প্রাণোদাহ পর্ব-১৪+১৫

0
531

#প্রাণোদাহ
|১৪+১৫|
– নবনীতা শেখ

-“নতুন কেউ এসেছে?”

নক্ষত্র ওপর নিচ একবার মাথা নেড়ে বলল,
-“হ্যাঁ।”

অতসীর হাসি ভয়াবহ করুণ শোনাল। হাসতে হাসতে চোখের কোণে জল চলে এলো, গলার আওয়াজে শোনা গেল নিজের প্রতি ভীষণ চাপা ক্ষোভ,
-“তুমি আমার সবক্ষেত্রেই কী বিচ্ছিরি এক ভুল, নক্ষত্র! তোমার জন্য আত্মসম্মানের অবশিষ্টাংশও আমি আজ হারালাম। অতিশোকে লোকে নাকি পাথর হয়ে যায়, আর আমার হাসিই থামছে না। আহ নক্ষত্র, তুমি আমার এ কী দশা করে ছাড়লে!”

নক্ষত্র অনুতপ্ত হলো। নতমুখী হয়ে অতসীর ঠিক পাশে বসে রইল। অতসী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। ভুলক্রমেও আর তাকাল না নক্ষত্রের দিকে।

নক্ষত্র প্রসঙ্গ পালটাতে বলল,
-“তোমার বাংলা অনেক বেটার হয়েছে।”
-“হ্যাঁ, জানি। প্রাক্টিস করছি যে।”
-“হঠাৎ বাংলায় আগ্রহ?”
-“আমার প্রতি যেই মানুষটার চরম আগ্রহ, তার আবার বাংলায় আগ্রহ। তাই আর কী।”

নক্ষত্র বার বার অপ্রস্তুত হচ্ছে। অতসী বলল,
-“তোমার গ্র‍্যাজুয়েশন শেষ হয়নি?”
-“উঁহু। এক্সাম চলছে।”
-“কোন ইউনিভার্সিটিতে আছো?”
-“নর্থসাউথে।”
-“সাবজেক্ট?”
-“ফিজিক্স।”

অতসী কিঞ্চিৎ বিস্ময় নিয়ে এবার জানতে চাইল,
-“তোমার না বুয়েটে হয়েছিল?”
-“হ্যাঁ।”
-“পড়োনি কেন?”
-“আত্মগ্লানিতে।”
-“আত্মগ্লানি?”
-“কাইন্ড অভ শেইমনেস, নিজের প্রতি।”
-“আমি জানি গাঁধা, আত্মগ্লানির অর্থ। আমি এটার কারণ জানতে চাইছি।”
-“কোনো কারণ নেই।”
-“কোনো কারণ না থাকলে মানুষ স্বপ্নপূরণের সুযোগ পেয়েও ছেড়ে দেয় না। তুমি কত পরিশ্রম করেছ, কেউ না জানলেও আমি জানি, আমি দেখেছি। এসব ভংচং তুমি আমাকে বোঝাতে এসো না।”

নক্ষত্র প্রসঙ্গক্রমে এক খণ্ড হাসল,
-“আমার ফ্রেন্ড হবে, অতসী?”

অতসী স্বস্তি পেল,
-“কেন নয়? ইউ আর মাই টাইপ..”

এটুকু বলার পর দুইজনেই হাসল। মনে পড়ে গেল অতীত, চোখের সামনে ভেসে উঠল ছয় বছর আগের সেই সংঘর্ষ। আঠারো-উনিশের দ্বারে দাঁড়িয়ে, অনুভূতিহীন দুই হৃদয় একে-অন্যের সাথে জড়াতে উন্মুখ হয়েছিল। সেই হৃদয় দুটো ঠিক ক’টা মাস পর থেকেই একে-অন্যের বিপরীত রাস্তা বেছে নিল। আজ তারা দুইজন ঠিক বিপরীত শীর্ষে, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বন্ধুদের প্রস্তাবনা রাখছে।

________
প্রীতির সাথে নক্ষত্রের দেখা হলো পরদিন সন্ধ্যায়। নক্ষত্র পড়াতে এসেছে। আগামীকাল এক্সাম আছে, অথচ সে এখন প্রীতির বাসায়। কারণ মেয়েটাকে না দেখে সে স্বস্তিতে পড়তে পারবে না। পড়াশোনা ভালো ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন, তবে ভালো ভবিষ্যতের জন্য একমাত্র প্রয়োজনীয়তা কেবল পড়াশোনাই নয়। এরও অধিক গুরুত্ব রাখে প্রীতিলতা।

সে চোখ তুলে তাকাল প্রীতির দিকে। মেয়েটা ঠিক সামনেই বসে আছে। এত শান্তশিষ্ট মেয়ে প্রীতি কখনোই না। তবু আজ সে ভীষণ নিশ্চুপ, উদাসীন৷ চুলগুলো বেনি করে রাখা। হালকা রঙের এক সুতির গোলজামা, ওড়না মাথায় টানা। ছোট্ট মুখটা ফুলে আছে। বোধহয় ঘুম থেকে উঠেছে মাত্র। নক্ষত্র চশমাটা ঠিক করে বই বের করল। এরপর ডাকল,
-“প্রীতিলতা?”
-“বলুন।”
-“কোনো কিছু নিয়ে টেনসড?”
-“সম্ভবত। আচ্ছা…”

প্রীতি তাকাল নক্ষত্রের দিকে, ঠোঁট উলটে মুখভঙ্গিতে প্রশ্নবোধক রেখা ফুটিয়ে বলল,
-“আচ্ছা, আপনার সাথে আলোচনা করতে পারি?”
-“হুম, নিশ্চয়ই।”

নক্ষত্র চেয়ার টেনে এদিকে ঘুরে বসল। একহাতে প্রীতির চেয়ারটা টান দিয়ে তার মুখোমুখি করে নিল। প্রীতি প্রথমত ছিটকে উঠল। পর পর শান্ত হলো। বুকে হাত রেখে দম ছাড়ল। নক্ষত্র প্রীতির চেয়ারটার একপাশে হাত রেখে ওর দিকে তাকিয়ে রইল,
-“বলো।”
-“আচ্ছা।”

প্রীতি বড়ো করে একটা দম নিল। উদাসীন হয়ে বলা শুরু করল,
-“আমার এক ফ্রেন্ড আছে। আমাদের বয়সী মেয়েরা তো জানেনই কেমন হয়। যেই গাঙ্গে অন্যরকম কিছু খুঁজে পায়, সেখানেই আগ্রহের সাথে ডুব দেয়। তো আমার ফ্রেন্ড ডুব দেওয়ার আগেই ফ্যামিলি থেকে ওই জিনিসটাকে তার করে দেওয়ার প্ল্যান করতে লাগল। সহজে পেয়ে যাওয়া জিনিস তো, আমার ফ্রেন্ড এখন আর আগের মতো আগ্রহ পাচ্ছে না। তার ওপর আগ্রহের জিনিসটাতে অন্য কারোর ভাগ আছে। এটা জানার পর থেকে পুরোপুরি আগ্রহ উঠে যাচ্ছে। এই অবস্থায় আমার ফ্রেন্ডের কী করা উচিত? আমি ওর জন্য চিন্তিত।”

এতগুলো শব্দ উচ্চারণ করার পর নৈঃশব্দ্যে প্রীতি বলল, “আর ওই ফ্রেন্ডটা হচ্ছে আমার অন্তরাত্মা”—যে কথা নক্ষত্রের শোনা হলো না।

নক্ষত্র বেশ রয়ে সয়ে বলল,
-“প্রতিটা গল্পের দুটো পিঠ থাকে। একপিঠ দেখে কোনো কমেন্টস করা উচিত না। যেহেতু আমি কেবল মেয়েটার দিক থেকে জানি, তাই বলব মেয়েটাকে ধৈর্য ধরতে। সময় ও পরিস্থিতি নিজেদের গন্তব্যের পথ নিজেরাই বেছে নেবে।”

প্রীতি টেবিলের ওপর দুই হাত রেখে সেখানেই মাথে এলিয়ে দিলো। অকস্মাৎ প্রতিক্রিয়ায় নক্ষত্র থমকাল। চিন্তিত গলায় শুধাল,
-“অল ওকে?”
-“হয়তো।”
-“নিশ্চিত হও। অনিশ্চিত শব্দেরা গল্পের মোড় পালটে দেয়।”

প্রীতি মাথা তুলে তাকাল নক্ষত্রের দিকে,
-“আমি ঠিক নেই, নক্ষত্র। আমি আমার মনের সাথে কানেক্টেড হতে পারছি না। আমি ব্যথা পাচ্ছি না, আমার কষ্ট হচ্ছে না, আমার কান্না আসছে না। চাপা অনুভূতিরা বিষ হয়ে জ্বালাচ্ছে। আমি শ্বাস নিতে পারছি না।”

নক্ষত্র টেবিলে একহাত ভাঁজ করে রেখে, তার ওপর নিজের মাথা রাখল। তাকাল প্রীতির দিকে। স্থির চাহনি তার। গলার আওয়াজে নমনীয়তা,
-“তুমি গতকাল কিছু দেখেছ?”

প্রীতি স্বাভাবিকভাবেই বলল,
-“দেখেছি।”
-“কিছু শুনেছ?”
-“নাহ।”

এই ছোট ছোট সংলাপগুলো কতখানি ভয়াবহ তার পরিমাপ করা যেত কেবল তখন, যখন মানুষ দুটো স্বাভাবিক অবস্থায় থাকত। অস্বাভাবিক অবস্থায় বলা অস্বাভাবিক বাক্যগুলো কাটাকাটিতে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

নক্ষত্র অন্য হাতটা প্রীতির মাথায় রাখল, অপ্রশস্ত হেসে বলল,
-“সে আমার প্রাক্তন। বর্তমানে আমি তোমার। ইন ফিউচার, যদি জীবিত ও সুস্থ থাকি, তোমারই থাকব। প্রীতিলতা? জাস্ট রিমেম্বার দ্যাট, আ’ম অল ইয়োর্স।”

প্রীতি দু’চোখের পাতা বন্ধ করে ফেলল।

______
আলফাজ সাহেব ঢাকায় শিফট হয়েছেন। নীহম সকাল থেকে সেসবই গোছাচ্ছে। বাবা একটু গ্রোসারির জন্য বেরিয়েছেন। নীহমের মনে পড়ল, বাবার শিফট হওয়ার ব্যাপারটা সে এখনো মাকে জানায়নি। হাতের কাজ করতে করতেই কল লাগাল মাকে। রিসিভ হলো লাস্ট রিংয়ে।

নীপা বললেন,
-“কী হয়েছে?”
-“কিছু না, মা। বোর হচ্ছিলাম তাই কল দিয়েছি।”
-“ওহ আচ্ছা। কল কাটো, কাজ করছি।”
-“বাবাকে নিয়ে আলোচনা করব।”
-“তাহলে বলো, ফ্রি আছি।”

নীহম ইনডোর প্ল্যান্টগুলো কোনটা কোথায় রাখবে কোমরে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ সেটা ভাবল। তারপর বলল,
-“বাবা ঢাকায়।”
-“ওহ আচ্ছা। ভালো কথা। ঘোরোঘুরি করো আর ছবি দিয়ো না।”
-“বাবা শিফট হয়েছে এখানে। কয়েকমাস থাকবে।”
-“বুকে জ্বালা বাড়িয়ে দিলে, নীহম। না বললেই চলত।”
-“চলত?”

নীপা টেবিলের ওপর রাখা কী-বোর্ডেই মাথা এলিয়ে দিলেন। ক্লান্তি ও বিরক্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। তার ওপর আবার নীহমের বাবার জন্য বুকের চিনচিনে ব্যথা। তিনি ওভাবেই বললেন,
-“আমার কী ইচ্ছে করছে নীহম, জানো?”
-“জানি।”
-“বলো তো, কী?”
-“এমন অসহ্য কথা তোমাকে জানানোর অপরাধে তোমার ইচ্ছে করছে আমাকে তুলে ছাদ থেকে ফেলে দিতে।”
-“এত সঠিক কী করে ধরলে?”
-“গ্যেস করেছি, মা।”

নীপা দাঁত কিড়মিড় করে হাসতে লাগলেন,
-“অথচ আমি তোমাকে ছাদ থেকে ফেলে দিতে পারছি না। এজন্য আমার কেমন লাগছে বলো তো?”
-“এজন্য তোমার রাগ ও কষ্ট একসাথে পাচ্ছে। তাই তুমি একহাত মুঠো করে টেবিলের গ্লাসে দুই সেকেন্ড অন্তর অন্তর একটা করে বাড়ি মারছ।”

নীপা তার চলমান থাকা হাতের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে আমার।”
-“থ্যাংক ইউ, মা।”

নীহম বুকশেলফে একটা একটা করে বই রাখতে লাগল। ফোনটা স্পিকারে রাখল তার কুর্তির পকেটে। নীপা বললেন,
-“বাবা কই?”
-“সুপারশপে।”
-“আমার ব্যাপারে কিছু বলেছে?”
-“না।”

নীপা টেবিলে আঙুল চালাতে লাগলেন,
-“স্বার্থপর মানুষ সব। অন্তত মন রাখার জন্যই মিথ্যে বলতে পারতে, নীহম।”
-“কী বলতাম?”
-“বলতে যে, বাবা বলেছিল।”
-“তারপর?”
-“তারপর আরও অনেক কিছু বলতে।”
-“মিথ্যে?”
-“হ্যাঁ।”
-“লাভ কী হতো, মা?”
-“আমার মন ভালো থাকত। সত্য বলে অন্যকে কষ্ট দেওয়ার চেয়ে মিথ্যে বলে তাকে ক্ষণিকের শান্তি দেওয়া ভালো।”

শেলফে বই রাখতে থাকা হাত নীহমের থেমে গেল। ঘাড় কাত করল সে। কপাল কোঁচকাল। থমকানো গলায় শুধাল,
-“মা? চিরস্থায়ী সুখকে সযতনে ঠুকরে দিয়ে, ক্ষণস্থায়ী শান্তির এত লোভ কেন মানুষের?”

নীপা আলগোছে কল কেটে দিলেন। তার বলার কিছু নেই। কান্নাকাটিও এখন আর আসে না। কেবল চুপ হয়ে যান তিনি। বুকেতে ভার হয়ে স্মৃতিরা, চোখেতে ভাসে অগোছালো স্বপ্নেরা।

আলফাজ সাহেব বাড়ি এলেন। নীহম বলল,
-“বাবা, তোমার কি মায়ের সাথে দেখা করা উচিত?”
-“প্রশ্ন করছ?”
-“হ্যাঁ।”
-“আমরা যখন কাউকে কোনো প্রশ্ন করি, উত্তরটাও মনে মনে ভেবে রাখি। ঠিক না?”
-“হ্যাঁ, বাবা।”
-“তুমি কেমন উত্তর ভেবেছ?”
-“দেখা করা উচিত না।”

আলফাজ সাহেব হাসলেন,
-“হ্যাঁ। উচিত না।”

নীহম বাবার হাসির সাথে হাসল। তারপর চলে এলো ওখান থেকে। রাত হয়ে এসেছে প্রায়। একা একা বাড়ি ফিরতেও ইচ্ছে করছে না। সে কল লাগাল স্মরণকে। স্মরণ রিসিভ করতে সময় নিল না,
-“নীহম?”
-“হ্যাঁ, স্মরণ। কই আছো?”
-“বনানীতে। তুমি কোথায়?”
-“আমিও। লোকেশন দিচ্ছি, আসো।”

নীহম নিজের লোকেশনটা শেয়ার করে নিল স্মরণের সাথে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে স্মরণ উপস্থিত হলো নীহমের মুখোমুখি।
স্মরণ জিজ্ঞেস করল,
-“এখানে?”
-“বাবা শিফট হয়েছে। বাসা গোছাতে হেল্প করলাম।”
-“বাবা আলাদা থাকেন?”
-“হ্যাঁ।”

স্মরণের চোখে-মুখে লেগে আছে প্রশ্ন। নীহম সেটুকু টের পেতেই আবার বলল,
-“আমার বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়েছে আমি ছোট থাকতেই। আমি মায়ের সাথে থাকি। আবার মাঝে মধ্যে বাবার সাথেও।”

নীহমের কথার মধ্যে এরকম কিছুই নেই যাতে বোঝা যায় যে মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে। কত স্বাভাবিকভাবেই এ কথাগুলো বলে ফেলল। স্মরণ বড়ো করে শ্বাস ফেলল। ব্রোকেন ফ্যামিলি সম্পর্কে তার সামান্য ধারণা আছে। সে ধারণা নিয়েই সে বলল,
-“সরি ইফ আই হার্ট ইউ।”
-“সমস্যা নেই, স্মরণ। ইটস ফাইন।”

স্মরণ নীহমের হাতটা ধরে হাঁটতে লাগল। কোনো এক সরু গলি এটা। মানুষ নেই একদমই। এ গলির শেষে থেকে রিকশা নেবে। স্মরণ আলতো করে ধরলেও নীহম করল কি, সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে স্মরণের হাতটা ধরল। যেন তার মাথার ঘুরছে এমন কথা, এভাবেই ধরে রাখতে হবে। মনের জোর ঢিলে হলেই সে চলে যাবে। তখন একা হয়ে যাওয়া লাগবে। তখন বাকিটা জীবন একা থাকা লাগবে। মায়ের মতো, বাবার মতো। তাদের পরিণতি সম্পর্কে তারা অবগত ছিল না, তাই কষ্ট কম। নীহম দেখে এসেছে। যা যা দেখে এসেছে, সব কষ্ট সে নিজেও পাবে। কষ্ট যে সময়ের সাথে কমবে, এমনটা ভাবতেও পারবে না। কারণ সে আগে থেকেই জানবে, কিছু ব্যথা কমে না। সময়ের ক্রমে বুকে চাপা পড়ে যায়। শোক দেয়, সুখ দেয় না। ব্যথা দেয় তবে মৃত্যু দেয় না।
এ সব কথা ভাবতেও তার অশান্তি হচ্ছে।

স্মরণ ডাকল,
-“নীহম?”

নীহম সে ডাকের সাড়া নিল না। নিশ্চুপ হয়ে রইল। বিক্ষিপ্ত নজর তার। কপাল কোঁচকানো। স্মরণ সেখানেই থেমে দাঁড়াল এবং তাকিয়ে রইল নীহমের দিলে, নিষ্পলক। এজন্য নীহমও এগোতে পারল না। প্রথম পাঁচ সেকেন্ডে স্মরণ লক্ষ করল, মেয়েটাকে আজ অন্যরকম লাগছে। একটু বেশিই অন্যরকম। কিন্তু কীজন্য? সে মেলাতে লাগল।

গোল জামা, গায়ে শাল, চুলগুলো কাটা দিয়ে মাথায় আটকানো, কিছু চুল মুখের সামনে এসে আছে, ছোট্ট মুখটায় কাঠিন্য, চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল, ঠোঁটের প্রতিটা ভাঁজে নীরবতা। নীহম ছোট্ট করে হাসল। সে হাসিতে স্মরণ পালটা হাস্যমুখ দেখাতে পারল না। শক্তহাতে নীহমের হাতের কবজি ধরে তাকে গলির শেষমাথায় নিয়ে গেল। হাত ছেড়ে দিলো।

অকস্মাৎ স্মরণের এত দ্রুত কদমে কাছে এগোনোতে, নীহমের পিঠ গিয়ে ঠেকল দেয়ালে। সে ভীত হচ্ছে না। চাহনি দেখে মনেও হচ্ছে না যে এখন ভয়াবহ কিছু হতে যাচ্ছে। অথচ সে জানে, খুব করে টের পাচ্ছে স্মরণের পরবর্তী পদক্ষেপটা কী হতে যাচ্ছে।

স্মরণ এতটাই কাছে চলে এলো যে, নীহম নিঃশ্বাসটাও আটকে ফেলল। যেন তার দ্রুতগামী হৃৎপিণ্ডের বেহায়া স্পন্দনগুলো স্মরণ শুনে ফেললে তার খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। স্মরণ তাকে একটুও ছাড় দিলো না। নৈকট্যের চাহিদায় নাকের সাথে নাক ঠেকে গেল। পুরুষালি কর্কশ আওয়াজ তার। বড়ো ফিসফিস করে ডাকল,
-“নীহম?”

ডাকশোনা জবাবে নীহম বলল,
-“হু-উম?”
-“কিস করি?”

এ প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ বা না কোনোটাই বলা সম্ভব না। চোখে চোখ দুইজনের, মাথা নেড়ে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার চিন্তাও ভুলে বসল। মধ্যাহ্নের অর্ধইঞ্চি সমপরিমাণ দূরত্বটা নীহমের তরফ থেকেই মিটল।

_________
অতসী গতকাল এয়ারপোর্ট থেকে সোজা মামারবাড়ি উঠেছিল। নুরনাহারের কাছে নক্ষত্রের অবস্থান জেনে আশকোনার ওখানে চলে গেল। আর তারপর কী থেকে হয়ে গেল। এখন হুট করেই এই বাড়ি থেকে অন্য কোথাও চলে যাওয়াটাও তার পক্ষে সম্ভব না।

অতসী দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। সামনে বসে থাকা শামাকে সহাস্যমুখে জিজ্ঞেস করল,
-“তুমি আমাকে চেনো, শামা?”
-“না, আপা। চিনি না। আগে দেখি নাই তো।”
-“চিনেই বা কী হবে, বলো?”
-“সেটাও, আপা। চা খাবেন? নিয়ে আসি?”

শামা চা নিয়ে এলো। সে এ বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ড। পাঁচ বছর ধরে এ বাড়িতে কাজ করছে। তাই অতসীকে চেনে না। অতসী প্রচণ্ড হাসছে, অথচ তার মন খারাপ। শামা সেটা টের পাচ্ছে। বিভিন্ন রসিকতাও করার চেষ্টা করছে। যেমন,
-“আপা, জানেন অমুকের সাথে তমুকে ঘটনা ঘটাইছে। আমি তা শুনে সেই যে হাসা শুরু করছিলাম, থামাইছি চৌদ্দদিন পর।”

এর প্রতিক্রিয়াও অতসীর হাসিমুখে এমন ছিল,
-“ও আচ্ছা। ভালো তো।”

শামা হতাশ হয়। অতসী ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে বলে,
-“আচ্ছা, শামা! তুমি কি টের পাচ্ছ আমার মন খারাপ?”
-“পাচ্ছি, আপা।”
-“বাকিরাও পাচ্ছে তার মানে?”
-“না, আপা। বাকিরা পাচ্ছে না। শুধু আমি পাচ্ছি। আমার মায়ে বলছে, আমারে নাকি আল্লাহয় মানুষের মন খারাপ বুঝতে পারার ক্ষমতা দিছেন। তাই আমার উচিত, এই ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর।”
-“কীভাবে কাজে লাগাও?”
-“তাদের মন ভালো করে।”
-“তাই?”
-“হ্যাঁ, আপা। কিন্তু আপনারটা পারতেছি না।”

অতসী ঠোঁট ওলটাল,
-“তাহলে কি আমার মন ভালো হবে না?”
-“কেন হবে না, আপা? মানুষের মন খারাপের কিছু পর্যায় থাকে। নিচের দিকের পর্যায়ের মন খারাপটা সহজেই ঠিক করা যায়। কিন্তু একটু ওপরের দিকেরটা আবার ঠিক করতে সময় লাগে, কষ্ট লাগে। বুঝেন নাই, আপা? যখন ব্যথা বেশি পায়, ঘা সাড়তে তো সময় লাগেই। আপনার ঘা মনে হয় অনেক গভীর। ঠিক না, আপা?”

অতসী মাথা নাড়ে,
-“ঠিক।”
-“চিন্তা করবেন না, আপা। সব ঠিক করে দেবো। এই বাড়ি থেকে যেদিন চলে যাবেন, দেখবেন আপনার মন কত ভালো হয়ে আছে।”

শামার চাঞ্চল্যে অতসী হাসে,
-“শামা, তুমি কখনো প্রেমে পড়েছ?”
-“পড়ছিলাম, আপা।”
-“তারপর?”
-“তারপর বিয়ে বসলাম তার সাথেই।”
-“এখন একসাথে থাকো?”
-“হ্যাঁ, আপা। সে আমাকে অনেক ভালোবাসে।”
-“ধরো, তুমি তাকে পেলে না..”
-“ছি ছি, আপা। ওসব বলবেন নাহ। ভাবতেও তো কেমন কলিজা কাঁপতে থাকে।”

অতসী সোফায় গা ছেড়ে দেয়, সিলিংয়ের দিকে স্থির দৃষ্টি তার। চোখে ভাসে তার করুণ দশা। আওয়াজে নমনীয়তা, গলার স্বর ভাঙ্গা,
-“আমি ওই পর্যায়ে আছি, শামা। আমার ভেতরটা কাঁদছে। আমি বাইরে থেকে অতটা হাসতে চাই, যাতে ভেতরটা কেউ না দেখতে পায়। সম্ভব না?”

______
কেউ থাকে বুকের বাঁ পাশে।
কেউ ভাসে একলা আকাশে।
ঠোঁটে ঠোঁট মেশে, কেউ চোখে হাসে।
তারপর সবই যেন একা দুঃখিনী;
কী থেকে কী হয়ে আসে..

চলবে…