প্রনয়ের বাকবিতন্ডতা পর্ব-১৫+১৬

0
10

#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#১৫তম_পর্ব
#বর্ষা
৪১।
দিনটা শুক্রবার।আদালত বন্ধ থাকে শুক্র,শনি।দুইদিনই এখানে কাটাতে হবে আজলানকে। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই সে আছে এখানে।এখন নিরব।ফোনের চিন্তা করছে সে।আরমান কল দিয়ে না পেলে অভিমান করবে।সে চিন্তায় সে পাগল।আবার আরেকদিকে তার রাগ হচ্ছে অদ্রির পরিবারের ওপর।ওর মনে হচ্ছে সবাই অদ্রিকে ফুঁসলিয়ে ফাসলিয়ে ওর বিরুদ্ধে নিয়েছে।ওর মনে হচ্ছে অদ্রি ওকে ভালোবাসে, কিন্তু সবার প্ররোচনায় সে গা ভাসিয়েছে। কিন্তু এগুলো সে কাকে বলবে!সে যে মনের ভাব ভালো করে প্রকাশ করতে পারছে না। পুলিশটা তো তার কথা শুনছেই না।তার দেশে হলে এতোক্ষণে এই পুলিশকে সে নাকানিচোবানি খাওয়াতো।লয়্যার তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হতো।

‘’স্যার’’

আযানকে দেখে আজলান অবাক হয়।সে যে এখানে তা তো আযানের জানার কথা না।আযান একটা চেইন আজলানের দিকে এগিয়ে দেয়।আজলান অবাক হয়না।আযান তাকে জানিয়েছিলো অদ্রির চেইন ফেরত দেওয়ার কথা। আযান বলে ওঠে,

‘’স্যার আপনার উচ্চবংশীয় ব্যক্তিত্ব‌। কেন একটা বাচ্চা মেয়ের পেছনে পড়ে আছেন?মেয়েটা জীবনে কম ঝামেলা পোহায়নি।ওকে ছেড়ে দিন। শুধু শুধু ওর জীবনটাকে আপনি জাহান্নাম করে তুলছেন।মেয়েটা ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে।কবে জানি সুই…’’

‘’চুপ,একদম চুপ।এখান থেকে যা তুই।আর একটা বাজে কথা বললে এখানেই গেঁড়ে ফেলবো’’

আযান সরে আসে।চেইনটা দিতে পারায় বোধহয় বুক থেকে একটা বোঝা কমলো।একটু বানিয়ে বানিয়েও বললো। যতদূর বুঝেছে এই লোককে দিয়ে কাজ করাতে হলো মিথ্যের আশ্রয় নিতেই হবে‌।তাইতো অদ্রির ক্ষতি হচ্ছে এমন নাটক রটলো।

আজলান মেঝেতে বসে পড়ে।হাতে সেই চেইনটা। ডায়মন্ডের ছোট একটা পাথর আছে।চেইনটার ঘ্রাণ নেয় আজলান।ওর মনে হয় অদ্রির ঘ্রাণই ও পাচ্ছে।ওর হঠাৎ খারাপ লাগা শুরু হয়।নিজেকেই দোষারোপ করতে লাগে।অদ্রির থেকে দূরে থেকেও যদি অদ্রিকে একঝলক দেখা যায় তাতেও ও খুশি হবে। কিন্তু ওর জন্যে যদি অদ্রিই না থাকে তাহলে ও কি করে বাঁচবে,কি করে নিজেকে ক্ষমা করবে। কতগুলো প্রশ্ন ঘিরে ধরে আজলানকে।

আজলানের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়।ওর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা যখন মারা গেলও তখনও ও কাঁদতে পারেনি।ভাইয়ের মৃত্যুতে ও পাথর বনে দাঁড়িয়ে ছিলো। কিন্তু আজ একটা মেয়ের জন্য কাঁদছে।যেই সেই কান্না নয় বরং নিরব কান্না।পুরুষের নিরব কান্না,নারীর চিৎকার করে কাঁদার চেয়েও ভয়াবহ। পুরুষ কাঁদতে পারেনা,হয়তো সমাজের ভয়ে নয়তো আত্মসম্মানের ভয়ে। কিন্তু যখন পুরুষ নিজেকে একেবারে নিঃস্ব ভাবে,ভাবে তার চাওয়া-পাওয়ার সব শেষ তখন সে কাঁদে।আজলান কাঁদছে।

৪২।

আজ রবিবার।সূর্য্যিমামার দেখা পাওয়া যায়নি।সকাল থেকেই বৃষ্টির ছোঁয়া।এখন তো তাও বিকেল হলো বলে।অদ্রিরা আদালত থেকে ফিরেছে তাও দেড় ঘন্টা।রায় হয়েছে আজলানের বিরুদ্ধে।সে একটা কথাও বলেনি।সে নিজে থেকেই প্রস্তাব দিয়েছে তুরস্কে ফিরে যাওয়ার। আদালতের কাছে ক্ষমা চেয়েছে তার পাগলামির জন্য।আদালত তার স্বীকারোক্তিতে এবং নিজের করা অন্যায়গুলোর পরিবর্তে ভিক্টিমদের সাহায্য প্রদান করায় তাকে ক্ষমা করেছে।ভিক্টিমরা কেউ সাধু ছিলো না।তাইতো আজলানের শাস্তি হয়নি।যা হবার ছিলো তা তো আজলান নিজ থেকেই করলো।নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আর্জি করলো।

শেষ বিদায়ের মুহূর্তে আজলান তাকিয়ে ছিলো অদ্রির দিকে।রিয়ানের ভালো লাগেনি।তাইতো অদ্রির সামনে গিয়ে সে দাঁড়িয়েছিলো।আজলান দেখেছিলো।মুচকি হেসে ছিলো কেবল। বোধহয় বুঝেছিলো অদ্রির জন্য কেউ আছে।যে অদ্রিকে বেশ ভালো ভাবেই আগলে রাখতে পারবে।

সেদিন রাতেই আকাশে উড়েছিলো সে।টাকা থাকলে বাঘের দুধও পাওয়া যায় এমন বোধহয় একটা প্রবাদ ছিলো।তেমনি আজলান আজই ফ্লাইটের ইমার্জেন্সি টিকেটও পেয়েছিলো। তুরস্কে ফিরে যাচ্ছে সে।পেছনে ফেলে যাচ্ছে এমন একজনকে যাকে সে ভালোবাসে তবে হারাতে চায়না। ভাগ্যে জোটার হলে বোধহয় সে কিছুবছর পরে জন্মাতো নয়তো অদ্রি কিছু বছর আগে জন্মাতো।বয়সভেদে ভালোবাসা যায় তবে অনেক ক্ষেত্রেই বয়সের ফারাকে আগলে রাখা যায়না।

আজলান তার ভাবনা নিজেকে বোধহয় ভেবেই দেখেনি।সে যে বিবাহিত।হোক কারো কসম কাটিয়ে আর যেভাবেই।সে বিবাহিত।বয়স কোনো সমস্যা না এমনটা কথা নয়।বয়সও একটা বাঁধা তবে সবচেয়ে বড় বাঁধা তার বৈবাহিক অবস্থা।সে বিবাহিত।আর কেউই তার আদরের রাজকন্যাকে কোনো বিবাহিত ছেলের জীবনে সেকেন্ড অপশন হতে দিতে চায় না। কোনো মেয়েই তার স্বামীর জীবনে সেকেন্ড অপশন হতে চায়না।

৪২।

বাড়ি ফিরে অদ্রি ছাদে গিয়েছিলো। আকাশটা সুন্দর। সারাদিন বৃষ্টি হলেও আকাশে আজ ঝলমলে তাঁরা আর চাঁদের উপস্থিতি।অদ্রির ইচ্ছে করে গান গাইতে। কিন্তু আলসেমি লাগে ভায়োলিনটা নিয়ে আসতে।তাইতো খালি গলায় গান গাইতে লাগে।

‘’ইউ’আর মাই হানি বানচ
সুগার পাম,
পাম্পি-আম্পি-আম্পকিন
ইউ’আর মাই সুইটি পাই….’’

অদ্রির গান নিরবেই মনোযোগ দিয়ে শোনে রিয়ান।গানটা বাড্ডি কেস্টেলের দ্যা কাপ্পি কেক।অদ্রির প্রিয় একটি গান।যদিও ওর ভাষ্য অনুসারে ওর প্রিয় ব্যক্তিত্ব রিয়ান হলেও ভালোবাসার মানুষ নয় সে।প্রিয় ব্যক্তিত্ব তো অনেক হতে পারে তবে ভালোবাসা তো কেবল একজনই হয়।

‘’কার ওপর তোর এতো ভালোবাসা উতলে পড়ছে রে?আজলান বেহরান চলে যাচ্ছে বলে দুঃখে এই গান গাচ্ছিস নাকি?’’

‘’রিয়ানের বাচ্চা ফালতু বকবক করলে খুব খারাপ হইবো…’’

ওদের ঝগড়ার মাঝেই নিচ থেকে সোর-সারাবা শোনা যায়।রিয়ান আর অদ্রি দুইজনেই একপ্রকার দৌড়ে নিচে আসে।আয়েশা সিদ্দিকা এসেছেন।সঙ্গে আরিয়াও আছে।হ্যান্ড ব্যাগ।লাগেজ নেই।হয়তো ঘন্টাখানেকের জন্য আসা। জেনিয়া ফিরোজের সাথেই মূলত তর্ক করছেন তিনি।আয়েশা সিদ্দিকার কয়টা কথা অদ্রির কানে লাগলো খুব করে।

‘’তোমার মেয়ে তোমার মতনই হয়েছে।ছেলে নাচিয়ে বেড়ায়।তুমি আঠারো বছর আগে কেন গেছিলে জানিনা বুঝি! নিশ্চিত কোনো ছেলের চক্করে।তোমার…’’

‘’ফুপি আপনার মেয়ে কেমন সেদিকে নজর দিন।অন্যের মেয়ে নিয়ে পড়ে থাকলে নিজের মেয়ে কোথায় টেম্পু চালায় তা তো চোখে পড়বে না’’

অদ্রি কিছু বলার আগেই রিয়ান বলে ওঠে।জেনিয়া ফিরোজ রিয়ান আর অদ্রির দিকে একবার দেখেন।আদ্র এখানে নেই।হয়তো ঘরে।ঘরে থাকলে এখনো আসলো না কেন!অদ্রির রাগ লাগে নিজের বাবার ওপর।সে কেন বাইরে এসে নিজের বোনকে কিছু বলছে না!রিয়ানের কথায় ততক্ষণে তেতে গেছেন আয়েশা সিদ্দিকা।রেগে মেগে বলে ওঠেন,

‘’তুইতো আমার মেয়ের বিরুদ্ধে এখন কথা বলবিই।নষ্টার সাথে ঘুরলে তো এমন হবেই।এই মেয়েকে নিয়ে আবার আদালতে দৌড়াদৌড়ি ছিঃ ছিঃ ‘’

‘’আয়েশা,আর একটা বাজে কথা বললে তোকে আমি থাপ্পড়ে সোজা করবো।অদ্রি আমার নাতিন।ও কেমন তা আমি খুব ভালো করেই জানি।তোর থেকে আমায় জানতে হবেনা’’

আজাদ মীর মুর্তজা এখন বাসায় ছিলেন না।দরজায় দাঁড়িয়ে আয়েশা সিদ্দিকার শেষ কথাগুলো তিনি শুনেছেন।তারই প্রতিবাদ করলেন।এই বাড়িতে আয়েশার কথার অনেক মূল্য।তাইতো ফাতেমা চুপ ছিলেন।ওনার স্বামী আবারো কাজে চলে গেছে।ছুটি শেষ।বিয়ের পর স্বামীই হলো একজন নারীর শক্তি। সেনাবাহিনীর জেনারেলের স্ত্রী হওয়া তো এতোটাও সহজ নয়।তবে স্বামীর অনুপস্থিতিতে নারীকে তার সন্তানদের আঁকড়েই কোনমতে বাঁচতে হয়।শশুরবাড়ির মানুষগুলোর সাথে ঝামেলায় জড়ানো যায় না।

কথায় কথায় আয়েশা আরো কথা তোলেন।তিনি বলেন অদ্রির চরিত্রে সমস্যা তা ধামাচাপা দিয়ে জেনিয়া নাকি সেদিন আরাভের সাথে অদ্রির বিয়ে দিতে চাননি।অদ্রির সতিত্ব নেই।আপনদের মাঝে বিয়ে হলে সব জানাজানি হবে বলেই জেনিয়া নাকোচ করেছে।মা-মেয়ে এক ইত্যাদি ইত্যাদি।ঠিক এসব কথার শেষ মুহূর্তে ব্যাগপত্র হাতে উপস্থিত হয় আদ্র।তিনটা ব্যাগ এনে রাখে ড্রয়িংরুমের সোফার পাশে।একটা সোল্ডার ব্যাগ আর বাকি দুটো লাগেজ।আদ্র কাউকে কিছু না বলে অদ্রির কাছে যায়।ওর হাতটা নিজের হাতের মাঝে বন্দী করে মাথা নুইয়ে ফেলে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে,

‘’সুইটি আমরা অনেক বড় ভুল করেছি তোমায় রেখে চলে গিয়ে।আমি আমার ভুলগুলো প্রতিনিয়ত বুঝতে পারছি।তবে আর না।বাবা তুমি আজ আমাদের সাথে এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাবে।তুমি,আমি তোমার মাম্মাকে নিয়ে আমরা চলে যাবো’’

আদ্রর কথায় যেন বাজ পড়লো ওখানে।সবাই জানে আজাদ মীর মুর্তজার কত আদরের অদ্রি। মরিয়ামের বিয়ের পর অদ্রিই তো এই বাড়ি এক আদুরিনী ছিলো। মরিয়াম বছরে আসে এক কিংবা দু’বার।এর বেশি না।তাও যখন মিরাজুল করিম আসেন তখন আসে।

আদ্র অদ্রিকে নিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলে অদ্রি আমতা আমতা করতে থাকে।তখন আদ্র বলে ওঠে,
‘’তোমার মাম্মা খুব কিছু আনেনি।এইযে এই লাগেজে তোমার মাম্মার জিনিসপত্র আর এটায় তোমার কিছু কাপড়চোপড়, পাসপোর্ট, জন্মনিবন্ধন আর সার্টিফিকেট’’

‘’আদ্র তোর যেখানে মনচায় যা।তবে আমার নাতিনরে নিয়ে তুই কোথাও যাইতে পারবি না’’

আজাদ মীর মুর্তজা সামনে এসে দাঁড়ান।অদ্রির কান্না পায়।এই রাতবিরেতে কি শুরু হলো!এর মাঝেই আয়েশা সিদ্দিকা বলে ওঠেন,
‘’নাটক শুরু করছে’’

তখন আর সহ্য করতে পারেন না আদ্র।বড় বোন বলে ছাড় দিচ্ছিলেন।তবে আর না।যদিও কোনো মামাই ভাগ্নির বিরুদ্ধে কথা বলেনা কিন্তু কথা যখন নিজের নির্দোষ মেয়ের বিরুদ্ধে হয় তখন কোনো বাবাই চুপ থাকেনা।আদ্র বলে ওঠে,

‘’তোমার মেয়ের কারণে আমার মেয়েকে সাফার করতে হয়েছে।তোমার মেয়ের এতো যদি অন্যকে ম্যাসেজ দেওয়ার ইচ্ছা করে তাহলে অন্যের আইডি দিয়ে কেন দেয়? নিজের আইডি দিয়ে দিতে পারে না!মেয়েকে সামলাও। বাংলায় একটা শব্দ আছে কুড়কুড়ানি, না আটকালে দেখবে কবে যেন তোমার মান ইজ্জত খেয়েছে।আমার মেয়ের চিন্তা না করে নিজেরটার চিন্তা করো’’

চলবে?

#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#১৬তম_পর্ব
#বর্ষা
৪৪।
এইচএসসি পরীক্ষা আসতে হাতে খুব বেশি সময় নেই।অদ্রি এখন একেবারে বইয়ে মুখ গুঁজে ফেলেছে।বাড়ি ছাড়া হয়নি।আজাদ মীর মুর্তজা অদ্রিকে যেতে দেননি।বরং আয়েশা সিদ্দিকার প্রতি রাগ দেখিয়ে বলেছেন,
‘’তোমার ইচ্ছে হলে চলে যেতে পারো আয়শা।তবে আমার নাতিনের সম্পর্কে একটা বাজে কথা আমি শুনতে রাজি না’’

আজাদ মীর মুর্তজার গম্ভীর কথায় পুরো বাড়ি যেন কেঁপে উঠেছিলো।আয়েশা সিদ্দিকা চোখের পানি-নাকের পানি এক করে বাড়ি ছেড়েছিলেন।তবে বের হওয়ার আগে অদ্রিকে অভিশাপ দিতে চুপ থাকেননি।আদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে গিয়েছেন,’’দেখবো তোর এই নষ্ট মেয়ে কি করতে পারে।দেখিয়ে দেবো আমার আরিয়ার অবস্থান’’

সেদিনের পর পার হয়েছে প্রায় ছয় মাস।আদ্র-জেনিয়া আমেরিকা ফিরে গিয়েছেন।কাজকাম তো বাদ দেওয়া যাবেনা।তবে হ্যা এখন নিত্যদিন কথা হয় অদ্রির সাথে।আদ্র জেনিয়া একসাথেই আছেন এখন।মিডিয়া পাড়ায় কয়দিন তুমুল তোলপাড় চলেছিলো আদ্রকে নিয়ে।তারপর সব শান্ত। ইতিমধ্যে আদ্র নতুন একটা মুভিতে হাত লাগিয়েছে। ইচ্ছে আছে এরপর থেকেই নিজেই মুভি মেক করবে।কম টাকা তো থামায়নি।সফলতা কোনো নির্দিষ্ট মাকামে থামেনা।সফলতা তার গতিতে নতুন নতুন পর্যায় যুক্ত করে।

রাত নয়টা।সেই বিকেলে বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকেছে অদ্রি।আর বের হয়নি। রাতের খাওয়াটাও এখনো হয়নি।অদ্রির ফোনটা বেজে ওঠে।লস অ্যাঞ্জেলেসে এখন রাত আটটা।বাবা-মা দুজনই বোধহয় ফ্রি হয়েছে।অদ্রি কল ধরে।বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,

‘’হ্যাপি এনিভার্সিরি মাম্মা-পাপা’’

‘’থেঙ্কস সুইটি’’

বাবা-মায়ের সাথে দুষ্টু মিষ্টি কথায় অদ্রির সময়টা আগায়। বাংলাদেশে যখন রাত নয়টা সাতাশ ঠিক তখন ফাতেমা জোহরা অদ্রিকে ডাকেন।রাতের খাবার খেতে।অদ্রি বাবা-মাকে বিদায় জানায়।

খাওয়ার টেবিলে সবাই চুপচাপ।কয়েকটা চেয়ার বাদে সবগুলোই ফাঁকা।মোয়াজ বাড়িতে নেই।তার চাকরি হয়েছে।সেই সুবাধে সে এখন রাজশাহীতে গেছে। রাজশাহীর মানুষ চাকরির খাতিরে আসে ঢাকাতে আর সে চাকরির খাতিরে গিয়েছে রাজশাহীতে!আজাদ মীর মুর্তজার একপাশের চেয়ারে অদ্রি বসেছে আরেকপাশে রিয়ান।রিয়ানের পাশে বসেছেন মৌসুমী বেগম।খাবার বেড়ে দিয়ে ফাতেমা জোহরা নিজেও বসলেন।বাড়িতে আপাতত এই কয়জনই আছেন।বাকিরা যে যার অবস্থানে!

‘’জাবিন বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা হয়?’’

‘’হ্যা দাদা,আজ বাবা-মায়ের বিশতম বিবাহবার্ষিকী গেলো। শুভেচ্ছা জানালাম’’

‘’দেখতে দেখতে কতগুলো বছর গেলো ওদের। তারমধ্যে কেবল দুটো বছর একসাথে ছিলো ওরা’’

মৌসুমী বেগম দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।তার ছোট ছেলেটা গোয়ার হয়েছিলো। মাঝেমধ্যে সব কথাই শুনতো আবার মাঝেমধ্যে এমন করতো যা বলার বাইরে।গোয়ারামির সীমা অতিক্রম করতো।এই যে এতো বছর বাদে ছেলে আসলো।তিনি ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কাঁদবেন তারও জো নেই।আদ্র বলে বলেছিলো যে আম্মা আমি আসছি তুমি কই খুশি হবা তা না কেঁদে কেটে দুঃখ দেখাইতাছো।চলে যাবো নাকি!

খাওয়ার টেবিলে চুপচাপ খাওয়া যায় না।তেমনি কোনো না কোনো কথায় কথা উঠেই আসে।এই যে অদ্রি হিচকি তুলছিলো তখনই রিয়ান মজা করে বলে উঠলো,

‘’কিরে কি চুরি করছোস?’’

‘’তোরে’’

‘’ছিঃ অদ্রি ছিঃ।আমার মতন মাসুম বাচ্চারে তুই কেমনে চুরি করলি?’’

‘’তুই আর মাসুম হা!আস্তো এক শয়তান।’’

দুইজনের কথা কাটাকাটির মাঝে মৌসুমী বেগম হুট করে বলে ওঠেন,
‘’দুই ফাজিলের চারহাত এক করলে ভালোই হবে।কাছেই থাকবে দুটোতে।বাড়িটা এমনই হাস্যোজ্জ্বল থাকবে’’

মৌসুমী বেগমের বলতে দেরি হলেও অদ্রির টেবিল ছেড়ে রান্নাঘরে যেতে দেরি হয়নি।ওর মনে আশঙ্কা ছড়িয়েছে।ওর নিজের বাবা-মাও দূরসম্পর্কের আত্মীয়। কিন্তু আত্মীয়তা গভীর হওয়ার ফলটা খুব একটা মধুর ছিলো না।অদ্রির ক্ষেত্রে তো একেবারেই না।সে এই ভুলের প্রমাণ দেখেও কিভাবে রিয়ানের সাথে জড়াবে!

৪৫।
ছয়টা বছর এগিয়ে যাওয়া খুব সহজ ছিলো না।অদ্রির জন্য তো একেবারেই না।নিজের স্বপ্নকে ছেড়ে সে উড়ে বেরিয়েছে এখান থেকে ওখানে। বাবা-মায়ের রাজকন্যা নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন সাজিয়েছে।সেই স্বপ্নের রাজ্যে সেই এক বুক আশা নিয়ে জয় করতে পেরেছে বিশ্ব।বাবা-মাকে ছাড়িয়ে আরো একধাপ ওপরে ওর বিচরণ।হুট করেই মেডিকেলের স্বপ্ন ছেড়ে ট্রেকিং করা, ওয়াইল্ড পিকচার তোলা আর গান গাওয়াতে ফোকাস করা শুরু হয় ওর। পড়াশোনা ওই এইচএসসি অব্দিই ভালো মতন হলো।তারপর গ্রাজুয়েশনের নামে ফটোগ্রাফি এবং ইমেজিং-এ ব্যাচেলর অফ ফাইন আর্টস করলো।সাইন্সের ছাত্রী হুট করেই স্বপ্নকেই বাদ দিয়ে উড়লো।

আপাতত পিরুতে আছে সে।একটা ইন্টারন্যাশনাল প্রতিযোগিতার জন্যই এখানে আছে সে।এবার সেখানে তারও ছবি যাবে। মনের মতন একটা ছবির খোঁজে আকাশ পাতাল এক করছে সে।বিগত পাঁচবছর সে লস অ্যাঞ্জেলেসে নামমাত্র থাকলেও বিদেশ ভ্রমণটা বেশ ভালো মতনই করেছে।

সামনেই সবুজ রেখার শেষ।অদ্রি শুয়ে পড়ে সেই সবুজ রেখার ওপরই।ঘাসে ঘাসে কি সুন্দর!অদ্রি যদি লেখক হতো তবে এই দেশ নিয়ে সুরসুর করে কতই না কবিতা রটতো,গল্প বানাতো।শিল্পী হলে বোধহয় ছবি আকতো। কিন্তু অদ্রি শিল্পী নয়।ছবিতে সে এই সৌন্দর্য মন্ডিত পিরুর ছবি ফুটিয়ে তুলতে পারবে না।বৃথা চেষ্টা করে সে কেন তার সময়টা নষ্ট করবে? তারচেয়ে ভালো নয় কি এদেশের সৌন্দর্যকে ভাল মতন উপভোগ করা!

অদ্রির ফোন বাজছে।প্রকৃতির কাছে থাকলে এসব যান্ত্রিক জিনিস তখন বিরক্তিকর লাগে।যেমনটা অদ্রির লাগছে।তবুও পকেট থেকে ফোনটা বের করে।বিদেশ এসে তারও পোশাক পরিচ্ছদে পরিবর্তন এসে।একেবারে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে না রঙলেও হালকা আঁচ তো পড়েছে।রিয়ান কল করেছে। অদ্রির মনটা যেন আরো ভালো হয়।

‘’কিরে ফকিন্নি কই আছস?তোর না দেশে ফেরার কথা ছিলো গতকাল’’

রিয়ানের কথায় জিহ্বায় কামড় দেয় অদ্রি।ওরা ভিডিও কলে কথা বলছে।রিয়ান বোঝে এই পাগলে ভুলেই বসেছিলো দেশে ফেরার কথা।রিয়ান আবারো বলে ওঠে,

‘’ভাই এবার তো ফিরে আয়।আমার ইন্টার্নি শেষ।আমি মালয়েশিয়া থেকে ফিরেও এসেছি। কিন্তু তোর আসার নামগন্ধ নেই’’

‘’আসবো তো। তুই আগে ভালো মতন চিকিৎসক হ তারপর।আর হ্যা আমাকে কিন্তু ফ্রিতে চিকিৎসা দিবি নয়তো খবর আছে’’

‘’তুই আয়।তোর যা যা লাগবে সব দেবো। কিন্তু তুই আয়’’

‘’আচ্ছা যা।আগামীকাল ফিরবো।বাবা-মাও আসবে।কাউকে বলিস না। সারপ্রাইজ দিবো’’

‘’ঠিক আছে ম্যাডাম’’

‘’তুই এখন জেলাস হ।আমি তোকে পিরু দেখাচ্ছি।পিক পাঠাবোনি পরে’’

রিয়ান-অদ্রির সম্পর্ক সেই আগের মতনই আছে।সেই ঝগড়া,সেই কথাকাটাকাটি। তবে দূরত্ব!কয়েকশ মাইল।দেখা হয়না তাও কত বছর!মাঝে অদ্রি একবার মালয়েশিয়া গিয়েছিলো।তখন রিয়ানের সাথে দেখা, ঘোরাঘুরি।অদ্রির ছোট পেইজটা এখন অনেক বড় হয়েছে।তিনশ’হাজার এখন দেড় মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে।তবে অদ্রি থাকলেও অদ্রির ক্যামেরাম্যান রিয়ান তার পাশে নেই!

৪৬।
তুরস্কে দিনকাল বেশ ভালোই যাচ্ছে। আবহাওয়া সুন্দর।আরমান বড় হয়েছে।সে এখন আর নয়বছরের ছোট বাচ্চা নেই।সে এখন পনেরো বছরের কিশোর।তার ছোট বোন লাইজা এখন আটবছরের বাচ্চা। দুইজনের সম্পর্ক আগের মতনই মিষ্টি।তবে এরমধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে।লাইজা তার পাপার ভালোবাসা পাচ্ছে।

আজলান বাংলাদেশ থেকে ফেরার পর একটা সপ্তাহ সব ছেড়েছুড়ে ঘরের মাঝে বন্দি ছিলো।তারপর লাইজাকে কাছে ডেকে আদর করলো।আরমানের কপালে কপাল ঠেকিয়ে বসে ছিলো অনেকক্ষণ।তারপর থেকেই ভালোই চলছে সব।লিয়ানার সাথেও রুষ্ট আচরণ করেনি আর সে।তবে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা সেই আগের মতনই খাপ ছাড়া।এক ঘরেই দু’দুটো আলাদা বিছানা লেগেছে।আজলান মদ খাওয়াও ছেড়ে দিয়েছে।যদি আবারো দূরত্ব ঘোচে সেই ভীতিতে।

ছয় বছরে আমূল পরিবর্তন ঘটলেও আজলানের মাঝে এখনো একটা পরিবর্তন আসেনি।অদ্রিকে দেওয়া চেইনটা এখনো তার বুকপকেটে থাকে।রাতের আঁধারে এখনো সে অদ্রিকে স্বপ্ন দেখে।অদ্রির প্রতিটা ভিডিও সবার আগে সেই দেখে।নিরব দর্শক হয়ে সে এখনো অদ্রির আশেপাশে রয়ে গেছে।

‘’পাপা আই লাভ ইউ’’

লাইজা দৌড়ে এসে আজলানকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে।আজলানও আদর করে লাইজাকে।সেও বলে ওঠে,

‘’পাপা লাভস ইউ টু বেবি গার্ল’’

‘’তুমি কি ভাবছো পাপা?’’

‘’আমার অনেক প্রিয় একজন মানুষের কথা বেবি’’

‘’আমার,ভাইয়ার থেকেও প্রিয়?’’

আজলান হাসে কেবল।কোনো উত্তর সে দিতে পারে না।এই প্রশ্নের উত্তর জানলে বোধহয় ওরও মনটা শান্ত হতো। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর সে জানলেও দিতে চায়না। পৃথিবীর কাছে সে নিষ্ঠুর কম হয়নি,আর কত হবে!তার ভালোবাসা নিষিদ্ধ, বিবাহিত পুরুষের জন্য অন্য নারীর প্রতি আকর্ষণ নিষিদ্ধ।সে নাহয় পাপী হয়েই থাকলো।মন তো জানে তার ভালোবাসা কতটা শুদ্ধ।সময়, পরিস্থিতি আর অবস্থানের কারণে সে অক্ষমতা গ্রহণ করেছে।গ্লানি নেই, আফসোস নেই।কেবল একপাক্ষিক ভালোবাসাটা সারাজীবন বয়ে বেড়ানোর বোঝাটা সে আগলে নিয়েছে।

চলবে?