প্রিয়অপ্রিয়ের সংসার পর্ব-২+৩

0
37

#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০২_০৩

“শুনো মা আমি বলি কী ঐ পাত্রীর বাবাকে কল করে বিয়ের জন্য মানা করে দাও। আরে ভাইয়ার জন্য আমার নিজের ননদ মাইমুনার চেয়ে রূপে,গুণে গুণান্বিত অন্য কাউকে পাবে না। হ্যাঁ এটা মানছি যে সে অল্প শিক্ষা অর্জন করেই বাসায় বসে সোশ্যাল জগতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। তার মানে এই না যে সে কিছুই করতে পারে না। জানো মা সে পড়াশুনা ছাড়লেও কাজের হাত তার খুব পটু। তুড়ি বাজাতেই সব কাজ শেষ। তাকে রেখে তুমি কেনো অন্য কোথাও মেয়ে খুঁজতে যাও বুঝি না আমি। কতবার বলেছি মাইমুনার দিকে ভাইয়াকে ভিড়িয়ে নাও। কিন্তু না তুমি তো মানোই না আমার কথা।”

জাহানারা পুষ্প কপাল চাপড়ে মেয়ের মাথায় চাপড় মারেন। সারোয়ার এর বোন সাজিয়া কপাল কুঁচকে মায়ের দিকে অভিমানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

“হ্যাঁ হ্যাঁ এখন আমাকেই বুঝাবে তুমি।‌ আর‌ বুঝানোর দরকার নেই। আমি তোমার সারাজীবন এর শান্তির জন্য সুপুত্রী খুঁজে বেড়ায় আর তুমি তাদের কে ছাঁটাই করে আমার মুখের মধ্যে থা*প্প*ড় দাও।”

“দেখ মা আমি তোর ভাইয়ার মুখের উপর কথা বলতে পারুম না। দেখলি না পাত্রীর বাসার থেকে বের হতেই মানা করছিলাম শুনছিল তোর ভাইয়ে? শুনেনি উল্টো নিজ মুখী কথায় অটুট থেকে আমায় চুপ করিয়ে দিয়ে ছিল। পারলে তুই নিজে গিয়ে বল যাহ্।”

সাজিয়া মায়ের কথা শুনে দমে গেল। এতক্ষণের উচ্চ আওয়াজ মিইয়ে গেল। সে তার ভাইকে জঙ্গের মত ভয় পায়। কেননা একদা সময় তার স্বামী দেওয়ান শেখর এর কথা অমান্য করে সে বাপের বাড়িতে চলে এসে ছিল। তার পিছু পিছু তার স্বামী দেওয়ান ও আসে। এতে সাজিয়ার দাপট দ্বিগুণ বেড়ে যায়। সে দেওয়ানের উপর মানসিক অত্যাচার শুরু করে। তখন বাড়িতে তার ভাই সারোয়ার ছিল না। রাজনৈতিক সুখ্যাত এক ব্যক্তির কেইসের তদন্তে ব্যস্ত ছিল। দেওয়ান কে একলা পেয়ে সে তার মাথায় খালি এক কথা ঢুকানোর চেষ্টা করে।
‘মাইমুনাকে ভাইয়ার সাথে বিয়ে করাতে রাজি করাও। এতে আমাদের লাভ বেশি। আমার বাবা জমির অর্ধশতাধিক অংশ ভাইয়ার নামে করে রেখেছে। ভাইয়ার সাথে মাইমুনার বিয়ে হলে সে রানীর মত রাজ করবে। আর তোমার মায়ের বয়সও হয়েছে অনেক। তারও তো বিশ্রামের দরকার। এমনিতে উনি থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত। উনার সুষ্ঠু চিকিৎসা না হলে আগের চেয়েও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়বে। তাই বলছিলাম কী উনাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠালে ভালো হবে। দেখো না আমিও বাচ্চার পেছনে লেগে থাকি আর তুমিও অফিসের কাজে শহরের বাহিরে চলে যাও। সব সামলে উঠতে আমার কষ্ট হয়।’

একদিকে বউয়ের ইমোশনাল কথাবার্তা আরেকদিকে মায়ের অসুস্থতার চিন্তা দুদিকের বেড়াজালে আটকে পড়ে দেওয়ান। সাজিয়াও সুযোগ বুঝে তীর মারতে ভুলেনি। মানসিক ভাবে চাপ দিয়ে স্বামীকে রাজি করিয়েই ছাড়ে। দেওয়ান নিজ মনে না চেয়েও বউয়ের কথার পরিপ্রেক্ষতা সঠিক বিবেচনা করে সর্বপ্রথম তার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে নেওয়ার ব্যবস্থা করে। এর মাঝে দুদিনের ছুটিতে বাড়িতে আসে সারোয়ার। তার হাসিমাখা মুখে গম্ভীরতা ছড়িয়ে পড়ে যখন সে জানতে পারে সাজিয়া বাড়িতে চলে এসেছে সামান্য এক তর্কের ভিত্তিতে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার মেয়েটা কী বুঝে ঐ বৃদ্ধ মহিলাকে সন্তান ছাড়া করতে চাইছে সারোয়ার খুঁজে পেল না। পরক্ষণে ঘোর ভাবে ভাবার পর সারোয়ার তার বোনের শয়তানি বুদ্ধির বিষয়টা বুঝতে পারে। তখনি সকলের সামনে থেকে বোনকে আঁকড়ে ধরে রুমে এনে দরজা আটকে দু দুবার চ’ড় দেয়। সেদিন সাজিয়ার ঠোঁট ফেটে রক্ত গড়িয়েছিল। কিছু উচিৎ কথা শুনিয়ে দেওয়ানকে বুঝিয়ে সাজিয়াকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে ছিল। এ নিয়ে কান্নাকাটি করেও লাভ হয়নি সাজিয়ার। সারোয়ার এক কথার মানুষ। সাজিয়া পরবর্তীতে ক্ষমা চেয়ে ছিল। সারোয়ার তখনো তার জেদের কাছে অটল। তার মাসখানেক পরে অবশ্যই সারোয়ার ক্ষমা করে দিয়ে ছিল। বিধেয় সে আবারো তার বাপের বাড়িতে অবস্থান করতে পারছে।

“কী হলো আগের ঘটনা কল্পনা করা শেষ?”

মায়ের কথায় সাজিয়া চোখ নিচে করে নিল। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানায়। জাহানারা পুষ্প মৃদু হেসে দেওয়ালের দিকে মুখ করে বলেন,

“তোর ভাইকে আমি সবচেয়ে ভালো চিনি। তার প্রতিটা রূপ-আচরণের মূলভিত্তি হলো তোর বাবা। তার রগ পেয়েছে ছেলেটা। মায়ের কোনো কিছুই পায়নি সে। তার একটাই কথা আমিই ভুল আর তার বাবা সঠিক।”

“এটা তোমার ভুল ধারণা মা।”

ভাইয়ের রূফ গলায় কথাটা শুনে ইতস্তত করে মায়ের সাথে গাঁ ঘেঁষে বসে পড়ে সাজিয়া। যেনো ভাইকে বসতে জায়গা করে দিলো মায়ের সামনের আসনে। সারোয়ার রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। দরজায় টোকা দিয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ভেতরে আসার অনুমতি চাইল। ছেলেটার ভদ্রতা সবচেয়ে বড় তার নিকট। জাহানারা পুষ্প আমতা আমতা করে আসার অনুমতি দিলেন। সারোয়ার এসে মা-বোনের কাছ থেকে যথেষ্ট দূরত্ব রেখে সিঙ্গেল চেয়ার টেনে বসল। হাঁটুর উপর হাত রেখে কপাল কুঁচকে মা-বোনের দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টি রাখল। জাহানারা পুষ্প ঢোক গিলে বলেন,

“বাবা সাজিয়ার কথায় কিছু মনে করিস না। সে তোর ভালো চাই দেখেই মাইমুনার সাথে তোর বিয়ের বন্দোবস্ত করতে চাই।”

“মা প্রথমত আপনি জানেন আমার বয়স কত? মা হিসেবে আপনার কাছেই আমার বয়সের সঠিক উত্তর থাকার কথা কিন্তু সেই উত্তর আপনার জানা নেই। হয়ত বয়সের আর সংসারের টানাপোড়েনে সেই উত্তর অজানা থাকার কথাই। এতে অবশ্য আমি দোষ দিচ্ছি না। আপনারা শেহরীনা কে দেখতে পারেন তবে মাইমুনা কে নয়। মাইমুনার বয়স আর আমার বয়সের তফাৎ খেয়াল করেছেন? সে আমার থেকে বারো বছরের ছোট একটা মেয়ে। তাকে আমি সাজিয়ার মত বোনের চোখেই দেখে থাকি। সেই স্বল্প বয়সী মেয়ের বুঝজ্ঞান কতটুকু হতে পারে ভাবেন তো দেখি!”

জাহানারা পুষ্প এবার যেনো গলে গেলেন। ছেলের কথায় সত্যতা লুকিয়ে আছে। মাইমুনা মেয়েটি চঞ্চল আর খুব জেদি প্রকৃতির। তার কাছে শিক্ষা মর্যাদা নেই বললেই চলে। এসবের দিক থেকে আবার এগিয়ে আসে শেহরীনা মেয়েটি। মায়ের অবিচল মুখশ্রী দেখে সারোয়ার মৃদু গলায় বলে,

“আপনি এতটা চিন্তা করবেন না মা। সবটা আপনার এই সন্তান সামলে নেবে। যেহেতু আমি শেহরীনার বাবার কাছ থেকে একসপ্তাহ সময় নিয়ে ফেলেছি। সেহেতু আমি শেহরীনাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচাই করে নিজের জন্য বাছাই করতে চাই।”

সাজিয়া শুনে মুখ বাঁকিয়ে বলে,

“শুনেন ভাইয়া বয়স নিয়ে এতো মাতামাতি কিসের? মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে করাই উত্তম। নাহলে বয়স বাড়তেই যৌবনের ভিন্ন রঙিন মোহে পড়ে বিপথে চলে যায়। আমার কেনো যেনো মনে হয় ঐ শেহরীনা মেয়েটার ও কোথাও চক্কর চলছে। দেখেননি কীভাবে আপনাকে রিজেক্ট করল! এতো বড় ব্যারিস্টার পদবী প্রাপ্ত ব্যক্তিকে কেউ মুখের উপর না করতে পারে? অবশ্য যে করে তার অন্য কোথাও চক্কর নিশ্চয় চলছে। এদিকে মাইমুনা কে দেখেন তার মনের মত নিষ্পাপ মেয়ে আমি আর দুটো কোথাও দেখিনি।”

সারোয়ার নির্লিপ্ত হয়ে বসে রইল। বোনের কথার প্রসঙ্গে জবাব দেওয়ার মন ইচ্ছে পোষণ করল না। বোনের অহেতুক কথাবার্তা তার কাছে নতুন কিছু নয়। মায়ের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বলে,

“আমার আজ মন্ত্রিসভায় মিটিং আছে। নতুন কেইস হাতে এসেছে। সেই কেইসের তদন্তে বের হচ্ছি। বাড়ি আসতে রাত হতে পারে আপনারা খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে যাইয়েন। আমার কাছে এক্সট্রা চাবি আছে। নিজ দায়িত্বে রুমে আসতে পারব।”

জাহানারা পুষ্প মৃদু হাসলেন। ছেলের স্বভাব অবিকল তার স্বামীর মতন। ঐ মানুষটাও বিন্দুমাত্র কষ্ট দিতে চাই না তার স্ত্রীকে। সাজিয়া তার মায়ের মন গলেছে দেখে দাঁতে দাঁত চেপে মায়ের পাশ থেকে সরে উঠে পড়ল। জাহানারা পুষ্প গোলগাল মুখ করে মেয়ের দিকে তাকান। সাজিয়া ফোঁস ফোঁস করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মা হয়ে জাহানারা পুষ্প মেয়েকে কিছুটি বললেন না। তার মধ্যে বাপের বাড়িতে কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে আসা মেয়েটার। ফলে চুপটি করে ছেলে-মেয়েদের কাণ্ড দেখে গেলেন।

____
শেহরীনার খুব খিদে পেয়েছে। কোনো মতে আইন প্রচ্ছদের ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে পড়ে সে। তার পিছু পিছু তার ফাজিল বন্ধুগণ চলে এলো। শেহরীনা উত্তপ্ত লাভার মত ভড়কে পড়ে তাদের উপরে। শেহরীনার বান্ধবী ইপশিতা কোমরে হাত রেখে ঠোঁট কামড়ে বলে,

“এটা কোনো কথা তুই ব্যারিস্টার কে বিয়ে করতে মানা করলি? মানে তোর মাথায় এতটা ঘিলু ভরা যে এত বড় পদবীর মানুষ কে রিজেক্ট করে বসে আছিস। আমি হলে তো তার কোলে বসে যেতাম।”

শেহরীনা দাঁতে দাঁত চেপে ইপশিতার বাহুতে চাপড় দেয়। সে ‘আউচ’ করে বাহুতে মালিশ করে কাঁদো কাঁদো মুখ করে তাকায়। শেহরীনার বন্ধু ফারদিন ইপশিতাকে ঠ্যালা মেরে সরিয়ে শেহরীনার গাঁ ঘেঁষে বসল। ইপশিতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“আসলে তোরই মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি নাই ইপু। শেহু যদি ইজিলি ঐ ব্যারিস্টার কে হাতে নিয়ে চেপে ধরে তাহলে ব্যারিস্টার কী কোনো পাগলও তার সাথে বিয়ে করতে চাইবে না।”

শেহরীনা শুনে ভ্রু কুঁচকে ফারদিনের তাকায়। ফারদিন এর সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা জাফরান ও একই ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। সকলের দৃষ্টিজোড়া দেখে ফারদিন আমতা আমতা করে বলে,

“আরে আমার কথার অর্থ হলো শেহরীনার বয়স এখনো বেশি হয়নি। ব্যারিস্টার হলেও তার চারিত্রিক গুণ সম্পর্কে আমরা জানি না। সে যদি ভবিষ্যতে বিয়ের পর শেহরীনাকে পড়তে না দেয় তখন? তখন তো বেচারীর স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে। তাই আমার মনে হয় তার বেয়াদবি করাটা একেবারে উচিৎ হয়েছে।”

শেহরীনা আনমনে ফারদিনের কথাটি ভাবল। তার কাছে অবশ্য মনে হচ্ছে না যে সারোয়ার তাকে পড়াবেন না অথবা ঘরকুনো বউ বানিয়ে রাখবেন তবুও মনের কথায় সাড়া দিলে চলবে না। এই ভেবে সেও তার কথায় অটল রইল।
হঠাৎ তাদের মাঝে খাবারের অর্ডার নিতে ছেলে একটা আসল। তারা তাদের মত খাবার অর্ডার দিয়ে আড্ডায় মশগুল হলো। কথার ছলে জাফরান এর নজর পড়ল শেহরীনার পেছনের টেবিলে বসা অন্য একটি গ্যাং এর দিকে। তারাও আইন বিভাগের ছাত্র ছাত্রী তবে এক সেমিষ্টার আগে রয়েছে তারা। সিনিয়র ব্যাচ হলেও তাদের শয়তানি কাণ্ডকীর্তি সকলের জানা। এদের কী ভেবে আইন বিভাগে ভর্তি করানো হয়েছে কে জানে? জাফরান তার হাত দিয়ে টোকা দিয়ে সর্তক বাণী ইঙ্গিত করে সবাইকে। শেহরীনা দেখে চুপচাপ গল্পে মেতে রইল। ইপশিতা প্রচুর কথা বলে। তার কথার মাঝে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে শেহরীনা।
তখনকার ছেলেটা খাবার নিয়ে এলো। যে যার মত খাবার নিয়ে নেয়। শেহরীনা যেই না তার খাবারটুকু মুখে নিতে গেল তখনি তার হাত চেপে ধরে সেই খাবারটুকু খেয়ে নিলো এক যুবক। শেহরীনা ভ্রু কুঁচকে বিকৃত মুখ করে নিলো। হাতটা ছাড়িয়ে টেবিলে থাবা মেরে তাকাল যুবকের দিকে। তার পরণে বাদামী রঙের শার্ট আর কালো জিন্স,মুখের আদল দেখে বোঝা ভার তার মনে কী চলছে? ভাঁজ করা চুলের অর্ধেক অংশ বাতাসের তালে উড়ছে তাকে বেবি হেয়ার বলে। যুবকটি ভ্রু নাচিয়ে বলে,

“পছন্দ হয়েছে কী কুমারিনী?”

“অলুক মানুষ কে আমার কস্মিনকালেও পছন্দ নয়।”

“ইশ এভাবে বলো না কুমারিনী। সিনিয়র কে সম্মান দিয়ে পছন্দ হয়েছে বলতে হয় বুঝেছো?”

“সেইটা আপনার ব্যাপার। আইম নট ইন্টারেস্টেড।”

“ওহ কুমারিনী বুঝি রেগে গেল? কী তোমার হাত থেকে একটু ভালোবাসাময় আদর খেয়েছি এতেই এতো রাগ বাবা। বিয়ে হলে তখন কী করবে শুনি?”

ফারদিন রেগে দাঁড়িয়ে যেতে চাইলে শেহরীনা তার হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিলো। সে ভার্সিটিতে কোনো ধরনের ঝগড়া বিবাদ চাইছে না। এটা কোনো কোর্ট ক্যাচালির স্থান ও নয় , উপযুক্ত সময় ও নয় তথাপি কথার তালে কথা বেড়ে হাতাপায়ি হতে পারে। শেহরীনার ধৈর্য্য দেখে যুবকটি তার বুকের উপর হাত রেখে বলে,

“উফ মেরে ফেললা। এত ধৈর্য কেমনে আসে তোমার? আমি হলে কতক্ষণে চ’ড় লাগিয়ে দিতাম।”

শেহরীনা ভ্রু কুঁচকে বলে,’চ’ড় মা*রা*র এই স্থান উপযুক্ত নয় মিস্টার কায়েসাম তাহর এখন যদি আমি হাত তুলি তাহলে তা আপনার জন্য বেশি একটা সুবিধার হবে না। আফটার অল জুনিয়রের হাতে সিনিয়র এর চ’ড় খাওয়াটা বেমানান।’

কায়েসাম তাহর হাত মুষ্টিবদ্ধ করে অপমান টুকু গিলে নিল। দাঁত দেখিয়ে হেসে বলে,’ওয়াও নাইচ এটটিটিউড গার্ল। তাই তুমি আমার এতটা পছন্দের।’

“আপনি আমার ততটা অপছন্দের যতটা আপনি আমায় পছন্দ করেন। নাউ প্লিজ আমার সাথে খাবারটুকু শেয়ার করুন। আমি আবার বেশি দয়ালু কেউ খেতে চাইলে ভিক্ষা চাওয়া ছাড়াই দিয়ে দেয়।”

কায়েসাম এর অপমানিত রূপ দেখে তার বন্ধু এগিয়ে আসতে চাইলে সে থামিয়ে দেয়। শেহরীনার মুখের আদলের দিকে তাকিয়ে থেকে জবাব দিলো।

“এই দয়ালু ব্যক্তির জন্য ভিক্ষুক হলেও আমার সমস্যা নেই।”

ফারদিন গলা উঁচিয়ে বলে,’তাহলে কোন মুহুর্তের অপেক্ষা করছেন ভাইয়া এখনি ভিক্ষা করতে শুরু করেন। আমরাও এর বিনিময়ে কিছু পয়সা দিয়ে সওয়াব কামানোর সুযোগ পেতে চাই।’

কায়েসাম মৃদু হাসল ফারদিনের দিকে একপলক তাকিয়ে শেহরীনাকে ‘বাই জান’ বলে ক্যান্টিন থেকে চলে গেল। শেহরীনা পাত্তা অব্দি দিলো না উল্টো ফারদিনের কথায় হাসতে লাগল। কায়েসাম মেয়েলী হাসির শব্দে পেছন ফেরে শেহরীনার দিকে তাকায়। সেও খেয়াল করে পানির বোতল নিয়ে তার হাত ধুতো করল। এতে গম্ভীর হয়ে গেল কায়েসাম এর মুখশ্রী। কেননা শেহরীনার যেই হাত সে ছুঁয়ে ছিল সেই হাতই শেহরীনা তাকে দেখিয়ে ধুয়েছে। গম্ভীর মুখখানা নিয়ে কায়েসাম ক্যান্টিন ত্যাগ করল।

চলবে……..
(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৩

নাছির উদ্দিন এর বে*ল্ট র*ক্তা*ক্ত হয়ে আছে। ক্লান্ত হয়ে ছেলের বিছানার উপর বসে হাঁফাচ্ছেন তিনি। তার সামনে মাটিতে অসহায় নিরীহ আঘাতপ্রাপ্ত শরীর নিয়ে পড়ে আছেন রূপালি বেগম। নাছির উদ্দিন বে*ল্টটি নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলেন। রূপালি বেগম নিজেও বহু যন্ত্রণা সহ্য করে উঠে বসলেন গদির উপরে। নাছির উদ্দিন বে*ল্ট ধুয়ে ফকফকা করে আলনায় শুকাতে ঝুলিয়ে রাখলেন। লুঙ্গির মধ্যে গিট্টু মে*রে টেবিল থেকে একথোকা পান নিয়ে মুখে পুরে নেন। নিজ স্ত্রীর আঘাতপ্রাপ্ত শরীর দেখেও পাত্তা দিলেন না। উল্টো কর্কশ গলায় আদেশ করলেন।

“এই মা* এখনো বসে আছিস কেন? আমার বাচ্চারা এগারোটা বাজতে বাজতে চলে আসব। তাদের পেটে ক্ষুধা থাকব না? তোই বসে আছিস কেন? যাহ্ রান্না বসা। ন্যাকা ব্যথা দেখাইয়া লাভ নাই।”

তাচ্ছিল্য দেখিয়ে নাছির উদ্দিন পান‌ চিবুতে থেকে এক প্যাকেট সিগারেট তার স্ত্রীর চোখের আড়ালে কৌশলে লুঙ্গির মধ্যে চেপে ধরে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। রূপালি বেগম নির্জীব দৃষ্টিতে স্বামীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। তিনি জানেন লোকটা এ মুহূর্তে একান্ত সময় কাটাবেন। তিনি নিজ মনকে বুঝ দিয়ে নিজেকে শাস্তি দেবেন। সেই শাস্তিটি শরীরকে অকেজো বানানোর অন্যতম হাতিয়ার হলো সিগারেট। তিনি বাচ্চাদের কে নিয়ে আসার পূর্বেই সিগারেটের এক প্যাকেট শেষ করবেন। রূপালি বেগম তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করে আলমারি খুলে মলম এর কৌটা বের করে ব্যথা পাওয়া স্থানে ধীরে স্থির ভাবে লাগাতে বসলেন।
শেহরীনা টিউশনি পড়িয়ে সবে মাত্র বাসায় ফিরল। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)কিন্তু বাহির থেকে বাসার বাতি বন্ধ দেখে কিছুটা অবাক হলো সে। সাধারণত অন্য সময়ে বাতি জ্বালানো থাকে। আজ বন্ধ দেখে ভয়ভীতি মনে ধরে তৎক্ষণাৎ মায়ের রুমে ছুটে গেল। কিন্তু গিয়ে থমকে যায়। তার মা তার সৎ বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে শেহরীনার মুখের আদলে কষ্ট ভেসে উঠল। তার সৎ বোন নাসমার জায়গায় সে নিজেকে কল্পনা করতে লাগল। ছোট থেকে মায়ের আদরের অভাব বোধ করেছে শেহরীনার শক্তপোক্ত মন। তার সেই মনের দ্বার নরমও হতে পারতো। কিন্তু কেউই তার কাছে ছিল না যে আদর স্নেহ দ্বারা বুঝিয়ে পথ দেখাবে। শেহরীনা মুখ মলিন করে মাকে জিজ্ঞেস করে।

“মা আজ বাতি জ্বালাওনি কেনো?”

“সব কথা কী বলে বলে করাতে হবে? দেখছিস আমি আমার মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি এখানে এসে ঠ্যাং দিচ্ছিস কেন? নিজ দায়িত্বে বাতি জ্বালিয়ে দিতে পারিস না?”

“সরি মা আমি তো শুধু জিজ্ঞেস কর…।”

রূপালি বেগম ‘অ’ উচ্চারণ করতে নিলে ছোট মেয়ে নাসমা ‘উহ মা মাথা ব্যথা করছে’ কাতর কন্ঠে বলে কাঁচা ঘুম থেকে জেগে উঠল। রূপালি বেগম দ্বিগুণ রেগে যান। শেহরীনার দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বকে দিলেন।

“মুখপুরী দিলি তো আমার মেয়ের সাধের ঘুমটা ভেঙ্গে। যাহ্ সামনে থেকে যখনি আছিস কোনো না কোনো অঘটন ঘটিয়ে ছাড়িস।”

মায়ের তীক্ষ্ণ কথা মুখ বুঁজে সহ্য করে নিল শেহরীনা। কাঁধের ব‌্যাগ শক্ত করে চেপে উঠানে গিয়ে বাতির সুইচে জোরে সরে আঘাত করে বাতি জ্বালালো। নাছির উদ্দিন এতক্ষণ দূর হতে মা-মেয়ের ঝগড়া উপভোগ করছিলেন। এ মুহূর্তে শেহরীনার রেগে করা কাজটিকে তিনি খুঁত ধরে বাঁকা হেসে এগিয়ে গেলেন। শেহরীনা দাঁতে দাঁত চেপে প্রস্থান করতে গেলে নাছির উদ্দিন কণ্ঠস্বর গম্ভীর করে ‘এই মেয়ে দাঁড়া’ বলে থামিয়ে দিলেন তাকে। সৎ বাবার ডাক অপেক্ষা করতে চেয়েও পারল না শেহরীনা। মায়ের মলিন মুখ তার চোখের সামনে ভেসে উঠায় চোখ বুঁজে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সৎ বাবার দিকে তাকাল। নাছির উদ্দিন লুঙ্গির নিচু অংশ ঝাড়তে থেকে সৎ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

“সুন্দর করে আবারো সুইচটা চালু কর। এইডা তোর বাপের সম্পত্তি না। এডা আমার টাকায় কেনা সম্পত্তি। তোরা মা-মেয়ে মিলে নষ্ট করা ছাড়া আর কিছু শিখিসনি?”

শেহরীনার মোটেও কথাগুলো শুনতে মন চাইছে না। অতৃপ্ত মন নিয়ে সৎ বাবার কথামত পুনরায় সুইচ বন্ধ করে আবার জ্বালিয়ে ছুটে রুমে চলে যায়। নাছির উদ্দিন তার কাজে সফল হয়ে তৃপ্তি পেলেন। লুঙ্গির মাঝ অংশ থেকে পান বের করে মুখে নিয়ে নিজের স্ত্রী কে আদুরীয় গলায় ডাক দিলেন। রূপালি বেগম নাসমার গাঁয়ে কাঁথা দিয়ে স্বামীর ডাকে ছুটে আসলেন। নাছির উদ্দিন পান চিবুতে থেকে নিজ বেগমের আপাদমস্তক পরখ করলেন। রূপালি বেগম না ঘৃণ্য, না অভিমান নির্জীব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। নাছির উদ্দিন রূপালি বেগমের গাল টেনে বলেন,

“যাহ্ আমার জন্যে খেজুর বাটা নিয়ে আয়। আজকে খেজুরের শরবত খামু। আমার মুখ থেকে নেবে কেমন? তুমি তো জানোই আমার রাগ বেশি তখনের কথা ভোলার জন্যে স্বামী স্ত্রীর মোহাব্বত বাড়াতে হবে। তোই আমরা আজ রাতে স্বামী স্ত্রীর মোহাব্বত বাড়াব। বুঝছো বেগম সাহেবা?”

রূপালি বেগমের চুলের মুঠি চেপে ধরে জোরে এক টান প্রয়োগ করেন তিনি। স্বামীর দেওয়া আঘাতে যন্ত্রণায় অসহায় হয়ে মাথা নাড়লেন রূপালি বেগম। নাছির উদ্দিন তৃপ্তির হেসে উঠান পেড়িয়ে বের হয়ে যান। রূপালি বেগম আড়চোখে দেখে ধীরস্থির ভাবে হেঁটে শেহরীনার রুমের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। শেহরীনাকে কাঁথা মুখে চেপে শুয়ে থাকতে দেখে তিনি কয়েক কদম পেড়িয়ে জানালার কাছে এগিয়ে গেলেন। জানালায় কান পেতে শুনতে পেলেন মেয়ের আর্তনাদ। শেহরীনা ঘুমোয়নি সে মুখে কাঁথা চেপে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। তার মনের অভিযোগ ফিসফিসিয়ে আত্ম অনুভূতি নিয়ে ব্যক্ত করছে। মেয়ের অগোচরে তিনি নিজেও মুখে আঁচল চেপে কান্না নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলেন। মেয়েকে যতই উপুড় উপুড় ঘৃণা দেখাক না কেনো তিনি নিজে জানেন স্বামীর হাতে তিনি অসহায় মানবী। মানুষটার কথার চাল চলনে তিনি যদি অমান্য করেন তবে তার সেদিন কপালে সুখ থাকে না। আজকের ব্যথার যন্ত্রণায় তিনি পূর্ব পরিচিত। এই যে তার যন্ত্রনার কথা তিনি শেহরীনা কে জানতে দিলেন না। কেননা নাছির উদ্দিন এর একটাই শর্ত তিনি যদি মেয়েকে কিছু বলেন তবে তাদের সংসারে শেহরীনার স্থান বিতাড়িত হয়ে যাবে। চোখ বুঁজে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তিনি মেয়ের জানালার সামনে থেকে সরে গেলেন। ঘণ্টাখানেক পর রাতের খাবারের আয়োজন করতে হবে সেই কারণে তিনি ধীরস্থির পায়ে ছেলের রুমে গেলেন। কিছুটা সময় বিশ্রাম নিলে যদি শরীরটায় আরাম পান সেই উদ্দেশ্যে।

____
সারোয়ার কে রাস্তার মোড়ে বাজার কিনতে দেখে নাছির উদ্দিন এর চোখজোড়া লোভে ফরফরে হয়ে গেল। তিনি পানের চিলকি থুথু দিয়ে ফেলে মুখ মুছে ছুটে হবু জামাই বাবার কাছে গেলেন। সারোয়ার মিটিং শেষে তদন্ত এর উদ্দেশ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। তার সাথে দেখা করতে রাজনৈতিক নেতা খলিল বকর মুখোশধারী হয়ে কিছু দলিলপত্র নিয়ে হাজির হবে। সেই উদ্দেশ্যে সারোয়ার ঘড়ি দেখছে আর অপেক্ষা করছে। অপেক্ষার মাঝে খেয়াল করে খোড়কপুর বাজারে তাজা পাকা আমের আসর বসেছে। দেশি মুরগির আনাগোনা বাজারে অহরহ চলছে। সারোয়ার তার বাবার পছন্দের মূল হলো দেশি মুরগি। সেই ক্ষেত্রে দুটা দেশি মুরগি কিনে নিলো। কয়েকটা আম কিনল বাসার জন্য।
হঠাৎ কারো কাশির শব্দ শুনে ভ্রু কুঁচকে পেছন ফেরে সে। হবু শ্বশুর কে বাজারে দেখে মৃদু হেসে কুশল বিনিময় করে। নাছির উদ্দিন উঁকি ঝুঁকি দিয়ে সারোয়ার এর হাতের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছেন। সারোয়ার ব্যাপারটা বুঝতে পারল। সে শেহরীনা কে ভালো মত না জানলেও তার মহাশ্রেয় বাবাকে জেনে নিয়েছে বেশ। সারোয়ার ভদ্রতার খাতিরে মুরগির মাংস আরো দুটো কিনে নেয়। আমও বাড়িয়ে নিয়ে সেগুলো শ্রদ্ধীয় হবু শ্বশুরের হাতে ধরিয়ে দিলো। চোয়াল ফাঁকা হয়ে গেল নাছির উদ্দিন এর। জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ঢোক গিলে বলতে লাগলেন।

“বাবা এর দরকার ছিল না। আমি প্রায় এই রাস্তায় আছি। আমার মুদির দোকান এখানেই কাছে। এক-দু রাস্তা পার করলেই দোকান সামনে চলে আসে। তোমাকে এখানে দেখে এমনিতে দিনকাল কেমন যাচ্ছে জানতে এসে ছিলাম।”

কথার মাঝেও তিনি পলিথিন ঘেঁটেঘুটে ভেতরের জিনিসগুলো পরখ করছেন। সারোয়ার গলা ঝেড়ে বলে,

“সমস্যা নেই আঙ্কেল আপনি আমার কথায় একসপ্তাহ অপেক্ষা করতে পারলে আমি নিশ্চয় এতো টুকু দিতে দ্বিধাবোধ করব না।”

নাছির উদ্দিন পান মাখানো দাঁতের হাসি দিলেন। পলিথিন দুটো ভালো করে চেপে ধরে সারোয়ার কে উদ্দেশ্য করে বলেন,

“তো বাবা বাসায় আসো। শেহরীনাও বাসায় আসে। কথাবার্তা বললেও ভালো হতো।”

সারোয়ার এর চোখে সেই দিনের শ্যামাঙ্গিণী পরীর রূপটি চোখের মধ্যমণিতে ভেসে উঠল। মনে মনে ‘অপূর্ব’ আখ্যায়িত করলেও তা গোপনে হৃদয়ে দাফন করে ফেলল। নাছির উদ্দিন কে দেখে সারোয়ার কপাল চুলকে আমতা আমতা কণ্ঠে বলে,

“আসলে আঙ্কেল আজ বাসায় কাজ আছে। তাই যাই পরের বার আসা হবে।”

নাছির উদ্দিন ততটা ঘাঁটলেন না। মুক্ত হাতে জিনিস পেয়ে তিনিও বাড়িতে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে আছেন। সারোয়ার বিদায় নিয়ে রাস্তার অন্যপাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ফোন বের করে খলিল বকর কে কাল দুপুর একটায় টিটো পার্কে আসার জন্য জানিয়ে দিলো। সেও ক্লান্ত বিধেয় বাড়িতে ফেরার জন্য গাড়িতে উঠে বসে।

চলবে……
(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)