#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#১৯তম_পর্ব
#বর্ষা
৫২।
আরিয়ার বিয়ের তিনদিন বাকি।আজ থেকেই অনুষ্ঠান শুরু।আর তার শরীক হতেই ইতিমধ্যে গাড়িতে উঠেছে অদ্রিরা।এখান থেকে দুই আড়াই ঘন্টার পথ। গাজীপুরের দিকে হচ্ছে বিয়েটা।আরিয়ার দাদাবাড়িতে।দুটো গাড়ি যাবে এখান থেকে।একটাতে অদ্রি,রিয়ান,মারিয়াম,লিয়ন,মোয়াজ আর ওর বউ মায়া।অন্য গাড়িতে বাড়ির বড়রা যাবে।অদ্রি গাড়িতছ উঁকি দিয়ে দেখে সবাই যে যার মতন বসে পড়েছে।গাড়ি ড্রাইভ করবে রিয়ান।ওর পাশের সিটটাই কেবল ফাঁকা।
‘’মোয়াজ ভাই সামনে বসো।আমি ব্যাকসিটে বসি’’
‘’চুপচাপ সামনে বস বনু।আমার কেমন যেন বমি বমি লাগছে।এখানে পাশে বউ আছে সামলে নেবে’’
রিয়ানের দিকে একবার দেখে অদ্রিকে কথাগুলো বললো মোয়াজ।গাড়িতে ওঠার আগেই বেশ ভালো করেই রিয়ান সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছে কেউ যেন সামনে না বসে।আগের গাড়ি ইতিমধ্যে বেরিয়ে পড়েছে।ওরাই কেবল এখনো এখানে।বাধ্য হয়ে অদ্রি ফ্রন্ট সিটে উঠলো।পেছন থেকে লিয়ন অদ্রির কোলে এসে বসলো।
‘’মিমি,একটা সিক্রেট শুনবে?’’
লিয়নের মুখে সিক্রেট শুনে রিয়ান চমকায় না।এই ফাজিলে নিশ্চিত বলে দিবে রিয়ানের কর্মকান্ডের কথা। চকলেট খাইয়ছ লাভ হলো না।অদ্রি লিয়নকে পাল্টা জিজ্ঞেস করে,
‘’কি সিক্রেট বাচ্চা?’’
‘’যদি আইসক্রিম খাওয়াও তাহলে বলবো’’
‘’আচ্ছা খাওয়াবো।বল’’
‘’এখনই খাওয়াও’’
‘’তাহলে থাক বাদ দে।পরে বইলো ‘’
অদ্রির শেষ কথাটা লিয়নের মনমতন হলো না।ভেবেছিলো পেটের কথাগুলো দ্রুত বলবে। আইসক্রিমটাও খাওয়া যাবে। কিন্তু হলো কই! যাইহোক পেট ব্যথা কমাতে হলে সিক্রেট তো ফাঁস করতেই হবে।লিয়ন বলে ওঠে,
‘’মিমি জানো সবাই কেন পেছনে বসলো?’’
‘’কেন?’’
‘’এই লিয়ন পেছনে আয়। সামনে বসে তোর যতসব দুষ্টামি না!’’
মারিয়ামের কথায় লিয়ন পরোয়া করলো না।গাড়ির সামনের অংশ ধরে বসে রইলো শক্ত করে।তারপর নিজেই বললো,
‘’দেখছো তোমায় সত্যি বলছি দেখে মাম্মা কেমন করছে?সব সাজিশ চলছে এখানে’’
অদ্রি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,’’হিন্দি বাংলা মিলিয়ে জগাখিচুড়ী করছো কেন বাচ্চা?আর কি চক্রান্ত হচ্ছে শুনি?’’
সবার দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো অদ্রি।মোয়াজ বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।এমন ভান সে কিছুই শোনেনি।মায়া ঘুমের ভান ধরেছে।আর মারিয়াম ততক্ষণে কানে এয়ারফোন ঢুকিয়ে হাসছে। বোধহয় রিলস দেখছে।আর অদ্রির পাশের মহাজন যেন এ দুনিয়ায় নেই।গাড়ি চালানোতেই মগ্ন।
লিয়ন আর কিছু বললো না।অদ্রির থেকে ফোন নিয়ে গেমস খেলতে লাগলো।অদ্রি আর কি করবে বাইরে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ করেই আজ ট্রাফিক পুলিশ গাড়ি চেক করছে।লোকটা ভালোই বয়স্ক।এগিয়ে এসে খোঁজ নিতে লাগলেন রিয়ানের থেকে। বোধহয় অদ্রি আর লিয়নকেও দেখলেন।অদ্রি তখন বাইরেই তাকিয়েছিলো তবে অন্যপাশে। ট্রাফিক পুলিশের কথায় ফিরে তাকালো।
‘’আচ্ছা উনি তো বোধহয় আপনার মিসেস?ম্যাডামকে আর বাচ্চাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন?’’
প্রয়োজনের বাইরের কথা।কাগজপত্র দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করলেন।এরই মাঝে ফাজিল লিয়ন মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে অদ্রিকে জোড়ে করেই বলে উঠলো,
‘’মাম্মি পাপাই গাড়ি চালাচ্ছে না কেন?তুমি একটু বকে দেও তো’’
অদ্রি চমকে তাকালো।রিয়ানও অবাক হলো তবে কিছু বললো না ওকে।পুলিশের দিকে তাকিয়ে বললো,’’ফ্যামিলি নিয়ে গাজীপুরে যাচ্ছি’’
ট্রাফিক পুলিশ কাগজপত্র ফেরত দিয়ে যেতে দিলেন।রিয়ান আবারো গাড়ি চালাতে লাগলো।মারিয়াম লিয়নের কথা শুনেছে।মুচকি মুচকি হেসেছে।এবার সে কিছু গম্ভীর মুখ করে লিয়নকে বলে উঠলো,
‘’কিরে ফাজিল অদ্রি তোর মাম্মি হলো কবে?আর রিয়ান তোর পাপাই হলো কিভাবে?’’
‘’আমিও তো জানি না।পুলিশ আংকেলই তো বললো।আর তাছাড়া মামু আর মিমির বাচ্চা হলে খারাপ হয়না।কত কত আদর পাবো বল’’(লিয়ন)
‘’ঠিক আছে তুই ওর কাছেই থাক।আমার কাছে আসবি না।তোর ডেডকেও বলবো সে যেন আর তোকে আদর না করে।তোর তো পাপাই-মাম্মি আছেই’’(মারিয়াম)
লিয়নের মুখটা এতটুকুনি হয়ে গেলো। সারা রাস্তা বাচ্চাটা মন খারাপ করে রাখলো।যদিও মারিয়াম এর মাঝে বলেছে যে সে মজা করেছে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।অদ্রির কোলে পরে ঘুমিয়ে গেছে সে।মারিয়াম তো প্রেগন্যান্ট।এই অবস্থায় লিয়নকে কোলে বসিয়ে ওতোটা পথ যাওয়া রিস্কি তাইতো অদ্রিই ওকে ওর কাছে এনে বসিয়ে ছিলো।
৫৩।
বিয়ে বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর হয়।ফ্রেশ হয়ে কোনমতে খাওয়া-দাওয়া করেই রেডি হতে দৌড়াদৌড়ি।আজ মেহেদির আয়োজন হয়েছে।সাধারণত এটা এখানকার সংস্কৃতি না।তবে আরিয়ার আবদার।ওর বিয়ের আগে তিনদিন অনুষ্ঠান হতেই হবে। সেজন্যেই এই আয়োজন।আজ মেহেদি, আগামীকাল হলুদ,পরশু কাবিন করে পরদিন মেয়ে উঠিয়ে দেবেন।
মেহেদির অনুষ্ঠানে কে কি রঙের শাড়ি পড়বে তা আগে থেকেই ঠিক করা।গায়ে হলুদ,বিয়ের সবকিছুর শপিং করেই তারপর না ওদের আসা।রিয়ান মালয়েশিয়া আবার ব্যাক করবে। নতুন কোর্সে ভর্তি।ক্যারিয়ারের যুদ্ধ তো কেবল শুরু।মাত্র না এমবিবিএস শেষ করলো। একজন ডাক্তারের পরিপূর্ণ হতে পড়াশোনা চালিয়েই যেতে হয়।এখনও সে সেই বিষয়েই কারো সাথে কথাবার্তা বলছে।
রিয়ানের পড়নে সবুজ রঙের পাঞ্জাবি।গলায় রঙধনুর মতন দেখতে উত্তরিয়। কতগুলো রঙ যে আছে!ফোনে কথা বলতে বলতে ওর চোখ যায় পেছনের দরজার দিকে।এদিকের গেস্ট রুমেই ওরা উঠেছে।তখনই দেখতে পায় অদ্রিকে।কোনোমতে শাড়ি পড়ে হাঁটছে সে।বাসন্তি রঙের শাড়ি,কোমড়ে কোমড় বন্ধনী।হালকা সাজেই যেন অপরুপা লাগছে। চুলগুলো খোপা করা।খোপায় বেলি ফুলের গাজরা পড়লে বোধহয়…।
‘’ভ্যাবলার মতন কাকে দেখছিস?’’(অদ্রি)
‘’একদম ফাও কথা বলবি না অদ্রি।ভ্যাবলা কি হ্যা?বলবি ডেশিং লুকে কাকে দেখছিস ‘’(রিয়ান)
ওদের ঝগড়ার মাঝেই দূর থেকে কয়েকটা মেয়ে ওদের দিকে তাকিয়েই কথা বলতে থাকে।রিয়ান বিষয়টা খেয়াল করে।অদ্রিকে জ্বালাতে বলে ওঠে,
‘’শুনবি কাকে দেখছি?ঘুরিস না বলছি।আমার সোজাসুজি কতগুলো মেয়ে দাড়িয়ে আছে।কি সুন্দর রে বাবা’’
অদ্রির ভেতরটা যেন জ্বলে উঠলো।রিয়ানের পায়ে পাড়া দিয়ে সরে গেলো।বাড়ির ওপাশের ফাঁকা জায়গায় আয়োজন।অদ্রি সেদিকেই গেলো।রিয়ান লিয়নের জন্য দাঁড়িয়ে রইলো।বোনের ছেলে মানেই নিজের ছেলের ছেলে।মামাগত অধিকারে বাবা সে।তাইতো ছেলেকে সামলে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে বোনের থেকে।
আরিয়াকে এখনো আনা হয়নি। কেবল তো সন্ধ্যা হলো বলে।আটটার আগে কনে আসবে বলে মনে হয়না।অদ্রি এদিক ওদিক ঘুরে দেখতে লাগলো।বেশ সুন্দর করেই সাজানো হয়েছে।তবে পুরান ঢাকার বিয়ের কাছে এ যেন কিছুই না।অদ্রিকে একাকী ঘুরতে দেখে ওই সময়ের মেয়েগুলো এগিয়ে এলো।অদ্রির সমবয়সীই হবে বোধহয়।আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলো,
‘’এই যে আপু ওই সময় আপনার সাথে যেই ছেলেটা ছিলো সে কি বিবাহিত?’’
অদ্রি মেয়েগুলোকে লক্ষ্য করলো। চঞ্চলতা বেশিই আছে।নয়তো কেউ কি এভাবে জিজ্ঞেস করে নাকি!অদ্রির ভালো লাগেনি বিষয়টা।রিয়ানকে বাদে যে কাউকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলে বোধহয় সে অকপটে বলে দিতো সব। কিন্তু এখন কথা তো হচ্ছে রিয়ানকে নিয়ে।অদ্রির কি হলো সে জানে না।বলে ফেললো,
‘’বিবাহিত না।তবে খুব শীঘ্রই বিয়ে।আমি ওর ফিয়ন্সে।কেন কোনো সমস্যা হয়েছে?’’
মেয়েগুলোর মুখ শুকিয়ে গেলো যেন।মাথা ঝাঁকিয়ে না বলে চলে গেলো।অদ্রি নিজেও চমকালো কি বলে ফেলেছে তা ভেবে!আবার পরক্ষনেই কি ভেবে হেসে উঠলো সেই জানে। কিন্তু তখনই কোত্থেকে রিয়ান এসে অদ্রির হাত তার হাতের মাঝে বন্দি করলো।অদ্রি কিছু বলতে নিলেই বলে ফেললো,
‘’তোর হাত ধরিনি।আমার ফিয়ন্সের হাত ধরেছি। মেয়েগুলো চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে যেন’’
অদ্রি মুখ বাকালো।তবে হাত ছাড়িয়ে নিলো না। দু’টোতে ওভাবেই ঘুরতে লাগলো। মৌসুমী বেগম দূর থেকে দেখলেন।ওনার সঙ্গেই লিয়ন দাঁড়িয়ে আছে।বড় মা’কে ডেকে বলে উঠলো,
‘’ও বড় মা ওদের বিয়ে দিয়ে দেও না।তাহলে খুব ভালো হবে।মাম্মা যখনই বকবে তখনই আমি মিমিকে মাম্মি বানিয়ে ফেলবো।ওকে কোথাও যেতে দিবো না তখন ‘’
মৌসুমী বেগম নাতনির ছেলেকে চুপ করতে বললেন।তবে নিজে ভেবে নিলেন সব।আরিয়ার বিয়েটা যাক তারপরই সবার সঙ্গে কথা বলবেন।আজাদ মীর মুর্তজা শুনলে বেশ খুশিই হবেন তা মৌসুমী বেগম জানেন।তবে ওনার চিন্তা অন্য জায়গায়।আদ্র রাজি হবে কিনা কে জানে!
চলবে?