প্রাণনাশিনী পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0
11

#প্রাণনাশিনী
#অন্তিম_পর্ব
#সুহাসিনি_মিমি

সুস্মিতার গায়ে হলুদ আজ। নাওফিকের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বয়স পেরিয়েছে ২৫ এর ঘর। পরিবারের চাপে পরেই এইবার বিয়েতে রাজি হতে হয়েছে তাকে। তবে এবার সে খুঁত খুঁজে পায়নি ছেলেটার মাঝে। তাই হয়তো হাল ছেড়ে দিয়ে এক পর্যায়ে রাজি হয়ে গেছে পরিবারের সিদ্ধান্তে।

গা-য়ে হলুদের হলুদ আলোকচ্ছটা চৌধুরী বাড়ির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে।মেয়েরা জড়িয়েছে গাঢ় লেভেন্ডা রঙের শাড়ি। নরম রেশমের উপর তাজা ফুলের গহনা যেন বসন্তের নৈসর্গিক ছোঁয়া বয়ে এনেছে।

শান্ত চোখ ও মুখে মৃদু দ্বিধা এবং হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা একরাশ না বলা কথা নিয়ে এগিয়ে গেল সুস্মিতার কক্ষের দিকে সুবহা,

কক্ষে তখন ছিল সুস্মিতা ও আরোহী। মেকআপ আর্টিস্টরা সদ্য বিদায় নিয়েছে। সুবহা দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। ওর উপস্থিতি লক্ষ্য করে আরোহীর চোখ জ্বলসে উঠল,

–“তুমি এখানে কেন এসেছো? কী চাই?”

সুস্মিতার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে থেমে গেল আরোহী। না বলা ভাষায় ইঙ্গিত পেয়ে গুটিগুটি পায়ে উক্ত কক্ষ টত্যাগ করল সে।

সুবহা তখনও দ্বিধার চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে। সুস্মিতা উঠে এল ধীরে পায়ে। দরজাটি বন্ধ করে ফিরে তাকাল সুবহার দিকে।

–“এসো এখানে। বসো তো আমার পাশে।”

সুবহা এগিয়ে গিয়ে বসল নরম গালিচার কিনারে। কাঁধ জুড়ে পড়া ফুলের চেন আর লেভেন্ডা রঙের কাপড় ওর কোমল মুখকে আরও শান্ত ও পরিণত করে তুলেছে অনেক।

সুস্মিতা স্নেহভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

–“পড়ালেখা কেমন চলছে তোমার?”

–“এই তো… আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই।”

–“সামনে তো ফাইনাল এক্সাম, প্রস্তুতি কেমন?”

–“চেষ্টা করছি… আলহামদুলিল্লাহ।”

সুস্মিতা কয়েক মুহূর্ত নিরব থাকল। সুবহার মুখের দিকে তাকিয়ে যেন বুঝে ফেলল চেপে রাখা মনখারাপের রেশ।

–“মন খারাপ কেন তোমার?”

সুবহা মৃদু হাসল। মাথা নুইয়ে বলল,

–“কই, না তো আপু।”

সুস্মিতা আলতো করে ওর গালে হাত রেখে বলল,

–“আরোহীর কথায় কষ্ট পেয়ো না। ও একটু অন্যরকম। তবে মনটা ততটাও খারাপ না।”

–“কিছু মনে করিনি, সত্যি বলছি।”

–“হুম। নাওফিকের সঙ্গে কথা হয় তোমার?”

আকস্মিক এহেন হঠাৎ নীরব হয়ে গেল সুবহা। চোখের কোণ ছুঁয়ে একটুকরো অস্বস্তি যেন কুয়াশার মতো ভেসে উঠল তৎক্ষণাৎ। নিচু চোখে তাকিয়ে থাকল কার্পেটের এক কোনায়। উত্তরটা গলায় এসে আটকে গেছে।

সুস্মিতা একটু এগিয়ে এসে ওর গালটা একহাত দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে বলল,

–“বলো না। হয়? কথা হয়?

সুবহা খুব আস্তে বলল,

–“না আপু।”

সুস্মিতার মুখটা একটু ভার হয়ে গেল। চোখে কেমন এক জটিল দৃষ্টি। হয়তো না বলা অনেক প্রশ্ন, অনেক অতৃপ্তি।

–“তোমার সঙ্গে কথা না বললে কি হবে তোমার প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি সেকেন্ড এর খবর কিন্ত ঠিকই সে রাখে। সেটা যানো তোহ?”

সুবহা কেবলার মত দু পাশে মাথা নাড়ালো। মৃদ হাসলো সুস্মিতা। পরপর বলল,

–“তবে আমি জানি। যেদিন থেকে তোমার মায়ায় জড়িয়ে ওই পুরুষের অস্তিত্ব খানাসেদিন থেকেই জানি। তবে ব্যাপার টাকে ওতো সিরিয়াসলি নেয়নি আমি। ভেবেছিলাম ক্ষনিকের মোহ। কেটে যাবে হয়তো একটা সময়। কিন্তু ভুল ছিলাম আমি। ওটা মোহ ছিলোনা। ছিল তোমার প্রতি ওর পাগলামি। মায়া। যেটা দিন বে দিন কমার বদলে বেড়েই গেছে। এখনো চলছে। যানো তুমি খুব ভাগ্যবতী সুবহা। বয়সে আমার চেয়েও যথেষ্ট ছোট তুমি। কিশোরী। অনেক বছরের তফাৎ তোমার আমার সাথে। তবে তবুও তোমার কপাল আর ভাগ্য নিয়ে আমার হিংসা হয় মাঝে মাঝে। অনেক হিংসা। এই হিংসার নাম না পাওয়া। এই হিংসার নাম এক তরফা ভালোবাসা। আমি জানিনা তুমি যানো কিনা। আর না জানলেও যেহেতু এই বাড়ির বউ হয়েছে তোহ একটা সময় ঠিকই জেনে যাবা। ওকে আমি সেই ছোট বেলা থেকে ভালোবেসে এসেছি। বলতে পারো আমার ভালোবাসা টা ছিল এক তরফা। আর সেটাই থেকে গেছে। অনেক ভাবেই আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছি। যা যা অপছন্দ করতো সেসবের ধারে কাছ ঘেসতাম না। যা যা পছন্দ করতো সেসব করে বেড়াতাম সারাদিন। তবে ভাগ্য দেখো আমার! ভালোবাসা তো দূর একটু ঠাই পর্যন্ত পায়নি ওই পাষান হৃদয়ে। আর তুমি এদিক থেকে কত টা ভাগ্যবতী নারী দেখেছো? এখন বলো তোমার ভাগ্য নিয়ে আমার হিংসা করাটা কি যুক্তিযুক্ত নয়?”

সুবহার চোখ দুটো ছল ছল করে উঠল। লক্ষ্য করল সুস্মিতার চোখ বেয়েও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে অনর্গল। হাতের সাহায্য সেই অশ্রু টুকু মুছে নিলো সযত্নে। বলল আবারো,

–“বোকা মেয়ে তুমি কান্না করছো কেন? তোমার তো আজ খুশি হওয়ার কথা। এই পৃথিবীকে জানিয়ে দেয়ার কথা। তোমার মত ভাগ্য কজনের হয় বলো?”

–“আপু আমি সত্যিই জানতাম না আপনি..

মুখের কথা কেড়ে নিলো সুস্মিতা,

–“আমি কি? আমি কিছুই নাহ। পরিবার বিয়ে দিচ্ছে। এতদিন অনেক জ্বালাতন করেছি পরিবার কে। নিজের কাছেই খারাপ লাগছে ভাবতে। আর কত জ্বালাব বলো পরিবার কে। তাইতো রাজি হয়ে গেলাম। ছেলেটা নাকি ভালো। দেখতেও নাকি যথেষ্ট হ্যান্ডসাম। তবে আমি দেখিনি। কারণ আমার চোখে যে এই পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর সুদর্শন আকর্ষণীয় বলতে শুধু একজনই…

বলেই ডুকরে উঠল সুস্মিতা। এরপর সুবহার কাছে গিয়ে বসল। ওর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় পুরে বলল,

–“তুমি অবুঝ নও আমি জানি। ভালো মন্দ বুঝার ক্ষমতা তোমার হয়েছে। প্লিজ ওকে কখনো কষ্ট দিয়ো নাহ। ওর খেয়াল রেখো। ও যা অপছন্দ করে সেসব করতে যেও নাহ কখনো। তাতে রেগে যায় ভীষণ ও।”

**

আলো-ঝলমলে চৌধুরী বাড়ির উঠানে গানের তালে তালে তালি দিচ্ছে মেয়েরা। হলুদ গায়ে হেসে উঠছে অনেকে।কেউবা হাসছে নিছক ফর্মালিটির জন্য।

স্টেজে বসে থাকা সুস্মিতা আজ যেন এক অপার্থিব রূপে আবির্ভূত। ফুলে ফুলে সাজানো মাথা। গাঢ় লেবেন্ডা শাড়ির সাথে সোনালি আলোতে ঝিকিমিকি করা গয়নার ঝলক। সবার চোখ এখন কেবল ওর দিকে।

কিন্তু স্টেজের সামনের পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা সুবহার চোখে জ্বলছে অন্যরকম এক আলো। তীব্র অপরাধবোধ, একাকীত্ব আর কষ্ট। মনে হচ্ছে যেন কেউ বুকে পাথর চাপিয়ে বসে আছে। ভেতরে ভেতরে কাঁপছে মেয়েটা। বুকের ভেতরটা কেমন ভার হয়ে আছে।সে নিজেও জানে না কেন আজ এত অস্থির লাগছে।

সুস্মিতার দিকে তাকাতেই বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল ওর। এই মেয়েটা এই হাস্যোজ্জ্বল মানুষটা ওর জন্য শুধু ওর জন্য একটা পুরো অধ্যায় মুছে ফেলেছে নিজের জীবনের। সে কি কখনো ওর সেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার যোগ্য ছিল?

**

নাওফিকের মা ঝর্ণা বেগম সুবহা কে নিচে স্টেজের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল,

–“মা একটু উপর থেকে আমার একটা জিনিস এনে দিতে পারবি।”

সুবহা না চাইতেও সম্মতি জানালো।

–“জি আম্মু বলেন কি লাগবে? ”

–“মা নাওফিকের রুমের কাবার্ড এ একটা বক্স আছে। খুলতেই সামনে পাবি। একটু এনে দেনা মা।”

না চাইতেও যেতে রাজি হলো সুবহা। কাপড় টা দু হাতে সামলে উপরে উঠে গেলো। নাওফিক এর রুম চিনে সুবহা। তবে ভিতরে ঢুকে নি এর আগে। এরপর রুমের সামনে গিয়ে দেখতে পেল রুমের দরজা খানা আগে থেকেই খোলা। সুবহা ইতস্তত করল কিঞ্চিৎ। পরপর ভাবলো লোকটা তো আর বাড়িতে নেই সুবহা ভয় পাচ্ছিস কেন? বলেই ভিতরে প্রবেশ করল ও। এরপর কাবার্ড খুলতেই সেখানে কিছু না দেখতে পেয়ে ভ্রু দয়ের মাঝে ভাজ পড়ল ওর। অতঃপর হন্ন হয়ে খুঁজতেই হাতে আটকালো জামা কাপড় এর সাথে কত গুলো সিগরেট এর পেকেট। নাক কুচকালো সুবহা।

–“প্রাণ!”

আকস্মিক পিছন থেকে গম্ভীর পুরুষালি পরিচিত কণ্ঠে ভড়কে উঠল সুবহা। হকচকিয়ে গিয়ে হাতে থাকা বক্স টা পরে গেলে ওর। চকিত পিছন ঘুরলো তৎক্ষণাৎ। বিস্ময়ে হতোবিহুল গেলো অমনিই। বলল অস্ফুট সরে,

–“নাওফিক ভাই।”

নাওফিক ভড়কে গেলো নিজ বউয়ের মুখে ভাই ডাকে। ভ্রূদয়ের মাঝে কয়েক স্তরের ভাজ ফেলে বলল,

–“নিজ বরকে ভাই ডাকলে আল্লাহ পাপ দিবে রে প্রাণ।”

–“আপনি এখানে? কবে এলেন?

–“খুশি হসনি তাইনা?”

সুবহা থম মেরে থাকলো। বলল আমতা আমতা করে,

–“না মানে আপনি।”

–“হ্যা আমি। তোর স্বামী। তেজওয়ান নাওফিক চৌধুরী। আর কিছু?”

সুবহা দু পাশে মাথা দুলিয়ে না জানালো। এরপর নিচে পরে থাকা বক্স টা তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলো সামনে। নাওফিক বলল,

–“কোথায় যাচ্ছিস?”

–“বাইরে।”

–“নিচে?”

–“জিহ।”

–“আজ সারারাত আর কোথাও যাওয়া যাওয়ি নেই তোর।”

সুবহা ভড়কে গিয়ে প্রশ্ন করল,

–“জিহ!

নাওফিক রুমের দরজাটা টেনে লাগিয়ে দিলো পিছনে। সুবহা বক্সটা বুকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে তার দিকে। নাওফিক ধীরে ধীরে কাছে এল ওর।

–“শোন, যথেষ্ট সময় দিয়েছি তোকে। আর সম্ভব নয় আমার পক্ষে।”

সুবহা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

–“মানে?”

নাওফিক চোখ নামিয়ে বলল,

–“মানে এই… এতদিন তো তোর মতামতের অপেক্ষা করেছি। ভাবছি তুই বুঝবি সময় নিবি স্বাভাবিক হবি। কিন্তু তুই তো শুধু পালিয়ে বেড়াস রে প্রাণ।”

সুবহার গলা শুকিয়ে আসে।

–“আমি পালাইনি। ভয় পেয়েছি।”

–“ভয়? আমার থেকে?”

–“যেতে দিন নাওফিক ভাই।”

সুবহা চোখ নামিয়ে বলল উক্ত কথাটি। বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেমন কেঁপে উঠছে।
নাওফিক কাছে এগিয়ে এল আরও একধাপ।

–“আজ থেকে কোথাও যাবি না তুই। থাকবি আমার কাছে। এই ঘরেই। এই বাড়িতেই। শুধু আমার হয়ে।”

সুবহা স্তব্ধ। কিছু বলছে না। চোখে জল জমছে। নাওফিক ধীরে হাত বাড়িয়ে তার হাত থেকে বক্সটা নিয়ে একপাশে রাখল।

–“ভয় পাস কেন আমায় এতো? আমি বাঘ? খেয়ে ফেলবো তোকে?”

সুবহা নিঃশব্দে চোখ তুলে চাইল তার চোখে।
নাওফিক কোমল স্বরে বলল,

–“আর এতো ভাই ভাই করছিস কেন? ভাই বলে ডাকলে আল্লাহ পাপ দিবে প্রাণ। বউ হয়ে ভাই ডাক ঠিক না। বরকে বরই বলা লাগে, বুঝলি?”

সুবহা খুব আস্তে মাথা নাড়লো।
নাওফিক হেসে বলল,

–“তাহলে শুধু নাওফিক বলতো একটা বার। তোর মুখে এই ডাকটা শোনার কত দিনের ইচ্ছা জানিস?”

–“আমি পারবোনা নাওফিক ভাই। যেতে দিন না আমায়।”

–“স্কুলে যাওয়ার সময় স্কুলের গেইটের সামনে যে একটা ছেলে রোজ তোকে ডিসটার্ব করে সেটা কাউকে জানাস নি কেন?”

সুবহা থত মত খেয়ে বলল,

–“কে কে বলেছে সেটা আপনাকে? ”

–“তুই কি মনে করিস তোর ওই আকামলা ভাইয়ের ভরসায় তোকে ফেলে রাখবো আমি? আর তোকে না বলেছিলাম বোরকা পরে মুখ আটকিয়ে চলা ফেরা করবি সবসময়?”

–“দম বন্ধ হয়ে আসে আমার মুখ আটকালে।”

–“দম আটকিয়ে মরে যা। তাও আমার হয়ে মর!”

–“নাওফিক ভাই সরুন। যেতে দিন আমায় আম্মু খুজবে।”

–“কেউ খুজবে না তোকে।%

–“মানে। ”

–“মানে তোর আম্মু তোকে এখানে আমার জন্যজ পাঠিয়েছে।”

সুবহা নিচু গলায় বলল,

— “সবাই জানে আপনি এসেছেন?”

নাওফিক ঠান্ডা স্বরে উত্তর দিল,

— “হ্যাঁ।”

সুবহা বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

— “তাহলে আমায় কেউ জানাল না কেন?”

— “জানালে কি আসতি?”

সুবহা চুপচাপ মুখ নিচু করে ফেললো।

— “আমি বাড়ি যাবো।”

একটু থেমে বলল ও।

নাওফিক গম্ভীর গলায় বলল,

–“বাড়িতেই তো আছিস।”

— “আমার বাড়ি যাবো মানে আমার বাসায়।”

–“তাহলে এটা কার বাড়ি? তোর স্বামীর বাড়ি কি তোর বাড়ি নয়?”

সুবহা বিরক্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলল,

–“উফ! সরুন তো, নাওফিক ভাই।”

নাওফিক ভ্রু কুঁচকে কিছুটা কৌতুক করে বলল,

— “বাব্বাহ, বউ দেখি আমার এক বছরে বেশ বড় হয়ে গেছে। মুখে মুখে তর্ক করে, রাগও দেখায়! সবকিছুই যখন শিখে গেছিস আসল কাজটাও শিখেছিস তো?”

সুবহা থমকে গেলো।

— “কি কাজ?”

নাওফিক কিছুক্ষণ চুপ থেকে চোখে চোখ রেখে বলল,

— “বর-বউ যখন একরুমে আলাদা থাকলে প্রথম রাতে যা হয়।”

সুবহা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

— “আপনি… আপনি সরুন প্লিজ। আম্মু খুঁজবে।”

নাওফিক সরে গিয়ে দরজার উপরের ছিটকিনির দিকে ইশারা করে বলল,

— “খুলতে পারলে চলে যা। আটকাবো না।”

সুবহা উপরে তাকিয়ে দেখলো ছিটকিনি বেশ উঁচুতে। সে একটু এগিয়ে গিয়ে কয়েকবার লাফিয়ে চেষ্টা করলো খুলতে।নাওফিক মুচকি হেসে বলল,

— “পারছিস না তো?”

সুবহা চোখ রাঙিয়ে বলল,

— “খুলে দিন।”

–“পারলে খুলে চলে যা!”

সুবহা ছিটকিনিতে হাত দিতে একটু উপরের দিকে ঝুঁকল। শাড়ির আস্তরণ সরে গিয়ে কোমরের ওপরটা খানিকটা দৃশ্যমান হয়ে উঠলো অজান্তেই। নাওফিকের চোখ সেখানে আটকে গেল। গম্ভীরভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। ঠোঁটের কোণে নিঃশব্দে এক দীর্ঘ তপ্ত শ্বাস ফুটে উঠলো নাওফিকের।
চাপা গলায় বলল,

— “কেন আমায় টালমাটাল করছিস রে প্রাণ! এমনিতেই মনটা অস্থির হয়ে আছে। উল্টাপাল্টা চিন্তা বাসা বাঁধছে মনে। আজতো দেখছি আমার পুরো প্রাণটাই বিনাশ করে ফেলবি রে প্রাণনাশিনী!”

সুবহা কথা শুনে ঘুরে তাকাল। নাওফিকের চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে ও নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝল শাড়িটা কিছুটা সরে গেছে। ও তাড়াতাড়ি কাপড় ঠিক করতে যাচ্ছিলোই অমনি নাওফিক ধীরে এগিয়ে এসে ওর হাত দুটো থামিয়ে বলল,

–“নিজেকে আড়াল করতে চাইছিস আমার কাছ থেকে? ”

সুবহা থমকে গেল। ওর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এল। চোখের পলক কাঁপল। নাওফিক উন্মুক্ত সেই জায়গা ওর হাত রাখলো। হাতের স্পর্শ গাঢ় করে এগিয়ে আনলো মেয়েটাকে ওর কাছে।

–“একটু পর আমাদের মধ্যে এমন অনেক কিছুই হবে যার জন্য মোটেও তুই প্রস্তুত ছিলি না। তবে আমার কিছু করার নেই তাতে। কারণ আমার পক্ষে আর সম্ভব না তোকে সময় দেয়া।”

সুবহার কান জ্বলে উঠল লজ্জায়। গাল লাল হয়ে গেল। ও তড়াক করে এক হাতে নাওফিকের মুখ চেপে ধরল।

— “যেতে দিন… প্লিজ।”

নাওফিক হাসল মৃদু,

— “পাপি নারী… আল্লাহ পাপ দিবে তোকে। তোর জন্য ছটফটিয়ে বিদেশ থেকে চলে এসেছি, তাও তোর হৃদয় গলছে নাহ? এবার আর দূরে থাকা নয়। দরকার হলে গ্রামে অবরোধ ডাকব। কিন্তু এই নাওফিক আর এক মুহূর্তও বউ ছাড়া থাকবে না।”

বলেই নিজের বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরল ওকে। সুবহার মাথা ওর বুকে। সুবহাও লোকটার বুকে পরম আবেশে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো।

–“প্রাণ রে। আমায় এইবার অন্তত একটু বুঝ। তোর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বুড়া হয়ে যাচ্ছি। একটু রহম কর এইবার। হবি আমার তুই? বিশ্বাস কর একটুও কষ্ট দিবো নাহ তোকে। অনেক আদর করবো প্রমিস। ”

সুবহার গাল দুটো লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। নাওফিকের গায়ের গেঞ্জি টেনে মুখ লুকালো নীরবে। বউয়ের নীরবতা কে সম্মতি ভেবেই আচানক পাঁজা কোলে তুলে নিলো নাওফিক ওকে।অতঃপর অগ্রসর হলো বেডের দিকে।

**

সকাল বেলা। চৌধুরী বাড়ির ড্রয়িং রুমের ঘড়িতে তখন আটটা বেজে বিশ। তোফাজ্জল সাহেব মুখ গম্ভীর করে চেয়ারে বসে আছেন। কপালের মাঝখানে তীব্র ভাঁজ। মুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট। ঠিক তখনই নাওফিক ঠাণ্ডা হাঁটার ছন্দে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে বেরিয়ে এল বাইরে। বেখেয়ালি ভঙ্গিতে এসে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল,

–“এক কাপ চা দিও তো আম্মা। একটু মিষ্টি বেশি দিয়ো।”

তোফাজ্জল সাহেব গর্জে উঠলেন,

–“নালায়েক! একে তো কাউকে কিছু না বলে চলে আসলে তার ওপর এসেই মেয়েটাকে নিজের ঘরে রাখলে? এইটা কি ঠিক করছো তুমি?”

নাওফিক মুখে একটা হালকা হাঁসি টেনে বলল”

–“আমায় বলছেন?”

–“তোমায় ছাড়া আর কারে বলব?”

নাওফিক চোখ ঘুরিয়ে বলল,

–“ওহ, আমি ভাবছিলাম হয়তো… এই সোফাটাকে বলছেন। ও তো কিছুক্ষণ আগেও করছিল ‘কর্কশ শব্দ’ আপনার মতোই।”

— “ইয়ার্কি মারছো আমার সঙ্গে?”

–“কেন আপনি কি আমার বেয়াই লাগেন নাকি?”

–“এই নে বাবা তোর চা। ”

নাওফিক একটা নিঃশ্বাস ফেলে গম্ভীর গলায় বলল,

— “তোমার স্বামীকে বলে দিও, আজ থেকে আমার বউ আমার সঙ্গে থাকবে। এই বাড়িতেই। যদি কারো এতে সমস্যা থাকে, তাহলে সে যেতে পারে। আমার কোনো আপত্তি নেই।”

তোফাজ্জল সাহেব থমকে গেলেন।

–“নালায়েক এটা আমার বাবার বাড়ি!”

–“আর আমার দাদার!”

–“বাড়িটা এখন আমার নামে!”

–“আপনার একমার উত্তরাধিকার এখন আপাতত আমি!”

–“হুমকি দিচ্ছ? ”

–“না সরাসরি থ্রেট দিচ্ছি।”

বলেই চা খেতে খেতে উঠে দাঁড়ালো নাওফিক। যেতে যেতে বলল,

–“বলবেন নাহ? ”

তোফাজ্জ সাহেব তেতে গিয়ে বললেন,

–“কিহ!”

–“ওইযে নালায়েক! আপনার মুখে সেই লাগে কথাটা আব্বা। একদম কলিজায় গিয়া লাগে।”

ওদিকে ঝর্ণা বেগম বাপ্ ছেলের এমন মনোমালিন্য জগড়া দেখে তপ্ত শ্বাস ফেললেন। মনে মনে বিড়বিড় করলেন তিনি,

–“এদের এই খুনসুটি ময় জগড়া আজীবন বহমান থাকুক আল্লাহ। এভাবেই রেখো চিরদিন তুমি ওদের।

বলেই দু হাত তুলে বললেন,

–“আমিন আমিন আমিন।

সমাপ্ত….