#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#১০ম_পর্ব
#বর্ষা
২৯।
গতকাল মাইর খেয়ে শরীর ব্যথা নিয়েই পরীক্ষা হলে গিয়েছিলো রিয়ান। ভাগ্যিস এমসিকিউ এর জন্য তখনও পনেরো মিনিট ছিলো। প্রথমদিনই বাংলা পরীক্ষা ছিলো।আট মিনিটে এমসিকিউ শেষ করে বাকি সময়টায় খাতা মার্জিন করেছে ও।শরীর কাঁপছে ওর।মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। ক্লাসে সব রেখেই তারপর গিয়েছিলো ছাদে।বেঞ্চের নিচে পানির বোতল রেখেছিলো।ঢকঢক করে পানি খেয়ে নেয় ও।
কোনোমতে একঘন্টা পরীক্ষা দিতেই রিয়ানের সহ্য ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। ডিসপেনসারিতে থেকে আসার পথে দু’টো প্যারাসিটামল এনেছিলো ও।একটা তৎক্ষণাৎ খেতে নিলে স্যার এসে হাত ধরে। জিজ্ঞেস করে,
‘’রিয়ান তোমাকে সেই অনেকক্ষণ ধরে দেখছি।কোনো অসুবিধা? চোখও তো লাল হয়ে আছে,আবার এখন ঔষুধ খাচ্ছো!’’
‘’স্যার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। প্যারাসিটামল খাচ্ছি’’
‘’বেশি সমস্যা হলেও জানিও’’
রিয়ান পরীক্ষা দিতে শুরু করে।আড়াই ঘন্টা শেষের কিছুক্ষণ আগেই রিয়ান বেরিয়ে আসে।ওর আর শরীর চলছে না।ক্লাসরুম থেকে বেরতেই দেখতে পায় অদ্রি দাঁড়িয়ে আছে পাশটায়।রিয়ানকেই বোধহয় খুঁজছে।রিয়ানের মুখে হালকা হাসি ফুটে ওঠে।
ব্যাগ জড়িয়ে রিয়ানকে খুঁজে চলেছে অদ্রি। পরীক্ষা তবুও সে ব্যাগ নিয়ে এসেছে। মেয়েদের ব্যাগে অনেককিছুই থাকে।প্রয়োজন অপ্রয়োজনে সবসময় কাজে লাগে সেসব।রিয়ানকে দেখেই ছুটে আসে অদ্রির।রিয়ানের গালের একপাশটায় আঁচড়ের দাগ। অদ্রির চেয়েও অনেক বেশি ফর্সা রিয়ান। ছেলেদের এতোটা ফর্সা হলে মেয়ে মেয়ে লাগে।ফর্সা ত্বকের কারণেই রিয়ানের গাল,হাতের বিভিন্ন অংশে লালচে ছোপ ছোপ ভাব ফুটে উঠেছে।
‘’এই তোর কি হয়েছে?গালে,হাতে ব্যথা পেলি কিভাবে?’’
‘’গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়েছিলাম’’
রিয়ান নির্দ্বিধায় মিথ্যা বলে।অদ্রি ধরতেও পারেনা।তবে কিছুটা সন্দেহ হয় ওর। দাগগুলো বোধহয় মারের। কিন্তু কারই বা দুঃসাহস হবে রিয়ানকে মারার!রিয়ান পা টেনে টেনে হাটছে দেখে অদ্রি ওর হাত ধরে।রিয়ানের মাঝে ভালো লাগা কাজ করলেও অদ্রির কাছে একদম নরমালই যেন সব!
জেনিয়া ফিরোজ নিতে এসেছিলেন ওদের।রিয়ানের গা ছুয়ে যখন দেখলেন গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।সঙ্গে সঙ্গে হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিলেন।ডক্টর বলেছিলো শরীরের ব্যথায় এই জ্বর।শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে তাও বলেছিলেন। কিছু ঔষধ লিখে আর কিছু নির্দেশনা দিয়ে ছুটি দিয়েছিলেন ডক্টর।
রাত থেকেই জ্বর বেড়েছিলো।অদ্রি একটু পরপর এসে দেখে গেছে।রিয়ানের জন্য ওর খারাপ লাগছে।ইশ,ছেলেটা পুরো লাল হয়ে আছে।রিয়ানের জায়গায় অন্য কেউ থাকলে বোধহয় দুইজনে মিলে দুষ্টামি করে বলতো,’’টমেটোটাকে দিয়ে সস বানালে মন্দ হয় না’’
রাত জেগে ছেলের পরিচর্যা করে শেষরাতে ঘুমাতে গেছেন ফাতেমা জোহরা। তাইতো উঠতেও দেরি হলো অনেকটা।রান্নার চিন্তা মাথায় আসতেই একপ্রকার ছুটে আসলেন তিনি।ওমা!খাবার রেঁধে যে টেবিল সাজানো। কতকিছু!পরোটা,মুরগির মাংস আর ডিম ভাজি।সাথে সালাদও কাটা আছে। তিনি ভাবতে লাগেন রান্না করলো কে!তখনই রান্নাঘর থেকে হাসির আওয়াজ পেয়ে সেদিকে যান তিনি।
অদ্রি আর জেনিয়া ফিরোজ একসাথে খুনসুটি করে রান্নাবান্না করছে।ফাতেমা জোহরার হঠাৎ করে হিংসে হয়।অদ্রিকে তো উনি বড় করেছেন।হয়তো বুকের দুধ পান করাননি কিন্তু পেলে পুষে তো বড় করেছেন উনি।অদ্রির কপালে খুব একটা বুকের দুধ জোটেনি।রিয়ানের যখন দেড় বছর তখন অদ্রি হয়।রিয়ানই তখন ওর মায়ের বুকের দুধ পেতো না।অদ্রিও তাই আর পায়নি। অবশ্য অদ্রির বয়স এক হবার পর আয়েশা সিদ্দিকা খাওয়াতে চেয়েছিলেন ওকে।তবে অদ্রি তখন আর খেতে পারেনি।ওর সহ্য হয়নি আর।ফর্মুলা মিল্ক খেয়েই বড় হয়েছে ও।
‘’আরে বড় মা বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন?ভেতরে এসো।দেখো মাম্মা আমায় পায়েস রান্না করা শিখিয়েছে ‘’
ফাতেমা জোহরা অদ্রিকে কখনো চুলো জ্বালাতে দেননি।হিতে যদি হাত পুড়িয়ে ফেলে তার ভয়ে।আর আজ অদ্রি রান্না করছে!তিনি কিছুটা রাগান্বিত হয়েই বলে ওঠেন,
‘’অদ্রি তুই রান্নাঘরে এসেছিস কেন? হাত পুড়বে তো তোর!’’
‘’ভাবি এভাবে ওকে নিরুৎসাহিত করছেন কেন?এটা তো বেসিক স্কিল। সারাজীবন কি সবার সাথে থাকবে নাকি!আত্মনির্ভরশীল হতে হবে ওকে’’
ফাতেমা জোহরার বোধহয় ভালো লাগেনি কথাটা।তবে তিনি কিছু আর বলতে পারলেন না।মা মেয়েকে শেখাচ্ছে।শেখাক। অবশ্য অদ্রির ক্ষতি না হলেই হবে।অদ্রির শরীরে একটা আচড়ও তিনি দেখতে পারেন না। মারিয়াম যখন হলো তখন তিনি নিজেই বাচ্চা ছিলেন।তাইতো মারিয়ামকে দিয়ে শখ আহ্লাদ পূরণ করতে পারেননি।সেসব পূরণ করেছিলেন অদ্রিকে নিয়ে।অদ্রির প্রতি একমাস পূর্তিতে একটা করে ছবি জমিয়ে আজ তার পরিমাণ দুইশ’ ষোলো।
৩০।
তুরস্কে সকাল ছয়টা।আজলানের একপাশে আরহান ঘুমিয়ে আছে।অন্যপাশ ফাঁকা।এই ঘরে থাকার অধিকার কেবল আরহানের।ঘুম ভাঙতেই আরহানকে বুকের মাঝে দেখে আজলান মৃদু হাসে। হঠাৎ ওর মনে হয় কতদিন যেন ও অদ্রিকে দেখে না।ওর ভালো লাগছে না।বিছানা ছেড়ে উঠে মোবাইল নিয়ে সাইডে যায় আজলান। ফোন দেয় আযানকে।রিং হচ্ছে।
বেশ বিরক্ত নিয়েই অপেক্ষা করতে থাকে আজলান।আসার আগে বেশ মোটা অংকের টাকা সে আযানকে দিয়ে এসেছে।যেন অদ্রির নিত্যদিনের খোঁজখবর সে পেতে পারে। কিন্তু এখন আযান ফোনই তুলছে না।আজলানের বিরক্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছানোর পূর্বেই আযান কল ধরে।
‘’কোথায় মরছিলি তুই?এতো সময় লাগে!’’
‘’সরি স্যার ‘’
‘’ওপাশের কি অবস্থা?জাবিন কেমন আছে?’’
‘’স্যার অদ্রিতা জাবিন ভালো আছে।তবে…’’
‘’ওই তুই তোর লিমিট ক্রস করিস না।ম্যাম বলবি।আর কি বলতাছিলি বল’’
‘’স্যার ম্যাম আপনার দেওয়া চেইন ফেরত দিয়েছে।ম্যাম বলেছে তাকে ডিস্টার্ব না করতে’’
আজলান ক্ষেপে যায়।অদ্রিতার সাহস কিভাবে হলো ওর কথা অমান্য করার!আজলান রাগে চিৎকার করতে থাকে।ফোন কেটে দেয়।আজলানের চিৎকারের আঁতকে ওঠে ছোট আরহান।বাবাকে চিৎকার করতে দেখে ছোট ছোট কন্ঠে ডাকে,’’পাপা’’
আজলান নিজেকে কন্ট্রোল করার বৃথা চেষ্টা করে।পারে না।আরহানকে কোনো উত্তর না দিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়।ওর মন চাচ্ছে সবকিছু ধ্বংস করে দিতে।আজলানের চিৎকারে ততক্ষণে লিয়ানা এরুমে ছুটে এসেছে। বিছানায় ভয়ে কুঁকড়ে বসে আছে আরহান।লিয়ানা গিয়ে ছেলেকে ধরে।আরহান বলে ওঠে,’’মাম্মা পাপাকে সাউট করছে।আমাকে চোখ রাঙিয়েছে।মাম্মা পাপা আমাদের আর ভালোবাসে না’’
৩১।
সাউথ কোরিয়াতে শুটিং এর শেষ সময় চলে এসেছে।আর একসপ্তাহ শুট করেই শেষ।তারপর চলবে ইডিটিং,কাটিং।সান অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে কাস্টিং শেষ হবার।এই মুভিটা শেষ হলেই সে বাংলাদেশে ফিরবে।কয়টা সিন আছে ওর এই মুভিতে?তাও বেশ কিছু।এখানে সেকেন্ড লিড এক্টরের রোল করেছে ও।ফাস্ট লিড এক্টরের বড় ভাই হিসেবেই পরবর্তীতে মুভিতে ওর এন্ট্রি।
ডিরেক্টর লিও, লিজাসহ বেশ কয়েকজন কাস্টিং ওয়ার্কার্স ঠিক করে আ বারবিকিউ নাইট হবে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো আয়োজন থাকে। তবে আজ স্পেশাল কিছু হবে হয়তো।লিজার চোখ কেমন জলজল করছে।সানের প্রথমে সন্দেহ না হলেও এখন সন্দেহ হচ্ছে।এক্টিং সূত্রে ওর এই নিয়ে বারোটা মুভির সাতটাই থ্রিলারধর্মী।তাইতো ইদানিং মুভির চরিত্রের মতই ওর মাইন্ড হয়ে উঠেছে।
প্রডিউসার মান বেশ গম্ভীর টাইপ মানুষ।প্রয়োজন ব্যতীত এক মুহূর্ত থাকেন না এখানে।তবে আজ আছেন।মেইন ফিমেল লিডও আজ থাকবে।জারা হার্নান্দেজ।বেশ বন্ধুসুলভ আচরণ করছে সেই নারী ওর সাথে।প্রথম দিন থেকেই।তবে এর বেশি কিছু জারার মাঝে দেখা যায়নি।সবাই তো আর বন্ধুত্বে ভালোবাসা দেখে না।
সান গিয়ে পাহাড়ের কাছ ঘেঁষে থাকা দোলনায় বসে দুল খাচ্ছে।তখনই ওর পাশে এসে বসে জারা।বেশ সুন্দর তার ত্বক, উজ্জ্বলতা।আর হাসিটা মারাত্মক সুন্দর।কোনো মানুষ এতো নিখুঁত কি করছ হয়! প্রাকৃতিক ভাবেই তার এই সৌন্দর্য।এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি জারা প্লাস্টিক সার্জারি করিয়েছে কিনা এই বিষয়ে।তাইতো কত চর্চা তাকে নিয়ে।
‘’শুনেছি তোমার মেয়ে আছে।অদ্দিতা জাবিন আই থিংক ‘’
‘’হুম,তুমি দেখবে ওকে?’’
‘’দেখাই যায়’’
সান ফোন বের করে অদ্রির আজ সকালের পোস্ট দেখায়।মা-মেয়ে দুইজন একসাথে কুকিং করছে।সেলফি।ক্যাপশনে লেখা:’’মায়ের সঙ্গে রান্নার হাতেখড়ি ‘’
জারা দুইজনকেই দেখে।অদ্রিকে দেখে ওর অনেক কিউট লাগে। চোখগুলো অন্যরকম। অন্যরকম সৌন্দর্যতা আছে এই মেয়ের মাঝে।অদ্রির পাশের নারীটিও সুন্দর। দুইজনের চেহারায় কত মিল!জারা প্রশ্ন করে,
‘’এটা বুঝি তোমার ওয়াইফ?খুব চেনা লাগছে।মিডিয়ারই কেউ নাকি?’’
‘’হ্যা আমার ওয়াইফ।তবে মিডিয়ার লোক না। আর্কিটেকচার সে’’
চলবে?