#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৯।
দুই সপ্তাহ অতিবাহিত হলো অশ্বগতিতে। এই দুই সপ্তাহের মাঝে বেশ কয়েকবার পুলিশ মেহতাবের মহলে এসেছে। সকলের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। করেছে অনেক তদন্তও। কিন্তু, এতসবের পরও ফলাফল বের হয়েছে শূণ্য। মোহন লাল মজুমদারের খু নের ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। পুলিশকে মেহতাব ঔষধও দেখিয়েছে, তাতেও কিছু পায়নি তারা। অনেক অনেক তদন্তের পরেও যখন তারা কিছু পায়নি, তখন তদন্তের প্রয়োজন সেখানেই সমাপ্ত করে এবং জানিয়ে দেয়, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু; কোনো খু ন নয়।
_______
‘এতকিছু করে লাভ কী হলো? সে’ই তো যেই লাউ সেই কদু।’
‘মেহতাব মজুমদারের পরিকল্পনা সব।’
‘তা আমি জানি। এখন বাকিটা তোমাকেই করতে হবে। জমিটা নিজের নামে করো তাড়াতাড়ি।’
‘মেহতাব মজুমদার কখনোই দিবেন না।’
‘সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকাতে হয়; আঙ্গুল বাঁকিয়ে যা করার করো। তাও তোমার চুপচাপ বসে থাকা আমি সহ্য করব না।’
মলিন স্বরে জবাব এল,
‘কী দরকার এই জমি-জমার, এই সম্পদের? আমরা পালিয়ে গিয়ে কি ভালো থাকতে পারতাম না?’
অপর পাশের ব্যক্তি হেসে বলে,
‘মেহতাব মজুমদার আমাদের পৃথিবীর ভূগর্ভ থেকে হলেও খুঁজে বের করতো।’
‘কিন্তু, এসব আর কতদিন?’
‘আর বেশি দিন নয়। কিছু খবর পেয়েছি আমি; সেগুলো যদি সত্যি হয় তবে, অতি শীঘ্রই মেহতাব মজুমদারের বিনাশ ঘনিয়ে আসছে।’
বিনাশ! মেহতাব মজুমদারের বিনাশ! কথাটা এতদিন অবধি মনে এক শান্তি দিলেও, আজ হঠাৎই মনঃস্তাপ হলো। ভাবল, সত্যিই কি সে মেহতাব মজুমদারের বিনাশ চায়? কেন মন আজ কঠোর হতে পারছে না। মনটা আবার দূর্বল হয়ে পড়েনি তো। হায় হায়, এমন হলে তো মহাবিপদ!
_______
মাথায় ওড়না টেনে মহলের বাইরে এসে দাঁড়ায় তনুকা। তার পাশেই রেনু। এখন সন্ধ্যা ঠিক সাতটা ত্রিশ। মহলে মেহতাব নেই। অন্যদিন তার সাথে ইশফাক গেলেও, আজ সে যায়নি। শরীর খারাপ তার। গা পোড়ানো জ্বর ওঠেছে। আর সেটা শোনার পর থেকেই অস্থির হয়ে উঠে রেনুর কিশোরী মন। কতক্ষণে ছুটে একবার ইশফাকের কাছে আসবে সেই চিন্তাতেই বিভোর ছিল সে। কিন্তু, মহলে এখন রাদাভ আর ছোট কাকাও রয়েছেন। তার উপর প্রহরীরা তো আছেই। এতসবের মাঝে উপায় না পেয়ে তনুকাকেই অনুরোধ করে বসে। ননদের বিগলিত সুরের এই অনুরোধ তনুকাও পরে আর ফেলতে পারেনি। তাই রাজি হয়ে যায়।
এই মুহূর্তে ইশফাকের ঘরের সম্মুখেই দাঁড়িয়ে আছে দুজন। রেনু ধীর সুরে ডাকে,
‘ইশফাক, ইশফাক, আছেন ভেতরে? আমি রেনু।’
দু মিনিটের মাঝেই দরজা খুলে যায় সটান। ইশফাককে দেখা যায় আরক্ত মুখে দোরের অভিমুখে। তার জ্বরাক্রান্ত বিধ্বস্ত মুখ দেখে বড্ড মায়া হলো রেনুর। চিন্তিত সুরে বলল,
‘জ্বর কমেনি এখনো?’
আচমকা দুজন রমণীর উপস্থিতি বক্ষঃস্থলে ভয়ের সঞ্চার করে ইশফাকের। সে আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
‘আপনারা এখানে? কেউ দেখে ফেললে ঝামেলা হবে।’
তনুকা বলল,
‘রেনুকে বুঝিয়ে পারছিলাম না, সে আপনার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেছে।’
ইশফাক রেনুর দিকে চাইল। সত্যিই মেয়েটাকে বিচলিত লাগছে ভীষণ। ইশফাক তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
‘চিন্তা করবেন না, রেনু। আমি ঠিক আছি। আপনারা মহলে ফিরে যান।’
রেনু বাঁধা দিয়ে বলল,
‘উঁহু, আমি আপনার সাথে কিছুক্ষণ থাকতে চাই।’
‘জেদ করবেন না, দয়া করে। বড়ো ভাইজান মহলে না থাকলেও ছোট ভাইজান আছেন, আমি কোনোপ্রকার ঝামেলা চাইছি না। মহলে যান।’
রেনু আমলে নিল না রুগ্ন ইশফাকের কথা। সে এগিয়ে এসে ইশফাকের গলা গাল স্পর্শ করে চকিত হয়ে বলল,
‘সে কি, আপনার শরীর তো দেখছি পুড়ে যাচ্ছে। কোনো ঔষধ খাননি?’
‘খেয়েছি। কিছুক্ষণ পর ঠিক হয়ে যাবে।’
‘এমনি এমনি ঠিক হয়ে যাবে? আপনার জল পট্টি প্রয়োজন।’
ইশফাক ঘনঘন নিশ্বাস ছাড়ছে। দাঁড়াতেও যেন কষ্ট হচ্ছে তার। সে ক্লান্ত সুরে বলে,
‘কিছুর প্রয়োজন নেই। আপনি যান, প্লিজ।’
রেনু তনুকার দিকে অসহায় চোখে চেয়ে বলল,
‘বউমনি, তুমি একটু বোঝাও না উনাকে। উনার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে যে।’
‘কিন্তু রেনু, তুমি কী করে জলপট্টি দিবে বলো? এখানে বেশিক্ষণ থাকাটা আমাদের জন্য ঠিক হবে না। একবার কারোর চোখে পড়লে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’
‘এখন কেউই এইদিকে আসবে না, বউমনি। কেবল দশ মিনিট, দশ মিনিট থেকেই চলে যাব।’
তনুকা মেয়েটার অস্থিরতা দেখে আর বারণ করতে পারল না। ইশফাক বিপদে পড়ল ভীষণ। মেয়েটা নাছরবান্দা, কোনোভাবেই ছাড়বে না। একপ্রকার জোর করেই সে ইশফাকের ঘরে ঢুকেছে। ইশফাকের অস্বস্তি হচ্ছে খুব। কিন্তু, রেনু এইদিকে নির্লিপ্ত। সে মগে করে পানি এনে রুমাল ভিজিয়ে ইশফাকের কপালে চেপে ধরে। ইশফাক হতভম্ব। মেয়েটার এই চঞ্চলতা আজ অন্যরকম লাগছে তার। সে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। রেনু তার পাশেই। তার কাছে খুব। চাইলেই ছুঁয়ে ফেলা যাবে, বুকের সাথে জড়িয়ে ধরা যাবে। অথচ সে ভয়ে বিভোর। জ্বরের কথা বেমালুম ভুলে, ভীত হয়ে বসে আছে। রেনু ক্রমাগত জলপট্টি দিয়ে চলছে। এত যত্ন নিয়ে করছে সব যেন, ইশফাক তার প্রেম নয় কেবল তার একনিষ্ঠ সাধনা, তার স্বামী।
দরজার বাইরে দাঁড়ান তনুকা। বারবার পিটপিট করে আশপাশ দেখছে। দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার, কারোর চোখে না পড়ে যায় আবার। অন্যদিকে রেনুকেও বাঁধা দিতে পারছে না। সে ভালোবাসা বোঝে। ভালোবাসার মানুষের একটু অসুস্থতায় চিত্ত জুড়ে অস্থিরতাটা একদিন সেও অনুভব করেছিল। তবে, সেদিন রেনুর মতো মানুষটাকে কাছে পাচ্ছিল না বলে খুব কেঁদেছিল সে। আজ তাই কোনোভাবেই রেনুকে বাঁধা দিতে মন সায় দিচ্ছে না যেন।
____
‘এখন আপনি যান, রেনু। আমি আগের থেকে অনেকটা সুস্থ বোধ করছি।’
রেনুর কপাল ছুঁয়ে বলল,
‘জ্বর এখনো কমেনি।’
‘কমে যাবে, যান আপনি।’
‘এত ভয় পান কেন, বলুন তো? ধরা পড়লে কী হবে? বড়জোর ভাইজান খু ন করবেন আমাদের, এর থেকে বেশি কি আর কিছু হবে?’
ইশফাক ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে বলল,
‘আমার জন্য খু ন হতেও রাজি আপনি?’
রেনু চাইল তার চোখের দিকে। বলল,
‘হ্যাঁ, রাজি।’
ইশফাক হয়তো জ্বরের ঘোরে নয়তো সজ্ঞানে অযাচিত এক কাজ করে বসল। আচমকা জড়িয়ে ধরল রেনুকে। ইশফাকের অতি উষ্ণ বক্ষের আবরণে কম্পিত হলো রেনুর কিশোরী হৃদয়। আন্দোলিত হলো বক্ষঃস্থলের কম্পন। পায়ের পাতা শির শিরিয়ে ওঠল। নিশ্বাস নেওয়ার কথা ভুলে গেল বেমালুম। ইশফাক ঘনঘন শ্বাস টানল। বলল,
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি, রেনু। ভীষণ ভালোবাসি।’
রেনুর এবার দম আটকে আসার উপক্রম। তার উপর ইশফাকের বলিষ্ঠ হাতের বাঁধন তাকে শ্বাস টানতে দিচ্ছে না। রেনু খানিক নড়ে ওঠল। ইশফাক ছেড়ে দিল সঙ্গে সঙ্গে। ভয়ানক কিছু বলে ফেলেছে দেখে লজ্জা আর অস্বস্তিতে মুখ লুকানোর জায়গা পাচ্ছে না। রেনু তার দিকে চেয়ে আছে ড্যাবড্যাব করে। ইশফাক অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
‘আপনি এখন যান, রেনু। দেরি করলে বিপদে পড়তে হবে।’
রেনু সহজ ভঙিতে উঠে দাঁড়ায়। ইশফাকের ঠিক বরাবর সে। উচ্চতা কম বলে মাথা তুলে তাকায়। ইশফাকের চোখের দৃষ্টি এলোমেলো। রেনুর সাথে চোখ মেলাতে পারছে না। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে সে। কিন্তু, রেনু স্বাভাবিক ভীষণ। এগিয়ে আসে ইশফাকের দিকে। মেয়েটার সাহস আকাশচুম্বী। সে চট করে ইশফাকের গালে চুমু খেয়ে বসে। হেসে বলে,
‘আমিও আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।’
বলেই ছুটে বেরিয়ে যায় সে। ইশফাক বাকরুদ্ধ। গালে হাত দিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো চেয়ে রেনুর ছুটে যাওয়া দেখে। পরে বুকে হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। কেন যেন মনে হচ্ছে, হৃদপিন্ডটা বেরিয়ে আসতে চাইছে।
_____
মহলের গেইটের সামনে আসতেই মেহতাবের ফোনটা বেজে ওঠে। হাতে নিয়ে দেখে রাদাভের কল। সে রিসিভ করে। ওপাশ থেকে রাদাভ বলে,
‘কোথায়, ভাইজান?’
‘এই তো গেইটের সামনে।’
রাদাভ কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
‘আর কিছুক্ষণ আগে আসলেই দারুণ এক দৃশ্য দেখতে পেতে।’
‘কী দৃশ্য?’
‘তোমার বউ, মানে আমার একমাত্র ভাবিজান এতক্ষণ তোমার সহকারীর ঘরের ভেতর ছিল। এই যে, মাত্রই বেরিয়ে এল কেবল।’
মেহতাব সময় নিয়ে প্রশ্ন করল,
‘ঠিক দেখেছিস তুই?’
‘একদম। বিশ্বাস না হলে ভিডিয়ো আছে, চাইলে দেখাতে পারব।’
মেহতাব চোয়াল শক্ত করে বলে উঠে,
‘ঠিক আছে রাখ, আমি আসছি।’
চলবে…..
#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪০।
‘ইশফাকের ঘরে কেন গিয়েছিলে, তনু?’
প্রশ্ন শুনে স্তম্ভিত হয় তনুকা। মেহতাবের দিকে ফিরে চায়। অকস্মাৎ প্রশ্নে রা হারায় সে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। মেহতাবের দৃষ্টি নিগূঢ় স্বচ্ছ। তনুকা ঘাবড়াচ্ছে। কী বলবে বুঝতে পারছে না। জবাব না পেয়ে এগিয়ে আসে মেহতাব। হাতের ঘড়িটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখে। তারপর ফের জিজ্ঞেস করে একই প্রশ্ন,
‘বললে না তো, কেন গিয়েছিলে?’
তনুকাকে অস্থির দেখায়। ধরা পড়া চোরের মতো মুখ চুপসে যায়। সাত পাঁচ না ভেবেই বলে উঠে,
‘আপনার খোঁজ নেওয়ার জন্য।’
‘আমার খোঁজ তুমি কল দিয়েই নিতে পারতে, বাড়ির বউ রাত বিরাতে একজন সহকারীর ঘরে, ব্যাপারটা কেমন না।’
তনুকা মাথা নত করে। মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে,
‘আর হবে না এমন।’
মেহতাব মুচকি হেসে ডাকে তাকে। তনুকা অপ্রস্তুত ভঙিতে এগিয়ে যায়। মেহতাব হাত ধরে, তাকে টেনে নিজের কাছে বসায়। তারপর আলতো হাতে তনুকার কপালের চুলগুলো গুঁজে দেয় কানে। এগিয়ে এসে ললাটে এক গভীর চুম্বন আঁকে। তনুকা নির্বাক রইল। মেহতাবের ছোঁয়ায় হৃদয়ের কম্পন বাড়লেও, নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করল সে। মেহতাব এক হাতে তনুকার কোমর জড়িয়ে তাকে আরো কাছে টানে। তনুকা বুঝতে পারছে না মেহতাবের উদ্দেশ্য। সে বরাবরের মতোই নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু, আচমকাই মেহতাবের হাতের বাঁধন দৃঢ় হতেই সে চমকে ওঠে। একটু নড়ে সরে আসার চেষ্টা চালায়। মেহতাব বাঁধা দেয়। মুহূর্তেই পাল্টে যায় তার চোখে মুখের অভিব্যক্তি। গলার স্বর দৃঢ় হয়। চোয়াল হয় শক্ত। আচমকা মেহতাবের এমন পরিবর্তন ভীত করে তনুকাকে। সে ঢোক গিলে। মেহতাব অন্যহাতে তনুকার গালে হাত বুলিয়ে বলে উঠে,
‘আর কত মিথ্যে বলবে, বিবিজান?’
তনুকার নিষ্পলক চাহনি। মেহতাব ক্রমাগত তার গালে হাত বুলিয়ে চলছে। ঐদিকে কোমরে মেহতাবের হাতের স্পর্শ যেন হাড় বাঁকিয়ে ফেলার উপক্রম করেছে। তনুকা নড়ে চড়ে উঠে। অস্ফুট স্বরে বলে,
‘ছাড়ুন, লাগছে।’
মেহতাব ঠোঁট উল্টে আহ্লাদের সুরে বলে,
‘আহারে! আমার বিবিজানের লাগছে বুঝি? ঠিক আছে, ছেড়ে দিলাম। এবার সত্যিটা বলে ফেলো তো, কেন ইশফাকের ঘরে গিয়েছিলে?’
মেহতাবের অদ্ভুত আচরণ তনুকার ভয়ের মাত্রাকে তড়ান্নিত করে। সে ভীত সুরে বলে উঠে,
‘বললাম তো, আপনার খোঁজ নিতে।’
‘আহা, আবারও মিথ্যে বলছো। সত্যটা বলো, বিবিজান। আমি কিছু মনে করব না।’
তনুকা মহাবিপদে পড়েছে। এখনই সত্যিটা জানলে, রেনুর বিপদ। আর মিথ্যে বলেও আজ হয়তো পার পাবে না সে। কিন্তু, কথা হচ্ছে, মেহতাবকে এসব কে জানাল? ইশফাক তো কখনোই বলবে না, তবে আর কে? মহলের কেউ?
তার ভাবনার মাঝেই মেহতাবের কর্কশ স্বর শোনা যায়। সে বলে,
‘বুঝতে পেরেছি, তুমি বলবে না। তবে, ইশফাকের কাছ থেকেই সব শুনব আমি।’
মেহতাব উঠে দাঁড়াতেই তনুকা তার পথ আটকে দাঁড়ায়। বিচলিত সুরে বলে,
‘বলব, সব বলব আমি তবে, তার আগে ওয়াদা করতে হবে সব শুনে রাগতে পারবেন না একদম। ঠান্ডা মাথায় সমাধান করবেন।’
মেহতাব কপালে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,
‘আমার আঁড়ালে কী করেছো তুমি?’
‘আপনার আঁড়ালে কিছু করা সম্ভব না, মেহতাব। আমি বলছি সব, দয়া করে আপনি শান্ত হয়ে বসুন।’
মেহতাব বসল। গম্ভীর সুরে বলল,
‘বলো এবার।’
তনুকা ভয়ে ভয়ে পাশে বসল তার। কোথ থেকে কীভাবে শুরু করবে ভাবল প্রথমে। অতঃপর একটু রয়ে সয়ে স্বাভাবিক স্বরে বলতে আরম্ভ করল সব। মেহতাব নিষ্পলক চেয়ে রইল। এতকিছু তার আঁড়ালে, অথচ সে কিছুই ঠাহর করতে পারেনি। মেহতাব হতবিহ্বল হয় সব শুনে। বলে,
‘এতকিছু হয়ে গেল, আর আমি কিছুই জানি না? আমার বোন শেষে কি না সামান্য এক সহকারীকে ভালোবেসেছে?’
তনুকা মলিন স্বরে বলল,
‘ভালোবাসার জন্য কি খুব ধনী মানুষ প্রয়োজন?’
মেহতাব চাইল; উত্তর দিল না কোনো। তনুকা বলল,
‘এখন এই নিয়ে রেনুকে কিছু বলবেন না, প্লিজ। ওর মাধ্যমিকের পর যা করার করবেন।’
‘করার কিছুই নেই। মাধ্যমিকের পর বিয়ে দিব ওকে। আর ওর জন্য পাত্র আমি আরো আগ থেকেই ঠিক করে রেখেছি।’
তনুকা বিচলিত হয়ে বলল,
‘তাহলে ওর ভালোবাসার কী হবে?’
‘ওসব স্বল্প সময়ের আবেগ বৈ আর কিছু না, সময়ের সাথে সাথে সব কেটে যাবে।’
তনুকা মানতে নারাজ। দ্বিমত পোষণ করে বলে উঠে,
‘আবেগ নয় এটা। আমি রেনুর চোখে সত্যিকারের ভালোবাসা দেখেছি।’
মেহতাব তখন হতাশ স্বরে বলল,
‘আর আমার চোখে দেখোনি?”
তনুকা কথার তাল হারায়। উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
‘দয়া করে ওদের সাথে কোনোরূপ অন্যায় করবেন না, ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে।’
মেহতাব শান্ত স্বরে জবাব দেয়,
‘কিন্তু, আমি সেখানে ওয়াদা দিয়ে ফেলেছি। তুমি জানো, আমি ওয়াদার খেলাফ করি না।’
মেহতাব তার কথা শেষ করে গোসলখানায় প্রবেশ করে। তনুকা অসহায় বোধ করে তখন। সে চায় না, রেনুর অবস্থাও তার মতোই হোক। ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে না পাওয়ার যে বিদঘুটে কষ্টটা, সেটা যে রেনু সহ্য করতে পারবে না।
________
রাতের খাবার খেতে বসেছে সবাই। খাবার মাঝেই মেহতাবের দৃষ্টি পড়ে রাদাভের উপর। যে এই মুহূর্তে তনুকাকে দেখতে ব্যস্ত। রাদাভের দৃষ্টি টের পেতেই মেহতাবের খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। শরীর শক্ত হয়, দৃঢ় হয় চোয়াল। কপালের ভাঁজ বলে দিচ্ছে, সে এখন মাত্রাতিরিক্ত রেগে গিয়েছে। খাবারের প্লেটটা ঠাস করে সরিয়ে দেয়। হঠাৎ এমন শব্দে চমকে তাকায় সকলে। আম্বিরা বেগম জিজ্ঞেস করেন,
‘কী হয়েছে, মেহতাব?’
মেহতাব উঠে দাঁড়ায়। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,
‘কাল থেকে রাতের খাবার সবাই যার যার ঘরে খাবে, ডাইনিং এ বসে আর কোনোপ্রকার খাওয়া দাওয়া হচ্ছে না।’
সবাই হতভম্ব এমন আদেশ শুনে। আম্বিরা বেগম কিছু বলার চেষ্টা করার আগেই মেহতাব তাঁকে থামিয়ে দেয়। বলে উঠে,
‘আমার আদেশের যেন কোনো হেরফের না হয়। বিবিজান, ঘরে এসো।’
সে বড়ো বড়ো পায়ে নিজের ঘরের দিকে যায়। অগত্যাই তনুকাকেও উঠে দাঁড়াতে হলো। রাদাভ বিরক্ত স্বরে বলল,
‘তোমার বড়ো ছেলের এমন অদ্ভুত আচরণের কারণ কী, মা?’
আম্বিরা বেগম ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘আমি কী করে জানব?’
‘এটা তো রীতিমত অত্যাচার। তোমরা কেউ প্রতিবাদ কেন করলে না?’
রাহীলা সুযোগের সৎ ব্যবহার করার জন্য বলে উঠলেন,
‘জমিদার সাহেবের মুখের উপর কথা বলার সাহস কারোর আছে না কি? বাবা গো বাবা! বলা তো যায় না, দেখা যাবে কথা বললে আবার জিভ’ই ছিড়ে নিলেন।’
ঊর্মি ধমকে উঠে বললেন,
‘আহা, ছোটো! কী বলছিস?’
‘না না মেঝ কাকী, চুপ থাকলে তো চলবে না। ভাইজানের সব কথা তো শোনা যায় না, আমাদের প্রতিবাদ করতে হবে। মা, তুমিও কি কিছু বলবে না?’
আম্বিরা বেগম উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
‘অযথা ঝামেলা করতে যেও না, রাদাভ। তোমার ভাইজান মোটেও মানবে না এসব।’
তিনি চলে গেলেন। রেনুও চলে গেল তারপর। মেঝ কাকা আর মেঝ কাকীও উঠে পড়লেন। বসে রইলেন কেবল ছোট কাকা আর ছোট কাকী। ছোট কাকী রাহীলা তখন বললেন,
‘রাদাভ, আমরা প্রতিবাদ করতে চাই। এই অত্যাচার আর সহ্য হচ্ছে না।’
রাদাভ ফিচেল হেসে বলে,
‘আরেকটু ধৈর্য্য ধরো, কাকী। আর বেশিদিন নেই।’
রাতে আর মেহতাবের সাথে কোনোপ্রকার কথা বলেনি তনুকা। খাবার টেবিলে মেহতাবের এমন অদ্ভুত আচরণের কারণও জানতে চায়নি। তবে, বিরক্ত সে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
____
রাত বোধ হয় তখন দুইটা। তনুকার ফোনে কল আসে। তনুকা ঘুমে বিভোর, তাই কলের শব্দ কানে যায় না ঠিক। তবে, মেহতাব ঠিকই টের পায়। আস্তে করে উঠে বসে তনুকার কলটা রিসিভ করে। কানে লাগিয়ে চুপ রয় সে। ওপাশ থেকে কেউ একজন বলে উঠে,
‘ঐখান থেকে পালিয়ে যা, মা। ঐখানে থাকলে মেহতাব মজুমদার তোকে আর শান্তিতে থাকতে দিবে না।’
মেহতাব হেসে ফেলে। ফোনটা চোখের সামনে ধরে নাম্বারটা দেখে নেয়। এরপর কল কেটে নাম্বারটা ব্লক করে ডিলিট করে, অতঃপর ফের চুপচাপ শুয়ে পড়ে তার জায়গায়।
চলবে….