#প্রাণনাশিনী
#পর্ব_০৯ [প্রথমাংস]
#সুহাসিনি_মিমি
রাত্রির প্রথম প্রহর। গ্রামের বেশিরভাগ কর্মফিরস্ত মানুষ ঢলে পরেছে গভীর নিদ্রায়।চারপাশ জুড়ে শুনশান নিস্তব্ধতা। দুরে কোথাও পুকুরের ধারে ব্যাঙ ডাকছে থেমে থেমে। মাঝে মাঝে শিয়ালের হালকা ডাকে কুকুরেরা ঘেউ ঘেউ করে উঠছে। নারকেল গাছের মাথায় চাঁদের আলো পড়ে এক রহস্যময় ছায়াঘেরা মূর্তি ধারণ করেছে।
এই নিস্তব্ধতার মাঝেই গ্রামের আঁকাবাঁকা পথ ধরে একখানা কালো বাইক এসে থামে সুবহা দের বাড়ির একটু দূরে। হেলমেট খুলে ধীরে ধীরে সেই বাইক থেকে নামল নাওফিক। সোজা পা টিপে টিপে বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ায়। হাতে ধরা ফোনটা বিরক্তিতে কানে চেপে ধরে। চারপাশে গিলগিলে মশা ভনভন করে ঘিরে ধরলো তাকে। বিরক্ত হয়ে এক হাত দিয়ে কানের পাশে মশা তাড়াতে তাড়াতে আরেক হাতে ফোনটা আরও শক্ত করে চেপে ধরলো কানের পাশে।
শ্রেয়ান সবেই রাতের খাবার শেষে উপরে এসেছে। ফোনটা বিছানার উপর রেখে ওয়াশরুমে ঢুকেছে কেবলই। ভাইব্রেট থাকা ফোনটা কেঁপে উঠছে ভ্রূম ভ্রূম শব্দ তুলে। শ্রেয়ান বের হয়ে আসলো ওয়াশরুম হতে। বিছানার উপর চোখ পড়তেই হাতে তুলে নিলো ফোনটা। এতো রাতে নাওফিকের একের পর এক মিসড কল দেখে চোখ কুচকে উঠে তার।
শ্রেয়ান ভয়ে ভয়ে ফোনটা কানে চেপে ধরল। ফোন ধরার পরপরই নাওফিকের গর্জে ওঠা কণ্ঠ শুনে গলা শুকিয়ে গেল তার,
–“সালা কই মরছিলি? কয়টা ফোন দিছি তোকে?”
শ্রেয়ান গিলে ফেলা গলায় বলল,
–“ওয়াশরুমে গেসিলাম ভাই… এই সময় ফোন দিলি যে?”
–“তোকে কি এখন আমার টাইম মেইনটেন করে ফোন দিতে হবে?”
–“আরেহ, সেটা তো বলছি নাকি আমি…”
–“ফর্মালিটি বাদ দে। আমার অস্বস্তি লাগতেছে, নিঃশ্বাস আটকে আসতাসে। দেখার ব্যবস্থা কর। এক্ষুনি!”
–“আচ্ছা দাঁড়া, আমি ওর রুমে গিয়ে ছবি তুলে তোকে পাঠাচ্ছি।”
–“পিকচার দেইখা আমার মনের তৃষ্ণা মিটলে কি আমি তোদের বাড়ির সামনে দাড়াইয়া দাড়াইয়া এতক্ষন ধরে মশার কামড় খাই? সালা!”
শ্রেয়ান কেঁপে উঠলো। বিস্মিত গলায় বলল,
–“মানে কই তুই?”
–“জানালা দিয়া নিচে তাকাইয়া দেখ।”
জানালার পর্দা সরিয়ে নিচে তাকাতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল শ্রেয়ানের। বুক কেঁপে উঠল আতঙ্কে। নাওফিক সত্যিই তাদের বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। এতো রাতে যদি তার মা নিজ বাড়ির সামনে তার বন্ধুকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাহলে যে বিশাল জটলা পেকে যাবে। শুষ্ক গলায় ঢু গিলে বলল,
–ভাই, বাড়ির সামনে দাঁড়ায় আছোস কেন? তুই বাড়ি যা প্লিজ। আমি এখনই ওর রুমে গিয়ে ছবি তুলে পাঠাচ্ছি তোকে। ”
–“ওই সব দিয়া আমার চলবে না আজ। সামনাসামনি দেখবো আমি। দ্রুত ব্যবস্থা কর। তোদের বাড়ির আশেপাশের প্রহরীরা ইতিমধ্যেই আমায় ঘিরে ধরছে। আর এক মিনিট এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে মেলোরিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হইবো নির্ঘাত। এরপর সেবা কিন্তু তোর বোনকে দিয়েই করাবো।”
শ্রেয়ান অস্থির হয়ে জানালা বন্ধ করে ফেলল। বাইরে নিশুতি রাত অথচ হাওয়া যেন ঝড়ের মতো কানে গুঞ্জন তুলছে তার ভূ ভূ করে।
শ্রেয়ান জানে নাওফিক কে আর আটকানো সম্ভব নয়। একরঘা, ত্যারা স্বভাবের নাওফিক যেটা বলবে সেটা হারে হারে পালন করেই দম নিবে। পরপর জানালার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে আরেকবার চাইলো সে। দেখল তার বন্ধু আগের চেয়েও দৃঢ় পায়ে এগিয়ে আসছে তাদের বাড়ির দরজার দিকে। কিছু বলার আগেই ফিসফিস করে ফোনে থাকা নাওফিক কে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“ভাই আম্মা নিচে এতো রাইতে আম্মা তোরে বাড়িতে দেখলে সন্দেহ করবো। কি বলবো আমি তখন? ”
–“সালা বেডি মাইনসের মতো তোর কলিজা নিয়ে তুই রুমে বইসা থাক। আমি আসতাসি। ”
শ্রেয়ান তড়িঘড়ি করে উত্তর করল,
–“থাক থাক ভাই তুই দাড়া আমি এখনই আসতাসি!”
শ্রেয়ান ত্রস্ত পায়ে ছুটে এলো নিচে। বিলকিস বেগম রান্না ঘরে রাতের অবশিষ্ট খাবার গরম করে রাখছেন। মাকে না দেখে চোরের মতো এসে সদর দরজা খুলে দিলো শ্রেয়ান। উঠোন পেরেয়ে দরজার ভিতর এসে ঘাড় টান করে ঢুকে পরলো নাওফিক।
–“নাওফিক! এতো রাতে তুমি এ বাড়িতে? ”
আকস্মিক মায়ের কণ্ঠে ভড়কে যায় শ্রেয়ান। তবে নাওফিক স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। গলা উচু করে জবাব দিল,
–“জি চাচি। আসলে..
–“আসলে আম্মা আমার ল্যাপটপে একটু সমস্যা হইতাসিলো তোহ তাই ওকে একটু আসতে বলসিলাম আরকি।
–“এতো রাইতে ল্যাপটপে কি কাম তোর?”
মায়ের সন্দীহান প্রশ্নে থমকে যায় শ্রেয়ান। আমতা আমতা করে বলল,
–“একটা কামের অফার আইসিলো। ওও তুমি বুজবা নাহ। নাওফিক তো আসতেই চাইতাসিলো নাহ। কত জোর কইরা আনসি। আয় আয় ভাই উপরে আয়। ”
বলেই এক প্রকার টেনে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো শ্রেয়ান বন্ধুকে। বিলকিস বেগম কিছুক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে রইলেন। আড় চোখে তাকিয়ে রইলেন দুজনের উপরে উঠার দিকে। ওদিকে নিজ রুমে ঢুকে ঘরের দরজা ঠাস বন্ধ করে দিলো শ্রেয়ান। বন্ধ করতে না করতেই নাওফিক কটমট করে তাকাল তার দিকে।
–“দরজা লাগাচ্ছিস কেন? তোর সাথে রুমে বসে আকাম করার জন্য আসছি আমি? ”
শ্রেয়ান হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
–“ভাই আরেকটু হলেই তো ফেঁসে যাচ্ছিলাম! তোকে মুখ খুলতে বলসিলো কে? ”
— আমি কাউকে ভয় পাই না। ওনি তোর মা, আমার না। ”
–” মেয়েটা কিন্তু ওনার। ভুলে যাস না।”
নাওফিক গা ছাড়া ভাব নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। চড়া গলায় বলল,
— “তোহ? শোন এই তেজওয়ান নাওফিক চৌধুরী এসবের ধার ধারে না। তুই কি মনে করছিস আমি তোর বাবা-মায়ের পা ধরে রাজি করানোর ছেলে?বেশি তেরা বেরা করলে সোজা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাবো। দেখি কে আটকায়!”
শ্রেয়ান এক মুহূর্ত চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা এখন আর শুধু নাওফিক না। সে যে ভালোবাসায় ভয়হীন, এক উন্মাদ প্রেমিক।
পরপর নাওফিক সোজা এগিয়ে গিয়ে এক টানে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। করিডোর পেরিয়ে গিয়ে দাঁড়াল কাঙ্খিত দরজার সামনে।দরজাটা খুলাই ছিল ভিতর থেকে। নাওফিক থমকে দাঁড়াল এক মুহুর্ত। একটানা তাকিয়ে রইল ভিতরে। এর মাঝেই পিছন শ্রেয়ান ফিসফিস করে বলল,
–“ভাই, বেশি সময় নিস না। ”
নাওফিক কিছু বলল না। শব্দহীনভাবে ভেতরে পা রাখল সে। শ্রেয়ান দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে রইল প্রহরীর মতো।
সুবহা ঘুমিয়ে আছে বিছানায়। পরনে হালকা রঙের একটি গোল ফ্রক। গায়ে কোনো ওড়না নেই। চুলগুলো এলোমেলো। কি নিদারুন মেয়েটা পরে পরে আরামে ঘুমাচ্ছে। তার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা।
চলবে…
#প্রাণনাশিনী
#পর্ব_৯ [দ্বিতীয় অংশ]
#সুহাসিনি_মিমি
নাওফিক এক পা এক পা করে এগিয়ে এলো ভিতরে। খোলা জানালার শিকের ফাঁক গলে চাঁদের আলো বিস্তৃত পুরো রুমজুড়ে। সেই আলো এসে পড়েছে সুবহার মুখে। নাওফিক থমকে দাঁড়িয়ে দেখল কিছুক্ষন এই অমায়িক দৃশ্য। ধীর পায়ে এসে ঠাস করে বসে পড়ল মেয়েটার মুখোমুখি।
মেয়েটার এলোমেলো চুল, ভ্রুর কোণার মৃদু ভাঁজ, ঠোঁটের পাশে নিস্পলক শান্তি বুকে কাপন ধরালো এই মানবের। ঘুমের ভেতর মেয়েটা কখনও থেমে থেমে নিঃশ্বাস নিচ্ছে তো আবার হঠাৎ করেই মুচকি হেসে উঠছে।
কি স্বপ্ন দেখছে সে? কে জানে!
নাওফিকের ঠোঁটে একটুকরো নিঃশব্দ হাসি ফুটে উঠল নিমিষেই। আলগোছে নিঃসব্দে হেসে উঠলো সে। বুকের ভেতর জমে থাকা অস্থিরতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে তার। একটু একটু করে গলে যাচ্ছে জমে থাকা অসস্তি। নাওফিক এর ভিতরে আচানক তুলপার শুরু হলো। খা খা করা হৃদয় খানা বড্ড উন্মাদ হলো একটা বার মেয়েটাকে ছুঁয়ে দিতে। আলতো করে। হাত বাড়ালো তা ভেবেই। পরপর কি ভেবে ভেবে যেন কাঁপতে কাঁপতে হাতটা গুটিয়ে নিলো আবার নিজের কাছে। চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস ফেলল গভীর করে।
নাওফিক থমথমে নিঃশ্বাস ফেলে একবার শেষবারের মতো তাকালো ঘুমন্ত সেই মহিয়সী নারীর পানে। ঘুমন্ত এই মুখ খানায় যেন পৃথিবীর সমস্ত সুখ অন্তর্নিহিত।
চট করে উঠে দাঁড়ালো ও। চুপচাপ দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে হেলান দিয়ে একবার চোখ বন্ধ করল। ভিতর থেকে নিজের অস্থিরতা চেপে ধরে বলল মনে মনে,
–“তুই জানিস না, কতটা যুদ্ধ করে তোকে আজ না ছুঁয়ে চলে যাচ্ছি। এই ঋণ তোর থেকে কড়ায় গন্ডায় শোধ করে নিবো। হয়তো খুব শীগ্রই!”
অতঃপর শব্দহীনভাবে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো বাইরে। নাওফিক বেরোতেই হাফ ছাড়লো শ্রেয়ান। এতক্ষন প্রহরীর দায়িত্ব পালনে শ্রেয়ান খুঁত রাখেনি কোনো। পূর্ণ মনোযোগ ছিল তার নিচে। মা যখন তখন এসে না আবার হাজির হয়ে যায়। বন্ধুকে করিডোরে দেখে ফিসফিস করে বলল শ্রেয়ান,
–“ঘুম ভাঙছে ওর?”
নাওফিক মাথা নাড়ল না শব্দে। পরপর বুকে হাত দিয়ে স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো শ্রেয়ান। আহত সরে বলল,
–“কবে জানি তোর এই বেপরোয়া স্বভাবের জন্য আমার বারোটা বাজে!”
নাওফিক শ্রেয়ান এর পেটে মৃদু চাপ দিতেই আর্তনাদ এর সরে চোখ মুখ কুঁচকে নিলো শ্রেয়ান। যেতে যেতে নাওফিক বলল,
–“সালা হয়েছিস দায়িত্ব পালন করবি নাহ। ”
শ্রেয়ান যত টুকু সম্ভব গলা উঁচিয়ে বলল,
–“আব্বে সালা না সম্মন্ধি হই তোর। বয়সে না হলেও সম্পর্কে বড় হই কিছু তো রেস্পেক্ট দে ভাই!”
**
চাঁদের আলোয় রুপালি হয়ে উঠেছে গ্রামের আঁকাবাঁকা কাঁচা রাস্তা। পেছনে বাড়ির ছায়া সামনে ঘন অন্ধকারে নাওফিক বাইকের গতি কিছুটা বাড়িয়ে ছুটে চলছে প্রফুল্ল চিত্তে। কে বলবে তার গায়ের তাপমাত্রা ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট?
দূরে একটা টং দোকানের সামনে কয়েকটা ছেলে আড্ডায় ব্যস্ত। দোকানটা অর্ধেক বন্ধ। তবু কেরোসিন বাতির আলোয় ওদের চোখ জ্বলজ্বল করছে নাওফিক কে দেখা মাত্রই।
হঠাৎ একজন কটাক্ষ করে ছুঁড়ে দেয়,
–“চেয়ারম্যান এর পোলা হঠাৎ এতো রাইতে পাটোয়ারি বাড়ি থেইকা বাইর হয় ব্যাপার সেপার কিরে?”
নাওফিক হঠাৎই ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ে। বাইক থামিয়ে এগিয়ে আসে টং দোকানটার সামনে। ছেলেগুলো একটু থমকে যায় প্রথমে।
ওদের লিডার উজ্জ্বল একপাশে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে। নাওফিক এসে আচমকা একজনের হাত থেকে জ্বলন্ত সিগারেটটা কেড়ে নেয়। নিজের ঠোঁটে চাপিয়ে টান মেরে ফুঁ দিয়ে আকাশে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে,
–“কেন? চেয়ারম্যানের ছেলের কারো বাড়িতে যাওয়া নিষেধ নাকি?”
নাওফিক এর এহেন কান্ডে উপস্থিত সকলের ছেলে গুলো ভড়কে গেলেও উজ্জ্বল স্বাভাবিক রইলো। দু ঠোঁটের মাঝে সিগরেট রেখে পায়ের সাথে থাকা খালি সিগরেট এর পেকেট টা পা দিয়ে পিষে বলল,
–“দিনের বেলা হলে মানা যায় কিন্তু রাতের বেলায় গিয়ে হাজির হওয়াটা তো নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই পড়ে, না কী?”
নাওফিক চোখ সরু করে তাকালো। ঠোঁটে তখনো সিগারেট।বাইকে হেলান দিয়ে ঠাণ্ডা স্বরে বলল,
–“তোদের নিষেধাজ্ঞা আমার বা* সমান নাহ। ঐডা তোগো মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখ। ভবিষ্যতে কাজে দিবো।”
উজ্জ্বল একটু কেশে উঠে বলল,
–“চেয়ারম্যান এর গদি চিরস্থায়ী না ভাই।
সময় বদলালে গলি গলিতে হিসেব হবে। বাপের বাহাদুরি দিয়ে রাজত্ব কদিন থাকে সেটাই দেখবো!”
–“সময় বদলালে তোরা গলির ভিতর ঢুকেই থাকবি। ইঁদুর ছানার মতো। আর বাপের বাহাদুরি এই নাওফিক চৌধুরী দেখায় নাহ।বুঝলি? ”
বলেই সিগারেটটা পায়ের নিচে মাড়িয়ে পিষে ফেললো নাওফিক। চোখ ঘুরিয়ে বাইকের সিটে বসে স্টার্ট দিলো বাইকটা। একবার পেছনে তাকালো ও। সবার মুখে থমথমে চুপচাপ।
বাইক ঘুরিয়ে চলেই যাচ্ছিল নাওফিক।
ঠিক সেই সময় উজ্জ্বল ঠোঁট কামড়ে, হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
–“পাটোয়ারি বাড়ির মাইয়ার ভিত্বে যে তোর প্রাণপাখি লুকায়া আসে, হেই খবর কিন্তু জানা হয়ে গেসে নাওফিক।ওই মেয়েরে আমিই ভোগ করমু তোর আগে।”
আকস্মিক ব্রেক কষার এক ভয়ংকর শব্দে থেমে যায় বাইক। হঠাৎ চলন্ত বাইক ব্রেক কষতেই ধুলো উড়ে গিয়ে ঝাপসা করে তোলে চারপাশ।
নাওফিক পুনরায় বাইক ঘুরিয়ে ফিরে আসলো ছেলেগুলোর সামনে। বাইক থেকে নেমে এসে দাঁড়ালো উজ্জ্বল এর সুম্মুখে। মাথা টা দু পাশে হেলিয়ে সোজা হয়ে উপর নিচ করল একবার। পরপর বলল,
–“কি বললি? আবার বলতো? ”
উজ্জ্বল হালকা হেসে বাকি ছেলেগুলোকে চোখ মেরে বলে ওঠলো,
–“যা শুনসোস তাই বলসি। খবর রাখি না মনে করসোস? সকাল বেলা বেলতলার ঘাটে দাড়ায়া থাকো , বাইকে কইরা ঘুরতেও লইয়া যা…
নাওফিক হাত তুলে থামিয়ে দিলো মাঝ পথেই। মুখ বাকিয়ে বলল,
–“উহু… ঐটা না। এরপর যেটা বললি, সেটা আবার বল।”
উজ্জ্বল একটু থেমে গলা ঝেড়ে হালকা সিগারেট টেনে বলে,
–সুবহারে আমি বিয়ে…
পুরো কথাটা শেষ করতে পারলো না আর উজ্জ্বল। টং দোকানের টিনের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে রাখা মোটা বাঁশটা এক টানে টেনে নিলো নাওফিক। এক পলকে দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে ঝাঁপিয়ে পড়লো উজ্জ্বলের ওপর। প্রথম আঘাতেই উজ্জ্বলের কাঁধে সজোরে পড়ে বাঁশটা।
মুহূর্তেই একটা আর্তচিৎকার ছড়িয়ে পড়ে রাতের নীরবতাকে ছিন্ন করে।
পাশে থাকা ছেলেগুলোর কয়েকজন চিৎকার করে সরে পড়ে সেইফ দূরত্বে। কেউ দৌড়ে পালায় তো আবার কেউ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নাওফিক থামলো নাহ একবারের জন্যও। উজ্জ্বলের বুক, পিঠ, হাঁটু যেখানে পারছে আঘাত করে যাচ্ছে অনবরত।
বাঁশের একেক টা আঘাতে আর্তনাদে চেচিয়ে উঠছে উজ্জ্বল।
পেছন থেকে উজ্জ্বলের ঘনিষ্ঠ দুজন ছুটে এসে আটকানোর চেষ্টা করে নাওফিক কে।
কিন্তু নাওফিক যেন আজ কোনো দয়া মায়াহীন পশু হয়ে উঠেছে। মারতে মারতেই বজ্র কণ্ঠে গর্জে উঠছে নাওফিক,
–” মা* ওর নাম মুখে নেয়ার কলিজা হইলো কেমনে তোর? বাইন…. সেদিন ভুল করসিলাম তোরে বাঁচাইয়া রাইখা।”
নাওফিকের বাঁশের আঘাতে উজ্জ্বলের শরীর ছিটকে পড়েছে দোকানের পাশের ধুলোমাখা মাটিতে।
মারতে মারতে একটা সময় হাপিয়ে উঠেছে নাওফিক নিজেও। তবুও যেন থামার নাম নেই।প্রতিটি আঘাত যেন একেকটা বজ্রাঘাত এর আঘাত করছে। উজ্জ্বলের আর্তনাদ ছাপিয়ে যাচ্ছে রাতের নিস্তব্ধতাকে। পিছন থেকে ছুটে আসে দুইজন ছেলেপেলে। আটকানোর চেষ্টা করে করুন সরে বলে,
–“ভাই থামেন থামেন, মইরা যাইবো !”
বলেই একজন নাওফিক এর হাতে থাকা সেই বাঁশের উদ্দেশ্য হাত বাড়াতে যেতেই বাঁশ উঁচিয়ে পেছনে ঘুরে ছেলেটাকে এমনভাবে ছুড়ে মারে যে ছেলেটা ছিটকে পড়ে টং দোকানের বাঁ পাশের ড্রেনের পাশে।আরেকজন ভয় পেয়ে পিছিয়ে যায় কয়েক কদম। এই ছেলের রাগ সম্পর্কে কমবেশি গ্রামের সবাই অবগত। রাগলে যে নিজের বাবা কেও চিনে নাহ সে আর কাকে মান্য করবে?
চায়ের দোকানদার মাঝবয়সী লোকটা কাপ-প্লেট ফেলে রেখেই দোকান ছেড়ে পালিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। উজ্জ্বলের মুখে র”ক্ত। চোখ উল্টে যাচ্ছে তবুও যেন বিন্দু মাত্রই মায়া হচ্ছে না নাওফিক এর। যেন সে এসবে ভীষণ ভাবেই অব্যস্ত!
উজ্জ্বলের গলা দিয়ে কঁকিয়ে ওঠার মতো শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই শরীরে।
শুধু দুহাত দিয়ে নিজেকে ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে অবিরাম।
এরপর একটা শেষ আঘাত করে হালকা থেমে দাঁড়ায় নাওফিক। হাফাচ্ছে সে। ঘাম আর রক্তে ভেজা তার কপাল। শরীরের অবশিষ্ট শক্তি দিয়ে বাঁশটা মাটিতে ফেলে দেয় মাটিতে পরে থাকা উজ্জ্বল এর নিথর দেহে পরপর দুটো লাথি মারলো ও।
আধমরা উজ্জ্বল মাটিতে ছটফট করছে তখনও। বাঁশের কোনায় থাকা ছোট ছোট হাস বিঁধে ছিলে গেছে নিজের হাতটাও। টুপ্ টুপ্ করে রক্ত পড়ছে হাত থেকে গড়িয়ে। সেদিকে হুশ নেই ওর। পিছনে তাকালো না একবারও। বড় বড় কদমে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো। যেতে যেতে ভারি সরে বলে গেলো,
–“ভবিষ্যতে ওর নাম মুখে নেওয়ার আগে
এই রাতটার কথা মনে রাখবি বা*…।
**
গ্রামের আকাশে তখন হালকা সোনালি আভা ফুটে উঠেছে। পাখিরা ডাকছে ডালে ডালে। নিজ রুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রায় বিছানায় নিমগ্ন নাওফিক আরামের ঘুমে। তবে তার আরামের ঘুম কে হারাম করে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন তোফাজ্জল সাহেব।
–নাওফিক! নাওফিক!”
কাক ডাকা ভোরে বাবার চিল্লানির শব্দে ঘুম ভাঙে নাওফিক এর। চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসলো ও। ঘুমন্ত কেশ এলোমেলো। শরীরে গতরাতের ভার বিদ্যমান। শেষ রাতে আবার গা কাঁপিয়ে জ্বর উঠেছিল একবার। একসাথে দুটো প্যারাসিটামল খেয়ে সবেই ঘুমে এলিয়ে পড়েছিল অমনিই সদ্য কাঁচা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় মাথা টা ঝিমঝিম করছে।
তোফাজ্জল সাহেব সোজা এসে দাঁড়িয়ে আছে ছেলের কক্ষের সামনে। খিটখিটে মেজাজ, মুখ ভার। গা ছাড়া ভাব নিয়ে খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো নাওফিক। আধবোজা চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ নিয়ে বাবার উদ্দেশ্য বলল,
–“সাত সকালে এমন গর্জন করতেসেন কেন, আব্বা? বাড়িতে ডাকাত পরসে নাকি? ”
তোফাজ্জল সাহেব নিজ কণ্ঠে বিস্ফোরণ ঘটালেন একপ্রকার। হুঙ্কার ছাড়লেন ছেলের উদ্দেশ্য,
–“তোরে পোলা বানাইছি নাকি এক্কেবারে দানব? রাতের আঁধারে মানুষ পিটাইয়া আধমরা কইরা রাখছোস! থানা পুলিশ এখন সামলাইবো কে?
–“কেন আমার বাপ্!”
ছেলের হেয়ালি কথায় আরো তেতে উঠলেন তোফাজ্জল সাহেব। গর্জে উঠলেন পুরোদমে,
–“মস্করা করিস আমার সঙ্গে? আমি তোর বেয়াই লাগি? তোর জন্য আমার নাম ডাক সব পানিতে ভাসবো একদিন।”
–“গ্রামের চেয়ারম্যান হয়ে যদি সামান্য বন্যার পানি আটকানোর ব্যবস্থা না করতে পারেন তাইলে তো ভাসবই। ”
–“বেয়াদপ ছেলে মস্করা করোস আমার সাথে?”
বলেই গর্জে উঠলেন তোফাজ্জল সাহেব পুরোদমে। সকাল বেলা এমন চিৎকার চেঁচামেচি তে বাড়ির সমস্ত লোক জমা হয়েছে নাওফিক এর ঘরের সামনে। মঞ্জু বেগম ছেলে কে থামার উদ্দেশ্য বলল,
–“সকাল বেলা এসব কি শুর করসোস তোফাজ্জল। এমনে চিল্লাস কেন কি হইসে? ”
–“তোমার নাতি গতকাল রাতে উজ্জ্বল রে মাইরা আধ মরা করে ফালাইয়া রাখসে মা। হাসপাতালে ভর্তি ওই ছেলে। অবস্থা বেশি ভালোনাহ। এখন যদি ওর বাবা থানা পুলিশ করে তখন সেসব আমি কিভাবে সামলাবো। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু চুপ করে আছে। ”
নাওফিক আগ বাড়িয়ে মাঝ খানে ফোড়ন কাটবে,
–“সালার দেখি কই মাছের প্রাণ। এখনো লটকাইয়া আছে। আমি তো ভাবসি সকাল হইতে হইতেই আর টিকবো নাহ!”
–“দেখেছো মা! শুনসো তুমি ওর কথা! ওরে আমি এইবার সত্যিই সত্যিই তেজ্য পুত্র করবো। আমার মান সম্মান নাম ডাক সব শেষ হইবো একদিন শুধু মাত্র এই পোলার লাইগা। ”
–“আহ! আগে মাথা ঠান্ডা কর বাপ্!” তুই উজ্জ্বল এর বাপের লগে আগে কথা কইয়া দেখা। এদিকে না হইলে শহরে পাঠাইয়া দেই চিকিৎসার লাইগা। ”
**
সকালবেলা রান্নাঘরের চুলার পাশে বসে আছে সুবহা। বিলকিস বেগম রান্নায় ব্যস্ত। মুরগির ঝোল, গরুর মাংস ভুনা, ইলিশ মাছ ভাজা থেকে শুরু করে হরেক রকমের খাবার রান্না করছেন তিনি। হাতের কাজ করতে করতেই ঘেমে উঠেছেন খানিকটা। সুবহা এসে বসেছে মায়ের পাশে। বিলকিস বেগম তখন পোলাও রান্নার জন্য পেঁয়াজ কুচি করছেন। সুবহা এসে বসলো মায়ের পাশে চুপটি করে। সকাল সকাল এতো রান্নার ঘ্রান পেয়েই রান্নাঘরে আসা তার।
ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল,
–“সকাল সকাল এত আয়োজন! কেউ আসব নাকি, আম্মা?”
বিলকিস বেগম না তাকিয়েই উত্তর দিলেন,
–“তোর ফুপি রা আসতেছে। তোর আব্বারে ফোন দিসিলো, রাস্তায় নামছে নাকি।”
ফুপি আসার খবর শুনেই চোখ বড় হয়ে যায় সুবহার। প্রফুল্ল চিত্তে মুখভর্তি হাসি নিয়ে বলে,
–“আসলেই? ফুপি আসতাসে? আর কে কে আসবো আম্মা?”
রান্নার হাঁড়িতে নেড়েচেড়ে দেখলেন বিলকিস বেগম। হাতে নিয়ে লবন এর পরিনাম পরখ করে তারপর বলল,
–“তোর আব্বা তো তাই কইলো বন্যা আর শুভ্র ও নাকি আসতাসে সাথে। শুভ্রর জন্যই নাকি সেদিন আসতে পারে নাই। আজকে সময় মিলছে সবার।”
–“সত্যি আম্মা শুভ্র ভাই আসতাসে?”
–“হেডাই তো হুনলাম। ”
সুবহার মনের বাগানে যেন আচানক পুস্প ফুটে উঠলো। মন চাচ্ছে এক লাফে উঠোনে গিয়ে থৈ থৈ করে নাচতে। গতকাল রাতে জ্বর ছাড়ার কারণে মনে মনে ঠিক করেছিল আজ স্কুলে যাবে বলে। তবে আজ আর সে স্কুলে যাবেনা। তার ফুপি আসছে শহর থেকে আর সে স্কুলে বসে বসে সময় পার করবে নাকি? আর সবথেকে বড় কথা তার শুভ্র ভাই আসছে। এই শুভ্র ভাইকে ঘিরে সেইজে কত পুরোনো স্মৃতি রয়েছে তার! আহা ভাবতেই মেয়েটার টমেটোর মতো গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে উঠছে।
চলবে……