#প্রাণনাশিনী
#পর্ব_০৮
#সুহাসিনি_মিমি
দীর্ঘ একদিনের প্রবল ঝড় শেষে ধরণীতে নেমে এসেছে স্বচ্ছ, শান্ত এক সকাল। গতকাল দুপুরের দিকে কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে ফের শুরু হয়েছিল বৃষ্টির তাণ্ডব। যা অব্যাহত ছিল সারারাত জুড়েই। ঝরেছে অঝোর ধারায়। এই লাগাতার বৃষ্টিতে গ্রামের চারপাশের দৃশ্য হয়ে উঠেছে অস্বাভাবিক ও বিষণ্ণ। ছোট ছোট কাঁচা ঘরের পুরোনো টিনের ছাউনি খুলে এসে পড়েছে উঠোনজুড়ে। গাছের অধিকাংশ পাতা হয়তো ঝরে পড়েছে বৃষ্টির স্রোতে, আবার কিছু গাছ যেন মাটির সঙ্গে এক হয়ে নুইয়ে পড়েছে ভারসাম্য হারিয়ে।
সকাল পেরিয়ে গেছে ৯টা ৩৫ মিনিট। ঝকঝকে রোদ্দুর গাছের পাতার আড়াল ফাঁকি দিয়ে জিকিমিকি করে খেলে বেড়াচ্ছে সুবহাদের উঠোনজুড়ে। সেই আলোয় পা রেখে, পিঠে ব্যাগ চাপিয়ে হাজির হলো শিউলি। গতকাল তানভীরের সঙ্গে বাইরে বেরোলেও বেশি কিছু কেনার সুযোগ হয়নি তার। বৃষ্টির চোটে বের হতে পারেনি। হালকা পাতলা কিছু কিনা কাঁটা করেই বাড়িতে দিয়ে গেছে তানভীর শিউলি কে। তবে বাড়ির সামনে আর যায়নি। মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দিতেই তড়িঘড়ি করে বৃষ্টি নামার আগে ভাগেই নিজ বাড়ির ভিতরে পারি জমিয়েছে শিউলি। সুবহার সাথে তারপর থেকে আর কোনো যোগাযোগ হয়নি শিউলির। আজ স্কুলে যাওয়ার উদ্দেশ্যই কাঁধে ব্যাগ ঝাঁপিয়ে এসেছে বান্দুবীর বাড়িতে। কিন্তু দরজা পেরোতেই বিলকিস বেগমের গম্ভীর ও কঠিন হুঁশিয়ারি কণ্ঠে থমথমে খায় শিউলি,
–“তোদের না কতবার বারন করসিলাম শিউলি? রাস্তায় বৃষ্টি দেখলে কোনো খানে দাঁড়াইয়া থাকবি। দরকার হইলে একটু দেরি কইরা বাসায় আবি তাও বৃষ্টি টে ভিজবি নাহ! তুই জানোস নাহ সুবহার বৃষ্টির পানি সহ্য হয়না। মাথায় পড়লেই যে অসুখ করে?”
শিউলি হকচকিত নয়নে থেমে দাঁড়িয়ে শুনলো বিলকিস বেগমের কথা। মুখে রা তুললো নাহ। তার বান্দুবী যে গতকাল বৃষ্টি টে ভিজসে সে কথা তো তার অজানা। আন্দাজে কি উত্তর করবে সে? তাই চুপ করে থাকায় শ্রেয় ভেবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো বিলকিস বেগমের কথার। বিলকিস বেগম শিউলিকে পরপর কড়া গলায় আওড়ালেন,
–“এরপর থেইকা আর কখনো বৃষ্টি টে ভিজবি নাহ। আজ স্কুলে যাইবো নাহ সুবহা। গতকাল রাইত থেইকা গাঁ কাঁপাইয়া জ্বর আইসে। তুই চইলা যা।”
বলেই এক বালতি কাপড় উঠোনে মেলতে শুরু করে বিলকিস বেগম। শিউলি মনে দ্বিধা নিয়ে ঢুকে সুবহার ঘরে। রুমের ভিতর সুবহার নির্জীব অসুস্থ মুখশ্রী দেইখা বুক কেঁপে উঠে শিউলির। দরজায় এক পল উঁকি মেরে দ্রুত এসে দাঁড়ায় বাঁন্দুবীর সামনে। কাঁধ থেকে ব্যাগ টা নামিয়ে খাটের উপর পা ভাজ করে বসে। সুবহার দু চোখ বন্ধ। মুখটা কেমন মলিন জ্বরে শুখিয়ে নেতিয়ে গেছে মাত্র এক দিনে। কপালে হাত স্পর্শ করতেই চোখ মেলে তাকায় সুবহা। ব্রু কিঞ্চিৎ কুচকিয়ে তাকিয়ে থাকে শিউলির দিকে।
–“কিরে মাইয়া গতকাল বৃষ্টি টে ভিজতে গেসোস কে? জানোস না বৃষ্টির পানি যে তোর সহ্য হয়না?”
সুবহা উত্তর করলো নাহ। নিস্তেজ দুর্বল শরীর তার সায় দিলো না শিউলির অযাচিত প্রশ্নের উত্তর দিতে। এই সবটা তো এই মেয়ের জন্যই হয়েছে। এর জন্য দায়ী এই শিউলির বাচ্চাই। তবে কেন জানি সুবহা রাগ করে থাকতে পারেনা। আর চাইলেও রাগ দেখাতে পারেনা সবার সাথে।
উঠে বসলো সুবহা। পিঠে দুটো বালিশ ঠেকিয়ে। কপাল কুচকিয়ে বলল,
–“তুই আমারে একা রাইখা কই গেসিলি গতকাল। তোর জন্য আমার জ্বর আইসে”
–“হুস আস্তে কো মাইয়া। তোর মায় শুনতে পাইবো।”
–“পাইলে পাক। তুই সবসময় আমারে ফাঁসাইয়া দিয়া ভাগোস। তোর লাইগা ক্ষতি হয় আমার।”
–“আরেহ আমি কি জানতাম নাকি হঠাৎ কইরা বৃষ্টি আইয়া পড়বো। আর নাওফিক ভাই না তোর লগে আসিলো? তাইলে বৃষ্টি টে ভিজসোস কেমনে?”
শিউলির কথায় স্তব্ধ বনে যায় সুবহা। না চাইতেও চোখের কোণে ভেসে উঠলো গতকাল এর সেই স্মৃতিচরণ। এইতো গতকাল যখন বৃষ্টির তোপ একটু খানি কমে এসেছিলো তখনই তো সুবহা মাথায় কালো হিজাব টা পেঁচিয়ে দৌড়ে ছুটে এসেছিলো লোকটার কাছে। লোকটা এই মেলা ঝড় এর মধ্যে বাইকে পা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল নির্নিমেষ! সুবহার ছোট্ট নরম মনটা যে বিষন্নতায় ভরে উঠছিল সেই দৃশ্য দেখে। লোকটাকে তো সেই আদেশ করেছিল তার সাথেই থাকতে তাহলে হঠাৎ করেই সেখান থেকে এসে এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়েছিল কেন? সুবহা আর কথা বাড়ায় নি। সুবহা কে দেখা মাত্রই বাইকে উঠে বসে নাওফিক। সুবহা ও পিছনে উঠে বসতেই বাড়ির সামনে এনে নামিয়ে দেয় তাকে। সুবহা নেমে যায় নিঃসব্দে। একটা কথা ও বলেনি আর না পিছন ফিরে তাকিয়েছে। পিছনে ফিরে তাকালে হয়তো বুঝতে পারতো বা দেখতে পারতো কারো তৃষ্ণার্থ দৃষ্টি যুগল কিভাবে তার দিকে নিস্পলক চেয়ে ছিল সেই দৃশ্য!
–“বৃষ্টি তে মানুষ কেমনে ভিজে জানোস নাহ? তুই কই ছিলি বলতো? তোকে দেখলাম না কেন?”
–“আমারে তো তানভীর ভাই মেলা কিসু কিন্না দিসে জানোস? আরো কিনতে পারতাম কিন্তু বৃষ্টির লাইগা সব শেষ। আইচ্ছা তোরে কি কিন্না দিসে রে নাওফিক ভাই?”
শিউলির কথায় সুবহার মুখ চুপসে গেলো। সে যে আকাম করে আসছে সেটা বলা যাবেনা এই মেয়েকে। এমনেই শিউলির মুখ পাতলা। যদি জানে সে কাজী অফিসে গিয়ে স্বয়ং বিয়ের সাক্ষী দিয়া এসেছে দেখা যাবে তখন এই মাইয়া চিল্লাইয়া পুরা গ্রাম মাথায় তুলবে রীতিমতো। এমনিতেই গতকালের ভয় আর বৃষ্টির পানি মিলেমিশে আজ তার এই অবস্থা”
–“কিরে কস না কেন? দেহি তোরে কি কি কিন্না দিসে।”
–“আমারে কিসু দেইনাই। আর দিলেও কি আমি নিমু নাকি? আমি তর মতো নাহ।”
–“কি কস তাইলে তোরা কই ছিলি? আর বৃষ্টি তে ভিজলি কেমনে?”
–“বার বার একই কথা কইস নাতো শিউলি। তুই স্কুলে যা। আম্মা আইসা দেখলে আমারে বকবো। ঔষুধ খাইতে কইসে ঘুমের ভান ধইরা আসিলাম। যদি দেহে আমি জাইগা রইসি জোড় কইরা আইয়া ওই সাদা তিতা ঔষুধ মুখে পুড়বো আমার। ”
শিউলি বুঝলো বান্দুবীর মনের অবস্থা। এই মেয়ে ঔষুধ দু চোখে সহ্য করতে পারেনা। তাই একবার জ্বর বাঁধাইলে আর সারতে চায়না। কথা বাড়ালো নাহ আর। এমনিতেই স্কুলে দেরি হয়ে গেছে তার। ১০ টায় ক্লাস। ধপ করে খাট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ টা পুনরায় কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো শিউলি। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে কি মনে করে যেন আবার ফিরে তাকালো বান্দুবীর দিকে। জহুরি চোখে বলে গেলো,
–“মাইয়া তুই কিজানি লুকাইতাসোস! আমি স্কুল থেইকা আইয়াই তোরে ধরতাসি দ্বারা।”
**
বেলতলার ঘাট ধরে হেঁটে চলেছে শিউলি। মনের আনন্দে, পায়ে হালকা ছন্দে। সুবহার বাড়ির পেছনের পুরনো জাম গাছটা চোখে পড়তেই থমকে দাঁড়াল শিউলি। গাছের নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ঝরে পড়া কাঁচা-পাকা জাম। বাচ্চারা ভোরেই পাকা গুলো তুলে নিয়ে গেছে। শিউলি কুড়িয়ে নিলো একটা সবুজ ডালের গোছা। সেটা নাড়াতে নাড়াতে হাঁটছিল রাস্তায়। হঠাৎই চোখে পড়লো বটগাছের নিচে বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নাওফিক কে।
ছাই রঙা ট্রাউজারের উপর কালো শার্ট জড়িয়েছে আজ লোকটায়। এই লোকটা নিঃসন্দেহে এই গ্রামের সবথেকে সুদর্শন ব্যক্তি। নাহ! শুধু এই গ্রামের বললে ভুল হবে শিউলির দেখা সব থেকে সুদর্শন ব্যক্তিই হইলো এই চেয়ারম্যান এর ছেলে শিউলি তো আর কম গ্রামের মানুষ দেখে নাই এই ১৬ বছর জীবনে! অহরহ পথে ঘাটে কত মানুষ দেখেছে সে।
নাওফিক দূর থেকেই তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। তারপর গম্ভীর গলায় বলল প্রশ্ন করে উঠলো,
–“তোর সাথের জন কই রে, শিউলি?”
শিউলি ডালটা হাতেই নাড়াতে নাড়াতে একটু দূরে দাঁড়িয়ে উত্তর দিলো,
— “সুবহা আজকে স্কুলে যাইবো না, নাওফিক ভাই।”
কথাটা শুনেই যেন কিছু একটা ভিতর থেকে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়লো নাওফিকের। চোখদুটো মুহূর্তেই ভারী হয়ে উঠলো। ঠোঁট ভিজিয়ে অস্থির গলায় প্রশ্ন করল,
— “কেন? কী হইছে ওর? স্কুলে যাবে না কেন?”
— “ওর শরীর ভালা না। শুনলাম কালকে বৃষ্টিতে ভিজসে। শরীর কাঁপাইয়া জ্বর আইসে রাইতে”
নাওফিক কপাল কুঁচকে ফেললো। সে জানে, সুবহার ঠান্ডায় সমস্যা। বৃষ্টির পানিতে শরীর খারাপ হয়। জ্বর আসে। । তবু মুখে কিছু বলল না।
–“আচ্ছা, তুই যা।”
কিন্তু শিউলি গেলো না। চোখে একরকম চিন্তা আর কৌতূহল মিশিয়ে তাকিয়ে রইলো নাওফিক এর পানে। আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
–“আপনারও কি শরীর ভালা না, নাওফিক ভাই? কী হইছে আপনার?”
নাওফিক পকেট থেকে ব্যস্ত হাতে ফোন বের করলো। স্ক্রিনে তাকাতে তাকাতে গলা নিচু করে বলল,
–“তোর বান্ধবীর যা হইছে, তাই।”
শিউলি চোখ গোল করে বলল,
— “জ্বর আইসে আপনারেও? আপনেও কি বৃষ্টিতে ভিজছিলেন?”
এই প্রশ্নে যেন কাঁটার মতো খচখচ করে উঠলো কিছু একটা। হঠাৎ করেই গম্ভীর গলায় ধমকে উঠলো নাওফিক,
–“তোরে এখন সব প্রশ্নের কৈফিয়ত দিতে হইবো শিউলির বাচ্চা? স্কুলে যা, যলদি।”
আচমকা ধমকে শিউলির সাহস হলোনা এখানে দাঁড়িয়ে থাকার। ডালের গোছাটা আঁকড়ে ধরে প্রায় দৌড়ে পালালো সে। মনে মনে ভাবতে লাগল, সে আবার কী এমন জিজ্ঞেস করল যে এভাবে হঠাৎ চেইতা উঠলো?
শিউলি যেতেই পরপর কারো নাম্বারে কল লাগায় নাওফিক ত্রস্ত হাতে। কানে ফোন চেপে ধরতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলোনা তার ফোনটা। গটাগট হাতে আবারো একই উত্তেজনা ভঙ্গিতে কল লাগায় লাগাতার।
–“এই সালা তোরে আমি রাখসি কোন কারণে? সালা আকামের ঢেকি তুই থাকস কোন দুনিয়ায়?”
শ্রেয়ান সবেই নাস্তার টেবিলে এসে বসেছে। ফোনে লাইভ ফুটবল ম্যাচ দেখছে আর্জেন্টিনার। সামনে বসা বিলকিস বেগম। লেকচার ছাড়ছে কোনো কাজ কাম না করায় ছেলেকে। এমন সময় আকস্মিক নাওফিক এর ফোন আসলে প্রথমে সেটা রিসিভ না করে মুট করে দিলেও নাওফিক এর লাগাতার কোলে একটা সময় বাধ্য হয়ে রিসিভ করে নেয় শ্রেয়ান। পরপর রিসিভ করতেই এমন কিছু শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা সে। বিনিময়ে মুখ দিয়ে শুধু হম হুম ছুড়লো। বন্ধুর মুখে নিজের প্রশ্নের উত্তরে হুম হুম শুনতেই রাগের পারদ আকাশ ছুলো নাওফিক এর।
–“তোর বইন অসুস্থ সেই খবর আমার বাইরে থেইকা জানতে হইবো কেন? তুই কি গরুর ঘাস কাটস? কালকে রাত থেইকা যে জ্বরে ভুগতাসে তুই আমায় বলস নাই কেন?”
শ্রেয়ান এবারও চুপ রইলো। মায়ের সামনে মুখ খুলে কিচ্ছু বলতেও পারছেনা আর না পারছে ভাতের প্লেট রেখে উঠে যেতে। উত্তরে এবার বলল,
–“হ্যাঁ হ্যাঁ বল শুনছি। তারপর আংকেল এর কি অবস্থা এখন? কোন হস্পিটালে আছে?”
–“তোর বাপের হসপিটালে। বাই* কালকে রাতে কয় পেক খাইসোস? আবোল তাবোল বকতাসোস আমার লগে। আমি এখুনি তোদের বাসায় আসতাসি রাখ তুই!”
শ্রেয়ান এবারও ঠান্ডা মাথায় উত্তর করলো হূ হূ। পরপর তার মস্তিষ্কে নাওফিক এর কথা মানে আয়ত্তে আসতেই হকচকিত হয়ে দ্রুত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো বসা হতে। চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
–“না না না ভাই না! প্লিজ না!”
বিলকিস বেগম ছেলের মুখের চেহারা দেখে সন্দেহে ভুরু কুঁচকালেন।
— “এই, কি হইলো? কার লগে কি নিয়া চিল্লাচিল্লি করতাসোস শ্রেয়ান?”
শ্রেয়ান কোনোমতে একটা হাসি চাপতে চাপতে বলল,
— “কিচ্ছু না আম্মা। এক কাজ আছে, আমি উপরে যাই।”
বলেই দ্রুত পায়ে উঠে গেলো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায়। দরজা লাগিয়ে এক নিঃশ্বাসে ফোনটা কানে ধরে বলল,
–“ভাই, তুই চিন্তা করিস না। অবস্থা তেমন খারাপ না। তুই তো নিজেই শরীর খারাপ নিয়া ঘুরতাসস তাই কাল কিছু বলি নাই তোকে।”
ওপাশ থেকে আগুন ঝরানো গলায় নাওফিক বলে উঠলো,
— “আমার চিন্তা করতে কেডা কইছে তোরে? সালা আমি তোকে যে দায়িত্ব দিছি, তুই ওটা পালন কর! ওরে বাইরে নিয়া আয়, আমি ডাক্তার দেখাবো।”
— “ভাই, সত্যি বলতাসি অবস্থা বেশি খারাপ না। বাবা ঔষুধ এনে দিছে। খেয়ে ঘুমাইলে ঠিক হইয়া যাইবো। তুই টেনশন করিস না প্লিজ।”
ওপাশ থেকে এহেন শব্দে এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইলো নাওফিক। তারপর হঠাৎই যেন নিজেকে সংবরণ করে নিলো। ঠোঁট কামড়ে ধরে চোখ বন্ধ করে কণ্ঠের সব ঝাঁজ গিলে ফেললো সে।
— “থাক! ফোন রাখতেসি।”
ফোনটা কেটে যাওয়া মাত্রই শ্রেয়ান যেন হাফ ছাড়লো। একটা দীর্ঘ প্রশান্তির শ্বাস ফেললো সে। মাথা পেছনে ঠেকিয়ে জানালার দিকে তাকালো। মনের গভীর থেকে ভেসে উঠলো একটাই অনুভব। তার ছোট আদুরে বোনটা সত্যিই ভাগ্যবতী।
**
নাওফিক বাড়ি ফিরেই দরজা ঠেলে ঢুকলো নিজ রুমে। মুখ ভার, চোখে বিদ্যুৎ খেলা করছে যেন। বুকের ভিতরটা কেমন ধুমধুম করে উঠছে। রাগ, বিরক্তি, অস্থিরতা সব মিলিয়ে একটা বিস্ফোরণ হবার অপেক্ষায়।
দেয়াল ঘড়ির কাঁটা সকাল ১০ পেরিয়েছে একটু আগে। রুমের দরজা খুলতেই, সেই বিস্ফোরণ ঘটলো সুস্মিতা কে নিজ রুমের ভিতর দেখেই।
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বিছানা গুছাচ্ছে।
নাওফিক থমকে দাঁড়ায় এক মুহূর্ত। এরপর ঠিক যেন আগুনের হলকা ওঠে তার চোখ থেকে।রাগে গর্জে উঠে,
–“তুই আবার এখানে কী করিস?”
সুস্মিতা একটু চমকে পিছিয়ে আসে। নিজেকে ধাতস্ত করে নিয়ে উত্তর করে,
–“ওই যে… ঘরটা এলোমেলো ছিলো তো, ভাবলাম…!”
–“ভাবলি? কি ভাবলি? তোরে ভাবতে কে কইছে হ্যাঁ? একবার বলি নাই আমার ঘরে পা দিবি না?”
বলতে বলতে রাগে ফেটে পড়লো নাওফিক। দুই হাতে সুস্মিতাকে ধরে প্রায় টেনে হিচড়ে রুম থেকে বের করে আনলো বাইরে।
–“ছাড়ো! কী করছো তুমি! লাগছে আমার!’
সুস্মিতা কে টেনে হিচড়ে নিয়ে আসে ড্রয়িং রুমে। ড্রয়িংরুমে তখন বসা তোফাজ্জল সাহেব আর তার ভাই উভয়ই। এই দৃশ্য দেখা মাত্রই তৎযলদি বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় দুজনেই। নাওফিক পরোয়া করলো না সেসবে।
তীব্র ক্ষোভ চেঁচিয়ে বলল,
–“এই বাড়ির মেয়ে হয়েও কবে থেকে এত বেহায়াপনা শুরু করছিস তুই? কতবার নিষেধ করছি, আমার রুমে না ঢুকতে! বুঝিস না?”
সুস্মিতার চোখ ছলছল করে ওঠে। সে কিছু বলতে গিয়েও যেন শব্দ আটকে এলো গলায়।
তোফাজ্জল সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,
–“এইসব কোন ধরণের ব্যবহার তেজ?”
নাওফিক তার বাবার কথার প্রত্তুত্বর করলো না। নিজের জেদ বজায় রেখেই হিসহিসিয়ে বলল,
–“আমি অনেক আগেই বলে দিয়েছিলাম, এই ধরনের হুটহাট ঢুকে পড়া আমি সহ্য করবো না। আজকের পর থেকে যদি কেউ আমার রুমে আমার পারমিশন ছাড়া পা রাখে, আমি নিজেই এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবো।”
বলেই নাওফিক দ্রুত পা ফেলতে ফেলতে নিজ ঘরে ঢুকে দরজা ধুপ করে বন্ধ করে দেয়। তার ভিতরে আগুন জ্বলছে। নিজের রাগ, অসহায়তা, আর অদৃশ্য এক দায়বোধ তাকে গ্রাস করছে। ঘরের ভেতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জিনিসের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বাইরে থেকে তার শ্বাসপ্রশ্বাসের ভারী শব্দ যেন কেউ না শুনলেও শুন্য খা খা দেয়াল গুলো শুনলো।
ড্রয়িংরুমে নেমে এসেছে এক অস্বস্তিকর নীরবতা।সুস্মিতা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে অপমানিত মুখে। চোখ ছলছল করে ওঠে তার। তীব্র অপমানে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে যায় উপরের দিকে।
নাওফিকের বাবা সামান্য ঝুঁকে পড়েন নিজের ভাইয়ের দিকে। এক ধরনের অনুশোচনায় তার চোখ নুয়ে পড়ে। সুস্মিতার বাবা চুপ। তাঁর চোয়াল শক্ত হয়ে আছে।
**
চেয়ারম্যান বাড়ির ডাইনিং টেবিলে গরম ভাত, মুরগির ঝোল আর পোলাও এর গন্ধ মৌ মৌ করছে পুরো হলরুম। খাবার পরিবেশন করছেন কাজের মেয়েটি। একজন একজন করে এসে বসতে শুরু করেছে টেবিলে।
এরমধ্যে নাওফিক আসতেই টেবিল ঘিরে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো।
নাওফিকের মুখ লালচে। শরীরজুড়ে একধরনের জ্বরের ঘোর। তবু খাবারের প্লেট টেনে নিয়ে খেতে শুরু করে সে। তোফাজ্জল সাহেব আড় চোখে সবটাই পরখ করেন। নীরবতা ভেঙে বলে উঠেন,
–“আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
বাবার কথায় কোনো ভাবভঙ্গি ফুটে উঠলো না খেতে ব্যস্ত থাকা নাওফিক এর। তোফাজ্জল সাহেব যেন এতে আরো ফেটে পড়লেন। ক্ষোভে চেঁচিয়ে উঠলেন,
–“আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি তেজ!”
নাওফিক মুখ না তুলে খেতে খেতেই বাবার কথার প্রত্তুত্বর করল,
–“যদিও আপনার নেয়া একেক টা সিদ্ধান্ত আমার বাঁশের মতোই কাজ করে। তাও শুনি নতুন বাঁশটা কি?”
ছেলের এহেন সরাসরি তেরা কথায় চেয়ারম্যান কিঞ্চিৎ বিব্রত হলেন তোফাজ্জল সাহেব। তবুও নিজেকে সংবরণ করে তেজি কণ্ঠে ফের বললেন,
–“তোমার বিয়ে ঠিক করেছি। আমাদের তো কোনো কাজে আসোনা। এভাবে বুড়ো হয়ে যাচ্ছ বিয়ে সাধি করবে নাহ জীবনে? অন্তত আমাদের জন্য হলেও করো। আমাদের কি শখ আল্হাদ নেই নাতি নাতনি নিয়ে খেলার? বাচ্চা কাচ্চার শখ নেই তোমার? ”
নাওফিক এবারও মুখ তুলে তাকালো না। বরং ঠাণ্ডা গলায় বলে,
–“আমার এখনো বিয়ের বয়স হয়নি।”
–“৩০ এর ঘরে ঢুকছ এখনো বলছো বিয়ের বয়স হয়নি? তোমার বয়সে আমি তো দু’সন্তানের বাপ ছিলাম!”
নাওফিক এবার উঠে দাঁড়ায় বসা হতে। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বাবার উদ্দেশ্য আওড়ায়,
–“তাই তো! অল্প বয়সে বিয়ে করলে এমনই হয়। পাশের গ্রামের জরিনা আন্টি এখনো অবিবাহিত। ইচ্ছা করলে আপনার জন্য ওনাকে আনতে পারি। আপনাদের প্ৰেম কাহিনী তো সবাই জানে। একটা ছোট বোন থাকলে মন্দ হয় না, তাই না আম্মু?”
নাওফিক এর এহেন নির্লজ্জ কথায় বিস্ফোরণ ঘটে পুরো ড্রয়িং রুমে। তোফাজ্জল সাহেব কেশে উঠে খুক খুক করে। গলায় খাবার আটকে আসছে যেন। তনয় হেসে ফেলে ঠোঁট চাপা দিয়ে। মঞ্জু বেগম নিচু গলায় ফিক করে হাসে। নাওফিকের মা চোখ রাঙিয়ে ওঠে ছেলের দিকে। পরপর কথার পাল্লা এড়াতে ছেলের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে,
–“কোথায় যাস তেজ! অন্তত খাবারটা শেষ করে যা বাবা।”
নাওফিক হাঁটতে হাঁটতে বলে ওঠে,
–“পেটের ক্ষুধা মিটে গেছে আম্মা… এখন একটু মনের ক্ষুধাটা মিটিয়ে আসি।নাহলে যে রাতে আর ঘুম আসবে নাহ!”
চলবে…..