#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৫।
মেহতাবকে দেখে পিলে চমকে উঠল তনুকার। অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল তার। ভয়ে বিচার বুদ্ধি সব খুইয়ে বসল যেন। কী বলবে, কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। গলা শুকিয়ে ওঠেছে, মাথাটাও ঘুরছে ভীষণ। রাদাভ সরে দাঁড়াল। ঢোক গিলল সেও। হ্যাঁ, সেও ভীত খুব। রান্নাঘরে প্রবেশ করল মেহতাব। তনুকা আর রাদাভকে আপাদমস্তক পরখ করে ফের প্রশ্ন করল,
‘রান্নাঘরে তোর কী, রাদাভ? কিছু প্রয়োজন হলে তনুকাকে বলতে পারতি, তুই কেন আসতে গেলি?’
তনুকা আর রাদাভ দুজনে এবার আরেক দফা চমকাল। ভাবল, মেহতাব কিচ্ছু টের পায়নি? রাদাভ মাথা চুলকে কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলল,
‘ভাবিকে একটু চা বানানোর কথা বলতে এসেছিলাম।’
‘ওহ আচ্ছা। বলেছিস?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বলে দিয়েছি।’
‘ঠিক আছে, যা তুই।’
রাদাভ রান্নাঘর থেকে বের হয়। মেহতাব তনুকার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তনুকার চোখে মুখে এখনো ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। ধরা পড়া চোরের মতো মুখ চুপসে আছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মেহতাব আঙ্গুলের ঢগা দিয়ে সেটা মুছে দেয়। হেসে বলে,
‘ভয় পাচ্ছো কেন? আমি তোমাকে সন্দেহ করছি না।’
তনুকা ফ্যালফ্যাল করে চাইল। মেহতাবের সন্দেহ না করাটাই এখন তাকে আরো ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। সে আর অন্য প্রশ্ন করার সাহস পেল না। মাথা নুইয়ে কেবল জিজ্ঞেস করল,
‘আপনি কি চা খাবেন?’
মেহতাব হাসল। বলল,
‘না। তুমি ঘরে যাও। আজ আমি তোমাদের জন্য চা বানাব।’
তনুকার বিস্ময়ের রাশি যেন আজ পিছু’ই ছাড়ছে না। সে বিস্ময়াবিষ্ট সুরে বলল,
‘আপনি?’
‘হ্যাঁ, তোমার হাতের স্পেশাল চা’টা তো আর খাওয়ালে না; তাই ভাবলাম, আমি বরং আমার স্পেশাল চা’টাই খাওয়াই। কী বলো!’
তনুকার হতভম্ব, হতবিহ্বল দৃষ্টি। মেহতাব তার গালে হাত রেখে বলল,
‘আমাকে কি বিশ্বাস করতে পারছ না?’
তনুকা পরপর মাথা ঝাঁকাল। হ্যাঁ সূচক জবাব পেয়ে হাসল মেহতাব। বলল,
‘তবে ঘরে গিয়ে বসো, আমি আসছি।’
তনুকা বিলম্ব করল না আর। কোনোপ্রকার বাঁধাও দিল না। সে সোজা চলে এল নিজের ঘরে। চিন্তা আর ভয়ে হাত পা এখনো কাঁপছে তার। মেহতাব কি কিছুই বোঝেনি? কিছু না বোঝাতে যেন এখন আরো দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার। তনুকা হাত কচলাচ্ছে। নাকের ঢগার লবনাক্ত কণাগুলো যেন চিকচিক করছে। কিছুক্ষণ পায়চারি করে শান্ত হয়ে বিছানায় বসে। না না, এবার আর দেরি করা চলবে না। এদিকের কাজ দ্রুত সেরে পালাতে হবে।
তার ভাবনার ছন্দ পতন ঘটিয়ে আবির্ভাব ঘটে মেহতাবের। সে হেসে এগিয়ে দেয় তার এক হাত। হাতের গোলাপী রঙের কাপটা থেকে ধোঁয়া উড়ছে। তনুকা সেটা গ্রহণ করে। মেহতাব তার পাশে বসে। বলে,
‘তোমার দেবরকে এক কাপ দিয়ে এসেছি।’
তারপর চায়ের কাপে সে ঠোঁট লাগায়। তনুকা বিভোর অন্য চিন্তায়। হাতের চা কাপটা অতি অবহেলায় পড়ে আছে। মেহতাব সেটা খেয়াল করে জিজ্ঞেস করে,
‘খাচ্ছো না কেন?’
তনুকা তার দিকে ফিরে হাসার চেষ্টা করে বলল,
‘না, এই তো খাচ্ছি।’
তনুকা এক চুমুক খেল। মেহতাব উৎসাহ সমেত জিজ্ঞেস করল,
‘কেমন হয়েছে?’
তনুকা মেকি হেসে বলল,
‘ভালো।’
মেহতাবও জবাবে হাসল কেবল। তারপর দুজনেই চুপচাপ পুরো গ্লাসের চা’টা শেষ করল। চা শেষ করে উঠে দাঁড়াল তনুকা। বলল,
‘আমি বিছানা করে দিচ্ছি, শুয়ে পড়ুন।’
বিছানা করার পর শুয়ে পড়ল দুজন। আর কোনো কথা হলো না। একই বিছানায় দুই প্রান্তে দুই মানব মানবী। অন্তরে বিস্তর এক ঝড় বইছে দুজনেরই। এই ঝড়ের শেষ কোথায় কেউ জানে না। কতটা তান্ডব ঘটিয়ে এর অবসান ঘটবে সেই সম্পর্কেও কেউ অবগত নয়। তবে এইটুকু আন্দাজ করা যায় যে, সবকিছু বিনাশ করার আগ পর্যন্ত এই ঝড় থামবার নয়, বরং ক্রমে ক্রমে তা প্রলয়ংকারীর রূপ ধারণ করছে।
আজ পূর্ণিমা নয়। সাধারণ স্বচ্ছ অন্তরীক্ষে ওঠেছে এক অর্ধবৃত্ত চন্দ্রিমা। অথচ সেই অর্ধবৃত্ত চন্দ্রিমাই যেন আজ অধিক প্রকট হয়ে ওঠেছে, তার মোহনীয় চাহনিতে ঝলসে দিচ্ছে চারদিক। কিন্তু, চমৎকার ব্যাপার হলো, এই নিখুঁত সুন্দর দৃশ্যটা দুজন প্রেমাসক্ত যুগল ছাড়া আর কারোরই চোখে পড়ছে না। ব্যাপারটা অতিশয় আশ্চর্যজনক! তারা একই চাদরে নিজেদের বেষ্টন করে চন্দ্রিমা দেখায় মগ্ন। কী নিরুপম সুন্দর এই চাঁদ তবে, অবশ্যই তার প্রেয়সীর থেকে অধিক নয়।
ইশফাক বলল,
‘চাঁদ সুন্দর তবে, তার থেকেও অধিক সুন্দর আমার এই ছোট্ট লাল পরী।’
লজ্জায় মারা যাওয়া গেলে বোধ হয় রেনু এখনই মারা যেত। মুখে চাদর টেনে ইশফাকের বুকে মুখ গুঁজে বলল,
‘ঘুমান তো, আমার ঘুম পাচ্ছে।’
ইশফাক হেসে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘এত রাত আমাকে জ্বালিয়ে আজকের রাতে নিজে মাফ পাওয়ার কথা কী করে ভাবছ, মেয়ে? আজ সব সুদে আসলে উশুর করে তবেই ছাড়ব।’
_______
সকাল হলো। অন্যদিনের মতোই প্রকৃতি তার নিজস্ব কাজে ব্যস্ত। ঘড়িতে এগারোটা বেজে দশ মিনিট। বিচার মহলে মেহতাব। তার ঠিক মুখ বরাবর রাদাভ বসা। একা সে। সে আর মেহতাব ব্যতিত আজ বিচার মহলে কেউ নেই, ইশফাকও না। রাদাভের চোখে মুখে ভয় আর সংশয়। মেহতাবের আচরণ সুবিধার না। পকেটে ছু ড়ি গুঁজা আছে তার। উল্টা পাল্টা কিছু হলেই, ভাইয়ের বক্ষ ছেদ করতে একবারও হাত কাঁপবে না তার।
তনুকা মিষ্টির প্লেটটা ইশফাকের সামনে রেখে আস্তে করে বলল,
‘একবার বিচার মহলে যাবেন, ভাইয়া? মেহতাব রাদাভ ভাইয়ের সাথে একা ওখানে কী করছেন?’
ইশফাক ম্লান সুরে বলল,
‘ভাইজানের হুকুম না আসা অবধি আমি যেতে পারব না, বউমনি। ভাইজান নারাজ হবেন।’
তনুকা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। যবে থেকেই দুজন একা বিচার মহলে গিয়েছে তবে থেকেই দুশ্চিন্তায় বক্ষঃস্থল কাঁপছে তার। না জানি ভেতরে কী হচ্ছে। তনুকাও এখন বাইরে যেতে পারবে না। বাড়ির কেউই না। সবার জন্য সাফ বারণ। দরজার অভিমুখে পাহারাদারও বসিয়েছে মেহতাব। আজ হঠাৎ এত আয়োজন কেন? এইসব কিছু অস্থির করে তুলেছে তনুকাকে। সে কোনোকিছু করেও শান্তি পাচ্ছে না। মনটা এক তীব্র আশঙ্কায় বারবার ছলকে ওঠছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি সব শেষ; এই বুঝি জীবনের শেষ সময় ঘনিয়ে এল তাদের।
_____
‘ভাইজান, কী বলবে বলো?’
মেহতাব তার হাতের কাগজগুলো সামনের টেবিলে রাখল। চোখ মুখ কুঁচকান তার। মুখ দেখে অন্তঃকরণে অবস্থা ঠাহর করা সম্ভব না। তাও রাদাভ তার অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা চালাচ্ছে। মেহতাব সামনের দিকে চাইল। তার একমাত্র ভাইয়ের দিকে। একই মায়ের পেটের ভাই দুজন। শরীরে একই বাবার রক্ত। অথচ, কত বিবাদ। মেহতাব জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। নিজেকে প্রস্তুত করে সব বলার জন্য। গম্ভীর, রাশভারী স্বরে অতঃপর সে বলে উঠে,
‘রাদাভ, তোকে আমি দুইটা অপশন দিব, তোর কাছে সুযোগ থাকবে যেকোনো একটা বেছে নেওয়ার। আর এই দুই অপশনের মাঝে যেটা তুই বেছে নিবি, সঙ্গে সঙ্গেই সেই জিনিস তোর হবে। তাই যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভেবে চিন্তে নিবি।’
মেহতাবের কথা শুনে রাদাভ আরো চিন্তায় ডুবল। হঠাৎ এই অপশন চয়েজের খেলায় কেন মেতেছে মেহতাব মজুমদার? কী চায় সে? রাদাভকে নির্বাক দেখে ভ্রু কুঁচকায় মেহতাব। বলে,
‘আজ চুপ থাকলে কিন্তু তোর’ই লস হবে। তাই বলছি, ভেবে চিন্তে উত্তর দিবি।’
‘কী অপশন, ভাইজান? আর হঠাৎ এসব অপশনের কথা আসছে কোথ থেকে?’
মেহতাব টেবিলে রাখা কাগজগুলো রাদাভের দিকে এগিয়ে দেয়। রাদাভ সেটা দেখে জিজ্ঞেস করে,
‘কী এগুলো?’
‘আমার এই যাবত অবধি কামানো সকল অর্থ বিত্ত জমি জমা সবকিছুর দলিল, তার সাথে আব্বাজানের সমস্ত সম্পত্তি যেগুলো বর্তমানে আমার নামে আছে, এই সবকিছুর দলিল এখানে আছে।’
রাদাভ হকচকিয়ে ওঠে। হতভম্ব হয়ে বলে,
‘এগুলো দিয়ে কী হবে, ভাইজান?’
মেহতাব গলার স্বর দৃঢ় করল। বলল,
‘তোর কাছে দুটো অপশন, রাদাভ; হয় এই সমস্ত সম্পত্তি নিজের নামে করে নিয়ে তনুকে ছেড়ে দিবি আর না হয় সম্পত্তিহীন শূণ্য পকেটে তুই তনুকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাবি। এবার ভেবে দেখ, কোন অপশনটা বেছে নিবি; তোর উপর কোনো চাপ নেই। আস্তে ধীরে ভেবে তবেই জানা আমায়।’
চলবে….
#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৬।
রাদাভ নির্বাক। মেহতাবের কথাগুলো সমস্ত মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ চালাচ্ছে তার। আদৌ সে ঠিক শুনছে তো? নাকি সবটাই তার ভুল?
মেহতাব তার বসা চেয়াটাতে আরাম করে বসল। চোখ মুখের অভিব্যক্তি স্বাভাবিক রেখে বলল,
‘আর কতক্ষণ সময় লাগবে, রাদাভ?’
রাদাভ চাইল। ভাবছে এখনো। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। মেহতাবের মনে কী চলছে সেই সম্পর্কেও অবগত নয় সে। তাই ভয় পাচ্ছে। মেহতাব এত সহজেই ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়। যেহেতু সে সব জানে সেহেতু এত সহজে সে ছাড় দিবে না। তবে, এই অপশন চয়েজের খেলাতেই বা কেন মেতেছে সে?
রাদাভ ভীত সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘তুমি এসব কী বলছো, ভাইজান?’
মেহতাব হাসল। বলল,
‘তুই কি সত্যিই কিছু বুঝতে পারছিস না?’
রাদাভ মাথা নোয়াল। ইতস্তত বোধ করছে সে। মেহতাব কখন আর কী করে জানল সব? কে জানাল? মেহতাব বলল,
‘এত সময় নিলে তো হবে না। বলে ফেল, কোন অপশনটা বেছে নিতে চাস তুই?’
রাদাভ চোখ তুলে চাইল। সাহস করে বলল,
‘তুমি সত্যি বলছ, আমি যেটা চাইব নির্দ্বিধায় তুমি সেটা দিবে আমায়?’
‘অবশ্যই। মেহতাব মজুমদার তার কথার খেলাপ করে না, এটা তুই খুব ভালো করেই জানিস।’
রাদাভ নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ হিসাব কষল, কোনটা পেলে অধিক লাভ হবে তার। অতঃপর গলা ঝেরে বলল,
‘আমার সম্পত্তি চাই, ভাইজান। তোমার আর আব্বাজানের সমস্ত সম্পত্তি চাই আমার।’
মেহতাব ঠোঁট প্রসারিত করে হাসল। উত্তর তার আগেই জানা ছিল। তাই তো সব ব্যবস্থা করে রেখে দিয়েছে। সে বলল,
‘ঠিক আছে। অপেক্ষা কর, এই একই কথাটা তুই এখন তনুর সামনেও বলবি।’
রাদাভ এবার নড়ে চড়ে ওঠল। মনে মনে তো অন্য চিন্তা ছিল তার। তনুকা এই মুহুর্তে এসব শুনলে তো তার পরিকল্পনা আর সফল হবে না। তাই সে অস্থির সুরে বলল,
‘তনুকাকে না মানে ভাবিকে এখন এখানে আনার কী দরকার?’
মেহতাব বলল,
‘অবশ্যই দরকার। তনুর নিজের কানে তার প্রেমিকের বক্তব্য শোনা উচিত।’
রাদাভ রেগে গেলেও প্রকাশ করল না। ভাবল, তনুকাকে হারালে আর আফসোস নেই, এই এত এত সম্পত্তি যে তার হতে চলেছে।
মেহতাব মহলে লোক পাঠাল। তনুকাকে নিয়ে আসা হলো পনেরো মিনিটের ভেতর। চিন্তায় তনুকার পেটে মোচড় দিচ্ছে। মেহতাবের এই আচানক আহ্বান তাকে আরো বেশি সংকুচিত করে তুলছে যেন।
মেহতাবের সম্মুখে সে। মেহতাব বলল,
‘বসো।’
তনুকা অপ্রস্তুত ভঙিতে একটা চেয়ারে বসল। তার সামনেই একটা চেয়ারে রাদাভ বসা। চোখের দৃষ্টি তার জমিনে। এখানে কী কী ঘটেছে সে সম্পর্কে তনুকার কোনো ধারণা নেই। তবে, রাদাভকে দেখে ভয়ের মাত্রা তড়ান্নিত হয়েছে তার। বেশ বুঝতে পারছে, মারাত্মক কিছু একটা ঘটেছে।
মেহতাব এক পল সময় নিয়ে বলল,
‘তনু, আমি রাদাভকে দুটো অপশন দিয়েছিলাম। বলেছিলাম সে যেটা বেছে নিবে সেটাই তার হবে। রাদাভ তার মধ্যে একটা অপশন বেছে নিয়েছে, এখন শর্ত মোতাবেক সেই জিনিসটা আমি তার হাতে তুলেও দিব। তবে, এইসবের মাঝে তোমার উপস্থিতিটা খুব প্রয়োজন ছিল। তাই তোমাকে এখানে ডাকা হয়েছে।’
তনুকার মাথার উপর দিয়ে গেল সব। কীসের অপশন, কীসের শর্ত? মেহতাবের কথা তার বোধগম্য নয়। সে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে রাদাভকে দেখল। সে এখনো নিচের দিকেই চেয়ে আছে। চোখ মুখ অপরাধীর ন্যায়।
মেহতাব বলল,
‘আমি জানি, তুমি কিছুই বুঝতে পারছ না। অপেক্ষা করো, সব বুঝতে পারবে। তার আগে তোমাকে অপশন দুটোর কথা বলে নেই। রাদাভকে দেওয়া আমার প্রথম অপশন হলো, আমার আর আব্বাজানের সমস্ত সম্পত্তি নিজের নামে করিয়ে নিয়ে তোমাকে ছেড়ে দেওয়া আর দ্বিতীয় অপশন হলো, কোনো সম্পত্তি ছাড়া একেবারে শূণ্য পকেটে কেবলমাত্র তোমার হাত ধরে এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া। এই দুটোর মধ্যে রাদাভ কোনটা বেছে নিয়েছে জানো? প্রথমটা। রাদাভ তোমাকে নয়, আমার সম্পত্তিকে বেছে নিয়েছে, তনু।’
সব শুনে কিছুক্ষণের জন্য নিশ্বাস ফেলতে ভুলে গেল তনুকা। মনে হলো মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। কী আশ্চর্য! মেহতাব সব জানে! আর সে এত বড়ো একটা সুযোগ দেওয়ার পরেও রাদাভ তাকে না বেছে সম্পত্তিকে বেছে নিয়েছে? এই ছিল তার এত বছরের ভালোবাসার প্রতিদান?
তনুকা কথা হারাল। বাকরুদ্ধ সে। ক্ষণে ক্ষণে নিশ্বাস ফেলছে কেবল। ততক্ষণে আবার বুকে এক তীব্র ব্যথা দেখা দিয়েছে তার। সে রাদাভের দিকে চাইল ফিরে। রাদাভ এখনো আগের মতোই বসা। মেহতাব জিজ্ঞেস করল,
‘তোমাদের কত বছরের সম্পর্ক ছিল?’
তনুকা নিষ্প্রাণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কেবল। রাদাভও উত্তর দিল না কোনো। মেহতাব কপাল কুঁচকে বলল,
‘আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি। চুপ কেন, উত্তর দাও।’
তনুকা তখন ম্লান সুরে বলল,
‘সেই ছোট্ট বেলা থেকে। যখন বলে ভালোবাসা বুঝতে শিখেছি, তখন থেকে।’
মেহতাব বড়ো নিশ্বাস ফেলল। বলল,
‘কখনো বলোনি কেন?’
‘মা বাবা তো জানতেন সব, তাই তো এত আয়োজন করে মিথ্যে বলে মামার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।’
‘তার মানে ঐ সবকিছু নাটক ছিল? তুমি বরাবরই সুস্থ ছিলে?’
আর কী লুকাবে সে? সব তো এবার শেষের পথে। তাই বিনা দ্বিধায় সে বলল,
‘হ্যাঁ, সবকিছু মিথ্যে ছিল। নাটক ছিল সবকিছু।’
‘এত বড়ো ছলনা করতে ভয় করল না?’
‘না।’
‘আজকে যদি তার শাস্তি স্বরূপ আমি তোমাকে মে রে ফেলি?’
‘মে রে ফেলুন। এমনিতেও আমি আর বাঁচতে চাই না। কার জন্য বাঁচব? কীসের জন্য বাঁচব আমি? মিথ্যে ভালোবাসার আশায় বাঁচার চেয়ে ম রে যাওয়া শ্রেয়।’
তনুকা নিশ্বাস ছাড়ল। বুকটা কেমন ভার ভার লাগছে তার। শরীরটা অসাড় লাগছে। মনে হচ্ছে দম আটকে আসছে যেন। এটা কি ম রে যাওয়ার আগ মুহূর্ত, তাই কি এত কষ্ট হচ্ছে?
মেহতাব নিরুত্তাপ। এই যে এত ভয়ানক বিদঘুটে কিছু সত্যির মুখোমুখি সে অথচ, কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই তার মাঝে। যেন, এই সবকিছু হওয়ারই ছিল।
মেহতাব প্রশ্ন করল,
‘তবে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলে কেন?’
তনুকা এই পর্যায়ে ফের রাদাভকে দেখে। এবার তার সাথে চোখে চোখ পড়ে তার। তনুকা চোয়াল শক্ত করে ফেলে। ক্ষিপ্ত হয়ে বলে উঠে,
‘সবকিছু রাদাভের পরিকল্পনা ছিল। আপনার সম্পত্তি পাওয়ার লোভে এইসব কিছু করেছে সে। আর আমিও তার ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে এসব কিছু করতে রাজি হয়েছি। এখন ভাবতেই কষ্ট লাগছে, আমি এই জঘন্য মানুষটাকে এত বছর যাবত ভালোবাসে এসেছি।’
তনুকা গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। রাদাভ “টু” শব্দটিও করে না। যেন আজ বোবা সে। মেহতাব বলে,
‘এই মহলের প্রত্যেকটা মানুষ আমার সাথে প্রতারণা করেছে। আমার চোখের আঁড়ালে অনেক কিছু ঘটিয়েছ তোমরা। এবার সবকিছু অবসানের পালা, শাস্তির পালা। আমি কাউকে ক্ষমা করব না, তনু। কাউকে না।’
তনু নিশ্চল ভঙিতে বসে রইল। কিছু কানে যাচ্ছে না তার। চিত্ত জুড়ে যে দাবানল বইছে সেটাই তো শেষ করতে পারছে না সে, আবার এসবে মনোযোগ দিবে কী করে?
রাদাভ এতক্ষণে কিছু বলার সাহস করে। সে মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে,
‘ভাইজান, তুমি বলেছিলে কথার খেলাপ করবে না। এখন কি সম্পত্তি পাব না আমি?’
মেহতাব প্রচন্ড শব্দ তুলে হাসল। এমন হাসির শব্দে বুকে মোচড় দিল রাদাভের। সে কিছু বলার আগেই কিছু একটা ঘটে গেল। কী ঘটল অকস্মাৎ বুঝল না সে। এক পল বাদেই বুকের ঠিক মাঝ বরাবর অনুভব করল তীব্র এক ব্যথা। আর তার সাথে সাথেই টকটকে লাল রঙের এক তরল জাতীয় পদার্থে শার্ট ভিজে উঠল তার। যখনই বুকের মাঝে আটকানো ধারালো জিনিসটা চোখে পড়ল তখনই বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠল সে। তার চিৎকারে সম্বিৎ ফেরে তনুকার। রক্তাক্ত রাদাভকে দেখে বুক কেঁপে উঠে তার। ভয়ে সিঁটিয়ে যায় যেন। কী হয়ে গেল ভাবতেই সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠল। একটু পরেই মেঝেতে ঢলে পড়ল রাদাভ। মেহতাব চোয়াল শক্ত করে বলল,
‘ইশফাক, জানো য়ারটাকে ভেতরে নিয়ে রেখে এসো।’
চলবে….