#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৭।
অতি প্রত্যুষেই মেহতাব তনুকাকে নিয়ে রওনা হলো মহলের উদ্দেশ্যে। মহলের কাউকেই এত ঝামেলার কথা জানানো হলো না। তনুকার মনে বিষন্নের ছায়া। কালকের মুহূর্তগুলো সে ঠিক ভুলতে পারছে না। মেহতাব সকাল থেকেই চুপচাপ; খুব একটা কথা বলেনি কারোর সাথে। শুধু জানিয়েছে, আজ কিছু গরীব খাওয়াবে সে। তার কথা মতো ইশফাকও সব ব্যবস্থা করেছে।
তনুকা গোসল সেরে আসতেই ঘরে রেনুকে দেখে। রেনু হেসে বলে,
‘শুভ জন্মদিন, বউমনি।’
তনুকাও প্রসন্ন হাসে। বলে,
‘সে তো কালই চলে গিয়েছে।’
‘হ্যাঁ, জানি তো। ভাইজান বলেছিলেন। তোমাকে সারপ্রাইজ দিবে বলে আমিও আর উইশ করিনি। কালকের সারপ্রাইজটা কেমন লেগেছে তোমার?’
তনুকা ক্ষীণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পরক্ষণেই আবার কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে বলে,
‘ভালো। এভাবে কেউ আমাকে কখনো সারপ্রাইজ দেয়নি।’
‘দেখেছো, ভাইজান তোমায় কত ভালোবাসে।’
তনুকা জবাবে নির্বাক থাকে কেবল। রেনু আফসোসের সুরে বলে উঠে,
‘তোমাকে ভাইজান কী চমৎকার সারপ্রাইজ দিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাল আর ঐ ইশফাক তো আমার জন্মদিনের কথাই মনে রাখে না, উইশ তো দূরে থাক।’
তনুকা হাসে। রেনুর গাল টেনে বলে,
‘কষ্ট পেও না, ননদিনী; সময় আসলে সব মনে রাখবে।’
রেনু আগ্রহ নিয়ে শুধায়,
‘সেই সময় কবে আসবে, বউমনি?’
‘আসবে, খুব শীঘ্রই।’
রেনু ভীত সুরে বলে,
‘ভাইজান কখনোই মানবেন না।’
‘আমি আছি তো। তোমার ভাইজানকে আমি রাজি করাব।’
রেনু খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে তনুকাকে। বলে উঠে,
‘তুমি খুব ভালো, বউমনি। খুউব খুউব খুউব ভালো।’
_________
সন্ধ্যা হতেই মহলে খবর আসে পাশের গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলে রাজীব ভূইয়া কাল রাত থেকে উধাও। পুরো গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাকে কোথাও পাওয়া যায়নি। খবরটা তনুকার কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই বিচলিত হয়ে পড়ে সে। দ্বিধাহীন চিত্তে সে ভেবে নেয়, এই কাজ অবশ্যই মেহতাবের। মেহতাব মহলে ফিরেনি এখনও। তনুকা তার পথ চেয়ে অধীর আগ্রহে বসে আছে। আসলেই রাজীবের খোঁজ নিতে হবে যে।
মেহতাব ফিরেছে কিছুক্ষণ হবে। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে বসে। তনুকা সেই মুহূর্তেই হাতে এক চায়ের কাপ নিয়ে হাজির হয় সেখানে। মেহতাবের পাশের ছোট টেবিলটাতে চায়ের কাপ রেখে তার পাশেই বসে। ভাবছে, এবার জিজ্ঞেস করবে। মেহতাব চায়ের কাপ হাতে নেয়, চুমুক বসিয়ে বলে উঠে,
‘আজ একটু বেশিই মিষ্টি দিয়ে ফেলেছ।’
সাজানো কথাতে তাল হারায় তনুকা। এই মুহূর্তে মেহতাবের এই কথা তার ভাবনাতে ব্যাঘাত ঘটায় বেশ। তাও সে তাল মিলিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘আবার বানিয়ে নিয়ে আসব?’
‘না না, এইটুকু মিষ্টি আমি ঠিক হজম করে নিতে পারব।’
তনুকা এক পল নীরবতা পালন করে বলে উঠে,
‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
‘করো।’
‘রাজীবকে আপনি গুম করেছেন, তাই না?’
মেহতাব এমন প্রশ্ন হয়তো আশা করেনি। তাই একবার ভ্রু কুঁচকে তাকায়। চায়ের কাপ রেখে সোজা হয়ে বসে। তনুকার দুই হাত নিজের হাতের ভাঁজে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘তোমার এমনটা কেন মনে হলো?’
‘শুধু মনে হয়নি, আমি নিশ্চিত এটা আপনার কাজ।’
মেহতাব হাসল। তাচ্ছিল্য প্রকাশ পেল সেই হাসিতে। তনুকা বোধ হয় বিরক্ত হলো। জিজ্ঞেস করল,
‘হাসছেন কেন?’
‘কাজটা আমি করেছি, শুনলে খুশি হবে?’
তনুকা জবাব না দিয়ে সন্দিহান চোখে চাইল। মেহতাব ফের হেসে বলল,
‘ওভাবে কী দেখছ? আমাকে প্রেমে ফেলার ধান্ধা!’
‘বাজে বকবেন না একদম। রাজীবকে কোথায় রেখেছেন আপনি? ঐ গ্রামের মানুষ এসব জানতে পারলে কী ঝামেলা হবে বুঝতে পারছেন?’
‘ওসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি বরং তোমার জন্মদিনের উপহার নিয়েই ভাব। উকিলের সাথে কথা বলেছি আমি, খুব শীঘ্রই ঐ জমি তোমার হতে চলেছে।’
তনুকা এই মুহূর্তে এই ব্যাপারে কথা বাড়ানোর আর কোনো আগ্রহ পায় না। সে উঠে দাঁড়ায়। বলে,
‘আমি কোনো ঝামেলা চাই না, মেহতাব। দেশে পুলিশ আছে, আইন আছে, অযথা নিজ হাতে আইন তুলে নিবেন না। আশা করছি আমার কথাটা রাখবেন।’
তনুকা বেরিয়ে যায়। মেহতাবের ঠোঁটের কোণে প্রশ্বস্থ হাসি ফুটে। তৃপ্তির হাসি বোধ হয়। দেশের পুলিশ আর আইনের পোরোয়া সে আগে কখনো করেছে নাকি যে এখন করবে। মেয়েটা বোকা বড্ড! বোঝেনা কিছু। যে মানুষ পেটে চলে গিয়েছে সেই মানুষকে কোথ থেকে আনবে সে।
______
রাদাভের মেজাজ ঠিক নেই। রাতে খেতে আসেনি সে। তার মেজাজ বিগড়ানোর কারণ সম্পর্কে কেউ অবগত নয়। সবাই খেয়ে দেয়ে যার যার মতো ঘরে চলে গিয়েছে। তনুকা নিজ ঘরে না গিয়ে গিয়েছে ঊর্মির ঘরে। দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে সে। ঊর্মি তাকে দেখে জিজ্ঞেস করেন,
‘হঠাৎ এই ঘরে?’
তনুকা ততক্ষণাৎ কাঠ কাঠ গলায় বলে উঠে,
‘বাবার খোঁজ নিতে এসেছি।’
রমেজ মজুমদার বিছানায় আধ শোয়া তখন। তিনি কপালে ভাঁজ ফেললেন। বললেন,
‘তোমার বাবার খোঁজ আমাদের কাছে নেই।’
‘অবশ্যই আছে। আর কত মিথ্যে বলবেন আপনারা? আমি আপনাদের আর বিশ্বাস করি না। এবার ভালোই ভালোই বাবার খোঁজ দিন আমায়, নয়তো আমি মেহতাবকে সব বলতে বাধ্য হব।’
ঊর্মি হকচকিয়ে উঠে বলেন,
‘তুমি আমাদের ভয় দেখাচ্ছ, তনু। আমরা কি তোমার খারাপ চেয়ে কিছু করেছি?’
তনুকা বিদ্রুপের সুরে বলে উঠে,
‘খবরদার, একদম ভালোবাসা দেখাতে আসবেন না। আপনাদের আমার চেয়ে ভালো কেউ চেনে না। স্বার্থের জন্য সব পারেন। দুইদিন সময় দিলাম, এর মাঝে যদি আমাকে বাবার খোঁজ না দিতে পারেন তবে মেহতাবকে আমি সব জানাব। আর সব জানার পর মেহতাব আপনাদের কী অবস্থা করবে সেটা নিশ্চয়ই আমাকে বলে দিতে হবে না?’
তনুকা ফিচেল হেসে বেরিয়ে যায়। রমেজ মজুমদারের চোখ ভিজে ওঠে। বিধ্বস্ত সুরে তিনি বলে উঠেন,
‘মেয়েটা কি কখনোই আমাদের ক্ষমা করতে পারবে না, ঊর্মি?’
ঊর্মি হতাশ সুরে বলেন,
‘হয়তো না।’
.
আচমকা কোমরে কারোর হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠে সে। আগন্তুককে চিনতে না পেরে ভয়ে চেঁচিয়ে উঠতে নেয় কিন্তু, পরক্ষণেই এক চেনা ঘ্রাণ নাকে ঠেকতেই শান্ত হয় বক্ষঃস্থল। পেছনে মাথা হেলিয়ে দিয়ে বলে উঠে,
‘তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।’
আগন্তুক তার কাঁধে চিবুক ঠেকায়। মৃদু আওয়াজে বলে উঠে,
‘কালকের দিনটাও আমায় দিলে না।’
‘কী করব বলো? আমি বুঝতে পারিনি উনি এত কিছু করবেন।’
‘তা উনি আর কী কী করেছেন? অতি আবেগে তোমার উপর অধিকার খাটিয়ে বসেননি তো?’
এমন প্রশ্নে দ্বিধায় পড়ে সে। তবে তাকে বুঝতে না দিয়ে বলে উঠে,
‘উঁহু, একদমই না। তবে, এসবের মাঝে আমাদের পরিকল্পনাটা বাস্তবায়ন হয়েছে। জমিটা আর কিছুদিনের মাঝেই আমার হয়ে যাবে।’
অজ্ঞাত ব্যক্তি খুশি হয়ে হাতের বাঁধন আরো শক্ত করে। কাঁধে চুমু খেয়ে বলে উঠে,
‘সত্যি বলছো?’
‘হ্যাঁ, একদম।’
মেহতাব তনুকার অপেক্ষায়। অথচ তার আসার নাম গন্ধ নেই কোনো। বিরক্ত হয়ে সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। আনমনে এদিক ওদিক দৃষ্টি বুলায়। তখনই এক দৃশ্যে দৃষ্টি থমকায় তার। চোখের সেই দৃষ্টি সরু হয় সঙ্গে সঙ্গেই। দুই জন ছায়া মানব দেখে আচমকা বক্ষঃস্থলের কম্পন বাড়ে তার। সঙ্গে ভর করে এক তীব্র আতঙ্ক। মস্তিষ্ক জেগে উঠে। স্নায়ু থেকে সংকেত আসে, আজ তাদের হাতে নাতে ধরা উচিত। মেহতাব সেই সংকেত অগ্রাহ্য করতে পারে না। প্রচন্ড রাগে কপালের রগ ফুলে উঠে তার। আজই হয়তো এই লুকোচুরি শেষ করবে সে। সেই প্রস্তুতি নিয়ে ঘর থেকে বড়ো বড়ো পা ফেলে বেরিয়ে আসে। যাওয়ার পথে আলমারি থেকে তার সবথেকে ধারালো ছুড়িটাও নিয়ে আসে। সিদ্ধান্তে অটল সে, আজ সেই ব্যক্তির বক্ষচ্ছেদ না করে ক্ষান্ত হবে না, একদমই না।
চলবে,
#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৮।
রেনু জড়িয়ে ধরার জন্য হাত বাড়াতেই ইশফাক পিছিয়ে যায়। কপালে তার সূক্ষ এক ভাঁজ প্রস্ফুটিত হয়। সেই ভাঁজ ইঙ্গিত করছে, রেনুর আচরণে এই মুহূর্তে ভীষণ বিরক্ত সে। ইশফাকের এহেন বিরূপ প্রতিক্রিয়া রেনুকে কষ্ট দেয়। সে অভিমানে গাল ফুলায়। ইশফাক সেসব অগ্রাহ্য করে বলে উঠে,
‘আপনার ভাইজানের হাতে আমার প্রাণ যাওয়া না অবধি আপনি বোধ হয় ক্ষান্ত হবেন না, তাই না?’
রেনুর ফুলানো গালযুগল আরো ফুলে যায় যেন। অভিমানের পাল্লা ভারী হয়। ভেজা সুরে বলে,
‘একটু সাহসী হলে কী হয়, ইশফাক? ভাইজানের সামনে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে আমাকে চাইতে পারবেন না?’
‘না।’
নির্দ্বিধায় নাকচ করল ইশফাক। রেনু বিধ্বস্ত নয়নে চাইল। আহত হলো তার ক্ষুদ্র হৃদয়। ব্যথিত সুরে বলল,
‘এই আপনার ভালোবাসা? এইটুকু সাহসও আপনার নেই?’
ইশফাক নির্বাক রয়। মেহতাবকে সে যতটা কাছ থেকে দেখেছে তা আর কেউ দেখেনি। তাই কেউ এই নিয়ে ঠিক অবগতও নয় যে, সেই মানুষটা ঠিক কতটা ভয়ংকর। ইশফাক জানে সেটা। আর জানে বলেই তার সাহস হচ্ছে না। রেনু উত্তরের অপেক্ষায় চেয়ে আছে। সিক্ত চোখের দৃষ্টি তার। ইশফাক মাথা নোয়াল। মৃদু আওয়াজে বলল,
‘অনেকক্ষণ হয়েছে, রেনু; এবার আপনার ফেরা প্রয়োজন।’
রেনু ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘আমি যাব না।’
‘জেদ করবেন না। কেউ দেখে ফেললে বিপদ।’
‘হোক বিপদ। আমি আপনার মতো ভীতু না, বুঝেছেন?’
ইশফাক ক্ষীণ হাসল। এগিয়ে এসে চট করে রেনুর গাল টেনে দিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, বুঝেছি আপনি অনেক সাহসী নারী। কিন্তু, সব জায়গায় সাহস দেখানো ঠিক না। আপাতত মহলে ফিরে যান। এখন কেউ দেখে নিলে, সব সাহস একদম ফুঁস হয়ে যাবে।’
রেনু হাসল। লজ্জা ঝরে পড়ছে যেন সেই হাসিতে। হাত কচলাতে কচলাতে সে বলল,
‘গাল টেনে বুঝি আদর করলেন আমায়?’
ইশফাক বিষম খায় যেন। ইতস্তত সুরে বলে উঠে,
‘বাজে না বকে মহলে যান তো। রাত হয়েছে অনেক।’
রেনু অতি ব্রীড়ায় কুন্ঠিত হলো। অস্ফুট সুরে বলল,
‘আমি জানি, এটাই আপনার আদর।’
ইশফাক কিছু বলার আগেই দ্রুত পা চালাল সে। বেশ কয়েক কদম হেঁটে সামনে গিয়েই আচমকা থমকাল। সামনে দাঁড়ান মানুষটাকে দেখে পিলে চমকে উঠল তার। গায়ে কাটা দিল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো হৃদকম্পন থেমে গিয়েছে তার। গলা শুকিয়ে ওঠেছে। দু কদম পিছিয়ে গিয়ে শরীর শক্ত করে দাঁড়ায়। ঢোক গিলে কম্পিত সুরে বলে উঠে,
‘ভ-ভাইজান, তত-তুমি?’
মেহতাব চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে। প্রশ্ন করে,
‘এত রাতে এখানে কী তোর?’
প্রশ্ন শুনে প্রাণপাখি যেন ফুরুৎ করে উড়ে যেতে চায়ল। রেনু শান্ত রাখল নিজেকে। যুতসই উত্তর সাজানোর চেষ্টা চালাল। কিন্তু, পারল না বোধ হয়। ধরা পড়া চোরের মতো চুপসে যাওয়া মুখে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল কেবল। মেহতাব প্রশ্ন করল ফের,
‘কীরে, কিছু বলছিস না কেন?’
রেনু ঢোক গিলছে পরপর। মেহতাবের চোখের দৃষ্টি সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়। হয়তো সে কিছু আন্দাজ করতে পারছে। তাও রেনুর উত্তরের অপেক্ষায় সে। রেনুর নীরবতায় এক পর্যায়ে অত্যধিক বিরক্ত হয়ে মেহতাব ধমকে ওঠে। উচু আওয়াজে জিজ্ঞেস করে,
‘কী ব্যাপার, কথা বলছিস না কেন? আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি তো?’
রেনু শরীর অসাড় হয়ে আসছে যেন। উত্তরে কী বলবে সে? সত্য বললে আজ যে প্রাণ যাবে নির্ঘাত। রেনু ভয়ে ঘামছে রীতিমতো। মেহতাবের চোয়াল শক্ত হয়। সে এগিয়ে আসে একদম। কন্ঠস্বর শক্ত করে ফের একই প্রশ্ন করে,
‘রেনু, চুপ করে না থেকে উত্তর দে। এত রাতে এখানে কী তোর? কী লুকাচ্ছিস তুই?’
মেহতাবের এইটুকু সুরই ছোট্ট দেহের রেনুকে মৃত্যুর পথযাত্রী বানাতে যথেষ্ঠ। সে নিশ্চল, নির্বাক। উত্তর তো জানা নেই, কী বলবে? তবে, ভাগ্য ভালো সে সময়ই তার সম্মুখে এসে হাজির হয় তনুকা। ঘরে গিয়ে মেহতাবকে না পেয়ে ঘটনাস্থলে তার এই আগমন। আর তার এই অকস্মাৎ আগমনেই এই মুহূর্তে রেনুকে একটু শ্বাস ফেলার ফুরসতটুকু দেয়, নয়তো শ্বাস ফেলার কথা বেমালুম ভুলে বসেছিল সে। তনুকা ভাই বোনের মুখের ভাবমূর্তি দেখেই ধারণা করে নেয়, চোর হয়তো ধরা পড়েছে। তাও নিশ্চিত হতে মেহতাবকে জিজ্ঞেস করে,
‘কী হয়েছে? এই সময় আপনারা দুজন এখানে?’
মেহতাব তার দিকে তাকায়। গম্ভীর সুরে বলে উঠে,
‘এই সময় রেনুর এখানে আসার কারণটা তুমিও বোধ হয় জানো তাই না, তনু?’
তনুকা অপ্রস্তুত হয়। রেনুর দিকে তাকায়। রেনু অসহায় চোখে ঢোক গিলে। তনুকা বুঝে উঠতে পারে সবটা, ইশারায় আশ্বস্ত করে তাকে। অতঃপর বলে,
‘না তো, আপনি কীসের কথা বলছেন?’
‘রেনু কি এখানে ইশফাকের সাথে দেখা করতে এসেছে, তনু?’
প্রশ্ন শুনে তনুকা আর রেনু দুজনেই চকিত হয়। মেহতাব যে এত শীঘ্রই এই ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যাবে এইটুকু ভাবনায় ছিল না তাদের। তাই হজম করতে কষ্ট হয়। তনুকা উত্তর না দিয়ে রেনুর পানে চায়। রেনু চোখের ইশারায় অনেক আকুতি মিনতি করে ফেলে যেন, তনুকা এই মুহূর্তে কিছু না বলে। তবে, মেহতাব ছাড়ার পাত্র না। তার শকুনেরর চোখ ফাঁকি দেওয়া মুশকিল। রেনু বা তনুকার কাছ থেকে কোনোপ্রকার জবাব না পেয়ে সে গলা উচিয়ে ইশফাককে ডাকল সঙ্গে সঙ্গেই।
ঘরে দোর দেওয়া ইশফাকের কানে আচমকা মেহতাবের ডাক যাওয়া মাত্রই বুকের ভেতরে ধক করে উঠে তার। ভেবে নেয়, আজ সব শেষ। বক্ষঃস্থলের কম্পন তীব্র হয়। তবে, অদ্ভুত ভাবে কোনোপ্রকার ভয় কাজ করছে না তার মধ্যে। রেনুর মিষ্টি, মায়াবী, আদুরে মুখখানা দৃশ্যপটে ভাসছে বারংবার। মেয়েটার জন্য মৃত্যুর আগে অন্তত একবার বুক ফুলিয়ে বলে যাবে যে, সে তাকে ভালোবাসে। সকলের সামনে বলে যাবে সে। ভয় আর দ্বিধাহীন সেই কন্ঠ থাকবে। সেই প্রস্ততি নিয়েই ইশফাক ঘর ছেড়ে আজ বেরিয়ে আসে। মা বাবাকে ছোটবেলাতেই হারিয়েছিল। মোহন লাল মজুমদার কুড়িয়ে এনে বড়ো করেছিলেন তাকে। তারপর একটু বোঝ হবার পর থেকেই মেহতাবের গোলামী করে চলছে। আর আজ সে তার এক বিশ্বস্ত সহকারী। এমন অনেক কিছুই সে জানে যা একবার ফাঁস হলে মেহতাবের ক্ষমতা সঙ্গে সঙ্গেই ধুলোয় মিশে যাবে। অথচ সে বেঈমানী করেনি কখনো আর ভবিষ্যতেও করবে না। যদি এই ভেবেও মেহতাব আজ রাজি হয়ে যেত। ইশফাক এই দোয়াটাও করে নেয়। বলা তো যায় না, কখন কোন দোয়া লেগে যায়।
মেহতাবের ঠিক মুখোমুখি ইশফাক। মাথা নোয়ানো তার। ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক। ভয় দেখা যাচ্ছে না কোনো। তারই অপর পাশে রেনু দাঁড়ান। ভয়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত তার। অথচ একটু আগে এই মেয়েই কত বড়ো বড়ো কথা বলছিল। তনুকা নীরব চোখে দেখছে দুজনকে। তার মুখে কোনো রা নেই। অপেক্ষা করছে মেহতাবের অভিব্যক্তির। মেহতাব কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে প্রশ্ন ছুড়ে,
‘রেনু এত রাতে তোমার কাছে কেন এসেছিল, ইশফাক?’
ইশফাক চোখ বোজে জোরে নিশ্বাস ফেলে। নিজেকে ধাতস্ত করার যত আয়োজন। তারপর স্পষ্ট সুরে বলে উঠে,
‘যেহেতু তিনি এসেছিলেন সেহেতু আসার কারণটাও তিনিই ভালো বলতে পারবেন।’
মেহতাব সঙ্গে সঙ্গেই রেনুর দিকে তাকায়। রেনু চোখ নামিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়ায়। মেহতাব একই প্রশ্ন তাকেও করে। কিন্তু, বরাবরের মতোই নীরব ভূমিকা পালন করছে সে। মেহতাবের রাগ হয়। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠে,
‘মেয়েদের গায়ে আমি হাত তুলিনা, রেনু। নয়তো আজ চুপ থাকার অপরাধে গা থেকে তোর চামড়া তুলে নিতাম।’
রেনু কেঁপে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গেই কেঁদে ফেলে সে। তনুকা ব্যস্ত হয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে। শান্ত করানোর চেষ্টা করে। ধীর সুরে বলে,
‘আজ সব বলার সময় এসেছে, রেনু। আর লুকিয়ে রেখো না। বলে দাও সব।’
রেনুর কান্নার মাত্রা বাড়ে বরং। মেহতাবের রাগও বাড়ে তাই। ইশফাক ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে,
‘এই আপনার সাহস, রেনু? কিছুক্ষণ আগেও না বলছিলেন আপনি খুব সাহসী? তবে, প্রমাণ করুন, আপনি সাহসী। কাঁদছেন কেন? সাহস নিয়ে বলুন, কেন এসেছিলেন আমার কাছে?’
রেনু কান্না থামায়। বিস্মিত চোখে দেখে ইশফাককে। ইশফাকের চোখের দৃষ্টি নিরেট শূণ্য। আশ্চর্য, সে ভয় পাচ্ছে না কেন? রেনু অবাক হয়। চট করে কোথ থেকে যেন তখন এক বুক সাহস এসে ভরে করে তার ভেতর। সে মেহতাবের দিকে তাকায়। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে। অতঃপর গম্ভীর সুরে বলে উঠে,
‘আমি ইশফাককে ভালোবাসি, ভাইজান। আর ভালোবাসি বলেই এই রাত বিরেতে তাকে একটু দেখতে ছুটে আসি। আর আজ রাতেও এখানে আসার কারণটাও তাই। আমি ভালোবাসি ইশফাককে। এটাই সেই কারণ, যেটা জানার জন্য এত উদগ্রীব হয়ে উঠেছ তুমি।’
চলবে….