#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৯।
মেহতাবের দুহাত পেছন থেকে মুষ্ঠিবদ্ধ করে রাখা। কপালে তার গাঢ় ভাঁজ। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণত্বের মাত্রা ছাড়িয়েছে। রেনু চেয়ে আছে ভীত দৃষ্টিতে। ভাইজানের প্রতিক্রিয়া নিয়ে চিন্তিত সে। ভয়ও পাচ্ছে খুব। সাহস করে চটপট সব বলে দিলেও এখন আতঙ্কিত সে। ইশফাকের দৃষ্টি স্বচ্ছ। নিশ্চল ভঙিতে দাঁড়িয়ে এক ধ্যানে মেহতাবকে দেখছে। মেহতাব ইশফাকের দিকে চায়। জোরে নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করে,
‘ইশফাক, তুমিও কি রেনুকে ভালোবাসো?’
ইশফাক সহ বাকি দুই রমণীর নেত্রে পৃথিবী কাঁপানো বিস্ময়। বিমূঢ় দৃষ্টিতে কয়েক পল চেয়ে রইল ইশফাক। মেহতাব হয়তো উত্তরের অপেক্ষায়। তাই বলল,
‘আমি তোমায় কিছু জিজ্ঞেস করেছি, ইশফাক।’
ইশফাক নীরবতা ভাঙার প্রস্তুতি নেয়। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে সহসা স্বচ্ছল স্বরে বলে উঠল,
‘জি ভাইজান, আমিও রেনুকে ভালোবাসি।’
রেনু আপ্লুত হলো। চোখের দৃষ্টি ছলছল হয়ে উঠল যেন। এই সাহসটুকুই তো চেয়েছিল সে। তনুকাও খুশি এতে। ভালোবাসা স্বীকার করে নেওয়ার মাঝেও এক অদ্ভুত সুখ আছে, আর এই সুখ ভালোবাসা অন্তরে লুকিয়ে রাখলে পাওয়া যায় না।
মেহতাবের নিরুত্তাপ প্রতিক্রিয়া। রেনু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ভাইকে দেখছে। তার মুখ থেকে কিছু শোনার আশায় চিত্ত জুড়ে জোয়ার-ভাটা হীন নদীর স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ইশফাকেরও তাই। উদগ্রীব দেখাচ্ছে তাকে। মেহতাব খানিক সময় নেয়। এই সময়ে অনেক ভাবে সে। স্মৃতির পাতা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে ইশফাকের জীবনী দর্শন করে আসে। হিসেব মিলিয়ে নেয় বরাবার, সাথে মেলায় নিজের লাভ লোকসানও। অতঃপর অনেক ভেবে চিন্তে সে নিভু স্বরে বলে,
‘কাল বিকেলে মহলে আসবে। বাড়ির সকলের সামনে আমি তোমাদের বিয়ের তারিখ পাকাপাকি করব।’
আচমকা মনে হলো, এ যেন মেঘ না চায়তেই বৃষ্টির আবির্ভাব। মেহতাবের এহেন স্বভাব বিরুদ্ধ আচরণ প্রথমে ঠিক হজম হলো না কারোর। কথাখানা বোধগম্য হতে সময় নিল বেশ। রেনুর খুশি ধরছে না। হাতে চাঁদ পেলেও এত খুশি হতো না সে, আজ যতটা হয়েছে। ইশফাকের চোখ মুখ ঝলমল করছে। খুব করে ইচ্ছে করছে একবার মেহতাবকে জড়িয়ে ধরতে। এত সহজে এমন অমূল্য রত্ন পেয়ে যাবে আশা করেনি। বামুন হয়ে চাঁদে হাত দিয়েছিল, অথচ চাঁদ যে এত শীঘ্রই তার আকাশে এসে ধরা দিবে তা ছিল তার কল্পনাতীত।
মেহতাব রেনুর দিকে তাকায়। গম্ভীর সুরে বলে,
‘ভেতরে যা। বিয়ে না হওয়া অবধি আর লুকিয়ে দেখা করতে আসবি না, বুঝেছিস?’
রেনু সভ্য মেয়ের ন্যায় মাথা নাড়িয়ে নিজের ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। মেহতাব বলল,
‘বিবিজান, তুমিও এবার ঘরে যাও।’
তনুকাও তাই করল। ইশফাক দাঁড়িয়ে রইল একা। এবার ইতস্তত দেখাচ্ছে তাকে। মেহতাবের মুখোমুখি অপ্রস্তুত হচ্ছে বোধ হয়। তাও দ্বিধা কাটিয়ে বলল,
‘ধন্যবাদ, ভাইজান।’
মেহতাব তাকে আপাদমস্তক পরখ করে বলল,
‘তোমার থেকে আমি এটা আশা করিনি, ইশফাক। তুমি আমার বিশ্বাস ভেঙেছ। আগে জানলে রেনুকে কখনোই তোমার সামনে আসতে দিতাম না।’
ইশফাক আহত হলো এই কথার বাণে। বিধ্বস্ত চোখে চেয়ে বলল,
‘এভাবে কেন বলছেন, ভাইজান? আমার প্রতি বিশ্বাস না থাকলে আমাকে এক্ষুনি তাড়িয়ে দিতে পারেন, কিংবা মৃত্যুদণ্ড দিলেও মাথা পেতে নিব আমি।’
‘তোমাকে মৃত্যুদণ্ড দিলে আমার বোন কষ্ট পাবে। আর আমি চাইনা ও কষ্ট পাক। ওর কথা ভেবেই কেবল আমি রাজি হয়েছি। নয়তো আমি কখনোই তোমার হাতে আমার বোনকে তুলে দিতাম না।’
ইশফাকের ভীষণ আত্মসম্মানে লাগল কথাটা। সে মেহতাবের মতো ধনী না হোক অন্তত মনটা ছোট নয়। মেহতাবের মতো এত নির্দয় নয় সে। যদিও আজকাল তার হয়ে কাজ করতে করতে অনেকটাই সেই পথে চলে গিয়েছে সে, তাও অন্তরে এখনো যথেষ্ঠ ভালোবাসা আছে, মায়া, মমতা, প্রেম সবই আছে। সে নিঃসন্দেহে রেনুকে ভালো রাখতে পারবে। তবে মেহতাব কেন এভাবে বলছে?
ইশফাকের কষ্ট হয় খুব। মেহতাব সেখান থেকে চলে আসে। ইশফাকও নিজ ঘরে ফিরে যায়। বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সহসাই। ভাবে, কত মানুষ তো কত কিছু করেছে তার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য, সে না হয় তার আত্মসম্মানটাই খোয়ালো, তাতে কী আসে যায়।
________
বিছানা ঝেরে তনুকা হেলান দিয়ে বসে। মেহতাব তখন আলমারি খুলে কিছু একটা করছিল। তনুকা চেয়ে বলল,
‘আপনার এই সিদ্ধান্তে আমি খুব খুশি হয়েছি, মেহতাব।’
মেহতাব চাইল। বলল,
‘এই ব্যাপারটা তুমি আগেই জানতে, তাই না?’
তনুকা নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল,
‘হ্যাঁ।’
‘তোমার দেখা বাগানের ঐ ছায়ামূর্তিগুলো তবে ওরাই ছিল?’
‘হু।’
‘আগে বলোনি কেন আমায়?’
‘উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম।’
‘যদি সেই উপযুক্ত সময় আসার আগেই কোনো অঘটন ঘটে যেত?’
‘কী ঘটতো?’
‘বিবি, রেনু এখন নিত্যান্তই এক কিশোরী, অন্যদিকে ইশফাক পুরো দুস্তর এক যুবক। রেনুর রাত বিরেতে তার সাথে এই হুটহাট দেখা করাটা নিশ্চয়ই মঙ্গল কিছু বয়ে আনত না। এইটুকু নিশ্চয়ই তুমি বুঝো?’
তনুকা ইতস্তত সুরে বলল,
‘ইশফাক ভাই ভালো। আমার মনে হয় না উনি তেমন কিছু করতেন বলে। আমি উনার চোখে সত্যিকারের ভালোবাসা দেখেছি।’
‘আর আমার চোখে দেখনি?’
তনুকা থমকায়। নিষ্পলক চোখে মেহতাবকে দেখে। কেমন উদ্ভ্রান্তের ন্যায় সে চেয়ে আছে যেন। তনুকার অস্বস্তি হয়। তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে চট করে বিছানায় শুয়ে বলে উঠে,
‘লাইট’টা অফ করে এসে শুয়ে পড়ুন। অনেক রাত হয়েছে।’
মেহতাবও আর কথা বাড়াল না। তনুকা যে ব্যাপারটা উপেক্ষা করছে তা সে বেশ বুঝতে পারছে। তার ঠোঁটের কোণে অবজ্ঞার হাসি ফুটে। করুক উপেক্ষা, কতদিন চলবে এসব? একদিন ঠিক শেষ হবে। দিন যে এবার ফুরিয়ে আসার পালা।
__________
‘মেহতাব।’
মেহতাব তাকাল। মেঝো কাকাকে দেখে প্রশ্ন করল,
‘কিছু বলবেন, কাকা?’
রমেজ মজুমদার একবার সতর্ক দৃষ্টিতে আশপাশ দেখলেন। তারপর মেহতাবের কাছে গিয়ে বললেন,
‘একটা কথা জানার ছিল।’
‘জি, বলুন।’
‘ওমরের কোনো খবর জানো?’
মেহতাব ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
‘উনার খবর আমি কী করে জানব?’
‘না, আসলে তোমাদের বিয়ের পর থেকেই নিখোঁজ ও।’
‘নিখোঁজ হলে পুলিশের কাছে যান, পুলিশ কেইস করুন। আমাকে বলে তো কোনো লাভ নেই, আমি তো আর নিখোঁজ মানুষকে খুঁজে বের করতে পারব না।’
রমেজ মজুমদার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যতই মেহতাব মুখে বলুক না কেন সে কিছু জানে না, রমেজ মজুমদার নিশ্চিত, ওমরের খোঁজ একমাত্র মেহতাবই দিতে পারবে। তাও সেটা মুখে প্রকাশ করার বিন্দুমাত্র সাহস নেই উনার। তাই বিচারমহল থেকে বেরিয়ে তিনি ঘাটের কাছে গেলেন।
সকালের উষ্ণ রোদ। সেখানে ছিল রাদাভও। কোমরে হাত রেখে ঘাটসহ আশেপাশটা ভালোভাবে পরখ করছে সে। মতিব মজুমদার তার পাশে গিয়ে দাঁড়ান। রাদাভ কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে তাকায়। মতিব মজুমদারকে দেখে ফিচেল হাসে। বলে,
‘কী ব্যাপার, হঠাৎ এখানে?’
‘এমনিতেই। তুমি এখানে কী করছো?’
‘ঐ তো দেখছি, সামনের জমি-জমা আর এই দিঘী কিছুদিনের মধ্যেই আমার হতে চলছে যে।’
রমেজ মজুমদার কপাল কুঁচকে বললেন,
‘মানে?’
রাদাভ হাসে। বিদ্রুপের হাসি সেটা। অতঃপর বলে,
‘আজ যদি আমি মেহতাব মজুমদারের মতো অনেক জমির মালিক হতাম তবে, তনুকাও আমার হতো। কিন্তু, আফসোস! হলো না। তাই ভেবেছি যে করেই হোক অনেক জমি জমার মালিক বানাতে হবে নিজেকে তবে, আমিও খুব সহজে আপনার সুন্দরী রূপবতী মেয়ে, তনুকা মজুমদারকে নিজের করে নিতে পারব।’
রমেজ মজুমদার রেগে যান খুব। অতি মাত্রায় ক্ষুব্ধ হয়ে রাদাভকে মারার জন্য হাত তুলতেই রাদাভ সহস্তে চেপে ধরে তা। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠে,
‘খবরদার আমার না হওয়া শ্বশুর, আমাকে এখন আর আগের মতো দুর্বল ভাববেন না। আপনার এই হাতকে এই মুহূর্তেই ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আছে আমার। তাই সাবধান, এমন ভুল আর দ্বিতীয়বার করবেন না। নয়তো আমি ভুলে যাব, আপনি আমার বাবার ভাই আর আমার ওয়ান এন্ড ওনলি প্রেমিকা তনুকার একমাত্র বাবা।’
এক ঝটকায় রমেজ মজুমদারের হাত নামিয়ে রাদাভ চলে যায় সেখান থেকে। রমেজ মজুমদারের চোখ থেকে অগ্নি ঝরছে। রাগে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলছেন তিনি। দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে শক্ত করলেন। ভাবলেন, খুব শীঘ্রই এর একটা বিহিত করে তবেই ক্ষান্ত হবেন তিনি; এর আগে না।
চলবে….
#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫০।
মেহতাব কোনো এক কাজে বেরিয়েছে। ইশফাককে নেয়নি সাথে। ইশফাকের দুশ্চিন্তা তাতেই। মেহতাব নারাজ হয়েছে ভীষণ। ইশফাক চায়নি এমনটা। তবে ভালোবাসার কাছে পরাস্ত হয়ে এইটুকু তাকে এখন সহ্য করে নিতেই হবে।
______
‘বুঝলে রাহীলা, যা দেখছি দুদিন পর থালা নিয়ে পথে না বসতে হয় আমাদের।’
রাহীলা হকচকিয়ে উঠলেন। প্রশ্ন করলেন,
‘কেন কেন? কী হয়েছে?’
‘হওয়ার কী আর কিছু বাকি আছে? ঐ মেহতাবের উপর তো কোনো কালেই ভরসা ছিল না, ভেবেছিলাম রাদাভকে একটু বিশ্বাস করে যদি কিছু পায়। কিন্তু, এখন তো মনে হচ্ছে ঐ বেটাও ধূর্ত ভীষণ। আমাদের কিছুই দিবে না।’
রাহীলা নাক মুখ কুঁচকালেন। নিরস মুখে বললেন,
‘তা তো আমি আগেই জানতাম। যতই হোক দুই ভাই না, বৈশিষ্ট্য তো একই রকম হবেই।’
‘কিন্তু, এভাবে চলতে দিলে তো হবে না। কিছু একটা তো করতে হবে। নয়তো মেঝো ভাইজানরাও সব পেয়ে যাবেন, শেষে ফকির হয়ে বসে থাকব আমরা।’
রাহীলা ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘মেঝো ভাইজানকে কে কী দিবেন বলুন তো? উনার কোনো সন্তান আছে না কি যে কিছু পাবেন?’
মতিব মজুমদার নিভু সুরে বললেন,
‘আছে আছে।’
রাহীলা চমকালেন খুব। চেঁচিয়ে বললেন,
‘কী? কোথায়? আমি জানি না কেন?’
মতিব মজুমদার বিরক্ত হয়ে তাঁর মুখ চেপে বললেন,
‘আরে, আস্তে আস্তে। চেঁচালে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে যে।’
‘আচ্ছা আচ্ছা, চেঁচাব না। আপনি জলদি বলুন সব।’
‘বলছি। আসলে তুমি এই মহলের খবর অনেক কিছুই জানো না। কারণ তুমি এই মহলে এসেছ অনেক পরে। আমাদের বিয়ের আগেই অনেক কিছু ঘটে গিয়েছিল এখানে, যা তোমাকে কখনো জানানো হয়নি। প্রয়োজনও পড়েনি তাই। তবে আজ জেনে নেওয়া উচিত। মেহতাবের বউ তনুকা কিন্তু এই বাড়িরই মেয়ে। আমাদের মেঝো ভাই ভাবির একমাত্র মেয়ে। ওর যখন পনেরো কী ষোলো বছর বয়স তখন ওর একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল। ডাক্তার জানিয়েছিলেন, এক্সিডেন্টে ওর মস্তিষ্কে চাপ পড়াতে পুরনো সমস্ত স্মৃতি মুছে গিয়েছে। ওর চিকিৎসার প্রয়োজন। গ্রামে ভালো চিকিৎসা পাবে না বলে, ওকে সবাই মিলে ঢাকা তার মামার কাছে পাঠায়। তারপর থেকে সেখানেই বড়ো হয়েছে সে। কিন্তু, এত এত চিকিৎসা করেও স্মৃতি আর ফেরানো যায়নি। ডাক্তারও বলেছিলেন, কোনোপ্রকার চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। তাতে হিতে বিপরীত হয়ে মস্তিষ্ক একেবারেই বিকল হয়ে যেতে পারে। সেই ভয়ে পরিবারের কেউ তার সাথে কখনো কোনো যোগাযোগ রাখেনি। দূর থেকে খবর নিয়েছে কেবল। তবে এতকিছুর মাঝেও আমাদের জমিদার সাহেব তনুকা বলতে আধপাগল ছিলেন। ছোট থেকেই এই দূর্বলতা তার। তাই তনুকা বিদেশ থেকে পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরতেই একপ্রকার জেদ করেই তাকে বিয়ে করে এই বাড়িতে আনে। মেঝো ভাই ভাবি কিংবা বড়ো ভাবিও চাননি এই বিয়ে। কেবল মেহতাবের জোরের কারণেই হয়েছে সব। মেহতাব চেয়েছে, তনুকা পুরোনো পরিচয়ে নয় বরং নতুন পরিচয়ে এই বাড়িতে থাকুক। আর সেই জন্যই তো তার প্রতি জনাবের এত টান।’
রাহীলা দুই ঠোঁটের মাঝে দূরত্ব বেশ। তিনি মুখ বন্ধ করতে পারছে না। বিস্ময়ে চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গিয়েছেন যেন।
‘তাই তো বলি, মেঝো ভাবি সেই প্রথম থেকেই তনুকাকে কেমন আগলে আগলে রাখেন। আমি কিছু বলতে গিয়েও উনার জন্য পারতাম না, যেন তনুকার চেয়ে উনারই গায়ে লাগত বেশি। এখন বুঝলাম, মেয়ে বলেই এত ভালোবাসা।’
‘হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ।’
রাহীলার চোখ মুখ থমথমে হয়ে আসে। তিনি বিষন্ন সুরে বলে উঠেন,
‘তবে এখন কী করবেন? তনুকার মা বাবা হওয়ার সুবাদে উনারাও তো বেশ সম্পত্তি পেয়ে যাবেন। শেষে তো আমরা আর কিছুই পাব না।’
‘তাই তো ভাবছি, গিন্নি। খুব শীঘ্রই কিছু একটা করতে হবে। নয়তো আম আর ছালা দুটোই একসাথে হারাব।’
‘কী করবেন?’
মতিব মজুমদার গাল চুলকাতে চুলকাতে বললেন,
‘মেহতাবকে মে রে দিলে কেমন হয়?’
রাহীলা চকিত হয়ে বললেন,
‘আপনি পারবেন?’
মতিব মজুমদার হাসলেন। বললেন,
‘হ্যাঁ, পারব।’
‘কীভাবে?’
___________
বিকেল হয়ে এসেছে। সূর্যের তেজ কমেছে অনেকটা। বাগানে এখন সোনালী আলো। দক্ষিণের দিকটাই খানিক বাতাসও বইছে। বসার ঘরে বসে আছে সবাই। গম্ভীর ভাবমূর্তি। মেহতাব ঠিক মাঝের এক সোফাতে বসা। তার পাশেই বসেছেন আম্বিরা বেগম। বিস্ময়াবিষ্ট চোখে চেয়ে আছেন কেবল। সবকিছু এখনও তিনি ঠিক হজম করতে পারছেন না। কবে কখন হলো এসব? ইশফাক আর রেনুর বিয়ে? ঠিক মানতে পারছেন না তিনি। রেনুর আকুতি ভরা চোখ মুখের বাচন ইশফাককেও যেন তার ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে দিচ্ছে না। রাদাভ বলে উঠে,
‘সব ছেড়ে তোমার সামন্য এক সহকারীর সাথে বোনের বিয়ে দিবে, ভাইজান?’
প্রশ্ন শুনে মেহতাব চাইল তার দিকে। জিজ্ঞেস করল,
‘তাতে তোমার কোথায় সমস্যা হচ্ছে?’
রাদাভ বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,
‘আমাদের বোনের জন্য নিশ্চয়ই ছেলের অভাব পড়েনি তবে, এই সহকারী কেন?’
‘তারা একজন অন্যজনকে ভালোবাসে, তাই।’
রাদাভ কপাল কুঁচকে বলল,
‘ভালোবাসলেই কি সব হয়ে যায়? লেভেলের ও তো একটা ব্যাপার আছে; ওর সাথে কি আমাদের বোন যায়, বলো?’
রাদাভের কথা শুনে তনুকা হতভম্ব। যেন এটা আশাতীত ছিল তার নিকট। রাদাভের কাছে কি ভালোবাসার ঊর্ধ্বেও কোনো বস্তু আছে? তার কাছে ভালোবাসা এত ঠুনকো কী করে হতে পারে? ভালোবাসার প্রতি তার এই মনোভাব তনুকাকে ব্যথিত করে ভীষণ।
মেহতাব বলে,
‘আমার সিদ্ধান্ত আমি জানিয়েছি। আশা করছি, আমার কথার বিরুদ্ধে কেউ যাবে না।’
রাদাভ উঠে দাঁড়ায়। গর্জে উঠে বলে,
‘কেন, ভাইজান? সবসময় কেবল তোমার কথাই শুনতে হবে কেন? আমাদের কি মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই? তুমি রীতিমতো জুলুম শুরু করেছ আমাদের উপর। আর কত? এবার বন্ধ করো এসব।’
রাদাভের হুংকারে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে সকলে। কারোর মুখে কোনো রা নেই। নির্বাক নিষ্পলক চেয়ে আছে কেবল। ভাবছে, হয়তো এক্ষুনি মেহতাব এক টানে তার জিভ ছিড়ে নিয়ে আসবে। অথচ সবাইকে চমকে দিয়ে মেহতাব পূর্বের ন্যায় শান্ত হয়েই বসে রইল। বরং হাসল সে। বলল,
‘হঠাৎ এত রেগে গেলে যে? জীবনের মায়া বুঝি ফুরিয়ে গিয়েছে?’
‘ভয় দেখাচ্ছ আমায়?’
রাদাভ দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল। মেহতাব বিদ্রুপের সুরে বলে উঠল,
‘মেহতাব মজুমদার কাউকে ভয় দেখায় না, ভাই। ডিরেক্ট কাজ করে দেখায়। ভাই বলে সব সময় মাফ পেয়ে যাবে ভেবো না। আমার রাগ সম্পর্কে নিশ্চয়ই তোমার পরিপূর্ণ ধারণা আছে?’
রাদাভ দাঁত খিঁচে এমন ভাবে চাইল যেন, মেহতাবকে এখনই কাঁচা চিবিয়ে খাবে সে। মেহতাব ফের হাসল তা দেখে। বলল না আর কিছু। হালকা গলা ঝেরে বলল,
‘আগামী পরশু আমি রেনু আর ইশফাকের কাবিন করাব। কিছু গরীব দুঃখী খাইয়ে সবটা করব ভাবছি। বড়ো অনুষ্ঠান ভবিষ্যতে হবে। আপাতত রেনু এইটুকুতেই খুশি থাক।’
রেনু খুশিতে নাচতে পারলে বোধ হয় বাঁচত। কোনোরকমে নিজেকে শান্ত রেখে বলল,
‘এইটুকুতেই আমি ভীষণ খুশি, ভাইজান। আমার আর কিচ্ছু চাই না।’
মেহতাব প্রস্থান ঘটাল। মেহতাবের কথার উপর কথা বলার সাহস কারোর নেই। তাই পছন্দ না হলেও মেনে নিল সবাই। একে একে বেরিয়ে গেল তারা। রাদাভ ইশফাকের দিকে কটমট করে চেয়ে নিজের রাস্তা মাপল। দাঁড়িয়ে রইল তনুকা কেবল। রেনুর কাছে গিয়ে বলল,
‘চিন্তা নেই। তোমার ভাইজান যখন বলে দিয়েছেন বিয়ে তখন হবেই।’
রেনু উত্তরে হাসল কেবল। তনুকাও চলে গেল সেখান থেকে। রেনু ইশফাকের বরাবর দাঁড়াল। ক্ষীণ সুরে বলল,
‘ছোট ভাইজানের কথায় আপনি খুব কষ্ট পেয়েছেন, তাই না?’
ইশফাক চাইল। মৃদু হেসে বলল,
‘ভালোবাসলে এমন একটু আধটু কষ্ট সহ্য করে নিতেই হয়।’
রেনু আবেগাপ্লুত হয়ে বলল,
‘আই লাভ ইউ।’
ইশফাক সতর্ক দৃষ্টিতে আশপাশ দেখল, তারপর চোখ পাকিয়ে বলল,
‘বিয়ে পর্যন্ত ধৈর্য্য ধরা যাচ্ছে না? এখনই এত চেঁচিয়ে সব বলে দিতে হবে? আপনার ভাইজানদের ভরসা নেই, আমি আমার কক্ষে যাচ্ছি।’
ইশফাক দ্রুত পা চালাল। তার ব্যস্ততা দেখে হাসল রেনু।
_______
সন্ধ্যার নিভু নিভু আলোতে দেখা যাচ্ছে দুই ছায়ামূর্তিকে। কিছু একটা নিয়ে জরুরি আলাপ চলছে হয়তো তাদের মাঝে। ইশফাক বিকেলে এইদিকটাই এসেছিল। মেহতাবের দেওয়া কোনো এক কাজ সারতেই এইদিকে আসা তার। যাওয়ার পথে এই দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ায় সে। মানুষ দুটিকে চেনার জন্য আরেকটু এগিয়ে যায়। সন্ধ্যার মথিত আলোয় যদিও কিছু স্পষ্ট নয় তাও এক চেহারা দেখে চিনতে পেরেছে সে। চেনা মাত্রই চোখের দৃষ্টি আরো তীক্ষ্ণ হয় তার। লোক দুটির কথা শোনার চেষ্টা চালায়। গাছের আঁড়াল থেকে শোনা মুশকিল বেশ। কিন্তু, না শুনলে বিপদ হয়তো। ইশফাকের মন বলছে, লোকটার মাথায় ভয়ানক কিছু চলছে। আর তাঁর মাথায় ভয়ানক কিছু মানে মেহতাবের বিপদ। ইশফাক সেটা চায় না একদমই। তাই শুনতে হবে। কান খাড়া করতেই বেশ কয়েক লাইন তার কর্ণগোচর হয়। আর যতটুকু শুনেছে ততটুকুতেই বুঝেছে মেহতাবের সামনে ঘোর বিপদ। তাকে এক্ষুনি গিয়ে জানাতে হবে সবটা।
চলবে…..