প্রতাপ গড়ের অভিশাপ পর্ব-০৯

0
1

#প্রতাপ_গড়ের_অভিশাপ
#লেখায়_জান্নাতুন_নাঈম
#পর্ব_৯

হৈমু তাঁবুর ভেতরে বসে আছে। তার বয়সী একজন মেয়ে তার জন্য খাবার নিয়ে আসে, কিন্তু হৈমু কিছুই মুখে নেয় না। এখানে আসার পর থেকে সে পানি ছাড়া আর কিছুই খায়নি। মেয়েটি তাকে অনেক জোর করে, কিন্তু হৈমুর জেদের কাছে হার মানতে হয়। মেয়েটি হৈমুর ভাষা বোঝে না, আর হৈমুও মেয়েটির ভাষা বোঝে না। মেয়েটি তার ভাষায় অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু হৈমু কিছুই বুঝতে পারে না।

হঠাৎ তাঁবুর ভেতর আরাফ এবং রুদ্র প্রবেশ করল। তাদের দেখে হৈমু উঠে দাঁড়াল। মেয়েটি চিৎকার করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই রুদ্র মেয়েটির মুখ চেপে ধরল এবং তার হাত-পা বেঁধে ফেলল। রুদ্র মেয়েটিকে একটা খুঁটির সাথে বেঁধে রাখল।

রুদ্র বলল, “তাড়াতাড়ি চলুন। আমাদের এখান থেকে পালাতে হবে।”

হৈমু জিজ্ঞেস করল, “উনি কোথায়?”

আরাফ উত্তর দিল, “উনি নিরাপদে আছেন। তাড়াতাড়ি চলুন।”

আরাফ হৈমুকে কোলে তুলে নিল, এবং তাঁবু থেকে বেরিয়ে দুজনেই জঙ্গলের দিকে রওনা হলো। এদিকে বীর প্রতাপ এক সুড়ঙ্গের ভেতর পায়চারি করছে। আরাফ ও রুদ্র জঙ্গলের পথে দৌড়াচ্ছিল, তাদের পেছনে জলদস্যুরা আসছে। জলদস্যুরা তাদের পালাতে দেখেছে।

আরাফ ও রুদ্র হৈমুকে নিয়ে একটি বড় গর্তের পাশে লুকিয়ে রইল। দুজনের হাতেই অস্ত্র। তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত গর্তের ভেতরে অপেক্ষা করল। সন্ধ্যার পর তারা গর্ত থেকে বেরিয়ে আবার জঙ্গলের পথে রওনা দিল। আরাফ তখনও হৈমুকে কোলে নিয়ে চলছিল, কারণ এত রাতে জঙ্গলের পথে হৈমু হাঁটতে পারবে না।

বীর প্রতাপ খুব অসুস্থ বোধ করছিল, হৈমুর চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছে। তিনজন সুড়ঙ্গে প্রবেশ করল, এবং হৈমুকে দেখে বীর প্রতাপের মন শান্ত হলো। বীর প্রতাপ হৈমুকে জড়িয়ে ধরল, আর হৈমু কান্নায় ভেঙে পড়ল। সে ভেবেছিল জলদস্যুরা তার স্বামীকে মেরে ফেলবে।

সারা রাত তাদের সুড়ঙ্গে কাটাতে হলো। টানা দুই-তিন দিন না খেয়ে থাকার জন্য হৈমুর শরীর খারাপ করতে শুরু করল। বীর প্রতাপ তার শরীরের অবস্থা বুঝতে পারল, কিন্তু হাতে কোনো উপায় ছিল না। জলদস্যুরা দিনের বেলাতেও পুরো জঙ্গল খুঁজে বেড়াচ্ছে। বীর প্রতাপ তার দুইজন চাকরকে পাঠাল খাবার সংগ্রহ করতে। হাতে টাকা পয়সা নেই। চাকর দুজন জঙ্গল থেকে কিছু ফল আর পানি সংগ্রহ করে আনল।

জলদস্যুদের সর্দার বেশ রেগে আছে, কারণ তার বিয়ের পাত্রী পালিয়ে গেছে। এদিকে জাহাজের সব লোক দ্বীপে বন্দী। জাহাজের জন্য বাড়ি ফিরতে পারছে না। সম্পূর্ণ অজানা দ্বীপে আটকা পড়ে আছে। জলদস্যুর সর্দার জাহাজ দখল করে নিয়েছে।

জংগলে খুঁজে পাওয়া একটু ফল খেয়ে হৈমুর শরীর একটু সুস্থ লাগছে শুরু করলো।বীর প্রতাপ সুড়ঙ্গে বসে আছে।হৈমু তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকে।

রুদ্র বলল, “এখানে এভাবে পড়ে থাকলে না খেয়ে মরতে হবে। তাছাড়া আমাদের পিছনে জলদস্যু পড়ে আছে। কিছু করো?”

বীর প্রতাপ বলল, “তোমার অনেক বড় ঝুঁকি নিয়েছ। আরেকটা ঝুঁকি নিতে হবে। আমাদের লক্ষ্যের কথা মনে আছে তো?”

আরাফ বলল, “বলো শুনি”

বীর প্রতাপ বলল, “রাতে যখন ঘুমিয়ে যাবে ।তখন আমরা ওদের থেকে একটা ছোট নৌকা চুরি করে রওনা দিব। এছাড়া আর উপায় নেই। আমাদের কাছে হালকা অস্ত্র ও আছে”

রুদ্র বলল, “রাতে জংগলের পথে লুকিয়ে পড়বো।সবাই ঘুমিয়ে পড়লেই কাজ করতে হবে”

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। জলদস্যুর কিছু লোক সাগর থেকে মাছ ধরে নিয়ে এসেছে।মাছ ধরার বড় নৌকাটা দ্বীপের একপাশে দাঁড় করিয়ে রেখে দেয়। জলদস্যুর সর্দার বেশ খুশি।তার লোকেরা অনেক গুলো মাছ ধরতে পেরেছে বলে।সবাই একে একে মাছ গুলো জালে করে নিজেদের তাঁবুর দিকে নিয়ে যেতে শুরু করল।রাতে খাবার খেয়ে জলদস্যুরা সবাই ঘুমিয়ে পড়লো।বীর প্রতাপরা দুর থেকে তাদের উপর নজর রাখতে শুরু করলো।সবাই ঘুমিয়ে পড়তেই মাছ ধরার বড় নৌকার দিকে ধীরে ধীরে চলছে লাগলো।নৌকার উপর একজন ঘুমিয়ে আছে। রুদ্র আর আরাফ লোকটার কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুখ চেপে ধরলো।হাত পা বেঁধে একপাশে ফেলে রাখলো।হৈমু বীর প্রতাপ নৌকায় উঠে বসলো। রুদ্র আরাফ ও নৌকায় বসে পড়লো।চাকররা নৌকা ঠেলে পানিতে এনে নৌকায় উঠে পড়লো।চাকরা নৌকার বৈঠা বাইছে। নৌকা চলতে চলতে দ্বীপ থেকে অনেক দূরে চলে এলো।

বীর প্রতাপ বলল, “তোমরা মাছ ধরতে পারো ?”

রুদ্র বলল, “এইসব পারি না”

আরাফ বলল, “এখানে ওরা জাল রেখে দিয়েছে”

রুদ্র বলল, “ওরা তো জানে না আমরা নৌকা চুরি করে নিব”

হৈমু বলল, “আমাদের উনিশ দিনের যাত্রা ছিল।জাহাজে মনে হয় পনেরো দিন ছিলাম। আপনার কি মনে হয় আমরা এই নৌকায় করে চারদিন সমুদ্র পথ পারি দিতে পারবো ?এই চারদিন খাবো কী? খাবার পানি নেই আমাদের কাছে। আমরা কি সমুদ্রের লবনাক্ত পানি খেতে পারবো?”

বীর প্রতাপ বলল, “আমি জানি না। আমার কাছে এসবের উত্তর নেই। আমি এখন মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছি। আমার একদম শক্তি নাই। আমার বিশ্রাম দরকার।”

রুদ্র ও আরাফ দুজনেই বলল , “ আমরা ও মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরেছি।খুব ক্লান্ত লাগতেছে। জলদস্যুরা সবকিছু লুট করে নিয়েছে। আমাদের গায়ে একটা পোশাক ছাড়া আর কিছুই নেই। আমাদের যাতায়াত খরচটাও নেই”

হৈমু বলল, “ভেঙে পড়ো না। আমাদের হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। আমরা পাশেই কোন দ্বীপ পেলে সেখানে অপেক্ষা করবো। আমার কাছে কিছু স্বর্ণের গয়না আছে যেগুলো দস্যুরা নেয়নি। এইগুলো বিক্রি করলেও আমাদের কিছু উপকার হবে”

বীর প্রতাপ আফসোস করে বলল, “আমার এতই খারাপ দিক দিন আসলো যে পোশাক আর খাবারের জন্য নিজের স্ত্রীর গয়না বিক্রি করতে হচ্ছে”

হৈমু বলল, “মন খারাপ করবেন না।প্রতাপ গড়ে ফিরে গেলে আমাদের কোন কিছুর অভাব হবে না”

বীর প্রতাপ বলল, “তুমি আমার যোগ্য স্ত্রী হৈমু।তোমাকে বিয়ে করে আমি কোন ভুল করিনি”

রুদ্র বলল, “হৈমুর মতো একটা সুন্দরী বউ যেন আমার কপালে জুটে”

বীর প্রতাপ বলল, “পাবে না।হৈমু শুধু একজনই আছে।এর মতো এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই”

রুদ্র বলল, “বউ ভক্ত জামাই”

নৌকা চলতে শুরু করল। নৌকা ছোট হওয়ায় সারারাত নৌকা অনেক দুলছিল।নৌকায় কেউ ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি।বীর প্রতাপ বলল, “তোমরা ঘুমাও। তোমাদের বিশ্রাম দরকার। এখন রুদ্র আর আরাফ নৌকা চালাবে”

সন্ধ্যায় একটা দ্বীপের সন্ধ্যান পাওয়া গেল।একটা নির্জন দ্বীপ। অন্ধকারে কোন কিছু দেখা যাচ্ছে না।সবাই বুঝতে পারলো এখানে কোন মানুষ থাকে না।এই নির্জন দ্বীপে নৌকা আর দ্বীপের কাছে গেল না।নৌকাটাকে মাঝ সমুদ্রেই রেখে দিল।এই নির্জন সমুদ্রে হিংস্র পশু থাকতে পারে।

পরদিন সকালে নৌকা দ্বীপে গিয়ে পৌঁছাল। সমুদ্রের পাড়ে অনেক গুলো নারকেল গাছ ছিল।সবাই ডাব পেড়ে না ডাবের পানি খেতে লাগলো। সুমদ্রের কাছে মাছ ধরার জাল দিয়ে কিছু মাছ ধরার চেষ্টা করলো কিন্তু কোন লাভ হলো না।একটাও মাছ জালে ধরা দেয়নি।

বীর প্রতাপ বলল, “মাছ ধরতে গিয়ে অনেক পরিশ্রম করে ফেলছি। এখানে অনেক ফল আছে।ফল খেয়ে দুইদিন কাটিয়ে দেয়া যাবে। দুইদিন বিশ্রাম নিতে চাই”

রুদ্র বলল, “চলো থাকার জন্য আশ্রয় খুঁজতে যাই”

বীর প্রতাপ বলল, “আমরা সবাই যাব।এই অজানা জায়গায় যেকোনো সময় বিপদ হতে পারে। এখানে কাউকে ফেলে রেখে গেলে চলবে না”

সবাই মিলে রাতের আশ্রয় খুঁজতে লাগল।হাঁটতে হাঁটতে পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে লাগলো।পাহাড় থেকে পুরো দ্বীপ সুন্দর ভাবে দেখা যাবে।

পাহাড়ের উপর উঠার পর একটা জায়গায় থাকার জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। পাহাড়ের পাশেই একটা ছোট গর্ত। এখানে মাচার মতো তৈরি করে দুইদিন থাকা যাবে।ছেলেরা কাঠ ও প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র খুঁজতে লাগল।বীর প্রতাপ আর হৈমু পাহাড়ে হেলান দিয়ে বসে রইলো।

বীর প্রতাপ বলল, “তোমার কি হয়েছে বলো তো। কেমন যেন পরিবর্তন লক্ষ্য করছি তোমার মধ্যে”

হৈমু বলল, “তাঁবুতে মেয়েটা আমার পেটে হাত রেখে কি যেন বলল বুঝতে পারিনি। তবে আমার কি মনে হয় জানেন আমার ভেতরে কেউ যেন বেড়ে উঠছে”

হৈমুর কথা বীর প্রতাপের বুঝতে বেশি সময় লাগলো না।বীর প্রতাপ বেশ চিন্তায় পড়ে গেল।

ছেলেরা জিনিস পত্র নিয়ে দুপুরের আগেই ফিরে এলো।থাকায় জন্য একটা তাবু বানিয়ে নিল ছড় আর গাছের ডাল দিয়ে।তাঁবুর সামনে কিছু শুকনো কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করে নিল।যাতে রাতে হিংস্র পশু আক্রমণ করতে না পারে।

রুদ্র বলল, “পাশেই বড় পাহাড়ের পাশে একটা সিড়ি আছে।একদম পাকা সিঁড়ি দেয়া আছে। আমার মনে হয় উপরে কোন প্রাসাদের মতো কিছু আছে।দূর থেকে ভালো দেখা যাচ্ছে না’

হৈমু বলল, “চলো ওখানে যাই”

বীর প্রতাপ ধমক দিয়ে বলল, “এটা নতুন জায়গা। এখানে এত তিড়িং বিড়িং করতে হবে না।কাল সকালে সবাই মিলে যাব। এখন ওখানে গেলে ফিরতে ফিরতে রাত হবে।তখন যদি কোন বিপদে পড়ি তখন কি করবে?”

হৈমু আর কোন কথা বলল না। চুপচাপ তাবুতে বসে রইলো।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। সন্ধ্যা হতেই এক অদ্ভুত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আরাফ তাঁবুর সামনে আগুন জ্বালিয়ে তাঁবুর ভেতরে গিয়ে বসে।চারজন চাকর একটু পর পর পালা করে পাহাড়া দিবে।তাঁবুর বাইরে একজন চাকর হাতে শক্ত লাঠি নিয়ে দাড়িয়ে থাকে।

চারদিকে পাখিরা উড়াউড়ি করতে থাকে।হঠাৎ করে আকাশ লাল রক্তের মতো ধারণ করে।পাখি গুলো খুব জোরে জোরে ডাকাডাকি করতে করতে উড়াউড়ি করছে।দুরে কোথাও দুই তিন টা শেয়াল ডাক দেয়।
রাত হয়ে এলে এই জনপদের রুপ পরিবর্তন হয়ে যায়। সবাই তাঁবুর ভেতরে সতর্ক হয়ে বসে থাকে।অনেক রাত হয়ে যাওয়ার পরেও কোনকিছু হয় না। বীর প্রতাপ রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। রাতের খাবার হিসেবে ফল আর ডাবের পানি দিয়েই কাজ সারিয়ে নেয়।

হঠাৎ শেয়াল ডেকে উঠে।একে একে বেশ কয়েক বার শেয়ালের ডাক শোনা যায়। শেয়ালের ডাক থামতেই একটা নুপুরের শব্দ কানে বেজে ওঠে। সাধারণ মানুষ নুপুর পড়ে হাঁটলে এত জোরে শব্দ হয় না।মনে হচ্ছে কেউ খুব জোরে জোরে হাঁটছে।সেই সাথে নূপুরের ভয়ংকর শব্দ পরিবেশটাকে ভৌতিক করে তুলে। বাইরে থাকা চাকর হঠাৎ খুব জোরে চিৎকার করে উঠল।
আরাফ বাইরে বেরিয়ে আসলো।বলল, “কি হয়েছে?”

চাকর বলল, “দূরেই একটা নর্তকী নৃত্য করছে”

আরাফ কিছু বলার আগেই দেখলো আগুনের সামনে একজন নর্তকী দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করেই মেয়েটিকে দেখেই বলল, “আপনি কে?”

মেয়েটি বলল, “আমি পাশের গ্রামে থাকি।”

আরাফ বলল, “এখানে গ্রাম আছে?”

মেয়েটি বলল, “জী”

কথা বলার ফাঁকে আরাফ খেয়াল করলো চাকর ভয়ে কাঁপছে। চাকরটি তাকে ইশারায় কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে।আরাফ হঠাৎ দেখলো মেয়েটার পা উল্টো দিকে ঘুরানো।আরাফের বুঝতে বাকি রইলো না এই নর্তকী কে।

আরাফ বলল, “তুমি বাড়ি ফিরে যাও। অনেক রাত হয়েছে।”

কথাটা বলেই আরাফ ভেতরে প্রবেশ করে ফেলল।চাকরটি ভয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিল।

বীর প্রতাপ বলল, “কে?”

আরাফ বলল, “ডাইনী।পা গুলো উল্টো দিকে ঘুরানো ছিল”

(চলবে)