#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#৬ষ্ঠ_পর্ব
#বর্ষা
১৬।
বিকালে অদ্রি বেরিয়েছিলো হাঁটাহাটির জন্য।বাসায় কাউকে কিছু জানায়নি।সঙ্গে মোয়াজ ভাই আছে। প্রয়োজনে সেই জানাবে।ওরা এখন যাচ্ছে মাঠের দিকে।রিয়ান ওখানেই আছে।মোয়াজ ওদেরকে নিয়ে আজ ঘুরবে।আজ সে অফিস কামাই করেছে।মোয়াজ আগে আগে আর অদ্রি পেছন পেছন হাঁটছে।ওর মনটা ভালো নেই। আহসানুল আদ্র তারপর রিপ্লাই করেনি।কেউ তো হারিয়ে যাওয়া সময় ফিরিয়ে দিতে পারেনা।এটা অসম্ভব।
‘’কিরে তাড়াতাড়ি আয়।এতো আস্তে হাটছিস কেন?’’
‘’আসছি ভাইয়া’’
অদ্রি পা চালায়।ভাইয়ের সাথে সাথেই হাঁটে।মাঠের কাছাকাছি যাওয়ার পর অদ্রি জিজ্ঞেস করে,
‘’ভাইয়া জেনিয়া ফিরোজ কি আমাদের বাসায়?’’
মোয়াজ থেমে যায়।জেনিয়া ফিরোজ সম্পর্কে মোয়াজের ছোট চাচা আহসানুল আদ্রের ওয়াইফ।আলাদা থাকেন প্রায় আঠারো বছর যাবত।মোয়াজ জানে না সম্পর্ক ঝুলিয়ে রাখার মানে কি!হয় সম্পর্ক শেষ করুক নয়তো সুন্দর করুক।মাঝে অদ্রি সাফার করছে।মোয়াজকে চুপ থাকতে দেখে অদ্রি ভাইয়ের শার্টের হাতা ধরে টান দেয়।মোয়াজ ওর দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
‘’হুম আমাদের বাড়িতেই।যদিও তোর নানা,নানি,মামনি চলে গেছেন’’
‘’ওহ’’
ফুটবল মাঠের ওখানে যেতে যেতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়। অদ্রি -মোয়াজ দৌড়ে ছাউনির নিচে যায়।বড় ভাইকে মাঠের দিকে আসতে দেখেছিলো তাইতো বৃষ্টি শুরু হওয়ার সাথে সাথেই রিয়ানও ছুটে ছাউনির নিচে এসেছে।ছোট একটা বসার জায়গা এখানে।উপরে ছাউনি করা।একপাশে নারিকেল গাছ লাগানো।সামনের দিকটায় কাঠগোলাপ গাছ।ফুলও ফুটেছে।আর একটু দূরেই বাকি ছেলেপেলে বৃষ্টিতে ভিজে খেলছে।এটাই বোধহয় ভিন্ন আনন্দ।
‘’কি ভাই তুমি আর অদ্রি এদিকে কেন?’’
‘’অদ্রি বললো বের হবে।তাই ভাবলাম তোকেও নিয়ে যাই।তিনজন মিলে ঘুরে আসি’’(মোয়াজ)
‘’লিয়নকেও নিয়ে আসতে’’(রিয়ান)
‘’ঘুমাচ্ছে ও’’(মোয়াজ)
বৃষ্টি থামতে অনেক দেরি বুঝে অদ্রি ফোনের ক্যামেরা অন করে।ভিডিও করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার,শব্দের।অদ্রির হাতের জাদুতে ভিডিওটা প্রাণবন্ত।যেন সামনে থেকেই বৃষ্টি দেখা হবে এমন।রিয়ান আর মোয়াজ একটু দূরে কি নিয়ে যেন গুছুরফুসুর করছে।অদ্রি ঢোকেনি। ভাইদের মাঝে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকে।থাকতেই পারে।
১৭.
রেস্টুরেন্টে খেতে এসেছে অদ্রিরা।সন্ধ্যা কেবল।শেষ বিকেলটা ওরা রিকশায় ঘুরে কাটিয়েছে।ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো তখন।বেচারা রিয়ানকে রিকশার ওপরে উঠতে হয়েছিলো।খাওয়ার আগেই অদ্রি একবার ওয়াশ রুমের দিকে আসে।ফ্রেশ হয়ে যেই না বেরতে যাবে ওমনি কেউ একজন ওকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে আসে।আজলান বেহরান!
‘’এটা লেডিস ওয়াশ রুম।আপনি এখানে কেন?’’
‘’সরি?…’’
অদ্রি বাংলায় বলেছিলো।আজলান বুঝতে পারেনি।অদ্রির মন চায় নিজেকে মারতে।এমনেই ভয় পেয়েছে সে।আবার কেউ যদি দেখে ফেলে কি না কি রটাবে কে জানে!অদ্রি একই কথা ইংলিশে বলে।আজলান ডন্ট কেয়ার ভাব দেখিয়ে অদ্রিকে জেরা করতে শুরু করে। জিজ্ঞেস করে,
‘’তোমাদের সাথের ওই ছেলেটা কে?’’
‘’কে?’’
‘’তোমার পাশের চেয়ারে এবং রিয়ানের সামনের চেয়ারে বসেছিলো যে..’’
‘’আমার ভাই হয়’’
‘’কাজিন?’’
‘’হুম’’
‘’দূরে থাকবে।কাজিনকে বিয়ে করা জায়েজ আছে।তুমি আমার।তাই ভুলেও অন্যদের কাছে ঘেষবে না।’’
‘’ও হ্যালো,আমি কিভাবে আপনার?আর আমার ভাইদের নিয়ে বাজে বকবেন না।ওরা আমার ভাই’’
আজলান এগিয়ে আসে।অদ্রির কোমড় জড়িয়ে একবারে কাছে নিয়ে আসে।আজলানের উচ্চতায় অদ্রি বাচ্চা।আজলান পাঁচ ফুট দশ আর সেখানে অদ্রি কেবল পাঁচ ফুট দুই।অদ্রির অস্বস্তি লাগে।সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে।আজলান নিজের পকেট থেকে কিছু বের করে এনে অদ্রির চোখের সামনে ধরে।বলে ওঠে,
‘’এই যে এই চেইনটা পড়াবো।একটুও নড়াচড়া করবে না।ভালো বাচ্চা হয়ে থাকবে।নয়তো অন্যকিছু করতে সময় নেবো না’’
চেইনটা সুন্দর।তবে এমন কারো থেকে কিছু নেওয়ার ইচ্ছে অদ্রির নেই।সে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করতেই আজলান অদ্রির কপালে কপাল ঠেকিয়ে দেয়।আজলানের নিঃশ্বাস তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে।।অদ্রির শ্বাস প্রশ্বাস বেড়ে যায়।সে শান্ত হয়ে যায়।চোখ বন্ধ করে ফেলে।কেমন এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে চলে।আজলান ওর হাতের বাঁধন আলগা করে অদ্রির গলায় চেইনটা পড়িয়ে দেয়।তারপর সাথে সাথে দূরে সরে আসে।
অদ্রির চোখ তখনও বন্ধ।সে কোন দুনিয়ায় হারিয়েছে কে জানে।আজলান হাসে।সে হাসিতে আলাদা শান্তি আছে যেন।সে অদ্রিকে বলে ওঠে,
‘’এখনও নৈকট্য চাচ্ছো বুঝি?’’
অদ্রি ঝটপট চোখ খুলে। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সেকেন্ড কয়েকের ব্যবধানে রাগান্বিত হয়ে বলে ওঠে,
‘’আপনার সাহস কি করে হলো আমাকে ছোঁয়ার!আর..আর এই চেইন আমি জীবনেও আমার গলায় রাখবো না।এখনই খুলে ফেলে দিবো’’
অদ্রি চেইন খুলতে নেয়।আজলান রেগে যায়।অদ্রিকে দেয়ালের সাথে আটকে ফেলে।আজলানের কপালের রগ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।নীল আভা।আজলান অদ্রিকে আটকে দেয়ালে সজোরে ঘুষি মারে ,
‘’আমার ভালো রুপ দেখছো।খারাপ রুপ দেখাতে বাধ্য করো না।চেইন যেন গলাতেই থাকে নয়তো…’’
আজলান আর কিছু না বলেই বেরিয়ে যায়।অদ্রির চোখ জলজল করছে।কাকে বলবে সে এ সম্বন্ধে।কেউ নেই ওর!অদ্রির কান্না পায়।ও চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে আসে। সাধারণ থাকার চেষ্টা করে।ওরনার আড়ালে চেইনটা লুকিয়ে রাখে।
১৮.
জেনিয়া ফিরোজের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে সে বসেছে।সামনে খোলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। অনেকদিন বাদে বোধহয় বৃষ্টি আলিঙ্গন।আজ ওনার মেয়ের জন্মদিন।ঠিক আজকের এই দিনেই আঠারো বছর আগে তিনি ওনার মেয়েকে রেখে চলে গিয়েছিলেন। কতো গুলো বছর পর উনি ওনার মেয়েকে আবার দেখলেন!কি বাজে একটা কারণে ওনাদের সব শেষ হয়ে গেলো। আফসোস করেও যে এখন খুব একটা লাভ নেই।
ফোনের শব্দটাও এখন কর্কশ লাগে জেনিয়া ফিরোজের।মনে শান্তি না থাকলে সবই কেমন যেন লাগে!বুকটা ব্যথা করে।এখন রাত নয়টা।আটটার সময় গিয়ে মেয়ের খোঁজ করেছিলেন।বাড়িতে নেই। ভাইদের সাথে বেরিয়েছে।জেনিয়া ফিরোজের বিষয়টা খারাপ লাগেনি। বাচ্চা মানুষ এখন ঘুরা ঘুরি না করলে কখন করবে!
অপরিচিত নাম্বার দেখে জেনিয়া একটু চোখ কুঁচকান। পরবর্তীতেই নাম্বারটা চেনা লাগে।আদ্রের নাম্বার।নিজের ফোর্স খাটিয়ে নাম্বারটা জোগাড় করতে খুব একটা কষ্ট হয়নি জেনিয়ার। হঠাৎ তাকে কেন কল দিলো!জেনিয়া কল রিসিভ করেন।
‘’হাই’’
‘’জেনিয়া?’’
‘’ইয়েস’’
‘’জেনিয়া তুমি কি অদ্রির কাছে?’’
‘’তোমাদের বাড়িতে আছি’’
ওপাশ থেকে কোনো কথা আসে না। আহসানুল আদ্র উরফে সান বোধহয় এখন ভাবছে মেয়েকে আরো বেশি হারিয়ে ফেলার কথা।অদ্রির মা যদি ওকে ওর বিরুদ্ধে কথা বলে!আদ্র কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে আবার বলে ওঠে,
‘’জেনিয়া তুমি অদ্রির থেকে দূরে চলে যাও।এতোবছর তো দূরেই ছিলে।আবার কেন এসেছো?’’
‘’একই কথা যদি আমি বলি?’’
‘’আমি অদ্রির জন্মদাতা বাবা’’
‘’আমি অদ্রির গর্ভধারিণী মা’’
‘’জেনিয়া তোমার ঝগড়ার করার অভ্যাস এখনো বদলায়নি।মুখে মুখে তর্ক করা আমার অপছন্দ ‘’
‘’সত্যিটাকে যদি তুমি তর্ক ভাবো সেটা তোমার ভুল আদ্র।তুমি সত্যি মানতে পারো না।তোমার কারণেই অদ্রি আমাদের থেকে এতো দূরে।’’
‘’সব দোষ এখন আমার?তুমি কেন থাকোনি ওর কাছে!তুমি তো মা।’’
‘’তুমি আমাকে কি অপবাদ দিয়েছিলে মনে নেই?যেই সন্তানের জন্য স্বামী হারালাম তাকে তখন বুকে জড়ানোর মতন ক্ষমতা আমার ছিলো না।আর তুমিই তো বলেছিলে অদ্রি তোমার সন্তান হতে পারেনা।তাহলে এখন আবার নাটক করছো কেন?’’
আদ্র ওপাশ থেকে চিৎকার করে ওঠে।জেনিয়া তাচ্ছিল্য হাসে।তখনও এইলোক এমন ছিলো আর এখনও এমনই আছে।
অদ্রির যখন জন্মের কেবল ঘন্টা সাতেক ঠিক তখনই আদ্র হুট করে জেনিয়ার কেবিনে এসে সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলে।এই বাচ্চা পেটে আসার পর থেকেই ওদের মাঝে মনোমালিন্য বেড়ে যায়।একে তো অল্প বয়সে বিয়ের কারণে আদ্রের পড়াশোনাতে তেমন মন ছিলো না আবার অদ্রির জন্ম আদ্রের কাছে শূন্যতা ছিলো বোধহয়।আদ্র তখনই সন্তান চায়নি। কিন্তু জেনিয়া তখন প্রেগন্যান্ট।ওর প্রেগন্যান্সিতে সমস্যা আছে।বাচ্চা নষ্টের চেষ্টা করলে ওরও জীবনের ঝুঁকি।আর বাচ্চা নষ্টের মতন নিকৃষ্ট কাজ এই দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি হয়না।কথাটা মৌসুমী বেগম বুঝিয়েছিলেন ওদেরকে।তবুও অদ্রি জন্মের দিন আদ্র খেপে যায়।সে জেনিয়াকে বাচ্চা নষ্টের ঔষধ এনে দিয়েছিলো।জেনিয়া খায়নি।তাইতো রাগ করে আদ্র সেদিনই চলে যায়।বাড়ি থেকে পাসপোর্ট, জামাকাপড় সব নিয়ে কোথায় যেন চলে যায়।স্বামীর চলে যাওয়া দেখে জেনিয়া ভেঙে পড়ে। অদ্রি নরমালে হওয়ায় খুব অল্প সময়েই জেনিয়া স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারছিলো।স্বামীর সাথে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি কাউকে কিছু না জানিয়েই অদ্রিকে হসপিটালে রেখে বাড়িতে চলে আসেন।অবশ্য হসপিটালে ছিলেন ওনার শাশুড়ি মৌসুমী আর বড় ভাবী ফাতেমা জোহরা।ওনারা ওকে আটকাতে পারেনি।কেবিনের বাইরে বসেছিলেন ওনারা তখন।ভেতরে এসে দেখেছিলেন সেখানে ছোট একটা কাগজে জেনিয়া লিখে রেখে এসেছিলেন,
‘’বাবা-মা ছাড়া বড় হবে ও।ওর নাম অদ্রিতা জাবিন রেখো।পৃথিবীর মতন শক্ত হতে হবে ওকে’’
চলবে?