প্রাণসখা পর্ব-০২

0
4

#প্রাণসখা
#লাবিবা_আল_তাসফি

২.
‘আপনি খুব অধৈর্য নারী। নারীদের ধৈর্য হবে আকাশ সমান কিন্তু আপনার ভেতর ছিটেফোঁটাও নেই। এটা দুঃখজনক।’

অতিব সত্যি এই কথাখানার জবাব আমি দিতে পারলাম না। বাসের জানালা থেকে বাহিরে তাকিয়ে রইলাম নিশ্চুপ ভাবে। তিনিও আমাকে আর ঘাটালেন না। একইভাবে চোখ বন্ধ রেখে বসে রইলেন। আমার ফোনে কল এলো। মামা কল করেছে। কল ধরতেই মামার হাস্যোজ্জ্বল কন্ঠস্বর কানে এলো,

‘কি রে বাচ্চা! কতদূর?’

আমি ঠোঁট উল্টে জবাব দিলাম,

‘মাত্র বিশ মিনিট হলো গাড়ি ছেড়েছে। এখনো বেশ দেরী। তুমি কোথায় আছো?’

‘আমার কথা বাদ দে। তোর বাপ কি করেছে জানিস? আমার নামে মামলা করেছে। ভাবতে পারছিস কোন লেবেলের মীরজাফর তোর বাপ? ছোট থেকে কোলে পিঠে করে তোকে মানুষ করলাম আমি আর তার প্রতিদান এই দিলো!’

আমি অবাক হলাম না। বাবার পক্ষে এটা করা অসম্ভব ব্যাপার নয়। মামাকে সে আগেই বলে রেখেছিলো মামা যদি আর কোনো ঝামেলা বয়ে আনে তার ঘাড়ে তাহলে সে মামাকে হাজতে পাঠাবে। আমি ছোট করে শ্বাস ফেলে বললাম,

‘তুমি জানলে কিভাবে এতসব?’

‘তোর পালানোর পেছনে আমার কোনো হাত নেই এটা প্রমাণ করতেই আমি নিজে তোর বাপকে কল করেছিলাম। তোর নতুন সিমের নম্বরটাও তাকে দিয়েছি। তুই রাজশাহীতে যাচ্ছিস একথাও সে জানে। মুখ ফসকে বাসের নম্বরটাও বলে দিয়েছি। কেবল কার বাড়িতে যাচ্ছিস সে কথা বলিনি। কিন্তু ব্যাটা তার আগেই আমার বিরুদ্ধে মামলা করে ফেলেছে। আমার এত কষ্ট সব জলে!’

আমি আতকে উঠলাম। চাপা রাগে ছলকে উঠলো মস্তিষ্ক। মামাকে বললাম,

‘কি করেছ তুমি বুঝতে পারছো?’

‘অবশ্যই বুঝতে পারছি। তোর বাপের মতো খাটো মস্তিষ্ক না আমার। কথা হচ্ছে তোর বাপ যখন তখন পুলিশ নিয়ে তোর বাস আটকাবে। তোর উচিত এখনি বাস থামিয়ে নেমে যাওয়া। ডিরেক্ট রাজশাহী না যেয়ে ভেঙে ভেঙে যাওয়া। তোর বাপের পক্ষে ওভাবে তোকে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না। খাটো মাথায় অতো বুদ্ধি নেই তার।’

আমি উদ্ভ্রান্তের মতো বাসের জানালা থেকে উঁকি দিলাম। পেছন থেকে কেউ আমায় টেনে সিটে বসিয়ে দিলো। তাকিয়ে দেখলাম ঝাঁকড়া চুলের অধিকারী মানুষটা কপাল কুঁচকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে আছে। বেশ বিরক্ত গলায় বললো,

‘মরতে চাচ্ছেন? অন্যকোনো ওয়েতে মরুন। এভাবে মরলে আজ আর আমার বাড়ি ফেরা হবেনা। বুঝতেই পারছেন পুলিশের একটা ব্যাপার রয়েছে! কিন্তু আমার বাড়ি ফেরাটা জরুরি।’

ফোনের ওপাশ থেকে মামা বললেন,

‘তোর পাশে কে?’

আমি জবাব দিলাম,

‘এক খারুজ লোক। যার প্রতি কথায় জ্ঞান ঝড়ে পড়ে!’

মামা ওপাশ থেকে হুঁ হাঁ করে হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন,

‘তোকে শেষ বারের মতো একটা উপকার করি বাচ্চা। তুই ঐ লোকের সাথেই পালিয়ে যা। নয়তো ঐ লোককে নিয়ে পালিয়ে যা। না যেতে চাইলে হুমকি দে। তুই তোর বাপের মেয়ে হয়ে এটুকু তো করতে পারবিই। হুমকি দেওয়ার ব্যাপারটা তোদের রক্তের সাথে মিশে আছে।’

আমি মামার মশকরা শোনার মুডে নেই ঐই মুহূর্তে। তাই রেগে বললাম,

‘মশকারা রাখো। ভালো বুদ্ধি থাকলে দাও। বিপদে তো ফেলেছোই। এখন বের হওয়ার একটা উপায় দাও অন্তত।’

‘আমি মোটেই মশকারা করছি না আদ্রী। ভেবে দেখ তোর একার পক্ষে ভেঙে ভেঙে রাজশাহী যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। যতই হোক তুই সাহসী। যেতে রাত হবে। রাতের বেলা একা একটা মেয়ে জার্নি করা মোটেও সহজ কোনো লক্ষণ না। লোকটার কাছে সাহায্য চা। দেখতে সুন্দর হলে প্রেমেও পড়তে পারিস। কোনো বাঁধা নেই।’

মামার পুরোপুরি কথা না মানতে চাইলেও বুঝলাম এটা সত্যি আমার জন্য রাতে একা জার্নি করাটা সুবিধার হবে না। কিন্তু পাশের মানুষটা কি আদেও সাহায্য করবে? এই মুহূর্তে বাস থেকে নেমে না গেলে বাবার হাতে ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় সত্তোর ভাগ। বাকি ত্রিশ ভাগ সম্ভাবনা রয়েছে পুশিরের সাথে থানায় যাওয়ার। বাবা হয়তো আমার নামেও ইতিমধ্যে মামলা ঠুকে দিয়েছেন। মানহানির মামলা। আমি তপ্ত শ্বাস ফেলে পাশের মানুষটির দিকে তাকালাম। তিনি বুকে হাত বেঁধে সিটে চোখ বন্ধ করে এলিয়ে রেয়েছে। সূর্যের নরোম আলো এসে তার মুখে পড়ছে। তাতে বিন্দুমাত্র বিরক্তি নেই তার চোখে মুখে। আমি পাহাড় সমান সংকোচ নিয়ে তাকে ডাকলাম।

‘এই যে! শুনছেন?’

তিনি শুনলেন না। আমি একটু আড়ষ্ট হয়ে বসলাম। আঙুল দিয়ে তার হাতে মৃদু টোকা দিলাম। মুখে বললাম,

‘এই যে! একটু দরকার!’

তিনি ধীরে সুস্থে চোখ মেলে তাকালেন। আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে বললেন,

‘বলে ফেলুন। শুনছি।’

কেমন কাটকাট জবাব। আমি খানিক দ্বিধায় পড়লাম। অপরিচিত মানুষটাকে এতখানি ভরসা করা কি উচিত হবে? কিন্তু সামনে আসন্ন বিপদের কথা চিন্তা হতেই দ্বিতীয় বার না ভেবে বলে ফেললাম,

‘আমায় পালাতে সাহায্য করুন প্লিজ! যখন তখন আমার বাবা পুলিশ সহিত এসে বাস থামিয়ে নিবে।’

তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,

‘আমি কি করতে পারি?’

‘সাহায্য। আমার সাথে চলুন।’

‘কিছু মুহূর্ত পূর্বে আপনি আমার দেওয়া পানি খেতেও ভয় পাচ্ছিলেন যতদূর মনে পড়ে। হঠাৎ এই মন পরিবর্তনের কারণ? আমি কিন্তু খারাপ হতেই পারি।’

আমি জবাব দিতে পারলাম না। আমি তো তাকে এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারিনি। কেবল সাহায্য চাওয়ার মতো মানুষ আশপাশে নেই তাই বাধ্য হয়ে তার সাহায্য নিচ্ছি। এ কথা তাকে বলা যাবে না। ততক্ষণে সে সিট ছেঁড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। বাসের হেল্পারকে ডেকে বললেন,

‘মামা বাস সাইড করো। ইমারজেন্সি। আমাদের এখনি নামতে হবে।’

পরক্ষণে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

‘বসে আছেন কেন? চলে আসুন। সুন্দরী মেয়েদের আবদার প্রত্যাখ্যান করতে পারি না আমি।’

বাস সাইড করা হলো। হেল্পার লোকটা অল্প বয়সী। সে এগিয়ে এসে বললো,

‘কেউ মারা গেছে ভাই?’

আমি তাকালাম আমার প্রতিবেশী সিটের ঝাঁকড়া চুল ওয়ালার দিকে। সে বেশ স্বাভাবিক ভাবে বললেন,

‘তার থেকেও ভয়ংকর কিছু। ধন্যবাদ আপনাকে।’

আমরা নেমে পড়লাম বাস থেকে। দুরু দুরু মন নিয়ে ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে চললাম তার পিছু পিছু। আমার ফোনে আবারো কল এলো মামার থেকে। রিসিভ করতেই তিনি বলে উঠলেন,

‘সর্বোনাশ হয়েছে তোর বাপ বারোজন পুলিশ সমেত পরবর্তী স্টপে অপেক্ষা করছেন। কি স্বৈরাচারী বাপ তোর! কোথায় আছিস?’

আমি ক্লান্ত গলাম জবাব দিলাম,

‘কোথায় আছি ঠিক বলতে পারছি না। বাস থেকে নেমে পড়েছি।’

‘পাশের সে খারুজ ব্যক্তি কোথায়? তাকে নিয়ে নেমেছিস?’

‘হুহ।’

‘গুড জব। ফোনটা তার কাছে দে তো। ব্যাটাকে একটু ঘাটিয়ে দেখি।’

আমি কোনো কথা ছাড়াই তার দিকে ফোন এগিয়ে দিলাম। তিনি ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। বললাম,

‘মামা কথা বলবে।’

তিনি আমার হাত থেকে ফোন নিয়ে সুন্দর করে সালাম দিলেন। মামার সাথে তার অনেক্ষণ কথা হলো। আমি পুরোটা সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কল কাটতেই তিনি বলে উঠলেন,

‘আপনার মামা বেশ মজার মানুষ। আপনায় নিয়ে ভদ্রলোক প্রচন্ড চিন্তায় ভুগছেন।’

আমি তার এ কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলাম না। তাকে উল্টো প্রশ্ন করলাম,

‘এখন আমরা কোথায় যাব?’

‘কোনো নাস্তার হোটেলে। আপনি সকাল থেকে না খেয়ে আছেন নাকি? আজ অনেক জার্নি হবে। না খেয়ে জার্নি করাটা ঠিক হবে না। অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’

আমরা পাশের এক নাস্তার হোটেলে গেলাম। পরোটা শেষ হয়ে গেছে। ডিম সিদ্ধ আর সিঙ্গারা অর্ডার করা হলো। খাবার আসতে দু মিনিট দেরী হবে। সিঙ্গারা ভাজার জন্য কেবল তেলে দেওয়া হয়েছে। আমি সেদিকেই তকিয়ে আছি। ঘ্রাণে ক্ষুদা বেড়ে গেছে। তিনি বললেন,

‘আপনি বেশ অদ্ভূত! আমার সাথে এতটা পথ যাওয়ার প্লান করেছেন কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার পরিচয় দূরে থাক নামটাও জানতে চাইলেন না। আপনি কি একটুও ভয় পাচ্ছেন না?’

চলবে……….