#প্রাণপ্রিয়❤️ [পর্ব-১০]
~আফিয়া আফরিন
“আজ আবার ভাইয়া বাবার কাছে বকুনি খেয়েছে। কী লিখব আর কী বলব? বেচারার কোথাও ঠাঁই হচ্ছে না। কেউ তার কপালে পার্মানেন্ট ভাবে লেপ্টে যাচ্ছে না। প্রথমবার বকুনি খেল মিষ্টির কারণে, এইবার আবার আরেকজন। বাবা তো ভীষণ রেগে গেছে। রেগে মাকে বলছেন, ‘শাহানা তোমার ছেলের সমস্যা কি? ওকে এসব ভন্ডামি ছাড়তে বলো আর নয়তো আমার বাড়িতে থাকতে পারবে না সে।’
মা আর ভাইয়াকে কি বলবে? তবুও যতটুকু সম্ভব শাসন করত। ভাইয়ের বর্তমান গার্লফ্রেন্ডের নাম হচ্ছে ঐশী। একদিন ভাইয়া আমার মাধ্যমে ওকে চিঠি পাঠিয়েছিল, তারপর থেকে চিনি।”
২০ অক্টোবর, ২০০০.
“আমার জীবন সুন্দর কাটছে। ও প্রতি সপ্তাহে একবার আসে আমার সাথে দেখা করার জন্য। সপ্তাহের ছয়টা দিন আমাকে তৃষ্ণার্ত থাকতে হয় ওকে এক পলক দেখার জন্য, আমি চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকি। এই অপেক্ষাটা খারাপ লাগে না…. দীর্ঘ অপেক্ষার পর যখন ওকে এক নজর দেখতে পাই, তখন সারা দুনিয়া হাতের মুঠোয় মনে হয়। আমি শুধু ক্লাস ফাঁকি দিয়ে প্রেম করতেই যাই না, বান্ধবীদের সাথে সিনেমা দেখতে যাই। মাকে একদিন বলেছিলাম, সে আমাকে কিছুতেই অনুমতি দিবে। সোজা বলে দিয়েছে, ‘ক্লাস শেষে একদম বাড়ির ফিরে আসবি। কোন দিকে তাকাবি না।’
আমার বান্ধবীদের ভাষ্যমতে, আমাদের বড় ভাইরা নাকি খুব কড়া। অথচ আমি এইদিক দিয়ে অনেক লাকি। আমার ভাইয়া কোনোদিন এসব দেখতেও আসবে না, কেউ বললেও কানে নেবে না। ভাইয়ার সাথে আমার সম্পর্কটা এইরকমই মিষ্টি, মধুর।”
০১ নভেম্বর, ২০০০.
“শীতকাল আমার ভীষণ পছন্দ। শীতের কুয়াশামাখা ভোর, চাদর মুড়ি দিয়ে পড়তে যাওয়া সকাল, পথে যেতে যেতে ভাপা পিঠা খাওয়া, মায়ের হাতের বিভিন্ন ধরনের পিঠাপুলি, খেজুরের রস—সবটাই আমার প্রিয়। এতটাই প্রিয় যে আমি সারা বছরের মধ্যেই নভেম্বর, ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাসের অপেক্ষায় থাকি। এইবার বেশ জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আর ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করে না। তবুও যাই, ওই মানুষটা যে হুটহাট কখন চমকে দিতে এসে হাজির হয়!”
১৮ নভেম্বর, ২০০০.
“আমার মায়ের ধারণা, শাড়ি পরলে আমাকে অনেক বড় দেখায়। আর বড় দেখানো মানে আমার দ্রুত বিয়ে হয়ে যাওয়া। আজ আবার শাড়ি পড়েছিলাম। মা কী আফসোস করল! মায়ের দুঃখী মুখটা দেখতে আমার ভালো লাগে না। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বিয়ের আগে আর শাড়ি’ই পড়ব না।”
২৮ নভেম্বর, ২০০০.
“একটা বিষয় নিয়ে আমি চিন্তিত। আজ ওর আসার কথা ছিল, কিন্তু এলো না। আগে এই বিষয়টা নিয়ে মন খারাপ হত। এখন ভয় হয়, চিন্তা হয়। কারণ ও বলেছিল, ‘কোন বিপদে না পড়লে বা কোন সমস্যা না হলে আমি তোমার কাছে আসব’ই। কোনো বাঁধাই আমাকে বেঁধে রাখতে পারবে না।’
তাই ভয় হয় প্রচুর। ওদের ইচ্ছাকৃতভাবে আসে নাই, এটা আমার জানা আছে। তবে? রাস্তাঘাটে কোন বিপদ আপদ হলো না তো? ধুর, কী ভাবছি আমি। আল্লাহ! দ্রুত ওর সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করে দাও। পরীক্ষা চলছে, তারমধ্যে আমি এত টেনশন নিতে পারছি না।”
০৮ ডিসেম্বর, ২০০০.
“আরো দু’টো দিন কেটে গেল, অথচ সে এলো না। এমন তো হয় না। আজ দেখা করতে না পারলেও কাল এসে ঠিক দেখা দিয়ে যায়। ওর কাছে ব্যক্তিগত টেলিফোনও নাই যে ফোন করে একটা খোঁজখবর নিব। সকালটা মন খারাপ নিয়ে কাটে, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা এবং রাতেও একই অবস্থায়। ওর সাথে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে এখন আর কিছুই ভালো লাগেনা ওকে ছাড়া।”
১১ ডিসেম্বর, ২০০০.
“তোমার অনু, তোমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে রয় সারাক্ষণ…….. কবে তুমি আসবে? আরেকটিবার ভালবাসি বলবে? চলে এসো প্রিয় পুরুষ, তোমাকে ছাড়া একটি মুহূর্তও ভালো কাটে না।”
১৬ ডিসেম্বর, ২০০০.
“আজ ওকে খুব বকেছি। এতকাল পর আমার সাথে এসেছে দেখা করতে। অবশ্য এখানে আমার একটা দোষ ছিল। ও আমাকে বলে গিয়েছিল, প্রাকটিক্যাল চলবে। দেখা করতে আসতেও পারে আবার নাও আসতে পারে। আমি এই কথাটা বেমালুম ভুলে বসে ছিলাম। কতই না চিন্তা করতে করতে মাথা খারাপ করেছি। আমার এই নিজস্ব রাগের থেকেই ওর প্রতি রাগ তৈরি হলো। তারপর আচ্ছামত বকা দিলাম, একদম আড়ি নিলাম। বললাম, ‘কথাই বলব না তোমার সাথে।’
ও তো বারবার আমায় কনফেস করানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমি ওসব পাত্তা দিচ্ছিলাম না। অবশেষে রাস্তা ভর্তি মানুষের সামনে কানে ধরে বলতেছে, ‘সরি, সরি, হাজার বার সরি অনু। আর কোনদিন এমন ভুল হবে না।’
আমি দ্রুত এগিয়ে গেলাম। এখানে যদি পরিচিত কোন মানুষ থাকে? কয়েকজন পথচারীও ঘুরে ঘুরে আমাদের দেখছিল। ওকে নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে এলাম। কোমরে হাত রেখে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমায় কি ফাঁসাবার তাল করে এসেছ?’
‘তোমার কাছে ক্ষমা চাইতেছি।’ সে নিরীহ মুখে বলল। আমি চুপ থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে দেখলাম। আমাকে চুপ থাকতে দেখে ও আবার বলল, ‘আবার কি ক্ষমা চাইব? মনে হচ্ছে তুমি আমাকে এখনো ক্ষমা করো নাই। ঠিক আছে।’
ও আবারো চেঁচাতে গেলে আমি মুখে হাত চাপা দিয়ে থামিয়ে দিলাম। ক্ষমা করতে বাধ্য হলাম। না হয় ওইভাবে চেঁচামেচি করতেই থাকতো। তবে এই মুহূর্তে ওর ঠোঁটের কোণে বিজয়ের হাসি দেখে আমার মেসেজটা আরো গরম হয়ে গেল। অভদ্রটা এভাবেই প্রতিবার জিতে যায়। আমি ওর হাসির দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটলাম তারপর বাড়ির পথে রওনা দিলাম।”
২২ ডিসেম্বর, ২০০০.
“ও বোধহয় বুঝেছিল, আমি তাকে ক্ষমা করলেও আমার মান ভাঙ্গে নাই। তাই তো আবার দুইদিন পর এসে হাজির। কী যে করে! সেই কতদূর থেকে, আবার এসেছে! কোন মানে হয়? আজকে আর মান-অভিমান ধরে রাখতে পারলাম না। কত কথা বললাম ওকে। হাত ধরে হাঁটলাম। মাত্র কিছুদিন! তারপর শুরু হবে নতুন বছর, সে নিয়ে কত কথা বললাম। আমরা সহ আমাদের সম্পর্ক নতুন বছরে পদার্পণ করবে! কী মজা। এভাবে জনম জনম প্রতিটি বছর একসাথে এক হয়ে থাকতে চাই।”
২৪ ডিসেম্বর, ২০০০.
“মা-বাবা, ভাইয়ার সাথে ঘুরতে বের হয়েছিলাম। ইশশশ, ইদানিং যেখানে যাই সেখানে গলি-গুপচিতে প্রেমিক প্রেমিকার মেলা। বুঝিনা এদের লজ্জা শরম কোথায়? আমিও তো প্রেম করি। কিন্তু ও কিংবা আমি কেউ আমাদের সম্পর্কটা ওত বাজে পর্যায়ে নিয়ে যাই নাই, কখনো যাবোও না। হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছি, এইভাবে প্রেম কলুষিত করব না। দু’জন দু’জনার থাকব, যেভাবে পৃথিবীকে জুড়ে রাখে তার গ্রহ-নক্ষতারা; ঠিক সেভাবেই আমরা থাকব, আমাদের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখবে আমাদের বিশ্বাস, ভালোবাসা এবং ভরসা। এই নিয়েই থাকব আজীবন….. সারাজীবন।”
২৫ ডিসেম্বর, ২০০০.
“ইয়েস, ও আজ আবার এসেছে। ও এলে আমার এত আনন্দ লাগে কেন? উফফফফ, এই আনন্দ আমি কিছুতেই প্রকাশ করতে পারছি না। নাচতে ইচ্ছে করছে। আজকে বলেছি, আমি তোমার সাথে মাঝে মাঝে অভিমান করব আর তুমি এভাবেই আমাকে চমকে দিতে বারবার আসবে।”
২৮ ডিসেম্বর, ২০০০.
“আমার ভাইটা কত বড় হয়ে গেছে, মা বলেছে তার বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। অথচ এখনও আমার সাথে ঝগড়া করে। আজকে আবার কম্বল নিয়ে ঝগড়া শুরু করে দিয়েছে। আমার যা পছন্দ, ও সেটা নিয়েই টানাটানি শুরু করে দেয়। আশ্চর্য! এইবার আর দিব না ওকে! যা ইচ্ছে হয় করুক। দরকার পড়লে বাবাকে নালিশ করব। মাকে বলে কোনো কাজ হচ্ছে না।”
২৯, ডিসেম্বর, ২০০০.
“আজ ৩১ ডিসেম্বর, বছরের শেষ। অনুষ্ঠান ছিল ক্যাম্পাসে, সেখানে গিয়েছিলাম। উনি এসেছিলেন, নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানালেন। বেশিক্ষণ অবশ্য থাকতে পারলেন না, ইমার্জেন্সি বাসায় যেতে হবে তাকে। তাই ঢাকা বাসস্ট্যান্ড থেকেই বাসে উঠে সোজা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আমার কেমন বুকের ভেতর টান লাগে! মন খারাপ হয়ে যায়। অপেক্ষায় থাকি, কবে যে ও আমার হবে পুরোপুরি! তাহলে আর এভাবে অপেক্ষা করতে করতে হাহাকার করতে হবে না আমার। সারাক্ষণ ওকে চোখের সামনে দেখতে পারব, ছুঁতে পারব যখন-তখন। তাকিয়ে দেখব, এই মানুষটা শুধুই আমার, আগাগোড়া সম্পূর্ণটা।”
৩১ ডিসেম্বর, ২০০০.
.
অনিতা ডায়েরীটা বন্ধ করল। বাবা সকালে ফোন করেছিল, বাসায় ফিরতে বলেছে। আহিরের সাথে তার কথা হয়েছে, শীঘ্রই বাসায় আসবে। এরইমধ্যে নাকি একদিন আহিরের সাথে তিনি আলাদাভাবে দেখাও করেছেন। অথচ অনিতাকে বিষয়টা কেউ জানায় নাই। না আহির, না তার বাবা। একদিক থেকে ভালোই হয়েছে, ওরা নিজেদের মত আলাপ-আলোচনা করে ফেলেছে; তার আর নিজের কিছু করতে হবে না। জাস্ট, অপেক্ষা এখন!
আহিরের সাথেও কথা হয়েছে। অনিতার যাওয়ার কথা শুনে সে আসছে, তাকে নিয়ে যেতে। এটা এখনও ফুপি জানে না। বাড়ি ফিরুক, তারপর বলবে। অনিতা কিছুক্ষণ আগেই ব্যাগপত্র গুছিয়ে রেখে তারপর ডায়েরী পড়তে বসেছে। আর পড়া হবে না। কবে আবার পড়তে পারবে কে জানে? ২০০০ সালটা শেষ হয়ে গেছে। নতুন বছরে কি কাহিনী ঘটেছিল তার জানা নাই, সেই সুযোগটাও আপাতত কিছুদিন নাই।
অনু বাড়ি এলে অনিতা ঢাকা ফিরে যাওয়ার কথাটা বলল। শুনেই সে অবাক! বলা নেই, কওয়া নেই, এইভাবে চলে যাওয়ার কোনো মানে হয়? অনিতাকে বলল, ‘তুই ওয়েট কর, আমি ভাইয়ার সাথে কথা বলি। এখনি যাবি মানে কি?’
অনিতা বাঁধা দিয়ে বলল, ‘দাঁড়াও ফুপি, বাবাকে বলে লাভ নেই। আমাকে আজকেই যেতে হবে।’
‘কেনো? কীসের তাড়া তোর? পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে?’
‘না।’ অনিতা ছোট্ট করে বলল।
‘তাহলে? গতকাল পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। আজ কি হয়েছে?’
অনিতা মিনমিন করে বলল, ‘আসলে ফুপি, আমার ফিরে যাওয়ার কথা শুনে আহির আসছে। ও বলেছে, আমাকে নিয়ে ঢাকা ফিরবে। এইজন্য আর কী!’
‘ওর সাথে তো আমার দেখা হলো না এখনও? কত বড় সাহস ব্যাটার! আমার ভাতিজিকে আমার সামনে দিয়ে চুরি করে নিয়ে যাওয়ার প্লান করতেছে। আসুক আজকে। ধরে বেঁধে একদম পুলিশে দিব।’ হেসে বলল অনু।
অনিতা বলল, ‘তাহলে চলো বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। ও ওখানেই থাকবে বলেছে।’
‘ওমা! জামাই মানুষ…মানে হবু জামাই। বাসায় আসবে না?’
‘অন্য একদিন। আমাদের তো আবার বাড়ি ফিরতে হবে তাইনা? তুমি আমার সাথে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত চলো, ওখানে একপলক দেখে নিও। বাসায় আসার জন্য জোরাজুরি করো না, এখন সম্ভব না।’
অনু এক মুহূর্ত চুপ থেকে অনিতাকে তৈরি হতে বললেন। অনিতা ঝটপট তৈরি হয়ে নিল। আহিরকে ফোন করে শুনে নিল, এখানে পৌঁছাতে যার আর কতক্ষন সময় লাগবে! সেই অনুযায়ী ফুপিকে নিয়ে বের হলো।
বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে দেখল, বাস এখনো আসে নাই। দশ মিনিট অপেক্ষা করতেই কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা পেল। আহির প্রথম অনিতাকে দেখে এগিয়ে গেল।
অনিতা ওর ফুপির সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। আহির সলজ্জ নেত্রে কথাবার্তা বলল। তারপর বাসের সময় হয়ে গেলে বিদায় নিল। অনু বারবার করে বলে দিল, ‘তোমরা সাবধানে যাবে। গিয়েই আমাকে ফোন করবে।’
আহিরকেও বলে দিল, অনিতাকে যেন ঠিকমত বাড়ি পৌঁছে দেয়। বাস না ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত অনু দাঁড়িয়েই ছিল। ভালোবাসা সর্বদাই সুন্দর, যদি সেই ভালোবাসার মানুষটা সঠিক হয়!
.
.
.
চলবে…..
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা— ১৫১০