প্রতাপ গড়ের অভিশাপ পর্ব-০৪

0
5

#প্রতাপ_গড়ের_অভিশাপ
#লেখায়_জান্নাতুন_নাঈম
#পর্ব_৪

হৈমু বলল, “লোভ কখনো ভালো কিছু বয়ে আনে না। লোভ মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।”

বীর প্রতাপ বলল, “আমার বাবার কখনো লোভ ছিল না, কিন্তু আমার দাদার ছিল। আমার দাদাই বাবাকে জোর করে নিয়ে যান।”

হৈমু বলল, “আচ্ছা, এরপর কী হয়েছিল?”

বীর প্রতাপ বলল, “আমার দাদা যখন জানতে পারলেন যে একটা কবরে অনেক গুপ্তধন আছে, তখন তার লোভ জন্মায় সেই সম্পদের প্রতি। আমার বাবা তাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে এগুলো অন্য কারোর সম্পত্তি, এবং অন্যের জিনিসে নজর দেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু দাদা তাকে বোঝাতে শুরু করেন যে হাজার বছর ধরে মরা মানুষের সম্পদের আর কী প্রয়োজন! এতগুলো বছরে ওরা সব পচে মাটির সাথে মিশে গেছে। আমার বাবা তবুও বোঝানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু দাদা শোনেননি। তিনি সেই সম্পদ নিজের করে নিতে চাইলেন। একশো জন সঙ্গী নিয়ে কবরে গেলেও, ফিরে এসেছিলেন মাত্র নয়জন। কবরে কী ঘটেছিল তা বিশদভাবে বলার মতো দীর্ঘ ইতিহাস, তবে এটুকু বলতে পারি—দাদা কবর থেকে শুধু সম্পদ আনেননি, সঙ্গে এনেছিলেন অভিশাপ আর মহামারীও। এরপর থেকে আমাদের বংশে কোনো সন্তান জন্মায়নি। শুধু আমাদের বংশে না, এই প্রতাপগড়ে জন্ম নেওয়া কোনো মেয়েই মা হতে পারেনি। দাদা যখন ফিরে এসেছিলেন, তখন তার শরীরে সেই মহামারীর লক্ষণ ছিল। বলতে গেলে সেই নয়জনের সবাই মহামারীতে আক্রান্ত ছিল। তখন অনেক মানুষ এই মহামারীতে মারা যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এক ডাক্তার এই রোগের ওষুধ তৈরি করেন। অনেক কষ্টের পর মহামারী থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। মহামারীতে আক্রান্ত সকল মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়, কারণ তারা রাতের বেলায় জীবিত হয়ে উঠত। এই ঘটনার কিছুদিন পর সেই ডাক্তার মারা যান, তবে মৃত্যুর আগে তিনি এক বই আকারে এই রোগের ওষুধ লিপিবদ্ধ করে রেখে যান। শুনেছি, সেই ডাক্তার তার জীবদ্দশায় যত রোগের চিকিৎসা করেছেন, সব রোগের ওষুধ সেই বইয়ে আছে।”

হৈমু বলল, “সেই বই এখন কোথায়? ওই বই পেলে তো দ্রুত এই মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।”

বীর প্রতাপ বলল, “কয়েক বছর আগে কেউ সেই বই চুরি করে নিয়ে গেছে। এখন সেই বইটা এক রহস্যময় দ্বীপে রয়েছে। আমার হাতে এখন অনেক কাজ আছে—প্রথমত মহামারী চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার আগে এর প্রতিকার খুঁজে বের করা, এবং দ্রুত সেই বইও খুঁজে বের করতে হবে।”

হৈমু বলল, “আপনি কী করতে চান?”

বীর প্রতাপ বলল, “আমি সেই বইয়ের খোঁজে ওই দ্বীপে যাব। ক্লিফটন নামের এক দ্বীপে সেই বই রাখা আছে, কিন্তু সমস্যা হলো, এই দ্বীপ আমাদের থেকে অনেক দূরে। যাতায়াত করতে অনেক সময় লাগবে”

হৈমু বলল, “এটা অসম্ভব। আমাদের বিয়ে হয়েছে এক সপ্তাহও হয়নি। এমন নতুন পরিবেশে আপনি আমাকে একা ফেলে রেখে যেতে চাইছেন? তাও এমন এক যাত্রায় যেখানে এক বছরেরও বেশি সময় লাগবে! আমি আপনাকে একা যেতে দেব না। যদি যেতেই হয়, তবে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে।”

বীর প্রতাপ বলল, “বাচ্চাদের মতো কথা বলো না। এমন ভয়ংকর পরিবেশে তোমাকে সঙ্গে নিতে পারব না।”

হৈমু বলল, “বিপদ হলে আপনারও হবে। আমাকে না নিয়ে গেলে আপনাকে যেতেই দেব না। আমি না খেয়েই মরে যাব। এবার যদি আমাকে একা ফেলে যান, আমি পানিও খাব না।”

বীর প্রতাপ বলল ,”তুমি বড্ড ছেলেমানুষী করো হৈমু।এখনো ছোট বাচ্চার মতো আবদার করো”

হৈমু বলল, “আমাকে নিচ্ছেন তো ?”

বীর প্রতাপ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।হৈমু বলল, “আপনি বিশ্রাম নিন। আপনি অনেক ক্লান্ত”

বীর প্রতাপ শেষমেশ হৈমুর প্রস্তাবে রাজি হতে বাধ্য হলো। সে জানে, হৈমুর কথা না শুনলে সত্যিই খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে ঘরে বন্দি হয়ে থাকবে। হৈমুর জেদের কাছে বীর প্রতাপের হার মানতে হলো। তবে বীর প্রতাপ এই যাত্রায় বেশি কাউকে সঙ্গে নিল না, অল্প কয়েকজন মানুষ নিয়েই তিনি যাত্রা শুরু করতে চাইলো।

বীর প্রতাপ তার ভ্রমনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। এইদিকে নানা জায়গা থেকে অসুস্থতার খবর ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।প্রতাপ গড়ের মানুষের মধ্যে ও মহামারী ছড়িয়ে পড়ছে।কয়েক জায়গায় মানুষের লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।বীর প্রতাপ সবাইকে জানিয়ে দেয় সবাই যেন ঘরেই অবস্থান নেয়। প্রয়োজনের বাইরে কেউ যেন ঘর থেকে বাইরে বের না হয়।কেউ ঘর থেকে বাইরে গেলেও ঘরে ফেরার পর ভালো ভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নেয়া। যেসকল মানুষ মহামারীতে মারা গেছে তাদের লাশ পুড়িয়ে ফেলা ‌এতে অন্যদের মহামারীতে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা কমে।এই মহামারী ছোঁয়াচে হবার কারণে অসুস্থ ও অপরিচিত মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেয় বীর প্রতাপ।

আশেপাশের অবস্থা খুব খারাপ হতে লাগল।বীর প্রতাপ তার যাত্রা শুরু করলো। জমিদার বাড়ির সামনে একটা পালকি ও একটা ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।পালকিতে জমিদারের স্ত্রী হৈমু বসবে আর ঘোড়ার গাড়িতে জমিদার বীর প্রতাপ ও তার দুই সহকারী আরাফ ও রুদ্র।হৈমু পালকিতে গিয়ে বসলো।একে একে পালকি ও ঘোড়ার গাড়ি ছেড়ে দিল। জমিদার মাতা দরজায় দাঁড়িয়ে মুখে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে কান্না করতে লাগলো। এইরকম এক যাত্রায় অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়েছে।আজ একমাত্র ছেলে এই ভয়ংকর যাত্রায় রওনা দিয়েছে।বীর প্রতাপের দুই স্ত্রী কিছুই করলো না।কেবল দরজায় দাঁড়িয়ে থাকলো যতক্ষণ তাদের স্বামীর ঘোড়ার গাড়ি টা দেখা যায়।

গোধূলি পেরিয়ে রাজ্যের চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। চারপাশে ধূ-ধূ মরুভূমি। যেদিকে চোখ যায়, কেবল বালি আর বালি। মরুভূমির পাশ থেকে একদল কাফেলা এগিয়ে আসছে উটে চড়ে। ছয় সাত জন লোকের ছোট একটা কাফেলা।হৈমু পালকির পর্দা সরিয়ে তার স্বামীকে ডাক দিলো, “শুনছেন”
বীর প্রতাপ বলল, “কি গো গিন্নি।গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছ বুঝি।কেমন লাগছে এই যাত্রা”

হৈমু বলল, “এইরকম জায়গায় তো গরম পড়বেই।রাতের বেলা তারপরেও কি গরম। যেদিকে চোখ যায় কেবল বালি আর বালি। আপনি তো বললেন জাহাজে করে যাবেন। কিন্তু আপনি তো প্রথমে ঘোড়ার গাড়িতে এরপর এখন উঠে চড়ে বসলেন।”

বীর প্রতাপ বলল, “এক বছরের যাত্রা কি এমনি এমনি বলেছি গো গিন্নি।আরো কত গাড়ি পরিবর্তন করতে হবে দেখোই না। তুমি শুধু হিসেব করে রাখো। তোমার তো কষ্ট নেই পালকিতে বসে আছো।আমায় দেখো সারাদিন রোদের মধ্যে উটের পিঠে বসে আছি।”

হৈমু বলল, “আপনার কষ্ট হচ্ছে?একটু বিশ্রাম নিলে হয় না”

বীর প্রতাপ বলল, “রাতে ঘুমানোর জন্য বিশ্রাম নেয়া যাবে এইরকম একটা জায়গা ঠিক করতে হবে। আমাদের সাথে তুমি আছো যে। সাবধানে থাকতে হবে। ডাকাতেরা আক্রমণ করতে পারে যখন তখন।”

বীর প্রতাপ একটু থামলো। আশেপাশে একটু নজর দিয়ে বলল, “তুমি পালকিতে ঘুমাও হৈমু।তোমার তো অসুবিধা নেই তুমি পালকিতে ঘুমাতে পারো।”

হৈমু পালকির পর্দা নামিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো।তৈমুর পালকিতে খাবার ও খুব সামান্য পরিমাণ পানীর ব্যবস্থা আছে। যাতায়াতের সময় হৈমুর যাতে কোন অসুবিধা না হয়।হৈমু ঘুমিয়ে পড়লো।

মরুভূমির পাশে পাহাড়ের পাদদেশে ছোট একটা গ্রাম তার দিকে আগ্রসর হচ্ছে কাফেলা। পানি সংগ্রহ করার জন্য। বহুপথ পাড়ি দিয়ে আসায় তাদের জমানো পানি প্রায় ফুরিয়ে এসেছে।

দুরে কুপের পাশে, বালির উপর নীল শাড়ি পরিহিত এক যুবতীর সদ্য মৃত লাশ পড়ে আছে। পাশেই মাস দুয়েকের একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে।মেয়েটির পুরো শরীর ভর্তি ঘা। ঘায়ের কারণে তাতে ক্ষতের সৃষ্টি করেছে।পুরো শরীর লাল বর্নের ধারণ করেছে।এক ধরনের ছোঁয়াচে রোগ। মেয়েটি হয়তো বেশিক্ষণ বাঁচবে না। কাফেলার মানুষগুলো বিষ্ময়ে চেয়ে দেখে আশেপাশে আরো মানুষের মৃত দেহ পড়ে আছে। সকলের শরীর জুড়ে একই রকম ক্ষত।
কেউ তুলে কবর দিচ্ছে না।যেখানে মরেছে ওখানেই পড়ে আছে।

কবর দেওয়া তো দূর;কেউ ঘর থেকেই বের হয় না কেউ ।পুরো গ্রাম জুড়ে ভয়ংকর মহামারীর প্রকোপে উজার হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের সকল মানুষ এই অজানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। চিকিৎসার অভাবে প্রতিদিন ছটফটিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে শত–সহস্র তাঁজা প্রাণ।দূরে কিছু লোককে দেখা যাচ্ছে, মরন ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে আছে মৃত্যুর অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।
আক্রান্ত হওয়া সকলের সমস্ত শরীর জুড়ে এক ধরনের ফোড়া হয়েছে। যার থেকে গড়িয়ে পড়ছে কালচে রক্ত-পুজ। ভোটকা একটা গন্ধে ভারি হয়ে আছে চার পাশের বাতাস। লোকগুলো পানির খোজ করতে থাকে।

বীর প্রতাপ তাদের কে বলল, “শোনো এইখানে পানি পান করা নিরাপদ নয়। এখান থেকে পানি নিও না”

উটের মালিক বলল, “কিন্তু কেন?”

বীর প্রতাপ বলল, “এখানকার পানিতে মরন ব্যাধি সৃষ্টিকারী জীবাণু মিশে থাকতে পারে।দেখছোই তো আশেপাশে কত মানুষ মরে পড়ে আছে। এখানে এমন রোগে মানুষ মারা গেছে যার সম্পর্কে আমরা কেউ অবগত নই।শুনেছি এইগুলো ছোঁয়াচে রোগ। তবে তারমানে এই নয় যে এখানকার পানি নিরাপদ। এমন ও তো হতে পারে এই পানিতে মহামারীর জীবাণু আছে। এই পানি পান করে সকলে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারি। আমার ধারনা মতে প্রত্যেক কুপের নিচে এক ধরনের বিষ চলে এসেছে। আমরা পানি পান করলে সকলেই অসুস্থ হয়ে পরবো। আমাদের কাছে বেঁচে থাকার মতো অল্প কিছু পানি এখন ও রয়েছে।জেনে শুনে নিজেদের বিপদের মুখে ঠেলে দেয়া বোকামি”

হৈমু থেকে নামলো। আশেপাশে এতগুলো লাশ দেখে হৈমুর বমি বযি ভাব হতে লাগলো।হৈমু মুখ রুমাল দিয়ে ঢেকে নিলো।

কুয়ার পাশে পড়ে থাকা বাচ্চাটার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, “বাচ্চা টা এখনো বেঁচে আছে।বাচ্চাটা কি আমাদের সাথে নিয়ে নিব?এখানে অসহায় অবস্থায় ফেলে রাখলে মারা যাবে। আমরা নাহয় ওর বাবা মায়ের দায়িত্ব নিলাম।অথবা কোন এতিমখানায় রেখে এলাম”

পাশ‌ থেকে বীর প্রতাপ বলল, “তুমি ভুলে গেছো আমরা একটা জরুরী কাজে বের হয়েছি। বাচ্চা টা কে দেখা শোনা করবে বলো তো?আর তুমি তো দেখছো সে অসুস্থ।ছোঁয়াচে রোগ।ওকে নিলে আমরাও মারা পড়বো ।এখানে আর এক মুহূর্তও থাকলে চলবে না।আর তুমি বাচ্চা নিতে চাইছো”

রুদ্র বলল, “শুনুন আপনার স্বামী সঠিক বলেছে। আপনি জেদ করবেন না। আমাদের এগিয়ে চলা উচিত”

হৈমু আর কোন কথা বলে না।পালকিতে গিয়ে বসল।সবাই গ্রামটা ছেড়ে চলে যেতে শুরু করল।

(চলবে)