রতাপ সিন্দুকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, “আমাদের পূর্বপুরুষরা একটা ভুল করেছিল। আমি ভেবেছিলাম সবকিছু ফিরিয়ে দেব, তবে জলদস্যুরা তা নিয়ে নিয়েছে। জলদস্যুরা যদি এই সম্পদ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করে, তাহলে তারাও হয়তো অভিশাপের অংশীদার হবে।”

বীর প্রতাপ সিন্দুক খুলে দেখল। সিন্দুকের ভেতরে অনেক স্বর্ণালংকার, হিরা-মনি, মুক্তা ছিল। তবে বীর প্রতাপ শুধু বইটা নিয়েই সিন্দুক বন্ধ করে দিল। তারপর বলল, “আমাদের এখন ঔষধ খুঁজতে যেতে হবে। চলো, রওনা দিই।”

আরাফ বলল, “ঔষধ খুঁজতে কতগুলো দিন চলে যাবে কে জানে!”

বীর প্রতাপ হেসে বলল, “ঔষধ এই দ্বীপেই আছে। এখানকার অদ্ভুত সব গাছপালা একেকটা ঔষধি গাছ। এই বইয়ে সব ঔষধের কথা লেখা আছে। আজ রাতে গুহায় থাকব। কাল সকালে সব ঔষধ খুঁজে বের করব। বইয়ে গাছের ছবি আঁকা আছে। সবাইকে কাল অনেক কাজ করতে হবে।”

বীর প্রতাপের কথাগুলো শুনে আরাফ বলল, “
আমি এখানে আসার পর ভাবছিলাম যে দ্বীপ টা কি অদ্ভুত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এইরকম একটা দ্বীপ আমাদের বাড়ির পাশে থাকা দরকার।সব ঔষধি গাছ এখানে আছে। অনেক উপকারি একটা দ্বীপ। আমাদের বাড়ি থেকে আসতে মাসের পর মাস চলে গেল।এই দ্বীপ আমাদের বাড়ির কাছে হলে কোন রোগ হতো না”

বীর প্রতাপ বলল, “সব রোগী শুধু তোমার কাছেই আসতো”

ধীরে ধীরে রাত হয়ে এলো।পুরো গুহা নীল আলোয় ভরে গেল।সবাই ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখলো এক প্রকার পিচ্ছিল পোকা থেকে এই আলো আসছে।বীর প্রতাপ তার পানির পাত্রে কিছু পোকা নিয়ে নিল।বলল, “এই পোকা অনেক কাজে আসে। এইগুলো পোড়া জায়গায় রাখলে কিছু সময় পর দেখবে পোড়া গুলো আর নেই। তাছাড়া কাটাছেঁড়া কিংবা বিভিন্ন ফোঁড়া হলে এই পোকা সেই জায়গায় রাখলে ভালো হয়ে যায়। পোকাগুলোর শরীরের এই পিচ্ছিল পদার্থ গুলো লাগালেও ভালো হয়ে যায়।

আরাফ বলল, “আমাদের বর্তমান মহামারী টাও ফোঁড়ার মতোই হয়”

বীর প্রতাপ বলল, “হ্যা। তবে এরজন্য আলাদা ঔষধ আছে।আমরা পোকাগুলোর ক্ষতি হয় এমন কাজ করবো না।”

হৈমু বলল, “আমার ক্ষুধা লেগেছে”

বীর প্রতাপ বলল, “পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। পানি খেলে ক্ষুধা লাগে না”

হৈমু বলল, “ক্ষুধা লাগলে ঘুম আসে না”

হৈমুর কথায় কেউ গুরুত্ব দিল না।হৈমু বুঝলো তাদের বলে কোন লাভ নেই।তাই সবাই ঘুমিয়ে পড়তেই গুহার বাইরে বেরিয়ে এসে একটা গাছ থেকে অজানা ফল খেতে লাগল।একটু টক টক লাগলেও খেতে ভালোই লাগছে। তবে বেশি খেতে পারলো না।অন্য একটা গাছের কাছে চলে গেল। অনেক গুলো ফল খেয়ে আবার গুহায় পৌঁছে গেল।হৈমু গুহায় গিয়ে দেখে তাদের থেকে কিছু দূরে একটা সিংহ ঘুমিয়ে আছে।সিংটা বিড়ালের মতোই খুব ছোট।হৈমু সিংহ নিয়ে বেশি ভাবতে পারলো না।তার খুব ঘুম পাচ্ছে।সে তার স্বামীর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে বীর প্রতাপ ঘুম থেকে উঠে দেখলো তার পাশে হৈমু নেই।বীর প্রতাপ বেশ ভয় পেয়ে যায়।বীর প্রতাপ হৈমুকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে।হৈমু গুহার বাইরে বসে ফল খাচ্ছে।বীর প্রতাপ হৈমুকে দেখে বেশ রেগে গেল। বলল, “আমি কতবার নিষেধ করলাম। তুমি আমার কথা শুনলে না”

হৈমু বলল,”কাল সারাদিন না খেয়ে আছি। আমার কি ক্ষুধা লাগে না”

বীর প্রতাপ বলল, “এমনিতে তো ঝগড়া করলে দুই তিন দিন না খেয়ে থাকতে পারো।”

হৈমু বলল, “ফলে কোন বিষ নাই।থাকলে তো আমি কত আগেই মরে যেতাম। আপনি ও খান অনেক মজা”

বীর প্রতাপ বুঝতে পারলো না হৈমুর কথায় কি উত্তর দিবে।

সবাই সারাদিন ঔষধ খুঁজতে খুঁজতে কাটিয়ে দিল। ঔষধ খুঁজে ঔষধ গুলো জাহাজে রেখে দিল। আগামীকাল আরো কিছু ঔষধ খুঁজে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিবে।

বীর প্রতাপ বলল, “ আমরা যদি আজ রাতে এখানে গুহায় বিশ্রাম নেই। তাহলে কাল সকালে আমরা আরো কিছু ঔষধি গাছ খুঁজে বের করে নিতে পারবো।”

রাতে তারা গুহার মাঝখানে একটি জায়গা বেছে তাতে ঘুমিয়ে পড়লো। রাতের শান্তিতে, তারা একটি নতুন দিনের অপেক্ষা করতে লাগল, যখন তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য প্রস্তুত হবে।

পরদিন সকালে আরো ঔষধি গাছ খুঁজে বের করলো। দুপুরের পর সবাই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। জাহাজ চলতে শুরু করল।হৈমু বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বীর প্রতাপের বুঝতে বাকি রইলো না তাদের পরিবারে নতুন সদস্য আসতে চলছে।বীর প্রতাপ চায় ভালো ভাবে বাড়ি পৌঁছে যেতে।

দেখতে দেখতে অনেক গুলো দিন চলে গেল।হৈমুর অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগল।পালকি মরুভূমির মধ্য দিয়ে চলছে।হৈমু পালকিতে বসে আছে।হৈমু বীর প্রতাপে কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকে।বীর প্রতাপ পালকি একটা গ্রামে গিয়ে দাড় করায়।গ্রামের একজন মহিলা ধাত্রীর কাছে হৈমুকে দেখাতে নিয়ে যায়।হৈমুকে দেখেই ধাত্রী বলল হৈমুর সন্তান জন্ম দিতে বেশি দেরি নেই।খুব তাড়াতাড়ি সন্তান জন্ম দিতে যাচ্ছে।

বীর প্রতাপ বলল, “কতদিন লাগবে?”

ধাত্রী বলল, “আজ কিংবা কাল।হৈমুর খুব শীঘ্রই প্রসব বেদনা শুরু হতে যাচ্ছে।প্রসব বেদনা অনেকটাই লক্ষ্য করা যাচ্ছে”

বীর প্রতাপ বলল, “তাহলে তো আমাদের এখানেই অবস্থান নিতে হবে।”

ধাত্রী বলল, “আপনারা পাশের ঘরে অপেক্ষা করুন”

বীর প্রতাপ আরাফ ও রুদ্র কে নিয়ে পাশের ঘরে অপেক্ষা করতে লাগল।বীর প্রতাপের চোখে মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখা দিচ্ছে। সারাদিন এভাবেই চলে গেল।রাতে হৈমু পুত্র সন্তানের জন্ম দিল।বীর প্রতাপ তার সন্তান কে কোলে নিয়ে হৈমুর পাশে গিয়ে বসল।হৈমুর শরীরের অবস্থা খারাপ থাকার কারণে গ্রামে দুই তিন দিন অবস্থান নিতে হলো। তৃতীয় দিন তারা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

পালকি প্রতাপগড়ে প্রবেশ করতেই বীর প্রতাপ দেখলো রাস্তা ঘাটে কোন মানুষ নেই। অনেক মানুষ মহামারীতে মারা গেছে। কিছু লাশ রাস্তায় পড়ে আছে।বীর প্রতাপের অনেক দিন পর নিজেদের পরিবারের কথা ভেবে চিন্তা হতে লাগলো। পালকি প্রাসাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ঘোড়ার গাড়ির আওয়াজ শুনে বীর প্রতাপের মা ও দুই স্ত্রী প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে এলো।হৈমু তার পুত্র সন্তান নিয়ে পালকি থেকে নামলো।বীর প্রতাপ দেখলো এক বছরের মধ্যে তার প্রাসাদের চিত্র গুলো বদলে গেছে।তার পরিবারের লোকজনকে চেনাই যাচ্ছেনা। শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে।বীর প্রতাপের মা তার ছেলেকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো।প্রতাপ গড়ে বহু বছর পর পুত্র সন্তানের জন্ম হয়েছে। এবার হয়তো প্রতাপ গড়ের অভিশাপ শেষ হয়ে গেছে।

একমাস পর। প্রতাপ গড়ের সব মহামারী ভালো হয়ে গেছে।আরাফ ও রুদ্র দুইজনে দ্বীপ থেকে আনা উপকরণ দিয়ে ঔষধ বানিয়েছে। প্রতাপ গড়ের বাইরে যেসকল এলাকায় এখন ও মহামারী ভালো হয়নি তারাও প্রতাপ গড়ে আসছে ঔষধ নেয়ার জন্য। অল্প সময়ের মধ্যে প্রতাপ গড় আবার আগের রুপ ফিরে পায়।

(সমাপ্ত)