#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২১।
মনোহর নদীর উত্তর পাড়ে রয়েছে এক বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছ। গাছটি ভরে আছে কৃষ্ণচূড়া ফুলে। দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন, এক টুকরো রক্তের খ’ন্ড সেটা। তনুকা সেদিকেই তাকিয়ে আছে। মেহতাব তার পাশেই। এক পল পরে তনুকা মনোযোগ ভেঙে মেহতাবকে দেখে। বলে,
‘আমাকে একদিন নদীর ওপারে নিয়ে যাবেন?’
‘কেন? ওপারে কী?’
‘ঐ যে কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখে সামনে থেকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।’
কিঞ্চিৎ হেসে মেহতাব বলে,
‘ঠিক আছে, নিয়ে যাব।’
তনুকা খুশি হয়। আবার তাকায় সামনের দিকে। মনোহর নদীতে শান্ত স্রোত। বিকেলের ডুবন্ত সূর্যের আলো ঝলমল করছে সেখানে। একপাশটা সোনালী লাগছে তাই। মেহতাব তখন বলে,
‘জানো, এই সুন্দর চমৎকার নদীটা মানুষের সব কলুষিত কাজের স্বাক্ষী।’
তনুকা চকিতে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,
‘কীভাবে?’
‘এই নদী থেকে বেশ কয়েকটা লা’শ উদ্ধার করেছে পুলিশ। যাদের খুব কুৎসিত ভাবে খু’ন করা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো খুনীকে আজও ধরা যায়নি।’
‘খুনী বোধ হয় খুব চালাক ব্যক্তি। প্রমাণ রাখে না কোনো।’
মেহতাব হাসে। বলে,
‘কতদিন আর চালাকি করবে? ধরা তো একদিন না একদিন তাকে পড়তেই হবে।’
‘তা অবশ্য ঠিক। অন্যায়কারী বেশিদিন টিকতে পারে না, কোনো না কোনো ভাবে ধরা ঠিকই পড়ে যায়।’
মেহতাব জবাবে আর কিছু বলে না। ঘাটের দুদিকে দুজন বসা। দৃষ্টি দুজনেরই নদীর স্রোতে। তনুকা হঠাৎ বলে,
‘অনেকক্ষণ যাবত রেনুকে দেখছি না, ও কোথায়?’
‘আছে হয়তো আশেপাশে। ওকে নিয়ে চিন্তা করো না, ওর এসব জায়গা মুখস্থ।’
আরেকটু সময় নীরবে অতিবাহিত হবার পর মেহতাবের ফোনে কল আসে। তনুকা চেয়ে বলে,
‘আপনি কথা বলুন, আমি বরং রেনুকে খুঁজে নিয়ে আসি।’
মেহতাব ফোন বের করতে করতে বলে,
‘দূরে কোথাও যেও না কিন্তু।’
‘না, যাব না।’
তনুকা উঠে আসে। রেনুকে আশেপাশে পায় না সে। হাঁটতে হাঁটতে সামনে আসে বেশ কয়েক পা। এখানে বেশ কিছু গাছ সারিবদ্ধ ভাবে লাগান। এক গাছের আড়ালে রেনুর সবুজ রঙের স্কুল ড্রেসটা দেখা যাচ্ছে। তনুকা তাকে ডাকতে নিয়ে আচমকা থেমে যায়। মনে হয়, রেনু একা নয়, পাশে আরো একজন আছে। তাই আঁড়াল হয়ে দাঁড়ায় সে। কিন্তু অপর পাশের ব্যাক্তির মুখটা গাছের জন্য দেখতে সক্ষম হয় না। তনুকা ভাবে, সরাসরি গিয়ে চমকে দিবে। তবে সে গাছের আঁড়াল থেকে বের হবার আগেই সামনে থেকে রেনু উধাও। ভড়কে যায় তনুকা। এই ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে মেয়েটা উধাও হয়ে গেল কী করে? তনুকা খুঁজতে আরম্ভ করে তবে, এইদিকে পায়না কোথায়। তনুকা ফিরে আসতে নিলেই পুনরায় রেনুকে দেখে, গাছের সাথে হেলান দিয়ে বিস্কুট খাচ্ছে। অকস্মাৎ তাকে দেখে ফের চমকায় তনুকা। জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি হঠাৎ উধাও হয়ে গেলে কী করে?’
রেনু হাসে। বলে,
‘আমি উধাও হব কেন? আমি তো এখানেই ছিলাম, তুমি এতক্ষণ কী খুঁজছিলি বলোতো?’
‘তোমাকেই খুঁজছিলাম। কোথায় ছিলে তুমি?’
‘কিছুটা সামনে একটা দোকান আছে, সেখানেই গিয়েছিলাম। এই যে এই চিপস বিস্কুট কিনতে।’
তনুকা তার হাতে দেখে একটা বড়ো শুকনো খাবারের প্যাকেট। কিন্তু তাও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না সে। তবে কি তখন ভুল দেখেছিল? ঐটা রেনু ছিল না? না, ড্রেসটা তো স্কুল ড্রেস’ই ছিল। আর ঐ লোকটার পোশাক…অল্প ভেবেই তনুকার মনে এল, ঐ লোকটার পোশাক তো ইশফাকের মতো ছিল। কালো রঙের পাঞ্জাবী। এত বড়ো ভুল নিশ্চয়ই তার হবে না। মেয়েটা মিথ্যে বলছে তাকে, কিছু লুকাতে চাইছে।
তাও তনুকা আর ঘাটাল না। বলল,
‘চলো, তোমার ভাইজান বাসায় ফিরবেন বললেন।’
‘ওমা, গ্রাম পর্যবেক্ষণ শেষ?’
‘হ্যাঁ, উনি তো তাই বললেন।’
______
ঘোড়ার গাড়ি চড়ে মহলে ফিরে সবাই। তনুকার যদিও আরেকটু ঘোরার শখ ছিল তবে, মেহতাব জানায় তাদের নামিয়ে দিয়ে তাকে না কি আবার কোন জরুরি কাজে বেরুতে হবে। সেজন্য তনুকাও আর দ্বিমত করেনি।
সন্ধ্যার নামাজ শেষ করে ঊর্মি তনুকার কক্ষে আসেন। দরজায় টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করেন,
‘আসব?’
তনুকা গলার স্বর ধরতে পেরে বলে,
‘হ্যাঁ, আসুন।’
ঊর্মি ভেতরে প্রবেশ করেন। তনুকা শুয়ে ছিল। তাকে দেখে উঠে বসে। বলে,
‘বসুন না।’
তিনি তনুকার পাশে বসলেন। তনুকার মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘এখানে তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো, মা?’
তনুকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,
‘অসুবিধা হলে কি চলে যেতে পারব? পারব না তো। সুবিধা অসুবিধা নিয়েই থাকতে হবে, তাই এতকিছু ধরে লাভ নেই।’
ঊর্মি হতাশ চোখে চাইলেন। বললেন,
‘মেহতাব কি যত্ন করছে না তোমার?’
তনুকার হেসে বলে,
‘উনার চেয়ে ভালো এই বাড়ির কেউই আমাকে বাসেন না বোধ হয়।’
‘এভাবে বলছো কেন, মা? আমরাও তো তোমায় ভালোবাসি।’
তনুকা জোরে নিশ্বাস ফেলে। বলে,
‘যাক, এইটুকু শুনে ভালো লাগল।’
ঊর্মি এরপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন,
‘একটা কথা বলব?’
‘না।’
তনুকার কাছ থেকে সরাসরি নাকচ শুনে মনঃক্ষুন্ন হয় ঊর্মির। তনুকা বলে উঠে,
‘আপনার কোনো কথা শুনতে এই মুহুর্তে ইচ্ছে করছে না।’
ঊর্মি দুঃখী চিত্তে উঠে দাঁড়ান। আর কিছু বলার ইচ্ছে হয়না তাঁর। ঘরে থেকে বেরিয়ে আসেন। তারপর রান্নাঘরে চলে যান সকলের জন্য চা বানাতে।
________
‘তুমি এখানে বসে বসে খালি ঠোঁটে রং ঘঁষো। আর ঐদিকে এইটুকু একটা মেয়ে আমাদের সবার নাকে দড়ি দিয়ে এই জমিদারী নিয়ে যাচ্ছে বলে।’
রাহীলা কপাল কুঁচকালেন। হাতের লিপস্টিকটা শব্দ করে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে বলে উঠলেন,
‘তো এখন আমি কী করব? তুমি নিজেও তো তোমার ভাতিজার মুখের উপর কিছু বলতে পারো না, আবার এসেছো আমাকে বলতে।’
‘দেখো, এমনিতেই মাথা গরম। এসব উল্টা পাল্টা কথা বলে আর মাথা গরম করো না। তুমি কী বোঝবে আমার কষ্ট! আমি যে তলে তলে কী করছি তা কেবল আমি জানি।’
রাহীলা ঘুরে বসলেন। অধিক আগ্রহ সমেত বললেন,
‘এই এই, কী করছো তুমি?’
‘বাঘের কাছ থেকে বাঘিনীকে সরিয়ে নিলে বাঘ এমনিতেই দূর্বল হয়ে যাবে। তখন শত্রুপক্ষের সাথে লড়াই করার ক্ষমতা আর থাকবে না। আপাতত আমি সেই ব্যবস্থাই করছি।’
রাহীলা বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বললেন,
‘শুনো, সাবধানে করবে সব। বাঘ কিন্তু শেয়ালের চেয়েও ধূর্ত।’
মতিব মজুমদার দাঁত বের করে হাসলেন। বিশ্রী দেখাল সেই হাসি। তবে রাহীলার চোখে তাই যেন স্বর্গ সুখ। তিনি বললেন,
‘ভয় নেই। এবার আটঘাঁট বেঁধেই নেমেছি।’
___________
‘এই ছুড়িতে ধার নেই কেন? ধার করে রাখোনি?’
‘জি, সকালেও তো ধার ছিল। এখন কী হলো, বুঝতে পারছি না।’
ছুড়িটা দূরে ফেলে সে বলল,
‘বাদ দাও, চাপাতি’টা নিয়ে এসো।’
তার কথা মতো চাপাতি হাজির করা হলো। চাপাতি হাতে তুলে হাসল সে। দায়ের আগায় আঙ্গুল টেনে ধার পরীক্ষা করে বলল,
‘বাহ, এতে বেশ ধার।’
অতঃপর সে প্রথম কো’প বসাল হাতের কব্জি বরাবর। সঙ্গে সঙ্গেই কব্জি খুলে হাত আলাদা হয়ে এল। তারপরের কো’পটা বসাল কনুই বরাবর। ঐটুকু অংশও আলাদা হতে সময় নিল না। র’ক্তের স্রোতে টেবিল ভেসে যাচ্ছে যেন। টপটপ করে শব্দ হচ্ছে নিচে পড়ন্ত র’ক্তের। লোকটার পরনে সাদা পরিচ্চদ-রক্ষক বহিরাবরণটা র’ক্তে রক্তিম হয়ে ওঠল। হাত ভিজে গেল তাজা লাল র’ক্তে। চোখে মুখেও বিন্দু বিন্দু তারই অস্তিত্ব। একটা শরীরের অনেকগুলো টুকরো যত্ন করে একটা পলিথিনে ঢুকানো হলো। তারপর সামনে চেয়ে লোকটি হেসে বলল,
‘ফ্রিজে রেখে দাও তো।’
কথা মতো পলিথিনগুলো সব ফ্রিজে রাখা হলো। কাজ শেষে গা থেকে পরিচ্চদ-রক্ষক বহিরাবরণটা খুলে ফেলল সে। বিরক্ত গলায় বলল,
‘গোসল করতে হবে। গিজারটা অন করে এসো।’
চলবে…..
#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২২।
মেহতাব অন্দরে প্রবেশ করে দেখল, তনুকা বসার ঘরেই বসে আছে। তার পাশেই বসা রেনু। গল্প জুড়েছে দুজন। মেহতাব ব্যস্ত ভঙিতে সিঁড়িতে পা রেখে বলে,
‘বিবিজান, এক কাপ গরম চা নিয়ে এসো তো, মাথা ধরেছে খুব।’
তনুকা বলল,
‘আচ্ছা আপনি যান, আমি আনছি।’
মেহতাব ছোট পায়ে হেঁটে উপরে নিজের কক্ষে গেল। তনুকা উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘তুমি বরং এখন পড়তে যাও, আমি চা বানিয়ে তোমার ভাইজানকে দিয়ে আসি।’
রেনু মাথা কাঁত করে বলল,
‘আচ্ছা।’
রেনু নিজের কক্ষের দিকে গেল। আর তনুকা গেল রান্নাঘরের দিকে। কড়া লিকারে দুই কাপ চা বানাল। অতঃপর নিয়ে গেল নিজ কক্ষে।
মেহতাব বিছানায় শোয়া। এক হাত ঠেকানো কপালে। চোখের পাতা নিমীলিত। তাকে দেখে ক্লান্ত মনে হচ্ছে। তনুকা চায়ের কাপ রেখে আস্তে করে ডাকে,
‘শুনছেন, চা নিয়ে এসেছি।’
মেহতাব কপাল থেকে হাত সরায়। তার দিকে চেয়ে বলে,
‘রাখো।’
তনুকা খাটের সাথে লাগানো টেবিলে চায়ের কাপ দুটো রাখে। মেহতাবের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?’
মেহতাব উঠে বসে। চোখ মুখ থমথমে তার। গম্ভীর সুরে বলে,
‘না, মন খারাপ লাগছে।’
‘কেন?’
‘ঘরের শত্রু যদি বিভীষণ হয়, তবে মন আর কী করে ভালো থাকবে বলো?’
তনুকা বিস্মিত হয়। জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে, বলুন আমায়। আবার কেউ কিছু করেছে?’
মেহতাব কিঞ্চিৎ হাসে। বলে,
‘চেষ্টা করেছিল কিন্তু, মেহতাব মজুমদারকে হারানো এতটাও সহজ নয়।’
তনুকা অবাক চোখে চেয়ে থাকে। সহজ মানুষটাকে বড্ড জটিল মনে হয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। বলে,
‘চা’টা খান, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
তনুকার কথা শুনে মেহতাব চায়ের কাপে চুমুক বসায়। অশান্ত অন্তর তৃপ্ত হয় তার। বলে,
‘চা খুব দারুণ বানাও তুমি।’
‘আমি অনেক রকমের চা পারি। আপনাকে একদিন আমার হাতের সবথেকে স্পেশাল চা’টা করে খাওয়াব।’
মেহতাব অতি উৎসাহ সমেত বলে,
‘কবে?’
‘কোনো এক স্পেশাল দিনে।’
‘ঠিক আছে, অপেক্ষায় রইলাম তবে।’
কাপের চা প্রায় শেষের দিকে। নীরবে চা পান করেছে দুজন। এত কাছাকাছি থেকেও এই নীরবতা মেহতাবের নিকট অসহ্যকর। তাও সহ্য করতে হয়, তনুকাকে যে সে কষ্ট দিতে চায় না।
তনুকা পুরো চা শেষ করে একটু রয়েসয়ে বলে,
‘আপনার যে এত বিশাল একটা লাইব্রেরী আছে, আগে বলেননি তো।’
মেহতাব তাকায়। জিজ্ঞেস করে,
‘তো এখন কে বলল?’
‘রেনু বলেছে। নিয়েও গিয়েছিল। তিন তালার পুরোটা লাইব্রেরী। এত বই পড়েন আপনি?’
মেহতাব হেসে বলে,
‘শুধু আমি না, রেনু বাদে আমি, মা, বাবা আর রাদাভ আমরা সকলেই খুব বই পড়তে পছন্দ করি। যদিও আরেকজনও
আছে আমাদের দলে। আগে বই পড়তাম খুব, এখন ব্যস্ততার কারণে আর পড়া হয় না।’
‘একটা কথা বলব?’
‘বলো।’
‘আপনার লাইব্রেরীতে এত বই থাকতে মা ঐসব খু’ন-খারাবি নিয়ে বই কেন পড়েন?’
‘সেটা উনার ব্যক্তিগত পছন্দ। এই ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই।’
তনুকার আর কথা না বাড়িয়ে ছোট্ট করে বলল,
‘ওহহ।’
তারপর ফের কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে মেহতাব বলল,
‘সামনের শুক্রবার একটা আয়োজন করব ভাবছি।’
‘কীসের?’
‘তোমার আমার বিয়ের রিসিপশন তো এখনো হয়নি। সেটাই করব।’
‘বাবা তো এখন নেই এখানে।’
‘সমস্যা নেই। গ্রামের মানুষদের খাওয়ানো হবে। তোমার বাবা আসলে না হয় পরে উনাকে আলাদা ভাবে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো যাবে। এখন আপাতত এই রিসিপশনটা করে ফেলি, গ্রামের মানুষেরা তোমাকে দেখার জন্য উতলা হয়ে ওঠেছেন।’
তনুকা জবাবে ধীর গলায় বলল,
‘ঠিক আছে, আপনার যেভাবে সুবিধা মনে হয়।’
মেহতাব খুশি হয়ে বলে,
‘আমার লক্ষী বিবিজান।’
_______
তনুকা রাতে কোনোভাবেই শ্বশুরকে খাবার খাওয়াতে পারেনি। তিনি খাবেন না মানে খাবেন’ই না। অনেক জোর করে দুই চামচ মুখে পুরা গেলেও আর পারেনি। তাই কোনোরকমে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে চলে এসেছে সে। ইদানিং এমন হচ্ছে, মানুষটা খেতেই যাচ্ছে না কিছু। এমন করলে তো তাঁকে আর সুস্থ করা যাবে না। মেহতাব আর শাশুড়িকে জানিয়েছে এই কথা। অথচ উনারা এমন একটা ব্যবহার করছেন যেন, এটা কিছুই না। তনুকা তাই ঠিক করে, তার নিজের পরিচিত ডাক্তারকে আনবে। তনুকার জোরাজুরিতে রাজি হতে হলো মেহতাবকেও। ডাক্তার আসবেন তাদের রিসিপশনের পর থেকেই।
________
আজ বুধবার। আগামী পরশু’ই শুক্রবার। রিসিপশনের কথা বাড়ির সকলে জানে। রেনু আগ্রহ দেখাচ্ছে একটু বেশিই। তার এখন না কি আবার নতুন জামা জুতাও লাগবে। মা’কে বলেছে এই কথা; মা টাকা দিয়ে বলেছেন, কোনো এক কাকীর সাথে গিয়ে কিনে নিয়ে আসতে। কিন্তু দস্যি মেয়ে কি আর কথা শোনার পাত্রী! সে কাউকেই সাথে নিবে না। নাচতে নাচতে গিয়ে দাঁড়াল বিচার মহলের পেছনের কক্ষের সামনে। গলা ছেড়ে ডাকল,
‘ইশফাক, ইশফাকুর রহমান, শুনছেন?’
সাড়া নেই কোনো। রেনু ফের ডাকে,
‘ইশফাক, আমি ডাকছি আপনাকে। আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?’
তাও রা হীন নীরব পরিবেশ। রেনু এবার বিরক্ত হলো। বলল,
‘আপনি বের হয়ে না আসলে আমি কিন্তু এবার ভেতরে চলে আসব।’
ভেতরের মানুষটি তার এহেন হুমকিতে কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভয়ও পেল না বোধ হয়। তাই দেখা মেলল না তার। রেনু নিজের কথা রাখল, আদ্যোপান্ত না ভেবেই ঢুকে পড়ল সেই কক্ষে। কক্ষ খালি। বদ লোকটা কোথায় কে জানে? রেনু আরাম করে তার বিছানায় বসল। গোসলখানা থেকে আওয়াজ আসছে, সে নিশ্চয়ই সেখানে। কিছুক্ষণ বসল রেনু। হুট করেই শব্দ করে গোসলখানার দরজাটা খুলল, বেরিয়ে এল তার কাঙ্খিত পুরুষ। আচমকা তাকে দেখে স্তব্ধ হলো রেনু। উদম গায়ে আধভেজা শরীরের পুরুষকে দেখে কিশোরী মন উদাসীন হয়ে পড়ল। ঢোক গিলে উঠে দাঁড়াল। তাকে দেখা মাত্রই বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে নিল ইশফাক। চট করে গায়ে গামছা জড়িয়ে বলল,
‘অনুমতি ছাড়া আপনি আমার রুমে কেন এলেন?’
রেনু ভড়কে যায়। অস্বস্তিতে পড়ে ভীষণ। আমতা আমতা করে বলে,
‘ন-না মানে ডাকছিলাম আপনাকে, শুনেননি বলে ভেতরে চলে এসেছি।’
‘আপনি তো দেখছি আমার জীবন নেওয়া না অবধি ক্ষান্ত হবেন না।’
কথা বলতে বলতে ইশফাক আলমারি খুলে একটা পাঞ্জাবী বের করল। রেনু নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে। ইশফাক তার দিকে ফিরে বলল,
‘আমার জামা পাল্টানোটাও কি দেখতে চান?’
রেনু চকিতে তাকায়। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘ছি, কী বলছেন! আমি বাইরে অপেক্ষা করছি, আপনি দ্রুত জামা পরে বাইরে আসুন।’
রেনু বের হয়ে গেল। বাইরে এসে বুকে হাত দিতেই মনে হলো, হৃদকম্পন কয়েক মুহূর্তের ভেতরে যেন দ্বিগুণ হয়ে ওঠেছে। দৃষ্টিপটে ইশফাকের উদম বক্ষঃস্থল ভেসে উঠতেই লজ্জায় আরক্ত হয়ে ওঠল সে। মনে মনে কিছু বেহায়া চিন্তা ভাবনা করে বসল। নিজের চিন্তায় নিজেই লজ্জায় কুন্ঠিত হলো, এভাবে ফের ভাবল, ফের লজ্জা পেল।
ইশফাক বাইরে এসে দাঁড়ায়। রেনুকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে সামনে পা বাড়াতেই ক্ষিপ্ত হয় রেনু। কোমরে হাত দিয়ে বলে উঠে,
‘এই যে, কোথায় যাচ্ছেন?’
‘কাজ আছে আমার।’
‘এই মুহূর্তে আপনার অন্য কোনো কাজ করা নিষেধ। আম্মাজানের হুকুম, আমাকে নিয়ে আপনি এখন মার্কেটে যাবেন; ভাইজানের রিসিপশনের জন্য জামা কিনব আমি।’
ইশফাক ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলে,
‘আশ্চর্য, আমি কেন?’
‘তো, আর কে যাবে? আম্মাজানের হুকুম, অগ্রাহ্য করবেন না নিশ্চয়ই।’
ইশফাক সরু চোখে তাকায়। মেয়েটাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। রেনু তাড়া দিয়ে বলে,
‘আরে চলুন না। তাড়াতাড়ি গেলে তাড়াতাড়িই ফেরা যাবে।’
‘আপনি কি আমার সাথে একা যাবেন?’
রেনু দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,
‘জি জি।’
ইশফাকের মুখটা ছোট হয়। এই মেয়েকে একা সামলাবে কী করে? সারাক্ষণ যা চোটপাট করে। আজকে তার সাথে একা গেলে যে আবার কী কী করে বসে, কে জানে।
চলবে….