প্রাণেশ্বর পর্ব-৫৭+৫৮

0
392

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৭।

তনুকা থমথমে স্বরে বলল,

‘আপনি ওকে মে রে দিলেন?’

মেহতাব তার দিকে চেয়ে জবাবে বলল,

‘প্রতারকদের বাঁচিয়ে রাখতে নেই।’

তনুকা বসা থেকে উঠে গিয়ে মেহতাবের মুখোমুখি হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর আস্তে করে তার মুখটা এগিয়ে নিয়ে রাখল মেহতাবের হাঁটুর উপর। মেহতাব ভ্রু কুঁচকাল। তনুকা ঢোক গিলে বলল,

‘তবে তো আপনারও বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই, মেহতাব মজুমদার।’

মেহতাবের ভ্রু জোড়ার ভাঁজ আরো দৃঢ় হলো। তনুকার অভিব্যক্তি এখন সে বুঝতে পারছে না। বলল,

‘আমাকে তো বেঁচে থাকতেই হবে, বিবিজান। তোমার জন্য বেঁচে থাকতে হবে।’

তনুকা মাথা তুলল। আচমকা হেসে উঠল সে। ঠিক যেন উন্মাদ দেখাল তাকে। হাসতে হাসতে বলল,

‘আমার জন্য বাঁচবেন? না কি আমাকে মা রার জন্য?’

মেহতাবও হাসল এবার। প্রত্যুত্তর করল,

‘তা অবশ্য ঠিক বলেছ, মৃত্যু তো তোমার আমার হাতেই।’

‘তাহলে এখন কেন মেরে ফেলছেন না, সময় দিলে হয়তো পালিয়েও যেতে পারি।’

মেহতাব বিদ্রুপের সুরে বলল,

‘তুমি পালাবে না কখনোই, আমি জানি।’

তনুকা চোয়াল শক্ত করল। বলল,

‘ঠিক বলেছেন, আমি পালাব না, পালাবেন আপনি। অনেক হয়েছে, এবার সবাই দেখবে আপনার আসল রূপ। গ্রামবাসীদের সাথে করা এত এত দিনের অভিনয়ের সমাপ্তি আজই ঘটবে।’

তনুকা ফোঁস ফোঁস করছে। মেহতাব কিঞ্চিৎ হেসে বলল,

‘আমাকে ভয় দেখাচ্ছ, বিবিজান?’

তনুকা তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

‘একদমই না।’

তারপর সে উঠে দাঁড়াল। খানিকটা পিছিয়ে গেল। অতঃপর শব্দ করে ডাকল,

‘ইশফাক ভাইজান।’

ইশফাক পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। এক কোণে দাঁড়ায় সে। মেহতাব কপাল কুঁচকায়। তনুকা ইশফাকের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। স্মিত সুরে বলে,

‘আর ভয় পাবেন না, ভাইজান। আজ এই জমিদারের মুখোশ খুলব আমরা।’

মেহতাব ফ্যালফ্যাল করে চাইল। উঠে দাঁড়াল সে। জিজ্ঞেস করল,

‘এসব কী হচ্ছে, ইশফাক?’

ইশফাক জোরে নিশ্বাস ফেলল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ভীত সন্ত্রস্ত। তনুকা বলল,

‘ভাইজান, বলুন। আজ আর চুপ থাকবেন না।’

মেহতাব ক্ষুব্ধ হয়ে শুধাল,

‘তনু তোমাকে ভাইজান বলে কেন ডাকছে, ইশফাক?’

ইশফাক মাথা নোয়াল। মৃদু সুরে বলল,

‘কারণ, ও আমার বোন।’

মেহতাব হকচকিয়ে ওঠে। ঠোঁট যুগল আপনা আপনি ফাঁক হয়ে যায় তার। বুঝতে সময় লাগে। মস্তিষ্কের নিউরনগুলো জেগে উঠে তীব্র ভাবে। স্নায়ু জুড়ে একটাই কথা ছুটে চলছে কেবল, “তনুকা আর ইশফাক ভাইবোন?”

মেহতাবকে চমকাতে দেখে হাসে তনুকা। চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কী ব্যাপার, মেহতাব মজুমদার? মুখ থেকে কোনো কথা বের হচ্ছে না যে? বিশ্বাস হচ্ছে না, তাই না? কিন্তু, এটাই সত্যি। আমি, তনুকা মজুমদার ইশফাক মজুমদারের বোন। আর ইশফাক মজুমদার হলো রমেজ মজুমদার আর ঊর্মি মজুমদারের একমাত্র ছেলে।’

মেহতাব ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে। হাতলে হাত রেখে মাথা চেপে ধরে। বিধ্বস্ত সুরে বলে উঠে,

‘তুমিও আমায় ঠকালে, ইশফাক?’

ইশফাক চাইল। বলল,

‘ঠকিয়েছি? কই না তো। আমি তো কেবল আমার সাথে হয়ে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিশোধ নিয়েছি। সম্পত্তি দেওয়ার ভয়ে, জমিদারী হারানোর ভয়ে আমার জন্মের পরই আমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন আপনার বাবা, মোহন লাল মজুমদার। আমার বাবা খুব কষ্ট করে সবার আঁড়াল থেকে বাঁচিয়েছিলেন আমাকে। মামার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর বোঝার বয়স হতেই মিথ্যে নাটক সাজিয়ে আমাকে আবার এই মহলে ফিরিয়ে আনেন। তারপর আপনার বাবা আর আপনি মিলে আমাকে বানিয়ে দিলেন আপনাদের দাস। আর আমিও সেই সুযোগটা নিলাম। আপনাদের বিশ্বাস অর্জন করলাম। আপনার প্রতিটা অন্যায়ের স্বাক্ষী হলাম। আর সবথেকে বড়ো শোধ তো তুলতে পেরেছি আপনার বোনকে বিয়ে করে। এবার খেলা ঘুরে গিয়েছে, মেহতাব মজুমদার। অনেক চাল চেলেছেন, এবার চাল দেওয়ার পালা কেবল আমাদের।’

মেহতাব হতবিহ্বল, হতভম্ব, নিশ্চুপ হয়ে শুনল সব। পরিশেষে এইটুকুই বলল,

‘এসবের জন্য আমার ছোট্ট বোনটাকে কষ্ট দিও না, ইশফাক। ও যে নিষ্পাপ।’

‘নিষ্পাপ তো আমি আর আমার বোনও ছিলাম। কিন্তু, এই মহলে আমাদের এই নিষ্পাপ সত্ত্বার কোনো দাম ছিল না। সবকিছু কেবল ছিল আপনাদের। এই জমিদারী, এই সম্পত্তি, এই যশ প্রতিপত্তি, সম্মান, সুখ শান্তি, সব আপনাদের ছিল। আমরা কিছুই পাইনি। পেয়েছি কেবল, অবহেলা, দুঃখ কষ্ট আর লাঞ্ছনা। এতকিছুর পরেও আপনাদের কী করে ছাড় দেই বলুন তো?’

‘তুমি এত নিঁখুত অভিনয় করতে পারো, ইশফাক? অথচ আমি অন্ধ বিশ্বাসটা তোমাকেই করেছিলাম।’

ইশফাক হাসল। জোরে নিশ্বাস ফেলল সে। এতদিনে মনের বোঝা হালকা হয়েছে তার। তিল তিল করে জমিয়ে রাখা সমস্ত আক্রোশ আজ মেটাবে সে। নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল,

‘আপনার থেকেই শিখেছি, কীভাবে নিঁখুত অভিনয় করতে হয়। বোনকেও তাই শিখিয়েছি। আর আপনি জানলে খুশি হবেন যে, আমার বোন মানে আপনার বিবিজান কিন্তু রাদাভকেও ভালোবাসেনি। রাদাভকে ও কেবল ব্যবহার করেছে, আপনার মুখোশ উন্মোচনের জন্য।’

মেহতাব তনুকার দিকে চাইল। তনুকার ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি, যেন মেহতাবের পরাজয় তাকে ভীষণ সুখ দিচ্ছে। মেহতাব বলল,

‘এতটা প্রতারণা না করলেও পারতে। তোমাদের মা রতে যে আমার বড্ড কষ্ট হবে।’

তনুকা আর ইশফাক মুখ চাওয়া চাওয়ি করে হাসল। তনুকা বলল,

‘কে কাকে মা রবে তা তো একটু পরেই বোঝা যাবে, মেহতাব মজুমদার। এখন আমাদের কথা না ভেবে নিজের চিন্তা করুন, গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষের কাছে আপনার করা অন্যায়ের ফুটেজ চলে গিয়েছে। পুলিশকেও খবর দেওয়া হয়েছে। এই হাতে এত খু ন করেও আফসোস মেটেনি আপনার? আরো খু নের কথা ভাবছেন? আর কী যেন বলছিলেন, প্রতারণার কথা? আপনি তো আমাদের চেয়েও বড়ো প্রতারক, ক্ষমতার লোভে নিজের বাবা আর কাকাকেও ছাড়লেন না, মা’কেও জালিম বানিয়ে ছাড়লেন। আপনাকে হারানোর জন্য নিজের মামাকে অবধি বলি দিতে হলো আমাদের। তার উপর গ্রামের অসহায় মানুষদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে যে মানুষের মাংস খাওয়ালেন, সেগুলো বুঝি প্রতারণার মধ্যে পড়ে না, মেহতাব মজুমদার?’

মেহতাব হেসে বলল,

‘বাহ, সব জানো দেখছি।’

‘অবশ্যই। জানতে তো হতোই, না জানলে আপনার মুখোশ উন্মোচন করতাম কী করে, বলুন?’

মেহতাব ঠোঁট কামড়ে হাসল। কী যেন ভাবল সাথে। বলল,

‘আচ্ছা বিবিজান, তুমি সকালের নাস্তা করেছ এক ঘন্টার উপর হয়ে গিয়েছে না?’

প্রশ্ন শুনে ভ্রু কুঁচকাল তনুকা। হঠাৎ লোকটা এমন অপ্রাসঙ্গিক কথা বলছে কেন? তনুকা জবাব দিল না। মেহতাব নিজের হাতের ঘড়ির দিকে চেয়ে সময় মেলাল। বলল,

‘হ্যাঁ, এক থেকে দেড় ঘন্টা তো হয়ে গিয়েছি। তবে এখনো…’

থামল মেহতাব। তনুকা ভ্রু কুঁচকে অদ্ভুত ভাবে চেয়ে আছে। মেহতাব কী বলতে চাইছে? কিছুক্ষণ আগে বুকে ব্যথা করছিল তার। হ্যাঁ, এখন আবার জ্বালাপোড়া করছে। এতকিছুর মাঝে খেয়াল’ই করেনি সে। তনুকা বুকের উপর হাত রাখে, ড্যাবড্যাব করে তাকায় মেহতাবের দিকে। মেহতাবের ঠোঁটের কোণে ম্লান হাস্যরেখা ভয় পাইয়ে দেয় তাকে। মেহতাব উঠে আসে। তনুকার ঠিক মুখ বরাবর দাঁড়াল সে। তনুকার গলা জ্বলছে। শ্বাস ফেলতে কষ্ট হচ্ছে তার। ইশফাক মেহতাবকে দেখে বিরক্ত হলো। তবে সে কিছু বলার আগেই মেহতাব তার পেট বরাবর ঢুকিয়ে দিল ধারালো ছুড়ি খানা। চোখের পলকে ঘটে গেল সবকিছু। ইশফাক হতভম্ব হয়ে চাইল তার পেটের দিকে। তনুকার কষ্ট হচ্ছে তাও চেঁচিয়ে উঠল সে। ধরার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল ইশফাক। তনুকার নিশ্বাস আটকে আসছে। প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে তার। মাটিতে পড়ে থাকা ভাইয়ের শরীরের ছটফটানো আরো বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। তনুকা গলা ফাটিয়ে চিৎকার দেয়,

‘কেউ কি নেই এখানে? বাঁচাও আমাদের?’

মেহতাব হাসে। তনুকার গালে হাত রেখে বলে,

‘কেউ আসবে না, বিবিজান। কেউ আসবে না। আমি না চাওয়া অবধি এই কক্ষের ভেতর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।’

চলবে….

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৮।

বুকের জ্বালাপোড়া তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। তনুকার সহ্য সীমানার বাইরে গেল তা। সে দু হাতে গলা চেপে ধরে বলল,

‘আপনি আমায় বিষ দিয়েছেন, মেহতাব?’

মেহতাব হাসল। সেই হাসিতে মোটেও খুশি দেখা গেল না। করুন আর হতাশ দেখাল বরং। বলল,

‘বাধ্য করেছ তুমি। প্রতারককে কী করে বাঁচিয়ে রাখি, বলো?’

‘তবে আপনি কেন বেঁচে আছেন?’

তনুকা বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেলছে। নিশ্বাস আটকে আসছে তার। মনে হচ্ছে যেন, শরীরের স্নায়ুগুলো সব ধীরে ধীরে কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে। তার গলার স্বর নিভু হয়ে আসে। মেহতাব দু হাতে আগলে ধরে তাকে। কাছে টেনে নেয়। তনুকার চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। মেহতাব তার গালে হাত রাখে। অসহায় সুরে বলে,

‘তুমি কি মা রা যাচ্ছো, বিবিজান?’

তনুকা চোখের পাতা ঝাপটে তাকায়। শরীরের শক্তিগুলো ধীরে ধীরে মিইয়ে আসছে এবার। সে এক হাতে মেহতাবের পাঞ্জাবীর কলারটা চেপে ধরে। রুদ্ধশ্বাস স্বরে বলে,

‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, মেহতাব।’

মেহতাব সঙ্গে সঙ্গে বুকে জড়িয়ে নেয় তাকে। মাথাটা চেপে ধরে বুকের মাঝখানে। বক্ষঃস্থলের কম্পন বাড়ে তার। ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে বলে,

‘আমারও যে খুব কষ্ট হচ্ছে, বিবিজান। খুউব। তোমার মৃত্যু যন্ত্রণা আমাকে উন্মাদ করে তুলছে। কিন্তু, কী করব বলো? তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতাম কার জন্য? যেখানে মেহতাব মজুমদার থাকবে না সেখানে তনুকার মজুমদারের বাঁচারও কোনো অধিকার নেই। আমাকে ক্ষমা করো, বিবিজান। তোমাকে না মে রে আমার আর কোনো উপায় ছিল না।’

তনুকার কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। পরিবেশটা কেমন যেন গুমোট নিস্তব্ধ। মেহতাবের বুকে আচমকা মোচড় দিল। সে তনুকাকে হালকা ঝাঁকিয়ে বলল,

‘বিবি, এই বিবি, কথা বলছো না যে? মা রা গেলে? এত তাড়াতাড়ি চলে গেলে?’

তনুকা নীরব, নির্বাক। মেহতাব সামনে টেনে ধরে তাকে। দেখে, চোখের পাতা নিমীলিত। মুখে কোনো রা নেই। শরীরটা কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা হয়ে এসেছে যেন। মেহতাব ড্যাবড্যাব করে কিছুক্ষণ চেয়ে দেখে তাকে। তারপর মেঝেতে শুইয়ে দেয়। মাথার চুলে আঙ্গুল ডুবিয়ে বলে,

‘মা রা গেলে, বিবিজান? আমার জন্য অপেক্ষা করতে পারলে না? এত তাড়া তোমার?’

মেহতাব অন্য হাতে তখন তার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা ছোট্ট শিশি বের করে আনে। শিশির গায়ে লেখা, “অ্যাব্রিন”। শিশিটাতে অর্ধেকের মতো তরল পদার্থ পড়ে আছে। মেহতাব সঙ্গে সঙ্গেই খেয়ে ফেলে সেটা। তারপর শিশিটা দূরে ছুড়ে মারে। হাসে সে। তনুকার একটা হাত চেপে ধরে বসে। নিষ্পলক তনুকার পানে চেয়ে বলে,

‘আমার সবকিছু মিথ্যে হলেও আমার ভালোবাসায় কোনো মিথ্যে ছিল না, বিবিজান। তুমি চাইলেই সবটা অন্যরকম হতে পারতো। তুমি চাইলেই আমাদের সুন্দর একটা জীবন হতো। কিন্তু আফসোস! তুমি তা চাওনি। তুমি চেয়েছ কেবল আমার পরাজয়। দেখো বিবি, আজ আমি পরাজিত। শূণ্য হাতে, শূণ্য মনে তোমার শিউরে বসে আছি। কিচ্ছু নেই আমার, কিচ্ছু না। অথচ তুমি চাইলেই থাকতে পারতে, তুমি চাইলেই আমাদের একটা ছোট্ট সংসার হতে পারতো। কিন্তু আফসোস বিবি, তুমি চাওনি। কেন চাইলে না? কেন? এত এত প্রতারণা, এত এত ধোকাবাজী, এত এত শঠতার মাঝেও যেটা সত্য ছিল, তা হলো আমার ভালোবাসা। এই ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না, বিবিজান। অথচ তুমি বুঝলেই না। কী নিষ্ঠুর তুমি, বিবিজান! কী নিষ্ঠুর!’

মেহতাবের রাগ হলো খুব। প্রচন্ড রাগে উন্মাদ হয়ে উঠল যেন। ইশফাকের পেট থেকে টান দিয়ে ছুড়িটা বের করে তনুকার গলা বরাবর টান বসাল। সঙ্গে সঙ্গেই ফিনকি দিয়ে র ক্তের স্রোত বইতে আরম্ভ করল তার। মেহতাব ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠল। বীভৎস সুরে চেঁচিয়ে বলতে আরম্ভ করল,

‘কেন এত নিষ্ঠুর তুমি, বিবিজান? কেন? কেন আমায় ঠকালে? কেন প্রতারণা করলে? তুমি চাইলেই তো একটা অন্যরকম জীবন হতো আমাদের। কিন্তু, তুমি চাইলে না। এত নির্দয়, নিষ্ঠুর কী করে হতে পারলে তুমি? কী করে?’

থামল মেহতাব। দম আটকে আসছে তারও। গলা ধরে আসছে। বমি বমিও পাচ্ছে যেন। মেহতাব জোরে নিশ্বাস ফেলল। তারপর শান্ত কন্ঠে বলল,

‘আমায় একটুখানি ভালোবাসলে কী ক্ষতি হতো, বিবিজান? একটুখানি ভালোবাসাই তো চেয়েছিলাম, তাও দিলে না তুমি। তাহলে তোমার আর বেঁচে থেকে কী লাভ? তাই তো মে রে দিয়েছি। ভালো করেছি না, বলো?’

মেহতাব আচমকা শব্দ করে হাসতে আরম্ভ করল। হাসতে হাসতেই তনুকার বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল সে। তারপর মিইয়ে যাওয়া সুরে বলল,

‘আমি তোমায় ভালোবাসি, বিবিজান। প্রচন্ড ভালোবাসি। জান্নাতে তো আর দুজনের ঠাই হবে না, জাহান্নামেই না হয় আবার দেখা হবে। তুমি অপেক্ষা করো কিন্তু। সেখানে গিয়ে রাদাভকে পেয়ে আবার আমাকে ভুলে যেও না। আমি আসছি।’

অতঃপর মেহতাব চোখ বুজল।

_______

‘একটা অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষকে কোনোপ্রকার চিকিৎসা না করিয়ে আপনারা তাকে ক্ষমতা দিয়ে বসিয়ে দিলেন? আর সে কি না এতদিন ধরে এত জঘন্য সব কাজ করে এসেছে! আমাদেরও বোকা বানিয়েছে! আপনি তো সুস্থ ছিলেন তবে, আপনি কেন লুকিয়ে গিয়েছেন এসব?’

আম্বিরা বেগম মাথা নুয়ালেন। ঢোক গিললেন তিনি। এতদিন ধরে ছেলের সাথে মিলে তিনিও কম অন্যায় করেননি। আজ সেসবের বোঝা’ই বহন করতে হবে তাকে। অফিসার টেবিলে বারি মেরে বলে ওঠলেন,

‘চুপ করে আছেন কেন? কথা বলুন, কেন করেছেন এসব?’

আম্বিরা বেগম জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালেন। বললেন,

‘সম্পত্তির লোভ আমারও ছিল। আর তার সাথে ছিল মেহতাবের প্রতি ভয়। ও পাগল ছিল, মানুষকে ভয়ংকর ভাবে খু ন করত। নিজের বাবাকে দিনের পর দিন ঔষধ খাইয়ে মে রেছে। ওকে এসবে সাহায্য করতে বাধ্য করেছিল আমায়। আমিও সম্পত্তি পাওয়ার লোভে ওর কথাই শুনে গিয়েছি, নয়তো আমিও কবে মা রা পড়তাম, কে জানে।’

‘তবে ইশফাককে কেন মে রে ফেলতে চেয়েছিলেন?’

আম্বিরা বেগম ইতস্তত সুরে বললেন,

‘মেহতাব হবার এক বছর পরই ইশফাক হয়। ওর জন্মের পরই আমি আর আমার স্বামী এই ভেবে ভীত হয় যে, আমাদের জমিদারী না ওদের হাতে চলে যায়। যেহেতু ছেলে সন্তান, মেঝো ভাই নিশ্চয়ই তাকে এনে আমাদের সামনে দাঁড় করাতেন। তাই পথের কাটা সরাতেই তাকে মেরে ফেলার কথা ভাবি। তবে, মেহতাবের সহকারী’ই যে মেঝো ভাইয়ের ছেলে সেটা আমরা ক্ষুনাক্ষরেও টের পায়নি কখনো। পেলে তো মেহতাব আরো আগেই মে রে ফেলত তাকে।’

‘চুপ করুন।’

ধমকে ওঠে অফিসার। আম্বিরা বেগম চুপ হয়ে যান। অফিসার মেহতাবের রিপোর্টগুলো উল্টে পাল্টে দেখে বলেন,

‘মেহতাব মজুমদার কি মানসিক ভাবে অসুস্থ এমনি এমনি হয়েছেন? না কি এর পেছনেও কোনো কারণ আছে?’

আম্বিরা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

‘সবকিছু হয়েছে ওর বাবার জন্য। মোহন লাল মজুমদার নিজেও ভালো মানুষ ছিলেন না, তিনিও এই গ্রামের মানুষদের সাথে অনেক অন্যায় করেছেন। মানুষের মাংস রেঁধে খাওয়ানো তো উনার থেকেই শিখেছে মেহতাব। মেহতাবের এই চরম অবনতির পেছনে একমাত্র তিনিই দায়ী। ছেলেকে অমানুষ বানিয়েছেন তিনি। শেষে নিজের ছেলের হাতে খু ন হয়ে তবেই এই পাপের প্রায়াশ্চিত্ত করেছেন। ছোট বেলা থেকে খু ন, মানুষের র ক্ত, মাংস নিয়ে হাতাহাতি করতে করতে মেহতাবের এসব স্বভাবে পরিণত হয়ে যায়। প্রতি সপ্তাহে একটা করে মানুষ খু ন না করে থাকতে পারত না। নিঁখুত ভাবে সেই খু নকে আবার ধামাচাপাও দিয়ে দিত। কেউ টের পেত না সেটা। এই সব কিছু সে তার বাবার কাছ থেকেই শিখেছে। বাবার জন্যই সে একটা জানো য়ারে পরিণত হয়েছিল। কাউকে মা রতে দুবার ভাবত না। আর আজ দেখুন, এসবের কী ভয়ংকর পরিণতি হয়েছে।’

আম্বিরা বেগম আঁচলে চোখ মুছলেন। কষ্ট তারও হচ্ছে। যতই লোভী হোক না কেন, শুরুতে তিনিও চেয়েছিলেন একটা স্বাভাবিক সুন্দর জীবন। কিন্তু স্বামীর জন্য পারেননি তা, পরবর্তীতে ছেলেও তার সেই জীবনের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই তিনিও বাধ্য হয়ে একেবারে সেই জঘন্য পথটাই বেছে নেন। নিজের স্বামীর মৃত্যুর কারণ হোন। এত অন্যায় চোখের সামনে দেখেও চুপ থাকেন, শুধু একটু সম্পত্তি আর জীবনের লোভে।’

চলবে…