#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#বর্ষা
#সূচনা_পর্ব
১।বিয়েরদিন হবু বরের পাশে অপরিচিত নারী মুখ দেখে চমকেছে অদ্রিতা।মেয়েটা লাল বেনারসীতে এই গরমের মাঝেও বউ সেজে ছিলো কারো জীবনকে রঙিন করতে।আর সেই ব্যক্তিই নাকি প্রতারিত করলো তাকে!নুহানের সঙ্গে আসা মেয়েটা ওর প্রথম স্ত্রী অনন্যা।এই বিয়ের আয়োজন, বিয়ের নাটক সবই ছিলো একটা বাচ্চার জন্য।আজ নুহান যখন জেনেছে অনন্যা মা হতে চলেছে ওমনি সে হাজির হলো অনন্যাকে নিয়ে।যাতে বিয়েটা আর করতে না হয়।
অদ্রিতা স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। কিছু বলার নেই তার।এতোদিন তবে সবই নাটক ছিলো! ভালোবাসি বলা,খাইয়ে দেওয়া, ঘোরাঘুরি করা সব।বিয়ে ঠিক হয়েছে আড়াই মাস।এই দীর্ঘ সময়টায় একদিনও অদ্রিতার মনে হয়নি এই মানুষটা প্রতারক। কিন্তু আজ!আজ তবে কি হলো।অদ্রিতার নিজের প্রতি ঘৃণা লাগলো।
‘’তোর সাহস কেমনে হয় মা**পুত, তুই মীর পরিবারের মেয়ের সাথে প্রতারণা করছোস!’’
মিরাজুল করিম ততক্ষণে বন্দুক নিয়ে এসেছেন।তাক করেই কথাটা বললেন। সম্পর্কে অদ্রিতার বড় আব্বু হয় সে।আর্মিতে বেশ ভালো পদেই তার অবস্থান।অদ্রিতা তার বড্ড আদরের।অনন্যা আর নুহান দু’জনই ভয় পেলো।তবে নুহানের পরিবার থাকেনি এখানে।যখনই নুহান অনন্যাকে দাঁড় করিয়েছে তখনই তাঁরা রাগে ক্ষোভে চলে গেছে।নুহান তাদেরকেও বোকা বানিয়েছিলো বোধহয়।
‘’আঙ্কেল দেখেন যা হবার তা তো হয়ে গেছে।আমি এই অনুষ্ঠানে যত খরচ হয়েছে সব চুকিয়ে দেবো। দেখুন আমি তো পালিয়ে যাইনি। বরং সামনে থেকে এসে সত্যিটা বললাম ‘’
‘’তোর সত্যির বাড়া ভাতে পানি ঢালি।তোর সাহস কেমনে হয় বিবাহিত হয়েও সত্যি লুকনোর!’’
মিরাজুল করিমের বড় ছেলে মোয়াজ তেতে আসেন।নুহান আমেরিকা প্রবাসী।পরিবার ভালো দেখেই ওনারা রাজি হয়েছিলেন এ বিয়েতে।নুহানের পরিবারের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকায় আর বেশি খোঁজ করেননি মিরাজুল করিম।রিয়ান এসবকে পাত্তা না দিয়ে ছুটে গেছে অদ্রিতার কাছে।
‘’রিয়ান,সবাইকে বল নাটক শেষ করতে।আমার আর ভালো লাগছে না’’
অদ্রিতা দুই হাতে শাড়ি উঁচিয়ে নেমে আসে সৌন্দর্য মন্ডিত স্টেজ থেকে। চারপাশে এখনো কাঁচা ফুলের সুবাস।পুরো বাড়িটা কাঁচা ফুলে সজ্জিত।অদ্রিতার পেছন পেছন রিয়ান,মারিয়াম ছোটে।মেয়েটা উল্টাপাল্টা কিছু করে না বসলেই হয়।
উপস্থিত সবাই সমালোচনা করার সাহস করে উঠতে পারছে না।এতোটা ক্ষমতা এখনো মীর বংশের আছে। অতীতের ইতিহাস না ঘাটাই শ্রেয়।তবুও পুরান ঢাকার আনাচে-কানাচে মানুষ এদেরকে চেনে মীর মুর্তজা পরিবার নামে। মিরাজুল করিম হাতের বন্দুক নামিয়ে বলে ওঠেন,
‘’একদিন সময় দিলাম।আজকের মধ্যে যদি ঢাকা ছাড়তে না পারিস তাহলে পরবর্তীতে তোকে আফসোস করতে হবে’’
‘’ধমকাচ্ছেন কোন সাহসে’’
অনন্যা চেঁচিয়ে ওঠে। অনেকক্ষণ ধরে নাটক দেখছে সে।যে যা পারছে বলছে।বিয়ে তো করেনি।করতো।তাহলে এতো নাটক করার কি আছে সে জানে না। অনন্যার চিৎকারটা বোধহয় পছন্দ হলো না আজাদ মীর মুর্তজার।অতীত জিজ্ঞেস করলে বলতে হয় তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী।বর্তমানেও ব্যবসাটা তিনিই সামলাচ্ছেন। মিরাজুল করিমের থেকে বন্দুক ছিনিয়ে আকাশে ফাঁকা গুলি করেন তিনি।
‘’আজকের সময় দেস কেমনে করিম?এই ফহিন্নির পুতে আমার নাতনির চোখে জল আনছে। একঘন্টার মধ্যে এলাকা ছাড়তে না পারলে কলিজা কাইটা কুত্তারে খাওয়াম’’
‘’দেশে আইন কানুন নেই নাকি!ছেলে খেলা পাইছেন?যাবো না আমরা কি করবেন?’’
নুহান অনন্যাকে থামানোর চেষ্টা করে।তবে পারে না।আর এদিকে আইন-কানুনের কথা শুনে হাসতে থাকে উপস্থিত মানুষেরা। অবশ্য প্রায় সবাই চলে গেছে।একদম কাছের মানুষগুলোই আছে।মীর মুর্তজা পরিবার আইনের ধার ধারে না।যেমন অন্যায় করেনা,তেমন অন্যায় সহ্যও করেনা।যদিও তা পরিবারের মাঝে দেখা যায় বলে মনে হয়না।
‘’তুই আমাদের আইন শেখাবি?তোর চৌদ্দ গুষ্টিকে প্রতারণার দায়ে হাজত বাস করাতে পারি।এখানে যত দেরি করবি তোদের প্রাণ পাখিটা ততটা ছটফটানির কাছে আসবে’’
মীর মুর্তজা পরিবারের জামাই সোহান বাশার বলে ওঠেন।বর্তমান সময়ের বেশ সুনাম রয়েছে ওনার।সুপ্রিম কোর্টের সুপরিচিত আইনজীবী তিনি।নুহান এবার বেশ ভয় পেয়ে যায়।ছোটবেলায় এ পরিবার নিয়ে ভীতি ধরানো অনেক কিচ্ছা শুনেছে সে।তাইতো ভয় লাগা।এবার সে অনন্যাকে জোর করেই নিয়ে বেরিয়ে যায়।
‘’করিম তোর মা,বউ কই?একটা মাইয়া মানুষ কামের সময় থাকে না’’
‘’আব্বা অদ্রির পেছনে গেছে সবাই’’
‘’আমার জাবিন দুর্বল না যে দল বেঁধে ওর পিছনে সবার যাইতে হইবো।মোয়াজ যা ভাই সব মাইয়া মানুষরে ওর থেকে সরা।নয়তো বেচারিরে একটু শান্তি দিবো না’’
দাদার হুকুম পেয়েই ছুট লাগায় মোয়াজ। মিরাজুল করিম বাকি আত্মীয়দেরকেও বিদায় জানান। আজাদ মীর মুর্তজা চেয়ারে বসে পড়েন।তার বাবা-মা হারা নাতনিটার কপালেই কি সব দুঃখ লেগে আছে!
২। হলিউড পাড়ায় চাঞ্চল্য।এতোদিন যেই অভিনেতাকে জাতে ব্রিটিশ ভাবা হয়েছিলো সে আদৌতে এক বাঙালি।বোঝার কোনো উপায়ই নেই।সাদা চামড়া,বাদামি চোখ,চুলে পুরোপুরিই যেন নেটিভ সে। হলিউডের দুনিয়ায় সে অতি বিখ্যাত সান নামে। অবিবাহিত বলেই সবার ধারণা।এবার নিয়ে মোট এগারোবার তাঁর করা মুভি সাফল্যের চূড়ায়।তার আগমনের সময়কাল বোধহয় পনেরো কিংবা তারও বেশি কিছু বছর।
ইন্টারভিউয়ের আয়োজন করেছে বর্তমান ফ্লিমের ডিরেক্টর। সেখানেই একজন রিপোর্টার প্রশ্ন করেন সানকে।
‘’স্যার,মিডিয়ায় রটছে আপনি বাঙালি।মিথ্যা পরিচয়ে এখানে আছেন।এসব নিয়ে কিছু বলবেন না আপনি?’’
সান হাসেন।হাতের রবিস্কিউবটা টেবিলে রেখে মাইকটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ান।একবারে ক্যামেরার সামনে এসে বলে ওঠেন,
‘’মিট উইথ সান,ফুল ন্যাম আহসানুল আদ্র,বাঙালি।মাই গ্র্যান্ড মাদার ওয়াজ এন নেটিভ আমেরিকান।আই এম ফুললি লাইক হার টাইপ।এমনি মোর কুয়েশ্চেন?’’
সানের বলা কথাগুলো শুনে যদিও প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত ছিলো নেগেটিভ।তবে তেমন কিছুই হয়নি।উল্টো সানের প্রতি যেন সবার চাওয়া -পাওয়া আরো বাড়লো।আমেরিকানরা নেটিভ বাদে বাকিদের অন্য চোখে দেখে এমনটা যদিও প্রচলিত। তবে তার সিকিভাগও লক্ষ্য করা গেলো না।
প্রডিউসার, ডিরেক্টরের সাথে তার নতুন ফ্লিম ‘’অরা’’ দেখা শেষে সে তার লাক্সারিয়াস এপার্টমেন্টের উদ্দেশ্যে ক্যাবে উঠলো।এতো বড় অভিনেতা।তবে নেই নিজের গাড়ি,ভাবা যায়!বাড়ি পৌঁছানোর আগে একবার ফেসবুকে ঢুকলো ।অপ্রত্যাশিত কোনো নিউজ না পেয়ে ফোন রেখে দিলো সে। রেডিওতে শুনতে লাগলো তারই গাওয়া একটা গান ‘’লাইফ ইজ ফুল ওফ চ্যালেঞ্জ’’
এপার্টমেন্টে পৌঁছে পোশাক ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো সে।আজ আর এনার্জি নেই কিছু খাওয়ার।মন চাইলো পরিবারের সাথে কথা বলার। কিন্তু কিভাবে!গত আঠারো বছর যাবত সে যেন বড্ড একা।নিজের দোষেই তো। স্বপ্ন পূরণের জন্য সেই যে বিদেশ পাড়ি দিলো আর তো যায়নি।তখন তারই বা বয়স কত ছিলো!কেবল বিশ।আর এখন আটত্রিশ।
৩।রাত এগারোটা।অদ্রিতা পোশাক পাল্টে এতোক্ষণ ঘুমিয়েছে। মাত্রই উঠলো।ফ্রেশ হলো।পুরো বাড়ি অন্ধকার হয়ে আছে। সাজসজ্জার কোনো নাম গন্ধ নেই।হয়তো তার দুঃখ কমাতে দাদা সব ছাড়িয়ে নিয়েছে।অদ্রিতা গুটি গুটি পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে আসে।রান্নাঘরে যায়। অনেক খিদে পেয়েছে তার।ফ্রিজে রাখা আছে তার পছন্দের মোরগ পোলাও,ফিরনি।তা থেকেই অল্প অল্প করে নেয় সে।
হঠাৎ লাইট চলে ওঠে।রিয়ান আড়মোড়া দিতে দিতে এগিয়ে আসে। ঘুমঘুম চোখ।বেচারাও কিছু খায়নি।খিদের জ্বালায় উঠে এসেছে।
‘’রিয়ান খাবি?খাবার বেড়ে দিবো?’’
অদ্রিতার কথা শুনে চোখ খুলে বড় বড় করে তাকায় সে।ভাবেনি এই মেয়ে ঘন্টা তিনেকের ঘুমে সব ভুলে যেতে পারবে।কত স্বাভাবিক আচরণ করছে!
‘’তুই এখানে?’’
‘’খিদে পেয়েছে তাই এসেছি।খেয়ে দেখ জালি কাবাবটা অস্থির হইছে’’
‘’দে এক কামড় খাই’’
‘’ফ্রিজ থেকে নিয়ে খা।আমি দিতে পারবো না’’
‘’তো গরম করে দে’’
‘’আমি নিজেই খাইতাছি ঠান্ডা।সর সামনে থেইকা’’
রিয়ান পূর্ণ দৃষ্টিতে অদ্রিতাকে দেখে।কালো পলো শার্ট আর বাদামি রঙের প্লাজুর সঙ্গে কালো ঝর্না জড়িয়ে এসেছে সে।বাড়িতে সাধারণ এভাবেই ঘুরঘুর করে মেয়েটা।রিয়ান হুট করে কি ভেবে যেন বলে ওঠে,
‘’অদ্রি আজলান বেহরান তোর খোঁজ করছে’’
লোকটার নাম শুনেই অদ্রিতা কাঁপতে থাকে।পুরনো কথা মনে পড়ে।এই লোক ওকে কেন খুঁজছে ভাবতেই ওর রুহতে কাঁপুনি লাগে।
চলবে?