#প্রাচীর
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০১
নিশাত একটু তাড়াতাড়ি পা চালালো। সে এখন যাচ্ছে একটা টিউশনিতে! হেলে দুলে অফিস থেকে বের হতে হতে বলতে গেলে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে অবশ্য এমন কোন কথা নেই। তাড়াতাড়ি কেন এক ঘন্টা লেট হলেও সমস্যা নেই। এটা বলতে গেলে তার পার্ট টাইম টিউশনি। তাদের এলাকার মধ্যেই এক বাড়ি। ছাত্রের চেয়ে ছাত্রের মায়ের সাথেই তার ভাব বেশি।
এই টিউশনি ঘাড়ে নিয়ে সে আছে ছোট্ট একটা চাকরিতে ! চাকরি বলতে যা বুঝায় নিয়ম মাফিক আসো নিয়ম মাফিক যাও, আসলে সেই রকম কিছু নেই। তার চাকরি আরামের চাকরি। জাপানি একটা প্রজেক্টস। দরিদ্র শিশু কিশোর দের প্রাথমিক শিক্ষা, দরিদ্র মহিলাদের হাতের কাজ শেখানো, অভাবগ্রস্ত গর্ভবতী মায়েদের বিভিন্ন সেবা ও সাহায্য ইত্যাদি ইত্যাদি করে থাকে। তাদের এলকার ব্রাঞ্চে সে আছে। সে ছাড়াও আরো দু- তিনজন আছে।
অবশ্য সেবা বলতে নামের! যা আসে উপর থেকে খেতে খেতে থাকে ধুলা পরিমাণ। সেই ধুলা তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরামছে বসে থাকে। শুধু যখন উপর মহল থেকে অফিসার টফিসার আসে তখন একটু দৌড়াদৌড়ি এই যা, বাকি সময় আরাম’ই আরাম। যদিও বেতন খুব বেশি না। তবুও বাড়ির কাছে এরকম আরামের চাকরি আর কয়জনের’ই বা জোটে।
সে বলতে গেলে খুবই সুখী মানুষ! ঐ যে কথায় আছে না সুখে থাকলে ভূতে কিলায়। এই টিউশনিটা কিছুটা সেই রকম। দুনিয়ার বিশ্ব বাঁদর। কোন টিচারই টিকে না। একই এলাকার মানুষ হিসেবে পরিচিত। তাই খুব করে বললো। এভাবে বললে কি আর নিষেধ করা যায়? তাই সেও রাজি হলো। কেউ না টিকলেও সে টিকে গেলো। অবশ্য না টিকে উপায় কি? সে হলো বসে বসে মাছি মারা টাইপ টিচার। কি দরকার মেরে ধরে এতো শেখানোর। সে হাই তুলে আরামছে নাস্তা টাস্তা খায়। স্টুডেন্টের মায়ের সুখ দুঃখের গল্প শুনে। ব্যস এভাবেই আরামে যাচ্ছে দিন।
নিশাত হাঁটতেই হাঁটতেই গুনগুন করতে লাগলো! তার গানের গলা ভালো। ভালো বলতে বেশ ভালো। সজল ভাই প্রায়ই বলবে,” একটা পেজ খুলে ফেলি নিশু। শুধু তোর গান ছাড়বো। দু- দিনেই ভাইরাল।
নিশাত হাসে! কারণে অকারণে হাসার রোগ তার আছে। অবশ্য হাসির আসল কারণ কেউ জানে না। হাসি এমন এক জিনিস। যা দিয়ে দুনিয়ার সব কিছু আড়াল করা যায়। দুঃখ আড়াল করা যায়, কষ্ট আড়াল করা যায়। এমনকি ঘৃণা, রাগ, জেদ, মনের পোষা আগুন সব । দুনিয়ার দারির অর্ধেক মানুষতো এই হাসির উপরই টিকে আছে।
তাই সেও হেসে হেসে দুনিয়া দারিতে খুঁটি গাড়ছে। টিকে থাকতে তো হবে নাকি। তাই সেই দিনও হেসেছে। তার বাবা ভাইরাল টাইরাল হওয়ার ইচ্ছে নেই। আসলেই নেই। সে শান্তি প্রিয় মানুষ। খেয়ে দেয়ে আরামছে গুনগুন করে এতেই শান্তি। এই যে যেমন এখন করছে , “আমার মতো আছে কে সুখে, আয় সখীরা আমার কাছে”
তখনি বিকট শব্দ হলো। যেন তেন বিকট না। পুরো কলিজা কেঁপে উঠা বিকট। নিশাত তো পুরো হেলে দুলে গেলো। হেলেদুলেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলো। হলোটা কি ? সে আশে পাশে দেখতে দেখতে মাথা ঘুরিয়ে পিছনে ফিরতেই দেখলো এক্সিডেন্ট হয়েছে।
কি কান্ড দেখতো! এখন শাখা রাস্তার মধ্যেও এক্সিডেন্ট হচ্ছে । নিশ্চই কোন বড় লোক বাপের ব্যাটা। নেশা টেশা করে গাড়ি চালাচ্ছে। ফালতু যত্তোসব! এদের জন্যই না সব শান্তি নষ্ট। আরামছে একটু হাঁটা হাঁটি করবে সেই জোগাড়ও নেই। কলিজা, ফেপসা হাতে নিয়ে রাস্তা ঘাটে চলাচল করতে হয়। শালা বদমাইশের দল! এই বদমাইশদের জন্যই সাধারণ মানুষের সব শান্তি বিনষ্ট।
বলেই নিশাত মহা বিরক্ত হলো। এই মহা বিরক্ত নিয়েই আবার যেতে নিলো। বদমাইশদের জন্য সময় নষ্টের মানে হয় না। তবে যেতে গিয়েও আবার দাঁড়ালো! দাঁড়িয়ে সেখান থেকেই একটু উঁকিঝুঁকি মারলো! বাঙালি বলে কথা! শান্তি যতোই নষ্ট হোক কৌতুহল থাকবেনা? গাড়িটাও বাবা বেশ দামি। তোরা থাকবি গুলশান বানানীতে, এইরকম বস্তি এলাকাতে তোদের কাম কাজ কি?
নিশাত উঁকিঝুঁকি মারতে মারতেই দু- কদম এগুলো। জায়গাটা মেইন রাস্তা থেকে একটু ভিতরে। বসত এলাকা আরেকটু ভিতরে, তাই গলিটা বলতে গেলে পুরোই ফাঁকা, তবুও তার মতো কিছু লোকজন এসে জমা হয়েছে। ফিরে যাবে, না যাবে না। দু মন দুয়াশার মাঝে নিশাত আরো এগিয়ে গেলো। না গিয়ে উপায় কি? মনের শান্তি বড় শান্তি। মন চাইছে এই তামাশা আরো একটু দেখতে। তাই বাবা চলো! মুখ দর্শন যেহেতু হয়েছে চরণ আর বাদ থাকিবে কেন?
নিশাতের মতো বাকি সবাইও উঁকিঝুঁকি মারছে। গাড়ি ভিতর থেকে লক, তার মধ্যে কালো গ্লাস! ভেতরের কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবে কেউ আছে, সারা শব্দ নেই অবশ্য। তবে অনুমান করা যাচ্ছে। এটা তো আর টারজান দ্যা ওয়ান্ডার কার না, যে একা একাই চলবে।
নিশাত এগিয়ে পুরো গাড়িটাকেই একবার ঘুরে ফিরে দেখলো। গাড়ির যে অবস্থা! ক্যারেন্টের খাম্বার ভিতরে অর্ধেক সেঁধে গেছে। পটল তুলে ফেলেছে কি না কে জানে?
সে পেছন থেকে বললো, চাচা, ভাইয়েরা উঁকিঝুকি না মেরে গাড়ির কাঁচটা ভেঙে ফেলেন তাহলেই ভেতরের আপডেটা একটু জানা যাবে। দম যদি থাকে ব্যবস্থাও তো করা দরকার।
তার কথা শুনে সবাই তার দিকে তাঁকালো! নিশাত জোরপূর্বক একটু হাসলো! এটাকে অবশ্য হাসি বলা যায় না। ঠোঁট ভ্যাটকানো বলা যেতে পারে।
সে ভ্যাটকিয়েই একটু সাইড হলো। উপস্! গাড়ির অবস্থা দেখে আবেগী হয়ে মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে। তা না হলে ভালো কি বা মন্দ। অন্যের কোন কাজে টাজে সে নেই। সত্যিই নেই! সে মহাত্মা গান্ধীর তিন বানরের নীতে চলার চেষ্টা করে। যেমন না কিছু দেখে, না কিছু শুনে, না কিছু বলে। তবে আজ মুখ ফসকে বের হলো কেন কে জানে?
অবশ্য তার কথায় কারো মাঝে খুব একটা আগ্রহ দেখা গেলো না। না থাকারই কথা। কে চায় সেঁধে ঝামেলা ঘাড়ে নিতে। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাইডে থেকে এক লোক এগিয়ে এলো। হাতে তার বড় সাইজের একটা ইট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে শরীরে গোস্তের পরিমাণ কম থাকলেও মনে প্রাণে তার বেজায় উৎসাহ।
এগিয়ে আসতে দেরি তবে মারতে দেরি হয়নি! উৎসাহ যতো ছিল শক্তি তার ছিটেফোঁটাও নেই। না থাকার’ই কথা। বরং থাকলেই অবাক করা বিষয় হতো। তাই কাঁচ ভাঙেনি তবে ফেটেছে। অবশ্য দামি গাড়ির দামি কাঁচ বলে কথা। লোকার বাসের হলে সমস্যা ছিল না, ছোট্ট পাটকেলেই ভেঙে চৌচির।
নিশাত নিজের নীতির বাইরে গিয়ে আবারো একটা অকাজ করলো। আবার এগিয়ে উৎসাহ দিয়ে বললো। — “ভাই আরেকটা মারেন। প্রথমটায় যেহেতু ফেটেছে আরেকটায় নিশ্চয়ই ভাঙবে। ”
বলে নিজেই অবাক হলো। আল্লাহ! আজকে হচ্ছে কি তার সাথে? নিজের কাজে তো নিজেই বিস্ময়ে খাবি খেতে হচ্ছে। ভেতরের মানব দরদি মনে হয় আজে ফেটে বেরুতে চাইছে। সাবধান নিশাত, সাবধান। অতি ভালোই গলার দড়ি হয়।
বাকি জনতাও সায় জানালো! নিজেরা না পারুক, আরেকজন পারছে এই কম কি?
এবারো বলতে দেরি মারতে দেরি নেই। যাক, এবার দামি গাড়ির দামি কাঁচের মান ভেঙেছে। আর ভাঙতেই এক লম্বা চওড়া লোকের মুখ দৃশ্যমার হলো। জ্ঞান নেই, হেলে পড়ে আছে। সম্ভবতো মাথায় লেগেছে। রক্তে মাখামাখি। সিটবেল্ট পরা না থাকলে এই বেটার মাথা নির্ঘাৎ কদবেল ভর্তা হয়ে যেতো।
অবশ্য তার ভাবনা খাপে খাপ মিলে গেছে। বড় লোক বাপে ব্যাটাই। আলালের ঘরের যে দুলাল দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ওরে বাবা হাতে কি রোলেক্স নাকি?
সেই ইটওয়ালা ভাই ভাঙা কাঁচ গলিয়ে হাত ভেতরে নিয়ে লক খুললো। খুলে নাকের কাছে হাত নিয়েই বললো, — বেঁচে আছে, আরে বেঁচে আছে বলেই সবার দিকে তাঁকালো! কোন আশায় তাঁকালো কে জানে। আজকাল এক্সিডেন্টে বাঁচার চেয়ে মরা বেশি এন্টারটেইনমেন্ট।
তাই কারোই আর তেমন উৎসাহ দেখা গেলো না। বরং সবার এমন ভাব মরলেই ভালো ছিলো, ঝামেলা শেষ। একেক জন তো কেটেও পড়লো। বাকি যে কজন আছে তারা কবিতার মতো বলল, হাসপাতালে নিতে হবে, হাসপাতালে নিতে হবে। অথচ নেবে টা কে? এখান থেকে থানা বলুক আর হসপিটাল সবই বহুত দূরে।
ইটওয়ালা ভাই হতাশ হলো! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, কেউতো আসেন লোকটাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে।
এবার বাকি কয়েকজনও কেটে পড়তে লাগলো । অবশ্য এই বাকি কয়েকজনের মধ্যে সে নিজেও। সে ভাই আগেই বলেছে, সে শান্তি প্রিয় মানুষ। দুনিয়া দারির কোন ঝামেলায় নেই।
লোকটা তার দিকে অবাক হয়ে বললো — আপা আপনিও চলে যাচ্ছেন ?
নিশাত চোখে মুখে এক বালতি অসহায় এনে বললো — ভাই আমি অবলা নারী, কি বা করবো?
লোকটা একটু রেগে বললো — একটা মানুষ মরে যাচ্ছে আর আপনি ইয়ার্কি করছেন? সাহায্যের জন্য অবলা আর সবলা কি?
তাও কথা! মনরে মন, তোর জ্বলায় আর বাঁচি না। তোর শান্তির চক্করে এখন লও ঠেলা। সে এগিয়ে গেলো। সারা জীবনতো এমনি এমনি পার করে ফেললো । চলো আজ একটু পূর্ণ্য করা যাক। মানব দরদি সেকশনও একটু শান্তি পাবে। জীবনে অন্তত একবার কাজে এসেছে।
তাকে এগিয়ে যেতে দেখে লোকটা বললো — রিকশা করেতো নেওয়া যাবে না, আপনি একটু দাঁড়ান আমি মেইন রোড থেকে সিএনজি নিয়ে আসছি। বলেই লোকটা দৌড়ে চলে গেলো।
নিশাত মাথা চুলকালো! এই লোক তো মহা সমাজ সেবক। তখনি উঁহ্ শব্দ হলো। নিশাত চমকে ফিরে তাঁকালো।
লোকটা মনে হচ্ছে পুরোপরি জ্ঞান হারাইনি।সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে লোকটাকে সোজা করলো। গালের মধ্যে আলতো থাপড়ে বললো — আপনি ঠিক আছেন। হ্যালো ভাইয়া, হ্যালো, ।
লোকটা কোনরকমে টেনে চোখ খুললো! খুলে কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে রইলো। তবে মনে হচ্ছে না কিছু দেখছে। বাল্ব ফিউজ হওয়ার আগে যেমন ফুরুৎ করে জ্বলে উঠে এটাও মনে হয় সেই রকম কিছু।
আর তার ভাবনাকে সত্যি করে লোকটা সত্যি সত্যিই কিছুক্ষণ তাঁকিয়ে পুরোপরি জ্ঞান হারালো। যাকে বলে পুরোপুরি আউট।
নিশাত বেরিয়ে এলো ! দু- মিনিটের মাথায় মহা সমাজ সেবক সিএনজি নিয়ে হাজির। আনতেই সে, মহা সমাজ সেবক আর সিএনজিওয়ালা ধরাধরি করে সিএসজিতে তুললো। গাড়ির ভেতরে দরকারি তেমন কিছু নেই। মোবাইল টোবাইলও নেই। নিশাত একবার চোখ বুলালো। সে ভালো করেই জানে, তারা সরতেই কেউ না কেউ আসবে গাড়ি হাতড়ে দেখতে। তবে হাতড়ে নেওয়ার মতো তেমন কোন জিনিস নিশাতের চোখেই পড়লো না। কেমন বড় লোকের ব্যাটা কে জানে? তবে এই ব্যাটাকেই তুলতে গিয়ে বলতে গেলে তারা তিন তিনটা মানুষ গড়াগড়ি খেলো। কি খেয়ে এমন সাইজের হয়েছে কে জানে? লম্বায় জিরাফ ফেল।
সে বিরক্ত মুখেই ওড়না দিয়ে মাথা চেপে ধরলো। যেতে যেতে তো শরীরে আর কিছু বাকি থাকবে না। আহারে তার জামাটা। শেষ একদম শেষ। কোন দুঃখে যে আজই পরেছিলো। এই বেগুনি রং’ই তার জন্য কুফা। জনমকার কুফা! এর আগে একবার এই রংয়ের ড্রেস পরেই ড্রেনের জন্য খোঁড়া গর্তে উলটে পড়েছিল, আরেক বার রিকশা থেকে। আজ আবার এই ঝামেলা। ধুর! জীবনে আর এই রংয়ের জামা’ই কিনবে না। বলেই লোকটার মুখের দিকে তাঁকালো। কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। ওরে বাবা কোলের উপরেই মরে গেলো নাকি?
নিশাত তাড়া লাগিয়ে সিএনজি ওয়ালাকে বললো, — তাড়াতাড়ি টানেন চাচা। মরে টরে গেলে দায় নেবে কে? সামনে যেই হসপিটাল পান সেটাই নেন। টাকা পয়সা ব্যাপার না। লাখ টাকার হাত সাথেই আছে।
সমাজ সেবক কটমটিয়ে তাঁকালো। নিশাত আগের মতোই একটু হাসলো । একে অবশ্য এবারো হাসি বলা যায় না। ভদ্রতা সূচক ঠোঁট ভ্যাটকানো বলা যেতে পারে।
চলবে…..