#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২১+২২
“এই যে মিস্টার সারোয়ার সাহেব আপনি আমার সাথে কথা বলতে চান না অথচ কোন না কোন লো ক্লাস মেয়ে একটার সাথে কথা বলার জন্য উতলা হয়ে থাকেন। বলে কী এমন অসভ্যতা কোনো ভদ্রলোকের ছেলেকে শোভা পায় না। আপনার উচিৎ আমার সাথে বেশি বেশি কথা বলে ফ্রি হওয়া। আফটার অল আপনার ওয়া….।”
নিলীমার কথার অর্ধ অংশ কেটে দেয় সারোয়ার তার তিক্ত মুখের বুলি আওড়ে। সে সোজাসাপ্টা কখনো কাউকে অপমান অথবা কথা শোনায় না। বরং শান্ত কণ্ঠের দ্বারা যে অপমানিত করার মজা তা একমাত্র আয়ত্তে করে রাখা পুরুষ সারোয়ার। সে নিলীমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে নম্র গলায় বলে,
“যার বিয়েতেই মত নেই তার উপর হুটহাট করে হবু বউ হওয়ার মজা লুটায় করা কোনো ভদ্রলোকের মেয়ের মাঝেও শোভা পায় না। এ বিয়েতে যদি আমি মতই না দেয় তাহলে কারো সাধ্য নেই এই সারোয়ার সিদ্দিক কে তার সিদ্ধান্ত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার। সেখানে আপনি হলেন আমার বয়স থেকে দুতিনেক ছোট। সেই ক্ষেত্রে আপনাকে আমি সম্মানসূচক কণ্ঠেই নাকচ করলাম। আপনার জায়গায় কোনো পুরুষ লোক হলে আমার কণ্ঠের তিক্ততা সহ্য করতে পারতো না। সো ইউ আর লাকি। থাক আজকে আমার একজনের সাথে দেখা করতে যেতে হবে। হুটহাট কারো অফিস অথবা কেবিন রুমে চলে আসবেন না। সে হয়ত তার পার্সোনাল কাজে ব্যস্ত থাকতে পারে। টেক কেয়ার এন্ড গুড বাই।”
সারোয়ার তার পরণের কোট হাতে নিয়ে নিলীমার পাশ কেটে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে নিলীমাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘যদি আপনি আমার কেবিন থেকে বের হোন তাহলে আমার জন্য উপকৃত হবে। জানেন তো দেশের পরিস্থিতি এখন ডাকাত চোরের মাঝে ভরে গেছে। আর আমার অফিসে সব প্রয়োজনীয় সামগ্রী সো প্লিজ!’
হাত দেখিয়ে বাহিরের দিকে ইশারা করে। নিলীমার মুখমণ্ডলে লালাচে ভাব চলে এসেছে। তার জীবনে তাকে কেউ কখনো উচ্চ গলায় কথা বলেনি। বরঞ্চ এই লোক কী না তাকে শান্ত মনে অপমান করে দিলো। ব্যাপারটা তার হজম হচ্ছে না। শরীর সামলে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে সে উত্তপ্ত চেহারা নিয়ে সারোয়ার এর বিপরীত পাশ দিয়ে চলে যায়। সারোয়ার হাসল। সে তার দরজা লক করে চাবিটি রেখে দেয়। যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে তার পিএকে খেয়াল করে। সে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে নিলীমার যাওয়ার দিকে। সারোয়ার চোখজোড়া সরু করে পিএ তানভির মাথায় চাপড় মারলো। তানভি হকচকিয়ে দৃষ্টি সংযত করে তার স্যারের দিকে তাকায়। সারোয়ার ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে।
‘পা পিছলে যায়নি তো?’
তানভির চোখজোড়া ডিমের মত বড় হয়ে গেল। দম আটকে মাথা এপাশ ওপাশ নেড়ে না বোঝায়। নেতিবাচক ধারণা পেয়ে সারোয়ার আপনমনে হাসল। ছেলেটা তার ভয়ে ভীতি জবাব প্রদর্শন করেছে। তবে এটা ঠিক। নিলীমার ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়া অব্দি তানভির সাথে জড়ানো থেকে বিরত রাখতে হবে। সারোয়ার কে অন্য মনস্ক দেখে তানভি আমতার কণ্ঠে বলে,
‘স্যার ঐ কমলা সুন্দরী মেয়ের নাম কী?’
সারোয়ার চোখ পিটপিটিয়ে কোমরে হাত রেখে তানভির মজা নেওয়ার স্বার্থে জিজ্ঞেস করে।
‘তোর কী ম*রা*র শখ জাগছে?’
‘না না স্যার কী বলছেন! আমি তো এমনি আপুটার নাম জিজ্ঞেস করছিলাম।’
‘এমনিটাকে না তোর পকেটের ভেতর চেইন মেরে রাখ। এমনিটা যদি খাপছাড়া হয়ে যায় না তাহলে তোর মাথায় বাজ পড়বে। বুঝতে পেরেছিস আমার কথা?’
‘জ্বি জ্বি স্যার।’
সারোয়ার গম্ভীর মুখে তার সামনে থেকে সরে গেলেও লুকিয়ে মিটমিটে হেসে দেয়। গাড়িতে বসে ড্রাইভার কে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘তোমার শেহরীনা ম্যাডামের বাড়িতে নিয়ে চলো।’
মূলত আজ সে ড্রাইভ করছে না। তার শরীর ক্লান্তিতে ভরে আছে বিধেয় পুরোনো ড্রাইভারকে কল করে ডেকে এনেছে কয়েকদিনের জন্য। সুস্থ বোধ করলে পুনরায় সে নিজেই ড্রাইভ করবে।
এক দুয়েক ঘণ্টার দিকে শেহরীনার বাড়ির দিকে এসে পৌঁছায়। সারোয়ার গাড়ির দরজা খুলে বের হয়। সেই মুহুর্তে খেয়াল করে কাঁদা মাটির অপর দিকে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটা ঘাঁটতে ড্রাইভারের দিকে তাকায় সে। ড্রাইভারটি আমতা আমতা করে বলে,
‘স্যার ঐ দিক যেতে পারব না। গাড়ির চাকা গুলো কাঁদায় পড়লে চালাতে কষ্ট হবে। নাহয় কাঁদায় পড়ে অন্য এক ঝামেলা পোহাতে হবে। তাই আমি…।’
‘ঠিকাছে এখানে থাকো আমিই যায় সামনে।’
ড্রাইভারকে কথায় থামিয়ে সে নিজেই তার বাক্য বয়ান করে হাঁটা ধরে।
____
‘শুনেন আজই মেয়েকে দেখতে যায়। আমার থেকে স্যামের এই অতিরিক্ত মাদক নেশা পানির দৃশ্য দেখা সহ্য হচ্ছে না। তার জীবনটা ঠিক করে দিতে পারলে আমার শান্তি জুটবে কপালে। নাহলে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে তার অসুস্থতা দেখে।’
নিজের স্ত্রীর মুখে ছেলের অসুস্থতার কথা শুনে ইদরিব সাবেক চিন্তিত হয়ে বুকে হাত চেপে বসে পড়লেন। কয়েকদিন যাবত ঘরবন্দি হয়ে পড়ে আছে তার ছেলেটা। খাওয়ার সময় একদুমুঠো খেয়ে ঘুম দেয় আর উঠে নিজের মত খেয়ে আবারো ঘুম দেয় নাহয় নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিচ্ছে। বাবা-মা হয়ে তারা ছেলের অসুস্থতার লক্ষণ দেখে সহ্য করতে পারছেন না। রুফিয়া সাইমুম ছেলেকে আহ্লাদ করে খাইয়ে দিতে চাইলে সরাসরি নাকচ করতে করতে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তখন না চেয়েও তিনি কান্নাময় চোখজোড়া আর হৃদয়বিষাদ নিয়ে ছেলের রুম থেকে ফিরে আসেন। ইদরিব সাবেক শেষমেশ ছেলের আগাম ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সোজাসুজি স্ত্রী কে জানান।
‘এখনি তুমি ইপশিতার মাকে জানিয়ে দাও। বিয়ে আগামী মাসের ১ তারিখেই সম্পূর্ণ হবে। বিনিময়ে আমাদের মেয়ের পরিবারের কাছ থেকে কিছুটি লাগবে না শুধু বউমা যেনো আমাদের ছেলেকে সুস্থ করে সংসার সাজায় সেই আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটাও। দরকার পড়লে আমরা মেয়ের পরিবারের কাছে হাতভরে দেবো তবুও ছেলের সুস্থতা কাম্য চাই।’
রুফিয়া সাইমুম নিশ্চিন্ত মনে প্রশান্তির হেসে বলেন,
‘জ্বী আমি এখনি ফোন দিচ্ছি।’
তিনি খোশমেজাজে ফোন হাতে নিয়ে ইপশিতার মায়ের কাছে কল দেন। অন্যত্রে,
ইপশিতার মা মেয়ের হাবভাব কয়েকদিন ধরে লক্ষ করেছেন। সেই ভার্সিটির মধ্যে মিষ্টি বিলিয়ে আসার পর থেকে মেয়ের মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিত লক্ষণ তিনি ধরতে পেরেছেন। তবে এর মূল ভিত্তি কী সেটা বুঝতে অথবা জানতে পারছেন না। আজও মেয়েকে ভার্সিটির জন্য পরিপাটি হওয়ার থেকেও অদ্ভুত হাতে সাদা গোলাপ ফুল সাথে চুড়ি পরে বের হতে দেখে তিনি অনিশ্চিতায় ভোগছেন।
একবার ভাবছেন হয়ত তিনি মেয়ের উপর অযথা সন্দেহের নজর ছুঁড়ে দিচ্ছেন। আরেকবার ভাবছেন তার সন্দেহের তীর বোধহয় সঠিক। ইপশিতার মাকে কল্পনায় ডুবে থাকতে দেখে ইপশিতার বাবা আদুরীয় গলায় ‘ও বউ’ বলে ডাক দেন। ইপশিতার মায়ের ধ্যান ফেরে তিনি ভ্রু কুঁচকে মেয়ের বাবার দিকে চোখের ইশারায় কী বোঝান। ইপশিতার বাবা চোখ টিপ দেন। এতে তিনি বিরক্তির মুখ করে রান্না ঘরে চলে আসেন।
অপরিষ্কার বাসন কোসন এ হাত দেওয়ার মুহূর্তে চার্জে লাগানো ফোন ভাইব্রেশন হতে দেখে তিনি কপাল চাপড়ে ফোনের কাছে গেলেন। ফোন হাতে নিতেই ছেলের মায়ের ৪টা মিসড কল দেখে হতভম্ব। তড়িঘড়ি বেয়াইন সাহেবা রাগ করবেন ভেবে ভয়ে ভয়ে তিনি নিজেই কল দেন।
রুফিয়া সাইমুম মেয়ের মাকে কলে না পেয়ে ফোন রেখে চলে যেতে নিছিলেন। তখনি মেয়ের মায়ের কল পেয়ে খুশি হোন লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)। কল ধরে নিজ খোশমনে সালাম দেন। ইপশিতার মা কিছুটা অবাক। তারা কত ধনী বিত্ত মানুষ ভেবেছিল অহং দেখিয়ে শুধু বিয়ে পাক্কা করে উপকার করেছেন। তবে কুশলতার শ্রী দেখে তিনি সন্তুষ্ট খুব। তিনিও সরল গলায় সালামের জবাব দিয়ে শরীরের ব্যাপার জিজ্ঞেস করেন। রুফিয়া সাইমুম সম্মান মিশ্রিত কণ্ঠেই জবাব দেন। কথার তালে তিনি নিজের স্বামীর দিকে তাকান। কায়েসাম এর বাবা ইশারায় কথাটা বলতে ইঙ্গিত করেন। রুফিয়া সাইমুম কিছুটা অনুভূতি মিশ্রিত গলায় আবদার সুরে বলেন,
‘আপনার মেয়েকে আমার ঘরের মেয়ে হিসেবে চাই।’
কথাটায় তীর যেনো ইপশিতার মায়ের বুকে প্রশান্তি বয়ে দিল। তবে পরের বাক্য যা রুফিয়া সাইমুম ব্যক্ত করলেন। এতে তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন। মেয়ের হাবভাব কেমন সন্দেহ ভাজন। সেই ক্ষেত্রে সরাসরি তিনি নিশ্চিত করতে পারবেন না তবে আশ্বাস দিতে তো কোনো ভুল নেই ফলে তিনি
‘জ্বি ইন-শা-আল্লাহ’ বলেন। শুনে রুফিয়া সাইমুম তৃপ্তির শ্বাস ফেলে ছেলের বাবাকে ইশারায় হ্যাঁ বোঝান। তিনিও ছেলের সুস্থতা ভেবে স্বস্তি পেলেন।
ইপশিতার মা ভাবছেন আজ প্রায় দুসপ্তাহ হয়ে গিয়েছে। বিয়ের পাকাপোক্ত দিন আসতে এখনো দুসপ্তাহ বাকি। তার মাঝে মেয়ের অনার্সের সেমিষ্টার পরীক্ষাও আরম্ভ হবে। জুটপাকিয়ে যাবে কী না ভাবছেন তিনি। এর মাঝে হঠাৎ তিনি ইচ্ছে পোষণ করেন কাল বা পরশু করে তিনি মেয়ের পিছু নেবেন। মেয়ের সত্যতা তিনি জেনে দম নেবেন।
_____
সারোয়ার রাগে লাল হয়ে আছে। তার কান দিয়ে যেনো লাভার ন্যায় গরম ভাব বের হচ্ছে। সে হাত কচলে বিরোধী দলের আসামীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে টাকার সুটকেস। সে ব্যারিস্টার সারোয়ার কে হুমকি দিতে এসেছে। কেসের শুনানি কয়েক দিন পিছিয়ে যাওয়ায় আসামীর দল লাই পেয়ে মুক্তির ন্যায় ঘুরছে, খাচ্ছে, বেড়াচ্ছে। অথচ অসহায় নিপীড়নে ধ*র্ষণের জ্বালা নিয়ে ভোগে ধুঁকে ধুঁকে মরছে নয় বছরের বালিকা কল্যাণী। তার বাবা মা অসহায় হয়ে তার কাছে সাহায্য ন্যায় চেয়েছে বিচার চাই তার মেয়ের সাথে হওয়া অন্যায়ের। সেই ক্ষেত্রে সারোয়ার পূর্ণ আশ্বাসও দিয়েছে। তবে আজ হঠাৎ আসামী দলের লোকদের পুনরায় অফিস রুমে এসে টাকার সুটকেস রাখতে দেখে সারোয়ার অবাক হয় না। তবে তার মাথা ধরে যায় শুধু এক কথায়। আসামীর একপক্ষত্ব লোক কুটিল হেসে তার আসামী বন্ধু কে বলে,
“আরে উনি ব্যারিস্টার না দেখবি তুই যে রেপ করছিস তা ফাঁসই হবে না। উল্টো তুই নির্দোষ প্রমাণ হয়ে আবারো ঐ কল্যাণীকে ধরে বেঁধে মজা নিতে পারবি। সাথে স্যার আপনাকে ও আমরা ইনভাইট করবো। উফ মেয়েটার ফিগার যা না।”
শুনেই সারোয়ার এর র’ক্ত গরম হয়ে গেল। তবে ঐ যে স্বভাব বলে একটা কথা আছে না! মানুষ এর স্বভাব যা তাই সে করে বেড়ায়। সারোয়ার শান্ত প্রকৃতির মানুষ। তার কানে নিকৃষ্ট কথাগুলো পৌঁছে গিয়েছে তবুও সে নিশ্চুপ বসে আছে। তবে তানভির সহ্য হলো না। সে এক দফায় লোকটার নাকে জোরেসরে আঘাত করে বসে। এতে অফিস রুমে আসামীর লোকেরা ক্ষেপে যায়। তারা তানভির উপর পাল্টা আঘাত করে। যা দেখেও চুপ করে বসে ছিল সারোয়ার। তানভির নাকমুখে বার দুয়েক আঘাত পড়ায় সে হাঁপিয়ে উঠে। তখনি গলা খাঁকারি দিয়ে সারোয়ার উঠে তাদের কে থামিয়ে আশ্বাস দিল।
‘আমি খুব শীঘ্রই নতুন পিএ সিলেকশন করব। আপনাদের সাথে তানভির যা করেছে তার বিনিময়ে সে একশটা…।’
সারোয়ার এর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আসামীর সেই দুর্নীতি বাজ লোকটি ‘চ’ উচ্চারণ করে তানভিকে গা*লি দিয়ে বলে,
‘এই স্যার আপনে দেখে এই পোলাকে ছাড়ছি। নাহলে আজই খতম করে দিতাম।’
সারোয়ার বাঁকা হেসে লোকটার কাঁধ চাপড়ে বলে,
‘এই সুযোগ জীবনে একবারই পায় মানুষ। তবে আমি চাই না আপনারা আইন হাতে নিন। প্লিজ ইউ মে লিভ!’
তানভির চোখজোড়ায় নোনাজল এসে ভিড় করছে। তার স্যার যে মন থেকে এতটা জঘন্য সে কখনো কল্পনাও করেনি। প্রথম দিকে ভেবেছিল এই আসামীর টাকা নিয়ে তিনি তাকে ফাঁসিয়ে দেবে তবে আজ সে বিশ্বাস করে নিলো সে ভুল। তার স্যার আসামীর পক্ষে গিয়ে অসহায় ধ*র্ষিত মেয়েটিকে দোষী সাব্যস্ত করবে। তানভির নাক দিয়ে রক্তপাত হচ্ছে। ঠোঁট ফেটে গিয়েছে। তার সেই দিক দিয়ে কোনো যন্ত্রণা অনুভব করছে না যতটা যন্ত্রণা সে মানসিক ভাবে তার স্যারের কথা দ্বারা পেয়েছে। সারোয়ার একপলক তানভির দিকে তাকায়। নির্লিপ্ত গলায় বলে,
‘যাও ঘরে গিয়ে রেস্ট করো। তোমার সামনে থেকে আর অফিসে আসতে হবে না।’
তানভির ও জেদ হলো সে তার ইউনিফর্ম এর কটি খুলে সারোয়ার এর অফিস রুমের সোফায় ছুঁড়ে ফেলে বলে,
‘এই নিন স্যার আপনার অবৈধ ভাবে বানানো কটি ফিরিয়ে দিলাম। আর কখনো আপনার সাথে আমি কাজ করব না। আপনি যে এতটা নিকৃষ্ট জানলে কখনো আপনার সাথে কাজ করতাম না। আমার রুচি এত খারাপ নয়।’
নির্জীব ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল সারোয়ার। তানভির কথার তীরে সে শুধু ডান হাতের ইশারায় বাহিরের দরজার দিকে ইশারা করে। তানভির ভারাক্রান্ত মন নিয়ে একপলক পুরো অফিস রুমের দিকে তাকিয়ে সোজা বেরিয়ে গেল। সারোয়ার নিশ্চুপ দম নেয়। যাকে দুঃখের শ্বাস বলা চলে। সে ধীমি পায়ে হেঁটে জানালার ধার ঘেঁষে দাঁড়ায়। সেদিন শেহরীনার সঙ্গে দেখা করতে চাওয়াটা বোধ হয় তার জন্য ভুল ছিল। কথায় আছে কাজ কখনো তাড়াহুড়োয় করতে নেই। তাড়াহুড়োর কাজ শয়তানের। বিবেকবান এর কাজ হলো ঘটনা ভেবে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
সেদিনকার ঘটনা,
রূপালি বেগম অবাক হলেন সারোয়ার কে কাঁদা মাটির উপর অসহায় হয়ে ধীমি পায়ে হেঁটে আসতে দেখে। তিনি তৎক্ষণাৎ তার কাছে গিয়ে ছেলের হাত ধরে ফুটপাত এনে সহজে ঘরের উঠানে নিয়ে এলেন। সারোয়ার লজ্জা পেল। বৃষ্টির কারণে রাস্তাটা পিছলা আর ঘাস পাতায় ভরে যাওয়ায় সে লক্ষ্য করতে পারেনি ফুটপাতের ধার কোনদিকে! রূপালি বেগম কেশে ছেলেকে সহজ হতে দিয়ে জিজ্ঞেস করেন।
‘বাবা তুমি হঠাৎ এলে কিছু কী হয়েছে?’
সারোয়ার শেহরীনার মায়ের নম্র কণ্ঠ শুনে সেও স্বস্তির শ্বাস নিয়ে বলে,
‘আন্টি ফারদিন থেকে শুনলাম আঙ্কেল অসুস্থ। সময় বের করে এসেছি দেখা করতে। আঙ্কেল কী ঘুম না জাগনা?’
রূপালি বেগম মনে মনে আতঙ্কিত বোধ করলেন। তার স্বামী জানেন ছেলেটা তার ভাইয়ের ছেলে তবে দেখেই কী কোনো ভয়ানক প্রতিক্রিয়া দেখাবেন? তিনি ইতস্তত গলায় বলেন,
‘না বাবা আসলে হয়েছে কী!’
ঘরের ভেতর থেকে মৃদু আর্তনাদ শোনা গেল। সেই স্বর শুনে রূপালি বেগম এর আগেই সারোয়ার ডিঙিয়ে গেল। তিনিও পিছু গেলেন। মাটির উপর চিত হয়ে পড়ে আছেন নাছির উদ্দিন। অসুস্থতায় শরীর জমছে গেছে। একটু নেড়েচেড়ে উঠতে গেলেই ভর সামলে উঠতে পারলেন না। ধপ করে পড়ে গেলেন। ব্যথায় ‘আহ’ শব্দ করে উঠার স্বর শুনেই চলে আসে তাদের রুমের ভেতরে। সারোয়ার তৎক্ষণাৎ তাকে ধরে বিছানায় শুয়ে দিলেন। নাছির উদ্দিন মুখপান তখনো খেয়াল করেননি। ভেবেছেন তার ছেলে নাজমুর এসে ধরেছে। তবে শক্তপোক্ত শরীরের ভার পেয়ে তিনি চোখ পিটপিটিয়ে ছেলেটির দিকে তাকান। দেখেই আশ্চর্য হলেন। তার পেছনে স্ত্রী কে দেখে গম্ভীর মুখে বলেন,
‘এই ছেলে এখানে এসেছে কেনো জিজ্ঞেস করো!’
সারোয়ার জানে পূর্বে সে ভদ্রলোকটার সাথে বেইজ্জতময় গলায় শাসিয়ে কথা বলে ছিল। তবে তা পরিস্থিতির সাপেক্ষে থেকে। তার কোনোভাবে ভদ্রলোককে আঘাত দেওয়ার পুরোনো পরিকল্পনা ছিল না। সে নিরীহ গলায় ম্লান মুখ করে বলে,
“আঙ্কেল প্লিজ! আন্টিকে বকবেন না। আপনাকে যে স্বরে আমি শাসিয়ে ছিলাম তার জন্য আমি আপনার হাত ছুঁয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।”
বলার মুহুর্তেই সে নাছির উদ্দিন এর হাত ধরে নিলো। তিনি তপ্ত শ্বাস ফেলে ছেলের হাতের উপর ডান হাত চেপে বলেন,
‘নারাজি নেই বাবা ক্ষমা চেয়ে নিজেকে ছোট দেখাবে না। আমি মনে কিছু রাখিনী। তবে হ্যাঁ বাবা তোমার ইচ্ছে হলে তুমি শেহরীনার জন্য প্রস্তাবে রাজি মত দিতে পারো। শেহরীনার মন খারাপ হয়েছে আজ তবে আমি বুঝালে সে মানবে।’
সারোয়ার মৃদু হেসে বলে,’না আঙ্কেল আপনি বলেছেন সেটাই বেশি আমার জন্য। দরকার হলে আমি অপেক্ষা করব। সে এখনো প্রস্তুত নয়। তার কাছে বিয়েটা দেওয়া হলে সে নিজেকে বন্দিনী ভেবে গোমরে থাকবে। আমি কখনো চাই না আমার ভবিষ্যৎ বউ নিজেকে গোমরে আঘাতে জর্জরিত হোক। তার মনো স্বাধীনতা তার ইচ্ছেমত এর প্রাধান্যতা আমার কাছে বেশি।’
সন্তুষ্ট ভরা নজরে তাকিয়ে নাছির উদ্দিন বলেন,’আমি বাবা হিসেবে হয়ত স্বার্থক হতে পারিনী। তবে বাবার দায়িত্ব পালনে কোনো নিষ্ঠুরতা দেখায়নি আমি। সুতরাং স্বার্থক হয়েছি আমি বাবার পূর্ণ দায়িত্ব পালনে।’
সারোয়ার মাথা নাড়ল। নাছির উদ্দিন মেহমান স্বরূপে আসা সারোয়ার এর জন্য আপয়্যনের দৃষ্টি দেন নিজ স্ত্রীর দিকে। রূপালি বেগম স্বস্তির গলায় বলেন,
‘আপনারা বসে কথা বলুন আমি চা-পানি নিয়ে আসছি।’
নাছির উদ্দিন স্ত্রীর চলে যাওয়া দেখে ইতস্তত গলায় সারোয়ার কে জিজ্ঞেস করেন।
‘বাবা তোমার মা কী সত্যি উনি ছিলেন!’
সারোয়ার অবাক। তার মা নিয়ে উনি এ কী প্রশ্ন করলেন? অদ্ভুত ঠেকল প্রশ্নটা তার কাছে। ছেলেকে অস্পষ্ট রূপে তাকিয়ে থাকতে দেখে তিনি আমতার স্বরে বলেন,
‘না মানে শুনে ছিলাম একসময়। তোমার বাবার সাথে পদ্মিতা নামের এক মেয়ের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।’
সারোয়ার শুনে অবাক চিত্ত মনে ভাবে।
‘আঙ্কেল কেমনে জানে আমার বাবার সাথে পদ্মিতা আন্টির বিয়ে হওয়ার কথা ছিল? এটা কেমনে সম্ভব উনিও বা আমার আন্টিকে কেমনে চেনেন?’
নাছির উদ্দিন পুনরায় কিছু বলার মুহুর্তে বিধ্বস্ত রূপে রুমের ভেতর প্রবেশ করতে দেখেন শেহরীনাকে।
চলবে…..
#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_২৩
“আপনার কী হয়েছে শেহরীনা কেনো আপনি হঠাৎ বিয়ের মতামত থেকে পিছিয়ে গেলেন? দেখুন আমি ভুল করে আপনার মনে আঘাত দিয়ে থাকলে সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ দেন। তবুও হুট করে এই খোশমহলে অশান্তি টানবেন না।”
শেহরীনা বিরক্ত মুখ করে তার হাত ছাড়িয়ে নিল সারোয়ার এর কাছ থেকে। সে দরজার কাছ দিয়ে শেহরীনার বিধ্বংসী রূপ দেখে আঁতকে উঠে। নাছির উদ্দিন মেয়ের দশা দেখে তৎক্ষণাৎ ‘মামুনি’ বলে বুকে হাত চেপে ধরেন। সারোয়ার প্রথমত উত্তেজিত অনুভব করলেও পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয়। তার মত তুখোড় যুবকের উত্তেজিত হওয়াটা মানানসই নয়। ফলে সে নিয়ন্ত্রণ পূর্বক বসে পড়ে। শেহরীনা নাছির উদ্দিন এর কাছে বসে তার হাত জোড়া আঁকড়ে ধরে। তিনি মেয়ের বিধ্বস্ত রূপ সহ্য করতে পারছেন না। ফুলের মত মেয়েটার এ কী হাল? তিনি কান্নায় কণ্ঠে মেয়ের হাত একহাতে চেপে ধরে বলেন,
“মামুনি তুই আমার কথায় কষ্ট পাস না। আমারি ভুল আমার উচিৎ হয় নাই তোরে তোর অতীত, তোর আসল পরিচয় জানানোর। আমি যদি তোকে কখনো তোর অতীত সম্পর্কে না বলতাম তাহলে তুই আজ আমার কাছে সামনে থেকে মুখ ফুলিয়ে রেগেমেগে থাকলেও অন্তর বেয়ে শান্তি পেতাম। অন্তত পক্ষে তোর এই মুখে কান্না আসতো না। আগের মত তোকে বকতাম, ঝাড়তাম ব্যস তুইও আমার মেয়ের মত থাকতি।”
“না বাবা আপনি কোনো ভুল করেননি। আমিই সবসময় আপনাকে গলদ ভেবে গালমন্দ করে নিজেকে প্রশান্ত করতাম। চাইতাম যেনো আপনার সাথে মায়ের সম্পর্ক ছিন্নভিন্ন হয়ে যাক। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম বাবা। আপনি নিজেই পরিস্থিতির মধ্যে ফেঁসে ছিলেন। আমায় পারলে ক্ষমা করে দিয়েন। তবে আমি আজ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি অনেক কষ্ট করে। হয়ত সেই সিদ্ধান্ত আমাদের সবার জীবনও পাল্টে দিতে পারে। আমায় ক্ষমা করিয়েন বাবা।”
সারোয়ার শেহরীনার কষ্টমাখা স্বরে ঘাবড়ে আছে। সে বুঝছে না হঠাৎ মেয়েটা কী এমন সিদ্ধান্ত নিলো যার জন্য সে ক্ষমা অব্দি চাইছে। শেহরীনা তখন সারোয়ার কে বলে,
‘কিছুক্ষণের জন্য আমার রুমে আসবেন?’
‘হুম আসুন।’
শেহরীনা তার সৎ বাবার হাতে মাথা ঠেকে চুমু খেয়ে বলে,’আপনি বিশ্রাম করেন বাবা। আমি আসছি।’
সারোয়ার কে সঙ্গে করে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়। সে তাকিয়ে রইল। শেহরীনা নিরীহ চোখে তাকায়। তার চোখ বোঝাচ্ছে সে নিশ্চয় তার হৃদয়বিদারক কোনো কিছু বয়ান করবে। সেও প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শেহরীনা বিছানার উপর বসে সারোয়ার কে উদ্দেশ্য করে বলে,
“আপনি জীবনে অনেক সুখী হবেন স্যার। তবে আমার লক্ষ্য উদ্দেশ্য অতীত জানার পর থেকে সেটা আমার প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে পড়েছে। আমি চাইলেও আপনার সাথে জীবনে আগাতে পারব না। আমি চাইব আপনি নিজের জীবনে এগিয়ে যান। অপেক্ষা করবেন না আমার। যতদিন না আমার শোধ বোধ হয় আমি ফিরব না। আমার হিসেবের কিতাব পূর্ণ না হলে আমার মায়ের উপর কলঙ্ক থেকে যাবে। আপনার বাবা তো এককালীন ভালো কর্ম অবশ্য করেছিলেন যার কারণে আমি আমার সৎ বাবার ঘরে লালিত পালিত হয়েছি। মাত্রই তো উনার ভালোবাসা, স্নেহ পেতে শুরু করে ছিলাম। কিন্তু সেটাও কপালে দ্বিক্ষণ হবে না। আপনার কাছে অনুরোধ আমার জন্য অপেক্ষা করবেন না। আমার অনার্স লেভেলের আরো তিন বর্ষ বাকি। আমাকে আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পুরোপুরি পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে হবে। আপনি থাকলে আমি বেসামাল হয়ে পড়ি সারোয়ার সাহেব। আপনি থাকলে ভেতরে আনচান লেগে যায়। মন চাই চিৎকার করে বলি আমি আপনার হতে চাই। তবে একথা নিকচ আবেগ আমি সেটা জানি। আপনি হয়ত আজকের পর থেকে আমায় সহ্য করবেন না। আমি এতেই খুশি থাকব। আমি চাইব আপনি আপনার ক্যারিয়ারের পাশপাশি হালাল বিয়ে করে ফেলুন। আমার অপেক্ষায় নিজের বয়স বাড়াতে থাকবেন না। জীবনে চলার পথে কখনো দেখা হলে নিশ্চয় চাইব আপনি খুশি থাকেন যেনো।”
সারোয়ার তার কথার ঝুড়িতে কোনো বাক্য খুঁজে পেল না। সে আজ পুরি পূর্ণ ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। তবুও লোকটার ধৈর্য অপরিসীম বটে। তার চোখজোড়া স্পষ্ট প্রকাশ করছে অশ্রুজল। অথচ কী নিদারুণ ভাব নিয়ে সে তাকিয়ে রইছে। শেহরীনার দৃষ্টিকোণ দেখে সারোয়ার কেশে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ম্লান হেসে বলে,
“আমি সবসময় মেয়েদের কথা মান্য করি। আমার মতামত তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা আছে। সে ক্ষেত্রে আপনিও বিকল্প নন। চিন্তে করবেন না আমি কখনো আপনাকে থামাব না। তবে একটা আবদার রাখতে চাই যদি আপনি সাথ দেন তবেই সম্ভব সেটা।”
শেহরীনার গলা কাঁপছে। সে তো প্রেম প্রণয়ে কখনো জড়ায়নি বরং প্রেম প্রণয়ে কী অনুভূতি সৃষ্টি হয় তাও সে জানে না। তবুও তার ভেতরে সারোয়ার এর প্রতি একটান অনুভব,মোহ আছে। সেটা সে বিশ্বাস করে। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে,
‘জ্বী বলুন।’
‘জীবনসঙ্গি নাই বা বানালেন অন্তত সঙ্গি হিসেবে রাখুন। বিপদাপদ এ সঙ্গে থাকতে দেন। কারণ দেখতে গেলে আপনার ভাষ্যমতে আমি কিন্তু আপনার মামাতো ভাই হয়। ভাববেন না আপনি সঙ্গি না বানালে আমি ফ্লার্ট করব। সেই সব ফ্লার্টিং ম্লার্টিং মারতে আমি ইচ্ছুক নয়। আমার থেকে ঐসব এক্সপেক্ট ও করবেন না। আর যেখানে বিয়ের কথা নিয়ে আপনি লেকচার শুনালেন। সরি টু সে আমি সেসব কানে পর্যন্ত নেইনি।’
শেহরীনার মাথা ধরে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বলে,’ফাজলামি করছেন আমার সাথে?’
‘যেহেতু মামাতো ভাই সেহেতু ফাজলামি শব্দটা আজ থেকে আনকমন নয় আমাদের মাঝে।’
‘দেখুন আমাদের প্রাইভেট কথার মাঝে রিলেটিভিটি আসবে না।’
‘কেনো আমরা তেমন কোনো প্রাইভেট কথা বলছি বলে তো মনে হচ্ছে না!’
ইঙ্গিতটা যে বাজে দিকে গেল সহজেই ধরে ফেলেছে শেহরীনা। রেগে সে চাপড়ে দিল সারোয়ার এর পিঠে। সে ‘আউচচচচচ’ করে বাচ্চাদের মত পিঠে মালিশ দিয়ে সরু চোখে শেহরীনার দিকে তাকিয়ে বলে,
“হোয়াট রাবিশ? মা*রলেন কেনো? আমি কী আপনাকে টার্চ করেছি না ন’টি কথা বলেছি না আপনাকে বিয়ে করার জন্য জোরজবরদস্তি করলাম হুম?”
একদমে কথাগুলো বলে সারোয়ার জোরালো দম ফেলে। শেহরীনা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। সে আর সহ্য করতে পারবে না এই বান্দর কে। তাই সে সারোয়ার এর বাহু ধরে তাকে রুমের থেকে ধাক্কিয়ে বের করে দরজা আটকে দিল। খানিক চিৎকার দিয়ে ‘গেট আউট পার্ভাট বয়’। চিৎকার শুনে রূপালি বেগম দৌড়ে আসলেন, সারোয়ার কে পকেটে হাত গুঁজে মিটমিটে হাসতে দেখে তিনি অবাক স্বরে জিজ্ঞাসা করেন।
‘বাবা কী হয়েছে ভেতরে কী বলেছে শেহরীনা? সে কী তোমার সাথে খারাপ আচরণ করেছে কোনো!’
সারোয়ার তার ফুপির দিকে তাকায়। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না তার ফুপি নামক এক ব্যক্তি আদৌ আছে। কোমল মুখশ্রীর এই মানবী কী না এতটা বছর দূরে ছিল। তার বাবাও কেমন কখনো তার বোনের কথা কেনো জানায়নি পরিবারের কাছে? তবে কী বাবা কিছু লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন? রূপালি বেগম সারোয়ার কে তাকিয়ে অন্যমনস্ক দেখে তাকে ধরে নাড়া দেন। সারোয়ার তার ধ্যান থেকে ফিরে বলে,
“না ফুপি কিছু হয়নি।”
রূপালি বেগম ‘ফুপি’ ডাক শুনে আহ্লাদী হয়ে গেলেন। তিনি সারোয়ার এর মুখে হাত রেখে কাছে টেনে কপাল বরাবর চুমু দিলেন। তার চুলে হাত বুলিয়ে বলেন,
“বাবা মাফ করিস তোর বাবার কারণে এতটা বছর অভিমান করে তোদের কেও দেখতে যায়নি। কিন্তু আমি জানি না তোরা কবে জম্ম নিলি। হ্যাঁ এটা মনে আছে আমি গর্ভবতী ছিলাম কিন্তু ভাইয়ার বউ পদ্মিতা ভাবীর আমার পর বিয়ে হয়েছিল ভাইয়ার সাথে তাহলে তোর মা কেমনে জাহানারা পুষ্প উনি? সেটা আমি জানি না। তোর বয়সও কেনো যেনো সন্দেহ জনক। আমি তোকে একটা কথা বলি মন দিয়ে শোন। ভাইয়া খুব চাপা স্বভাবের। হয়ত তিনি বুকের ভেতর কিছু কষ্ট লুকিয়ে রেখেছেন। তুই তো ভাইয়ার সন্তান। ভাইয়াকে একলা জায়গায় নিয়ে দুজন বসে আরামে অতীত এর ব্যাপারে জানার চেষ্টা করিস।”
“ঠিক আছে ফুপি আম্মু তুমি কোনো চিন্তা করো না।”
“হুম আচ্ছা বাবা শেহরীনা কী বলেছে? আমি রান্নাঘরের থেকে তোমার ফুপোর রুম থেকে অর্ধ কথা শুনেছি। সে নাকি বিয়েতে অমত করেছে?”
সারোয়ার মিটি হেসে বলে,
“সেটা নিয়েও চিন্তা করবেন না। আপনার মেয়ের আসলে চুটিয়ে প্রেম করার ইচ্ছে হচ্ছে। তাই সময় নিয়েছে। আমিও দিয়েছি আফটার অল আমার হার্ট অনেক বড় মাপের বলে কথা। হবু বউ কে তার স্বকীয়তা পূরণের জন্য আমিও পিছু পিছু যাবো। তার শখ মানে আমার শখ।”
রূপালি বেগম সারোয়ার এর বাচ্চামির মত মুখশ্রী দেখে হাসলেন। তাকে ধরে সোফায় বসিয়ে বলেন,
‘তুই বস আজ থেকে তুই করেই ডাকব তোকেও। বস আমি নাস্তা আনছি খেয়ে যাস।’
সারোয়ার মাথা নাড়ে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
ধ্যান ফেরে তার ফোনের মধ্যে আযানের ওয়াক্তের শব্দে। সে তার ফোনে ওয়াক্তের সময় ঠিক করে রেখেছে। বিধেয় এলার্ম বেজে উঠায় সে মাথা চুলকে হাসে।
সেদিনের পর থেকে আজ প্রায় পাঁচ দিন পার হয়ে গেল। মেয়েটা ইচ্ছেকৃত নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। কবে ভার্সিটির মধ্যে যায় আর আসে তাও সে ধরতে পারছে না। তবে কতদিন আর? সেও কী কম যায় তার মত ব্যারিস্টার মানুষের চোখ ফাঁকি কী আদৌ শেহরীনা দিতে পারবে? ভেবেই শেহরীনার চালাকিতে অমায়িক হাসল।
___
“স্যাম বাবা রেডি হও আমরা বীচে ঘুরতে যাচ্ছি।”
কায়েসাম শুয়ে আছে। তার গালে মোচ জমে পুরো মুখ ভর্তি হয়ে দেখতে পূর্ণ অগোছালো লাগছে তাকে। হাতে মদের বড়সরো কাঁচের বোতল। বোতলের সীপ খোলা। মায়ের কথা তার কানে গিয়েছে কী না আদৌ সন্দেহ। রুফিয়া সাইমুম কান্না আটকে পুনরায় ‘স্যাম বাবা’ বলে ডাকেন। কায়েসাম নিভু নিভু চোখজোড়া নিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। তিনি ফোঁস করে কান্না করতে লাগলেন। কায়েসাম বিরক্তির মুখ করে বলে,’ধ্যাঁত বাল কান্নার শব্দ শুনতে ভালো লাগছে না। যাও তো।’
‘বাবা একটু ঘুমিয়ে নেহ্ তোর চোখ লাল হয়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ জাগলে তোর শরীর খারাপ করবে।’
‘না না আমি ঘুমাব না। ঘুমালেই শেহরীনা আমাকে ছেড়ে চলে যাবে।’
রুফিয়া সাইমুম রুম থেকে বেরিয়ে শক্ত মনে নিজের রুমে গেলেন। আলমারি খুলে ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে ছেলের রুমে আসেন। ই*ন*জেক*শন বের করে ঘুমের মেডিসিন বোতল এ ফুটো দিয়ে হাঁফ করে সেটা ছেলের কাছে গিয়ে জোরপূর্বক তার হাতের কনুইয়ের মধ্যে লাগিয়ে দেন। কায়েসাম চিৎকার করলেও কোনো লাভ হয় না। পরক্ষণে সে ঘুমের মাঝে ঢলে পড়ে। তিনি ছেলের পাশে বসে তার চুলে হাত বুলিয়ে বিলি কেটে বলেন,
“দেখবি আমি তোর জন্য নূর আনব যে তোকে শেহরীনার কথাও ভুলিয়ে দেবে সারাজীবনের জন্য। তুই তখন শুধু তাকেই ভালোবাসবি।”
ইদরিব সাবেক ছেলের রুমের বাহির থেকে ভেতরের দৃশ্য দেখে তিনিও ছেলের যন্ত্রণায় কাতড় হয়ে গেছেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি ছেলের বিয়ে দিয়ে ছাড়বেন। ফলস্বরূপ তিনি ভেতরে গিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকান। তার কাঁধে হাত রেখে তার উপস্থিতি অনুভব করান। রুফিয়া সাইমুম স্বামীর আগায় ছেলেকে ওভাবে ফেলে দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দেন। ছেলের অসুস্থতায় যদি সে পালিয়ে যায় তার ভয়ে তারা ঝুঁকি নিতে চাননি।
চলবে……
(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। অপেক্ষা করানোর জন্য দুঃখিত।)