প্রনয়ের বাকবিতন্ডতা পর্ব-০৩

0
22

#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#৩য়_পর্ব
#বর্ষা
৭.
রাত নয়টা।খাবারের জন্য এই সময়টা নির্ধারিত।আরিয়ারা বিকেলেই চলে গেছে কি এক প্রয়োজনে।তাইতো রিয়ান আর অদ্রি কিছু বলতে পারেনি তাকে।অদ্রি প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে।আর রিয়ান তাকিয়ে আছে তার দাদার দিকে।দাদা কি সত্যিই অনুমতি দিলো!

কিছুক্ষণ আগের ঘটনা।সবাই যখন খেতে বসলো তখন হুট করেই অদ্রি স্থিত গলায় বলে উঠলো,
‘’দাদা,বড় আব্বু আমাকে কিছুদিনের জন্য দূরে পাঠাবে।আমার দমবন্ধ লাগছে এখানে’’

আজাদ মীর মুর্তজা চুপ করে রইলেন।তা দেখে মিরাজুল করিম চিন্তিত হয়ে বলে উঠলেন,
‘’কিন্তু আম্মু কিছুদিন পর যে তোর বার্ষিক পরীক্ষা’’

‘’বিয়েই তো দিয়ে দিচ্ছিলে।বিয়ে হলে কি আর আগামী কয়েক সপ্তাহ পড়তে পারতাম!’’

মিরাজুল করিম ভাষা হারিয়ে ফেলেন।আড়াই মাস আগে যখন অদ্রির বিয়ে ঠিক হলো তখনও অদ্রি না বলেনি।সে বলেছিলো তোমরা যা বলবে তাই।অদ্রি মেনে নিয়েছিলো।যেন সে এমনই একদিনের অপেক্ষা করছিলো।যেখানে ওকে দেখলে বাকিরা আর বলবে না যে ওর আপন কেউ নেই। পৃথিবীতে সবচেয়ে আপন বাবা-মা।ছোট থেকেই বাবা-মা হারা ও।স্কুল,কলেজ সব জায়গাতেই তো তাই কত তাচ্ছিল্য! সহানুভূতি দেখানোটাও একধরনের তাচ্ছিল্য বোধহয়।সে তো কারো কাছে সহানুভূতি চায়নি।

নিশ্চুপ থেকে খাওয়া-দাওয়া শেষে যেইনা অদ্রি উঠতে যাবে তখনই আজাদ মীর মুর্তজা গলা খাঁকারি দেন।অদ্রি দাদার দিকে তাকায়। তিনি হাত ধুতে ধুতে বলে ওঠেন,

‘’কোথায় যাবি জাবিন?’’

‘’দাদা আমিও যাবো অদ্রির সাথে।সাজেক ট্যুর দেই?’’

অদ্রি আর আজাদ মীর মুর্তজা দুইজনই তাকায় রিয়ানের দিকে।মোয়াজ তো হেসে বলে ওঠে,

‘’দেখলে দাদা চাইছে একজন।আর নিজের চাওয়াকে পূরণ করছে আরেকজন’’

‘’পাহাড়ে যেতে হবেনা।ওখানে আনাচে কানাচে বিপদ।আর সময়টাও তো বৃষ্টির।’’(মিরাজুল করিম)

‘’দাদা আমরা লিজার বোনের বিয়ে যাবো।ওর কাছেই কিছুদিন থাকবো।ও তো এখন শরিয়তপুর।আমরা যাই?’’(অদ্রি)

‘’ঠিক আছে। প্রয়োজনীয় সব গুছিয়ে নিও’’

আজাদ মীর মুর্তজার কথায় অদ্রি-রিয়ান দুইজনই খুশি হয়।পুরো সন্ধ্যা ভরে দুইজনে প্ল্যান করেছে কিভাবে পার পাবে আজলান বেহরান থেকে।ওদের কলেজেও এই লোক খোঁজ করেছে।তখনই তো রিয়ান জানতে পেরেছিলো এই বজ্জাত লোক অদ্রির খোঁজ করছে।এখন ঠিক করেছে কিছুদিনের জন্য ওরা লাপাত্তা হবে।মুডটাও ভালো হবে।

৮.শরিয়তপুরে যাওয়ার পথে পদ্মাসেতুর বেশ সুন্দর ভিডিও করেছে অদ্রি।ছোট থেকেই ভিডিও ধারণ,ছবি তোলার হাত ওর অনেক ভালো।সেদিকে রিয়ানও পিছিয়ে নেই।দুইজন যেন দুইজনের টক্কর দেওয়া প্রতিদ্বন্দ্বী।তবে একে অপরকে ছাড়া ওদের চলেও না।গাড়ির ব্যাকসিটে বসে ঘুমাচ্ছে রিয়ান।ওর বমি বমি পাচ্ছে।আসার পথে যতসব ভাজাপোড়া খেলে যা হয়।অদ্রি অবশ্য এদিক দিয়ে ঠিক আছে।যাই খাক গাড়িতে উঠলে ও একদম কুল থাকে।

‘’ওই রিয়ান দেখ দেখ স্প্রিটবোর্টগুলো হাসের বাচ্চার মতন লাগছে’’

ঘুমে ঢুলুঢুলু রিয়ানকে ধাক্কা মারায় সে লাফিয়ে জেগে ওঠে।রাগ করে অদ্রির চুল টেনে বলে ওঠে,
‘’ফহিন্নির ঘরে ফহিন্নি তোর মন চায় তুই দেখ।আমার স্বাধের ঘুম তোরে কি করছে!’’

দেড় ঘন্টার মধ্যে ওরা পৌঁছে যায় লিজার দেওয়া ঠিকানায়।তবে এরপর আর গাড়ি যাবেনা।রিয়ান কল দেয় লিজাকে। ওদের ওখানেই অপেক্ষা করতে বলে সে।লিজা আসবে ওদের নিতে।রিয়ান দেখে অদ্রি কাঁপছে।গাড়ি থেকে নামলেই নাকি ওর মাথা ঘুরে।তাইতো লাগেজ নিয়ে ওরা গিয়ে বসলো বন্ধ দোকানটার বসার জায়গাটা।গাড়িটাকে চলে যেতে বলেছে ওরা।চারপাশে কত নিরিবিলি!

দশ-পনেরো মিনিট পর কয়েকজন ছেলেপেলেকে দেখা যায় আসতে। ফাঁকা রাস্তায় হুট করে মানুষ দেখে দুইজনেই ভয় পায়।শহর থেকে গ্রামে আসলে এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। ওদের ভয়টা খুব বেড়ে যাওয়ার আগেই দূর থেকে লিজার কন্ঠ ভেসে আসে।ও ডাকছে ওদের।রিয়ান তিন রাস্তার মাথায় গিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে, পাশাপাশি চিল্লিয়ে নিজের অবস্থান বোঝায়।লিজা দৌড়ে আসে।সঙ্গে ওর গুটিকয়েক কাজিন ভাই-বোনও আছে।

‘’এতো সময় লাগে আসতে! কতক্ষন ধরে অপেক্ষা করছি।যা তোর বান্ধবীরে ধরগা।মাথা ঘুরে ওর’’(রিয়ান)

‘’ধরবোই তো। তুই তো ফাজিল।আমার বান্ধবীরে রেখে চলে আসছোস বেয়াদব’’(লিজা)

দুইজন ঝগড়া করতে করতেই যায় অদ্রির কাছে।অদ্রি এখন চাঙ্গা হয়ে গেছে।ঔষধ,পানি খেয়ে ওর খারাপ লাগাটা কেটে গেছে।আর প্রকৃতির কাছে থাকলে চাঙ্গা ভাবটা একাই চলে আসে।লিজা গিয়ে অদ্রিকে জড়িয়ে ধরে।বলে ওঠে,

‘’দোস্ত তোদের অনেক মিস করছি।বাবা যে কেন গ্রামে আপুর বিয়ে ঠিক করলো কে জানে!’’

‘’ভালোই তো হলো।এই ফাঁকে তোর গ্রামটাও দেখা হবে’’(অদ্রি)

ততক্ষণে ওই দূরে দেখা ছেলেপেলেগুলোও চলে এসেছে।এক ছেলে বলে ওঠে,

‘’লিজা এরা কারা রে?আর তুই এনে কেন?’’

‘’নিয়াম ভাইয়া এই যে এইটা আমার বেস্ট ফ্রেন্ড অদ্রিতা।আর ওই ছেলেটা ওর ভাই।’’

নিয়াম নামের ছেলেটা অদ্রিকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে চলে যায়।অদ্রির অস্বস্তি লাগে।রিয়ানের রাগ হলেও কিছু বলতে পারেনা।লিজার সাথে গ্রামের মধ্যে ঢোকে ওরা। কথায় কথায় জানতে পারে আজই নাকি গায়ে হলুদ।ভালোই হলো মিস হতে হতেও হয়নি।

৯.শাহজালাল বিমানবন্দরে ব্যাগপত্রের জন্য দাড়িয়ে আছেন জেনিয়া ফিরোজ।একজন আর্কিটেকচার।আমেরিকায় প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব ওনার।কত সুন্দর সুন্দর ভবনের নকশা ওনার আঁকা!জন্মগত বাংলাদেশি হলেও মাতৃপরিচয় ধরলে তিনি একজন আমেরিকান।পরিবার অবশ্য এই যে এই দেশটাতে।তাইতো ফেরা।

বাইরে বের হতেই দেখতে পান মা,বাবাকে।ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরেন মা’কে।মারিয়া রবার্টস মেয়ের কপালে চুমু খান। কতগুলো বছর বাদে তার মেয়ে তার কাছে ফিরলো! রায়হান ফিরোজ মেয়েকে একপলক দেখেন।তবে কথা বলেন না।পুরানো অভিমান জমে আছে।মেয়ে তাইতো ফেলে দিতে পারবেন না।

‘’বাবা কেমন আছো?’’

‘’হুম,ভালো।’’

মেয়ের দিকে না তাকিয়েই তিনি মারিয়াকে বলে ওঠেন,
‘’মারিয়া দেরি হচ্ছে।বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।আমি এগুলো (ব্যাগপত্র) নিয়ে গেলাম’’

‘’মাম বাবা কি কখনো আমার সাথে কথা বলবে না?এমন এড়িয়ে যাওয়াটা কি সারাজীবন থাকবে!’’(জেনিয়া)

মারিয়া রবার্টস মনে মনে বলেন,’’তুই যা করেছিস তোকে আমিও বোধহয় ক্ষমা করতে পারতাম না।তবে কি করবো বল!মা হই তাইতো মাতৃত্বের টানটা অবজ্ঞা করতে পারিনা’’

মারিয়া রবার্টস একজন ইনফ্লুয়েন্সার ছিলেন।রায়হানের সাথে ওনার পরিচয় হয়েছিলো আমেরিকায়। সেখানে রায়হান গিয়েছিলো পড়তে।যেই বাড়িতে উঠেছিলো গেস্ট হিসেবে,সেই বাড়ির ছোট মেয়ের সাথে ওর সম্পর্কটা গাঢ় হয়েছিলো। ওখানেই দুইজন বিয়ে করে নিয়েছিলো।সেদেশেই জন্ম রাজিয়া ফিরোজের। পড়াশোনা মাঝপথে রেখেই চলে এসেছিলেন রায়হান পরিবার নিয়ে।তারপর শুরু করলেন ব্যবসাপাতি।তাতে সফলতা পেয়েও গেলেন।

বাড়িতে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে একটু শুয়ে ছিলেন জেনিয়া। হঠাৎ করে মনটা কেমন যেন করে উঠলো।তাইতো পুরো বাড়িটা একবার ঘুরে দেখলেন তিনি।না,মা-বাবা ব্যতিত তো আর কেউ নেই।তাহলে ওনার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটা কোথায়!

রান্নাঘরে মারিয়া কাজ করছিলেন।জেনিয়া সেখানেই যায়।পরনে তার লং শার্ট আর প্লাজু।গায়ে ওরনা নেই।কেবল উনিশ বছর বয়সে আমেরিকা গিয়ে একেবারে পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে দেশে ফেরা ফলাফল এটা।জেনিয়া আমতা আমতা করে বলে ওঠেন,

‘’মাম ও কোথায়?’’

‘’কে কোথায়?’’

‘’মাম…’’

১০.

লাক্সারিয়াস রুমের সাদা চাদরের মাঝে অর্ধউলঙ্গ অবস্থাতে আধশোয়া হয়ে আছে আজলান বেহরান।রাত দশটা কি এগারোটা এখন।মদের নেশায় মত্ত এখন সে একহাতে হুইস্কির অর্ধ খাওয়া বোতল।অপরহাতে সিগারেট।সিগারেটের ধোঁয়া বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে ছাড়ছে সে।বাপই তো এমন বানিয়েছে তাকে। অবশ্য এখন হারামখোরটা বেঁচে নেই।নয়তো সে নিজ হাতে খুন করতো তাকে!আজলান বিড়বিড় করে বলে,

‘’আক্কাস বেহরান,হায়াত্তা কালমামান বায়উক সানস।ইউকসা হায়াতিমি ছেহেননিমি কেভিরমেনিন কেজাসি নে ওলউর্দু?বেনিম তারাফিমদান ওলদুরুলমুস ওলউর্দুন।’’

(অর্থ-আক্কাস বেহরান ভাগ্য ভালো তুই বেচে নাই। নয়তো আমার জীবনটা নারকীয় বানানোর জন্য তোর শাস্তি কি হতো বলতো?আমার হাতে খুন হইতি তুই )

আজলান তুরস্কের বাসিন্দা।কেবল বাসিন্দা না।প্রভাবশালী লোক।ক্ষমতার তুঙ্গে সে।মেয়েলি কোনো সমস্যা তার নেই। কিন্তু হুট করে এক মেয়ের ছবি দেখে সে দেওয়ানা হয়ে ছুটে এসেছে এতো দূরে।সেই ছবির চেয়েও কত সুন্দর নারীরা তার সঙ্গ চেয়েছে,তবে সে তো তখন আকৃষ্ট হয়নি!তবে এখন এমন কি হলো যে সে এমন দেওয়ানা হয়ে ছুটে আসলো এখানে?আজলান বেহরান তা জানে না।হয় নিজ ইচ্ছায় জাবিন তার সাথে যাবে নয়তো সে জোর করে তুলে নেবে। দিনশেষে তার পছন্দ হয়েছে কাউকে।ছেড়ে দিলেই হবে নাকি! কিছুক্ষণ পর আজলান ফেসবুকে ঢুকে অদ্রির ছবির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,

‘’জাবিন কিরমিজি দুদাকলারিন কালবিমি কারপটিরিওর।ডাহা ওয়ান হিক বয়লি হিসসিটমেমিসতিম।বেনি বায়উলুইওরসুন!কেযালানদিরিলমান গিরিক।’’

চলবে?