#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২১
জীবন বদলায়। মানুষ বদলায়। একসময়ের অকৃত্রিম ভালোবাসাও একটা সময় এসে অকিঞ্চিৎকর হয়ে পড়ে। সুমনার মত কতশত নারী মুখে কুলুপ এঁটে পড়ে থাকে। তারা চিৎকার করতে চায়। ভয় হয় সমাজের। চিৎকার আটকাতে তারা কামড়ে ধরে নিজ হাত। চোখের অশ্রু আটকাতে বারবার পানি ছিটিয়ে দেয় নিজ মুখে। আ ঘা তে আ ঘা তে জর্জরিত হয়ে উঠে তাদের মন। কোনো এক দিন ডাক আসে ওপাড়ের। মনে চাপা কষ্ট নিয়েই পাড়ি জমায় না ফেরার দেশে। এই পৃথিবীতে সুমনার আপন কেউ নেই। যারা ছিলো তাদের সাথে সেই কবেই সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। সেখানেও ফিরে যেতে পারবেনা। ইদানীং আত্মসম্মানবোধটা বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তার। আপাতত সে নদীর পাড়ে বসে আছে। মেঘনা আজ বেশ উত্তাল। কোনো কারণ ছাড়াই উত্তাল। হিসেব কষছে সুমনা। কোথায় যাওয়া যায়! স্টেশন থেকে ঢাকা এয়ারপোর্টের ট্রেন ছাড়বে সন্ধ্যার দিকে। ঢাকা চলে যাবে কি! সর্বপ্রথম ডিভোর্সের ব্যাপারে একজন ভালো উকিলের সাথে কথা বলতে হবে। সুমনা চাচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব সম্পর্কটা হতে বের হতে। উঠে দাঁড়ায় সুমনা। তার পরিচিত একজন মহিলা উকিল রয়েছেন। বাজির মোড়ে বসেন। দেখা যাক কথা বলে। হাতে যথেষ্ট টাকা আছে। এই টাকাগুলো একান্তই তার। আর কিছু গহনাও আছে।
শাহবাজ বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরেছে। প্রিয়াঞ্জনা অধীর আগ্রহে বসেছিলো তার শাহ্ এর জন্য। বেশ ক্লান্ত লাগছিলো শাহ্কে। বিছানায় বসে শার্টের বোতাম খুলছে সে। প্রিয়াঞ্জনা লেবুর শরবত নিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়ে আছে। শাহ্ চোখ তুলে তার পানে চায়। হাত বাড়িয়ে শরবত নিয়ে এক নিমিষেই খালি করে ফেলে গ্লাস।
“ফ্রেশ হয়ে আসুন। ভাত দিচ্ছি।”
“আচ্ছা”
খাওয়া দাওয়া সেরে গল্প করতে বসে দুজনে। খোলা বারান্দা। পাশাপাশি বেতের সোফা রাখা। সোফায় বসলে স্পষ্ট আকাশ দেখা যায়। আজ পূর্ণিমা। বাইরে জোৎস্নার আলো সর্বত্র। প্রিয়াঞ্জনা শুধায়,
“চা বসিয়েছিলাম। নিয়ে আসি?”
“যাও”
প্রিয়াঞ্জনা চা নিয়ে এলো। চাঁদের আলোয় ছাদ আলোকিত হয়ে আছে। মাতাল হাওয়া বইছে চারপাশে।
“কেমন কাটলো আপনার প্রথম ক্লাস?”
“ভালো। তবে আজকালকার ছেলে-মেয়েরা কি যে ইঁচড়েপাকা হয়েছে!”
“কেন কি হয়েছে?”
আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে প্রিয়াঞ্জনা।
“থাক সেসব কথা। এখন বলো কি কি করলে সারাদিন?”
উদাস নয়নে চায়ে চুমুক দেয় প্রিয়াঞ্জনা। ঝকঝকে চাঁদের পানে তাকিয়ে বলে,
“কত কি করলাম। বই পড়েছি, বাড়িওয়ালা চাচি আর উনার মেঝো মেয়ের সাথে গল্প করেছি। রান্না-বান্না করলাম। জানেন কি হয়েছে আজকে?”
“কি?”
“বাড়িওয়ালি চাচির ছোট মেয়ে আমাকে ছাদে দেখে দৌড়ে নিচে চলে গেলো। আমি নাকি ভূত!”
শাহ্, প্রিয়াঞ্জনার গালে আঙুল ছুঁইয়ে বললো,
“ভূত না পরী। আমার পরী।”
“আপনার পরী গান শুনতে চায়। একটা গান শুনান না শাহ্।”
আবদার করে প্রিয়াঞ্জনা। শাহবাজ হাসে। খোলা কন্ঠে গেয়ে উঠে,
“সেই রাতে রাত ছিল পূর্ণিমা
রঙ ছিল ফাল্গুনি হাওয়াতে….
গানের তালে তালে চায়ে চুমুক দিচ্ছে প্রিয়াঞ্জনা। চা, গান, ভালোবাসার মানুষ। প্রিয়াঞ্জনা তাকায় তার শাহ্ এর পানে। জীবন বদলায় তবে মানুষ কি সত্যিই বদলায়? হয়তো কিছু ক্ষেত্রে বদলায়। যার মানুষটা বদলায় না তারা হয়তো সুখীদের দলে পড়ে। প্রিয়াঞ্জনা পৃথিবীতে থাকা সেই সুখী মানুষগুলোর মধ্যেই একজন।
পূর্ণিমা রাতে নাদিয়া ছাদে হেঁটে বেড়ায়। দু’হাত মেলে গাঁয়ে ছুঁয়ায় চাঁদের আলো। দাদি বলতেন এতে নাকি চেহারাও চাঁদের আলোর মতো হয়ে যায়। গোলাপগাছগুলো তো তার পথ চেয়ে আছে। যদিও নাদিয়ার মনটা আজ ভিষণ খারাপ। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার সময় মোহনীয় কন্ঠস্বর কানে আসে।
“রাত আসে রাত চলে যায় দূরে
সেই স্মৃতি ভুলতে কি আজ পারি….
আবারও বুকে চাপা কষ্ট অনুভব করে নাদিয়া। বসে পড়ে সিঁড়িতে। এত অল্প পরিচয়ে কি করে লোকটা তার সমস্ত অন্তর দখল করে নিয়েছে। কি করে? নিজের প্রতি কিঞ্চিৎ ঘৃণা আসে তার। আবার পরক্ষণেই ভাবে ভালোবাসা তো খারাপ কিছু না। অনেকেই তো দুই বিয়ে করে। ভালোবাসা তো ভাগাভাগি করেও নেওয়া যায়। নাজমা ডাক লাগালেন নাদিয়াকে। নেশা ধরানো কন্ঠ ছেড়ে উঠতে মন চাচ্ছিলো না। তাও উঠে গেলো বাবা-মায়ের ঘরে। বদরুজ্জামান সাহেব ল্যাপটপ হাতে বসে আছেন।
“তুমি পদার্থবিজ্ঞানে ফেল করেছো নাদিয়া।”
গম্ভীর কন্ঠে বললেন বদরুজ্জামান সাহেব। তিনি যে অত্যধিক রেগে আছেন তা তার কন্ঠেই স্পষ্ট। নাদিয়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সাইন্স নিয়ে তো সে পড়তে চায়নি। এসএসসি এরপর আর্টস নিয়ে পড়তে চেয়েছিলো। বাবা-মাই তো তাকে জোর করে সাইন্সে দিলো। ভালো স্টুডেন্টরা নাকি সাইন্সে পড়ে। তাছাড়া জিপিএ ফাইভ পেয়ে সে আর্টসে পড়বে তা তার বাবা কোনো মতেই মেনে নিচ্ছিলেন না।
“কি হলো কথা বলছো না কেন?”
হুংকার দিয়ে উঠলেন বদরুজ্জামান। কেঁপে উঠে নাদিয়া। বাবা এমনিতে অনেক আদর করে তাকে। তবে রেজাল্ট খারাপ করলে অনেক বকা দেয়।
“আমি কলেজের শিক্ষক। সবুজ স্যার যখন টিচার্স রুমে সবার সামনে বললেন নাদিয়া পদার্থ বিজ্ঞানে ফেল করেছে। তখন কতটা লজ্জা পেয়েছিলাম সে জ্ঞান আছে তোমার?”
“প্রাইভেট পড়েও এ হাল নাদিয়া?”
নাজমার প্রশ্নেও উত্তর দেয়নি নাদিয়া। পদার্থবিজ্ঞান বিষয়টা তার মাথায় ঢুকে না। এটা কি তার দোষ?
“নাজমা তোমার মেয়েকে বলে দাও আগামীকাল থেকে সে শাহবাজের কাছে পদার্থ বিজ্ঞান প্রাইভেট পড়বে। ছেলেটা অনেক ভালো পড়ায়। আজ প্রথম ক্লাস ছিলো তার। খুবই ভালো পড়িয়েছে। শিক্ষার্থীরা নাকি বেশ প্রশংসা করেছে। আমি কথা বলেছি ওর সাথে। তিনদিন বিকেলে সময় দিবে।”
সকল মন খারাপ দূর হয়ে গেলো নিমিষেই। নাদিয়ার মনে উড়ে বেড়াচ্ছে শত শত প্রজাপতি। বাবা বকেছিলো বলে চোখে পানি চলে এসেছিলো তার। এখন, আহা! আকাশে উড়তে ইচ্ছে করছে।
সুমনা বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ায় কারো মধ্যেই তেমন বিচলিত মনোভাব পরিলক্ষিত হলো না। এ যেন হবারই ছিলো। প্রীতির অবশ্য অনেক খারাপ লাগছে। একা একা লাগছে। তার ভালো বন্ধু বলতেই কেবল ছিলো দুজন সুমনা ভাবী আর প্রিয়া আপা। দুজনেই বাড়ি ছেড়েছে। নতুন মেয়েটা, হ্যাঁ মেয়েটা। কারণ একে ভাবী বলার ইচ্ছে প্রীতির নেই। কেন জানি একে তেমন পছন্দ হয়নি তার। অন্যের সংসারে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। অথচ কোনো আত্মগ্লানি নেই। তার মাও একে নিয়ে আহ্লাদ করেন। মেয়েটা অনেক সুন্দর। চেহারায় একটা সরলতা ভাব আছে। তবে ভিতরটা কুৎসিত। প্রাপ্তি কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। ঝগড়া লাগেনা। কঠিন কথা শুনায় না। কেবল খাটে ম রার মতো পড়ে থাকে। আগামীকাল শুক্রবার। সকালে ছোট করে হলুদ করা হবে। বাড়িতে লোকজন আসছেন। অনেকে অবশ্য সুমনার কথা জিজ্ঞেস করছে। জোহরা কৌশলে এড়িয়ে যান। তাতে কি আর মানুষ বুঝেনা। চাপা একটা গুঞ্জন তো হয়ই। স্বর্ণার বাড়ন্ত পেটের দিকেও বাঁকা নজরে তাকাচ্ছেন অনেকে। অবাকও হন।
(চলবে)…
#প্রিয়াঞ্জনা, এককাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
#পর্ব-২২
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
বিয়েটা হয়েই গেলো। অনাড়ম্বরভাবে। মায়ের চোখ শাসানো দেখে প্রাপ্তি বুঝতেও পারেনি কখন সে কবুল বলে ফেলেছে। প্রীতি সেখানে উপস্থিত ছিলোনা। তার মন কেমন যেন করছে। তাদের বাসায় দুইটা শিউলি ফুলের গাছ আছে। বিল্ডিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তারা। ‘জমজ গাছ’ বলে পাড়ার লোকে। প্রাপ্তি, প্রীতির বয়স আর গাছ দুটোর বয়স একই। ফুলে ফুলে মুখরিত হয়ে থাকতো দুটো গাছ। সবুজ পাতার মাঝে কমলা আর সাদা ফুলগুলো যেন অজানা কল্লোলে মেতে উঠতো। সু ঘ্রাণে ভরিয়ে তুলতো চারপাশ। গতকাল রাতে মন খারাপ করে হাঁটছিলো প্রীতি। মা যা করছেন তা অন্যায়। সেও বুঝতে পারছে। তবে প্রতিবাদ করা নিছকই বোকামি। তখনই প্রীতি দেখে একটি শিউলি গাছ কেমন নেতিয়ে পড়েছে। পাতাগুলো নির্জীব হয়ে আছে। সেই অজানা কল্লোলও তার নেই। ছেৎ করে উঠে প্রীতির অন্তর। তবে কি এটা কোনো অশনি সংকেত? মন খারাপ বেশি করে জাপটে ধরে তাকে। কেবল ঠোঁট আওড়ে বলে,
“মা ভুল করছো। বড় ভুল করছো।”
তারপর রাত পেরিয়ে ভোর আসে। ভানু তার প্রতাপ বিস্তার করে আসমানে। নীল আর লালের মিশ্র খেলা দেখা যায়। স্বর্ণা মহা উৎসাহে হলুদের শাড়ি পরিয়ে দেয় প্রাপ্তিকে। হলুদ ছোঁয়ানো হয়। ছাদের একপাশে রমণীরা হাসাহাসি করে। মশকরা, টিটকারি করে। প্রাপ্তির ছোট প্রাণ যেন নিষ্প্রাণ। কলসি ভরে পানি ঢালা হয়। একসময় পরানো হয় লাল শাড়ি। তারপর?
তারপর বিয়েটা হয়ে যায়। কাকেরা কা কা করছিলো বাইরে। ফাহিমের মুখে বিস্তৃত হাসি। খাওয়া দাওয়া শেষে বিদায়ের পালা। প্রাপ্তি কান্না করেনি। কেবল মূর্তির মত দাঁড়িয়ে ছিলো। প্রীতি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছে। সে বুঝতে পারছে তাদের ঘরটা খালি হয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে সবাই চলে যাচ্ছে। প্রাপ্তি মায়ের পানে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে,’আমি তো তোমার সব কথা শুনতাম মা। আমার সাথে কেন এমন করলে তুমি?’ মুখ ফুটে কিছু বলেনা। গাড়িতে উঠে বসে। ফাহিম তার হাত ধরে৷ একটু শক্ত করেই ধরে। অজানা একটা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায় প্রাপ্তি। নরসিংদী শহরের দশ তালা উঁচু এক ভবনের সামনে গাড়ি থামে। ফাহিমের মা প্রাপ্তিকে গাড়ি থেকে বের করেন। লিফটে ওঠে তারা। ফাহিমদের সকল আত্মীয় স্বজন বিদেশে থাকে। বরযাত্রী বলতে তেমন কেউ ছিলোনা। ফাহিমের কিছু বন্ধু আর দুয়েকজন আত্মীয়। তারা প্রস্থান করেছে। ফ্ল্যাটটি খুবই বিলাসবহুল। রীতিনীতি শেষ করে ফাহিমের ঘরে বসিয়ে রেখে যাওয়া হয় প্রাপ্তিকে। ছোট মেয়েটা ভয়ে, শঙ্কায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ঘরে প্রবেশ করে ফাহিম। প্রাপ্তিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। প্রাপ্তি স্তব্ধ হয়ে যায়। কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে? আদোও কি তার সাথে এসব হওয়ার ছিলো? একসময় তীব্র ব্যথায় চিৎকার করে উঠে প্রাপ্তি। অনেক চিৎকার করে। কিভাবে অনুভূতি ব্যক্ত করা যায় প্রাপ্তির জানা নেই। তবে মনে হচ্ছে সিংহ শরীর থেকে এক থাবা মাংস নিয়ে গেলে যেমন লাগে তেমন লাগছে প্রাপ্তির। ফাহিম একবারও চিন্তা করেনি মেয়েটা ছোট। বয়স অল্প। সে নিজের কামনা মিটায়। একবার নয় কয়েকবার। মাঝরাতের দিকে অসহ্য যন্ত্রণায় জ্ঞান হারায় প্রাপ্তি। বেশ র ক্ত পাত হয়েছে তার।
মাঝরাতের দিকে ঘুম ভেঙে যায় প্রিয়াঞ্জনার। ধড়মড় করে উঠে বসে। খুব তৃষ্ণা পেয়েছে। কেমন শূন্য লাগছে ভিতরটা। মনটা বড় অস্থির লাগছে। ডান হাত দিয়ে কপালের ঘামটা মুছে নেয়। শাহবাজও সজাগ হয়ে যায়।
“কি হয়েছে প্রিয়াঞ্জনা?”
“জানিনা শাহ্, কেমন অস্থির লাগছে।”
“পানি খাবে?”
“হুম”
শাহবাজ উঠে লাইট জ্বালায়। গ্লাস ভরে পানি এনে দেয় প্রিয়াঞ্জনার হাতে। ঢকঢক করে পানি পান করে প্রিয়াঞ্জনা। হাত,পা কাঁপছে তার। শাহবাজ তা খেয়াল করে। জড়িয়ে ধরে প্রিয়াঞ্জনাকে।
“খুব খারাপ লাগছে?”
“বুঝতে পারছিনা। মনে হচ্ছে আমার যে কষ্ট পাওয়ার কথা তা অন্য কেউ পাচ্ছে।”
কথা জড়িয়ে আসছে প্রিয়াঞ্জনার। শাহবাজ মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় তার। ঘুমিয়ে পড়ে প্রিয়াঞ্জনা।
সকালবেলা প্রিয়াঞ্জনা অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। পরোটা বানাচ্ছে এখন। শাহবাজ কিছুক্ষণ পর কলেজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাবে। নিজে রেডি হওয়ার পাশাপাশি টুকটাক সাহায্য করছে প্রিয়াঞ্জনাকে। সকালবেলা নাস্তা হিসেবে পরোটা আর চা তাদের দুজনেরই খুব পছন্দ।
“একটা টিউশনি পেয়েছি প্রিয়াঞ্জনা।”
পরোটা খেতে খেতে বলে শাহবাজ।
“ভালো খবর? কাকে পড়াবেন?”
“বাড়িওয়ালা চাচার ছোট মেয়ে। নাদিয়াকে।”
“মেয়েটা কি যে দুষ্টু শাহ্! আশেপাশের অনেকে ওর নামে বিচার নিয়ে আসে।”
তারা গল্প করছিলো আর খাচ্ছিলো। গরম চা জিহ্বায় লাগে প্রিয়াঞ্জনার। শাহবাজ ব্যস্ত হয়ে উঠে। ভালোবাসা পেতে সবারই ভালোলাগে। এই যে প্রিয়াঞ্জনার সামান্য ব্যথায়ও শাহবাজ এত ঘাবড়ে যায় এমন কি সবসময় হবে? হুট করেই এমন ভাবনা প্রিয়াঞ্জনার মস্তিষ্কে চলে আসে। অবান্তর! এমন হতেই পারেনা। প্রিয়াঞ্জনা উড়িয়ে দেয় নিজের ভাবনা।
সারাদিন কলেজ শেষে শাহবাজ বাড়ি ফিরে বিকেলে। প্রিয়াঞ্জনা অপেক্ষায় ছিলো। পুকুর পাড়টায় যাওয়ার ইচ্ছে বহুদিনের। শাপলা ফুলের দলেরা যেন হাত বাড়িয়ে ডাকছে তাকে। কি অপূর্ব সুন্দর পুকুরটা। চারদিকে গাছে ঘেরা। মাঝখানে শতবর্ষী পুকুর। ঈষৎ সবুজ টলমল পানিতে ফুটে আছে কতশত শাপলা৷ ছাদ থেকে প্রিয়াঞ্জনা অবাক নয়নে চেয়ে থাকে। কি সুন্দর!
“চলুন শাহ্। আজ পুকুরপাড়ে যাই।”
“চলো। পাঁচটা থেকে নাদিয়াকে পড়াতে যাবো বলে আসছি।”
প্রিয়াঞ্জনা ঘড়িতে দেখে চারটা পঞ্চান্ন বেজে গিয়েছে। এখন গেলেও বেশিক্ষণ বসতে পারবেনা।
“থাক, আজ যাবো না শাহ্। আপনি বরং আজ পড়াতে যান। আমরা কালকে যাবো।”
“ঠিক আছে। তুমিও আমার সাথে নিচে চলো তাহলে৷ চাচির সাথে বসে গল্প করলে।”
“তা যাওয়া যায়। বিথীর সাথে কথা হলো সেদিন। মেয়েটা খুব ভালো। অনার্সে পড়ছে।”
“চাচার মেঝো মেয়ে?”
“হুম”
শাহবাজ ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয় প্রিয়াঞ্জনার কপালে। শুধায়,
“একা একা খারাপ লাগে তোমার? বাড়ির কথা মনে পড়ে?”
প্রিয়াঞ্জনা শাহবাজের বুকে মাথা রেখে বলে,
“না, শাহ্। আপনি সাথে আছেন না আমার। তাছাড়া একা থাকার তো আমার অভ্যাস আছে।”
“তখন সময়টা ভিন্ন ছিলো প্রিয়াঞ্জনা। তুমি ভার্সিটি, পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে। বাড়িতে ফোন করে কথা বলতে পারতে। এখন তো…
থেমে যায় শাহবাজ।
“চাচি সেলাই কাজ পারেন। আমি ভাবছি শিখবো। সময়ও কাটবে? আমি কি শিখবো শাহ্?”
“তোমার যা করতে ভালোলাগবে তাই করবে। আমার পারমিশন লাগবে বোকা মেয়ে!”
শাহবাজের পাল্টা জবাবে মন প্রসন্ন হয়ে উঠে প্রিয়াঞ্জনার। তার শাহ্ আলাদা। সবার চেয়ে আলাদা।
শাহবাজের কাছে মোবাইলে কল আসে। প্রিয়াঞ্জনা নাজমা আর বিথীর সাথে গল্প করছে ড্রয়িং রুমে। শাহবাজ বসে আছে ডাইনিং টেবিলে। নাদিয়া বই, খাতা আনতে গিয়েছে। কল রিসিভ করে শাহবাজ।
“হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। চিনেছেন?”
“জ্বি।”
“ছয়মাস সময় থেকে কিন্তু কিছুদিন মাইনাস হয়ে গেছে। ভাববেন না আপনি শিবপুরে আছেন আমরা জানিনা। টাকা রেডি রাখবেন।”
কল কেটে দেয় আগন্তুক। কয়েকটা দিন তো সুখেই ছিলো শাহবাজ। আবার সেই পিছুটান। টেনশনে মাথার রগ ফুলে উঠে তার। কি হবে ভবিষ্যতে? আড়াই কোটি টাকা! এত টাকা কোথায় পাবে শাহবাজ? তারা যদি কেস করে দেয়? ঝামেলার উপর আরেক ঝামেলার সৃষ্টি হবে। মামাদের কর্মে
বি ষি য়ে উঠে অন্তর। বিশ্বাসঘাতকদের বিচার সৃষ্টিকর্তার হাতে ছেড়ে দেয় শাহবাজ। একটা কথা সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে ভবিষ্যতে বড় কোনো ঝড় আসতে চলেছে।
নাদিয়া বই নিয়ে পাশের একটি চেয়ারে এসে বসে। সাজগোছ করেছে সে। ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক, চোখে গাঢ় করে কাজল। চুল ছেড়ে রাখা। নতুন একটি থ্রি-পিসও পড়েছে। ও বোধহয় জানেনা তার এসব সাজসজ্জা শাহবাজকে একটুও প্রভাবিত করছেনা। শাহবাজ পড়াচ্ছে নিজের মতো করে। একবার ফিরেও তাকাচ্ছে না নাদিয়ার পানে।
(চলবে)…