#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৩।
আরেকটি নতুন সকাল, নতুন উন্মেষ। নতুন উদ্দীপনায় মজে উঠা প্রকৃতি আর তার সাথে এক গমগমে মহল। বিয়ের আমেজে রেনু মজেছে নতুন উৎসাহে। সে সেজেছে আজ, হলুদ শাড়িতে গা রাঙিয়েছে। গলায় আর কানে লাগিয়েছে কমলা রঙের ফুল। ঠোঁটে টকটকে লাল রঞ্জক। সুন্দর মোহনীয় লাগছে তাকে।
গায়ে হলুদ মাখিয়ে গোসল করিয়ে রেনুকে তার ঘরে নিয়ে এল তনুকা। সবকিছু রেনুর ইচ্ছেতেই হচ্ছে। সকাল থেকে বাড়িতে চাপা উত্তেজনা। হুট করেই রাত থেকে বাড়ির এক কর্তা উধাও। রাহীলার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। তিনি অস্থির চিত্তে সকলকে ঘটনাটা জানিয়েছেন। মেহতাব বলেছে, “কাকা কাজে গিয়েছেন, জলদি ফিরবেন।” রাহীলার যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। তাও রেনুর বিয়ের জন্য কোনোপ্রকার হৈ চৈও করতে পারছে না তিনি।
রেনু গোসল সেরে এসে তনুকার সামনে বসল। ইনিয়ে বিনিয়ে বলল,
‘ইশফাককে তো আর হলুদ দেওয়া হলো না, বউমনি।’
তনুকা ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘দিতে চাও?’
‘হ্যাঁ।’
‘ঠিক আছে, বাগানের পেছনে যাও। আমি তোমার ভাইজানকে দেখছি।’
রেনু অতি আগ্রহে দুলতে দুলতে বাগানের পেছনের দিকে যায়। বাড়ির বাকি সদস্যরা অন্যসব কাজে ব্যস্ত। এই সুযোগে তনুকাও বাইরে চলে আসে। মেহতাব হয়তো বিচার মহলে। তনুকা সেখানেই যায়। বিচার মহলে আজ বাইরের কেউ নেই। ভেতরে কেবল মেহতাব, ইশফাক, রাদাভ আর রমেজ মজুমদার। তনুকা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আসব?’
সকলের দৃষ্টি পড়ে তার উপর। মেহতাব ভ্রু কুঁচকে বলে,
‘হঠাৎ এখানে?’
তনুকা ইতস্তত বোধ করছে। তাও বলে,
‘না আসলে, ইশফাক ভাইকে ডাকতে এসেছিলাম।’
মেহতাবের ভ্রু যুগলের ভাঁজ দৃঢ় হলো। বলল,
‘ইশফাককে কী প্রয়োজন?’
‘প্রয়োজন ছিল। বাগানের ঐদিকে একটু কাজ আছে, উনাকে পাঠিয়ে দিন।’
মেহতাব সন্দিহান চোখে তনুকাকে অবলোকন করে বলল,
‘সেই কাজটা কি ইশফাককেই করতে হবে?’
তনুকা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,
‘জি।’
মেহতাব বিরক্ত বোধ করল। ইশফাকের দিকে চেয়ে বলল,
‘যাও ইশফাক।’
ইশফাক বেরিয়ে এল। তনুকা নিচু আওয়াজে বলল,
‘বাগানের পেছনে রেনু আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।’
কথাটা কেবল ইশফাকের কান অবধিই পৌঁছাল। ইশফাক আর দাঁড়াল না, দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে। মেহতাব তনুকার দিকে এক ধ্যানে চেয়ে বলল,
‘আর কিছু বলবে?’
তনুকা মৃদু হাসল। বলল,
‘আমি কি ভেতরে আসতে পারি?’
মেহতাব অনুমতি দেওয়ার আগেই রাদাভ হেসে হেসে বলল,
‘আপনার কি আর অনুমতি প্রয়োজন আছে? আপনার জন্য মহলের সমস্ত দ্বার সবসময় উন্মুক্ত, ভাবিজান।’
তনুকা হাসল রাদাভের কথায়। তবে মেহতাব দ্বিমত পোষণ করে বলল,
‘আমি তো তা বলিনি, রাদাভ। আমার অনুমতি ব্যতিত কেউই মহলে কোনো কাজ করতে পারবে না, এমন কী আমার বিবিজানও না।’
তনুকা কপাল গুটাল। বলল,
‘ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি আমি।’
মেহতাব আটকে বলল,
‘চলে যাওয়ার জন্যও অনুমতে দেয়নি। ভেতরে এসো, কিছুক্ষণ পর একজন আইনজীবী জমির দলিল নিয়ে আসবেন। আমি চাই, সবকিছু তোমার চোখের সামনেই হোক।’
তনুকা নিশ্চিন্ত হলো। অনাড়ম্বর গতিতে ভেতরে প্রবেশ করল। রাদাভের সাথে চোখে চোখ পড়তেই চোখ ফিরিয়ে নিল সে। মেহতাব বলল,
‘ঐদিকে বসো।’
তনুকা বসল এক কোণে। রমেজ মজুমদার প্রশ্ন করলেন,
‘তনুকা, তুমি হঠাৎ উত্তরের জমি দিয়ে কী করবে?’
তনুকা ভ্রু কুঁচকাল। মেহতাব সঙ্গে সঙ্গেই বলল,
‘সেই কৈফিয়ত তনুকা নিশ্চয়ই আপনাকে দিবে না, কাকা।’
রমেজ মজুমদার নাক মুখ কুঁচকে নিলেন। মেহতাবের কথা বলার ধরণ আহত করেছে তাঁকে। তিনি আর কথা বললেন না। কিছুক্ষণ বাদেই সেখানে এসে উপস্থিত হলেন একজন আইনজীবী। হাতে বেশ কয়েকটা কাগজের ফাইল। তিনি এসে জমির কাগজ পড়ে শুনালেন সবাইকে। তনুকা শুনে প্রতিক্রিয়া দেখাল না তেমন। মেহতাব জিজ্ঞেস করল,
‘সব ঠিক আছে, বিবিজান?’
তনুকা মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল। তবে বাঁধ সাধল রাদাভ। সে বলল,
‘ভাইজান, উত্তরের জমি তো ছয় বিঘা কিন্তু, কাগজে উল্লেখ করা হয়েছে পাঁচ বিঘা আর এক বিঘা জমি কেন বাকি রাখা হয়েছে? ঐটুকুও দিয়ে দাও। ঐ এক বিঘা জমি আর কী’ই বা কাজে আসবে।’
মেহতাব রাদাভের দিকে চেয়ে হাসল। বলল,
‘বাহ, তোর তো দেখছি হিসাব-নিকাষ একদম পাকা তবে, জমি তো নিচ্ছে তনু, তোর এই নিয়ে এত চিন্তা কেন?’
রাদাভ আচমকা চোরের মতো মুখ করে বলল,
‘না এমনি, আমি তো ভাবির কথা ভেবেই বলছিলাম।’
মেহতাব গম্ভীর স্বরে বলল,
‘তোর এতকিছু না ভাবলেও চলবে।’
মেহতাব দলিলে স্বাক্ষর দিল। উত্তরের পাঁচ বিঘা জমি আজ থেকে তনুকা। দলিলটা সযত্নে সে তনুকার হাতে তুলে দিল। হেসে বলল,
‘এই নাও তোমার জন্মদিনের উপহার, এবার খুশি তো?’
তনুকা জোরপূর্বক হেসে বলল,
‘জি।’
‘ঠিক আছে তবে, এখন মহলে ফিরে যাও। আর ইশফাককেও আসতে বলো।’
তনুকা অপ্রস্তুত বোধ করছে হঠাৎ। সে দলিল হাতে দ্রুত বিচার মহল ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। বাগানের পেছনে গিয়ে ডাকল,
‘রেনু, আছো?’
রেনু দ্রুত বেরিয়ে এল গাছের আঁড়াল থেকে। বলল,
‘হ্যাঁ, আমি এখানে।’
‘ইশফাক ভাইকে বিচার মহলে পাঠিয়ে দাও এবার।’
ইশফাকও ততক্ষণে আঁড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। তনুকাকে দেখে দ্রুত রুমালে মুখ মুছতে থাকে। লজ্জায় পড়েছে বেচারা। সংকোচ নিয়ে বলে,
‘এক্ষুনি যাচ্ছি, বউমনি।’
তনুকা মুখ টিপে হেসে বলে,
‘পাঞ্জাবীও তো ভরিয়ে ফেলেছেন, আপনার ভাইজান নির্ঘাত বুঝে ফেলবেন।’
ইশফাক বিস্ফোরিত চোখে চাইল রেনুর দিকে। খানিকটা ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
‘বিয়ের আগ অবধি ধৈর্য্য ধরতে পারছেন না কি? আপনার জন্য বোধ হয় বিয়ের আগেই প্রাণ যাবে আমার।’
ইশফাক দ্রুত তার চোখ, মুখ আর পাঞ্জাবী ডলতে আরম্ভ করল। সাথে পাও চালাল দ্রুত। মেহতাব বুঝতে পারলে তার আর রক্ষে নেই বোধ হয়। সে চলে যেতেই রেনু আর তনুকা এক সাথে হেসে ওঠল। রেনু হাসতে হাসতে বলল,
‘আজকে বেটাকে ইচ্ছে মতো জব্দ করেছি।’
তনুকাও হাসল। বলল,
‘তোমার জ্বালায় বেচারা একদম নাকানিচুবানি খাচ্ছে।’
‘ঠিক আছে একদম। নিরামিষকে আমিষ বানাতে আমারও কম কষ্ট পোহাতে হচ্ছে না।’
তনুকা রেনুর গাল টেনে বলল,
‘এত দুষ্টু হয়েছ না।’
রেনু দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
‘একটু দুষ্টামি না করলে কি হয়, বলো!’
‘হয়েছে হয়েছে, এখন মহলে চলো। কারোর নজরে পড়লে আবার আরেক বিপদ হবে।’
ননদের বিয়ে বলে তনুকার আজ একটু বেশিই ব্যস্ততা। কোমরে ওড়না গুঁজে সে কাজে নেমেছে। যদিও ঘরোয়া বিয়ে তাও তনুকা আয়োজনের কোনো কমতি রাখছে না। এতক্ষণ সে রেনুকে মেহেদী পরিয়ে দিচ্ছিল। এখন গিয়েছে রান্নার তদারকিতে। যদিও ভৃত্যের অভাব নেই, তাও তনুকা বেশ খোঁজ খবর রাখছে সবকিছুর। ননদের বিয়ে উপলক্ষে তার উৎসাহের শেষ নেই। তার অতি আগ্রহের আরেক কারণ হলো, দুই মানব মানবীর ভালোবাসার পূর্ণতা। তার না হোক, তার কাছের মানুষগুলোর তো হয়েছে।
হাতে মিষ্টির থালা নিয়ে আম্বিরা বেগমের ঘরের দিকে যাচ্ছিল তনুকা। তবে ঘরে প্রবেশ করার আগেই ওড়নায় টান পড়ে জোরে। তনুকা ভয়ে চকিতে তাকায়। ওড়নায় টান দেওয়া লোকটিকে দেখে ভ্রু কুঁচকায় সে। ইশারায় বোঝায়,
‘কী চাই?’
লোকটি ইশারায় বলে,
‘এক্ষুনি দুতালায় এসো।’
লোকটির এই মুহুর্তে দেখানো এইরকম তাড়া তনুকাকে ভীত করল। সে আম্বিরা বেগমের ঘরে মিষ্টির প্লেট রেখে দ্রুত বেরিয়ে এল সেই ঘর থেকে। অতঃপর দোতালায় গেল সে। মনে মনে ভয় পেলেও নিজেকে ধাতস্ত রাখার চেষ্টায় নিবদ্ধ। দুকদম এগিয়ে যেতেই এক জোড়া হাত তার কোমর জড়িয়ে নিল। তনুকা ভয়ে গলা চেপে ধরল তার। ফিসফিসিয়ে বলল,
‘কী করছ, পাগল হয়েছ না কি?’
কোমরে হাতের চাপ বাড়ল। কন্ঠস্বর চওড়া করে সে বলল,
‘ঐ এক বিঘা জমি ছাড়লে কেন? আমার ঐ এক বিঘা জমিও চাই।’
চলবে….
#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৪।
‘তোমার তো আগে এত লোভ ছিল না, এখন কেন এমন করছো?’
লোকটা ম্লান সুরে বলল,
‘আগে বোকা ছিলাম, সুইটহার্ট; কিন্তু, এখন…এখন আমার সব চাই।’
তনুকা ফিরে চাইল। নিজেকে ছাড়াল তার কাছ থেকে। বিষন্ন সুরে বলল,
‘তোমার লোভ আমাদের আলাদা করে দিবে যে। আমাদের এত বছরের ভালোবাসা।’
তনুকা থামল। গলা ধরে আসছে তার। তার প্রিয় মানুষটা হাত রাখল তার গালে। গলার স্বর নরম করল। বলল,
‘ভালোবাসা ছাড়া জীবন চললেও টাকা ছাড়া জীবন চলে না, প্রিয়।’
‘তারমানে আমাকে ছাড়াও জীবন চলবে তোমার?’
সে হাসল। তনুকা বিরক্ত হলো এতে। সে নিশ্চয়ই হাসির কথা বলেনি তবে, হাসবে কেন? তনুকা রাশভারী স্বরে বলল,
‘সামান্য এক জমির অজুহাতে আমাদের এত বছরের ভালোবাসা শেষ হয়ে যাক তা আমি চাই না। তাই অনুরোধ করছি, এত লোভ করো না।’
তার প্রাণপ্রিয় মানুষটি জবাব দিল না। তনুকার কথা আদৌ সে মস্তিষ্কে ধারণ করল কি না তা নিয়েও যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে। তনুকা ফের কিছু বলার আগেই চলে গেল সে। তনুকার মনঃক্ষুন্ন হলো। আজ এত বছর পর মনে হলো, ভালোবেসে ভুল করেনি তো? এত বছর যাবত যাকে ভালোবেসে এসেছে, সে আবার কোনো ভুল মানুষ নয়তো? চিন্তা হলো তার। গন্তব্যের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে আবার না গতি হারায় সে, তখন গভীর স্রোতে তলিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় থাকবে না।
মেহতাব ঘরে ফিরে। তনুকা সব কাজ সেরে উপরে আসে আরো কিছুক্ষণ বাদে। ততক্ষণে মেহতাব শুয়ে পড়েছে। তনুকা হাত মুখ ধুয়ে এসে মেহতাবের পাশে বসে। কপালে হাত ঠেকিয়ে শুয়ে আছে মেহতাব। ঘুমাচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। তনুকা তটস্থ চিত্তে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। মেহতাবের উল্টো দিকে ফিরে শুয়েছে সে। চোখে ঘুম নেই, মনটা অস্থির। কিছুক্ষণ বাদেই কোমরের উপর উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে কিঞ্চিৎ পেছন ফিরে বলল,
‘ঘুমাননি এখনো?’
‘না।’
তনুকা আর প্রশ্ন করল না। মেহতাব নিজের মতো আগলে নিল তাকে। কাঁধে মাথা গুঁজে বলল,
‘বিবিজান, তোমাকে একটা গোপন কথা বলব?’
গোপন কথা শোনার আগ্রহ সবারই আছে। তনুকা তাই সঙ্গে সঙ্গেই বলল,
‘কী?’
‘আমাকে মা রার উপায় বলব?’
আচমকা এমন কথায় অপ্রস্তুত হলো তনুকা। ইতস্তত সুরে বলল,
‘হঠাৎ এসব বলছেন কেন?’
মেহতাব হাসল, তবে বোঝা গেল না। বলল,
‘মানুষকে মা রার সবথেকে বড়ো উপায় হলো তার দূর্বলতম জায়গাটাতে আঘাত করা। আমার দূর্বলতম জায়গাটা কী তুমি জানো?’
তনুকা জানে না। জানার আগ্রহ বোধ করল। জিজ্ঞেস করল,
‘কী?’
‘তুমি।’
মেহতাবের সহজ স্বীকারোক্তি। তনুকা ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করল,
‘আমি?’
‘হ্যাঁ, আমার প্রাণভোমরা তুমি। যাকে আঘাত করলে তার কষ্ট আমাকে সহ্য করতে হবে।’
তনুকার বুকে ব্যথা করে। এই যাতনার কারণ অন্বেষণে ব্যর্থ সে। তবে এইটুকু বোঝে, মেহতাবের এসব কথা বড্ড পোড়াচ্ছে তাকে। সে অস্ফুট স্বরে বলে উঠে,
‘এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে।’
মেহতাব তার হাতের বাঁধন দৃঢ় করে। তনুকার ঘাড়ে নাক ঘষে বলে,
‘আমার থেকে কি কিছু লুকাচ্ছো তুমি, বিবিজান? ভয় পেও না, আমাকে বলতে পারো।’
‘না না, কী লুকাব আমি? কিচ্ছু লুকানোর নেই। আপনি অযথা এত ভাবছেন। ঘুমিয়ে পড়ুন দয়া করে।’
তনুকা তার অস্থিরতা লাঘবের চেষ্টা চালায়। মেহতাব তাও ধরতে পারে সব। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলে,
‘সময় থাকতে সময়ের মূল্য দিতে হয়, তেমনি মানুষ থাকতে মানুষের। হারিয়ে ফেলার পর আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না যে।’
‘কেন এসব বলছেন? আমার এসব শুনতে ভালো লাগছে না।’
মেহতাব তার মাথায় হাত রাখল। নরম সুরে বলল,
‘আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়ো তবে।’
তনুকা চোখ বোজল। মেহতাব হাত বুলাতে আরম্ভ করল তার চুলে। যতক্ষণ পর্যন্ত না তনুকা পুরোপুরি ঘুমাল ততক্ষণ পর্যন্ত মেহতাব তার হাত বুলানো জারি রাখল। অতঃপর তনুকা ঘুমে বিভোর হবার পর সেও শুয়ে পড়ল তার জায়গায়। চোখ রাখল মাথার উপর সিলিং-এ। ভাবল, জীবন কত বৈচিত্র্যময়; যে চায় সে পায় না, আর যে চায় না তার আবার অভাব থাকে না।
______
সকাল সকাল শুরু হলো সব প্রস্তুতি। রেনু কোনোরকমে নাস্তা সেরেই বলল, তনুকার হাতে সাজবে সে। তনুকাও তাই আর বিলম্ব করল না। হাতের কাজ সব দ্রুত সেরে রেনুকে নিয়ে সাজাতে বসল।
‘ভাবি, আসব?’
‘কে, রাহীলা?’
‘জি।’
‘আয়।’
রাহীলা প্রবেশ করল ভেতরে। চোখে মুখে উদ্বিগ্নের ছাপ তাঁর। বিয়ে বিষয়ক কোনো ফূর্তির ছিটে ফোটাও নেই। স্বামী নিয়ে বোধ হয় বেশিই চিন্তিত। আম্বিরা বেগম বললেন,
‘কিছু বলবি?’
‘তোমার দেবর কোথায় গিয়েছে তুমি কি জানো?’
‘সেটা আমি জানব কী করে?’
‘তোমার ছেলে নিশ্চয়ই জানে।পরশু থেকে উনার কোনো খোঁজ নেই, তোমার ছেলে জানিয়েছে কাজে গিয়েছে; কাজে গেলে কি নিজের ফোনটাও ধরবে না? কোনো খোঁজ দিবে না আমাকে? আজ অবধি হয়েছে এমন?’
আম্বিরা বেগম কপাল গুটিয়ে বললেন,
‘সেসব আমাকে বলে কী হবে, ছোটো? মেহতাব কাজে পাঠিয়েছে যখন ওকে গিয়ে বল।’
রাহীলা বোধ হয় জ্বলে ওঠলেন। বাজখাঁই স্বরে বললেন,
‘তোমার ছেলেকে দিয়ে তো ভরসা নেই কোনো। যে ছেলে বাপকে মা রতে পারে তার আবার কাকাকে মা রতে কতক্ষণ?’
আম্বিরা বেগম হকচকিয়ে উঠলেন। বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে বললেন,
‘কী বললি?’
রাহীলা থতমত খেল। রাগের মাথায় ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে সে। ঢোক গিলে বলল,
‘না কিছুনা। যাচ্ছি আমি, পারলে মেহতাবের কাছ থেকে আমার স্বামীর একটু খোঁজ এনে দিও।’
রাহীলা দ্রুত ঘর ছাড়ল তাঁর। আম্বিরা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন। মনে মনে পরিকল্পনা করে নিলেন পরবর্তীতে কী কী করতে হবে।
_____
রেনুর সাজ শেষ। ইশফাক তার জন্য টুকটুকে লাল রঙ এর একটা শাড়ি এনেছে। সেই শাড়ি গায়ে বউ সাজে অপূর্ব লাগছে তাকে। তনুকা তার কপালে চুমু খেয়ে বলল,
‘তোমাকে চমৎকার লাগছে, রেনু।’
লজ্জায় আরক্ত হলো রেনুর গাল যুগল। মাথা নোয়াল। তনুকা হেসে বলল,
‘ইশ, কী লজ্জা মেয়ের! আজ রাতেই তো সব লজ্জার অবসান হবে, তখন কী করবে শুনি?’
রেনু লজ্জায় দু হাতে মুখ লুকাল। তনুকা শব্দ করে হেসে ফেলল তা দেখে। পরক্ষণেই রেনু আবার মাথা তুলে বলল,
‘এই বউমনি, তোমার বাসর রাতের গল্পটা আমাকে বলো না। তাহলে আমি আগে থেকেই সব জেনে বুঝে প্রস্তুত হয়ে থাকতে পারব।’
তনুকা হাসি থামায় তখন। বাসর রাত বলতে জীবনে কিছু এসেছে নাকি তার? যা এসেছে তা এক বিদঘুটে রজনী ছাড়া আর কিছুই না। সেই কুৎসিত মুহূর্তের কুৎসিত অনুভূতিগুলো কি আর মুখে বলার মতো? তনুকা তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে মেকি হেসে বলে,
‘ওসব বলা যায় নাকি! আমার লজ্জা করে।’
রেনু ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
‘তাই বুঝি? ভাইজান কি এখনো সব লজ্জার অবসান ঘটাতে পারেননি?’
তনুকা বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে রেনুর গাল টেনে বলল,
‘কী অসভ্য মেয়ে দেখছ! ভাইজানকে বলব এসব?’
‘বলো গিয়ে। আমি আর এখন কাউকে ভয় পাই না, আমার এখন জামাই আছে।’
রেনুর কথা বলার ধরণ দেখে হেসে ফেলল তনুকা।
বিয়ে পড়ানো শেষ। এই প্রথম কোনো মেয়ে বোধ হয় হাসতে হাসতে কবুল বলেছে। গ্রামের কয়জন মানুষ খাইয়ে ছোট পরিসরে সম্পন্ন হয়েছে সব। মেহতাব তার বোন জামাইকে সাদরে গ্রহণ করেছে। বুকে জড়িয়ে কোলাকুলি করেছে। গলা থেকে নিজ চেইন খুলে পরিয়ে দিয়েছে তাকে। এসব কিছু ইশফাকের কাছে মরীচিকার ন্যায় বোধ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এসব তার চোখের ভুল, একটু পরেই হারিয়ে যাবে সব। তবে, বধূ বেশে যখন ছোট্ট রেনুকে দেখল, তখন বিশ্বাস করল, না আজ সত্যিই বিয়ে করেছে সে। এই ছোট্ট লাল টুকটুকে পরীটা তার বউ, তার অর্ধাঙ্গিনী, তার একমাত্র প্রিয় নারী।
ইশফাক আর রেনুকে বাসর ঘরে দিয়ে এসে বসার ঘরে সোফায় বসল তনুকা। মেহতাব মহলে নেই। বাইরে কোথায় গিয়েছে সে জানে না। বাকি সবাই যার যার মতো নিজ কাজে ব্যস্ত। তনুকার আজকের মতো সব দায়িত্ব শেষ। বড়ো ভাবি হিসেবে খুব খেটেছে সে। আর শেষ পর্যন্ত এক জোড়া ভালোবাসার মানুষের মিলন দেখে তৃপ্তও হয়েছে অনেক। খুশ মেজাজেই ভাবল, এক কাপ চা খেয়ে আনন্দটা আরো উপভোগ করা যাবে। সেই ভেবে দ্রুত রান্নাঘরে যায়। চায়ের পাতিলে পানি ফুটতে বসায়। আচমকা তখন ঘাড়ে কিছুর স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে সে। পেছন ফিরে মানুষটাকে দেখে এবার ঘাবড়েও যায়। চিন্তিত সুরে বলে উঠে,
‘তুমি এই সময় এখানে কী করছো?’
তার প্রশ্নকে সম্পূর্ণ ভাবে উপেক্ষা করে মানুষটা তার অতি নিকটে এসে দাঁড়ায়। হাত দিয়ে গলার কাছটা স্পর্শ করে। অন্য হাত রাখে কোমরে। তনুকা অস্থির হয়ে ওঠে। ভীত সুরে বলে,
‘কেউ দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। প্লিজ, যাও এখান থেকে।’
শুনল না তার সতর্ক বাণী। মুখটা কাছে এনে বলল,
‘তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে, তনু।’
তনুকা ঢোক গিলে। ভয় হচ্ছে তার। কেউ দেখে ফেললে যে আর রক্ষে নেই। সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। তবে সেই ব্যক্তি যেন তাকে ছাড়তে নারাজ। হাতের আঙ্গুল তনুকার ঠোঁটের উপর রেখে বলে,
‘আমার অধিকারে ঐ মেহতাব মজুমদার হস্তক্ষেপ করেনি তো?’
তনুকা কাঁপা ঠোঁটে বলে,
‘না, করেনি।’
হাসে সে। তার ঠোঁট যুগল এগিয়ে আনে। অপ্রিতভ এক শঙ্কায় প্রচন্ড সংকুচিত হয়ে পড়ে তনুকা। উত্তেজিত হয়ে বলে,
‘কী করছো?’
সে জবাব দেয় না। এগিয়ে আসা বিদ্যমান রাখে। তনুকার সহ্য হচ্ছে না। সে এমনটা চায়ছে না। যখন বুঝল দূরত্ব আর বেশি নেই, তখন আর উপায়ান্তর না পেয়ে নিজের সবটুকু দিয়ে সে ধাক্কা মে রে বসল তাকে। তনুকার কাছ থেকে বাঁধা পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল মানুষটা। এগিয়ে এসে কিছু বলার আগেই শোনা গেল এক গম্ভীর স্বর। মেহতাব তখনই শুধাল,
‘তুই এখানে কী করছিস, রাদাভ?’
চলবে…..