প্রনয়ের বাকবিতন্ডতা পর্ব-০৫

0
15

#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#৫ম_পর্ব
#বর্ষা
১৩.
সকালে ঘুম ভাঙতে সাতটা বেজেছে অদ্রির।গতকাল যে সেই ঘরে আসলো ওমনি এসে ফ্রেশ হয়েই ঘুম।খিদেয় পিটটা চু চু করছে।ফ্রেশ হয়ে মোবাইল হাতে নিচে যেতে লাগলো।ছোট একটা পেইজ আছে তার।দশ হাজার ফলোয়ার।ঢাকার আনাচে কানাচে ঘোরাঘুরির ভিডিও ছাড়ে সে এখানে।প্রতিরাতে পেইজেই লগইন করে ঘুমায়ও। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময়ই হঠাৎ করে চিৎকার করে ওঠে অদ্রি।

‘’বড় আব্বু,দাদা,রিয়ান,বড় আম্মু,আপু ,ভাইয়া কই তোমরা….’’

অদ্রির চিৎকারে ভয় পেয়ে সবাই ছুটে আসে।অদ্রি খুশিতে লাফাচ্ছে।ছুটে গিয়ে মারিয়ামের হাত ধরে লাফাতে শুরু করে। মিরাজুল করিম জিগ্গেস করে,

‘’কিরে কি হয়েছে এমন লাফাচ্ছিস কেন?’’

‘’বড় আব্বু আমার পেইজের ফলোয়ার রাতারাতি বেড়ে তিনশ’ হাজার হয়ে গেছে।এখনও বাড়ছে।কি এমন হলো বলোতো ‘’

অদ্রি না জানলেও বোধহয় বাকিরা জানে ওর খুশির কারণ।অদ্রিকে ঘাটায় না কেউ।ফাতেমা জোহরা ওদের খেতে আসতে বলেন।রিয়ান ওঠেনি এখনো নয়তো ওও দশ বারোটা লাফ দিতে দেরি করতো না।বেচারা ক্যামেরাম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছে শুরু থেকে।খেতে বসে অদ্রি নিজের আইডিতে ঢোকে।মুখে দিতে নেওয়া খাবার মাঝপথেই আটকে যায়।ও আর মুখে দেয় না।ওর ম্যাসেঞ্জার ফুল হয়ে গেছে।কতশত মানুষ ওকে বার্থডে উইশ করেছে!ওর রাগ ওঠে।

‘’দাদুভাই খাচ্ছো না কেন?’’

আজাদ মীর মুর্তজার কথায় সবাই ওর দিকে তাকায়।অদ্রি কোনো কারণে রেগে গেছে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।আর তার কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে যেন এক নারী দরজা খোলা পেয়েই গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসে ওদের দিকে।বার্থডে সং।

‘’হ্যাপি বার্থডে সুইটহার্ট,হ্যাপি বার্থডে ‘’

অদ্রি চেয়ার লাত্থি মেরে উঠে দাঁড়ায়।সামনে দাঁড়ানো মহিলাটাকে ও চেনে।খুব ভালো করেই চেনে।পেছনে ওর নানা,নানী আর মামনিও তো আছে।ওরা কি এই মহিলাকে বলেনি অদ্রি তার আঠারো বছরের জীবনে বছর চারের পর আর কখনো নিজের জন্মদিন পালন করেনি।এমনকি মনেও রাখেনি।জেনিয়া ফিরোজ এগিয়ে এসে খাবার টেবিলের একপাশে কেকটা রেখে ওকে জড়িয়ে ধরতে নেয়।অদ্রি পিছিয়ে যায়। তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বলে ওঠে,

‘’আঠারো বছর পর আপনাদের নতুন ভীমরতি হয়েছে নাকি?প্রথমে সে আমায় নিয়ে পোস্ট করছে।আপনি আবার আমার জন্মদিন উদযাপনে আসছেন।আই ফা** দিস ডে’’

অদ্রি ছুটে নিজের ঘরে চলে যায়।আজাদ মীর মুর্তজা কিছুটা কঠিন স্বরেই রায়হানকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠেন,

‘’রায়হান হুট করে আসার মানে কি ভাই?আমি তো জেনিয়াকে আসতে বলতাম।আর তোরা তো জানতি অদ্রি এসব পছন্দ করে না তাও…’’

‘’আব্বা মাফ করবেন অদ্রি ছোট মানুষ।রাগ জেদ করবেই।তাই বলে ওর বিশেষ দিন উপভোগ করা ছেড়ে দিতে হবে!’’(জেনিয়া)

‘’ওর কাছে এটা বিশেষ দিন না জেনিয়া।ওর কাছে এই দিন অভিশাপের মতন। যেদিন কাউকে তার বাবা-মা ছেড়ে দেয় সে দিন কারো জন্য উপভোগ্য হতে পারেনা’’(মিরাজুল করিম)

‘’বয়স তো আমার কম ছিলো করিম ভাই‌।অপ্রস্তুত থাকাকালীন সবার ইচ্ছেতে বিয়েটা দিয়ে দিলেন।অদ্রি আসার সময়ও আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।তাইতো…’’(জেনিয়া)

‘’আহ এতো কথা ভালো লাগছে না। এসেছো যখন খেতে বসো।বড় বউমা খেতে দিচ্ছে’’(আজাদ মীর মুর্তজা)

‘’চাচা আমি কি অদ্রির কাছে যাবো?’’(রাজিয়া ফিরোজ)

‘’প্রয়োজন নেই।খেতে বসুন’’(মিরাজুল করিম)

অদ্রি ঘরে ফিরে দরজা আটকে দিয়েছে।ওর কান্না পাচ্ছে। অভিমানী মনে সে কত নালিশ জমিয়ে রেখেছিলো।ভেবেছিলো কোনোদিন বাবা-মায়ের মুখোমুখি হলে সব প্রশ্ন জবাব নেবে। কিন্তু তা হলো না।অদ্রির যেন বুকে ব্যথা হচ্ছে।বিছানায় শুয়ে বালিশ জড়িয়ে কাঁদতে থাকে সে।বারবার আল্লাহর কাছে জিজ্ঞেস করে কেন আল্লাহ তার সামলে যাওয়ার পর এদেরকে আবারও ওর জীবনে পাঠাচ্ছে।কেন!

১৪.

দক্ষিণ কোরিয়ায় এখন দুপুর প্রায়। শুটিংয়ের লাস্ট সিন শুট করেই সবাই খাওয়া-দাওয়ার দিকে চলে যায়। ডিরেক্টরের সাথে সান খেতে বসে।লোকটা বেশ রসিক। হুটহাট গল্প বলতে শুরু করে।আর খুবই সিরিয়াস গল্পটাকে হুট করেই রসিকতা পূর্ণ গল্পে রুপান্তরে দক্ষতা রয়েছে তার।সান বারবার মুগ্ধ হয়েছে।যদিও সে গতকাল বিরক্ত ছিলো। কেনো না থ্রিলার গল্পকে টানটান উত্তেজনা থেকে যদি রসিকতায় নিয়ে যাওয়া হয় যে কারোরই রাগ লাগতে পারে।তবে এখন সান মুগ্ধ হচ্ছে।

ডিরেক্টর লিও সকাল থেকেই কিছুটা গম্ভীর হয়ে আছেন।সান ওনার সামনাসামনি বসতেই তিনি একবার তাকান।গতকালের মতন সৌজন্যতা দেখিয়ে হাসেন না। গম্ভীর হয়েই থাকেন।সময় যায়।সান খাবার শেষে উঠতে নেবে ওমন সময় ডিরেক্টর লিও জিজ্ঞেস করেন,

‘’গতরাতে যেই মেয়েকে উইশ করলে সে কি সত্যিই তোমার?’’

‘’হুম,আমার।আমার একমাত্র সন্তান’’

‘’তোমারই তো মাত্র আটত্রিশ।তোমার তরুণ সময়ের সন্তান।ভালোবেসে বিয়ে করেছিলে নাকি?’’

সান কিছু বলে না।মুচকি হেসে চলে যায়। ডিরেক্টর লিও চুপ করে যান।ওনার কেবল এতোটুকুই জানার ছিলো।ওনার মেয়ে তো পাগল এই সানের জন্য।ভেবেছিলেন সময় করে সানকে বলবেন।তবে তার আগেই তো তিনি জানতে পারলেন সানের সন্তানের কথা।মেয়েকে কিভাবে বোঝাবেন তাই ভেবেই তিনি চিন্তিত হয়ে আছেন।

সানরা তাবুটা খাটিয়ে ওখানেই খাওয়ার বন্দোবস্ত করেছিলো।এতো সুন্দর পরিবেশ ছেড়ে হোটেলের চার দেয়ালে থাকা বোকামি।হিরোইন অবশ্য হোটেলেই উঠেছে।তার নাকি অসুবিধা।তা যাকগে।অ্যারিন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে।সানের নতুন মুভি নিয়ে অনেক প্রশ্নের জবাব দিতে হচ্ছে তাকে।কেন হুট করে কোনো মুভির মাঝে ঢোকা এই নিয়ে বেশ জলঘোলা হচ্ছে।তার ওপল আবার সানের মেয়েকে নিয়ে!এখন নতুন প্রশ্ন উঠে আসছে সানের গার্লফ্রেন্ড কে।এটা বাংলাদেশ এবং ভারতের মতন দেশে অস্বস্তিকর একটা প্রশ্ন হলেও বর্হিবিশ্বে এই প্রশ্ন অত্যন্ত স্বাভাবিক। বাচ্চাকাচ্চা বড় হলে তাদেরকে নিয়েই বিয়ে করাটা যেন সেখানে ট্রেন্ড।অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে বটে।

অ্যারিন হঠাৎ হাঁটা থামিয়ে পরক্ষণেই দৌড়ে আসে সানের দিকে।বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে বলে ওঠে,

‘’স্যার অদ্দি ম্যাম পেইজে ম্যাসেজ করেছে’’

অ্যারিনের হাত থেকে একবার ছিনিয়ে নেয় ফোনটা সে।জলজল করছে অদ্রিতা জাবিন নামের আইডিটা।সান আইডিতে ঢোকে।সন্তানের প্রথম বাবা ডাক সে শোনেনি।প্রথম হাঁটতে পারা,স্কুলে যাওয়া, পুরস্কার জেতা কিছুতে সে থাকেনি।কখনো কথাও হয়নি।আজ প্রথম কথা হবে বোধহয়।অদ্রিতা লিখেছে,

‘’স্যার,আঠারো বছর পর কি নতুন ঢং শুরু করছেন?আমাকে আপনার মেয়ে বলে আমাকে অপমানিত করবেন না।আমি সবাইকে বলেছিলো আমি অনাথ।সো আঠারো বছর পর এসে নতুন করে নাটক করবেন না’’

সান ভেবে পায় না সে কি লেখবি।একবার টাইপিং করে আবার ডিলিট করে।ওর হাত কাঁপে।মাথা ঘুরছে।মেয়ের সাথে প্রথম কথোপকথন কি দিয়ে শুরু করতে হয় সান বুঝে উঠতে পারছে না। তাইতো অ্যারিনকে সে জিজ্ঞেস করলো,

‘’অ্যারিন তোমার যদি মেয়ে থাকতো তাহলে তুমি তার সাথে প্রথমে কিভাবে কথা বলতে?’’

সানের অস্থিরতা দেখে অ্যারিন মনে মনে ভাবে তার মেয়ে হলে তো সে প্রথমেই তার ছোট মেয়েটাকে কোলে নিতো।আদরে আদরে ভরিয়ে দিতো।পাপা ডাকতে শেখাতো। কিন্তু তার স্যারের ক্ষেত্রে যে ভিন্ন।অ্যারিন অনেক ভেবে বলে ওঠে,

‘’স্যার আমার মনে হয় সবার প্রথমে আপনার অদ্দি ম্যামের কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত তার জন্মদিনে না থাকায়।যদিও ক্ষমা শব্দটা বড্ড ছোট’’

সান তাচ্ছিল্য হাসে নিজের ওপর।সে এমন বাবা যে কিনা নিজের মেয়ের সাথে এই যাবৎ কাল দেখা-সাক্ষাৎ কিছুই করেনি।এমনকি কথাও বলেনি। সেখানে জন্মদিনে উপস্থিত থাকাটা যেন বিলাসিতার মতন।তাইও সান লেখে,

‘’আমি জানি না তুমি আমায় ক্ষমা করবে কিনা।তবে আমি আমার ভুল শুধরাতে চাই।আমি আমার মেয়েকে চাই।আমি আর একা বাঁচতে পারবো না সুইটি ‘’

তৎক্ষণাৎ সিন হয়ে যায়।সানের বুক ধক করে ওঠে।অদ্রি টাইপিং করছে বোঝা যায়।সান অপেক্ষায় থাকে।কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে অদ্রি লেখে,

‘’আমার হারিয়ে যাওয়া আঠারো বছর ফিরিয়ে দিতে পারবেন?’’

১৫.

অনলাইন মিটিং করছে আজলান।পরনে তার ব্রাউন ব্লেজার,সাদা শার্ট আর শর্ট প্যান্ট।উপরের অর্ধেক দেখা যাবে বলেই এভাবে প্রিপেয়ার হয়েছে সে। মিটিং এর মূল বিষয় আজলানের নতুন কনস্ট্রাকশন সাইড।সে কম দামে কিছুটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে জায়গা কিনে সেখানে টুরিস্ট স্পট বানায়।এবারেরটা বেশিই সৃজনশীল কাজ।তাইতো আরো একবার তারা কনফার্ম হচ্ছে আজলানের থেকে।

মিটিং শেষে আজলান ব্লেজার ছুঁড়ে মারে।কালরাত থেকে ওর মাথায় আগুন জ্বলছে।ওই শালার অভিনেতায় কোন সাহসে অদ্রিকে সুইটি বলেছে তা ভেবেই ওর রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। পরবর্তী লাইভ সে দেখেনি।তাইতো জানে না যাকে এখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হচ্ছে সে অদ্রির আপন,অনেক আপন কেউ।

দরজায় নক হওয়ায় সে সেদিকে তাকায়।আযান এসেছে। মুখে হাসি যেন কোনো অনেক বড় কিছু আবিস্কার করে ফেলেছে সে।আজলানের রাগ ওঠে। তাইতো নিজের মাথার পেছনের চুল টেনে ধরে বলে ওঠে,

‘’বালের জীবন,একটার পর একটা কাহিনী ঘটতেই আছে।আমি ইজহার করার আগেই আরেক বেডা হাজির।আর সময় দেওয়া যাইবো না’’

আজলানকে একা একা বিড়বিড় করতে দেখে আজান চমকায় না।আজলান মাঝে মাঝেই এমন করে। একাকীত্ব মানুষকে নিজের প্রতি নিজের সঙ্গ দেওয়া শেখায়।আজলানকেও শিখিয়েছে।আযান ডাকে,

‘’স্যার..’’

‘’বলো আযান..’”

‘’স্যার ওই অভিনেতা…’’

‘’ওই বালডারে নিয়া কথা বলতে চাইলে এখান থেকে বের হ।আমার সামনে ওই বেডারে নিয়া কথা বলবি না’’

‘’আরে স্যার অভিনেতা তো জাবিন ম্যামের বাবা’’

অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো আজলান।আযানের কথা শুনে যেন সে আকাশ থেকে পড়েছে।আজলান বলে ওঠে,

‘’ওই অভিনেতার বয়স খুব বেশি হলেও চল্লিশ হবে না।আর আমার জাবিনের বয়স কত জানো?আঠারো।তাহলে?’’

‘’স্যার অভিনেতা সান নিজেই বলেছেন এই কথা।’’

আজলানের যেন এখন ভালো লাগছে।সান তার প্রিয় একজন তারকা। কিন্তু যখন দেখেছে সে অদ্রিকে নিয়ে পোস্ট করেছে তখন থেকেই অপ্রিয় হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এখন তার এতো ভালো লাগছে মন চাচ্ছে,গান গাইতে।ভায়োলিন সাথে থাকলেও সুর তোলা যেতো।তার জাবিন তো ভায়োলিন বাজাতে পারে।জাবিনের ভায়োলিন বাজানোর একটা ছোট ভিডিও ওর সামনে এসেছিলো।

চলবে?