প্রিয়তম পর্ব-২২ এবং শেষ পর্ব

0
215

#প্রিয়তম
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব -২২ (শেষ)

ইফাদের কথা শুনে, ওর চোখের চাহনি দেখে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নোয়াল রিতু। ইফাদের পোশাকে ওর সামনেই এভাবে ওকে পড়তে হলো? কী ভাবছে মানুষটা? মুখে কিছু বলতেই যাবে তার আগে ওকে থামিয়ে দিলো ইফাদ। হাতদুটো আঁকড়ে ধরে ওর ঠোঁটদুটো দখল করে নিলো। ছাড়লো নিজের মর্জি মতো। রিতুর ঠোঁট লাল। অপ্রস্তুত অবস্থায় চুমু, ফুরসত নেবার সময়টুকু পর্যন্ত দেয়নি। রাগ হলো ওর, কিন্তু কিছু বলতে পারল না। ইফাদ ওর অবস্থা দেখে বক্র হাসি হাসলো। কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
— আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝাঁঝালো হয়ে গেছ দেখছি! ক্রেডিটটা কার?
এমন আচানক কথা শুনে রিতু চোখ পাকিয়ে তাকাল। এরপর যেই ওকে রেগে ওকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতে যাবে ইফাদ আবারো রিতুর হাত দুটো নিজের মুঠোয় আটকে নিল। দু’হাতে ওকে তুলে নিয়ে বিছানায়
বসিয়ে নাটুকে গলায় বলল,
— জানি তুমি আমাকেই ক্রেডিটটা দিবে। তবুও সন্দেহ তো লাগে। আমার বউটার আবার সময়ে অসময়ে মুড সুইং হয় কি-না! বুড়ো টুরো হয়ে গেছি এখন যদি তার নজর অন্যদিকে চলে যায় তাহলে এ বয়সে এসে মুখে চুনকালি মেখে বসে থাকা ছাড়া আমার আর কিছুই করার থাকবে না। সেজন্যই জিজ্ঞেস করলাম। তুমি আবার কিছু মনে করোনি তো?

রিতুর চেহারাটা দেখার মতো হলো। ইফাদ ঠোঁট চেপে হাসছে। বুঝল ইফাদ ওকে ইচ্ছে করে রাগাতে চাইছে। সেদিন ঝগড়ার সময় রাগের মাথায় মুখ ফসকে ইফাদকে ‘বুইড়া বাঁদর’ বলেছিল। এখন সেটারই শোধ নিচ্ছে। অথচ বাস্তবে ইফাদের বয়স বাড়লেও এর কোনো লক্ষ্মণ ওর চেহারা বা আচরণের ধারেকাছেও নেই। যেখানে অন্যদের চোখেমুখে বয়সের একটা ছাপ দেখা যায়, সেখানে দিনদিন ইফাদের বয়স কমছে বৈ বাড়ছে না বলেই মনে হয় রিতুর। ও মুগ্ধ চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ইফাদকে দেখায় মনোযোগ দিলো। ঠোঁট, নাক, চোখ, কপাল এমনকি চুলগুলোও বাদ দিলো না। অদ্ভুত মোহছন্নতায় ডুবে গেল কয়েক মুহূর্তের জন্য। বুকের ভেতরের শূন্য জায়গাটা পূর্ণ অনুভব হতেই ছলছল চোখ মেলে আবিষ্ট কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— আপনি আমাকে দুঃখ দিয়ে মজা পান?
ইফাদ ভাবুক নয়নে ওর দিকে চেয়ে থেকে বলল,
— শুনতে চাও?
উত্তর না দিয়ে রিতু মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বসে রইল। ওকে চুপ দেখে ইফাদের ভ্রু কুঁচকে এলো। পেছন থেকে আঁকড়ে ধরে গভীর স্বরে বলল,
— পুরোটা শুনবে তো। তোমাকে দুঃখ দিয়ে আমি একটুও মজা পাই না। এইযে, সব গুছিয়ে চলে এসেছি। কার জন্য? তোমাকে ভালোবাসি বলেই তো!
রিতুর মনে শীতল বাতাস এসে হানা দিলো। শান্ত হয়ে গেল মনটা। ইফাদের দিকে তাকাল চোরা চোখে। ওড়নার কোণে ভেজা চোখদুটো মুছে নিল। ইফাদ চুপচাপ ওকে দেখল অনেকটা সময়। এরপর নড়েচড়ে বসে নিজের দু-হাত বাড়াতেই রিতু ওর বুকে মাথা রাখল। ইফাদ আটকে রাখে শ্বাসটুকু ফেলল। সব মজা আর ফাজলামো বাদ দিয়ে ওর চুলে নাক ডুবিয়ে স্বর্গরাজ্যে হারিয়ে গেল। দরজার বাইরে থেকে তখন শোনা যাচ্ছে বাড়ির বিচ্ছু ছেলে-মেয়েদের চাপা হাসি।
.

ইফাদের ওরকম আকস্মিক দেশে ফেরার ব্যপারটা নিয়ে নাজিয়া ইসলাম বেশ বকলেন ছেলকে। সেই সাথে বাড়ির বিচ্ছুদেরও। কারণ ওরা সবাই জানতো ইফাদ দেশে ফিরবে। কিন্তু বলেনি। ইফাদ মায়ের কপালে চুমু দিয়ে তার সব রাগ ভুলিয়ে দিলো। নাজিয়া ইসলাম শান্তি পেলেন। যাক, ঘরের ছেলে ভালোভাবে ঘরে ফিরেছে তার আর কিছুই চাওয়ার নেই। খুনসুটি, আনন্দ, ঝগড়া, কথা-কাটাকাটিতে দিনগুলো কেটে যেতে লাগল ইফাদ-রিতুর৷ ভালোবাসা আরো গাঢ় হলো দু’জনের। এরমধ্যেই এক বিকেলে গিয়ে বারান্দায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ভালোবাসা ভাগ করে নিচ্ছিল রিতু-ইফাদ। সে সময়ই ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। ইফাদ গিয়ে দরজা খুলতেই নাজিয়া ইসলাম হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে বিচলিত কন্ঠে রিতুকে বললেন,
— তোমার ফোন নাকি বন্ধ! বেয়াই মশাই ফোন করেছিল, ইশিতার লেবার পেইন ওঠেছে। ওকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে ওনারা। রেডি হও আমরা যাচ্ছি…

বলে তিনি যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই বেরিয়ে গেলেন। এদিকে খবরটা শুনে রিতু কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। মুখ থেকে চা ছলকে পড়ল। মনে ভর করল বোনের প্রতি দুশ্চিন্তা। এর প্রভাব এতটাই গাঢ় হলো যে ওর মুখ রক্তশূণ্য হয়ে গেল। মাকে হারিয়েছিল খুব ছোটবেলায়। এরপর ইশিতা-ই মায়ের স্নেহ, শাসন দিয়ে ওকে বড় করেছে। সারাক্ষণ খ্যাকখ্যাক করে রিতুকে বকা-ঝকা করলেও এই ইশিতা-ই ওকে সবচেয়ে বেশি আগলে রেখেছে, ভালোবেসেছে। রিতু নিজেও বড় বোনকে মায়ের মতো ভালোবাসে। সেজন্যই বোনকে হারিয়ে ফেলার ভয় হলো ওর। দুশ্চিন্তা ও হৃদপিন্ডের ধুকপুকানি এসে ভর করল। ইফাদ ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ওকে ভরসা দিলো,
— চিন্তা করো না একদম। সব ঠিক হবে।
রিতু ভীতু আর ছলছল কন্ঠে বলল,
— আপুর কিছু হবে না তো?
ইফাদ ওকে ভরসা দিয়ে বলল,
— ধুর বোকা! কী হবে? কিছুই হবে না। আল্লাহ ভরসা!

রিতুর মনের ভয় তবুও কমল না। কোনোমতে তৈরি হলো। হসপিটালে পৌঁছাতে ওদের আধঘন্টা সময় লাগল। ততক্ষণে ইশিতাকে ওটিতে নেওয়া হয়ে গেছে। সবার মুখ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। টুইন বেবি হবে। এজন্য চিন্তাটাও বেশি। ইশিতার শ্বাশুড়ি রাহেলা খাতুন করিডোরের চেয়ারে বসে দোয়া-দরুদ পড়ছেন। এজাজ আর বাবুল মিয়া ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলছে, ছুটাছুটি করছে। দুই ব্যাগ বি-পজেটিভ রক্তের প্রয়োজন পড়ল। তৌফর বন্ধুরা তা যোগাড় করে দিলো। পুরোটা সময় রিতু ইফাদের হাত ধরে বসে রইল।

সময় গড়াল ঘন্টাখানিক। ইশিতা জমজ বাচ্চার মা হয়েছে। এক ছেলে, এক মেয়ে। মা ও সন্তান সকলেই সুস্থ আছে। তবে ইশিতার এখনো জ্ঞান ফেরেনি। অতি শ্রীঘ্রই ফিরবে। খবর শুনে সকলের মনে স্বস্তি ফিরে এলো। ইশিতার স্বামী এজাজ রুমাল দিয়ে চোখের কোণা মুছে নিল। রাহেলা খাতুন শুকরিয়া আদায় করলেন। কিছুক্ষণ পর দু’জন নার্স কোলে করে বাচ্চাদের নিয়ে এলো। এজাজ আগে দু’জনকে কোলে নিলো। বিয়ের এতগুলো বছর ধরে সে এই দিনটারই অপেক্ষা করে গেছে। উপরে উপরে ইশিতাকে বাচ্চার জন্য পাগলামি করায় ধমকালেও সে মনে মনে নিজের বাচ্চা নিয়ে স্বপ্ন বুনে রেখেছিল। এতবছর পর সেই স্বপ্নগুলো সত্যি রুপে ধরা দেওয়ায় এজাজের খুশির অন্ত নেই। ইচ্ছে করছে ইশিতাকে পুরো পৃথিবীটা লিখে দিতে ওকে এই ছোট্ট দুইটা কিউট বাচ্চা উপহার দেওয়ার জন্য। এতক্ষণ ভেতরে ভেতরে সে বড্ড ভীতু হয়ে পড়েছিল। নিজের নার্ভাসনেস কমানোর জন্য সে শান্ত ছিল, কাজে ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করছিল। স্ত্রী-সন্তানকে ভালো দেখে সে এবার সে চিন্তামুক্ত। বাচ্চাদের কোলে নিয়ে পলকহীন মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেই যাচ্ছে। বুকের ভেতর প্রশান্তির ছোঁয়ায় তার হৃদয়, কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেছে। বাবা হওয়ার অনুভূতি এজন্যই বোধহয় সবচেয়ে সুখের। এটাই বুঝি পুরুষের জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম সফলতা। এজাজ যখন সন্তান সুখে উৎফুল্ল তখনি ওর মা রাহেলা খাতুন এসে খুশিতে ডগমগ হয়ে চোখভরা পানি নিয়ে বললেন,
— দেখি কই, আমার নাতনিডা কই! কার মতো হইছে!
এজাজ হেসে বলল,
— ইশিতার মতো।
রাহেলা খাতুন কিছুক্ষণ নাতনিকে ভালোভাবে পরখ করে বললেন,
— আরে না! দেখ ওয় তোর মতো হইছে। নাক আর কপালডা পুরাই তোর কপি-পেস্ট।
এজাজ মেয়েকে আবারও পরখ করল। তার চোখে এমন কিছুই ধরা পড়ল না৷ বরংচ ইশিতার মুখচ্ছবির প্রতিফলনই তার ছোট্ট কন্যার মুখে দেখতে পেল।
সে কপাল কুঁচকে বলল,
— ভালো কইরা দেখেন আম্মা। ও পুরোই ইশিতার মতো। চোখ, নাক, ঠোঁট, কপাল। সব।
দুলাভাইয়ের চেহারা দেখে রিতুর হাসি পাচ্ছে। বেচারা ভালোই কনফিউশনে পড়ে গেছে। রাহেলা খাতুন ছেলের মুখের দিকে চেয়ে তাকিয়ে রইলেন কতক্ষণ। ছেলের কথা শুনে তারও হাসি পাচ্ছে। তার বৌমা যে এতগুলো বছর একটা বাচ্চার জন্য তার ছেলের কাছে কত ধর্ণা দিয়েছে তা তিনি জানেন। এ নিয়ে ছেলের সাথে তারও কম কথা কাটাকাটি হয়নি! কিন্তু মা বা ইশিতা কারোর কথাই সে কানে তুলেনি। এ নিয়ে ছেলের প্রতি অভিমান ছিল তার, কিন্তু নাতি-নাতনি দুটোর দিকে চেয়ে তার সব রাগ দূর হয়ে গেছে। তিনি ছেলেকে হেসে বললেন,
— মনে হয় তোগো দুইজনেরই চেহারা পাইছে। তোরা দুইডা তো পাগল৷ ছ’বছর আগের কাজ ছ’বছর পরে করছস। আমার নাতি-নাতনি তেমন না হইলেই হয়।
রিতু রাহেলা খাতুনের কথায় সায় জানিয়ে বলল,
— ঠিক ঠিক। এরজন্য আপনার শাস্তি পাওয়া উচিৎ। কিন্তু আমার বাচ্চাগুলোর জন্য আপনি পার পেয়ে গেলেন দুলাভাই।
এজাজ মা আর শালীর কথায় বিব্রত হলো, লজ্জা পেল। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বাবুল মিয়ার কাছে গেল৷ তোয়ালেতে মোড়ানো ছোট্ট পুত্র সন্তানটিকে দেখে সে কিছুক্ষণ থমকে রইল। এই ছেলেটাও দেখি ইশিতার মতোই দেখতে হয়েছে!
বাবুল মিয়া গদগদ কন্ঠে এজাজকে বললেন,
— বুঝলা জামাই, আমার নাতিডা এক্কেবারে তোমার মতো হইছে। অহন বুদ্ধিডাও তোমার মতোন হইলেই হইছে। আমার নাতিরে আমি ডাক্তার বানামু।
এজাজ হাসল শ্বশুরের কথা শুনে। শ্বশুরের চোখ কি গেল নাকি? এই ছেলে মোটেও তার মতো হয়নি। বোনের মতো সেও ইশিতার সুন্দর, মায়াবী চেহারা পেয়েছে। ছেলেকে কোলে নিয়ে গালে, কপালে চুমু খেল এজাজ। তখনি সে হাতের নিচে ভেজা কিছু অনুভব করল। তোয়ালেটা আলতো করে সরাতেই বুঝতে পারল তার ঘন্টাখানিক আগে ভূমিষ্ঠ হওয়া ছেলে প্রথম জলত্যাগটা করেছে তার বাবার কোলেই। এজাজ তার মায়ের দিকে হতাশ মুখে তাকাল। রিতু-ইফাদ, রাহেলা খাতুন, নাজিয়া ইসলাম সহ করিডোরে থাকা সকলেই হেসে ওঠল। দু’জন নার্স এসে বাচ্চাদের নিয়ে বেবি কেয়ারে চলে গেল। বাবুল মিয়া ছুটলেন মিষ্টি আনতে। ইফাদ সব দেখে, বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে উদাস ভঙ্গিতে বসে রইল। বাবা হওয়ার মতো এমন মিষ্টি সুখ সে কবে পাবে? একফাঁকে রিতুকে সে ফিসফিস করে বলল,
— আমার লোভ হচ্ছে রিতু। আমারো এমন অনেকগুলো কিউটিপাই চাই…
রিতু লজ্জা পেয়ে কনুই দিয়ে মা’রলো ওকে। ইফাদ শব্দহীন হাসল। এক হাতে আগলে নিল রিতুকে।

.

সময় পেরুলো আরো কিছুদিন। নভেম্বর মাস। শীতের প্রকোপ শুরু হয়ে গেছে। গতবারের তুলনায় এবার একটু আগেই শীতের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। সবুজ গাছগাছালি বিবর্ণ রুপ ধারণ করেছে। তরতাজা পাতাগুলো শুকিয়ে গাছের ডালে মিশে আছে। ম্লান আকাশ। পাখিদের উড়াউড়িও তেমন একটা চোখে পড়ে না। ইফাদ বিছানায় বসে ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে একটা ডকুমেন্ট পড়ছে। তার বাহুডোরেই রিতু শুয়ে আছে গাল ফুলিয়ে। গাল ফোলানোর কারণ রিতুর আজ বাবার বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু যেতে পারেনি। তার কারণ ইফাদ। শেষ মুহূর্তে এসে সে অসুখ বাঁধিয়েছে। আর এ অবস্থায় রিতু কিছুতেই বাবার বাড়ি গিয়ে শান্তি পাবে না। তাই রিতুর মন খারাপ। মনে হচ্ছে ইফাদ ইচ্ছাকৃতভাবে টাবের বরফ ঠান্ডা পানিতে ডুবে জ্বর-ঠান্ডা বাঁধিয়েছে। কারণ রিতুর বাড়ি যাওয়ার খুব শোনার পর থেকেই ইফাদ মুখ ফুলিয়ে বসেছিল। মুখে না করেনি তবে মনে মনে যে সে চায়নি রিতু খুব ভালো করে সেটাও ইফাদ মিনমিন করে স্বীকার করেছে। একা ঘরে সে নাকি থাকতে পারবে না। রাতে নাকি ওর খুব ভয় হয়, কষ্ট হয়। শুনে রিতু হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। ওর বাড়ি যাওয়াটা আটকে দিয়ে এই লোক দিব্যি ল্যাপটপে ডুবে আছে। রাগে-ক্ষোভ রিতুর কান্না পাচ্ছে। ইচ্ছে করলেই সে যেতে পারে। কিন্তু সেটাও পারছে না এই লোকের জ্বর-ঠান্ডার জন্য। থাকতে পারবে না চিন্তা নিয়ে। সব মিলিয়ে রিতুর যাওয়ার ইচ্ছেটাই মরে গেছে। এক সপ্তাহ থাকার কথা ছিল ওর। কিন্তু এখন সবেতে গুঁড়ে বালি। ইফাদ ডকুমেন্ট পড়া শেষ করে ল্যাপটপটা কোলে রেখেই ম্লান স্বরে জিজ্ঞেস করল,
— তুমি কী রেগে আছ আমার উপর? বিশ্বাস করো আমিও বুঝতে পারছি না কীভাবে এত জ্বর হয়ে গেল। আমার জন্য অহেতুক তুমি আটকে গেলে!
রিতু ওর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে হাত দিয়ে কপাল, মুখ চেক করে বলল,
— বিদেশেও কি সারাবছর আপনি জ্বরে ভুগতেন?
ইফাদ তাড়াহুড়ো করে বলল,
— না না। মাঝেমাঝে হতো, নরমাল।
— তাহলে?
ইফাদ টিস্যু দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে বলল,
— আসলে যখন একটু টেনশন হয় তখনই আরকি! অনেকটা মনস্তাত্ত্বিক বলতে পারো। মনের চাপ শরীরে পড়ে…
রিতু হতাশ চোখে তাকাল।
— আমি বাপের বাড়ি বেড়াতে যাব এখানে আপনার
চাপ নেওয়ার কী আছে? হ্যাঁ, টেনশন এক-আধটু সবার হয়। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে অসুখ বাঁধিয়ে বিছানায় পড়া! জীবনে শুনিনি এমন কিছু! আপনাকেই প্রথম দেখলাম৷ এখন তো দেখছি আমি আপনাকে ছাড়া এক রাতের জন্যও কোথাও যেতে পারব না। এ কেমন আজব রোগ?
ইফাদ অপরাধীর ন্যায় চোখ নিচু করল,
— সরি।
রিতু দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দিল।
— কীভাবে আপনার অদ্ভুত এই মনোরোগ সারবে সেই সমাধান খুঁজুন!
— তুমি খুঁজে দাও না…
রিতু চোখ বড়বড় করে তাকাল,
— আমি কীভাবে খুঁজব?
ইফাদ আবদারের সুরে বলল,
–একটু আদর করে, চুমু খেয়ে আমার জ্বর নামিয়ে দাও।
রিতু সবটাই বুঝতে পারল। হাসি পেল ওর। তবে না বোঝার ভান করে বলল,
— অদ্ভুত! বাপের জন্মে শুনিনি চুমু খেলে জ্বর নেমে যায়? তখন তো জ্বরের ভাইরাস আমাকে আক্রমণ করবে। কীসব উল্টাপাল্টা কথা যে বলেন আপনি!
জ্বর হয়ে মাথা গেছে। মাকে জানাতে হবে যে, মা আপনার বিদেশফেরত গুণধর পুত্রের মাথার ঠিক
নেই। জলদি ব্যবস্থা নিন।
ইফাদ বিস্মিত হয়ে ওর কথা শুনলেও শেষের কথাগুলো শুনে রেগে গেল। ওর চাওয়া বুঝতে পারছে না রিতু? নাকি বুঝেই এ সমস্ত উল্টাপাল্টা কথা বলছে? ও চট করে ঠোঁট চেপে ধরল রিতুর ঠোঁটে। রিতুও কম যায় না। কামড় বসিয়ে দিলো। ইফাদ ব্যথা পেয়ে ছিটকে সরে গেল। চোখমুখ কুঁচকে আঙুল দিয়ে ঠোঁট ঘসতে ঘসতে বলল,
— জ্বরে কাহিল আমি। এরপরেও কামড় বসিয়ে দিলে?বেয়াদব মেয়ে আমার ঠোঁট কেটে ফেলেছ!
রিতু ততক্ষণে উঠে বসে নিজের জামাকাপড় ঠিকঠাক করছে। মুখ বাঁকিয়ে বলল,
— জ্বর শরীরে অসুরের মতো শক্তি নিয়ে চেপে ধরেছিলেন। আবার আমাকে বলছেন বেয়াদব! দেখি কে আবার এই বেয়াদবের কাছে ঘেঁষে। হুহ! যাচ্ছি…
ইফাদ ব্যথা নিয়ে ভোঁতা স্বরে চেঁচিয়ে ওঠল,
— যাও যাও। বয়েই গেছে আমার তোমার কাছে ঘেঁষতে…
— হুহ! রিতু ছাড়া তো চলেই না, আবার বড় বড় কথা! কথাগুলো মনে থাকলেই খুশি হব।
রিতু ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে কথাগুলো বলে গেল। ইফাদ না শোনার ভান করে ঠোঁটে আঙুল
বুলাতে লাগল। এসব কথা-কাটাকাটি মনে রাখতে ওর বয়েই গেছে! একশো বার কাছে ঘেঁষবে। কী করবে রিতু? ভালোবাসা ছাড়া?

এরপরের তিনদিন ইফাদকে সত্যিই এড়িয়ে চলল রিতু। এ তিনদিনে অবশ্য চমকপ্রদ একটা ব্যাপার ঘটে গেল। যেটা রিতু বাড়ির সবাইকে জানাল, ইফাদকে ছাড়া। চতুর্থদিন রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় অভিমানী রিতুকে টেনেটুনে নিজের বুকে এনে ফেলল ইফাদ। নিজের থেকে আকারে-শক্তিতে বেশি ইফাদের থেকে রিতু নিজেকে ছাড়াতে পারল না। ইফাদ ওকে সাপের মতো আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ওর হাত কপালে ঠেকিয়ে বলল,
— দেখো জ্বর বেড়েছে। দেখো না…
রিতু হাত কপাল থেকে হাত না সরিয়েই গরম স্বরে বলল,
— আমি দেখব কেন? আমি তো বেয়াদব।
ইফাদের তীক্ষ্ণ স্বর,
— ঠোঁট কামড়ে দিয়েছিলে তো বেয়াদবই তুমি। সব কথার শেষ কথা, এই বেয়াদব বউকেই চাই আমি।
— হুহ ঢঙ!
— আচ্ছা বাবা আমিই সরি বলছি৷
রিতুর আরকিছু বলল না। ইফাদের উষ্ণতা অনুভব করে শান্ত হয়ে করে মিশে গেল। ওর গালে আঁকিবুঁকি করতে করতে অনেক কথাই বলতে লাগল ইফাদ। রাগ ভুলে রিতু শুধু ‘হু, হা’ করে ওর কথায় তাল মেলাচ্ছে৷ সময় পেরুল। ইফাদ হাবিজাবি অনেক কিছু বলার পর একসময় বলল ,
–আমাদের হিকুপিকু কবে আসবে! বয়স তো হয়েছে। এর বেশি দেরি করলে বাচ্চারা আমাকে মামা-দাদু ডাকা শুরু করবে। নিজের বাচ্চার মুখে আমি একদম ওসব ডাক শুনতে চাই না। এ পর্যায়ে রিতুর জবাব পাওয়া গেল না। ইফাদ আঁকিবুঁকি থামিয়ে মাথাটা একটু উঁচু করতে
করতে বলল,
— চুপ কেন? রাগ কমেনি? কিছু তো…
কথা শেষ হওয়ার আগেই ইফাদ দেখল রিতুর চোখ বন্ধ। দেখে মনে হচ্ছে ঘুমে বিভোর। ব্যাপার কী চেক করতে গিয়ে দেখল রক্তিম হয়ে আছে রিতুর কান, গাল। খটকা লাগল ওর। রিতুর গালে টোকা দিতেই আরও গুটিশুটি মেরে গেল মেয়েটা। ইফাদের মাথায় শয়তানি বুদ্ধি এলো। রিতুর হাত-পায়ের তালুতে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করল। লাফিয়ে উঠে বসল রিতু। তোতলানো স্বরে বলল,
— ফাজিল লোক। কী করছিলেন!
ইফাদ কিছু জানি না এমন ভান করে বলল,
— চেক করছিলাম ঘুমিয়েছ কি-না!
রিতু গাল ফুলিয়ে বলল,
— বড্ড জ্বালান আপনি। ইনোসেন্ট চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়ান আসলে আপনি একটা বদের হাড্ডি।
ইফাদ গম্ভীরমুখে বলল,
— বেশি জ্বালাই? তিনদিন কিন্তু সুযোগ দাওনি।
— বেশ করেছি।
ইফাদ ওর রাগ দেখে গাল টেনে বলল,
— আমি বলেই এত ভালোবাসছি, অন্যকেউ হলে ঘাড় ধরে বাপের বাড়ি রেখে আসতো। তুমি আমাকে আমার চেয়েও বেশি জ্বালাও। কয়লা বানিয়ে দাও প্রতিবার! তবুও আমি তোমাকেই ভালোবাসি, বাসব।

ইফাদ অভিমানী গলায় বলল। রিতু চোখ ছোট করে অন্যরকম দৃষ্টিতে দেখল ওর অংক স্যারকে। আসলেই! বিয়ের এতগুলো বছর পার হওয়ার পরেও এ লোকটাকে কারণে-অকারণে জ্বালানো ছাড়েনি ও। অন্যকেউ হলে ওর এসব ঢঙ বেশিদিন সহ্য করতো না। অথচ ইফাদ! প্যাঁচগোচহীন আস্ত একটা ভালোবাসাময় মানুষ। যে রিতুর কাছে প্রতিবার ইচ্ছে করে, জেনে-বুঝেই হেরে যায়। যে মানুষটা ওর প্রতিটা কথা আমলে নেয়, রাগ-অভিমান দূর করে দেয় নিমিষেই। এইযে, গত তিনদিন যাবৎ এই লোকটার কাছ থেকে বাবা হওয়ার সুন্দর সংবাদটি লুকিয়ে রেখেছে! জানে রিতু, ইফাদ তবুও ওর প্রতি রাগ দেখাতে পারবে না। এতবেশি ভালোবাসে রিতু মানুষটাকে, অথচ কখনো বোঝাতে পারেনি। এই মানুষটাকে ভালোবেসে ও যে সুখ পেয়েছে যায় তার সাথে অন্য কোনো সুখের তুলনা চলে না। আর ধোঁয়াশায় রাখা ঠিক হবে না বেচারা হবু বাবাকে। মায়া হলো রিতুর। ওর অন্যরকম দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকাটা ইফাদও লক্ষ্য করল। ভ্রু সোজা করে কাছে টেনে বলল,
— চলো না, নিয়ে ফেলি।
রিতু বুঝেও না বোঝার ভান করল। ইফাদের অধৈর্য
গলার স্বর,
— বেবি। চেয়েছিলে না তুমি?
প্রতিক্রিয়াস্বরুপ রিতু ওর হাত টেনে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল। এরপর ধীরেধীরে নিজের পেটের উপর হাত রেখে বলল,
— সরি। বাবা হওয়ার খবরটা আপনি এখনো পাননি…
ইফাদ হতভম্ব হলো। চমকাল। রিতুর মুখ থেকে নজর সরিয়ে পেটের উপর রাখা হাতটাতে দৃষ্টি দিলো। নিজেকেই বলল,
— আমি কি কানে ভুল শুনলাম? বাবা হব? আমি?
রিতু হাসিতে ফেটে পড়ল ভেতরে ভেতরে। ইফাদের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকাটা বেশ লাগল ওর। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,
— ট্রাস্ট মি, ইফাদ আনিসুর। আপনি বাবা হবেন!
খুব বড় একটা চমক! যে চমকের জন্য ইফাদ তখনো প্রস্তুত ছিল না, যে স্বপ্ন এত দ্রুত বাস্তবায়িত হবে ভাবেনি, সেই চমক পেয়ে কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল ও।
এরপর বিস্ময় ভুলে এমনভাবে জড়িয়ে ধরল
রিতুকে, যে ও খানিকটা ভড়কে গেল। ইফাদ স্তব্ধ, অপ্রস্তুত, এলোমেলো স্বরে বলল,
— অ্যাই মেয়ে? রিতু? আমি কী বলব? কিছু তো বুঝতে পারছি না! মাথায় আসছে না! কান্না পাচ্ছে। ওয়েট ওয়েট! বাড়ির সবাইকে খবরটা জানিয়ে আসব আগে?
রিতু ওকে চমকে দিয়ে বলল,
— সবাই জানে। আপনি বাদে।
ইফাদ থম মেরে গেল। রিতু হেসে বলল,
— সারপ্রাইজ! আপনি যেমন আমাকে দেন, বাড়ির
সবাইকে দেন!
ইফাদ নিজের ভেতরের ঝড়টা কাউকে দেখাতে পারছে না৷ এত খুশি ও জীবনে হয়নি। বাবা হবে সে? আর এই পৃথিবী সেরা খবরটা রিতু ওর থেকে লুকিয়েছে? নাহ! এর কোনো ক্ষমা হবে না। একদম না। ও তক্ষুণি রিতুকে তার শাস্তি দিয়ে দিলো। বরাবরের মতোই শক্ত করে চেপে ধরে চুমু খেল রিতুর গালে। পেটে ঠোঁট ছুঁইয়ে, কান পেতে অনেকক্ষণ বসে রইল। বিড়বিড় করে কিছু বলল নিজের অনাগত বাচ্চাকে। যেগুলো রিতুর কানে আসছে না। ইফাদের খুশি দেখে মনের ভেতর অদ্ভুত সুখ ডালা মেলে উড়ছে রিতুর। ও শুধু ইফাদের পাগলামি দেখে হাসছে। হাসতে হাসতে ওর চোখে জল চলে এসেছে। বাইরে শীতল বাতাস। অর্ধ বাঁকা চাঁদ আলো ফেলছিল আঁধারের চাদরে মোড়ানো পৃথিবীতে। রিতু চোখ বুজল। প্রশান্তির শ্বাস ফেলল। এরপর গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ওর অপ্রিয় থেকে প্রিয় হয়ে উঠা প্রিয়তম মানুষটার পানে।

____________সমাপ্ত