প্রনয়ের বাকবিতন্ডতা পর্ব-০৯

0
14

#প্রনয়ের_বাকবিতন্ডতা
#৯ম_পর্ব
#বর্ষা
২৬।
সপ্তাহ কেটেছে।অদ্রির পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ইদানিং সে নিশ্চিন্তে যাতায়াত করতে পারছে।আজলান বেহরান তাকে ম্যাসেজ দিয়ে কিংবা দেখা করে আর জ্বালায় নি। ইতিমধ্যে আযান তার সামনে পড়ায় তার হাতে সে আজলানের দেওয়া চেইন ফেরত দিয়েছে।বলেছে বলতে যে তার স্যার যেন মোহের পিছনে ছুটে সময় না নষ্ট করে‌।

ছোটবেলায় পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় প্রত্যেকের মা’কে অদ্রি আসতে দেখতো। এসএসসি যখন দিলো তখনও সবার মা’ই যেতো কেবল অদ্রি আর রিয়ান যেতো একা।ফাতেমা জোহরা যেতেন না। আজাদ মীর মুর্তজা ওদের বলেছিলেন একা একা নিজের কাজ করতে শেখো, নিজের প্রয়োজন নিজে হও।অদ্রি আর রিয়ানও তাইতো নিজেদের প্রয়োজন একে অপরকে বানিয়েছিলো।

আজ রিয়ান অনেক আগেই চলে গেছে।ওর কিছু জিনিস ব্যাক করতে হবে ওর কোনো এক বন্ধুকে।অদ্রি জানে না।যাওয়ার আগে রিয়ান তাকে এসবই বলে গেছে।তাইতো নাস্তার টেবিলে জিজ্ঞেস করায় সেও এটাই জানালো সবাইকে।অদ্রি চারপাশে তাকিয়ে মা’কে খোঁজে। কোথায়ও নেই। বোধহয় ঘরে।অদ্রির ইচ্ছে করতে মায়ের সাথে যেতে।কখনো তো হয়নি।ফাতেমা জোহরা গেলেও সে তো আর ওর আপন মা ছিলো না।তিনি রিয়ানকে আগে জিজ্ঞেস করতেন সবকিছু। নিজের সন্তানকে সবাই বেশিই প্রাধান্য দেয় এটাই স্বাভাবিক।

অদ্রিতা কোনোরকমে খেয়ে উঠতে নেয়। মিরাজুল করিম তার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দেন।আজাদ মীর মুর্তজা নাতিনের কপালে হাতিয়ে দোয়া করে দেন। মৌসুমী বেগম দোয়া পড়ে ফু দিয়ে দেন।ফাতেমা জোহরা দই-চিড়া খাইয়ে মাথায় চুমু দিয়ে দেন।বলেন,’’ভালো মতন পরীক্ষা দিস মা’’

বেরিয়ে যেতে উদ্যত হতেই হঠাৎ কেউ ওর হাত ধরে।জেনিয়া ফিরোজ।তিনি একদম রেডি হয়ে এসেছেন।পরনে থ্রিপিস। মা’কে প্রথমবার বোধহয় এ পোশাকে দেখলো সে।খুব সুন্দর লাগছে তাকে। অবশ্য মাঝারি চুলগুলো যেন তার মায়ের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়েছে। অদ্রি তাকিয়েই থাকে ওনার দিকে।তখনই আজাদ মীর মুর্তজা কাশি দিয়ে বলে ওঠেন,

‘’জেনিয়া ওকে আটকাচ্ছো কেন?ও পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে।তোমার যেখানে যাওয়ার যাও।ওকে যেতে দেও’’

‘’আমি আমার মেয়ের সাথে যাবো আব্বা।ওর কলেজে যাবো’’

মিরাজুল করিম কিছু বলতে চেয়েছিলেন বোধহয়। কিন্তু তার আগেই অদ্রির বলা কথাটা শুনে নিজের কথা নিজের ভেতরেই রেখে দেন তিনি।অদ্রি বলেছিলো,’’মাম্মা লেট হয়ে যাবে।চলো’’

মা-মেয়ে একসাথে বের হয়।জেনিয়া ফিরোজের ইন্টারন্যাশনাল ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে।রেসিং এর শখ পূরণ করতে গিয়ে যখন মরতে মরতে বেঁচেছিলেন সেদিন বাদ দিয়েছিলেন। অবশ্য তাও পুরোপুরি না।জেনিয়া ফিরোজ বাবার বাড়ি থাকতেই নিজের জন্য গাড়ি কিনেছিলেন।আসার সময় ওইটা নিয়েও এসেছিলেন।আজ মা-মেয়ে ওইটাতে করেই যাবে।মেয়ে মা’কে রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।আঠারো বছর যে অনেক কিছুর বদল হয়েছে।

কলেজের সামনে গিয়েই পার্কিং দেখে গাড়ি থামায় জেনিয়া।অদ্রির সাথে নেমে আসে।অদ্রির সাথে বহুদিন পর অপরিচিত এক মুখ দেখে অনেকের মাঝেই কৌতুহল বাড়ে।অদ্রি আর জেনিয়া ফিরোজের চেহেরায় খানিকটা মিল আছে।তবে চোখের মনিতে পার্থক্য।জেনিয়া ফিরোজ মায়ের মতন নীলচে চোখ পেয়েছে।আর অদ্রি পেয়ে বাদামী আর নীলের মিশলে এক অদ্ভুত চোখ।এমন চোখ সাধারণই দেখা যায় না।

জেনিয়া ফিরোজ মেয়েকে বলেন,

‘’অদ্রি আমি সাড়ে বারোটায় আসবো।একা একা যাবে না।আমি এসে তোমায় নিয়ে যাবো’’

অদ্রির মুখে হাসি ফুটে।সায় জানায়।আজ ওর অনেক ভালো লাগছে।আজকের পরীক্ষাটাও বোধহয় অনেক ভালো হবে।অদ্রি ভেতরে যেতে নিলেই সেদিন ওর সমালোচনা করা মেয়েটা এগিয়ে আসে। ওকে জিজ্ঞেস করে,

‘’অদ্রি তোর সাথে ওই মেয়েটা কি তোর আপু?কত সুন্দর দেখতে!’’

অদ্রির হাসি পায়।সত্যিই ওর মাম্মা অনেক বেশি সুন্দর। স্বাস্থ্য সচেতন নারী।তাইতো বয়স পঁয়ত্রিশ হলেও এখনো অব্দি তা ফুটে ওঠেনি।যেন বয়স পঁচিশের ঘরে কেবল!অদ্রি ওই মেয়েটাকে বলে,

‘’জেনে কি করবে’’

“বলনা কে রে?’’

‘’তোমার তো সোর্সের অভাব নেই। খোঁজ লাগিয়ে জেনে নেও’’

মেয়েটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়।তবে কিছু বলেনা।অদ্রিও আর দাঁড়ায় না।এই মেয়েটা ওকে যে পরিমাণে অপদস্থ করেছে তা বলার বাইরে।মন তো চায় কতকিছু বলতে। কিন্তু কারো মনে কষ্ট দিয়ে ফেলার ভয়ে কিছু বলা আর হয়না ওর।

২৭।

রিয়ান পরীক্ষা হলে না গিয়ে এখনও দাড়িয়ে আছে ছাদে। ওদেরই ক্লাসের তিনজন ছেলে ওকে এখানে নিয়ে এসেছে।কারণটা হলো রিয়ান ওদের নামে বিচার দিয়েছিলো।মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাই এই অসভ্যগুলোর কাজ।এরা রিয়ানের সাথে খুব বাজে আচরণ করছে।মেরেছে বেশ কয়েকটা চড় লাত্থি।ছেলেটা হাঁটু গেড়ে বসে আছে।

নাফিজ হচ্ছে এইগুলোর সর্দার।বাকি দুটো চামচা।রামিম,লিহাব।নাফিজ এগিয়ে এসে রিয়ানের চুলগুলো টেনে ধরে বলে ওঠে,

‘’আর কখনো যদি আমাদের নামে বিচার দিসনা তোর ওই গার্লফ্রেন্ডকে সবার সামনে *** ফেলমু’’

পুরো কলেজে কেউই রিয়ান আর অদ্রির সম্পর্ক নিয়ে সিওর না।ওরা কেউই জানে না যে ওরা দুইজন কাজিন ভাই-বোন। যেহেতু ওরা দুজন খুবই ক্লোজ তাই বাকিরা ওরা গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড ভাবে।যদিও ওরা চাইলেই সবার এ ধারণা ভাঙতে পারতো। কিন্তু ভাঙেনি। রিয়ান অদ্রিকে বলেছিলো যে এতে অদ্রিকে কেউ জ্বালাবে না।

নাফিজের কথা বলতে দেরি হলেও রিয়ানের আক্রমণ করতে দেরি হয়নি।পকেটের কাছে রাখা কলমটার মুখ খুলে একেবারে হাতে ঢুকিয়ে দিয়ে ওর।নাফিজ ব্যথায় চিৎকার করে উঠেছে।রক্ত গলগলিয়ে বের হচ্ছে। চিৎকারের শব্দটা যেন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে।রামিম,লিহাব ভয়ে পালায়।রিয়ান নাফিজের কলার ধরে বলে ওঠে,

‘’তোর সাহস কেমনে হয় ওরে নিয়ে কথা বলছ!ওরে আমি ভালোবাসি,আমি ভালোবাসি।শুনছোস?আমারে মাইরা ফেলতি কিছু বলতাম না। কিন্তু তোর কলিজা কেমনে হয় তুই ওরে নিয়ে কথা বলছ ‘’

নাফিজ ব্যথায় কাতরাচ্ছে।রিয়ান কলম বের করে নেয়নি।কলম বের করলেই গলগলিয়ে রক্ত ছুটবে তা ওর জানা।রিয়ান আবার বলে ওঠে,

‘’দেখছ তোরে বিপদে দেখেই তোর চামচা গুলা পলাইছে আর তুই ওদের পেছনে টাকা ঢালছ!সো স্যাড ব্রো’’

‘’প্লিজ ভাই কলেজের ডেসপেনসারিতে নিয়ে যা। আল্লাহ কসম আমি আর এমন করমু না’’

রিয়ানের শরীরে ব্যথা।যেভাবে মেরেছে নিজেরই একা দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে।তবুও নাফিজকে সাথে নিয়ে দোতলায় আসে সে।নাফিজকে ওখানে ইরা ম্যামের হাতে দিয়ে বেরিয়ে আসতেই রামিম,লিহাব ছুটে আসে।

‘’নাফিজ কি?’’

‘’ডেসপেনসারিতে আছে যা’’

রিয়ান হলের দিকে যেতে থাকে আর ভাবতে থাকে অদ্রিকে নিয়ে।হ্যা,ও অদ্রিকে ভালোবাসে।কেবল বোন হিসেবে না।আরো বেশি। কিন্তু অদ্রি ওকে কেবল বন্ধু,ভাই ভাবে।তাইতো নিজের অনুভূতিগুলোকে সে মাথাচাড়া দেয়নি।আজলানকে নিয়ে ওর কখনো হিংসা হয়নি।কেউ তো অদ্রিকে পাক!সে তো পাবেনা।আজলান অদ্রিকে ভালোবাসে ভেবেই রিয়ান আজলানকে সাহায্য করতে চেয়েছিলো। কিন্তু আজলানের সেদিনের ব্যবহার রিয়ানের পছন্দ হয়নি। একেবারেই পছন্দ হয়নি।নুহানের সাথে যখন অদ্রির বিয়ে ঠিক হলো।তখন ও কেঁদেকেটে মোয়াজকে বলেছিলো ওর ভালো লাগার কথা।তবে মোয়াজ বলেছিলো,

‘’অদ্রিকে ওদের বাবা-মা মেয়ে ভাবে।আর মেয়েকে বউমা বানানো যাবেনা।একেই অদ্রি বাবা-মা ছাড়া থাকে।অদ্রিকে যদি রিয়ানের সাথে বিয়ে দেওয়া হয় তখন পাড়াপড়শিরা অদ্রির চরিত্র নিয়ে পিঠপিছে আলোচনা করবে!’’

২৯।

আজলান তুরস্কে এসে পৌঁছেছে অনেকক্ষণ।বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে গাড়ি নিয়ে আবার বেরিয়েছে।আপাতত বাবার বাড়ি যাচ্ছে।সবার সাথে সে একসাথে থাকেনা।নিজের আলাদাই এক জগৎ ওর।সেখানেই নিজের মতন, নিজের নিয়মে ও থাকে।বাবার বাড়ি বললেও আজলানের বাবা মৃত।কত বছর আগেই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে।বর্তমানে সে বাড়িতে আছেন রিজিয়া বেগম,লিয়ানা দেওয়ান,আরমান বেহরান।

বেহরান ভিলাটা সুরক্ষিত করা বডিগার্ড দিয়ে।বিশাল ভবন।কত বিঘা জমির আজলান জানে না।ভবনে প্রবেশের পরপরই ওর দেখা লিয়ানার সাথে।সম্পর্কে ওর ভাইয়ের বউ ছিলো একসময়।বর্তমানে সম্পর্ক ভিন্ন।তবে আজলান এ সম্পর্কটা কেবল মানে আরমানের জন্য।আজলানকে আসতে দেখেই আরমান ছুটে আসে।আজলানকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে,

‘’পাপা মাম্মা আমায় তোমার কাছে যেতে দেয়না।মাম্মাকে একটু বকে দেও না।মাম্মা বলে তুমি নাকি আমাদের ভালোবাসো না তাই আসোনা’’

আজলানের চোয়াল শক্ত হয়।লিয়ানা নারীটা চরম বেহায়া।আসলানের সন্তান এই নারীর গর্ভে না থাকলে তখন আজলান ওতো বড় পদক্ষেপ ইহজন্মেও নিতো না।এখন তো ওর মনে হয় ওর ভাইকে এই বেহায়া নারীই মেরেছে।আজলান আরমানকে ঘরে যেতে বলে।লিয়ানার গলা চেপে ধরে বলে ওঠে,

‘’নির্লজ্জ হওয়ার সীমা আছে।তোর বাপ-ভাইয়ের সাথে মিলেই তো নাটক করেছিলি।আমার ভাইয়ের অংশকে নিয়ে হুমকি না দিলে তোকে মেরে কোথায় ফেলে আসতাম তাও জানতি না’’

‘’তোমার স্ত্রী হয় আজলান।সম্মানটা তো দিবে।তোমার সন্তানের..’’

‘’তুই আমার না আমার ভাইয়ের সন্তানের মা।আর ওর মা’ই থাকবি।আর হ্যা আরমানের বয়স কিন্তু আট হয়ে গেছে।বেশি বাড়াবাড়ি করলে তোকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো।আরমানকে আমার কাছে রাখা আমার জন্য কঠিন না কিন্তু ‘’

‘’আজলান তুমি এভাবে বলতে পারো না।আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমাদের বিয়ের সাতবছর হয়েছে।আমাদের লায়জার…’’

‘’ভালোবাসা হাহ!তুইতো আমার ভাইকেও ভালোবাসতি। কিন্তু তাকেও তো হত্যা করেছিস। ব্ল্যাকমেল করে আমাকে বিয়ে করেছিস।আগে যদি জানতাম তোকে মেরে গুম করতাম আমি।আর লাইজা ও তো তোরই প্রতারণার ফল। পাঁচবছর আগে যদি তুই ওমন না করতি তাহলে ওর অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে থাকতো না’’

আজলান চলে যায়।লিয়ানা কাঁদতে থাকে।লিয়ান ছোট মেয়ে লাইজা দরজার আড়াল থেকে বাবা-মায়ের ঝগড়া দেখে আঁতকে ওঠে।বাবার সান্নিধ্য ও কখনো পায়নি।ভাইকে বাবা কত ভালোবাসে আর ওকে দেখলেই ঘৃণা করে।লাইজা গুটি গুটি পায়ে মায়ের কাছে এগিয়ে যায়।মায়ের চোখটা মুছে দিয়ে বলে ওঠে,

”মাম্মা কেঁদো না।তুমি কাঁদলে আমারও কান্না পায়”

চলবে?