প্রনয়ের বাকবিতন্ডতা পর্ব-১৭+১৮

0
14

#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#১৭তম_পর্ব
#বর্ষা
৪৭।
দীর্ঘ কয়েক ঘন্টার সফর শেষে অদ্রি বাংলাদেশে পৌঁছায়।বাবা-মা আরো দেড় ঘন্টা আগেই পৌঁছেছে।আপাতত হোটেলে স্টে করছেন তারা।একসাথেই বাড়ি ফিরবেন বলে কথা।অদ্রি একই হোটেলে চেক ইন করে। বাবা-মায়ের সাথে দেখা করে ফ্রেশ হয়ে আসে।একেবারেই ডিনার করেই তারপর নাহয় বাড়ি ফেরা যাবে।এমনিতেও তো রাত নয়টা বেজেই গেছে।

খাওয়া-দাওয়ার শেষমুহূর্তে অদ্রি জানায় সে তার ফটো জমা দিয়ে এসেছে।নয়তো দুপুরেই পৌঁছাতে পারতো। বাবা-মা অদ্রির জন্য খুশি হয়। তাদের মেয়েটা এই অব্দি কম সাফল্য অর্জন করেনি।বেশ ভালো জীবন কাটাচ্ছে।নিজের মধ্যে সে ওয়ান ম্যান আর্মি গড়ে তুলেছে।

‘’পাপা কখন বের হবে?’’

অদ্রি উৎসুক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে। কতগুলো বছর পর সে দাদাবাড়ি ফিরবে।যদিও প্রথমে বাড়িটা ওর নিজের বলেই দাবি করতো ও। কিন্তু এখন কেবলই দাদা বাড়ি।

‘‘এখনই সুইটি।গিয়ে তো আড্ডা দিতে হবে ‘’

জেনিয়া ফিরোজ ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসেন।অদ্রি-আদ্র দুইজনই প্রস্তুত হয় বের হবার জন্য।জেনিয়া আসতেই তিনজন একত্রে বেরিয়ে যায় সেই পুরনো গন্তব্যের দিকে।

৪৮।

রাত দশটা।সবাই ডিনার টেবিলে বসে আছে। পরিবারে মানুষ বেড়েছে।মারিয়াম এসেছে লিয়নকে নিয়ে।লিয়ন এখন ছোট বাচ্চাটি নেই।সে এখন দশ বছরের।মিমি পাগল ছেলেটা এখন মুখ লুকায় কথা বলতে গিয়ে।হয়তো লজ্জায়।মোয়াজ বিয়ে করেছে দেড় বছর।সে সময় ছুটি না পাওয়ায় অদ্রিরা আসতে পারেনি।আজ টেবিলের চেয়ারগুলো ভরা।তবে আজও রিয়ানের সামনের চেয়ারটা ফাঁকা।সেটা যেন অদ্রির জন্য সারাজীবন বরাদ্দ থাকবে।

কলিং বেল বেজে উঠতেই একজন কেয়ারটেকার গিয়ে দরজা খুলে দেয়।যারা ভেতরে ঢোকে তাদের দেখে যেন পুরো পরিবারে হাসির ঝলকানি ফুটে ওঠে।রিয়ান খাবার রেখে ছুটে যায়।বাড়ির নতুন বউ অবশ্য চিনতে পারেনি আগত মানুষগুলো।চিনবেই বা কি করে!স্বামীর সঙ্গে প্রায় সময়টা তার কাটে এদিক-ওদিকে।দেড় বছরে দুটো জবের উছিলায় মোয়াজকে থাকতে হয়েছে রাজশাহী আর কক্সবাজার।আপাতত তার ট্রান্সফার হয়েছে কোম্পানির ঢাকার সেক্টরে।

‘’জাবিন বিদেশ গিয়ে এই বুড়োকে ভুলেই গেলি?আমার কাছে আসতে তোর এতো সময় লাগলো?’’

আজাদ মীর মুর্তজার কন্ঠে অভিমান ঝড়ছে।কথাটা সত্য বয়স বাড়লে মানুষ বাচ্চা হয়ে যায়।অদ্রি তার দাদার হাত ধরে বলে ওঠে,

‘’তোমার জাবিন তো এমনি এমনি দেরি করেনি দাদা।তাও খুব খুব সরি।তবে শোনো এবার অনেকদিন থেকে যাবো’’

‘’তোকে একেবারেই রেখে দিবো বুঝলি পাজি ‘’

ফাতেমা জোহরার কথায় সবাই হেসে ওঠেন।অদ্রি নতুন মুখ দেখে প্রথমে চিনতে না পারলেও অনুমানের বসে ভাবী বলে ডেকে ওঠে।মোয়াজ হেসে বলে ওঠে,

‘’বাহরে এতো বছর বাদে এসেও চিনে ফেললি কে তোর ভাবি!’’

রিয়ান চুপচাপ অদ্রিকে দেখছে।কথা বলার সুযোগই পাচ্ছে না।কত কথা জমেছে!রিয়ান সবাইকে সরিয়ে বলে ওঠে,

‘’আরে আরে সবাই কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে?ওদেরকে ভেতরেও আসতে দেও ‘’

সবাই সরে দাঁড়ায়।অদ্রিরা গিয়ে সোফায় বসে।তাদেরকে খেতে বলা হলেও তারা যায়নি।বলেছে খেয়ে এসেছে।এদিকে বাকিরা তাড়াহুড়োয় খাওয়া শেষ করে।প্লেটে যেটুকুন ছিলো ওতটুকুই। উত্তেজিত অবস্থায় গলা দিয়ে খাবার নামে নাকি!জেনিয়া ফিরোজ অদ্রির তোলা ছবিগুলো দেখছেন।কতো ন্যাচারাল!

লিয়ন তো আর খায়নি।সোফার হাতল ধরে অদ্রির সামনের সোফার পাশে সে দাঁড়িয়ে আছে।না আসছে কাছে আর না সরছে।অদ্রি গিয়ে জোর করে ধরে আনে লিয়নকে।বাবাকে বলে ওঠে,

‘’হায় হায় পাপা এতো অল্প বয়সে তুমি নানা হয়ে গেছো ভেবে দেখেছো!তোমার নাতির বয়স এখন দশ। আরেকজন আপকামিং ‘’

মারিয়াম লজ্জা পেলো।এই ফাজিলে এই খবর জানলো কি করে তা ভেবেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো।গতকালই কথায় কথায় রিয়ান জানিয়েছে খবর।তাইতো অদ্রি জানে।জেনিয়া ফিরোজ মেয়ের গালে হাত রেখে বলে ওঠেন,

‘’এবার তোকে বিয়ে দিয়ে দিবো।তারপর ইয়াং নানা-নানু হওয়াটা সফল হবে কি বলো আদ্র?’’

আদ্রের চোখে যেন জল আসতে নেয়।এইতো কিছু বছর হলো মেয়েকে পেলেন।এখনই বিয়ে দিতে হবে! মেয়েদের বড় হতে বুঝি সময় লাগে না।আদ্রের চুপ হয়ে যাওয়া দেখে জেনিয়া তাকে ধাক্কা দেন।আদ্রও সায় জানান তার কথায়।তবে অদ্রি তার ঘোড় বিরোধ করে বলে ওঠে,

‘’আমি স্বাধীনচেতাই থাকবো।কোনো সম্পর্কে জড়ানোর মতন ওতটা সাহপ আমার নেই।ছোটবেলার ভীতি’’

যেই সময়টা সবাই হাসিখুশিতে মেতে উঠেছিলো ওমনি সবাই চুপ করে গেলো।অদ্রি জিহ্বে কামড় দিলো।এখন এই কথাটা না জানালেই হতো।একে একে সবাই ড্রয়িংরুম একত্রিত হয়েছে।অদ্রির কথা কমবেশি সবাই শুনেছে।ওনাদের মাঝেও যেন কষ্টের স্রোত বয়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি বোধ অসুবিধাটা রিয়ানের হয়েছে।

রিয়ান গিয়ে হুট করেই অদ্রির পাশে বসে পড়ে।অদ্রি চমকে ওঠে।রিয়ানের পিঠে দুম করে এক কিল বসিয়ে দেয়।রিয়ান ব্যথায় নাক মুখ কুচকায়।অদ্রি বলে ওঠে,

‘’ধুপধাপ কাজ করিস কেন?ভয় পেয়েছি তো’’

‘’তুই আর ভয়?মজা নেস বুঝছি।তোরে দেখলে তো শয়তানের বাপ-চাচাও ভয়ে পালাইবো’’

‘’তাইলে তুই কি শয়তানের সর্দার নাকি যে এখনো আমার পাশে বসে আছোস!’’

দুইজনের ঝগড়ায় যেন পুরো বাড়িটা সেই ছয়বছর আগে ফিরে গেলো।সবাই হাসছে ওদের ঝগড়া দেখে।লিয়ন হাসতে হাসতে বলে উঠলো,

‘’এহে মিমি আর ছোট মামা বাচ্চাদের মতন ঝগড়া করছে’’

লিয়নের কথায় লজ্জা পেয়ে দুইজন ঝগড়া থামায়।তবে একে অপরকে চোখ রাঙাতে ভোলে না।দূরে থাকলে একে অপরের জন্য দুইজনের কলিজা পোড়ে। কিন্তু কাছে থাকলেই সাপ নেউলের মতন শত্রুতা এদের। মৌসুমী বেগম নাত বউয়ের সাথে অদ্রির পরিচয় করালেন।অদ্রির ভাবির নাম মায়া।মেয়েটার মুখেও কত মায়া!

৪৯।

পরদিন সকালটা সুন্দর ভাবেই শুরু হলো। একঘন্টার ব্যবধান খুব একটা প্রভাব ফেলেনি ওদের ওপর।অদ্রি সেই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই ছাদে গিয়ে বসে আছে।হাতে ছোটবেলার সেই ভায়োলিন।প্রিয় এই ভায়োলিন রেখেই সে প্রদেশে গিয়েছিলো।গিটার ধরলো,বাজালো।তবে ভায়োলিন বাজানোর মতন শান্তিটা পায়নি সে।পাখির কিচিরমিচির শব্দে অদ্রির ভায়োলিনের সুরটা যেন অপরুপ হলো।দুটো মিলেমিশে একাকার হয়ে যেন সঙ্গিতের রটনা করলো।

‘’কিরে এতো ভোরবেলা ছাদে কি করছিস?’’

মোচড়ামুচড়ি করতে করতে রিয়ান জিজ্ঞেস করলো।অদ্রি বলে উঠলো,

‘’এটা ভোরবেলা কিভাবে মনে হয় তোর?সাতটা বাজে। তুই না ডাক্তার।এখনো বাসায় কি করছিস হ্যা?’’

‘’ওহ ম্যাডাম আমরা ডাক্তার হলেও মানুষ।আর হ্যা তুই আসছিস বলেই ছুটি নিয়েছি’’

‘’আমি কি মহারানী ভিক্টোরিয়া যে আমার জন্য ছুটি নিবি?’’

‘’মহারানী ভিক্টোরিয়া কেন হবি?তুই তো আমার ঘরের রানী হবি’’

রিয়ানের কথায় অদ্রি চুপ মেরে যায়।মনে পড়ে যায় কয়েকবছর আগে রিয়ানের প্রপোজালের কথা।তখন অদ্রি খুব নরমাল ভাবেই নিয়েছিলো কথাগুলো।তরুণ বয়সে সবার মনেই রঙ লাগে।সেই রঙ খুব বেশিদিন টেকে না।বয়স বাড়লেই সেই রঙকে মনে হয় মরিচিকা,প্রিয়জনের বিপরীত।তবে রিয়ানের কথাগুলো বোঝাচ্ছে সে বোধহয় সেই রঙে এখনো নিজেকে রাঙিয়ে আছে।

‘’রিয়ান তুই কি এখনো সিরিয়াস সেই ছোটবেলার কথাগুলো নিয়ে?’’

‘’কোন কথাগুলো নিয়ে?’’

‘’ভালোলাগার..’’

‘’না।এখন তো ভালোলাগা নেই’’

রিয়ানের মুখে ভালোলাগা নেই শুনে অদ্রির যেমন ভালো লাগলো।তেমন কিছুটা খারাপও লাগলো। মনটা খারাপ হয়ে এলো।তবে কেন এমন হলো অদ্রি নিজেও জানে না।তবে রিয়ানের পরবর্তী কথার জন্যে অদ্রি মোটেও প্রস্তুত ছিলো না যেন।রিয়ান একটানে অদ্রিকে নিজের দুইবাহুতে মুড়ে একেবারে বুকের কাছে হেঁচকা টানে নিয়ে আসলো। মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো,

‘’ভালোবাসি।তোকে প্রচন্ড ভালোবাসি।’’

অদ্রি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিঞ্চিত মুহূর্ত। কিন্তু তারপরই হুট করে রিয়ানকে ধাক্কা মেরে চলে গেলো সরাসরি নিচে।রিয়ান ভয় পেলো না। যথেষ্ট বড় হয়েছে।অদ্রি যদি বিচারও দেয় তাতেও ওর ভয় নেই।বিয়ে করার মতন যোগ্যতা এখন ওর আছে।

ছাদের একপাশটায় শেওলা পরে পিচ্ছিল।রিয়ান জায়গাটা দেখলো।ভেবে নিলো কাজের লোকগুলোকে বলে জায়গাটা পরিস্কার করতে হবে।তার পাগলিটা এখানেই সময় কাটায়। উঁচ-নিচ কিছু হয়ে গেলে! রিয়ান অদ্রির ফেলে যাওয়া ভায়োলিনটা হাতে তুলে নেয়।অদ্রির ছোঁয়া লাগা সবকিছুই যেন ওর ভালোবাসার।

চলবে?

#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#১৮তম_পর্ব
#বর্ষা
৫০।
ড্রয়িংরুমে আলোচনা অদ্রির পড়াশোনা নিয়ে।জেনিয়া-আদ্রকে সবাই কিছুটা বকাঝকাই করছে।মেয়েটা মেধাবী ছিলো।কেন তাকে ডাক্তারি লাইনে না পড়িয়ে ছেড়ে দিলো এভাবে!মেয়েটার ভবিষ্যৎটাই নষ্ট হয়ে গেলো বলে আফসোসের হিড়িক পড়েছে।তখনই বাড়িতে ঢুকলেন আয়েশা সিদ্দিকা।এইতো গত দুই বছর যাবৎ আবারো যাতায়াত শুরু করেছেন।মাঝে চারবছর রাগ ধরে বসেছিলেন।এমনকি ছেলের বিয়েতেও কাউকে নিমন্ত্রণ করেননি।

‘’হাহা,কিরে কেমন আছিস আদ্র?’’

আদ্র মুচকি হেসে জবাব দিলেন।নিজেও জিজ্ঞেস করলেন বোনের হালচাল।জেনিয়া ছিলেন ফাতেমা জোহরার সাথে কিচেনে।দেশে ফিরলে রান্নাবান্নার ক্ষেত্রে না থাকাটা সমীচিন নয়।দুই জা বোধহয় গল্প করছেন ওখানে।অদ্রি-রিয়ান বাড়িতে নেই।কোথাও বের হয়েছে।

আজাদ মীর মুর্তজার পাশে গিয়ে বসলেন আয়েশা।হাতে কার্ড।বিয়ের কার্ড।বাবার দিকে এগিয়ে দিয়ে সগৌরবে বলে উঠলেন,

‘’আব্বা আরিয়ার বিয়ে।এই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। তোমরা সবাই আসবে কিন্তু।’’

কার্ড হাতে নিলেন আজাদ মীর মুর্তজা। মিরাজুল করিম বসে আছেন আরেকপাশে। আজ ভোরেই ছুটিতে এসে পৌঁছেছেন তিনি।সময় মিলিয়েই আসা।যাতে পুরো পরিবার একসাথে হতে পারে। মিরাজুল করিম জিজ্ঞেস করলেন,

‘’ছেলে কি করে?’’

‘’ছেলে ইঞ্জিনিয়ার।ঢাকাতে ভালো চাকরি।মাসিক বেতন পঞ্চাশ হাজার।সময়ের সাথে সাথে আরো বাড়বে।একজন ফার্মাসিস্টের সাথে একজন ইঞ্জিনিয়ারের মিলন খারাপ না কি বলিস আদ্র’’

‘’হ্যা হ্যা।আরিয়া ফার্মাসিউটিক্যাল সাইন্সে পড়াশোনা করেছে নাকি?’’(আদ্র)

‘’তা আর বলতে।আমার মেয়েটা এতো বুদ্ধিমান কি আর বলবো’’

‘’কিন্তু ফুপি ও তো কমার্সের স্টুডেন্ট।তাইলে সাইন্সের সাবজেক্ট পড়লো কেমনে?’’(মারিয়াম)

আয়েশার মিথ্যে ফাঁস হতেই তার মুখটা চুপসে গেলো।ভেবেছিলেন বোধহয় মিথ্যে বলে বড় সাজবেন কিন্তু পারলেন আর কই।কেউ আর কোনো রা করলো না।লিয়ন এসে সবার মাঝে হইচই করতে লাগলো।হুট করেই সে জেনিয়ার হাত ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো,

‘’আপু অদ্রি মিমি কোথায়?’’

জেনিয়াকে আপু সম্বোধনে সবাই যেন আকাশ থেকে পড়লো।এই ছেলেকে কতবার বলা হয়েছে নানি না বলে আপা অথবা নানু বলতে।কিন্তু না সে ফাতেমা জোহরা এবং আয়েশা সিদ্দিকাকে নানি বলেই সম্বোধন করে। কিন্তু জেনিয়াকে প্রথমেই আপু বলে সম্বোধন করলো!আয়েশা সিদ্দিকা ভ্রু কুঁচকে লিয়নকে কাছে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন

‘’এই ফাজিল, তুই ওকে আপু ডাকিস।আমাকে নানি বলিস কেন?’’

‘’তুমি বুড়ো।আর আপু কত সুন্দর দেখেছো!’’

এবার আর কেউ হাসি আটকে রাখতে পারলো না।হো হো করে হেসে উঠলো।আয়েশা যেন এতো অপমানিত বোধ করলেন।চোখে জল এসে পড়লো।রাগ করে উঠে যেতে নিয়ে বললেন,

‘’থাক তুই তোর আপুকে নিয়ে।আমি চললাম।কেউ আমাকে ভালোই বাসে না এখানে’’

জেনিয়া ফিরোজ নিজেই গেলেন আয়েশাকে আটকাতে। কিন্তু আয়েশা থাকবেন না।ওনার কথা একটাই যে কেউ ওনাকে ভালোবাসে না।আদ্র কিছু বললো না।ছোটবেলায় দেখেছে তার এই বোনের কতশত নাটক।

মারিয়াম লিয়নকে ধমকে বলে ওঠে,’’দেখলি তোর জন্য ফুপি রাগ করে চলে যাচ্ছেন।যা সরি বলে।আর আপু বলে ডাকবি’’

‘’সরি বলতে পারি।তবে আপু বলতে পারবো না ‘’

দৌড়ে লিয়ন গেলো আয়েশা সিদ্দিকার কাছে।হাত ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো,’’নানি আ’ম সরি।ডন্ট গো প্লিজ’’

৫১।
ঢাকার শহরে কত পরিবর্তন এসেছে।তাও অদ্রির যেন অনেক চেনাজানা এখনো আছে।এইযে ঘুরছে,উড়ছে পাখির ন্যায়।রিয়ান তো কেবল পাহাড়া দিয়ে চলেছে।অদ্রি এটা ওটা খাচ্ছে আর বলছে,’’জানিস এটাকে কত মিস করেছি’’

হাঁটতে হাঁটতে একটা পয়েন্টে এসে অদ্রি মুখোমুখি হয় আযানের।হ্যা এই মানুষটার মুখ ওর চেনা।আযানের কথা মাথায় আসার সাথে সাথেই আরেকটা চেহারা ভেসে ওঠে অদ্রির মস্তিষ্কে —আজলান বেহরান।ছয় বছরে কি একবারও সে এদেশে আসেনি,একবারও কি অদ্রির খোঁজ করেনি এই মানুষটার কাছে।কি জানি।অদ্রি স্বেচ্ছায় গিয়ে সালাম দেয় আযানকে।আযান চমকে ওঠে।উত্তর নেয়।

‘’কেমন আছো ছোট আপু?’’

‘’আলহামদুলিল্লাহ,আপনি কেমন আছেন ভাইয়া?’’

‘’ভালো’’

‘’বাচ্চাটা কি আপনার?’’

‘’হ্যা,ওর নাম আহান’’

অদ্রি আহানকে কোলে নেয়।আদর করে দেয়।বাচ্চাটার বয়স কত হবে?দুই কিংবা তিন।কি সুন্দর অদ্রির সাথে গল্প করছে।ভাঙা-ভাঙা কন্ঠে কতকিছু বলছে।অদ্রি বাচ্চাটার সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটায়।হুট করে কি মনে করে যেন অদ্রি আযানকে জিজ্ঞেস করে,

‘’আজলান বেহরান কি আর এদেশে আসেনি?’’

আযান দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে হালকা হাসে।বলে ওঠে,
‘’তুমিই তো দেশে ছিলে না’’

অদ্রি আর কিছু জিজ্ঞেস করেনা।ব্যাগ থেকে বের করে আহানের হাতে কিছু চকলেট দিয়ে আযানকে বিদায় জানায় সে।ততক্ষণে রিয়ানও অদ্রিকে খুঁজতে খুঁজতে চলে আসে এদিকে।ফুচকার দোকানে দাঁড়িয়ে ছিলো সে।ফুচকা অর্ডার করেই ভীড় দেখে এদিকে চলে এসেছিলো অদ্রি। বোধহয় ফুচকা দিয়ে দিবে তাই রিয়ান ওর দিকেই আসছে।অদ্রিকে ফিরতে দেখে রিয়ান আবারো দোকানের দিকে ফিরে গিয়েছে।অদ্রি একবার রিয়ানের যাওয়া দেখে,আবার আজলানের কথা ভাবে। পরমুহূর্তেই ওর মুখে হাসি ফোটে।নিজেই নিজেকে বলে ওঠে,

‘’আমি সত্যিই ভালোবাসার যোগ্য।এখনও হয়তো দূরদেশে বসেও কেউ আমায় ভালোবাসছে।যার ধরাছোঁয়ার অতীত আমি’’

ফুচকার দোকানে যেতেই রিয়ান ওকে ধমকে ওঠে।দেশে ফিরে ওর ঘোরাঘুরি বেশি হচ্ছে এই বলে ওকে।অদ্রি দাত কেলিয়ে হাসে।রিয়ানের মুখে একটা ফুচকা ঢুকিয়ে দেয়।রিয়ান ফুচকা মুখে নিয়েই ওকে বকতে থাকে।

ফুচকা খেয়ে গাড়ির কাছে এসে দাড়ায় ওরা।রিয়ান ওর জন্য দরজা খুলে দেয়।অদ্রিকে গাড়িতে গিয়ে বসে।রিয়ানও গাড়িতে এসে বসে।ড্রাইভ করতে শুরু করে।তখনই অদ্রি বলে ওঠে,

‘’যতদিন আছি বকেনে।কয়দিনই তো বাংলাদেশে আছি।তারপর আবারও কোনদেশে থাকবো কে জানে’’

রিয়ান গাড়ি থামিয়ে দেয়।অদ্রির দিকে ঝুঁকে এসে বলে ওঠে,’’তোকে আমি কোথাও যেতে দেবো না।আর গেলেও আমার হয়ে তারপর যাবি’’

অদ্রি রিয়ানকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়।রিয়ান ড্রাইভ করতে শুরু করে।অদ্রি বাইরে তাকিয়ে কোলাহল দেখছে।গাড়িটা জ্যামে আটকাতেই অদ্রি বলে ওঠে,

‘’রিয়ান আমি সাইক্রাটিস্ট দেখিয়েছে বিগত কয়েকবছর।এখনো আমার ট্রমা কাটেনি।এখনো বিয়েতে আমার ভয়।তবে সবচেয়ে বড় ভয় কিসে জানিস?’’

রিয়ানের কৌতুহলী দৃষ্টি।অদ্রি বড় একটা দম নিয়ে বলে ওঠে,’’আত্মীয়তার মাঝে আত্মীয়তা কড়ায়’’

‘’কি বলতে চাস ভালো মতন বল’’

‘’রিয়ান আমার মাম্মা-পাপা কিন্তু কাজিন। আমাদের দাদার কাজিন কিন্তু আমার নানি।আবার দাদার বন্ধু কিন্তু আমার নানা।তারা তাদের সম্পর্ককে মজবুত এবং ছেলে-মেয়েকে ভালো রাখতে গিয়ে বিয়ে দিলো।দেখেছিস তাদের একটা ভুল আমার জীবনকে কি করে দিয়েছে!আমি সত্যিই জানি না আমার এই ভয় কখনো দূর হবে কিনা।আমি চাই না আমার কারণে ভবিষ্যতে কেউ আমারই মতন কষ্ট পাক।ছয়টা বছর আমি চেষ্টা করেছি আমার অনুভূতি জানার।প্লিজ আমাকে জোর করিস না’’

রিয়ান থমথমে মুখে বসে থাকে। কিছু বলে না।জ্যাম ছেড়েছে।সে গাড়ি ড্রাইভ করতে থাকে। হঠাৎ করে অদ্রিকে জিজ্ঞেস করে,

‘’তোর অনুভূতির নাম কি?’’

অদ্রি কিছুক্ষণ রিয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিছু বলে না।তবে সে জানে তার অনুভূতির নাম —ভালোবাসা। কিন্তু এই কথাটা রিয়ানকে বললে সে অদ্রির জন্য অপেক্ষায় থাকবে। নিজের জীবনটাকে সে আগিয়ে নিতে পারবে না।অদ্রির ভীতি কাটতে আরো কত সময় লাগবে কে জানে!আদৌ কাটবে তো?

বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা বাজে ওদের।সেই গাড়িতে কয়েকটা কথা হলো।তারপর নিরবতাই ছেয়ে ছিলো।গাড়ি থেকে নামার সময়ও কেউ কারো সাথে কোনো কথা বলেনি।রিয়ান নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।অদ্রি দেখে।মনে মনেই বলে ওঠে,
’’কয়েকদিন তোর খুব খারাপ লাগবে রিয়ান। কিন্তু বিশ্বাস কর এই অনুভূতিকে আস্কারা দিলে সব এলোমেলো হয়ে যাবে।আমি এলোমেলো হয়ে যাবো।আমি খুব স্বার্থপরতা করছি জানি। কিন্তু আমি পারবো না আমার ভীতির এই জীবনে তোকে জড়াতে’’

রিয়ান ঘরে এসেই দরজা আটকে দেয়।বড় পোট্রেটের ছবিটা ঘোরাতেই ভেসে ওঠে অদ্রির অজস্র ছবি। প্রায়গুলোই এদেশ-ওদেশের ভিডিও থেকে স্ক্রিনশট নেওয়া।রিয়ানের মুখে আজ হাসি নেই। প্রতিদিন ছবিগুলো দেখলেই ওর মুখে হাসি ফোটে।মনে প্রজাপতিরা উড়ে।আজ তেমন কিছুই হচ্ছে না।রিয়ান নিজের বুকে একহাত রাখে,আরেক হাত রাখে অদ্রির কয়েকটা ছবির ওপর।বলে ওঠে,
‘’তোর জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষায় থাকতে পারবো অদ্রি, সারাজীবন।ভালোবাসার মানুষের চোখই যদি না পড়তে পারতাম তাহলে কেমন ভালোবাসি অদ্রি বলতো।তোর চোখ তোর মুখের কথার ওপর ভাটা ফেলেছে রে পাগলি’’

চলবে?