প্রিয়অপ্রিয়ের সংসার পর্ব-৫৮+৫৯

0
28

#প্রিয়অপ্রিয়ের_সংসার
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_৫৮_৫৯ (আগলে নাও হারিয়ে যাওয়ার আগে😔)

ভরা মেলায় নিলীমা গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখের থেকে ঝরঝরে অশ্রুপাত হচ্ছে। তানভির জ্বলন্ত চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে। নিলীমার হিংস্রতা এখনো যায়নি। সে যেনো শেহরীনা কে মে’রেই ফেলবে মত দশা। তবে হঠাৎ তানভির চলে আসায় তার পরিকল্পনায় জল পড়ে গেল। তানভির তার বাহু শক্ত হাতে চেপে ধরে চেঁচিয়ে বলে,

“তোর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। ঐ বদ্ধ কুটিরে তিনদিন থেকেও বুঝি তোর শিক্ষা হয়নি। আবারো ঐ কুটিরের মধ্যে থাকতে চাস তুই।”

নিলীমার চোখমুখে প্রণয়ের আগুন জ্বলছে যাচ্ছে। তা কী তানভির অনুভব করতে পারছে না। সে করুন চোখে তাকিয়ে তানভির এর জড়িয়ে থাকা হাতটিকে আঁকড়ে ফুঁপিয়ে উঠল। তার গলা জড়িয়ে ধরল। তানভির নির্লিপ্ত ছিল কিন্তু তার চোখে ভেসে উঠল সারোয়ার এর করুন চেহারা, শেহরীনার মত বোন সমতুল্য মেয়েটার গর্ভপাতের করুণ চাহনি এবং তার চিৎকার। এ যেনো তাকে শক্ত করে দিলো, ভালোবাসার কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে নিতে শক্ত করে দিলো। দাঁতে দাঁত চেপে আক্রোশে ভরা মনে জোরালো এক ধাক্কা মা’রল নিলীমা কে। এতটা জোরে আ’ঘা’ত লাগায় নিলীমা ভার সামলে উঠতে না পেরে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল। হাতের কনুইয়ের অংশ ছোটখাটো পাথরের সংস্পর্শে আঁচড়ে গেল। শেহরীনা তৎক্ষণাৎ নিলীমা কে ছুঁতে গেলে তার স্পর্শ যেনো নিলীমার কাছে ঘৃ’ণিত লাগল। হাত এক ঝটকায় সরিয়ে নিলো। নিজ কষ্ট সহে নিজেই উঠে দাঁড়াল নিলীমা। মেলায় চৌপাশ জুড়ে মানুষের আনাগোনা। তারা যেনো ফ্রিতে সার্কাস দেখছে। নিলীমার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গেল। তার তো আজ সর্বনাশ হয়েই গেল। ভাইরাল জগৎ এ সে এখন অবহেলিত, প্রত্যাখ্যান হওয়া পাত্রী নামে পরিচিত হবে। তার চাহনি একমাত্র তানভির দিকে আবদ্ধ। সারোয়ার তানভির কে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে।

“এসব কী হচ্ছে তানভির! ভরা মাঠে দুজনে পাগলামি করছো কেনো!”

সারোয়ার এর কথা যেনো নিলীমার কাছে কাঁটা গাঁয়ে নুনের ছিটে দেওয়ার মত লাগল। হাত তালি দিয়ে বলে উঠল।

“বাহ্ বাহ্ মালিক আর ভৃত্য মিলে ভালোই আমাকে অপমান করার নাটক করছেন দেখি। এই নাটকের রচয়িতা তবে আপনিই তাইতো!”

“নিলীমা মুখ সামলে কথা বলো। আমার স্যারের সামনে…।”

“কেনো হ্যাঁ, কেনো আমি চুপ থাকব। বরং তুমি চুপ থাকো। শুধু মাত্র তোমার স্যারের জন্যে আমার এ অবস্থা। কী মিস্টার সারোয়ার সিদ্দিক! শুনে অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই! বলছি আমি…।”

তানভির শান্ত মুখে গিয়ে নিলীমার হাত আঁকড়ে ধরে টেনেহিঁচড়ে মেলার থেকে বেরিয়ে যায়। মেলায় মানুষজন তাকিয়ে ছিল। বিধেয় সারোয়ার স্বাভাবিক বিষয় আপনজনের মাঝে হয়ে থাকে বলে এই সেই বুঝিয়ে শেহরীনা কে নিয়ে মেলা থেকে বেরিয়ে আসল। নির্জন রাস্তার মাঝে এসে হাত ছাড়ল নিলীমার। তার মাথায় আজ শুধু প্রতিশোধের নেশা ঘুরছে! কেনো সবাই তাকে পুতুল বানিয়ে খেলবে! সে কী খেলাঘরের পুতুল! তানভির এর গালে কষে এক চ’ড় বসিয়ে দিলো সে। আগুন চোখে তাকাল তানভির। সেও প্রহার করতে নিলে তার হাত ধরে ফেলল সারোয়ার। ভীষণ রেগে গিয়েছে সে। নারীর গাঁয়ে হাত তোলাকে সারোয়ার কখনো সমর্থন করেনি। সেখানে তার সামনেই কি-না তানভির এক মেয়ের গাঁয়ের উপর হাত উঠাতে চাইল। এ যেনো ঘোর অন্যায়, ঘোর অপরাধ! নিলীমা তির্যক হাসল। সারোয়ার এর দিকে তাকিয়ে বলে,

“কেনো থামাচ্ছেন তাকে! আপনি তো তাকে এসব শিখিয়েছেন। নাহলে কেউ কী আর কোনো নারী কে অনাহারে, অবহেলায় এক অন্ধকার কুটিরে বন্দি বানিয়ে রাখতে পারে!”

সারোয়ার এর মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আশ্চর্য চোখে তানভির এর দিকে তাকাল সে। তানভির এর ভেতরটা আনচান হয়ে আছে। সে মাথা নিচু করে রেখেছে। সারোয়ার ভাবছে, সে বলেছিল বাড়ির মধ্যে সবার সামনে তাকে বন্দি রাখতে! এতে সে ভুল দেখেনি। কেননা বাড়িতে নিলীমার আপন মাও থাকতো তখন। তিনি কখনো নিজের মেয়েকে অনাহারে রাখতেন না। তবে নিলীমার মুখে এ কথা শুনে যেনো সে তার মস্তিষ্কের কাছে হেরে যাচ্ছে। তানভির কাঁপা গলায় বলে,

“সস্যার আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব! তাই আমি নিলীমা কে অপহরণ করে কুটিরে বন্দি বানিয়ে রেখেছিলাম। তার উপর শেহরীনা ম্যাম কেও পাওয়া যাচ্ছিল না। আমি একলা হাতে সব সামলে উঠতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। ফলস্বরূপ নিলীমা কে বন্দি করেই সব কথা উগড়ে নেয়। কিন্তু আমি জানতাম না নিলীমার অন্ধকারে ফোবিয়া আছে। সে যে অন্ধকারে থাকতে ভয় পায়। তা আগে জানলে কখনো আমি তাকে কুটিরে বন্দি রাখতাম না।”

“ওয়াও কত সুন্দর অভিনয় তোমার তানভির। এই কী আমার প্রতি তোমার ভালোবাসো! নিজের ভালোবাসার মানুষ কে তিনদিন অর্থাৎ পুরো ৭২ ঘণ্টা আঁধারে, অনাহারে ফেলে রাখতে পারলে! আরে একজন জা’নো’য়ার কেও ভুল শোধরানোর সুযোগ দেওয়া হয়। অথচ তুমি আমায় অন্ধকারে মে’রে ফেলতে চেয়েছিলে।”

তানভির এর বুক ধকধক করে উঠল। নিলীমার প্রতিটা শব্দ ধ্বনি যেনো কোনো প্রলয়ের ইঙ্গিত করছে! যে প্রলয়ে প্রেম নয় বিচ্ছেদ এর সুর বেজে থাকবে।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)ঢোক গিলে সে নিলীমার নিকট পা বাড়ায়। নিলীমা তাকে থামিয়ে দেয়। তবুও তানভির কদম থামায়নি। সে ধীরপায়ে নিলীমার রাগ কে সামলে নেওয়ার জন্যে আগায়। আকস্মিক নিলীমা কাঁদতে লাগল। শেহরীনার দিকে তাকিয়ে বলে,

“তুমি তো সব পেয়েছো আপু। আমি কেনো পায়নি! জীবনে সব পেয়েছি বাবা-মায়ের আদরে। বড্ড আহ্লাদ করতাম আমি। ভালোবাসা কী বুঝতাম না! যখন থেকে সারোয়ার ভাইয়া কে দেখি তখন তার এটিটিউড ও স্টাইলে আমি মুগ্ধ হয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম এই বুঝি ভালোবাসা। সেসময় জাহানারা মামুমি আমায় বলতেন সারোয়ার তোকে বিয়ে করলে দেখবি বড্ড আহ্লাদে মাথায় উঠিয়ে রাখবে। এই একটা কথা আমার মস্তিষ্কের মধ্যে গেঁথে যায়। এই আহ্লাদ পাওয়ার লোভ যেনো হুট করেই বেড়ে গেল। সারোয়ার এর প্রতিটা চরণ আমি উপলব্ধি করতে লাগলাম‌। তাকে মন দিতে চেয়ে ছিলাম।‌ কিন্তু বাঁধা হয়ে দাঁড়ালে তুমি আপু। তোমাকে আমার অসহ্য লাগতে শুরু করল। ইচ্ছে হতো এখনি তোমাকে মে’রে ফেলি। কিন্তু পারিনি জীবনে চলে আসল অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে তানভির। এই তানভির এসে পাল্টে দিতে লাগল। হ্যাঁ এটা আমিও মানি আমি সারোয়ার ভাইয়ের সাথে জেদ দেখিয়ে তোমার জীবন কে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়ে ছিলাম। তাই বলে আমিও কম কষ্ট পাইনি আপু। দিনকে দিন ভালোবাসার অনলে পুড়েছি। তানভির কে আমি ভালোবাসতে শুরু করেছি। ভেবেছিলাম সারোয়ার আমার ভালোবাসা কিন্তু তা নয়। সে আমার মোহ মাত্র। আমি তানভির এর অবজ্ঞা, অবহেলা, মন খারাপী সহ্য‌ করতে পারছিলাম না‌। তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম তোমাকে নিজ হাতে শোয়াইব মিলদাজ এর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেবো। তার আগেই তানভির আমায় অপহরণ করে ফেলল। কেনো করল শুধু তোমার কারণে আপু! কেনো আপু তোমাকেই কেনো সবাই প্রাধান্য দেয়! আমার কী মন নেই! আমি কী পশু! আমারো ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার আছে আপু। তাহলে কেনো আমার সাথে অন্যায় করলো এই তানভির!”

ফুঁপিয়ে রাস্তার মধ্যেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল নিলীমা। তানভির এর চোখজোড়া থেকে টপটপে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। শেহরীনা হচ্ছে কী বুঝছে না কিছু! তবে সে জানে নিলীমা দোষী। সেখানে তানভির অন্যায় করেছে শুনে তার মনে কৌতুহল জাগল। সারোয়ার পুরোপুরি অবগত হতে পারছে না। নিলীমা তানভির এর কোন অন্যায়ের কথা তুলছে! গম্ভীর হয়ে সে নিলীমা কে ধরে দাঁড় করাল। নিলীমা কান্নার কারণে ঠিক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে অব্দি পারছে না। সারোয়ার গলা খাঁকড়ে জিজ্ঞেস করল।

“তানভির কী অন্যায় করেছে আপনার সাথে! সব সত্য বলেই তো দিলেন। শেষ টুকু কেনো বাকি রাখছেন।”

নিলীমা আক্রোশে উম্মাদ হয়ে উঠল। সে সারোয়ার কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ল। চিৎকার করে বলে উঠল।

“কেনো তানভিরররর কেনো তুমি আমাকে ঠকালে! আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবেসেছিলাম তানভিরর। কেনো হ্যাঁ, কেনো তুমি বিয়েতে রাজি হলে কেনোওও! আমি সত্যিই তোমাকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি তানভির। তোমাকে ছাড়া বাঁচা যেনো আমার কাছে এক মুহুর্ত ও নরক সমান। প্লিজ! বিয়েতে না করে দাও না প্লিজ! আহহহ।”

চিৎকার করে তানভির এর সামনে হাঁটু গেড়ে পা চেপে ধরল। কেউ কতটা ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষের পা দুটো ধরতেও দ্বিধাবোধ করে না। তানভির কাঁপছে সে কী করবে বুঝতে পারছে না। নিলীমা কে এক ঝটকায় দাঁড় করিয়ে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু বুকে নিতে পারল না। সে তার মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। নিলীমার কথা সে কখনো তার মায়ের কাছে বলার সময় পায়নি। মায়ের হঠাৎ অসুস্থতায় তিনি মেয়ে দেখবেন বলে আজ্ঞা করায় সেও রাজি হয়ে গিয়ে ছিল। তাও কি-না নিলীমার কাছে থেকে প্রতারণার শিকার হয়ে জেদ নিয়ে রাজি হয়েছিল। ‌নিলীমা তানভির এর অসহায় চাহনি দেখে হাসল। তাচ্ছিল্যের হাসি তার ঠোঁটের উপর ভেসে উঠল। কাতর চোখে সেই বুকের দিকে দৃষ্টিপাত করল। এ কী মেয়েটার ঠোঁটের কোণায় করুন হাসি কেনো! এ হাসি এই সুন্দর ফুটফুটে গোলাপী রঙের ঠোঁটজোড়ার সঙ্গে মানানসই নয়।
নিলীমা কাঁপা গলায় বলে,

“ঐ বুকটা বুঝি তোমার নববধুর জন্য পবিত্র রাখছো! আমার জন্য তবে সেই জায়গা বরাদ্দ নেই তাই না! আমি শূন্য হয়ে গেলাম তোমার জীবন থেকে। একটু তো মাফ করতে পারতে আমায়।‌ এত বড় শাস্তি না দিলেও পার্…।”

কথাটা শেষ না হতেই নিলীমা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তানভির হতভম্ব। সারোয়ার শেহরীনা দৌড়ে কাছে এলো। তানভির নিলীমার গাল আঁকড়ে আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে,’নিলু এই নিলু কী হয়েছে চোখ বন্ধ করেছো কেনো! চোখ খুলো। আআআমি আছি তো আমি তোমাকে ছাড়ছি না সত্যি। আমি তোমাকে মাফ করেছি কী হয়েছে তোমার চোখ খুলছো না কেনো!’
তানভির দিশেহারা হয়ে পড়ল। সারোয়ার তানভির এর অবস্থা বুঝে তার কাঁধে হাত রেখে শক্ত গলায় বলে,
‘নিলীমা কে নিয়ে এখনি গাড়িতে আয়। হাসপাতালে যেতে হবে।’
তারা সময় ব্যয় না করেই গাড়িতে উঠে বসল। সারোয়ার যত দ্রুত পারল হাসপাতালের সামনে এসে গাড়ি থামায়। ত্রিশ মিনিট লাগল আসায়। তানভির হম্বিতম্বি হয়ে নিলীমা কে কোলে নিয়ে এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে গেল।
সেখানকার ডক্টর তাদের থামিয়ে নিজেরা ভেতরে ঢুকল। তানভিররা চিন্তিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এমার্জেন্সি ওয়ার্ডের সামনে আসল বয়স্ক ডক্টর ফজলে হক। তিনি সারোয়ারদের ফ্যামিলি ডক্টর। সারোয়ার কে দেখে তিনি কিছুটা অবাক হোন। তার কাছে গিয়ে ‘মাই ডেয়ার সান তুমি এখানে কী করছো’ বলে উঠলেন। পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে সারোয়ার ও শেহরীনা তাকাল। ডক্টর ফজলে হক এর নজর স্নিগ্ধ এক মায়াবতীর দিকে পড়ল। তিনি মুচকি হেসে বলেন,
‘মাশাআল্লাহ জুটি সুন্দর মানিয়েছে। তবে তোমরা হঠাৎ হাসপাতালে।’
‘আঙ্কেল ভেতরে আমাদের একজন পেশেন্ট আছে। প্লিজ একটু চেক করে দেখুন।’
ডক্টর ফজলে হক নিশ্চিত চোখের চাহনি দিয়ে এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে চলে যান। প্রায় এক ঘণ্টা পর ওয়ার্ড থেকে গম্ভীর মুখ নিয়ে বেরিয়ে আসেন ডক্টর ফজলে হক। রাগান্বিত গলায় তাদের কে জিজ্ঞেস করেন।
‘মেয়েটা তোমাদের কী হয়!’
তানভির উত্তেজিত গলায় বলে,’সসে আমার হবু বউ। কেনো ডক্টর কী হয়েছে!’
ডক্টর ফজলে হক নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে নিলেন। যে খবর তিনি দেবেন তাতে বোধোদয় ছেলেটা কে সামলাতে কষ্টসাধ্য হতে পারে। নম্র গলায় বলেন,

“নিলীমার সাথে এ কয়েকদিনে কোনো ইনসিডেন্ট হয়েছিল!”

তানভির মাথা নেড়ে চোখ নামিয়ে নিলো। ডক্টর ফজলে হক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলেন,

“দেখো সান, যা বলব তাতে কষ্ট হলেও আমাদের হাতে কিছু করার নেই। পেশেন্ট এর হাতে শুধু এক-দুয়েক ঘণ্টা সময় আছে। পারলে তার পরিবার কে জানিয়ে দাও।”

থমকে গেল তানভির। শেহরীনা মুখ চেপে ধরল নিজের। এ কী শুনল তারা। সারোয়ার আঁতকে জিজ্ঞেস করল।

“এ কী বলছেন আপনি নিলীমা সুস্থ সবল‌ নারী তার মধ্যে হঠাৎ কী হয়েছে যে বেঁচেই থাকবে না!”

“সারোয়ার আফসোস তোমরা হয়তো পেশেন্টের সিমটমস খেয়াল করোনি অথবা খেয়াল করেও অদেখা করেছো।
তীব্র মাথাব্যথা, ঘাড়ের শক্তভাব বা ব্যথা, জ্বর, বমি বমি ভাব বা বমি করা, হালকা বা শব্দে সংবেদনশীলতা, দৃষ্টিশক্তির সমস্যা (যেমন আলোতে চোখের সমস্যা),
বিভ্রান্তি বা অচেতন হওয়া, চামড়ায় লাল বা বেগুনি ফুসকুড়ি। এগুলো মেনিনজাইটিস এর লক্ষণ। এ ধরনের রোগীদের সঠিক সময়ে চিকিৎসা করালে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তবে মারাত্মক পর্যায়ে গেলে এর চিকিৎসা করেও সম্ভব হয় না। আপনাদের নিয়ে আসা পেশেন্ট বোধোদয় নিজের অজানায় রোগ কে অবহেলা করে বড় করেছে। তাই আমাদের কিছু করার নেই। আপনারা চাইলে শেষ সময়টুকু কাটিয়ে নিন তার সাথে। যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হতে পারে।”

তানভির ধসে পড়ল মাটিতে। শেহরীনার চোখজোড়া ছলছল করছে। সারোয়ার ও দুঃখ অনুভব করছে আজ। মেয়েটা দোষী তবুও সে কখনো চাইনি এতটা করুন পরিণতি হোক তার। শেহরীনা সারোয়ার এর বাহু আগলে ফিসফিসিয়ে বলে,

“মিশকিতা চাচী কে এখন কী বলব! উনি তো মেয়ের নিখোঁজের জন্যে কাতর হয়ে ছিলেন। আজ যখন মেয়ের মৃত্যুর সময়কার কথা শুনবেন। তখন তো তিনি নিজেই মরে যাবেন।”

“এমনটা বলো না কৃষ্ণ বউ। তুমি পারলে বাড়িতে জানাও। আমি তানভির কে সামলানোর চেষ্টা করি।”

শেহরীনা আলগোছে দূরে সরে গেলো। সারোয়ার তপ্ত শ্বাস ফেলে তানভির এর নিকট গিয়ে তার কাঁধে শান্ত্বনার হাত রাখল। তানভির মাথা নত করে ছিল। আকস্মিক সারোয়ার এর দিকে তাকাল। তার কলিজা মোচড়ে উঠল। ছোট ভাই সমতুল্য মানুষটার চোখ লালাচে ভাবে পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। চোখের কোণ বেয়ে যে জল গড়িয়ে পড়ছে এ দেখে সারোয়ার তাকে জড়িয়ে ধরল। তানভির কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

“স্যার আমি আর‌ কখনো নিলীমা কে হার্ট করব না। তাও তাকে বলুন আমার জন্য বেঁচে থাকতে। আমি যা করেছি মাথা পেতে নেবো। শাস্তি দিলে তাও রাজি মেনে নেবো। তবুও স্যার তাকে বলবেন আমার জন্য বেঁচে থাকতে।”

তানভির কে শান্ত করার প্রয়াসের মাঝেই হতদন্ত হয়ে এলেন নিলীমার বাবা-মা। নিলীমার মা উম্মাদ হয়ে সারোয়ার কে আগলে বলেন,

“বাবা এ কী শেহরীনা কী বলছে! আমার মেয়ে বলে হাসপাতালে। এতদিনে তাকে চোখের দেখাও দেখতে পারলাম না। তাহলে কী হয়েছে আমার মেয়ের বাবা!”

সারোয়ার নিরব। কোন মুখে এক মা কে তার ‘মেয়ের মৃত হতে পারে যেকোনো সময়ে’ এ বাক্যটা কোন মুখে শুনাবে সে! নিলীমার বাবাও চিন্তিত হয়ে আছেন। স্ত্রী কে আঁকড়ে ধরে সারোয়ার এর দিকে কাতর চাহনি দিয়ে বলেন,

“বাবা তোমার চাচী জ্ঞান হারিয়েছে এ নিয়ে তিন-চারবার। প্লিজ বাবা বলে দাও কোথায় আমাদের নিলীমা! নিশ্চয় তাকে বকার জন্য অভিমান করেছে। আমরা তাকে নিয়ে ফিরে যাব বিদেশে।”

শেহরীনা পাশে এসে দাঁড়াল। ইতিমধ্যে জাহানারা পুষ্প এবং মোঃ আবু সিদ্দিক কে শেহরীনা নিলীমার কথাটি জানিয়ে ফেলেছে। তারা এসেছেন পরিস্থিতি সামাল দিতে। কারণ এখন যখন সত্য প্রকাশ করা হবে তখন পুরো হাসপাতাল জুড়ে এক বাবা-মায়ের আর্তনাদমূলক কণ্ঠস্বর ভেসে বেড়াবে। সারোয়ার ঘন এক শ্বাস নিয়ে বলে,

“চাচী সত্য হলো নিলীমার মেনিনজাইটিস রোগ ছিল যেটা হয়ত আপনি অথবা আপনারা, আমরা কেউ বুঝতে পারিনি। সে এই রোগ নিজের মধ্যে বড় করে ফেলেছে। আজ হঠাৎ রাস্তায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললে হাসপাতালে নিয়ে আসি।‌ ডক্টর পরীক্ষণ করে বলেছেন…।”

সারোয়ার এর গলা কাঁপছে। তার সামনে মিশকিতা চাচী যিনি তার মায়ের সমতুল্য। এই মমতাময়ী কে সে দুঃখবোধ করাবে। হাত মুঠো করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ পূর্বক বলে,

“নিলীমার সময় প্রায় শেষ। ডক্টর শেষ কথা বলে দিয়েছেন, যেকোনো সময় মৃত হতে পারে।”

মিশকিতার হাত খসে পড়ল নিজের স্বামীর কাছ থেকে। অবাক হয়ে সারোয়ার কে দেখছেন তিনি। কাঁপা গলায় স্বামী কে জড়িয়ে বলেন,

“এই নিলীমার আব্বু ছেলেটা মনে হয় পাগল হয়ে গেছে। আমার মেয়ে নাকি মারা যাবে। ধুর বোকা ছেলে ডক্টররা কত কিছুই বলেন। এসব সত্যি ধরতে হয় না। চিকিৎসা আছে সব রোগের। এই তুমি বলো না। নিলীমা কে সুস্থ করা যাবে না হুম! আমার নিলীমা মা কে আমি নিজ হাতে খাইয়ে দেবো। দেখবে সে একেবারে সুস্থ সবল হয়ে যাবে। চলো, চলো নিলীমার আব্বু যাই মেয়েকে বাসায় নিয়ে যেতে হবে।”

নিলীমার বাবা শক্ত মনে স্ত্রী কে বুকে জড়িয়ে বলেন,
‘আমাদের মেয়ের হাতে বেশি সময় নেই নিলীমা।’
‘একটা চটকানা খাবেন আপনি। আমার মেয়ের কিছু হয়নি বলছি না। এরা সবাই মিথ্যুক। সারোয়ার তো এই কথা বলবেই তার আর শেহরীনার সাথে যে নিলীমা খারাপ করে ছিল। ওদের কথা শুনব না আমি।‌ চলো ভেতরে।’

একপ্রকার সারোয়ারদের এড়িয়ে মিশকিতাই প্রথম নিলীমাকে শায়িত করে রাখা কেবিনে ঢুকে পড়লেন। মেয়ের শিউরে বসার মুহুর্তে নিলীমার চোখজোড়া খুলে এলো। মায়ের দিকে আকুতি ভরা চোখে তাকাল। কণ্ঠস্বরে ব্যাঘাত ঘটতে তবুও শেষ সময়টুকু সে ভালোভাবে কাটাতে চাই।
‘আম্মু..।’
‘হ্যাঁ মা আছি তো।’
‘তোমাকে অনেক ভালোবাসি আম্মু।’
‘আমিও আমার দুই মেয়েকে খুব ভালোবাসি।’
মায়ের পেছন পেছন নিলীমার বোন এসেছে। তার চোখমুখ কান্নার কারণে ফুলেফেঁপে গেছে। নিলীমার আফসোস হচ্ছে কেনো সে এত বড় রোগ কে ভেতরে পেলেছে! লক্ষণ বুঝেও নিশ্চুপ থেকেছে। এখন ভেবে কী আর লাভ হবে! বোনটাকে বিয়ে দিয়ে তার সংসার দেখার সাধ্য অব্দি হবে না নিলীমার আর। হাতের ইশারায় বোন কে কাছে আসার ইঙ্গিত করল। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে নিলীমার কাছে দাঁড়াল সে। নিলীমা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“খুব পড়িস। জীবনে পড়ে আব্বু আম্মুর কথামত বিয়ে করবি। কখন কাউকে ভালোবাসিস না। এই ভালোবাসায় কখনো সুখ নামক শব্দটা নেই। যা আছে দুঃখভরা সাগর। বিয়ের পর একান্ত আপন মানুষ কে ভালোবাসিস, সংসার সাজাইস। দেখছিস না তোর বোনের কী হলো! ভালোবেসে শেষমেশ প্রাণপাখিটা উড়াল দেওয়ার অপেক্ষায় আছে।”

“বাহ্! মেয়ে আমার এতটা বড় হয়ে গেল। যে এত বড় রোগ হয়েছে। জানানোর ইচ্ছে ও পোষণ করেনি।”

নিলীমা দেখল তার বাবার চোখ লাল হয়ে আছে। সবাই কাঁদছে। নিলীমা মলিন হাসল। নিলীমার বাবা একমনে বড় মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। নিলীমা একই কথা পুনরায় বলে,
‘ভালোবাসি আব্বু।’ নিলীমার বাবা কাঁদতে লাগলেন। নিলীমার চোখ আশপাশ ফিরে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটির সাথে কয়েক মুহুর্ত কাটানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার মনে গ্রাস করছে। নিলীমার মা বুঝলেন তবে তিনি মোটেও চান না। নিলীমা তার মায়ের হাত ধরে বলে,”

‘মা বাহিরে দেখো না। সারোয়ার ভাইয়ারা আছেন। তার সাথে একজন ছেলে থাকার কথা। তাকে একটু ডেকে দাও না।”

মেয়ের কথায় বিস্ময়ে তাকান নিলীমার মা। তিনি স্বামীর দিকে তাকালে। তিনি বলে উঠেন,
‘বাহিরে একটা কান্না করা ছেলেকে দেখেছি সারোয়ার এর সাথে। তাকে কেনো ডাকব!’
নিলীমা ম্লান হেসে বলে,’বাবা আই লাভ হিম। আশা করি তোমরা এক মৃত্যুপথযাত্রীর কথা অবজ্ঞায় ফেলবে না।’
নিলীমার বাবা গিয়ে সারোয়ারদের ডেকে আনেন। তানভির চোখজোড়া ফুলে গেছে। মানুষটার বিধ্বস্ত রূপ দেখে নিলীমার স্বস্তি, সুখ অনুভব হচ্ছে। সে তার বাবার দিকে তাকিয়ে ‘একটু’ ইঙ্গিত করল। তিনি তানভির ব্যতীত সবাই কে নিয়ে বেরিয়ে যান। তানভির তার কাছে গিয়ে বসল।
নিলীমা আদুরীয় হাত তানভির এর গালে বুলিয়ে বলে,

“আজ থেকে আমার আর কোনো আফসোস নেই। প্রিয় মানুষের চোখে আমার জন্য কান্না দেখে আমি অতি সুখে মারা গেলেও আমার কোনো দুঃখবোধ হবে না। আমার অতীত জেনে আমায় ক্ষমা করে দিও। আর কখনো কাছে গিয়ে জ্বালাব না তোমাকে। আর কখনো বলব না ‘এই ছেলে তুমি এভাবে অলুক চোখে তাকিয়ে থাকো কেনো! আমার লজ্জা পায়!’ আর কখনো বলব না ‘আমি ভালোবেসে পেলেছি’। আজ থেকে তুমি মুক্ত। মুক্ত আমার মনের খাঁচা থেকে। আমি অতীতে যারই মোহে পড়েছিলাম তা ছিল ভুল। তবে তোমায় আমি ভালোবেসে মরণকেও আপন করতে প্রস্তুত। আমায় ক্ষমা করো প্রিয়। তোমাকে নিয়ে সুখের সংসার করা হলো না। আমার কিশোরী বয়সের স্বপ্ন ছিল উঁচু পাহাড়ে গিয়ে প্রিয় মানুষের হাত ধরে প্যারাসুট এ ছড়ে বেড়ানোর। দেখো তা আর কখনো পূরণ হবে না। আমার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। তোমাকেও পাওয়া হলো না, নিজেকেও হারিয়ে ফেলতে বসেছি। তোমার ভাষ্যমতে আমার জেদ, অহং আমায় মে’রে ফেলবে। সত্যিই তাই আমায় আজ মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়ে দিলো। আজ আমায় একটু বুকে জড়িয়ে নেবে। কখনো যে আর ঐ বুকে মাথা রাখা হবে না। চোখ বুঁজে রুহ্ চলে যাওয়ার পূর্বে আগলে নাও না প্রিয়। এই আকাঙ্ক্ষা অপূরণ রেখো না প্লিজ!”

তানভির জট করে নিলীমা কে বুকে নিয়ে তার সঙ্গে শুয়ে পড়ল। সে এই সময়কে দুঃস্বপ্ন প্রমাণ করতে চাই‌। নিলীমা পরম তৃপ্তিতে চোখ বুঁজে নিলো‌।‌ এত তার সর্বসুখ। এত তার সর্বহারা ভালোবাসা। প্রেম তো বহুবার আসে কিন্তু ভালোবাসা তা কেবল এক ব্যক্তির প্রতিই সীমাবদ্ধ থাকে। তানভির নিজের মত বিলাপ করছে।
সারোয়ার কেবিনের দরজা দিয়ে দেখছিল। তারও চোখে জল চলে এসেছে।
হঠাৎ ভেতর থেকে জোরালো এক আর্তনাদময় চিৎকার বাহিরে ভেসে আসল। হতদন্ত হয়ে সকলে প্রবেশ করতেই দেখল। তানভির চিৎকার করে নিলীমা কে ডাকছে। কিন্তু নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে শরীরটা। তানভির বুকে রেখেই ডাকছে আর কাঁদছে। শেহরীনার সহ্য হলো না। সেও সারোয়ার কে জড়িয়ে ধরল। ফুঁপিয়ে উঠল সে। তানভির চিৎকার করে করে ‘আমার বুকে ফিরে আসো নিলীমা প্লিজ! প্লিজ!’ বলছে।
নিলীমা কী আদৌ সে কথাটি শুনতে পাচ্ছে! উহুম আর পাবে না। তার জীবনের প্রদীপ নিভে গিয়েছে। তানভির নিলীমা কে বুকে রেখেই চোখ বুঁজে নিলো। করুন গলায় বলে,
‘তুমি না চাইতে আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে, নাও ঘুমাও আজ থেকে প্রতিদিন এ বুকে ঘুমাবে কেমন!’
নিলীমা কে জড়িয়ে রাখায় ডক্টর নার্স তানভির কে ছড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু নাছোড়বান্দা তানভির মোটেও ছাড়ছে না। তার এক কথা নিলীমা ফাজলামি করছে। সে ভান ধরে আছে। সারোয়ার চোখের ইশারায় ডক্টর কে ঘুমের ওষুধ দিতে ইঙ্গিত করে। তিনিও তানভির এর অগোচরে ইন’জে’কশন লাগিয়ে দেন। তানভির পরমুহূর্তেই ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু তার চোখজোড়া সেই নিলীমাতে আবদ্ধ ছিল। তার ঠোঁট ছিল নিলীমার কানের কাছে। সে ম্লান হেসে ঠোঁট নেড়ে বলে,’ভালোবাসি প্রিয়!’

চলবে…..