প্রাণসখা পর্ব-০৩

0
3

#প্রাণসখা
#লাবিবা_আল_তাসফি

৩.
আমি স্বভাবত খুবই সন্দেহপ্রবণ। টুপ করে কাউকে পছন্দ করে ফেলার মতো না। কাউকে পুরোপুরি ভাবে বিশ্বাস করতে লম্বা সময়ের প্রয়োজন হয়। সেখানে সকালে দেখা হয়ে যাওয়া একটা ছেলেকে বিশ্বাস করার প্রশ্নই আসে না। তবে তাকে খুব একটা অবিশ্বাস ও করতে চাচ্ছি না। এতটুকু সময়ে তাটে যতটুকু বুঝেছি সে বেশ প্রাণোচ্ছল স্বভাবের। মানুষের সাথে মিশে যেতে পারে মুহূর্তের মাঝে। এ ধরণের মানুষেরা বিপদে জড়িয়ে পড়ে বেশি। কারণ তারা সহজেই সবাইকে বিশ্বাস করে নেয়। আমিও তো তার কাছে অজানা। তবুও কেন সে সাহায্য করতে চাইলো? কারণ সে বোকা। ভিষণ বোকা। এমনও তো হতে পারতো আমি তাকে অপহরণ করে মোটা অংকের অর্থ দাবি করলাম!
আমি তপ্ত শ্বাস ফেললাম। তার দিকে সোজা চোখে তাকিয়ে বললাম,

‘আমি আপনায় বিশ্বাস করিনি। আমি কেবল আপনার উপর ভরসা রেখেছি। আপনি আমার ভরসা রাখতে না পারলে তা আমাকে কোনোভাবেই ক্ষতি করতে পারবে না।’

তিনি হাসলেন। নিঃশব্দে গা কাঁপিয়ে হাসি। আমি অপলক তাকিয়ে রইলাম। কি ভিষণ সুন্দর লাগছে! কোনো সিনেমার নায়ক কিংবা রাজকুমারের মতো সৌন্দর্য নেই তার কিন্তু তবুও অপরূপ। যেন কোন উপন্যাসের পাতা থেকে উঠে আসা শুদ্ধ মানব। আমার সত্যিই তার নাম জানতে ইচ্ছে হলো। এই অদ্ভূত সুন্দর মানুষটার নামটাও নিশ্চয়ই অদ্ভূত হবে!
খাবার চলে এসেছে। আমি পরোটা ছিঁড়ে মুখে না দিয়ে তার দিকে তাকালাম। জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললাম,

‘আপনার নাম?’

তিনি মাথা উঁচু করে ভ্রু বাঁকালেন। আমি নড়েচড়ে পুনরায় বললাম,

‘আপনার নাম জানতে চাচ্ছি।’

ভেবেছিলাম এ বিষয়ে সে মজা উড়াবে। হয়তো আবারো গা দুলিয়ে হাসবে। কিন্তু তেমন কিছু না কের বেশ স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দিলো,

‘স্বচ্ছ।’

আমি হেসে বললাম,

‘ইউ মিন পরিস্কার! এটাই আপনার নাম?’

তিনি মুচকি হাসলেন। খাবার চিবুতে চিবুতে বললেন,

‘কেন আমার নামটা আপনার পছন্দ হয়নি? পছন্দ না হলে আপনি একটা নাম দিতে পারেন।’

‘পছন্দ কেন হবে না? নামটা একদম আপনি টাইপ। বরং আপনার নাম এটা না হয়ে অন্যকিছু হলে বেমানান লাগতো।’

তিনি পুনরায় হাসলেন তবে জবাব দিলেন না। খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা অটোয় চেপে রেল স্টেশনে গেলাম। জীবনের প্রথম রেল যাত্রা হতে চলেছে আমার। আইডিয়াটা স্বচ্ছর। রেল মাঝ রাস্তায় থামিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আমার বাবার নেই। তাই এটা আপাতত সেইফ বলা চলে। স্বচ্ছ পুরো একটা কেবিন বুক করতে চাইলেন কিন্তু আমি বাঁধা দিলাম। অচেনা একটা ছেলের সাথে কেবিনে একা যাওয়াটা আপাতত দৃষ্টিতে খারাপ বলে মনে হলো। নরমাল দুটো টিকিট কাটা হলো। রাজশাহী পৌঁছাতে প্রায় ছয় ঘন্টার মতো লাগবে। দীর্ঘ জার্নি।

ছোটবেলায় ট্রেন কবিতায় পড়েছিলাম ট্রেন ঝকঝকাঝক শব্দে চলে। আজ তা নিজ থেকে উপলব্ধি করলাম। কি ভিষণ শব্দ! মাথা ধরে আসে। তবুও ভালো লাগছে। ট্রেনের জানালা থেকে পুরো আকাশটাকে দেখা যাচ্ছে। নীলচে আকাশে গাঙচিল উড়ে বেড়াচ্ছে। কিছু ছেলেমেয়ে আকাশের বুকে ঘুড়ি ওড়ানোর চেষ্টা করছে। পর্যাপ্ত বাতাস না থাকায় তা উপরে উঠছে না। রেল লাইনের পাশ ঘেঁষে বিশাল মাঠ। ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। বাচ্চা গুলোর পড়নের জামা ধুলা মাটিতে একাকার। এমন জীবন আমি কখনো উপলব্ধি করতে পারি নি। ছোট থেকেই বেড়ে ওঠা চার দেয়ালের মাঝে। নানা নিয়ম কানুনে ঘেরা এক পরিবেশে। রোজ বিকেলে ছাদে ওঠার সুযোগ হতো। নিজেকে তখন মুক্ত পাখির ন্যায় মনে হতো। তখন থেকেই আকাশটা ভিষণ প্রিয় হয়ে উঠেছে। এই নীলচে আকাশের প্রতি আমার প্রেম বোধহয় বিশ বছর ছাড়ালো!

‘কিছু খাবেন? দুপুরে তো কিছু খাওয়া হয়নি। ক্ষুধা লেগেছে নিশ্চই?’

কথাটা আমাকে জিজ্ঞেস করলেও আমি উত্তর দেওয়ার পূর্বেই সে ব্যাগ থেকে একটা পাওরুটির প্যাকেট বের করে দিলো আমার হাতে। আশপাশে তাকিয়ে বললো,

‘এখানে চা পাওয়া যায়। ফ্লাক্সে করে বিক্রি করে। খাবেন?’

এবারো সে আমার উত্তরের অপেক্ষা করলো না। সিট থেকে বের হয়ে চা আনতে চলে গেলো। আমি সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। না চাইতেও মানুষটাকে বেশ ভালো লেগে যাচ্ছে।

____________

আমরা যখন রাজশাহী পৌঁছালাম তখন ঘড়িতে বেজে সন্ধ্যা সাতটা। দীর্ঘ এই জার্নিতে কোমর যেন বেঁকে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে বেগ পেতে হলো। স্বচ্ছ আমাকে এগিয়ে দিতে চাইলো কিন্তু আমি মানা করে দিলাম। একটা মানুষের থেকে আর কত সাহায্য নেওয়া যায়? বরং তার থেকে সাহায্য নিতে বেশ লজ্জা লাগবে আমার। এরমাঝে স্বচ্ছর বাড়ি থেকে কল এলো। তার তো বাড়িতে দুপুরের দিকে পৌঁছে যাওয়ার কথা। আমারৎজন্য এতটা দেরী হয়ে গেলো। পরিবারের লোকেরা নিশ্চই চিন্তা করছে? আমার মন খারাপ হয়ে এলো। দেখলাম সে কপালে ভাঁজ ফেলে ফোনে কথা বলছে। সিরিয়াস কিছু কি?

স্বচ্ছ কথা শেষ করে এসে বেশ স্বাভাবিক ভাবেই জানালো,

‘আমাকে এখন যেতে হবে মিস। দুঃখিত আপনায় হয়তো বাকিটা এককেই ম্যানেজ করতে হবে। সাবধানে থাকবেন।’

আমার হয়তো মন খাযাপ হলো সামান্য। কিন্তু তাতে পাত্তা দিলাম না। হেসে বললাম,

‘আপনাকে ধন্যবাদ। বাকিটা আমি একাই যেতে পারবো। আপনি যেতে পারেন।’

স্বচ্ছ চলে গেল। আমি ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। আন্টির বাসা আমি চিনিনা। রাজশাহীতে আমি পড়াশোনার জন্য থাকলেও হল থেকে বেরিয়ে কখনো কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। কাজেই এ শহরের কিছুই আমার চেনা নেই।

আমি আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। খানিক ভাবনা চিন্তা করে অটো ঠিক করলাম। মামা আমায় যে ঠিকানা দিয়েছিল সেটা মনে পড়তেই নিজেকে হাল্কা লাগলো। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হওয়ায় একাএকা যাতায়াত করার সৌভাগ্য হয়নি কখনো আমার। আজ এতটা পথ পরিবারকে না জানিয়ে এসে এখন খানিকটা ভীতি অনুভব করলাম। একা চলাটা কতটা কঠিন আমার জন্য ভাবতেই বুক শুকিয়ে আসছে। অটো ভাড়া নিলো দুশো টাকা। এতটুকু পথে এতোটা ভাড়া!
যে বিল্ডিং এর সামনে অটো থেমেছে তা মূলত পাঁচ তলা বিশিষ্ট। এর তৃতীয় তলায় আন্টি থাকেন। এমনটাই জানিয়েছে মামা। মামার সংবাদ কখনো ভুল হয় না। সত্যিই ভূল হলো না। আন্টি আমায় দেখে ভিষণ অবাক হয়েছেন। সাথে খুশিও। আমার এক সপ্তাহ থাকার জায়গা বেড়ে একমাসে ঠেকলো। মাঝে মামা কল করেছিলো দুবার। জানিয়েছে বাবা তার উপর থেকে মামলা তুলে নিয়েছে। সেই খুশিতে সে সামনের সপ্তাহে শ্রীমঙ্গল যাচ্ছে। মামা অল্প কিছু টাকাও পাঠিয়েছে আমার হাত খরচের জন্য।
এই এক সপ্তাহ আমি পুরো ঘরে বসেই কাটালাম। আন্টি আমায় এখন পর্যন্ত এভাবে তার বাড়িতে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করেননি। বরং আমি আসায় জেন তার উপকার হয়েছে। সে প্রাণ খুলে গল্প করতে পারে। তার হাতের নতুন নতুন রেসিপি খাইয়ে তার ফিডব্যাক নিতে পারে। আমার সময় ও বেশ চলছে এভাবে। এর মাঝে স্বচ্ছ নামক মানুষটিকে ভুলে বসলাম আমি। ভুলে বসলাম তার ঝাঁকড়া চুলের সৌন্দর্যের কথা। চশমার আড়ালে থাকা তীক্ষ্ণ এক জোড়া চোখকে ভুলে বসলাম আমি। এতটা স্বার্থপর আমি!

তার সাথে আমার দেখা হলো এক বিকেলে অনাকাঙ্খিত ভাবে। আন্টি সেদিন অনেক কাপড় কেচেছেন। কাপড় শুকাতে দেওয়া হয়েছে ছাদে। আন্টির হাঁটুতে সমস্যা রয়েছে। খুব বেশি সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠা নামা করতে পারেন না। তখন বিকেল পড়েছে। সোনালী সূর্য ডুবে নরম আলো ছড়িয়ে পড়েছে। আন্টি আমায় বললেন ছাদ থেকে কাপড় গুলো এনে দেওয়ার জন্য। এর পূর্বে আমি কখনো আন্টিদের ছাদে উঠিনি। বাসা থেকে বের হইনি বললেই চলে। ছাদটা বেশ সুন্দর ও পরিপাটি। বিভিন্ন ফুলগাছ দিয়ে সাজানো। অর্কিড জাতীয় ফুল সংখ্যা বেশি। যে ব্যক্তির গাছ তিনি বেশ রুচিশীল হবে। আমি ছাদে দাঁড়িয়ে রইলাম অনেকক্ষন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। যখন দিনের আলো মিলিয়ে যেতে শুরু করলো তখন কাপড় নিয়ে নিচে নামতে যেয়ে আবিষ্কার করলাম স্বচ্ছকে। সেই ঝাঁকড়া চুল আর তীক্ষ্ণ এক জোড়া চোখকে। আমি স্তব্ধ হলাম। থমকে যাওয়া দৃষ্টিতে তাকে দেখলাম। এটা ভ্রম নয়! সত্যি!

চলবে……

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন)