#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#১৩তম_পর্ব
#বর্ষা
৩৬।
প্রথমবর্ষের পরীক্ষার শেষদিন।অদ্রিকে দেখতে আজ প্রফুল্ল লাগছে।দেরি করেই বেরিয়েছে ও।গেইটের কাছে কিসের যেন হইচই। অদ্রি-রিয়ান বকবক করতে করতেই এগোয় সেদিকে।প্রশ্নের সাথে তাদের একেঅপরের উত্তর মিলাচ্ছে ওরা। দুজনের যেন পড়ালেখা নিয়ে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলতেই থাকে।রিয়ানের একটার গ ভুল হয়েছে।এই নিয়ে দুইজনে তর্ক করছে।রিয়ান বলছে তারটা হয়েছে।ওদের তর্কের মাঝেই দুইদিক থেকে দুইজন লোক ওদের ডেকে ওঠে।
অদ্রি তাকায় একদিকে।রিয়ান তাকায় আরেকদিকে।অদ্রির কেমন যেন লাগে আহসানুল আদ্রকে এখানে দেখে।অদ্রি তাকিয়ে আছে তার বাবার দিকে।আর বাকিরা তাকিয়ে আছে অদ্রির দিকে। অবশ্য রিয়ান তাকিয়ে আছে আজলানের দিকে।আজলানের কথা মাথায় আসতেই রিয়ানের পায়ের রক্ত মাথায় ওঠে।এই বিদেশির তো মাথায় সমস্যা।যেখানে সেখানে বন্দুক বের করে।অদ্রিকে নিজের করতে না পারলেও এর কখনোই হতে দেবে না ও।
‘’ওই রিয়ান তোর চাচায় এনে কি করে?’’
রিয়ানকে ধাক্কা মেরে অদ্রি জিজ্ঞেস করে। ততক্ষণে রিয়ান খেয়াল করে ওর চাচাও এসেছে এখানে।রিয়ান আস্তে করে বলে ওঠে,’’আমি কেমনে জানমু’’
আজলান এগিয়ে আসার আগেই আদ্র এগিয়ে আসে। সামনাসামনি সে আরো সুদর্শন।মুভিতে মেকআপের প্রলেপ পড়ে।আসল সৌন্দর্য তো ঢাকা পড়ে।একেক সিনে একেক প্রলেপ। অভিনয় জগৎ এ নারী-পুরুষ নেই অধিকাংশকেই টাচআপ দেওয়া হয়।যার যেমন চরিত্রে তার তেমন টাচআপ।
‘’সুইটি লেটস গো।আমি তোমায় নিতে এসেছে’’
ততক্ষণাৎ গুঞ্জন শুরু হলো। কয়েকজন হয়তোবা চিনতে পেরেছে। আর বাকিরা জানবে কি করে! অধিকাংশ তো মুভি দেখলেও এক্টরের নামই জানে না।সেখানে সে কি পোস্ট করলো তা জানা কি সত্যিই সম্ভব!
‘’চলুন’’
এখানে দাঁড়িয়ে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চায়নি বলে অদ্রি রাজি হয়।রিয়ানের হাতটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে যেতে নেয়। তখনই আজলান আবারো ডেকে ওঠে।এবার অদ্রি খেয়াল করে।একবার নিজের বাবাকে দেখে তো একবার আজলানকে দেখে।আদ্র নিজেও আজলানকে খেয়াল করেছে।ওর ভ্রু কুঁচকে গেছে।এই লোকটা কে এইটাই বোধহয় তার মনে প্রশ্ন হয়ে উঠেছে।
অদ্রি রিয়ানকে নিয়ে আর দাঁড়ায় না।এই লোকের মানসিক সমস্যা অদ্রি কেনো টলারেট করবে।অদ্রি দ্রুত ওখান থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তার ধার ধরে দাঁড়ায়।আদ্র গাড়ি নিয়ে এসেছে। বাড়ির গাড়ি।ড্রাইভার মাহিম নিয়ে এসেছেন তাকে।অদ্রি আর রিয়ান গিয়ে পেছনের সিটে বসে পড়ে।আদ্র মাহিমের পাশের সিটে বসে।
‘’সুইটি ওই লোকটা কে ছিলো?’’
‘’একজন মানসিক রোগী চাচ্চু’’
‘’অ্যা..’’
‘’হ্যা চাচ্চু’’
‘’অদ্রিকে ডাকছিলো কেন?’’
‘’অদ্রি নাকি ওনার মৃত বউয়ের মতন দেখতে।তাই অদ্রিকে নিজের বউ ভেবে জ্বালাতন করে।ওনার বউয়ের নামও জাবিন ছিলো।’’
‘’রিয়ান সব উত্তর তুমি দিচ্ছো কেন?আমার মেয়েকেও বলতে দেও’’
রিয়ান চুপ করে যায়।অদ্রি এতোক্ষণ রিয়ানের মিথ্যা বলা দেখছিলো।কি সুন্দর করে মিথ্যা বলছে!অদ্রি নিজের ওপর গর্ব হয়।ওর সাথে থাকতে থাকতে রিয়ানও এখন কনফিডেন্ট নিয়ে মিথ্যা বলতছ পারছে হাহা।
‘’অদ্রি?’’
‘’জি’’
‘’গত তিনদিন হলো আমি এসেছি।তুমি একবারও তোমার পাপার কাছে আসলে না ‘’
‘’গত কয়েকবছর তো আমিও একা কাটিয়েছি।আপনি তো আসেননি’’
আদ্র চুপ করে যায়।রিয়ানের কষ্ট লাগে অদ্রির মুখটা দেখে।মেয়েটার মুখটা চুপসে গেছে।কেন যে আদ্রের এসব বলতে হলো!রিয়ান অদ্রির হাতে হাত রাখে।বোঝায় সে সবসময় আছে।আদ্র নিরবতা ভেঙে বলে ওঠে,
‘’আ’ম সরি সুইটি।বাট আ’ম ইউর ফাদার।আই হেড টু কাম।প্লিজ এক্সেপ্ট মাই এপোলজি’’
অদ্রি আর কিছু বলেনি। চিরচেনা রাস্তার দিকেই সে এমন ভাবে তাকিয়ে রইলো যেন বড্ড অচেনা কোথাও সে বড্ড আগ্রহের কিছু দেখতে পাচ্ছে।আদ্র আর তাকে জ্বালানো না।পাশের একটা গ্রোসারি স্টোরি গাড়ি দাড় করালো।অদ্রি আর রিয়ান আগ্রহ নিয়ে সেদিকে তাকালো।আদ্র নামলো।তবে স্টোরে না গিয়ে কাছেপিঠেই দাঁড়ানো একজন আইসক্রিম বিক্রেতার থেকে দধি আইসক্রিম নিয়ে এলো।এখনকার যুগে এসব খায় কে!অদ্রি,রিয়ান,মাহিম সবাইকে খেতে দিলো সে।নিজেও নিলো।
৩৭।
আজলানের রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে।অদ্রিকে ওকে ইগনোর করলো!রিয়ানের হাত ধরলো কোন সাহসে!ভাই তবে আপন তো না।চাচাতো ভাই।আর চাচাতো ভাইয়ের সাথে বিয়ে হওয়াটা কি খুব বড় বিষয়!একদমই না।অতি সাধারণ বিষয়।আজলান আযানের সাথে যোগাযোগও করতে পারছে না।ও থাকলে তাও ওর সুবিধা হতো।এখন কিভাবে কি করবে!তার ওপর অদ্রি তাকে তার পার্সোনাল আইডিতে ব্লক মেরে রেখেছে। কিছুই ভালো লাগছে না ওর।
‘’এক্সকিউজ মি. আই থিংক ইউ আর ওয়েটিং ফর এনিওয়ান’’
আজলান তাকায়।একটা মেয়েকে দেখে।তবে অদ্রি নয়।আজলান ঠিক করে এই মেয়ের থেকেই সাহায্য নেবে।ড্রেস দেখে তো মনে হয় একই কলেজের।আজলান বলে ওঠে,
‘’হাই আ’ম আজলান বেহরান।আ’ম থিংকিং এবাউট অদ্রিতা জাবিন।ডু ইউ নো হার?’’
‘’ইয়েস।তার বাড়ি তো আমাদের এলাকায়।পুরান ঢাকায়’’
‘’আমাকে নিয়ে যেতে পারবেন?প্লিজ’’
‘’জি কিন্তু আপনি ওর কি হোন?’’
‘’ফিউচার হাব্বি’’
‘’কিন্তু ও তো কমিটেড।অদ্রি তো রিয়ানের গার্লফ্রেন্ড ‘’
আজলানের রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে।আযান ওকে মিথ্যে বলেছে তাহলে!রিয়ান অদ্রির কাজিন না বরং বয়ফ্রেন্ড!তবে যাইহোক। অদ্রিকে ওর চাই।তাইতো এসবে পরোয়া না করে ও বলে উঠলো,
‘’চলুন যাওয়া যাক’’
যাওয়ার পথে মেয়েটার সাথে আজলানের কিছু কথা হলো।মেয়েটার নাম মনিকা।মনিকা অদ্রির জুনিয়র।ক্লাস টেনের ছাত্রী।অদ্রিতা জাবিন নামটা ওর পরিচিত হবার কারণ অদ্রির ব্লগিং কেরিয়ার।অদ্রির পেইজের নাম ইনফিনিক্স।কত ঘোরাঘুরির ভিডিও যে আছে সেখানে!
৩৮।
বাড়ি ফিরেই অদ্রি-রিয়ান ফ্রেশ হতে চলে যায়।বাড়িটা কেমন যেন নিরব লাগছে।ফ্রেশ হয়ে এসে অদ্রি আয়নার সামনে দাড়ায়। নিজের চোখের দিকে তাকায়।এই চোখ দুটো ওর প্রিয়।নিজেকে ওর অনেক ভালো লাগে।ও নিজেকে ভালোবাসে। অন্যদের মতন নিজেকে ঘৃণা করে না।কত মানুষ নিজেকে নিজেই টিচ করে,হিউমিলিয়েট করে,বডি সেমিং করে।অদ্রি তেমন না।অদ্রি যেমন ঠিক তেমন করেই নিজেকে ভালোবাসে।
অদ্রির চুলগুলো এলোকেশী না।পাতলা।কপালটা বড় হয়ে গেছে।চোখের নিচে হালকা ডার্ক সার্কেল পড়েছে।তবে হ্যাঁ অদ্রি উজ্জ্বল ফর্সা। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী।স্লিম হওয়ার ভুত এখনো ওর মাথায় ঢোকেনি।অদ্রির হাসি সুন্দর।হাসলে এক গালে টোল পড়ে।অদ্রি জানে মাংসপেশীর সুবিনস্ত বিন্যাস না হওয়াতেই গালে টোল পড়ে।
‘’অদ্রি’’
বড় মায়ের ডাকে অদ্রি দরজার দিকে তাকায়। ইদানিং বড় মা তার সাথে দূরত্ব করেছে।হয়তো ভেবেছে নিজের মা পেয়ে অদ্রি তাকে অবহেলা করবে।তাই নিজে থেকেই দূরত্ব করেছে।অদ্রি দরজা খুলে দেয়।ফাতেমা জোহরার হাতে শরবত।নিচ থেকে বোধহয় এতোক্ষণ ডাকছিলেন।না শোনায় নিজেই নিয়ে এলেন।
‘’ভেতরে এসো বড় মা’’
‘’নারে মা, চুলায় তরকারি। তুই শরবত খেয়ে গ্লাসটা দে।নিয়ে যাই’’
‘’আরে ভেতরে এসো তো।নিচে মনে হয় মানুষ নেই এমন করে বলছো।ওরা দেখে নেবে’’
ফাতেমা জোহরা ভেতরে এলেন।এই রুমটা তিনিই সাজিয়ে দিয়েছিলেন ছোট অদ্রিকে।অদ্রি আর রিয়ানকে এক হাতে মানুষ করেছেন তিনি। পাঁচবছর বয়সে ওদেরকে আলাদা ঘরে দেওয়া হয়েছিলো।এর আগে তো ফাতেমা জোহরা আর মিরাজুল করিমের সাথেই ঘুমাতো দুইজন। তারপর অদ্রির এই ঘরেই রিয়ান আর অদ্রি ওঠে।দুইটা ছোট বেড,দুইটা টেবিল।জেদাজেদি করে পড়াশোনা।ক্লাস এইট অব্দি তো এক স্কুলেও পড়েনি। রেষারেষির জন্য।তারপর না এক স্কুলে এলো।
“তুমি আমায় ভুলে গেছো বড় আম্মু। তুমি এখন আর আমার খোঁজ নেও না’’
‘’তোর খোঁজ নেওয়ার মানুষেরা তো এসেছে।তোর মা-বাবা তো ফিরে এসেছে’’
‘’কিন্তু তারা আর তুমি তো এক না। তুমি আমায় সেই ছোট থেকে বড় করেছো। তুমি আমার কাছে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট বড় আম্মু’’
‘’জন্মদাত্রী মায়ের থেকে চাচি বড় হয় না পাগলি।মা তো মা’ই হয়।মায়ের জায়গা কেউ নিতে পারে না’’
অদ্রি আর ফাতেমা জোহরা কথা বলছিলেন।দরজাটা খোলাই ছিলো।তখনই চেঁচামেচির আওয়াজ আসে।দুইজনেই অবাক হয়ে ছুটে যান নিজে।অদ্রির পরণে শার্ট, প্লাজু আর ওরনা।অদ্রিকে এ পোশাকে দেখে যেন আজলানের রাগ হয়।এসেই সে ঝামেলা করছে।নিচে তখন মাত্রই নেমেছিলেন আজাদ মীর মুর্তজা।আর হুট করে একজন অপরিচিতকে বাসায় ঢুকতে দেখে আর সঙ্গে ওদের থেকে সাতবাড়ি দূরের প্রতিবেশীর মেয়ে মনিকাকে দেখে চমকেছে সে।তার ওপর যখন শুনলো মনিকা বলছে,
’’দাদু এই নেও অদ্রির ভবিষ্যৎ জামাইকে নিয়ে এলাম।আমি এখন যাই’’
মনিকা যেতেই যাচাই করতে শুরু করেন আজাদ মীর মুর্তজা।আদ্রও ততক্ষণে নিচে এসে পৌছেছিলো।সে তো রিয়ানের কথাই মেনে নিয়েছে।আজলান যা বলে সবতেই রাজি হয়। কিন্তু এক ফাঁকে পুলিশেও ফোন দিয়ে দেয়।আর এদিকে অদ্রি সিঁড়ির কোনে দাঁড়িয়ে সব দেখছে।ওর পেছনে ওর মা ওকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।অদ্রি বলছে,
’’মাম্মা এই লোকটা কি সত্যিই পাগল?আমার পিছু কেন ছাড়ে না!এমন যদি হতো আমি ওনার সাথে রিলেশন করেছি তাহলে এই পাগলামি তাও মানা যেতো। কিন্তু আমি তো কথা বা দূরে টেক্সটও করিনি।আরিয়া করেছে।এই লোক তা জানে।তাও পাগলামি করে’’
চলবে?
#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#১৪তম_পর্ব
#বর্ষা
৩৯।
পুলিশে গ্রেফতারের পর বেশ কিছু কথোপকথন হয় তাদের। ইন্সপেক্টর মাহফুজ সম্পর্কে অদ্রির ফুফাতো ভাইয়ের চাচাতো ভাই। যেহেতু অদ্রির ফুপির বিয়ে জয়েন্ট ফ্যামিলিতে হয়েছে সে সূত্রেই অদ্রি বেশ কয়েকবার ও বাড়িতে গেছে। মাহফুজকে সে চেনে।ভাইয়া বলেই সম্বোধন করে। মাহফুজ তাকে ছোট বোনের মতোই স্নেহ করে।তার স্ত্রীও অদ্রিকে ছোট বোনের মতই মানে,আদর করে। মাহফুজ আর আজলানের কথোপকথনে মাহফুজ বুঝেছে আজলান মাত্রারিক্ত পাগলামি করছে।যদিও আজলান তার পাগলামিকে ভালোবাসা বলে দাবি করছে।
‘’দেখুন মি.বেহরান,আপনার উচিত পাগলামো ছেড়ে দেওয়া।অদ্রি বাচ্চা মেয়ে।আর আপনি? নিজের বয়সটা দেখুন’’
মাহফুজের কথা আজলানের মোটেও পছন্দ হয়না।সে জেলের ভেতর বসেই রাগ দেখাতে থাকে। অবশ্য এতোক্ষণ ঠান্ডা মাথায় বোঝাচ্ছিলো যে সে অদ্রিকে ভালোবাসে এক্সেক্ট্রা এক্সেক্ট্রা।তবুও মাহফুজের মুখে ওমন কথা শুনে আজলান আর রাগ সামলাতে পারেনা।
মাহফুজ ঠান্ডা মাথায় ওখান থেকে সরে আসে।পুলিশ হলে ওতো রাগ জেদ থাকা যায়না।সবসময় সব পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলে রাখতে হয়। সামলে কথা বলতে হয়।যে যুগ এই যুগে অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেও দিনশেষে দোষটা কখন যে নিজের ঘাড়ে এসে পড়ে কেও বলতে পারেনা।মাহফুজ সরে গিয়ে আহসানুল আদ্রকে ফোন করে।ওপাশের ব্যক্তিটা বোধহয় ফোন হাতে ছিলো। তাইতো তৎক্ষণাৎ ধরলো।
‘’আসসালামু-আলাইকুম আংকেল,আমি মাহফুজ’’
‘’হ্যা চিনেছি।তোমার নাম্বার সেইভ করা আছে।কি অবস্থা ওদিকের’’
‘’আংকেল আপনারা ঠিকই বলেছেন বোধহয়।পাগলামি আছে এর।পরিচিত কারো নাম্বারটা নিতে পারি কিনা দেখি।তারপর ওনার দেশে ফেরত পাঠিয়ে ভিসা বাতিলের আবেদন করবো ওনার পাগলামির রিপোর্ট দেখিয়ে।এছাড়াও এর বিরুদ্ধে আরো কিছু রিপোর্ট আছে’’
‘’আচ্ছা দেখো কি করা যায়’’
মাহফুজ ফোন কেটে দেয়।সে বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে এইতো একবছর হলো পুলিশের এএসপি পদে আছে।এইতো কিছুদিন সে এখানে ট্রান্সফার হয়ে এসেছে। মাহফুজ পুরনো ফাইল নিয়ে বসলো।আজলানের ফোন থেকে একটা নাম্বার সে টুকে নিয়েছে। বাংলাদেশে আসার পর এই নাম্বারেই এই অব্দি অনেকবার কল গেছে।যদিও ধরেনি কেউ।
মাহফুজ ফোন লাগায় ওই নাম্বারে। কিছুক্ষণের মাঝেই রিসিভও হয়।ওপাশ থেকে সালাম এলে মাহফুজ উত্তর দেয়।তারপর নিজের পরিচয় জানিয়ে ওপাশের ব্যক্তির পরিচয় জানতে চায়।পরিচয় জেনে আজলান সম্পর্কে সব জানায়। সহযোগিতা করতে বলে।আসতে বলে থানায়।লোকটা রাজি হয়।
ফোন রেখে মাহফুজ হাত দেয় ফাইলে।ওর নিম্নপদস্থ একলোকের কাছেই গতমাসের একটা কেইস ডিলেটস পেয়েছে। ক্রিমিনাল কেইস।তবুও আজলান বাইরে পাগলামি করছে কি করে! নিম্ন পদস্থ কর্মকর্তা এখন ভয়ে চুপ মেরে আছে।বলতে পারছে না টাকা খেয়ে হজম করেছে।আর তাছাড়া ভিক্টিম তো মরেনি।বেচেই আছে।তাহলে কিসের কেইস করবে।ভিক্টিমও তো কেইস নিয়ে আর খোঁজখবর করেনি।ওমনি পড়ে আছে।
কেইস রিড করা শেষ হওয়ার আগেই একজন লোক আসে।এএসপিকে খুঁজছে।বাইরে জানায় এএসপি নিজে ওকে ডেকেছে।মাহফুজ বাইরের কথোপকথন শুনে নিজেই উঠে আসে।বের হয় বাইরে।লোকটাকে দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘’আপনিই আযান আহমেদ?’’
‘’জি স্যার’’
‘’আসুন,ভেতরে’’
মাহফুজের পেছন পেছন আযান ভেতরে যায়।এখন সন্ধ্যা গড়িয়ে প্রায় রাত নয়টা।এই সময় সাধারণ আযান কোথাও বের হতো না। কিন্তু পুলিশের কল পেয়েই বেরিয়েছে। মাহফুজ হেয়ালি না করেই জিজ্ঞেস করে,
‘’আপনি আজলান বেহরানকে চেনেন?’’
‘’জি স্যার’’
‘’কিভাবে চেনেন?’’
আযান সব খুলে বলে।আজলানের তাকে পিএ করে হায়ার করা থেকে অদ্রির জন্য করা পাগলামি সব।তবে এড়িয়ে যায় আজলানের ক্রাইম ডিটেইলস।মাহফুজের মনে হয় আযান কিছু গোপন করছে।বার তিনেক জিজ্ঞেস করেই যখন ধমক দেয় আযান ভয় পায়।মাহফুজ বলে ওঠে,
‘’আপনার স্যার অদ্রিতা জাবিনের বাসা অব্দি চলে গেছে।তাকে বিয়ে করার জন্য পাগলামি করছে।তার পাসপোর্ট দেখে তো বুঝলাম বয়স উনত্রিশের কোঠায়। সেখানে বাচ্চা মেয়ের জীবনের পেছনে পড়ে আছে কেন?আমরা ধরতে গেলে অদ্রিকে হোস্টেজ বানিয়ে আমাদের দিকে বন্দুক তাক করেছিলো এই লোক।’’
আযান চমকায়।তার স্যার তো অদ্রিকে ভালোবাসে বলেই দাবি করে তাহলে ভালোবাসার মানুষকে হোস্টেজ বানালো কি করে!আযান আর লুকায় না।সে যত কিছু জানে সব বলে।তার সাথে থাকাকালীন আজলান যা যা করেছিলো সব জানায়।কোন থানায় কোন রিপোর্ট হয়েছিলো তাও জানায়। পরবর্তীতে মাহফুজের হাত ধরে বলে আসে,
‘’স্যার আজলান বেহরানের মানসিক সমস্যা আছে।যদি পারেন ওনার ভিসা ক্যান্সেল করে দিয়েন।ব্যবসা কইরেন তিনি যেন এদেশে আর আসতে না পারে। নয়তো বাচ্চা মেয়েটাকে ট্রমাটাইজ করে ফেলবেন উনি’’
৪০।
ভোরের আলো ফুটেছে চারদিকে।অদ্রিদের কিছুদিন কলেজ বন্ধ। তারমধ্যে ওরা পরীক্ষার আগে এমনিতেই অনেকদিন বন্ধ দিয়েছে।এই দুই তিনদিনের বন্ধে তাইতো সময় অপচয় করা যাবেনা। সেকেন্ড ইয়ার তো দেখতে দেখতেই কেটে যাবে।কত বড় সিলেবাস কিভাবে যে শেষ হবে!
ছাদে গিয়ে সকালের সতেজতাই উপভোগ করছিলো অদ্রি।তখনই জেনিয়া ফিরোজ আর আদ্রও ছাদে আসেন।একসাথে। গত চারদিন যাবৎ আদ্র দেশে ফিরলেও কেবল দুইদিন যাবৎ তারা একসঙ্গে আছেন। অবশ্য কারণটা আজাদ মীর মুর্তজা আর ওনার স্ত্রী মৌসুমী বেগম।মেয়েকে এই ভোরে একা ছাদে দেখে জেনিয়া হাসি মুখেই এগিয়ে যান।আদ্র তখনে সিঁড়িতেই দাঁড়িয়েছিলেন। বোধহয় অদ্রিকে খেয়াল করেননি।
‘’সুইটহার্ট এতো সকাল সকাল ছাদে কি করছো?’’
‘’এমনি এলাম।ভালো লাগছিলো না।’’
জেনিয়া ফিরোজ হঠাৎ করে মেয়ের গলার দিকে তাকিয়ে দেখেন।এখনো কালচে দাগ পড়ে আছে।তবে ঘাড়ের দিকে।ফর্সা ত্বক হওয়ায় তা উজ্জ্বল।জেনিয়া ফিরোজ আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করেন,
‘’বার্ড তোমার ঘাড়ে কালচে দাগ পড়লো কি করে?দেখে মনে হচ্ছে পুরনো।’’
অদ্রির মনে পড়ে।আজ থেকে কম হলেও দশদিন আগে অদ্রি আজলানের দেওয়া চেইনটা টেনে খুলে ফেলেছিলো।তখনই ঘাড়ে দাগ পড়ে।এখনো যে সেই দাগ রয়ে গেছে অদ্রি খেয়াল করেনি।করবে কি করে!ঘাড়ের পেছনে কি আর দেখা যায় নাকি।অদ্রি বলে ওঠে,
‘’মাম্মা চেইন পড়েছিলাম। কিন্তু খুলতে পারছিলাম না বলে পড়ে টেনেটুনে খোলায় ঘাড়ে দাগ পড়েছে।’’
‘’এমন কেউ করে?এখন যে দাগ হয়ে গেল।বোকা মেয়ে’’
আদ্রের কন্ঠ শুনে অদ্রি তাকায়।অদ্রির হঠাৎ করে কি হয় ওই জানে।ও কান্না করে ওঠে।আদ্র ঘাবড়ে যায়।তার ছোট কথায় তার মেয়ে কান্না করছে!দ্রুত মেয়ের কাছে যায়। মানানোর চেষ্টা করে।জেনিয়াও মেয়ের কান্না দেখে উতলা হয়ে পড়ে।অদ্রি যেন তাদের ছোট্ট বাচ্চা।যেই বাচ্চার হাসিতে বাবা-মা হাসে,আবার কান্নায় বাবা-মা উতলা হয়ে পড়ে।
অদ্রি মনে হতে লাগে আজ যেন সব অভিমান, অভিযোগ তুলে ধরা যায়।আজ বাবা-মাকে খুব করে বকা দেওয়ার দিন।আজ যেন বাবা-মাকে ভালোবাসি বলার দিন।কি হলো অদ্রির কে জানে!সে কেবল এতোটুকুই জানে বাবা-মা তার কাছে ফিরে এসেছে।যা গেছে তা নিয়ে পড়ে থাকলে বোধহয় এই সময়টাও হারিয়ে যাবে।ওরা দোষ করেছে তাই বলে কি অদ্রি নিজের জীবনের বাকি সময়টাও অভিমানে, অভিযোগে কাটাবে?না,সে তো ভালোবাসায় কাটাতে চায়।অদ্রি বাবা-মায়ের সাথে থাকতে চায়।
‘’মাম্মা-পাপা তোমরা কেন আমার রেখে চলে গিয়েছিলে?জানো আমার ছোটবেলা কোনো বন্ধু হয়নি।সবাই বলতো আমি অপয়া, অলক্ষ্মী তাই তোমরা চলে গেছো।কেউ খেলতে নিতো না।বলতো আমার সাথে খেললে নাকি ওদের ক্ষতি হবে।রিয়ান ছাড়া কেউ খেলতো না।পরিবার ছাড়া কেউ বুঝতো না’’
জেনিয়া-আদ্রের চোখ ছলছল করে ওঠে। তাদের মেয়েটা তাদের কারণে কতোই না কষ্ট পেয়েছে।জেনিয়া-আদ্র দু’জনেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। নিজেদের সম্পর্কটা নাহয় মেয়ের খাতিরে মধুময় করবে! ভালোবাসা বোধহয় কখনো ছিলো না।তবে ভালোলাগা, পছন্দ সবই ছিলো। এখনো বোধহয় তা হৃদয়ের কোথাও রয়ে গেছে একে অপরের খাতিরে।সংসার ভালোবাসা ছাড়াও করা যায়।তবে ভালোবাসা সংসারে প্রাণ,সুখ,শান্তি দেয়।
‘’সোনা মাম্মা-পাপা প্রমিস করছে আর কখনো তোমায় ছেড়ে কোথাও যাবেনা।কোথাও না।এই কথা দিচ্ছি যে আমরা একসাথে থাকবো।একত্রে থাকবো’’
আদ্র-জেনিয়া একত্রে বলে ওঠে।অদ্রির কান্না তখনে থামেনি।আদ্র মেয়ের কান্না থামাতে মজা করে বলে ওঠে,
‘’জেনিয়া দেখেছো আমাদের অদ্রি কেমন কান্না করছে?একদম লাল টমেটো হয়ে গেছে।এখন থেকে আমি জোর করে ওকে কান্না করাবে বলে দিলাম’’
বাবার কথায় অদ্রি হেসে ওঠে।চোখে জল নিয়েই সে হাসছে।চোখ জলজল করছে। পাখিরা আকাশে উড়ে যাচ্ছে। বোধহয় খাদ্যের খোঁজে।পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ আসছে।সূর্য্যি মামা তার আলোতে পৃথিবী আলোকিত করছে। উত্তাপ ছাড়ছে।ভোরের সোনালি আভা ছড়িয়ে এখন রোদ।আর সেই রোদ্দুরে মান অভিমান গলে গেল যেন।
চলবে?