প্রনয়ের বাকবিতন্ডতা পর্ব-২০ এবং শেষ পর্ব

0
10

#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#শেষ_পর্ব
#বর্ষা
৫৪।
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে রিয়ান তো বেশ চটেছিলো অদ্রির ওপর।মেয়েটা কেমন ছন্নছাড়া হয়েছে।শাড়ি ফাঁকে তার পেটের ভাজ ফুটে উঠছিলো। অবশ্য অদ্রির অজান্তেই সিফটিপিন ভেঙে এমন হয়েছে আরকি।রিয়ান যখন খেয়াল করে তখন দেখে আরো কয়েকটা ছেলের নজরও অদ্রির পেটের দিকে। আর অদ্রি স্টেজের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো তখন।

রিয়ান তেড়ে গিয়ে অদ্রিকে নিয়ে বেরিয়ে যায়।কোথায় যায় কে জানে!এখন রাত দেড়টা এই অব্দি বাড়িতে ফেরেনি। অবশ্য আজাদ মীর মুর্তজাকে ফোনে জানিয়েছে ওরা ঢাকায় যাচ্ছে কি এক প্রয়োজনে।

গাড়িতে থম মেরে বসে আছে অদ্রি।রাগে ওর মাথা ধরে যাচ্ছে।সেই কয়েক ঘন্টা ধরে গাড়ির মাঝে আটকে রেখেছে রিয়ান।নিজে অবশ্য কুম্ভকারের মতন ঘুমাচ্ছে।দাদাকে মিথ্যা জানিয়েছে এই ফাজিলে।তুরাগ নদীর কাছাকাছিতে এসে গাড়ি থামিয়ে রেখেছে।

‘’রিয়ানের বাচ্চা ওঠ না।আমার একা একা ভাল লাগেনা।মোবাইলও নাই’’

রিয়ান সাড়া দেয় না। অবশ্য ও ঘুমায়নি।ঘুমের ভান করে পড়ে আছে।এই মেয়ে যে ফাজিল!এর ওপর নজর না রাখলে কি বিপদ ঘটাবে কে জানে।রিয়ানের ফোন বেজে উঠতেই ও ধীরে সুস্থে ওঠে।অদ্রি দাঁত কিড়মিড় করে। বোধহয় মনে মনে আচ্ছা রকম বকে।আদ্র কল করেছেন।

‘’হ্যা চাচ্চু বলেন’’

‘’অদ্রি কি তোমার সাথে?’’

‘’হ্যা,আমরা তো ঢাকা এসেছি।অদ্রির কি বলে লাগতো।আপাতত বাসায় আছি।একটু পরই আবার বের হবো’’

‘’অদ্রি কোথায়?ওর ফোন তো আমার কাছে’’

‘’চাচ্চু ওতো ঘরে গেছে।কি বলে আনবে’’

‘’আচ্ছা ঠিক আছে। সাবধানে এসো।’’

আদ্র ফোন কাটতেই রিয়ান অদ্রির মুখ থেকে হাত সরায়। এতোক্ষণে ফোন লাউডে ছিলো।রিয়ান দাঁত মুখ খিচে অদ্রির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

‘’তুই কি রাক্ষস?আমার হাত কামড়িয়ে কি অবস্থা করছোস! আল্লাহ আল্লাহ ‘’

‘’শয়তান ছেড়া তুই আমার পাপাকে মিথ্যা বলছোস কেন’’

রিয়ান ডন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে চোখ বুজে থাকে।অদ্রি রাগে জেদে গাড়ি থেকে বেরতে নিলে দেখে কার লক করা।অদ্রির মন চায় রিয়ানের সবগুলো চুল টেনে টেনে তুলতে। কিন্তু সে নেহাতই ভালো মানুষ তাই তেমন কিছুই করলো না।ভালো বাচ্চার মতন বসে রইলো।

৫৫।

ভোর সাড়ে চারটার দিকে আরিয়াদের বাড়িতে ঢুকেছে ওরা।কেমন নিস্তব্ধতা চারপাশে!ওরা সরাসরি চলে যায় নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে।মারিয়ামের সাথে অদ্রি ঘুমাবে।তাই ওই ঘরেই যায়।ওর লাগেজপত্রও ওই ঘরে।গিয়ে ফ্রেশ হয়ে যেই চোখটা বুজবে ওমনি বাইরে থেকে মানুষের হইচই শুরু হলো।আর ঘুমানো হলো না তার।

গায়ে ওরনা জড়িয়ে অদ্রি বের হলো।পরনে সুতির থ্রিপিস।একেবারেই হালকা কাজের।ঘুমানোর জন্যই অবশ্য পড়েছিলো। কিন্তু তা আর হলো কই!অদ্রিকে দেখেই একজন বৃদ্ধা কাছে ডাকলেন ওকে।যতটুকু ওর মনে আছে এই বৃদ্ধা হচ্ছেন আরিয়ার দাদিমা।ওকে অনেক স্নেহ করেন।পাশেই আছেন মাহফুজ ভাইয়ের বউ সাদিয়া ভাবি।

‘’কিরে নাতিন এই ভোরে উঠছোস কেন?কেবল তো ভোরের আলো ফুটছে’’

‘’বোনের বিয়ে।কাজকাম তো দেখা লাগে তাইনা দাদি?’’

অদ্রি মুচকি হেসে বলে।সাদিয়া এগিয়ে এসে অদ্রিকে ধরে।তবে বৃদ্ধার সামনেই কিছু জিজ্ঞেস করে না। হাঁটতে হাঁটতে একটু সামনে যেতেই জিজ্ঞেস করে,

‘’বনু গতরাতে কোথায় ছিলে? সেই যে হলুদ ছুঁইয়ে লাপাত্তা হলে।আর এখন দেখছি’’

প্রশ্নটায় তেমন একটা চমক দেখা গেলো না অদ্রির মাঝে।সে আগেই জানে এমন বহু প্রশ্নের জবাব তাকে দিতেই হবে।সবাই তাকে নিয়ে ভাবে।অদ্রি বলে ওঠে,

‘’কি করবো বলো ভাবী!বিয়েতে পড়ার ড্রেস এনেছি।তাও ইনকমপ্লিট।তাইতো কাল রাতে গিয়ে আবার আনতে হলো’’

ঠিক বিশ্বাস হলো না যেন অদ্রির কথা।সাদিয়া তবুও মেনে নিলো।এখনো তো বাচ্চামো আছে।ভুলে রেখে আসতেই পারে।তখনই দেখা গেলো রিয়ানকে।দৌড়াচ্ছে।একবার এদিক তো একবার ওদিক।ওর পেছনে একটা কুকুর পড়েছে।এই বাড়ির পালতু কুকুর।নাম জেরি।সহজে কামড়ায় না।তবে তাড়া করে।

রিয়ানের অবস্থা দেখে অদ্রি হাসতে হাসতে শেষ।সাদিয়া গিয়ে জেরিকে ধরে।এই অনুষ্ঠান বাড়িতে জেরিকে ছাড়লো কে ভেবেই রাগ লাগে ওর। কিন্তু বাড়ির বউ বলে কাউকে তেমন কিছু বলে না সে।আরিয়ার দাদিই ইচ্ছে মতন বকে দিচ্ছে সবাইকে। সাদিয়া ভাবী জেরিকে নিয়ে চলে যান।

৫৬।

বাবার হাত ধরে ঘুরছে অদ্রি। আদ্রের হাতে মা-মেয়ে দুইজনেরই ফোন।জেনিয়া অবশ্য বাড়ির বাকিদের সাথে।কাজে টুকটাক হেল্প করছে।আর বাকিসব কাজ তো লোক দিয়েই করানো হচ্ছে।আদ্র মেয়ের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলেন,

‘’সুইটি ভেবেছি তোমার বিয়েটাও কিছুটা নিরব প্লেসে দেবো।কেবল আমরা আমরাই থাকবো।কি বলো?’’

অদ্রি সববারের মতন এবার আর না না করে না। বরং লজ্জা পায়।আদ্র বুঝে যায় মেয়ের মনে ধরে কাউকে।কেননা এমন একটা সময় সেও তো অতিক্রম করেছে।তবে আদ্র মনে দুশ্চিন্তা হয় কাকে পছন্দ করলো অদ্রি!এই বাড়ির কেউ কি?

তখনই রিয়ানকে দেখা যায়।ওর সাথে কিছু মেয়ে কথা বলছে।অদ্রি চেনে। এগুলো তো সেদিনকার মেয়ে।কেমন ছ্যাঁচড়া!অদ্রি বাবাকে বাই বলে ছুটে যায় ওদিকে।গিয়েই সরাসরি চিপা দিয়ে ঢুকে রিয়ানের হাত ধরে ফেলে। চিমটিও দেয় ওকে। তারপর সবাইকে বলে ওঠে,

‘’কি ব্যাপার সবাই আমার জানুকে এখানে আটকে রেখেছো কেন?

আদ্র উল্টো পথে হাঁটা ধরেছিলেন।মেয়ের কথা শুনে থামলেন।তবে পিছনে ঘুরলেন না।কি যেন ভাবলেন।তারপর মুচকি হেসে চলে আসলেন সেখান থেকে।

ততক্ষণে ডাক পড়লো মেয়ে চলে এসেছে পার্লার থেকে।অদ্রিরা ছুটলো সেদিকে।ওরা প্রত্যেকেই তৈরি।অদ্রির পরনে সোনালি আর মিষ্টি কালারে মিশলে সুন্দর গাউন।ম্যাচিং করেই পড়েছে রিয়ান।একসাথেই কিনেছিলো দুইজন।অদ্রিরা চলে যায় আরিয়ার ঘরে।রিয়ান গিয়েই একটা মুডি ভাবে বলে ওঠে,

‘’কিরে ধৈর্যহারা শেষমেশ বিয়ে করছিস দেখি’’

হাসির ঝঙ্কার পড়লো।আরিয়ার পড়নে টকটকা লাল রঙের ভারী কাজ করা শাড়ি।গলায় মোটা মোটা গহনা।হাতের চুড়ির সমাহার।এতো ভারী সাজে আরিয়াকে বাচ্চা একটা মেয়ে লাগছে।

৫৭।

গেইট ধরার মতন রিচ্যুয়ালে থাকতে পারেনি অদ্রি।মোয়াজ আর রিয়ান দুইজনেরই বারণ ছিলো।জেনিয়া এসে অদ্রিকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের সঙ্গে।মেয়েটাকে সেই রাত থেকে দেখেননি তিনি।এই পেলেন।সকালে খায়ওনি বোধহয়।অদ্রির সাথে হাঁটতে হাঁটতে জেনিয়া বলে ওঠেন,

‘’বাচ্চা তোমার দিদা তোমার আর রিয়ানের বিয়ের কথা তুলেছেন।আমি আর তোমার পাপা কিছু বলিনি।রিয়ান যথেষ্ট ভালো ছেলে।তবে সবকিছুর ওপরে তোমার মর্জি। তুমি কি চাও সোনা?’’

মায়ের কথায় অদ্রি যেন বিপাকে পড়লো।এতোদিন বয়ে বেড়ানো ভয়টা আস্তে আস্তে কাটছে।এখন সে কিভাবে নির্লজ্জের মতন বলবে যে সে রিয়ানকে চায়।এ কি আদৌ বলা যায় নাকি!অদ্রির মুখের মেকআপের আস্তরণ ভেদ করেই বোধহয় লাল আভা ছড়ালো।আগেকার ব্লাসের রঙ যেন আরো গাঢ় হলো।

‘’তোমরা যা ভালো বোঝো’’

অদ্রি মাথা নুইয়ে ফেললো।অসময়ে হাসি আসাটা বোধহয় রোগ।এই যে এখন অদ্রির মুখ হাসি হাসি হয়ে আছে!কি যে জ্বালা।অদ্রির রাগ হচ্ছে।এখনই কি মুখটা হাসি হাসি করতে হবে নাকি!

৫৮।

আরিয়ার কবুল বলার মুহুর্তটা বেশ মজার ছিলো।মেয়েটা তিন সেকেন্ডে তিনবার বলে ফেলেছে।তার বলার দ্রুততা দেখে সবাই হিহি করে হেসে ওঠে।কাজী নিজেও বলে ফেলেন মেয়ের বুঝি বিয়ের জন্য অনেক তাড়া।যদিও দুষ্টামি করেই বলেন।

বিয়ের পরপরই কনেকে বাইরে নেওয়া।কি সুন্দর স্টেজের মাঝে জামাই বউ দুইজনই বসে আছে। যতদূর সবার কথা থেকে বোঝা গেলো তাতে এতোটুকু জানা গেলো যে ছেলে কোনো ইঞ্জিনিয়ার না। বরং কার মেকানিজ। নিজের তিনটে মেকানিক্যাল শপ আছে ঢাকা শহরে।বেশ ভালো রুজি।

অদ্রি দুলাভাইয়ের সাথে পরিচিত হয়েই সরে আসলো।বিয়ে বাড়িটা এখন পুরোপুরি অচেনা মানুষে ভরে উঠেছে।একটু আগেও প্রায় ফাঁকা ছিলো।রিয়ান এসে অদ্রিকে ধরে।জানে অদ্রির অতিরিক্ত মানুষের মাঝে অস্বস্তি লাগে।রিয়ানকে পেয়ে অদ্রির অস্বস্তি যেন কাটলো।রিয়ান বুঝলো।কিছুটা নিরবতা খুজতে বাড়ির পেছনের দিকটার গেস্ট হাউসের দিকে গেলো।সঙ্গে মোয়াজ,মায়াও আছে।

‘’ওই ভাই আমার আর অদ্রির দুটো ছবি তুলে দেও তো’’

মোয়াজ ভ্রু কুঁচকালো।তবে রিয়ানের যেন তাতে ফারাক পড়লো না।অদ্রি নিজেও বাধা দিলো না। বিভিন্ন এংগেলে ছবি তোলার এক পর্যায়ে অদ্রি রিয়ানের কানের কাছাকাছি গিয়ে বলে উঠলো,’’রিয়ান আই ওয়ানা টু ম্যারি ইউ।উইল ইউ ম্যারি মি?’’

রিয়ান কথাটা শোনার সাথে সাথেই চমকে গেলো।অদ্রির দু’বাহু ধরে ওর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলো।অদ্রি হ্যা বোধক মাথা নাড়তেই রিয়ান তাকে জড়িয়ে ধরলো। এমনি সেমনি না।বড্ড শক্ত করে।যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে।অদ্রির কাঁধে পানির ছোঁয়া লাগতেই ও বুঝলো রিয়ান কাঁদছে।রিয়ান-অদ্রিকে এভাবে দেখে আগেভাগেই কেটে পড়েছে মোয়াজ-মায়া।তবে এই মুহুর্তের ছবিটাও লুফে নিয়েছে ওরা।অদ্রি বলে ওঠে,

‘’এই ছাগল ছাড় আমাকে।ভ্যাবলার মতন কাদছিস কেন?আমাকে বিয়ে করলে কাদবি নাকি।তাহলে দরকার নেই।সর ‘’

রিয়ান দ্রুত অদ্রিকে ছেড়ে চোখ মুছলো। হেসে বলে উঠলো,’’এই দেখ আর কাঁদছি না। তবে হ্যা বিয়ের পর যদি বকা দেস তাহলে কিন্তু তোর খবর আছে’’

‘’কি করবি?আমি একশোবার বকা দিবো’’

‘’তুই একটা বকা দিলে আমি একশোটা চুমু খাবো।বকা দিলেই মনে করবো চুমু খাবার ধান্দা’’

সমাপ্ত