প্রাণনাশিনী পর্ব-১১

0
9

#প্রাণনাশিনী
#পর্ব_১১
#সুহাসিনি_মিমি

সুবহার বাড়িতে আজ যেন উৎসবের আমেজ। বিলকিস বেগম নিজ হাতে রান্না করেছেন বাহারি সব পিঠাপুলি। সাথে আবার রয়েছে দুধে ভেজা সুগন্ধি পায়েস। নারকেলের টুকরো গুড় আর চালের মিষ্টি গন্ধে মৌ মৌ করছে চারদিক। বাড়ির উঠোন পেরিয়ে দরজায় পা রাখতেই বিলকিস বেগম হাসিমুখে সবাইকে ঠান্ডা শরবত আর ফ্রিজের ঠান্ডা পানি নিজ হাতে এগিয়ে দিলেন। আপ্যায়নের আন্তরিকতায় বিলকিস বেগম গাফিলতি করেননা বিন্দু পরিমানও।

সুবহা, শিউলি আর মিশমি তিনজনে একসাথে উঠে গেলো ওপরের ঘরে। নিচে রয়ে গেলেন জেসমিন, বিলকিস বেগমের পাশে। সুবহার দাদা মেয়ের আসার খবর শুনে ছুটে এসেছেন বাড়িতে। তার উপস্থিতিতেও বাড়ির প্রাণ যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

ওপরে পৌঁছে সুবহার রুমে ঢুকতেই মিশমি মুখ কুঁচকে ফেললো। চোখ-মুখে অস্বস্তির ছাপ নিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল,

–“তোর রুমে এসি লাগায় নি মামা? এই গরমে কিভাবে থাকিস? গরম লাগে না?”

–“না আপু, আমাদের এখানে অত গরম লাগে না। আর ফ্যান তো আছেই।”

মিশমি একহাত দিয়ে গলায় হাত নাড়িয়ে বাতাস করতে করতে বলল,

–“তবুও যেই গরম পড়ে আজকাল! বাব্বাহ! আমরা তো এসির রুমে থেকেও রীতিমতো ঘামাই।”

–“এই লাইগাই তো শহরের মানুষ গো, আমরা ফার্মের মুরগি কই! কাম নাই কাজ নাই খায় আর ঘুমায়।”

শিউলির মাঝ খানে ফোড়ন কাঁটা কথায় বিরক্ত হলো মিশমি। সঙ্গে সঙ্গে চোখ রাঙালো শিউলির দিকে। মেয়েটা একটু বেশিই কথা বলে মুখের উপর কথা বলা পছন্দ নয় মিশমির।

সুবহা শান্তভাবে বলল,

–“আপু, তুমি এই রুমেই রেস্ট নাও। আমি নিচের রুমে থাকবো।”

–“আচ্ছা, আমাকে একটা ফ্রেশ টাওয়াল দে তো। আমি ওয়াশরুম যাবো।”

সুবহা তৎক্ষণাৎ ওয়ারড্রোব খুলে একটা সাদা নরম তোয়ালে বের করে মিশমির হাতে দিলো। রুমের ভেতরে দুপুরের আলো পড়ছে জানালার পর্দা গলে। বাইরে থেকে ভেসে আসছে নারকেল ভাজার ঘ্রাণ। আর নিচে কৌতুহলী কথোপকথন।

**

দুপুরের ঠিক মাঝ বরাবর বাড়িতে ফিরে এলো শুভ্র। সঙ্গে সঙ্গে নিচে নামল সুবহা ও শিউলি।

সিঁড়ির মোড়ে পৌঁছে চোখে পড়তেই শিউলি হঠাৎ থমকে গেলো শুভ্র কে দেখা সবেই। মেয়েটার চোখ দুটো স্থির হয়ে গেল শুভ্রর ওপর।
অবশেষে নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে শিউলি আগে ভাগেই বলে উঠলো,

–“আস্সালামুআলাইকুম ভাইয়া, ভালো আছেন?”

শুভ্র মৃদু হেসে জবাব দিল,

–“ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যাঁ, তুমি কেমন আছো শিউলি?”

শিউলি একটু লাজুক হেসে বলল,

–“আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া, ভালো।”

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুবহা চমকে উঠল।সুবহা বিশ্বাসই করতে পারছিল না শিউলি কাউকে সালামও জানাতে পারে! বাহ্! এই মেয়ের গিরগিটির মতো খোলোস পাল্টায়।বান্ধবীর এই অদ্ভুত রূপান্তর দেখে সুবহার চোখ-মুখে বিস্ময়ের ছাপ পড়ল বেশ।

শুভ্র এগিয়ে এলো সুবহার দিকে। সামনাসামনি দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে দেখে শুভ্রর কপালে ভাজ পড়ল। গত দু’বছরে মেয়েটার অনেক শারীরিক পরিবর্তন ঘটেছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই বয়সে মেয়েদের শারীরিক গঠন বৃদ্ধি পায়। ভালো করে লক্ষ্য করল শুভ্র। তাদের সেই ছোট্ট দুষ্টু সুবহা এখন এক পরিপক্ব যুবতীতে পরিণত হচ্ছে আস্তে আস্তে।

–“কিরে, তোর কি খবর? লেখাপড়া কেমন চলে? শুনলাম গতকাল বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধিয়েছিস?”

সুবহা একটু কুণ্ঠিত হয়ে আমতা আমতা করে উত্তর দিল,

–“এখন ঠিক আছি শুভ্র ভাই।”

শুভ্র আবার বলল,

–“পড়াশোনা কেমন চলছে বললি না তো? আগের মতো ফাঁকিবাজির স্বভাব আছে এখনও?”

সুবহা জবাব দেয়ার আগেই পাশে থাকা বিলকিস বেগম খোঁচা মেরে উঠলেন মেয়েকে উদ্দেশ্য করে,

–“ওর আর পড়ালেখা! ওরে দিয়া কিছু হইবো না শুভ্র। স্কুল ফাঁকি, টিউশন ফাঁকি এইসব ফাঁকির উপরই ওর ডিগ্রি। দুইদিন পর ভালো পোলা দেখে বিয়া দিয়া দিমু। এমন কামচোর, পড়া চোর মাইয়া পাইলা কি আর কপালে শান্তি আছে!”

মায়ের এহেন কটাক্ষ পূর্ণ কথায়সু বেশ লজ্জায় পড়ল সুবহা। ইতস্তত করে মুখ ঘুরিয়ে নিল। মনে মনে ভাবল এই মা’টা কখন কোথায় কি বলে বুঝতে পারা দায়! ও কি এখনও ছোট বাচ্চা? এভাবে সরাসরি লজ্জা দেয়ার কি আছে? সুবহা মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

–“পড়ালেখায় ফাঁকি দেওয়া ভালো কাজ নয় সুবহা। আজকাল মেয়েদের শিক্ষিত হওয়া সবচেয়ে দরকার। একটা জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে একজন শিক্ষিত মায়ের ওপর। তুই তো সায়েন্স নিয়েছিস শুনলাম, তাই না? তাহলে এখন তো মন দিয়ে পড়া দরকার। এমন ফাঁকি দিলে তো চলবে না।”

–“নাহ ভাইয়া আসলে মা….

সুবহার মুখের কথা কেরে নিলেন বিলকিস বেগম। বললেন চিবিয়ে চিবিয়ে,

–“হুঁ, এখন সব দোষ আমার! পড়ার বেলায় ঠনঠন, আর ঘোরার বেলায় এক্সপার্ট!”

–“আহা বিলকিস। আমাদের মেয়েকে এভাবে বলছো কেন! এমন নম্র আর ভদ্র মেয়ে আদতে পুরো দুনিয়ায় পাবে আর? সুবহা মা, এদিকে আয়।”

সুবহা এগিয়ে গেল ফুপির কাছে। জেসমিন বেগম চুলে হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন,

–“বেশি জ্বালালে আমাদের মেয়েকে আমাদের সঙ্গে দিয়ে দাও। এবার আমরা সুবহাকে নিয়ে যাবো। কী বলিস শুভ্র?”

শুভ্রর ঠোঁটের কার্নিশে মৃদ হাসির রেখা ফুটে উঠল। বলল দৃঢ় কণ্ঠে,

–“হ্যাঁ মামী, মা ঠিকই বলছে। ওকে এবার আমাদের সঙ্গে দিয়ে দিন। শহরে নিয়ে মিশমির কলেজে ভর্তি করিয়ে দেব।”

শুভ্রর মুখে এহেন কথায় মুখ চুপসে গেল শিউলির। বোতা মুখে দাঁড়িয়ে রইলো ও।

–“সুবহার সঙ্গে আমাকে নিয়ে যাবেন না ফুপু? ওরে ছাড়া আমার দম বন্ধ লাগে। একসাথে থাইকা অভ্যাস তোহ!”

শিউলির এহেন বোকা কথায় হেসে উঠলেন জেসমিন বেগম। শিউলি ইতস্তত হয়ে মুখ লুকালো সুবহার পিছনে। ওদিকে জেসমিন বেগম শুভ্র কে একা বাড়িতে আসতে দেখে প্রশ্ন ছুড়লেন,

–“শ্রেয়ান আসেনাই শুভ্র? তোমার সাথেই তো ছিল?”

শুভ্র মাথা নাড়িয়ে বলল,

–“না মা। গ্রামের কার যেন মৃত্যু সংবাদ পেয়েছে… উজ্জ্বল না কি যেন নাম… ওখানেই গেছে শ্রেয়ান। আমাকে শুধু বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।”

শুভ্রর কথা শেষ হতে না হতেই শিউলি হঠাৎ বজ্রপাতের মতো চেঁচিয়ে উঠল,

–“কি! উজ্জ্বল ভাই?”

–“হ্যাঁ, উজ্জ্বল নামটাই তো শুনলাম যেমন!”

বিলকিস বেগম থমকে গেলেন। চোখ বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে। কণ্ঠে ভয়ার্ত কাঁপুনি নিয়ে প্রশ্ন করলেন,

–“কি কও শ্রেয়ান? পরশু দিনই তো দেখলাম চায়ের দোকানে বইসা চা খাইতাসে! এর মধ্যে পোলাডার কি হইলো হঠাৎ কইরা? তুমি সত্যি কইতাসো তো?”

–“হ্যাঁ মামী, শ্রেয়ান তো সরাসরি ওখানেই গেছে।”

বিলকিস বেগম তৎক্ষণাৎ আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বললেন,

–“দাড়াও, আমি তোমার মামারে ফোন দিয়া জিগাইতাছি… হায় আল্লাহ! কি সুন্দর পোলাডারে সেইদিনই তো দেখলাম… বইসা বইসা চায়ের কাপে ফুঁ দিতাসে… চা খাইতাসে শান্তশিষ্টভাবে…!”

বিলকিস বেগমের চোখে জল টলমল করে উঠল। একদিকে অবিশ্বাস। অন্যদিকে হঠাৎ শোকের চাপ। মুখ দিয়ে অস্ফুটে বের হলো,

–“হায় আল্লাহ, মানুষের কখন কি হইয়া যায়! আল্লাহ গো!”

**

সাদা রঙের প্রাইভেট কারটি চলছে গ্রামের পিছঢালা রাস্তায়। দুপুরের তপ্ত করাফাটা রোদ্রে খা খা করছে খাল বিল। নাওফিক সামনের দিকে তাকিয়ে পা দুটো আড়াআড়ি ভাবে উঠিয়ে ঠেকিয়ে রেখেছে সামনের সিটের দিকে। ঠোঁটে এক ঠান্ডা গাম্ভীর্য অটুট। পাশে বসা তোফাজ্জল সাহেব মুখ গোমড়া করে রেখেছেন। চোখেমুখে স্পষ্ট অসন্তোষ বিদ্যমান। ছেলের এমন কারবারে বরাবরের মতোই ফ্যাসাদে পরে জান তিনি। শেষমেশ নীরবতা ভাঙল বাবার কণ্ঠে। ভেতরে জমে থাকা আগুনে তপ্ত হয়ে অধৈর্য হয়ে উঠলেন তোফাজ্জল সাহেব।

–“এভাবে মুখ কুঁচকে বসে আছো যেন কিছুই জানো না! এমনটা কেন করলে তুমি? আমি জবাব চাই!”

নাওফিক ঠাণ্ডা গলায় বলল,

–“কিসের কথা বলছেন, খুলে বলুন তো?”

তোফাজ্জল সাহেব ঘুরে তাকালেন ছেলের দিকে। চড়া গলায় বললেন,

–“চুপ থাকো বেয়াদব ছেলে! এমন ভাব করছো যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে যানো নাহ? উজ্জ্বলকে মেরেছ কেন? কোন পাকা ধানে মই দিয়েছিলো তোমার? ”

–“ওহ, এই ব্যাপার। আমি ভাবলাম আরও জরুরি কিছু হয়েছে বুঝি।”

তোফাজ্জল সাহেব কাঁপা গলায় গর্জে উঠলেন,

–“মানুষ মারা তোমার কাছে তুচ্ছ ব্যাপার? জানো এখন কী হতে পারে? পুলিশ আসবে, তোমাকে নিয়ে যাবে। খুনের মামলা চলবে। জেলের ভাত খাওয়ার খুব শখ জেগেছে?”

নাওফিক হেলান দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে শান্ত গলায় বলল,

–” কি করবো বল? চিকন চালের ভাত খেতে খেতে শরীরে আলসেমি ভর করেছে। এখন যদি মোটা চালের ভাত খেলে সেই আলসেমি টা কিছুটা দূর হয় আরকি। ”

–“আর সেই ভাতের সঙ্গে তো মোটা মোটা ডান্ডার ভারির স্বাদও পাবে সেটা মনে আছেতো নালায়েক?”

–“আলবাত আছে! তবে চেয়ারম্যান এর ছেলে হয়ে জেলে যাওয়াটা নিশ্চই শুভনীয় দেখায় নাহ?ছেলে জেলে গেলে গুজব উঠবে। ভোট কমবে। চাপ তো আপনার দিকেই আসবে, তাই না?”

তোফাজ্জল সাহেব দাঁত চেপে বললেন,

–“আমায় কি বলদ পেয়েছো? আমি কেন তোমায় বাঁচাতে যাবো? তোমার মতো খুনি সন্তান থাকার থেকে না থাকা অনেক ভালো। আগে তো মানুষ কে পথে ঘাটে মেরে বেরাতে এখন ডিরেক্ট খুন করা শুরু করে দিয়েছো নালায়েক কোথাকার!”

–“আহা আব্বা এমনে চেঁচান কেন? আমি যে খু”ন করসি ওইটার কোনো প্রমান আছে? কেউ মুখ খুলে বলসে যে চেয়ারম্যান এর ছেলে খুন করসে? আপনার কাছে এই পর্যন্ত কোনো কমপ্লেইন আসছে সেটা বলেন?”

–“কারো বলতে হবেনা। আমি তোমাকে চিনি। ওই ছেলে গতকাল রাতে হসপিটাল এডমিট করিয়েছো মেরে। এরপর সকালে মৃত্ ঘোষণা করা হয়। তুমি বলছো তুমি মারোনি?”

–“সেটা কখন বললাম? ”

–“উহ! তেজ হেয়ালি করোনা। কেন মেরেছো ছেলেটাকে? কিসের এমন শুত্রুতা তোমার যে ডিরেক্ট মেরেই ফেলতে হলো?”

নাওফিক সামনে তাকালো। সিটের পিছে মাথা হেলিয়ে দিয়ে শুয়ার ভঙ্গিতে পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে পুনরায় বলল,

–“আছে কিছু একটা গুরুতর কারণ। ওই কারণের জন্য শুধু একটা কেন প্রয়োজনে একশো টা খু”ন করতেও এই নাওফিক দ্বিতীয় ভার ভাববে নাহ।”

তোফাজ্জল সাহেব সোজাসুজি বিমূঢ় দৃষ্টিপাত করলেন ছেলের পানে। হিসহিসিয়ে বলল,

–“নালায়েক এটা কি সিনেমা পেয়েছো? তার আগেই আমি তোমাকে এখনই পুলিশ এর কাছে দিয়ে আসবো। নিজ থেকে। সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি। আত্মসমর্পন করবে তুমি। ”

নাওফিক চোখ কপালে তুলে তাকালো বাবার দিকে।

–“আপনি আমার নিজ বাপ্ তো ? ছেলেকে পুলিশ এর কাছে ধরা দিতে নিয়ে যাচ্ছেন?

তারপর চেঁচিয়ে উঠল,

–“রহিম চাচা! গাড়ি থামান! এক্ষুণি থামান!”

তোফাজ্জল দাঁত চেপে বললেন,

–“রহিম গাড়ি থামাবে নাহ। তুমি সোজা সামনের মোড়ের পুলিশ স্টেশনে গিয়ে থামবে। এই ছেলের নামে আমি মামলা ঠুকবো। চুরি ডাকাতি সন্ত্রাস খু”ন যত প্রকার মামলা আছে সব ঠুকে আসবো আমি আজ। জেলে থাকলে অন্ততঃ কটা দিন শান্তিতে শ্বাস নিতে পারবো।”

–“আর আমি আপনার ওই শান্তির শ্বাস বিনাশ করে দিবে। রহিম চাচা গাড়ি থামান বলছি! নাহলে কিন্তু আমি চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিবো। এরপর আপনারা আমার সুইসাইড করার কারণ হিসাবে জেলে গিয়ে পঁচে মরবেন আজীবন!”

–“এই ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়লে মরবে না নালায়েক। উল্টো হাত ভা পেঙ্গে বাড়িতে বসে থাকতে হবে সারাজীবন। সেটাতেও আমার কোনো আপত্তি নেই। দাও ঝাঁপ।”

–“আপনি কি বাপ্?”

–“না আমি পাপ! তোমায় জন্ম দেয়া ছিল আমার সবচেয়ে বড় পাপ!”

–“তাহলে থাকেন এদিকেই। আমি গেলাম!”

বলেই আর এক মুহূর্ত বিলম্ব করল না নাওফিক। পায়ের দরজাটা ঠেলে খুলে চলন্ত গাড়ি থেকে আচানক ঝাঁপিয়ে পড়ল বাইরে।
সৌভাগ্যক্রমে ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি না থাকায় বেশি আহত হয়নি সে। তবে পাকা রাস্তায় শরীর ঘষা খেয়ে হাত আর পায়ে ব্যথা পেয়েছে। চামড়া ছিলে গেছে রাস্তার ঘষায়। সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে গড়িয়ে।

নাওফিক মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে, ধুলা ঝেড়ে, রক্ত ঝরতে থাকা হাতে বাতাসে ইশারা করে গর্জে উঠল,

–“বদ দোয়া দিলাম আপনাকে, তোফাজ্জল সাহেব! সামনের ইলেকশনে আপনি বিপুল ভোটে হারবেন। দরকার হলে বিরোধী দলের সঙ্গেও হাত মেলাবো আমি। দরজায় দরজায় গিয়ে ভোট ভিক্ষা চাইবো তাদের পক্ষে। আপনাকে হারিয়ে দেবো দেইখেন এ আমার শপথ। এই তেজওয়ান নাওফিক চৌধুরীর শপথ… না নাহ, চৌধুরী বাদ। এখন শুধু নাওফিক। আপনার সঙ্গে নামের আর কোনো রক্তসম্পর্ক নেই আমার। হিটলার মীরজাফর বাপ্!”

গাড়ির ভেতরে বসে তোফাজ্জল সাহেব চুপ করে রইলেন। গতি কমালেন না। আর না থামালেন। মূলত তিনি কথা বলছিলেন শুধু ছেলেকে শাসাতে, ভয় দেখাতে, যেন সে নিজের সীমা বোঝে। কিন্তু এ ছেলে তো অন্য ধাতুতে গড়া।

তোফাজ্জল সাহেব চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে তাকালেন। এই পৃথিবীতে একমাত্র দুর্বলতা যদি কিছু থাকে তা তো এই ছেলেটাই।
কিন্তু সেই দুর্বলতা আজ যেন তাঁর বুকের ওপর পাহাড় হয়ে চেপে বসেছে। গাড়িটা গিয়ে থামলো একটু দূরে। তোফাজ্জল সাহেব বসে রইলেন স্তব্ধ হয়ে। জানালা খুলে মুখ বের করে শ্বাস নিলেন বড় করে। চাইলেন পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলের পানে। ছেলেটা তার আচানক এভাবে লাফিয়ে পড়বে কল্পনা করতে পারেননি তিনি।

–“বাড়ির দিকে গাড়ি ঘুরাও রহিম!”

**

সন্ধ্যার আবছা আলোয় দরজার প্রান্তরে ছেলের রক্তমাখা অবয়ব দেখে আঁতকে উঠলেন চৌধুরী গিন্নি জর্ণা বেগম। আকুল কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি ছেলেকে দেখা মাত্রই,

–“এই কী হাল করছো নিজের! কে মারল তোমায়?”

বলেই দৌড়ে এগিয়ে আসতে না আসতেই পেছন থেকে ছুটে এলো সুস্মিতা। নাওফিক এর এই হাল দেখে দ্রুত কদমে ভিতর থেকে ব থেকে স্যাভলন আর কটন বার নিয়ে ছুটে এল ট্রিটমেন্ট করতে। নাওফিক হাত বাড়িয়ে দাঁত চেপে বলল,

–“থাম। একদম কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করবি না।”

সুস্মিতা থমকে দাঁড়ালো। নাওফিক চোখ তুলে তাকালো মায়ের দিকে। রুক্ষ কণ্ঠে বলল,

–“পর নারীর ছোঁয়া এই নাওফিক চৌধুরী লাগায় না। দূরে থাক!”

ঘরজুড়ে মুহূর্তেই নেমে আসে নিস্তব্ধতা। হাওয়ার মতো চুপসে যায় সুস্মিতা। চোখে বিস্ময়, অপমান, আর একটা চাপা দুঃখের রেখা টনটন করে বয়ে যায় মেয়েটার শরীর জুড়ে। নাওফিক পা টেনে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।

ছেলে চলে যেতেই নিঃসব্দে চোখের কোণে ক্ষীণ জল রেখা ফুটে উঠল জর্ণা বেগমের। বুকের গভীরে একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে ধরল উনার। ছেলেটা যে তার ভীষণ একরগা। এ ছেলেকে আর বোঝানো যাবে না। অন্তত তার পক্ষে আর সম্ভব নয়।

**

পরদিন সকাল। পাখির কলতানে ভেসে থাকা পরিবেশে এই সাত সকালে অতিথিদের আপ্পায়নে ব্যস্ত বিলকিস বেগম। ফজরের আজানের সময় উঠেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন সকালের নাস্তা বানানোর কাজে। সুবহা আজও স্কুল যাবেনা ধরে বায়না ধরেছে। অবশ্য এর পিছনেও ছিল বিশেষ কারণ। গতরাতে সবাই মিলে ঠিক করেছে আজ গ্রাম ঘুরতে যাবে সকলে মিলে।

প্ল্যান অনুযায়ী সকালবেলা হালকা নাস্তা শেষে বের হলো তারা। সুবহা, শিউলি, শুভ্র, মিশমি চারজনের মুখেই উচ্ছ্বাসের হাসি। হেঁটে চলেছে বাড়ির পেছনের মাটির পথ ধরে।

গ্রামীণ দৃশ্যপট দেখে না চাইতেও মুগ্ধ হটে বাধ্য সকলেই। তারউপর তারা যদি হয় শহরে বেড়ে উঠা মানুষজন। ধানের ক্ষেত, বাঁশবাগান, মাঝেমধ্যে দূরে গরুদের গলার ঘন্টার শব্দ সবকিছু মিলে গ্রাম্য পরিবেশ বেশ উপভোগ করছে মিশমি। শুভ্র হেটে চলেছে চুপচাপ।

সামনে এগুতেই ওরা পৌছালো বেলতলার ঘাটের দিকে। ছায়ায় ঢাকা পুকুরের ওই কোণটা সুবহার প্রিয় জায়গাগুলোর মধ্যই একটা। ঠিক তখনই মিশমি লাফিয়ে উঠল হঠাৎ,

–“আমি পুকুরের ঘাটে পা ডুবাতে চাই! এই মুহূর্তে!”

মিশমির কথা মতোই সুবহার আগে শিউলি সায় দিয়ে নেমে গেলো ঘাটের পারে। সবাই মিলে জুতো খোলার কসরত শুরু করল। সুবহা মাটিতে বসে নিজের চপ্পল সরিয়ে বলল,

–“সাবধানে নেমে আপু, সিঁড়িগুলো খুব পিচ্ছিল।”

অবশেষে ঘাটের সিঁড়িতে একটু একটু করে নেমে গেল তারা। সুবহা জুতো গুলো সাইডে রেখে ভিজা শিউলা পরা শিরি তে দাঁড়ালো পা টিপে টিপে। পরনে ব্লু রঙা সালোয়ার টা একটু উঠিয়ে দাঁড়ালো সেখানটায়। হঠাৎ সুবহার পায়ের নিচে কিছু বিধতেই আকস্মিক ওর ফুটে বেরিয়ে এলো তীব্র চিৎকার,

–“আআআহ্!”

একটা বুলেট বেল গাছের লম্বা কাঁটা ঢুকে গেছে ওর ডান পায়ের পাতায়। শুভ্র চোখের পলক ফেলার আগেই ওর দিকে দৌড়ে এল।
নিজে হাঁটু গেড়ে বসে সুবহার পা নিজের হাঁটুর ওপর তুলে নিয়ে খুব ধীরে কাঁটাটা টেনে বের করতে লাগল ও। সুবহার মুখ কুঁচকে যায় ব্যথায়। চোখে জল টলমল করছে। ঠোঁট দিয়ে চেপে রেখেছে যন্ত্রণার সেই শব্দ।

–“ব্যথা পাচ্ছিস? একটু সহ্য কর, ব্যান্ডেজ করে দিব। কিচ্ছু হবে না। আমি আছি।”

তবে উক্ত ঘটনায় সুবহার থেকে বোধহয় অন্য কারো বুকের মধ্যে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি হচ্ছে। দূর থেকে একজোড়া চোখ এদিকটায় চেয়ে আছে।
চোখে অগ্নির কুন্ডলি। ঠোঁটে সিগারেট। চোখ ঘোলাটে হয়ে উঠেছে রাগে। চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল বিড়বিড় করে,

–“সালার দুনিয়ার সব পোলার কি আমার প্রাণ টার দিকেই নজর দিতে হয়?”

পাশেই দাঁড়িয়ে আছে শ্রেয়ান। সবেই এসে দাঁড়িয়েছে সে। বন্ধুর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো নিচে। বুঝে নিলো যা বুঝার। শুষ্ক ঢুক গিললো শ্রেয়ান। ঠাট্টার সরে বলল,

–“কি ভাই জ্বলে টলে নাকি? ”

সাথে সাথেই নাওফিক আকস্মিক জ্বলন্ত সিগারেটটা তুলে চেপে ধরল শ্রেয়ানের হাতে। শ্রেয়ান চিৎকার করে উঠল,

–“আউচ! ভাই, জ্বালাইয়া ফেলছোস!”

–“এইটুকু জ্বালা? আমার বুকের মধ্যে এখন এর থেকে হাজার গুণ বেশি আগুন জ্বলতেছে। এখন বুঝ কেমন জ্বলে! সালা!”

–“ভাই রিল্যাক্স রিল্যাক্স! টেম্পারেচার লো কর। ওরা ভাই-বোন হয়! ভাই-বোন!”

নাওফিক শ্রেয়ান এর কথা কানে নিলোনা। চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে আসা ছেলেটাকে ইশারা করল কিছু একটা। ছেলেটা নাওফিক এর ইশারা পাওয়া মাত্রই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল। মিশমি তখন হাসতে হাসতে পা ভিজিয়ে নিচ্ছে সিঁড়ির পানিতে। হঠাৎ পেছন থেকে ছেলেটা একটা হালকা ধাক্কা মারলো এসে।
“ঢুপ!” করে পুকুরে পড়ে গেল মিশমি। সাথে সাথে ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এল চিৎকার,

–“ভাইয়া! ভাইয়া! বাঁচাও!”

সুবহা পা নাড়িয়ে উঠতে পারল না। শুভ্র সাথে সাথে ওকে ছেড়ে ছুটে গেল পানির দিকে।
পুকুরে মিশমি হাবুডুবু খাচ্ছে। পানির মধ্যে চুল ছড়িয়ে এক টুকরো আতঙ্কের মতো ভেসে উঠছে বারবার। শ্রেয়ান থ হয়ে তাকিয়ে রইল পুরো সিনটার দিকে। মনে মনে বিড়বিড় করে বলল,

–“হায় আল্লাহ, আমার বোনের কপালে এ কাকে রেখেছো তুমি?

ওদিকে নাওফিক পকেটে দু হাত গুঁজে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে হেটে যেতে লাগলো সামনে। শ্রেয়ান পানিতে নাকানি চুবানী খেতে থাকা মিশমি কে দেখে নিয়ে পুনরায় বন্ধুর চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে বলল,

–“যাচ্ছিস কোথায়? ”

না ফিরেই জবাব দিলো নাওফিক,

–“তোর ওই বেয়াদব বোনটাকে পার্মানেন্টলি নিজের কাছে রাখার ব্যবস্থা করতে..

চলবে…..