প্রাণনাশিনী পর্ব-১০

0
9

#প্রাণনাশিনী
#পর্ব_১০
#সুহাসিনি_মিমি

সুবহা দাঁড়িয়ে আছে ওদের বাড়ির সদর গেইটের সামনে। মনটা আজ বেশ ফুরফুরা ওর। মায়ের কাছ থেকে শুনা মাত্রই সেইজে এসে দাঁড়িয়েছে বাড়ির সামনে এক পাও নড়েনি মেয়েটা আর। ঔষুধের ফলে জ্বরের ঘোর কেটেছে সবেই। তবে মুখের তেতো ভাবটা কমেনি। শরীরটাও অনেকটা মলিন হয়ে গেছে গত দুদিনের জ্বরের তোপে। সুবহার একটি মাত্রই ফুপু। বিয়ে হয়েছে শহরের এক সম্রান্ত পরিবারে। বছর দুয়েক পরপর গ্রামে ভাইয়ের বাড়ি বেরাতে আসেন জেসমিন বেগম। আদর করেন সুবহা কে অনেক। তাইতো ফুপু আসার খবরেই সমস্ত রোগ বালাই পালিয়েছে সুবহার শরীর থেকে। এমন সময় হঠাৎ পিছন থেকে এসে ভেংচি কাটে শিউলি। শিউলি কে এতো সকাল সকাল ওদের বাড়ির সামনে দেখে হতভম্ব হয় সুবহা। কপালে ভাজ পরে প্রগাঢ়।

–তুই স্কুলে যাসনি?

–নাহ!

–কেন?

–তোকে ছাড়া স্কুলে গিয়া মজা পাইনা রে । তাই যাইনাই। হি হি।

সুবহা সন্দেহের চোখে তাকালো। এই মেয়েটাকে বিশ্বাস করেনা সুবহা এক রত্তিও। অগত্যা কপালে ভাজ এঁটেই বলল,

–আমার জন্য হঠাৎ কইরা এতো পিরিত আসলো কই থেইকা তোর?

— এমনে কইতাসোস কে সুবহা?তুই হইলি আমার জিগরি বান্ধবী!ল্যাদা কাইল্লা ফ্রেন্ড! তোর লাইগা এই শিউলির জান টাও হাজির। আর তুই এমনে কইলি আমারে? আইচ্ছা বাদ দে। এহন ক-তো এদিকে দাঁড়াইয়া কি ফুপু গো লাইগা অপেক্ষা করতাসোস?

–তুই জানলি কেমনে আজ ফুপু রা আইবো?

–চাচি সকাল বেলা আমগো বাসায় গেসিলো। কুদ্দুস রে দিয়া গাছ থেইকা নারকেল পারাইসে। তহন আম্মা রে কইলো,শুনলাম।

–এই জন্যই স্কুলে যাস নাই তাইনা?

শিউলির কাচু মাচু করার মতো ভাব ধরে বলল,

–শুনলাম তোর শহরের ভাইডাও নাকি আইবো। সত্যিই রে?

–আমি কেমনে কমু?

–এমন ত্যারা ত্যারা কথা কইতাসোস কে মাইয়া?আমি থাকলে কি তোর ভাগে কম পরবো নাকি?

সুবহা বিরক্তির ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলো ঠাই। শিউলির অবাঞ্চিত প্রশ্নের উত্তর দেয়ার থেকে ওর কাছে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হলো। এর মাঝেই হঠাৎ দূর থেকে গাড়ির হালকা গর্জন ভেসে আসতেই তড়িৎ সেখানে তাকালো সুবহা। গ্রামের মাটির কাঁচা রাস্তায় আঁকা বাঁকা পথ ধরে এগিয়ে আসছে সাদা রঙের একটি প্রাইভেট কার।

দরজা খুলে প্রথমে নামলেন এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা। পরনে নীল আর গোলাপি রঙে মিশেলে জর্জেটের একটি সালোয়ার কামিজ। চেহারায় মায়াভরা হাসি।সুবহা সেই ভদ্রমহিলা কে দেখা মাত্রই দৌড়িয়ে গিয়ে ঝাপ্টে পরলো তার উপর। সেই ভদ্র মহিলাও আদুরে হাতে জড়িয়ে নিলেন নিজ ভাইয়ের মেয়েকে।

তারপর গাড়ির অপর পাশ থেকে নামলো ঝলমলে মডার্ন পোশাক পরিহিত এক অষ্টাদশী। পরনে হালকা ক্রপ টপ আর জিনস। কোমরে বেল্ট, চোখে সানগ্লাসটা হালকা নামিয়ে রাখা। চিকন শরীরের গঠন, হাঁটুর ওপর পর্যন্ত সোজা কালার করা চুল আর হাই হিল পরা পা দেখে শিউলির হেঁচকি উঠলো বোধহয়।

–কেমন আছো মিশমি আপু?

মেয়েটি চোখ থেকে সানগ্লাস নামিয়ে হাতে রাখলো। একবার সামনে থাকা শিউলি কে দেখে নিয়ে পরপর নজর দিলো মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা সুবহার উপর। আলতো করে উত্তর করল,

–আছি ভালো। তোর কি অবস্থা? মুখ এমন শুকনো লাগছে কেন? খাস নাহ?

–ওর জ্বর হইসিলো আপা। হেরলাইগা অমন শুকনা দেহা যায়।

শিউলির আগ বাড়িয়ে কথায় মিশমি উত্তর করল না আর। এর মাঝেই শিউলি গাড়ির জানালার দিকে বারকয়েক তাকালো। ওর চোখ দুটো কাউকে খুঁজছে। অগত্যা বলে উঠল,

–কেমন আছেন ফুপু?

সুবহার ফুপু হেসে তাকালেন শিউলির দিকে।

— তুই শিউলি না! এদিকে আয়!

শিউলি একটু হকচকিয়ে গেলেও মৃদু হেসে এগিয়ে গেল সামনে। পায়ের পাতায় ধুলো মাখা। চোখে সামান্য কৌতূহল। হাসিমুখে মাথা নিচু করে দাঁড়ালো সুবহার ফুপুর সামনে।

কিন্তু মনের কোণে একটা খালি ভাব খচখচ করছে ওর। তাই কথার ফাঁকে, আড়চোখে একবার মিশমির চলাফেরা দেখে অধর্য্য শিউলি প্রশ্ন করেই বসল,

–শুভ্র ভাই আসেনাই ফুপু?

জেসমিন বেগম শিউলির মুখের দিকে তাকিয়ে আলতো করে হেসে উত্তর করল,

–এসেছে মা!

কথা শেষ করার আগে ভাগেই শিউলি পরপর প্রশ্ন ছুড়লো,

–কোথায় শুভ্র ভাই?দেখছি না যে?

–শুভ্র বাজারে রয়ে গেছে। আসার সময় শ্রেয়ান এর সঙ্গে দেখা হলো, সেখানেই রয়ে গেলো। শ্রেয়ান জানালো দুজন মিলে পরে একসঙ্গে আসবে।

–ওহ…!

–মম, আমার ভীষণ গরম লাগছে এখানে। এইভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় পার করবে, না ভেতরে যাবে?

মিশমি কথাটা বলেই আর কোনো উত্তর না শুনে হাই হিলের শব্দ ফেলে সোজা ভেতরের দিকে চলে গেল।

**

বাজারের পাশেই পুরনো একটি ক্লাব ঘর। গ্রামের ছেলেরা বিকেল গড়াতেই এখানে ভিড় জমায় । কখনো কেরাম, কখনো লুডু কিংবা চা-সিঙ্গারার আড্ডায় মগ্ন থাকে সকলে।

ভেতরে বসে আছে শ্রেয়ান। পরনে ঢিলেঢালা টি-শার্ট। সামনে একটা কাচের টেবিলে গ্লাসভর্তি সেভেন আপ রাখা। পাশেই বসে আছে শুভ্র। ছিমছাম পোষাক,চোখে চশমায় এই শ্যাম বর্ণের যুবক কে প্রথম দেখায় যে কেউই বলে দিবে নিঃসন্দেহে ভদ্র পরিবারের ছেলে বলেই।

বিদেশ থেকে সদ্য ডিগ্রি শেষ করে ফিরেছে শুভ্র। এখন শহরের এক নামকরা ইনস্টিটিউটে তার চেম্বার। পাশেই কিছু ছেলেপেলে কেরাম খেলছে। বোর্ডে গুটি ঠোকাঠুকি চলেছে ওদের মধ্যে।শ্রেয়ান হালকা হেসে বলল,

–খাচ্ছিস না কেন? অন্য কিছু আনাবো?

শুভ্র মাথা নাড়িয়ে বলল,

–না রে, কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। তোদের দিনকাল কেমন চলছে এখন? কী করছিস আজকাল?

শ্রেয়ান হালকা হাসল। কিন্তু মুখে একচিলতে গম্ভীর ভাবও এল ওর। সেই ভাব বজায় রেখেই উত্তর দিলো ঝটপট,

–চলছে কোনোরকম।

— বিয়ে-টিয়ে করবি নাকি?

শ্রেয়া ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি টেনে গ্লাস থেকে এক চুমুক সেভেন আপ নিয়ে বলল,

–এতো তাড়া কীসের রে ভাই? আগে তুই কর। তারপর আমার একটা লাইন ধরিয়ে দিস।

শুভ্র হেসে ফেলল। তারপর শ্রেয়ান চোখ টিপে বলল,

–তা শহরের খবর কী? গার্লফ্রেন্ড কয়টা এখন? দেখছি ভালোই ডিমান্ড তোর! পুরো ডাক্তার সাহেব হয়ে আছিস!

–আমি ওসব কিছুতে নেই ভাই। আমি হনেস্ট বয়। চাকরি, চেম্বার, পরিবার এই তিনে জীবন আটকে আছে।

শ্রেয়ান হেসে কাঁধে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলল,

–এই রকম বেশি হনেস্ট থাকলে কিন্তু আজকাল মানুষ উল্টাপাল্টা ভাবে ভাই! আমাদের চাচা হওয়ারও তো ইচ্ছা জাগে বল?

শুভ্র ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে চুপচাপ তাকিয়ে রইল শ্রেয়ানের দিকে। বলল,

–ওসব বাদ দে… আমাদের সুবহার কী খবর? শশুনলাম বেশ বড় হয়ে গেছে…

–কার বড় হওয়ার কথাবার্তা চলতেছিল শুনি?

নাওফিকের হঠাৎ আগমনে শ্রেয়ান গলা খাঁকারি দিয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,

–কই না না! এমনি আরকি!”

নাওফিক থ্রি কোয়াটার প্যান্ট এর পকেটে দু হাত গুঁজে এসে দাঁড়ালো ওদের সামনে। এগিয়ে এসে বসলো নিজের জন্য বরাদ্দকৃত চেয়ার টায়। অতঃপর আড়চোখে তাকাল শুভ্রর দিকে।
সামনে বসা ফর্মাল স্যুট পরা শুভ্র কে দেখেই কপাল সরু হলো নাওফিক এর। বলল,

–তুমি শ্রেয়ানের ভাই, তাই না? শহর থেকে এসেছো?

শুভ্র ভদ্র ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল,

–হ্যাঁ!

–তো কদিনের জন্য এসেছো?

আকস্মিক এহেন প্রশ্নে কিঞ্চিৎ বিব্রত বোধ হলো শুভ্রর। তবে তা মুখে প্রকাশ করল নাহ। নিজেকে ধাতস্ত করে নিয়ে বলল,

–জি মানে?

–মানে এখানে কদিন থাকবে?

শুভ্র একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। সরাসরি এমন প্রশ্নে একটু নড়েচড়ে বসল। বলল,

–আসলে এখনো ঠিক করিনি। কিছুদিন থাকব, তারপর দেখা যাক!

নাওফিক ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসি টেনে সামনে থাকা সিগরেট এর পেকেট থেকে একটি সিগরেট এনে দু ঠোঁটের মাঝে ভরলো। লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে নিলো সিগরেট। দু হাতের সাহায্য লম্বা টান মেরে ধোঁয়া উড়ালো ওদের সুম্মুখে।

শুভ্র অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। নাওফিক চোখ না তুলেই বলল,

–খাবে?

শুভ্র নরম স্বরে বলল,

–আমি ওসব খাই না।

নাওফিক হেসে উঠল। সিগরেট টানার এক ফাঁকে বলল,

–এইসব মাঝে মাঝে খেতে হয় বুঝলে। নাহলে শরীরে জং ধরে যায়। মাঝে মাঝে দু’একটা খেয়ে এসব জং ছাড়াতে হয়।

নাওফিকের কথা শেষ হতে না হতেই কোথেকে একুশ বাইশ বছরের এক যুবক ঘেমে-নেয়ে দৌড়ে এসে থামলো ওদের সামনে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

–ভাই… ভাই… বড় স্যার গেটের বাইরে… গাড়িতে বইসা আছে … আপনাকে দ্রুত যাইতে কইসে!

নাওফিক সিগারেটের ছাই ঝেড়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল,

–কি বলছে? স্পষ্ট করে বল।

ছেলেটা একটু কেঁপে উঠে বলল,

–হাসপাতাল থেকে খবর আসছে ভাই। উজ্জ্বল ভাই নাকি আর নাই…!

থমকে উঠলো শ্রেয়ান। বাঁকা চোখে তাকালো বন্ধুর ভাবলেশহীন হাবভাবের উপর।নাওফিক কপালের মাঝে ভাঁজ ফেলে বলল,

–বা*ল শান্তি নাই! তুই যা। আমি আসছি।

ছেলেটা দাঁড়িয়ে রইল ঠাই। অস্থির মুখে ফের বলল,

–স্যার বলছে… তাড়াতাড়ি যাইতে।

নাওফিক কড়াভাবে ছেলেটার দিকে তাকাতেই ছেলেটা আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না। ভয়ে গা ঢাকা দিয়ে চলে গেল সেখান থেকে।

শুভ্র এবার চোখে কৌতূহল নিয়ে নাওফিকের দিকে তাকালো। শুভ্র নাওফিক কে চিনে এই গ্রামের চেয়ারম্যান এর ছেলে হিসাবেই। জানে শ্রেয়ান এর বন্ধু। নাওফিক মুখ থেকে ধোঁয়া ছেড়ে বলল,

–তুমি তো ডাক্তার, তাই না?

–হ্যাঁ!

–আচ্ছা ধরো, যদি কেউ তোমার সামনে এমন কিছু বলে ফেলে যা তুমি সহ্য করতে না পেরে হঠাৎ রাগের মাথায় তাকে একটু ঘষামাজা করলা বাঁশ দিয়ে। এর ফলে মরার চান্স থাকে কতটুকু?

শুভ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,

–আঘাতের পরিমাণ যদি বেশি হয় তখন কিছুটা ক্রিটিকাল সিচুয়েশন হতে পারে। তবে সাধারণভাবে বাঁশ দিয়ে মারা অতটা প্রাণঘাতী হয় না।

নাওফিক এবার বলল গম্ভীর সরে,

–ঠিক তাই তো। অতটা মারধরের পরেও মরল না সা*লা। কই মাছের প্রাণ! তখন ভাবলাম আর ঝামেলা কেন রাখব? একেবারে ব্যবস্থা করেই দিয়ে আসলাম। না থাকবে লোক, না থাকবে সমস্যা! তাও দেখো মরে গিয়েও শান্তি দিচ্ছে না। এই ক’দিন সেই জ্বালা সহ্য করতে হবে এখন আবার!

শুভ্র আকস্মিক প্রশ্ন করে বসল,

–মানে? কে কাকে মেরেছে ঠিক বুঝলাম নাহ!

নাওফিক উত্তর করল নাহ শুভ্রর প্রশ্নর। বসা হতে উঠে দাঁড়ালো ও। হাতে থাকা সিগরেট টা ফেলে পায়ে পিষিয়ে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে যেতে যেতে বলল,

–ওটা তোমার ভাই শ্রেয়ান এর থেকে জেনে নিও!

শ্রেয়ান সবেই ঢেলে রাখা কাঁচের গ্লাসে থাকা কোক টুকু মুখে পুড়েছিল অমনিই গলগলিয়ে মুখের ভিতরের সব কোক টুকু কাশির সঙ্গে বেরিয়ে এলো ওর। নাকে মুখে উঠে পরা দরুন খুক খুক করে কাশতে লাগলো। শুভ্র হতোবিহুল দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো নাওফিক এর প্রস্থান এর দিকে। লোকটা কি বলে গেল সব যেন ওর মাথার উপর দিয়েই গেলো সোজা।

চলবে…